Friday, November 20, 2020

 ছোটগল্প


ফজিলন বালা

মিলটন রহমান


এক.

পাড়ে নোঙর ফেলে জলসন্তরনের বিপরীতে স্থির হয়ে আছে নৌকাটি।  কোন তাড়া নেই অন্য কোথাও যাওয়ার।  জলের বুকে ব্যস্ত বৈঠা গেঁথে গেঁথে নৌকারা চলে যাচ্ছে গঞ্জে কিংবা অন্য পাড়ে। কেবল এই নৌকাটির অন্য কোন গন্তব্য নেই। এখানেই রোদের সামিয়ানার নীচে থির হয়ে আছে। মাঝে চিৎ হয়ে শুন্য আকাশের সাথে কথা কইছে তরুণ মাঝি আকানূর। চোখের পলক পড়ে না। দ্রুত চলে যাওয়া নৌকার ঠেলে দেয়া ঢেউ আকানূরকে দোলা দিয়ে যায়। তার নৌকা জল কামড়ে থির হয়ে থাকে। অকস্মাত ঘূর্ণির মতো মোচড় দিয়ে ওঠে নৌকা। কোনমতে টাল সামলে উঠে বসে আকানূর। দেখে চোখের সামনে দাঁড়ানো একপেড়ে তাঁতের শাড়ি পরা এক তরুণী। ঝাঁঝালো কণ্ঠ আকানূরের-

-ওই নৌকা যাইবো না, নামেন।

শুনেছে কি শোনেনি বোঝা গেলো না। এক পাশে বসে পড়লো তরুণী। 

-কইলাম না যামু না, বসলা ক্যান?

তরুণী চোখ তুলে তাকায়। খিল খিল হাসে।

-রাগো ক্যান মাঝি। আমারে একটু গাঙের ওই পাড় থিকা ঘুরাইয়া আনো। তোমার লগে বেড়াইতে চাই।

মুহুর্তেই আকিনূরের চোখ গেঁথে যায় তরুণীর চোখে। এতো সুন্দরী এই গাঙে এলো কোথা থেকে! যাবেইবা কোথায়? 

-বাড়ি কই, আর যাইবেন কই?

-এই গাঙই আমার বাড়ি। এইহানেই আমারে একটু ঘুরাও মাঝি। তোমারে গল্প কমু।

-আমার গল্প হুননের কাম নাই। কই যাইবেন কন, নামাইয়া দিয়া আহি। 

-কইলাম তো এই গাঙই আমার বাড়ি। 

-আমার লগে ফাইজলামি করেন, নামেন নৌকা থিকা। 

-গল্প শুনবা না মাঝি? 

কি এক মুস্কিল। আকিনূরের চোখ-মুখ থেকে লাফিয়ে পরে বিরক্তি। কত সুন্দর তাতানো রোদে শরীরটা মেলে ধরেছিলো। তার চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা, কি গল্প বলতে চায় তরুণী। কে সে? এতো রূপসী মেয়ে  তাদের গাঁয়ে দেখে নি আগে। কোথা থেকে এলো? কোথায় যাবে? আবার বলছে এই গাঙই তার বাড়ি। পাকানো কথাসমুহের কোন জট খুলতে পারে না সে। চেঁচিয়ে বলে-

-কন কি গল্প হুনাইতে চান।  

     

দুই.

জলের ঢেউ আঁচড়ে পড়ে নৌকায় মিশে গিয়ে যেনো শেষ হয় তরুণীর বাঁকানো শরীরে। গল্প শুরু করার আগে কাটা তরমুজের মত ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে। চোখে-মুখে শূন্যতা। নদীর পাঁজর চিরে দ্রুত চলে যাওয়া একটি নৌকার দিকে ইঙ্গিত করেই গল্প শুরু করে তরুণী।

-এই পথেই  আসা যাওয়া আছিলো ফজিলন বালা‘র। কি রইদ, কি বিষ্টি, কি ঝড়, কি তুফান, কোন কিচ্ছুই থামাইতে পারতো না তারে। এই পথেই গাঙের ওইপারে যাইতো কবিরের লগে দেহা করতে। কোন কোন দিন কবিরও আইতো এই পাড়ে। সেই সত্তুর-একাত্তুর সালের কথা। তখন এই পাড়ার মাইয়ারা কোন পোলার লগে সম্পর্ক করার কথা স্বপ্নেও ভাবতো না। ফজিলন আছিলো উল্টা। কাউরে ডরাইতো না। রূপের তার কমতি আছিলো না। কত পুরুষ যে তারে পছন করতো তার কোন হিসাব নাই। কিন্তু কাউরেই সে গোনায় ধরতো না। কেবল কবিরই আছিলো তার সব। ওই সময় আবার দেখা দিলো গল্ডোগল। সারা দেশে কেবল গন্ডগোলের খবর। পাড়ায় পাড়ায় পাকিস্তানি পুলিশ। এই গাঙে সারাক্ষণ পুলিশ আর আর্মিরা যাইতো আর আইতো। পাকিস্তানীদের পক্ষে একটা দল হইলো শান্তিবাহিনী নামে। তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়া সাবধান করে, কেউ যেন মুক্তিবাহিনীতে না যায়। তারপরও অনেক পোলা ভারতে চইলা গেছিলো ট্রেনিং নিতে। হেই খবর যখন পাকিস্তানী মিলিটারি জানলো তো শুরু হইলো নির্যাতন। ফজিলনদের গ্রামের মোল্লা বাড়িতে একদিন আস্তানা গাড়লো পাকিস্তানী মিলিটারি। যাগোর পোলারা মুক্তিবাহিনীতে গেছে তাগোরে ডাইকা কইলো, যেনো তাগো পোলাদের ফিরাইয়া আনে। যারা গেছে তারা কি আর ফিরা আহে। আহে নাই। তারপরতো শুরু হইলো বাড়ি জ্বালাও। প্রায় সব বাড়ি থেকেই ধইরা নিয়া গেলো কম বয়সী মাইয়াদের। সেই তখন, ফজিলন বালা ছাড়লো বাড়ি। তার রূপের সুন্দরও হইয়া গেছিলো কাল। করলো কি সারা শরীরে কালি মাইখা, ছিঁড়া শাড়ি পইরা, গেলো কবিরের কাছে। কইলো, চলো কবির যুদ্ধে যাই। শত্রুগরে খেদাইতে না পারলে কাউরে বাঁচতে দিবো না। চলো কবির ভারতে গিয়া ট্রেনিং লইয়া যুদ্ধে নামি। কার কথা কে হুনে। কবির যাইতে রাজি হয় না। তার বাবা-মা উল্টা ফজিলনরে কইলো হেই যদি কবিররে যুদ্ধে নিতে চায় তাইলে মিলিটারিরে কইয়া দিব। ফজিলনরে ধরাইয়া দিব। কবির সাফ জানাইয়া দেয় যুদ্ধে যাইবো না। 

আকিনূর মগ্ন হয়ে শোনে তরুণীর কথা। যত শুনে ততই চোখে জেগে ওঠে বিস্ময়। 

-কি কও, কোন জাতের পোলা কবির! দেশের এমুন গন্ডোগলে যুদ্ধে যাইতে চাইলো না। অথচ ফজিলন মাইয়া হইয়া কইলো যুদ্ধে যাইবো।

-হ, কবির গেলো না। ফজিলন পলাইয়া যুদ্ধে যোগ দিতে চইলা গেলো। ট্রেনিং নিতে যোগ দিলো আগরতলার লেম্বুচোরা ক্যাম্পে। পুরুষ যোদ্ধাগর লগে বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্প থেকে আনা হইলো আরো নয়জন মাইয়া। যাগো বয়স প্রায় ফজিলনের সমান। দশ জনের একটি দল বানাইলো কমান্ডার। ওই দশ জনের মইধ্যে ফজিলন স্যুইসাইড স্কোয়াডের ট্রেনিংও নিছিলো। ট্রেনিং শেষে যোগ দিলো মতিনগর সাবসেক্টরে। তার সাহস দেইখা কমান্ডার ল্যাফটেন্যান্ট দিদারুল আলম নতুন নতুন অপারেশনের পরিকল্পনা করে। প্রথম অপারেশন হইবো পয়েলগাছায়। হেইখানে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালাইতে হইবো। একটা বোডের মইধ্যে মানচিত্র আইকা কমান্ডার সবাইরে বুঝাইয়া দিলো কোন দিক থিকা আক্রমণ শুরু করতে অইবো। কোন দিকে কতজন থাকবো। কার লগে কোন অস্ত্র থাকবো। মাইয়াগো কি করতে অইবো। সব বুঝাইয়া দেওনোর পরে শুরু হইয়া গেলো চলা। মতিনগর থিকা মাঝরাইতে বিশ জনের একটি দল রওনা দিলো পয়েলগাছার দিহে। আগেই দুইজনরে পাঠানো হইছিলো আশপাশে অবস্থান লইয়া খবর দেওনের লাগি। ঠিক ফজরের আজানের আগে আগে সবাই হাজির হয় পয়েলগাছায় সেই আর্মি ক্যাম্পের কাছে। বিশজন ভাগ হইয়া গেলো চাইরভাগে। আগে আসা দুইজনের একজন আইসা কইলো সূর্য উঠার আগেই আক্রমণ করতে অইবো। কমান্ডারের আদেশ মতই ফজিলন আরো দুইডা মাইয়ারে লইয়া ঢুকলো ক্যাম্পের ভিতর। সবার কোমরে শাড়ীর নিচে বান্ধা স্ট্যানগান। সোজা ঢুইকাই এক সিপাহীরে কইলো, তোমার বসের কাছে লইয়া চলো, আমরা তারে একটা খবর দিতে আইছি। সুন্দরী ফজিলনরে দেইখা সিপাহী বেটা দৌড় দিয়া তার কামান্ডাররে ডাইকা নিয়া আইলো। কমান্ডার উর্দুতে তাদের অন্ধরে যাইতে কইলো। অন্ধরে যাইয়াই কমান্ডাররে কইলো দরজা লাগাও, তোমার লগে জরুরী কথা আছে। কমান্ডার সিপাহীরে বাইর কইরা দিলো দরজা লাগায়া। খাস কামরায় গিয়া ফজিলন কোমর থিকার স্ট্যানগান বাইর কইরা ঝাঝরা কইরা দিলো কামন্ডারের বুক। সাথে সাথে চাইরদিকে থাকা মুক্তিরাও খইয়ের মত আক্রমণ করলো। হেইবার কোন মুক্তিযোদ্ধা মরে নাই। মরছিলো পাকিস্তানী আর্মির ছয় সিপাহী ও তাগো কমান্ডার। অপারেশন শেষ কইরাই সূর্য উঠার আগেই সবাই অবস্থান লইলো বিশাল এক পানের বরজের মাঝখানে। 

আকিনূর বিস্মায়াভিভ’ত চোখে গল্পবলিয়ে তরুণীকে দেখছে আর তার বলা গল্প ভক্ত শ্রোতার মত শুনছে। আকিনূরের কানে আর কোন জলচিরে চলে যাওয়া নৌকার শব্দ  আসে না। এমনকি ঠিক কোথায় সে বসে আছে তাও স্মরণে নেই। তরুণী বলতে থাকে-

-হেই পানের বরজ থাকি আবার বাইর হইলো পরের দিন মাঝ রাইতে। পান বরজের মালিক মুন্সি ব্যপারীর বাড়িতে হইছে খাওনের আয়োজন। কোন আলো নাই। গুটগুইট্টা আন্ধারে সবাই উঠলো ব্যাপারীর বাড়িত। খাওনের মাঝামাঝি সুময় শুরু হইলো গোলাগুলি। চারদিক থিকা পাকিস্তানী আর্মি ঘিরা ফালাইছে ব্যাপারী বাড়ি। শুরু হইলো পাল্টা গুলি। প্রায় এক ঘন্টা গোলাগুলির মইধ্যে ফজিলনের লগে থাকা দুই মাইয়ার একজন মারা যায়, সাথে মারা যায় দলের আরো দুই পোলা, হারাধন আর শফিক। শফিক দেইখতে ছিলো কবিরের মত। হের লাইগা ফজিলন তারে খুব পছন্দ করতো। শফিক মইরা যাওয়ার পর কবিররে আরো বেশি করে মনে পড়ে তার। ফজিলনের মন পোড়ে। নিজে নিজে কথা কয়, কবির কোথায় আছে, গিরামে কি আছে,নাকি পালায়ছে অন্য কোনহানে? তাইলেতো গিরামে গেলে কবিররে পাওন যাইবো না। কবিররে পাইবো না, একথা মনে হইতেই চোখ ভাইসা কাঁদন আহে তার। আর বুকে স্ট্যানগান চাইপা পালাইতে থাকে। কাউরেই লগে নিতে পারেনাই ফজিলনরা। অন্ধকারে কোরলিন কইরা ব্যাপারী বাড়ির পিছন দিয়া পালায় ফজিলনসহ বাকিরা। হের পর কে কোন দিহে গেছে কোন পাত্তা নাই। ফজিলন একা পালাইয়া আশ্রয় নিলো এক গোয়াল ঘরে। ওই ঘরে যে কখন ঘুমাইয়া পড়ছিলো তার মনে নাই। ঘুম থাকি জাইগা, চোখ কছলাইতে কছলাইতে দেহে চারদিকে। কোনহানে কোন মানুষের আলাপ পাওন যায় না। বাইর হইয়া বাড়ির উঠানে আইসা খাড়ায় ফজিলন। আস্তে আস্তে ডাকে, কেউ আছেন নাহি বাড়ি? নিরব নিস্তব্দ বাড়িতে তার ডাকের শব্দ চক্কর দিয়া মনে লয় আবার তার কাছেই ফিরা আহে।  কয়েকবার ডাকার পর এক বৃদ্ধ জানালা দিয়া দেহে, আর জিগায় কারে চাও গো মা? মা ডাক হুইনা হাটু গাইরা উঠানে বইসা পড়ে ফজিলন। চিৎকার করে কাঁদে। মনে পড়ে বাপ-মা‘রে। কই আছে তারা কেমুন আছে? বৃদ্ধ আইসা তারে লইয়া যায় ঘরে।  ঘরেই ঢুইকাই অবাক হয়ে যায় ফজিলন। দেহে তিনডা মাইয়া কোন রহমে ছিঁড়া কাপড় দিয়া গা ঢাইকা রাখছে। অমনি আর দেরি করে না। বৃদ্ধ পুরুষ মানুষটির দিকে উঠাইয়া ধরে স্ট্যানগান। চিৎকার কইরা উঠে ওই তিন মাইয়া। 

-উনিই আমাগোরে বাঁচাইছে। কাইল রাইতে ওই মাদ্রাসার ক্যাম্পে হানাদার বাহিনীর লোকেরা আমাগোরে ইচ্ছেমতন ব্যবহার করছে।  মুক্তির লোকেরা যখন হামলা চালাইলো তখন এই চাচা নামাজ পড়তে গেছিলো। গোলাগুলির ওই ফাঁকে চাচা আমাগোরে লইয়া পালাইয়া নিয়ে আইলো এই বাড়িতে। এই বাড়িও চাচার না। এইহানে থাকতো এক হিন্দু পরিবার। তাগো এক মাইয়া ও পোলারে পাকবাহিনী ধইরা লইয়া যাওনের পর বাকিরা চইলা গেছে গিরাম ছাইড়া। হানাদাররা জানে এই বাড়িতে কেউ থাহে না, তাই চাচা আমাগোরে এইহানে নিয়া আইছে।




তিন.

আকিনূর তরুণীর মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজের ভেতরে নিজে আছে কিনা টের পায় না।  হানাদারদের বিভৎসতা আর ফজিলনের সাহস তার মধ্যে মেঘ আর আলোর মত বেজে যায়। পাকিদের কঠিন চেহারা তার মনে এক ধরনের মেঘাচ্ছন্ন দেয়াল তুলে রেখেছে। অন্যদিকে ফজিলন, তার কাছে হয়ে উঠেছে সূর্যের আলোর মতো তীক্ষ্ম এবং ক্ষীপ্র।    

-তারপর কি হইলো কও না ক্যান?

-ফজিলন ঠিক করে এই বাড়িতেই থাকবো কয়দিন। এইহানেই তিন মাইয়ারে ট্রেনিং দিবো। তারপর আক্রমণ হইবো ওই মাদ্রাসা ক্যাম্পে। কিন্তু আরো তো অস্ত্র দরকার। পাইবো কই? ওই চাচায় কইলো বর্ডারের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটা দল আছে। ওইহান থেইকা হয়তো কিছু অস্ত্র যোগাড় করা যাইতে পারে। আর তা না হইলে চুরি কইরতে অইবো পাকিস্তানী ক্যাম্প থাইকা। চাচার দ্বিতীয় কথাটা ফজিলনের মনে ধইরলো। কিন্তু অস্ত্র কেমুন কইরা চুরি কইরতে অইবো? রাইতের মধ্যেই চাচারে কইলো তার লুঙ্গি, পাঞ্জাবী আর একটা টুপি আনতে। যেই চিন্তা হেই কাজ। পরদিন হাইঞ্জাবেলায় চাচার পাইঞ্জাবি, লুঙ্গি, আর চুল ছোট কইরা কাইটা টুপি পইরা মাদ্রাসার মসজিদের দিকে রওনা করে ফজিলন। পুকুরের ঘাটে গিয়া অজুর ভান কইরা দেইখা লয় সিপাহীগোর অবস্থান। এরই মইধ্যে হুনা যায় আরো কিছু মাইয়াদের কাঁদনের শব্দ। ফজিলন আর দেরি করে না, পুকুরের পাড় ধইরা পিছন থেইকা ঢুইকা পড়ে ক্যাম্পে। কয়েকজন সিপাহী দরজার বাইরে রাইফেল রাইখা ভিতরে আটক মাইগর লগে খারাপ কাম করে। ফজিলন চিন্তা করলো এখন কিছু করা যাইবো না। এখন কেবল তিনটা রাইফেল আর ম্যাগজিন লইয়া যাইতে অইবো। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনটা একে ৪৭ রাইফেল আর দশ বারোটা ম্যাগজিন লইয়া ফজিলন সোজা নাইমা পড়ে পুকুরে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ফজিলন পুকুরের উত্তর পাড় ঘেইসা যাইয়া উঠে পুব পাড়ে। রাস্তায় না উইঠা জমির আইল ধইরা কোনাকোনি গিয়া উঠে ওই বাড়িতে। আইসা দেখে চাচা মাইয়াগোর লাগি কাপড়সহ বাজার সদাই নিয়া আইছে। এই বাড়িতেই রাইতে চলে তিন মাইয়ার ট্রেনিং।  রানু, বালি আর সুজাতা, এই তিনজন ট্রেনিং নেয় আর ক্ষোভ নিয়া অপেক্ষা করে কখন হামলা চালাইবো ক্যাম্পে।  কিন্তু খারাপ খবর লইয়া আহে চাচা। রাইফেল চুরি যাওয়াই ক্যাম্পে রইটা গেছে এই এলাকায় মুক্তিবাহিনী আইছে। পুরা গ্রামে তল্লাশি করতাছে হানাদার বাহিনী। এই বাড়িও বাদ যাইবো না। যা করার আইজ রাইতেই করতে অইবো। গোয়াল ঘরের পাশ থেইকা দুইখান কোদাল লইয়া আইলো ফজিলন। বাড়ির পিছনে জংলা মতো জায়গায় খুঁড়তে শুরু কইরলো অদল-বদল কইরা। বিশাল এক গর্ত কইরা ভিতরেই অবস্থান লইলো সবাই। গর্তের মুখ বন্ধ করা হইলো গাছের ডাল-পাতা দিয়া। চাচারে কইলো তার বাড়িতে ফেরত যাইতে। দেখা গেলো সূর্য উঠার আগেই হাজির হইলো পাকিস্তানী সিপাহীরা। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কাউরে না পাইয়া, উল্লাস শুরু কইরা দিলো। কইলো এই বাড়িতেই তারা অবস্থান করবো। নিরিবিল বাড়ি।  গণিমতের মাল এই বাড়িতেই আইনা উঠাইবো। মহা বিপদে পড়ে যায় ফজিলনরা। তবুও সাহস হারা হয় না। অপেক্ষা করে আরেকটা রাইতের। কিন্তু একটি দূর্ঘটনা ঘটে যায় দুপুরেই। চাচা যখন এই বাড়িতে খাবার লইয়া আইলো, ঝাপটাইয়া ধরলো সিপাহীরা। জিগাইলো কার জন্য খাবার আনছে। চাচা কইলো কইবো না। চিৎকার কইরা কইলো মাইয়াগুলোরে কি করছস তোরা। ওরা তোগরে শেষ কইরা দিবো। এ ক‘টি কথা বলার পর পর এক সিপাহীর গুলিতে ঝাঁঝরা হইয়া যায় চাচার বুক। কলমা পইড়তে পইড়তে চাচা লুইটা পড়ে মাটিত। ফজিলনরা সব দেখতে পায় বাড়ির পিছন থেইকা। কেবল অপেক্ষা রাইতের। রাইতে যে করেই হোক অপারেশন করতেই অইবো। সারাদিন কোন খাওয়া নাই। সাথে কেবল এক কলসি পানি ছিলো। পানি খাইয়া চারজনে দিন কাবার করলো। হাইঞ্জার একটু পরে গর্ত থাকি বাইর অইয়া বাড়ির চাইর দিকে অবস্থান লয় ফজিলনরা। কথা আছে, শীষ দেয়ার সাথে সাথেই শুরু অইবো আক্রমণ। যেই কথা হেই কাজ। ফজিলনের শীষ হুইনাই শুরু হয় চাইরদিক থেইকা গুলি। ঘরের মইধ্যে থাকা ছয়জন সিপাহীর দুইজন পলাইয়া যায়, বাকি চারজন গুলি খাইয়া ওইখানেই মইরা যায়। কিন্তু এইহানেই শেষ না। হুনা যায় মাদ্রাসার ক্যাম্প থাকি গুলি কইরতে কইরতে আইতাছে আর্মিরা। ফজিলনরা ছয় সিপাহীর অস্ত্রগুলা লাইয়া আবারো অবস্থান নেয় গর্তে। আর্মিরা আইসা সিপাহীদের মরা দেইখাই আগুন লাগাইয়া দেয় বাড়িতে। দাউ দাউ করে জ্বলে বাড়ি। 


চার.

আকিনূর থির বসে থাকে। তার দৃষ্ঠি সম্মুখে শূন্যতার পর্দায় যেনো ভেসে উঠছে তরুণীর বয়ানকৃত দৃশ্য। এখন তরুণীর কণ্ঠ শুনে কেবল, আর দেখে দৃশ্য। যে দৃশ্য একের পর এক নির্মাণ করে যাচ্ছে তরুণী। 

-কোন মাইনষের আনাগোনা নাই। পোড়া বাড়ি, কোন আড়ালও নাই। ফজিলনরা রাত পোহানোর পর হারাদিন আর বাইর হইতে পারেনাই গর্ত থাইকা। ওই গর্ত থাইকায় হুনছে চারদিকে মানুষের কাঁন্দন। গিরামের পিরাই সব বাড়িতে হামলা দিছে হানাদাররা। ধাইরা নিয়া গেছে কম বয়সি মাইয়াগরে। রানু, বালি, সুজাতা আর সুময় লইবার চায় না। ফজিলনরে বলে, চলো মাদ্রাসা ক্যাম্পে হামলা করি। ফজিলন আরো সুময় লইতে চায়। তয় বেশি সুময় না। রাইতে বাইর হইয়া চার জনেই মাদ্রাসার চাইরধার ঘুইরা রেকিকইরা আহে। পরে হারাদিন গর্তে বইসা পরিকল্পনা লয় কিভাবে হামলা করন যায়। ওই ক্যাম্পে কমপক্ষে কুঁড়িজন আর্মি আছে। আর ফজিলনরা মাত্র চাইরজন। কিন্তু জান হাতে লইয়া হামলা করনই লাগবো। অনেকগুলা মাইয়ারে আটকায়া রাখছে। কোনমতে তাগোরে মুক্ত করা গেলেইতো দলের সদস্য বাইড়া যাইবো। হেই হিসাবে মাদ্রাসার পিছনে যেই ঘরে মাইয়াগরে আটাকাইয়া রাখা হইছে হেই ঘরেই প্রথম হামলা করার পরিকল্পনা ঠিক করে ফজিলন। পরিকল্পনা শেষে অপেক্ষা রাইতের। হাইঞ্জা নামনের কিছু পরেই ফজিলন বাইর হইয়া আরেকবার দেইখা আহে আশেপাশের পরিস্থিতি। গর্তে ফিরাই তৈরী করতে থাকে অস্ত্র। ভাগ কইরা লয় চাইরজনে। মাইঝ রাইতে বাইর হইয়া বিল ধইরা হাটতে থাকে মাদ্রাসার দিহে। ফজিলন আর সুজাতা গেল মাদ্রাসার পিছনে যেইহানে মাইয়াগোরে আটক করা হইছে।  বালি আর রানু গেলো মাদ্রার সামনের দিকে, যাতে আক্রমণ করার সুময় কেউ বাইর অইতে না পারে। ফজিলন আর সুজাতা কোরলিন কইরা ওই ঘরের দরজার সামনে গিয়া খাড়ায়। কান পাইতা হুনে। কয়েকটা মাইয়া বিলাপ কইরা কানতাছে। আর একজন কইতাছে, আমার উপরে আর কতজন সওয়ার হইবেন। আমিতো মইরা যামু। আমারে ছাইড়া দেন। অমনিতেই ভাইসা আসে অট্টহাসি। হানাদার বেটারা মাইয়াগো ফরিয়াদ হুইনা হাসে। ফজিলন আর স্থির থাকতে পারে না। দুইজনে গুলি কইরতে কইরতে ঢুইকাপড়ে ভিতরে। হাউমাউ কইরা আটক মাইয়ারা যে যেভাবে পারছে বাইর হইয়া পালাইতে শুরু করে। ওইদিকে সামনে থাইকা আক্রমণ শুরু করে বালি আর রানু। মাইয়াগোর ঘরে থাকা চাইর জোয়ানরে কিছু বুইঝা উঠার আগেই কতল করে দেয় ফজিলন আর সুজাতা। কিন্তু এর মইধ্যেই ওগোরে ঘিইরা ফেলে আর্মিরা। ওইদিকে সুজাতা আর বানুর কোন আলাপ পাওয়া যায় না। ফজিলন আর সুজাতা আবার গুলি চালাইতে শুরু করে। তাগোর দিকে ছুইটা আসে পাল্টা গুলি। সুজাতার ঠিক বাম বুকে আইসা লাগে গুলি। ঝাঁঝরা বুক লইয়াও অনেক্ষণ গুলি চালাইলো। কিছুক্ষণ পর হুইয়া পরলো মাটিতে। একহাতে স্ট্যানগান তুইলা কইলো, জয়বাংলা‘। আর কোন শব্দ পাওয়া যায়নাই সুজাতার মুখে। ফজিলন গুলি কইরতে কইরতে মাটিতে কয়েক গরান দিয়া পড়লো পুকুরে। দেখলো হেই সুময় বালি আর রানুরে ঘিরা রাখছে চাইর জওয়ান। পালাও ফজিলন কইয়াই ওরা চালাইতে শুরু করলো গুলি। দুই জওয়ান কতল হইলেও বাকি দুই জওয়ানের গুলিতে মাটিতে লুইটা পড়ে বালি আর রানু। দুইজনেই একলগে চিৎকার কইরা কয় ‘জয়বাংলা‘। এরপর দুই রাইন্ড গুলির শব্দ ছাড়া আর তাগোর কোন কথা হুনা যায়নাই। ততক্ষণে ফজিলন ওই এলাকা ছাইড়া অন্য এলাকার পথে। 


পাঁচ.

এরপর ফজিলনের গন্তব্য কোথায়? দলহারা এই যোদ্ধা বারবার একা হয়ে যাচ্ছে। প্রথম তাকে একা করেছে কবির। তারপর দলছুট হয়ে দল গড়া, আবার একা হয়ে যাওয়া। অকিনূরের ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলে, ফজিলন যেনো তাকে সাথে নিয়ে চলে। কিন্তু গলা থেকে কথা সরে না। কেবল দেখে বিধ্বস্ত গ্রামের পর গ্রামের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে এক ফজিলন। যতদূর ছুটে যাচ্ছে ততদূর লেখা হয়ে যাচ্ছে একটি নাম ‘বাংলাদেশ‘।  এই নামটির জন্যই একদিন কবিরকে ছেড়ে যুদ্ধে নেমেছিলো ফজিলন। আকিনূরের মনে অনেক ঘৃণা দলা পাকিয়ে ওঠে কবিরের জন্য। আকিনূর কবিরকে সরিয়ে দিতে চায় আর ফজিলনের সামনে গিয়ে নিজেই দাঁড়াতে চায়। বৈঠার আঘাতে ছিঁড়ে যাওয়া জলের মতো তার পাঁজরও যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ফজিলনের এই দৃশ্য সে আর দেখতে চায় না। এসব ভাবতে ভাবতে আকিনূর রক্তচোখে আবারো দেখতে থাকে তরুণী বিরচিত দৃশ্য।       

-ফজিলন দৌঁড়ায় আর কবিরের কথা ভাবে। আইজ কবির যদি লগে থাকতো আরো সাহস লইয়া যুদ্ধ করা যাইতো। হারা রাইত কাবার হইয়া যায়, ফজিলনের হাটা থামে না। একসময় ফজরের আজানের পর পর আইসা দাঁড়ায় এই গাঙের পারে। কোন মানুষের আনাগোনা নাই। গিরামের বাড়িঘর বলে কিচ্ছু নাই। গাঙপাড় থিকাই ফজিলন দেখে খাড়াইয়া আছে তাগো পোড়াবাড়ি। কোথায় তার বাবা-মা হেই খবর লওনের মতও কোন মানুষের দেখা মিললো না। পুরো গিরামে কোন মানুষ নাই। গাঙ পার অওনের নৌকা নাই। গাঙ পাড় ধইরা হাটতে হাটতে এক সুময় দেখলো একটা নৌকা বান্ধা ঘাটে। ওই নৌকা লইয়া নিজে বৈঠা বাইয়া পার হইলো ওইপাড়ে। রাস্তা ধইরা না যাইয়া, জমির আইল ধইরা গিয়া উঠলো কবিরদে বাড়ি। কবিরের বাবা-মা ফজিলনরে দেইখা শুরু করে চিৎকার। কবির ঘর থিকা বাইর অয়না। ফজিলন দৌড়াইয়া ঘরের ভিতর যায়। কয়, কবির দেখো আমি যুদ্ধ থেকে আইছি তোমারে নিতে। তুমি থাকলে আমি আরো যুদ্ধ করুম। তোমারে আমি স্বাধীন একখান দেশে বিয়া করুম। হেইদিন আমাগোর লগে আর কেউ মথা তুইলা কথা কইতে পারবো না। আমাগোরে গণিমতের মাল ভাববো না কেউ। আমি তখন বউ অইয়া তুমার সংসার করুম। চলো কবির যুদ্ধে যাই। এই সুময় কবিরের মা চিৎকার কইরা ওঠে, ‘হুন তুমি যদি না যাও, আমরা তোমারে হানাদারগো হাতে উঠাইয়া দিমু। আমার ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যাইবো না। হেই মুক্তিবাহিনীর খবর দেয় পাকিস্তানীগো কাছে। তোমার খবরও দিয়া দিবো। ফজিলন বিশ্বাস কইরতে পারে না কবিরের মায়ের কথা। সে আরো সুময় লয়। কবিরের ধারে বইসা থাহে। কবির কোন কথা কয় না। কিছুক্ষণ পরেই দেখে কবিরের বাবার লগে ঘরে আইসা ঢুকলো দুই আর্মি জওয়ান। ফজিলনের চুল ধইরা টান মাইরা খাড়া কইরা কয়, খুব সুরত লেরকি হায়‘। ফজিলন চুপ হইয়া যায়। কোমরে বাঁধা স্টেনগান তুইলা দেয় আর্মিগো হাতে। কোন কথা ছাড়াই হাটতে থাকে আর্মি ক্যাম্পের দিহে। ক্যাম্পে একটা ঘরে আরো মাইয়াগ লগে রাখে ফজিলনরে। রাইত ঘনাইয়া আইলেই তারে এক জওয়ান আইসা লইয়া যায় কমান্ডারের ঘরে। কিছুই কয় না। কমান্ডার ফজিলনের কাপড় ধইরা টান মারার লগে লগে চোখ তুইলা তাকায়। কোমরে বাইন্ধা রাখা হাত বোমটা ছুইড়া মারে কমান্ডারের দিহে। চারদিকে অন্ধকার হইয়া যায়। ক্যাম্পে আটকা বাকি মাইয়ারাও চিল্লাচিল্লি কইরা পালাইতে থাকে। হেই দলে ফজিলনও আছিলো বইলা হুনা যায়। কিন্তু ফজিলনরে আর কেউ কোনদিন দেখছে বইলা হুনা যায় নাই। 


আকিনূর তরুণীর কথা শেষ না হতেই তীরের মত তীব্রফলা তুলে দাঁড়ায়। কেঁপে ওঠে নৌকা। লাফ দিয়ে উঠতে থাকে নদীতীরের দিকে। পিছন থেকে তরুণী ডাকে, কই যাও আকিনূর?‘ আকিনূর পিছন ফিরে না তাকিয়েই উত্তর দেয়, ‘ফজিলনরে খুঁইজতে যাই। আমারে থামাইওনা, আমি বাংলাদেশরে খুঁইজতে যাই। পিছন থেকে তরুণীর কন্ঠ বাতাসের মত ভেসে আসে,‘কোথায় যাও, এইতো আমি এইহানে, আমিই ফজিলন‘,। তীব্রবেগে পিছন ফিরে তাকায় আকিনূর। দেখে শূন্য নৌকাটি ভাসছে নদীর জলে। কেউ নেই। কোন তরুণী কিংবা ফজিলন।  আকিনূর পা চালায়। ফজিলনের খোঁজে।        



 


No comments:

Post a Comment