Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts

Monday, October 26, 2020

 

কবিতায় কল্পনা, কবিতার মিথ্যে
কুমারেশ তেওয়ারী


‘কবিতা কল্পনালতা’ এই কথাটি তো সুপ্রাচীন। এবং এই কথাটির ভেতরেই ধরা আছে কবিতার আসল জিয়নকাঠিটি। মানব মনের চুড়ান্ত কল্পনার ফসলই তো কবিতা। কবিতার ক্ষেত্রে এই কল্পনার রূপটি এক লতানে গাছের মতো। আকর্ষ বাড়িয়ে বাড়িয়ে যা চতুর্দিকে তার লতা বিস্তার করে শান্ত আধিপত্য গড়ে তোলে। যে আধিপত্যে কোনো ক্ষতি নেই বরঞ্চ হিতৈষীর ভূমিকায় গ্রহণ করে এই আধিপত্য।  শত শত বৎসর ধরে এই কল্পনার ডানায় ভর করেই যত কবিতা। তা সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজকের নবীনতম কবিটির সদ্য লেখা কবিতাটি ওই কল্পনারই ফসল। 
“কা আ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” লুই পা-র এই কবিতায় কবি, শরীর কে এক বৃক্ষ কল্পনা করে সেই বৃক্ষরূপ শরীরের পাঁচটি ডালের কথা ভাবলেন। যদিও এখানে এক চুড়ান্ত দর্শন প্রতিফলিত হয়ে উঠেছে পঙক্তিটির মুকুর শরীরে। আবার একই সঙ্গে শাশ্বত আধ্যাত্মবাদ এবং বিজ্ঞান যেন মিলেমিশে একাকার। সত্যিই তো মানব শরীর এক বৃক্ষের মতো। যার পাঁচটি ডাল হলো ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও বোম। তাহলে কী দেখা গেল? দেখা গেল কবির কল্পনা মুহূর্তে এক শাশ্বত সত্যের পূণর্জন্ম দিল কবিতায়।
 
আবার বিনয় মজুমদারের একটি কবিতার এই পঙক্তিদ্বয় দেখুন,“ তবু কি আশ্চর্য, দ্যাখ, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে/তার উড়ে যাওয়া ইষৎ সঙ্গীতময় হয়”। এখানেও সেই কল্পনার আশ্রিত কবি। যে কল্পনায় মশার উড়ে যাওয়ার মধ্যেও কবি সঙ্গীতময়তার সন্ধান পেলেন। অর্থাৎ কবির কল্পনা জন্ম দিল দুটি প্রবাদপ্রতিম পঙক্তির। এখানেই কবি ও কল্পনার যুগলবন্দি। একজন সাধারণ মানুষের চোখ যেখানে শুধুমাত্র একটি মশার উড়ে যাওয়াকেই দেখতে পেত তার সাধারণ চোখে, সেখানে কবির চোখ মুহূর্তে কল্পনালতা হয়ে উঠে মশার উড়ে যাওয়ার মধ্যে আবিষ্কার করলো সঙ্গীতময়তার। এখন প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র বাস্তব দৃষ্টিতে এই দৃশ্যটি যদি কবি দেখতেন তাহলে কি জন্ম হতো এমন দুটি পঙক্তির? অবশ্যই না। শুধুমাত্র বাস্তব দৃষ্টিতে রচিত একটি কবিতা অনেকটা তেমন ইক্ষু দণ্ডের মতো, যা দেখতে সুদর্শন হলেও ভেতরমহল শুষ্ক কাঠের মতো রসহীন। যা সামান্য এক পিঁপড়েকেও তার নিকটে আকর্ষণ করতে পারে না। সুতরাং কী দেখা যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, চুড়ান্ত কল্পনার আশ্রয় না নিলে এক সার্থক কবিতার জন্ম দেওয়া কখনই সম্ভব নয়। বিশেষ করে কবিতায় মূর্ত ও বিমূর্তের খেলায় এই কল্পনার এক বিশেষ ভূমিকা আছে। ধরা যাক এমন একটি পঙক্তি—“ গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই/ গাছের ভেতর থেকে নৌকাটি গড়িয়ে নেমে/বললো, চলো নদীর দিকে যাই”। কল্পনাশক্তি না থাকলে কোনো কবি জন্ম দিতে পারবেন এমন পঙক্তির? কক্ষনো না কারণ তিনি তো শুধু গাছকেই দেখবেন সেক্ষেত্রে, গাছের ভেতর থাকা নৌকাটির অস্তিত্ব টের পাবেন কীভাবে? 

“এ আকাশ ভাঙে মাঝে মাঝে/ও আকাশ 
মেঘে আত্মহারা/সে আকাশে নৌকা খোলা আছে/মা আমি আকাশভরা ভরা”
এই কবিতাটি দেখুন, মিথ্যের বেসাতি করেছেন কবি। আকাশে কি নৌকা খেলা করে! নৌকা তো জলে ভাসে। আবার কবি কবিতার কথকের মুখ দিয়ে সেই মিথ্যেরই কথা লিখছেন। “মা আমি আকাশভরা তারা”। কারো পক্ষেই কি আকাশের তারা হওয়া সম্ভব? এই হচ্ছে কবির কল্পনাপ্রসূত মিথ্যে, যা মুহূর্ত কবিতাটিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে” ,জীবনানন্দের “বনলতা সেন” কবিতার এই পঙক্তিটির কথা ভাবুন। এ কি কবির চুড়ান্ত মিথ্যের ফসল নয়? অবশ্যই কারণ হাজার বছর কোনো মানুষ তো আর বেঁচে থাকতে পারেনা। অথচ এই মিথ্যেই জন্ম দিল এমন এক কবিতার যা বিশ্ববন্দিত কবিতা হয়ে থাকলো এতদিন। কত আলোচনা কত অনুসন্ধিৎসা এই কবিতাটি নিয়ে। অর্থাৎ মিথ্যের আশ্রয়ে গিয়ে (যে মিথ্যে আবার কবির কল্পনার ফসল) কবিতাটি অমরত্ব প্রাপ্ত হলো।  সুতরাং কল্পনার আশ্রয়ে গিয়েই কবি প্রসব করেন অজস্র মিথ্যার। টুকরো টুকরো মিথ্যা নিয়েই গড়ে ওঠে একটি কবিতা শরীর। তবে এই মিথ্যেই তো কবিতার অলংকার। এই মিথ্যে যত বেশি করে থাকবে কবিতায়, কবিতাও হয়ে উঠবে তত মোহময়ী এবং মিস্টিক। একটি কবিতার শরীর থেকে এই অলংকাররূপী মিথ্যেগুলো খুলে নিলে কবিতাটি হয়ে উঠবে শুধু কিছু শব্দের সমাহার সম্পন্ন এক অসাড় শরীর। যা পাঠকের মনে সামান্যতম অনুরণনেরও জন্ম দিতে পারবে না কখনও। তাহলে কী দেখা গেল? কবি মাত্রই মিথ্যুক এবং কবিতা মানের মিথ্যের ভাণ্ডার। আবার এই মিথ্যে না থাকলে কোনো কবিতা কবিতায় নয়। এই যে দুরকম বিপরীতধর্মী কথা বলছি মনে হতেই পারে, এ তো দ্বিচারিতা! হ্যাঁ, দ্বিচারিতায় তো কারণ এই দ্বিচারিতা না করলে কীভাবে বলতে পারবো, এই মিথ্যের মধ্যেই কবিতার নীল ভ্রমর। এই নীল ভ্রমরটি যেন একাধারে মৃত্যুদূত আবার একইসঙ্গে অনন্ত জীবন দূতের ভূমিকায়। কবিতায় মিথ্যে না থাকলে এই নীল ভ্রমর বিষাক্ত দংশন দেয় কবিতাকে আর কবিতাটি মারা যায়। অন্যদিকে আবার মিথ্যে থাকলে নীল ভ্রমরটি জেগে উঠে দংশন করে কবিতাকে আর কবিতাটিও অনন্ত আয়ু প্রাপ্ত হয়ে বের হয় বিশ্বভ্রমণে। “এখানে এমন একজন শায়িত রয়েছে যার নাম লেখা আছে জলের অক্ষরে“। কবি কীটসের সমাধি ফলকে লিখে রাখা  কল্পনা ও মিথ্যের মেলবন্ধনে রচিত কবিতার এই পঙক্তিটি কি বিশ্বভ্রমণের ফসল রূপেই পৌঁছইনি আমাদের কাছে এবং ওই যে ‘জলের অক্ষরে’ এই মিথ্যেই ( মিথ্যে কারণ জলের কোনো অক্ষর হয়না এবং জলের মধ্যে লেখাও যায়না। আবার জল কোনো কিছু লেখা হলে তার স্থায়িত্বও ক্ষণকালের) জন্যই এই পঙক্তিটির আবেদন এত তীব্র হয়ে ধরা দিল আমাদের কাছে।  ইংরেজীতে একটি শব্দবন্ধ আছে, “হোয়াইট লাই”। এমন মিথ্যে কখনও করো ক্ষতি তো করেই না উলটে মঙ্গলের কজই করে। এই মিথ্যেই কবিতার পাঠকের চোখের দরজা খুলে দেয় এবং পাঠকও তখন আবিষ্কার করেন ওই মিথ্যের ভেতরে সুপ্ত ঘুমে থাকা কোনো চরম সত্যকে।   এই মিথ্যে না থাকলে কবি কীভাবে জন্ম দেবেন হিরণ্ময় কবিতার এবং পাঠকই বা কীভাবে মিথ্যের জারকরসে জারিত হতে হতে মিলেমিশে যাবেন কবিতার অণু পরামাণুতে। সুতরাং এইকল্পনা ও মিথ্যে যা কবিতার প্রাণভোমরা অথবা প্রাণভোমরী, আরও শক্তিশালী হোক আর কবিও এইসব মিথ্যেকেই আশ্রয় করে রচনা করুন কোনো মহৎ কাব্যের। জয় হোক কবিতাকল্পনালতার এবং হিরণ্ময় মিথ্যের যুগলবন্দিতে গাওয়া অনন্ত সঞ্চারির।

 বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা

_________________________

সুজিত রেজ




যে-কোনো চিন্তন-দর্শন-ভাবনা-অনুভাবনার গূঢ় স্বরূপ বিচার করে,তার গৃহীত-সৃজিত অনুষঙ্গের পাঠ-পাঠান্তরের নির্যাসজাত মৌলিকত্ব-স্বাতন্ত্র্য মূল্যায়ণ কূটভিষার নামান্তর ; একইসঙ্গে চাপান-উতোরের অবকাঠামো বিনির্মাণের ক্ষেত্রভূমি কর্ষণের অবকাশ সৃষ্টি করা। এই মায়ালোকে প্রবেশ-বাঞ্ছা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে, রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবাদ-সিঞ্চিত রসসুধা পানে আগ্রহের উজ্জীবন আমার ধারণ-ক্ষমতা-বিচার  :


                                          শোনো বিশ্বজন

           শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ

           দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে

           মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে

          জ্যোতির্ময়। তাঁকে জেনে তাঁর পানে চাহি

          মৃত্যুকে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।


এই বিচার একান্তই আমি-সংশ্লিষ্ট। আমার মধ্যে যে আমি আছে , তাকে আহত করার ঝুঁকি নেওয়া যেতেই পারে। আহত আমির যন্ত্রণার শুশ্রূষা-প্রার্থনা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। আমার আমি কি ব্রহ্ম? জানি না। কেন জানি না, তা জানি না। বলতে পারব না। জানতে চাইনি তা তো নয়। তবে যেভাবে চাইলে জানা যায় , হয়ত সেভাবে জানতে চাইনি কোনদিন। জানার ইচ্ছের মধ্যেই বড় ফাঁকি ছিল। তবে জানা- অজানার মধ্যে 'কেটেছে ' একেলা বহুদিন। 'বিরহের বেলা ' হয়েছে দীর্ঘ।

অভিধানে আত্মাদিবিষয়ক  কিংবা দেহাদিতে অধিকৃত ব্রহ্মবিষয়ক জ্ঞান অধ্যাত্ম অর্থবাচক।আত্মা "আত্মানং রথিনং বিধি" ( কঠোপনিষৎ), অর্থাৎ যা ব্যাপ্ত করে বা সঞ্চরণ করে। আত্মা আপনি, নিজস্বরূপ, স্বীয়রূপ। আত্মা আবার প্রযত্ন, চেষ্টা, ধৃতি, ধৈর্য, ধর্ম, বুদ্ধি, মতি, প্রজ্ঞা, স্বভাব, প্রকৃতি ও শূন্য। আত্মা পরমাত্মা, ব্রহ্ম ও চৈতন্য নির্দেশক। ব্রহ্ম " বস্তু সচ্চিদানন্দমদ্বয়ং "; ওঙ্কার-শব্দ-ধন-বিত্ত-মোক্ষ-অন্ন -সত্য কিংবা তত্ত্বজ্ঞান-আত্মজ্ঞান-প্রকৃতিপুরুষবিবেকজ্ঞান।  উল্লিখিত ওঙ্কার-শব্দাদির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শৈশব-নাড়ির অচ্ছেদ্য বন্ধন।মাতৃজঠরের নাড়িছেদনের অনুষ্ঠানেই মাঙ্গলিক হুলাহুলির পরিবর্তে ধ্বনিত হয় :

" ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।"

( জগতে যাহা কিছু চলমান পরিবর্তনশীল বিকারশীল তাহার সব কিছুই যে এক পরমসত্যের দ্বারা আবৃত অর্থাৎ বিধৃত।)  অথবা " ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবির্তুব রেণ্যং ভর্গো দেবস্যঃ ধীমাহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।"

( যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে 

              পৃথিবী আকাশ তারা

   যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে

              বুদ্ধি চেতনা ধারা-----

    তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি

    ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি। )


জ্ঞান-পরিধির শৈশব-স্মৃতি রচন বাহুল্যদোষেদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ "মানবসত্য" প্রবন্ধে বাল্যস্মৃতি উদ্ধার করে লিখেছেন  :

" আমার জন্ম যে পরিবারে সে পরিবারের ধর্মসাধন একটি বিশেষ ভাবের। উপনিষদ এবং পিতৃদেবের অভিজ্ঞতা , রামমোহন আর আর সাধকদের সাধনাই আমাদের পারিবারিক সাধনা। আমি পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। জাতকর্ম থেকে আরম্ভ করে আমার সব সংস্কারই বৈদিক মন্ত্র দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল , অবশ্যই ব্রাহ্মমতের সঙ্গে মিলিয়ে।.... এমন সময় উপনয়ন হল। উপনয়নের সময় গায়ত্রীমন্ত্র দেওয়া হয়েছিল। কেবল মুখস্থভাবে না ; বারংবার সুস্পষ্ট উচ্চারণ করে আবৃত্তি করেছি এবং পিতার কাছে গায়ত্রীমন্ত্রের ধ্যানের অর্থ পেয়েছি। তখন আমার বয়স বারো বছর হবে। এই মন্ত্র চিন্তা করতে করতে মনে হত, বিশ্বভুবনের অস্তিত্ব আর আমার অস্তিত্ব একাত্মক। ভূর্ভুবঃ স্বঃ---- এই ভূলোক, অন্তরীক্ষ আমি তারই সঙ্গে অখণ্ড।এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি-অন্তে যিনি আছেন, তিনিই আমাদের মনে চৈতন্য প্রেরণ করেছেন। চৈতন্য ও বিশ্ব --- বাহির ও অন্তরে সৃষ্টির এই দুই ধারা এক ধারায় মিলেছে। এমনি করে ধ্যানের দ্বারা যাঁকে উপলব্ধি করছি, তিনি বিশ্বাত্মাতে আমার আত্মাতে চৈতন্যের যোগে যুক্ত। এইরকম চিন্তার আনন্দে আমার মনের মধ্যে একটা জ্যোতি এনে দিলে। এ আমার সুস্পষ্ট মনে আছে।"

ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে পারিবারিক গভীরতার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মলোকে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা নিবিড়তর হয়। ব্রাহ্মসমাজের উন্নতি সাধনের জন্য নির্স্বার্থ-প্রাণ পিতা দেবেন্দ্রনাথ ১৮৬৭-তে ' মহর্ষি ' রূপে কেশবচন্দ্র সেনের কাছে অভিনন্দিত হন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ছয়। ' ব্রাহ্মধর্ম ' ও ' ব্রাহ্মধর্মবীজ ' প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রণেতা ব্রাহ্মমুখ্য দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের ভাঙনে ব্যথিত হয়ে , ১৮৮০ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হন। ১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ ২৭ বছর তিনি এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন।


পিতার মনোবাঞ্ছায় ব্রহ্মসংগীত রচনার মধ্য দিয়েই  ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগের সূত্রপাত। ১৮৭৩ সালে পিতার সঙ্গে অমৃতসর স্বর্ণমন্দির দর্শন করে বিস্মিত বালক গুরু নানকের একটি গানের (গগন মে থাল রবি চান্দ দীপক বনে) কথা ও সুরের বিনির্মাণে রচনা করেন প্রথম ব্রহ্মসংগীত : " গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে "।  দেশ রাগে ঝাঁপতাল তালের এই গানটি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের মাঘোৎসবে প্রথম গীত হয়। গানের সূত্র-ভিত্তি এতটাই দৃঢ় যে গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের ৬২৬ টি গানের মধ্যে ৪৮৪ টি ব্রহ্মসংগীত ; সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মসংগীত গ্রন্থের সর্বশেষ পঞ্চদশ সংস্করণেও

(১৯৯৩) যা অন্তর্ভুক্ত।


" শান্তিনিকেতনে অপর সাধারণের একজন বা অনেকে একত্র হইয়া নিরাকার এক ব্রহ্মের উপাসনা করিতে পারিবেন" এই উদ্দেশ্য নিয়েই মহর্ষি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর উপাসনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে উপাসনা মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মোপনিষদ ভাষণ পাঠ করেন। এটি তাঁর প্রথম ধর্মদেশনা। পরের বছরে পাঠ করেন ব্রহ্মমন্ত্র। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের 'সাত বৎসরের ধর্মোপদেশের সংগ্রহ ' ধর্ম পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত  ' নিত্যপূজার নৈবেদ্য ' 'শান্তিনিকেতন'-গ্রন্থের একাধিক প্রবন্ধে উপনিষদের মন্ত্রগুলির সহজ ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি, যুক্তি ও প্রাচীন ঋষিদের অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য উপস্থাপিত। যার মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের সংকীর্ণ সীমা অতিক্রমণের প্রতিজ্ঞা এবং প্রথাসর্বস্ব সনাতন ধর্মের বিচ্যুতি-বেদনা বিনত মানসিকতায় উৎকীর্ণ। 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে তার স্পষ্ট পরিচয় আছে  :

" বস্তুত ব্রাহ্মসমাজের আবির্ভাব সমস্ত হিন্দু সমাজেরই ইতিহাসের একটি অঙ্গ। হিন্দু সমাজেরই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে তাহারই বিশেষ একটি মর্মান্তিক প্রয়োজনবোধের ভিতর দিয়া এই সমাজ উদ্বোধিত হইয়াছে। ব্রাহ্মসমাজ আকস্মিক অদ্ভুত একটা খাপছাড়া কাণ্ড নহে। যেখানে তাহার উদ্ভব সেখানকার সমগ্রের সহিত তাহার গভীরতম জীবনের যোগ আছে। বীজকে বিদীর্ণ করিয়া গাছ বাহির হয় বলিয়াই সে গাছ বীজের পক্ষে একটা বিরুদ্ধ উৎপাত নহে। হিন্দুসমাজের বহুস্তরবদ্ধ , কঠিন আবরণ একদা ভেদ করিয়া সতেজে ব্রাহ্মসমাজ মাথা তুলিয়াছিল বলিয়া তাহা হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধ নহে , ভিতর হইতে যে অন্তর্যামী কাজ করিতেছেন , তিনি জানেন তাহা হিন্দু সমাজেরই পরিণাম। "

শৈশবকাল থেকেই রবীন্দ্র-অন্তরে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক আকুতি স্বতঃস্ফৃর্ততায় বিকাশ লাভ করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক- সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মিলনগ্রন্থিতে মানবিক-ঐশিক এষণা প্রগাঢ়তমমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়। যা সত্য,শাশ্বত ও সুন্দর , যা বৃহৎ , বিপুল ও অবিনশ্বর তারই আস্পৃহায় রবীন্দ্র-অন্তর আকুলিত ও উদ্বেলিত হয়। ধর্ম-সাধনার বিকৃত বিক্ষুব্ধ ক্ষুদ্রতা- সংকীর্ণতা পরিহার করে  ভূমার সঙ্গে যোগসূত্র রচনার তীব্র আকুলতা জাগে। এর প্রাথমিক পাঠ তিনি গ্রহণ করেন বেদ ও উপনিষদের মণিকোঠার নিরুপম ও নান্দনিক শ্লোকমালায়। গভীর নিষ্ঠায় চলে প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাবগত ও মর্মগত রসসন্ধান। অচিরেই আত্মস্থ হয়  :

ক) একঃ দেব সর্বভূতেষু গূঢ় সর্বভূতান্তরাত্মা...


খ) সর্বে সুখেনি সন্তু সর্বে সন্তু নিরামায়া।


গ) সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ           সহচিত্তমেয়াম।


ঘ) স বিশ্বকৃৎ স হি সর্ব্বস্য কর্তা তস্য লোকাঃ স উ লোক এব...


ঙ) আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।


চ) ইয়ং পৃথিবী সর্বেষাং ভূতানাং মধু।


ছ) আত্মবৎ সর্বভূতেষু য পশ্যতি স পশ্যতি।


জ) ভ্রাতারো মানবাঃ সর্ব্ব স্বদেশ ভুবন ত্রয়ম।


ঞ) বিশ্বানি দেব সবিতদূরিতানি পরাসুব।


বৈদিকোত্তর ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, অহিংস প্রেমের প্রবর্তক, অপরিমেয় করুণা ও মৈত্রী বোধের প্রতিভূ বুদ্ধদেবের  ----

" সর্ব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু অবেরা হোন্তু অব্যাপজ্ঝা হোন্তু সুখী অত্তানং পরিহরন্তু " বাণীমন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ  মানবজীবনের পরম লক্ষ্য ও প্রশান্তির জগৎ খুঁজে পেয়েছিলেন। নোবেল প্রাপ্তির পর বিশ্ব-পরিক্রমায় আর এক মানবপুত্র যিশুর পায়ের চিহ্নে দীন মানুষের মিলনসাধনপীঠ অবলোকন করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী কবি -শিল্পী - দার্শনিক - বৈজ্ঞানিকদের স্নিগ্ধ সন্নিধানে , ব্রহ্ম-মানুষ-প্রকৃতি এই উপাদানত্রয়ে " বিশ্বলোকে চিত্তবৃত্তির যে বিচিত্র প্রবর্তনা আছে তাতে সাড়া দিতে হবে সকল দিক থেকে " এই সিদ্ধান্তে রবীন্দ্রনাথ উপনীত হয়েছিলেন।

দীর্ঘজীবনের প্রতিদিবসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর ' হইয়া উঠিয়াছেন '। শেষ জীবনে ' মানুষের ধর্ম ' প্রবন্ধে তিনি সেকথা জানিয়েছেন-- " আমার জীবন তাহার ধর্মকে লাভ করিয়াছে একটা বাড়িয়া উঠিবার প্রবাহের ভিতর দিয়া , কোনো উত্তরাধিকারের ভিতর দিয়া নয়, বাহির হইতে আমদানির দ্বারাও নয়।....

সব কিছুর ভিতর দিয়াই যে একই বিষয়বস্তু প্রকাশ লাভ করিয়াছে , তাহাতেই আমার নিকট প্রমাণিত হইয়াছে যে ' মানুষের ধর্ম ' আমার মনের মধ্যে একটা ধর্মের অনুভূতিরূপেই গড়িয়া উঠিয়াছে , কোনো দার্শনিক বিষয়বস্তুরূপে গড়িয়া ওঠে নাই। " আত্মলব্ধ এই মানসিক শক্তিতেই  ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ  অহং- এর আবরণ মুক্ত করেছেন। এই অহং নিত্যকালের অহং নয় , তা তো শাশ্বত অমৃতরূপ। এই অহং ক্ষুদ্র ; প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয়তা ও ভেদবুদ্ধির দ্বারা আবৃত, ক্লিন্ন ও মলিন। ভেদাত্মক আত্মকেন্দ্রিকতা থেকেই জন্মায় পাপ। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে এই সংকোচনধর্মী অহং - এর খোলস পরিত্যাগ অনিবার্য। কেননা " আত্মার প্রকাশরূপ যে অহং তার সঙ্গে আত্মার একটী বৈপরীত্য আছে। আত্মা ন জায়তে ম্রিয়তে। না জন্মায় না মরে। অহং জন্মমরণের মধ্য দিয়ে চলেছে। আত্মা দান করে , অহং সংগ্রহ করে , আত্মা অন্তরের মধ্যে সঞ্চরণ করতে চায় , অহং বিষয়ের মধ্যে আসক্ত হতে থাকে।" (আত্মার প্রকাশ, শান্তিনিকেতন) 


ছান্দোগ্য উপনিষদে আত্মা ও ব্রহ্ম নিরূপণমূলক উক্তি রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা লব্ধ সমর্থন পেয়েছে - " যিনি সর্বকর্মা , সর্বকাম, সর্বগন্ধ , সর্বরস, যিনি এই সখল পরিব্যাপ্ত করিয়া আছেন, যিনি বাকরহিত উদাসীন---- তিনিই আমার আত্মা, তিনিই আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে--- এই-ই ব্রহ্ম।" বিশ্বপ্রবাহ এক এবং অখণ্ড। এককে জানাই মানুষের লক্ষ্য। এককে জানলেই সমস্ত কিছুই জানা যায়। সব কিছুই করায়ত্ত হয়। সেখানেই মানুষের অমৃতত্ব অমরত্ব। বিশ্বপ্রবাহ একটি অনাদি অনন্ত মহাসঙ্গীত----

              জগৎ জুড়ে উদার সুরে

                          আনন্দগান বাজে,

              সে গান কবে গভীর রবে

                          বাজবে হিয়ামাঝে।(১৫)


      তুমি   কেমন করে গান করো যে, গুণী

                অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি।

                    সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে

                    সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে

                    পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে

                         বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।(২২)


                 

              বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি

                          সে কি সহজ গান।

              সেই সুরেতে জাগব আমি,

                           দাও মোরে সেই কান।

                       ভুলব না আর সহজেতে

                       সেই প্রাণসমন উঠবে মেতে

                       মৃত্যুমাঝে  ঢাকা আছে 

                             যে অন্তহীন প্রাণ।


               সে ঝড় যেন সই আনন্দে

                            চিত্তবীণার তারে

               সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত

                            নাচাও যে ঝংকারে।

                        আরাম হতে ছিন্ন করে

                        সেই গভীরে লও গো মোরে

                        অশান্তির অন্তরে যেথায়

                                  শান্তি সুমহান।(৭৪)

রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্ম মোহ নয় , মোহ থেকে মুক্তি। নিজের গোষ্ঠীর ধর্মমতকেও তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করেননি। দেবালয়ের তথাকথিত পবিত্র আবেষ্টনে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে তাঁর অস্তিত্ব অনুসন্ধান অর্থহীন---

             অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে

             কাহাকে তুই খুঁজিস সংগোপনে

             নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে

                                দেবতা নেই ঘরে।

' বিসর্জন ' নাটকে জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের পর, রঘুপতি গোমতীর জলে ত্রিপুরেশ্বরী কালিকামূর্তি নিক্ষেপ করেছে। রানি গুণবতী স্বামী গোবিন্দমাণিক্যের নিষেধ অগ্রাহ্য করে, মাতৃ-আরাধনার জন্য মন্দিরে উপস্থিত হয়ে লক্ষ করেছে, দেবীমূর্তি নেই। বিস্ময় -কৌতূহলে তিনি রাজপুরোহিতকে প্রশ্ন করেছেন : দেবী কই?

রঘুপতি : দেবী নাই।

গুণবতী :                               ফিরাও দেবীরে

             গুরুদেব, এনে দাও তাঁরে, রোষশান্তি

             করিব তাঁহার। আনিয়াছি মা'র পূজা।

             রাজ্য পতি সব ছেড়ে পালিয়াছি শুধু 

             প্রতিজ্ঞা আমার। দয়া করো, দয়া করে

             দেবীরে ফিরায়ে আনো শুধু, আজি এই

             এক রাত্রি তরে। কোথা দেবী?

রঘুপতি :                                       কোথাও সে 

             নাই। ঊর্ধ্বে নাই, নিম্নে নাই, কোথাও সে

             ছিল না কখনও।

তাই--- কাজ কি আমার মন্দিরেতে আনাগোনায়

         পাতব আসন আপন মনের একটি কোণায়

                                             (গীতিমাল্য/৮১)

কল্পিত, আরোপিত কঠোর নিয়ম-অনুশাসনের নিগড়ে দেবতা সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। " এইজন্যেই মানুষকে সাম্প্রদায়িক খ্রিস্টানের হাত থেকে খ্রিস্টকে, সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবের হাত থেকে বিষ্ণুকে, সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মের হাত থেকে ব্রহ্মকে উদ্ধার করে নেবার জন্য বিশেষভাবে সাধনা করতে হয়। "( খ্রিস্ট / খ্রিস্টধর্ম)

                     


আপন সত্তার অসাড়তার নির্মোক উন্মোচনের জন্যই রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক-মানস বরণ করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল আন্তর-আনন্দের জগতে বিহার। একমাত্র নিজের পূর্ণ প্রকাশেই সেই আনন্দ পাওয়া যায়, তা-ও উপলব্ধি করেছিলেন। এবং " আনন্দের ভোজে বাহিরের চেয়ে অন্তরের অনুষ্ঠানটাই গুরুতর " মনে করেছিলেন। তাই অন্তরতরর কাছে অন্তর বিকশিত করার, জাগ্রত-উদ্যত-নির্ভয়-মঙ্গল করার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন।


রবীন্দ্রনাথের ধর্ম - কর্ম একই পেটিকায় গ্রন্থিবদ্ধ  : " আমার ধর্ম হইল একজন কবির ধর্ম---- এ ধর্ম কোনও নিষ্ঠাবান সদাচারী লোকের ধর্মও নয়, কোনও ধর্মতত্ত্ববিশারদের ধর্মও নয়। আমার গানগুলির প্রেরণা যে অদৃশ্য এবং চিহ্নহীন পথে আমার কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে সেই পথেই আমি আমার ধর্মের সকল স্পর্শ লাভ করিয়াছি। আমার কবিজীবন যে রহস্যময় ধারায় গড়িয়া উঠিয়াছে, আমার ধর্মজীবনও ঠিক সেই একধারাকেই অনুসরণ করিয়াছে। যেমন করিয়াই হোক, তাহারা পরস্পরে পরস্পরের সহিত যেন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়া আছে........"

                                       হিবার্ট লেকচারস্সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় , রবীন্দ্রনাথের কবিত্বের মধ্যেই অধ্যাত্মসুধার নিরন্তর ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়েছে।

          একি কৌতুক নিত্যনূতন

                    ওগো কৌতুকময়ী !

         আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে

                    বলিতে দিতেছ কই ?

         অন্তরমাঝে বসি অহরহ 

         মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,

         মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ

                    মিশায়ে আপন সুরে।

         কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই

         তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,

         সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই----

                    কোথা ভেসে যাই দূরে !


কবি ঋষিতুল্য, মেধাবী, ক্রান্তদর্শী, মনীষী,প্রাজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্বুদ সুর একমাত্র কবির কানেই অনুরণিত হয়। কবিত্বশক্তি তূরীয়, দিব্য, অতিলৌকিক, ঐশ্বরিক, অনিঃশেষ, ইহজন্মীয় ও জন্মান্তরীয়। কবির সৃষ্টি তাই হৃদ্য, সুন্দর, রমণীয়, বিচিত্র, মনোরম, অত্যাশ্চর্য ও অদ্ভুত বিস্ময়কর। " মানুষ বুদ্ধির পরিচয় দেয় জ্ঞানের বিষয়ে , যোগ্যতার পরিচয় দেয় কৃতিত্বে, আপনার পরিচয় দেয় সৃষ্টিতে।" সৃষ্টি করে আনন্দে। সীমার দ্বারা অসীমকে পাওয়াই আনন্দ। " আকাশ খানিকদূর পর্যন্ত আকাশ, ততটা সে সাদা। তারপরে সে অব্যক্ত, সেইখান থেকে হে নীল। " সেই নীলিমাতেই আনন্দের বিস্তার। রবীন্দ্রনাথের চিত্তই সেই আকাশ। যে আকাশ পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের ইচ্ছা দিয়ে পূর্ণ। পূর্ণের উৎসবে দেওয়া আর পাওয়া--- একই কথা। " ঝরনার একপ্রান্তে কেবলই পাওয়া, অভ্রভেদী শিখরের দিক থেকে--- কেবলই পাওয়া। আর এক প্রান্তে কেবলই দেওয়া ---- অতলস্পর্শী সমুদ্রের দিকে।"এই অন্তহীন পাওয়া আর দেওয়ার নিরবচ্ছিন্ন আবর্তনেই আনন্দের উৎসার  :

           এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়

           যে প্রাণ তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়,

           সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্ব দিগবিজয়ে,

           সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দে-তালে-লয়ে

            নাচিছে ভুবনে ; সেই প্রাণ চুপেচুপে 

            বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে

            লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরষে,

            বিকাশে পল্লবে পুষ্পে---- বরষে বরষে

            বিশ্বব্যাপী জন্মমৃত্যু সমুদ্রদোলায়

            দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ারভাঁটায়।

কবি ও গুরু রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই মহাকালের বাণী ও মহাবিশ্বের রূপ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। বেদ ও উপনিষদের সূক্ত ও সংগীত এই ঋষিকণ্ঠকে আধার করে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। কবীর-নানক-মীরাবাঈ-চৈতন্যের ভক্তিসাধনার সহজ উপাচার' গীতাঞ্জলি 'র ভাবতন্ময়তায় সংগতি লাভ করেছে। বিশ্ববিদ্যাতীর্থ প্রাঙ্গনে বিশ্বমানবের মহামিলন রচিত হয়েছে। ভগবান ও বিশ্ব একীভূত হয়ে মানুষের ধর্ম হয়ে উঠেছে---

             বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো

             সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।

                  নয়কো বনে নয় বিজনে

                  নয়কো আমার আপন মনে

             সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,

                      সেথায় আপন আমারো।

Monday, August 31, 2020

প্রবন্ধের শিরোনাম : দর্শক- দর্শন - সুজিত রেজ

 প্রবন্ধের শিরোনাম :  দর্শক- দর্শন 

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ 

সুজিত রেজ




বছরে শতখানেক নাটক দেখার সুযোগ অতি সৌভাগ্যের। নিশ্চিতরূপে  অধমের মস্তকে ভরত-অ্যারিস্টটলের আশীর্বাদ। গুচ্ছেন নাটক দেখার নেপথ্য কারণ---- " বাড়ির পাশে আরশিনগর " (রবীন্দ্রভবন)। কাঁকতালেই বলা যায়। ইচ্ছে হলে নাট্যবিরতিতে বৌয়ের হাতের চা-পানও সম্ভব। তাছাড়াও , নাটক দেখায় আমার কোনও বাছবিচার নেই। বড়-মেজো- সেজো-ন' সব দলেরই প্রযোজনায় হাজির হই।

আর নাটকের প্রতি প্যাশন যে তীব্র ; সেই ছোটবেলাথেকেই------ যেদিন ফুলকাকার রূপান্তর ও  পরিচালনায় বঙ্কিমের " কপালকুণ্ডলা "-য় মা কালীর ভূমিকায় মঞ্চে উঠেছিলাম। তখন আমি ক্লাস টুয়ের ছাত্র। মেক্আপ করার পর আয়নায় রক্তাক্ত লোলজিহ্বা ( দন্ত পিষ্ট টিনের পাত ) ও

কালিবরণ দেখে কাপড়ে-চোপড়ে হয়েছিল। সেইদিন থেকেই-------


মন মোর নাটকের সঙ্গী 

উড়ে চলে দিগ্‌দিগন্তের পানে

নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে

রিমিঝিম   রিমিঝিম   রিমিঝিম॥


মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে

ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে।

ঝঞ্জনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে।

কলকল কলমন্দ্রে নির্ঝরিণী

ডাক দেয় প্রলয়-আহ্বানে॥


বায়ু বহে পূর্বসমুদ্র হতে

উচ্ছল ছলো-ছলো তটিনীতরঙ্গে।

মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে

তাল-তমাল-অরণ্যে

ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে॥



নাটক দেখতে গিয়ে কখনও চমকাই , কখনও দুঃখ পাই। নাট্যদলগুলির প্রযোজনার মান শেয়ার বাজারের সেনসেক্স-এর মতো ওঠানামা করে। শিল্পের স্বভাব বোধহয় তাই-ই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি হতাশ হই দর্শকের মান ও নগণ্য উপস্থিতি দেখে। কোনো কোনো দলের কল-শো দেখতে ভিড় উপচে পড়ে  ;  আবার , পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত নাট্যোৎসবে ওই দলেরই , একই নাটক দেখার জন্য দর্শকদের মধ্যে কোনও উৎসাহ থাকে না , প্রবেশ অবাধ থাকলেও। হয়ত কল-শোর আয়োজন করে স্থানীয় কোনও সংস্থা বা সংগঠন ; তাদের প্রচার ও কানাকানি প্রভাব ফেলে। 



চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় দর্শকদের একাধিক শ্রেণি চিহ্নিত করা যায। প্রথমত , জাম্বু-দর্শক।   নতুন বিয়ের পর , শালা-শালি-মাসশাশুড়ি- পিসশ্বশুর সহ সদলবলে নাটক দেখা। বিরতিতে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও , দু'হাতের মুঠোয় মোবাইলের সঙ্গে পাঁচ-ছ প্যাকেট ঘটি ভাজা নিয়ে , গলদঘর্ম দেহে জামাইবাবুর এন্ট্রি। দশ মিনিটের মধ্যে এক্সিটের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বধূটির বিরহিনী হয়ে ওঠার মহড়াও চলে এই অবকাশেই।  সিনেমার বদলে নাটক বেছে নিয়ে  নিজের রুচিবোধের প্রমাণ রাখার তাগিদও থাকে  জামাইবাবুর  ষোলো আনা। 



দ্বিতীয়ত , হুজুগে- দর্শক। নাটক হচ্ছে , যাওয়া যাক। এঁদের অনেকেই , নাট্যবিরতিতে হিসি করতে গিয়ে আর ফিল্ডিং করতে পছন্দ করেন না। এঁদের সংলাপপ্রীতি তারিফ-যোগ্য। তবে শোনার চেয়ে বলার দিকে অতিমাত্রিক ঝোঁক। গম্ভীর ট্র্যাজেডিকে এঁরা অনায়াসে কমেডিতে রূপান্তরিত করে নেয়। ফলে, নিয়তির তাড়নায় ট্র্যাজিক নায়কের পৌরুষ যখন ভুলুণ্ঠিত , পাশের সিটের দর্শকের চোখ ছলছল , এঁরা তখন ' হেসে খলখল ' । তালি দেওয়ার জন্য এঁদের হস্তযুগল সদাই উচাটন। 



তৃতীয়ত , মোবাইল-দর্শক।  আমৃত্যু মোবাইলে চোখ রাখার ধনুক ভাঙা পণ এঁদের। নাটক শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত  এঁরা বন্ধুদের হাঁড়ির খবর নিতে ব্যস্ত।  ওল খেয়ে গলা কত ডিগ্রিতে কুটকুট করেছিল , বৌয়ের সর্দিতে বেলাডোনা কেন কাজ করছে না---- নাটক তো শুরু হয়নি বলে নেওয়া যেতেই পারে। থার্ড বেল বাজার পর , ঘোষক যখন বলেন , অনুগ্রহ করে আপনার মোবাইল নিষ্ক্রিয় করে রাখুন ,  এঁরা শুধু ' বয়েই গেছে ' বলে না , কাঁচা খিস্তিও মারে। অভিনয়ের মাঝপথে এঁদের মোবাইল বেজে ওঠে  : ' যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে '। প্রসঙ্গক্রমে , দুটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নেওয়া যেতে পারে।দুটিই চাঁটি মারার ঘটনা। চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে নান্দীকারের         ' অজ্ঞাতবাস '-এর অভিনয় চলাকালীন , এক দর্শকের মোবাইল বেজে উঠলে , রুদ্রপ্রসাদবাবু বিরক্ত হয়ে সাময়িক অভিনয় বন্ধ করে দেন। নাট্যবিরতির পরের অভিনয়ে ওই দর্শকেরই মোবাইল আবার জেগে ওঠে : ' মার ঝাড়ু মার ঝাড়ূ মেরে ঝেঁটিয়ে বিদায় কর '। পাশের দর্শক চার অক্ষরের কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলে ওঠেন  :       ' ঝাড়ু মেরে তোকেই হল থেকে বিদেয় করে দেব '। ঠিক তৎক্ষণাৎ , তাঁর বুকপকেটে আলো জ্বলে ওঠে। গান বেজে ওঠে : ' তোমার হল শুরু আমার হল সারা '। এরপর শুধু  চাঁটি - চাঁটি-চড়চাপাটি। দ্বিতীয় চাঁটির ঘটনার সাক্ষীা হলুম এই জানুয়ারিতেই। প্রথামাফিক থার্ড বেল বাজল। দর্শকদের উদ্দেশে মোবাইল নিষ্ক্রিয় করার অনুরোধ জানানো হল। ড্রপ সিন নড়ছে--- সরবে-সরবে করছে। মোবাইল  বেজে উঠল। না কোনও গান নয় , বিএসএনএল মার্কা রিং টোন। ক্রি-ক্রি-ক্রি-----ং। একজন  বয়স্কার গলা পাওয়া গেল :   " যা বাবাঃ ! কোথায় রাখলাম রে ফোনটা "। একজন সহদর্শক বেশ জোরে চেঁচিয়ে বললেন : " বন্ধ করুন। অভদ্র "। ততক্ষণ বেশ কয়েকবার রিং হয়ে সুকণ্ঠী জানিয়ে দিলেন : দ্য পারসন য়ু আর কলিং , ইজ্ নট আনসারিং। আবার রিং ----- ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। পাশের দর্শককে বললেন :" দেখুন তো , ডিসপ্লেতে কার নাম ---- আমি চোখে ভালো দেখি না "। ততক্ষণে তাঁর মাথায় চাঁটি পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বুঝে যাই নাটকও শুরু হয়ে গেছে।


চতুর্থত ,  সহৃদয়-দর্শক। এঁরা চান আগের তিন শ্রেণির দর্শকের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশাধিকার বন্ধ হোক। ভিড়ের সংসর্গে উপভোগ-বিব্রত হতে চান না তাই । এঁরা  কিউবদ্ধ হয়ে হলে প্রবেশে সঙ্কোচ বোধ করেন।। এঁরা যে নাট্যপরিধিতে স্বতন্ত্র গ্রহের জীব , তা তাঁদের চলন-ধরণ-করণ-গড়ন থেকে বোঝা যায়।  এঁরা নগদ বিদায়ে প্রবেশপত্র গ্রহণে গড়িমসি করেন। নাট্যদলগুলির আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার প্রত্যাশায় তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন। নাট্য আকাদেমির সদস্য তো হলে কেল্লা ফতে ! নাটক শুরুর আগে ও সমাপ্তির পর সাজঘরে ঢুঁ মারেন। নাট্যবিরতিতে সিগরেটের ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে নাট্যার্ধ নিয়ে কচুকাটা করেন। পরার্ধে পরিণতির সম্ভাবনা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন। এঁরা মনে করে থাকেন , শিশির-শম্ভু-অজিতেশের পরে বাংলা নাট্য কলাবৌ। ঘোমটা তুলবে কে---- কবে--- জানার জন্য গণেশের দ্বারস্থ হয়ে লাভ নেই।  এঁদের চলভাষ রুদ্ধ ,  কটাক্ষ শুদ্ধ , কথন দুর্বোধ্য।


এবার ছুঁচো গেলার পালা। পাশে বিসলারি রাখতেই হল। আমার আবার গলায় লকগেট। কখনও খাদ্যনালি , কখনও শ্বাসনালি খোলে  আবার অচানক বন্ধও হয়। তখন পিঠে -পেটে প্রেসার দিতে হয়। " পিঠে খেলে পেটে সয় '----    প্রবচন উদ্ভবের  কারণ বুঝি এখন। ছুঁচো কেত্তন করতে - করতে কেমন পারা ভারত-নাট্যম দেখাবে ভগাই জানে। কেন না , প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক  আমি  কোন শ্রেণির দর্শক । তার উত্তর না- দিয়ে শঙ্খ বাজানোই বুদ্ধিমানের কাজ  : 


তোমার কোনো ভিত্তি নেই 

তোমার কোনো শীর্ষ নেই                        

             কেবল তক্ষক

তোমার কোনো উৎস নেই

তোমার কোনো ক্ষান্তি নেই

               কেবল ছন্দ 

তোমার কোনো মিথ্যা  নেই

তোমার কোনো সত্য নেই

               কেবল দংশন

তোমার কোনো দৃষ্টি নেই

তোমার কোনো শ্রুতি নেই

                 কেবল সত্তা


       


          

Saturday, July 25, 2020

প্রবন্ধ : সুজিত রেজের কলমে


প্রবন্ধের শিরোনাম  : কবিতা  মাঘরজনীর সবিতা
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -

 -

কবিতা একলা মানুষ ও একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরের একসুরে গাওয়া গান  :

             " অন্তর মাঝে বসি অহরহ
               মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ ,
               মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
                            মিশায়ে আপন সুরে।
               কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই ,
               তুমি যা বলাও আমি বলি তাই ,
               সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই ,
                           কোথা ভেসে যাই দূরে।
                         ( অন্তর্যামী : রবীন্দ্রনাথ )

কবিতা শিল্পের সংসারে একাকিত্বের শিল্পিত সংরাগ  :
          " সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে
                নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল। 
      তাকে বলি : এই তো তোমারই
                ঠিকানালেখা চিঠি, ডাকে দেব, 
      তুমি মন পড়া জানো নাকি ?
                        এলে কোন ট্রেনে ? 
       আসলে এ নির্জনতা নয়। ফুটপাথে
                        কেনা শান্ত, নতুন চিরুনি। 
       দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ
                         কালো চুল লেগে আছে।" 
                        ( রাক্ষস : উৎপলকুমার বসু )

কবিতা সামাজিক স্খলন-বিচ্যুতির পরিণামী ক্রোধের তলদেশ থেকে উত্থিত আগুনের ফুলকি  :

       " যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে
                                           ভয় পায় 
                      আমি তাকে ঘৃণা করি 
         যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক
                                          হয়ে  আছে 
                      আমি তাকে ঘৃণা করি 
         যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি 
          প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ
                                               চায় না 
                        আমি তাকে ঘৃণা করি----- 
            ( এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না :
                               নবারুণ ভট্টাচার্য  )
                           
কবিতা সম্পর্কের উন্নতি-অবনতি-স্থিতাবস্থার সাপেক্ষে স্থিতধী অথবা অস্থির চিত্তঘোর :

          " ভালোবাসা সবই খায়-----
                          এঁটোপাতা, হেমন্তের খড় 
          রুগ্ন বাগানের কোণে পড়ে থাকা
                           লতার শিকড় 
          সবই খায়, খায় না আমাকে 
          এবং হা করে রোজ আমারই
                         সম্মুখে বসে থাকে । "
                         (   সব হবে  :
                            শক্তি চট্টোপাধ্যায় )
                   
কবিতা অধরা সৌন্দর্যের সন্নিধানে অহেতুক বিহারবিলাসী প্রবণতা  :
               
            " শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
              কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
              শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝঙ্কার
              আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
              শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।।  "
                    ( প্রেমের কবিতা : বুদ্ধদেব বসু )

কবিতা মেধা-মনন-হৃদয়ের ঘোর লাগা শব্দকুহক ও মায়াজালবদ্ধ ধ্বনিপুঞ্জে স্খলিত জ্যোৎস্না  :
     
   " কবিতা কী শুধু দণ্ড দুই কারিগরি কুশলতা
     চিত্র ও সঙ্গীতময় শব্দের মচ্ছব
     কেবল ছন্দের সম্মোহন আর অণৃত ভাষণ?"
                   ( হে কবিতা কোথায় ট্রিগার  :
                                 কবিরুল ইসলাম )

কবিতা অভূতপূর্ব , অনাস্বাদিত বিস্ময়-ব্যাপ্তির মনোরম একোক্তি  :
   
     দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের
                       অন্ধকারে হয়েছে হলুদ , 
     হিজলের জানালায় আলো আর
                      বুলবুলি করিয়াছে খেলা, 
     ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো
                       রোমে মাখিয়াছে খুদ, 
     চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা
                       রূপ হয়ে ঝরেছে দু'বেলা 
     নির্জন মাছের চোখে---- পুকুরের পাড়ে
                         হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে 
      পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ---- মেয়েলি হাতের
                         স্পর্শ লয়ে গেছে তারে ; 
       
 কবিতা রমণীয় , কমনীয় , রসময় রচনা  :

      " তোমার যোগ্য গান বিরচিব বলে
         বসেছি বিজনে, নব নীপবনে,
         পুষ্পিত তৃণদলে।
         শরতের সোনা গগনে গগনে ঝলকে ;
         ফুকারে পবন, কাশের লহরী ঝলকে ;
         শ্যামসন্ধ্যার পল্লবঘন অলকে
         চন্দ্রকলার চন্দনটীকা জ্বলে। "
                     ( নান্দীমুখ : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ) )


মহামুনি বাল্মীকির নিখাদ দুঃখবাদী উচ্চারণে কবিতার নিদ্রাভঙ্গ :

 মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
 যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমবীবধঃ কামমোহিতম্।।

তারপর কালিদাসের পূর্ব মেঘের উত্তর মেঘে সরণ---- অজয়ে এসেছে বন্যা জয়দেবের ভাঙা সংস্কৃত ছন্দের টানে ----বিদ্যাপতির ব্রজবুলিতে মিশে গেছে সেই তরঙ্গনাদ----চণ্ডীদাসের রামী মাথায় তুলে নিয়েছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল ফুলিয়া-পুঁটুলি।


সৃষ্টির সোনার তরী ধীরে সমীরে যমুনা তীরে,ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি মেখেছে। সমান্তরালে সৃষ্টি ও স্রষ্টার অন্যোন্য সম্পর্ক নির্বাপনে , রহস্যময় সৃষ্টি ব্যাখ্যাত নয় জেনেও , নিরাসক্ত পরিচ্ছিন্ন তাত্ত্বিক-মনে জেগেছে অনন্ত-অন্তহীন কৌতূহল। কবে তার ইতি সকলেরই অজানা। তাই বোধহয় , অ্যারিস্টটল বলেছিলেন :" কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি , ইতিহাসের চেয়েও বড়।" সমসাময়িক ( আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী ) আচার্য ভরতও একই মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। এর কারণ , কাব্যচেতনা বিজ্ঞানের মতোই সর্ববাদীসম্মত। এমনকি , যেখানে বিজ্ঞান-দর্শনের শেষ , সেখান থেকেই কাব্যের বহতার সূত্রপাত। কবি তাই ঋষিতুল্য , মেধাবী , ক্রান্তদর্শী , মনীষী , প্রাজ্ঞ এবং   সর্বজ্ঞ । কবি মনুষ্যচরিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বোদ্ধা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্বুদ ঝঙ্কৃত সুর কবির কানেই অনুরণিত হয়। কবিকে বিশ্ববিধাতার চেয়েও অধিক শক্তিধর বলে মনে করেছেন অনেকেই। তাঁদের অভিমত, ঈশ্বর বিশ্ববিধানে নিয়মনিগড়িত , কিন্তু  কবি-কল্পতাঁদের অভিমত, ঈশ্বর বিশ্ববিধানে নিয়মনিগড়িত , কিন্তু  কবি-কল্পনার ভাবরাজ্য সর্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র। প্রতিভাগুণ কবির সহজাত ; যদিও বুৎপত্তি ও অভ্যাসের দ্বারা প্রতিভা অমিত শক্তি অর্জন করে। এই শক্তি তূরীয় , দিব্য , অতিলৌকিক , ঐশ্বরিক, অনিঃশেষ , ইহজন্মীয় ও জন্মান্তরীয়। কবির রচনা তাই হৃদ্য, সুন্দর , রমণীয় , বিচিত্র , মনোরম , অত্যাশ্চর্য ও অদ্ভুত।

যার ব্যাখ্যায় , খ্রিস্টপূর্ব আমলেই , প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্যে  সাহিত্যতত্ত্ব - নন্দনতত্ত্ব- সমালোচনাশাস্ত্র- সৌন্দর্যশাস্ত্র- কাব্যজিজ্ঞাসা- কাব্যমীমাংসার সূত্রপাত। নাট্যশাস্ত্র ( ভরত ), কাব্যাদর্শ ( দণ্ডী ), কাব্যালঙ্কার ( ভামহ ), কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তিঃ  ( বামন ),  দশরূপক,          ( ধনঞ্জয় ), ধ্বন্যালোক ( আনন্দবর্ধন ), কাব্যপ্রকাশ ( মণ্মট ), কাব্যালঙ্কার ( রুদ্রট ),
কাব্যালঙ্কার সারসংগ্রহ ( উদ্ভট ), অভিনবভারতী ( অভিনব গুপ্ত ), রসগঙ্গাধর ( জগন্নাথ ), বক্রোক্তিজীবিতম্ ( কুন্তক ), কাব্যমীমাংসা        ( রাজশেখর ), ঔচিত্যবিচারচর্চা  ( ক্ষেমেন্দ্র ), সাহিত্যদর্পণ ( বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ), দশরূপক       ( ধনঞ্জয় ), সরস্বতীকণ্ঠাভরণ ( ভোজরাজ ),   (  উজ্জ্বলনীলমণি ( শ্রীরূপ গোস্বামী ) প্রভৃতি গ্রন্থ প্রাচ্য আলঙ্কারিকদের উপাচার। প্রতীচ্যেও সমান্তরাল প্রবাহ   :   Poetics  ( অ্যারিস্টটল ), Ars Poetica ( হোরেস ), Sublime ( লংগিনাস ), An Apology for Poetry ( ফিলিপ সিডনি ), A Philosophical Enquiry into the Origins of the sublime and the  Beautiful ( এডমান্ড বার্ক ), An Essay on Criticism ( আলেকজান্ডার পোপ ), What is Poetry (জন স্টুয়ার্ট মিল ), Preface to the Lyrical Ballads , Poetry and Poetic Diction ( উইলিয়ম্ ওয়ার্ডসওয়ার্থ ),  A Defence of Poetry ( পি বি শেলি ), Biographia Literaria  ( সামুয়েল টেলর কোলরিজ ), The Four Ages of Poetry          ( টমাস্ লভ্ পিকক ), What  is Poetry ( জন স্টুয়ার্ট মিল ), The Poet ( রালফ্ ইমারসন ), The Poetic Principle    ( এডগার অ্যালান পো ), Poetry for Poetry's Sake , Oxford Lectures on Poetry ( ব্রাডলি ), The Study of Poetry ( ম্যাথু আর্নল্ড ), Practical Criticism (আই এ রিচার্ডস্ ),  The Idea of Great Poetry ( এবারক্রম্বি ), Poetry and Abstract Thought  (পল ভ্যালেরি ) The Hero as Poet ( কার্লাইল ) Principles of Criticism  ( ডাবলিউ বি ওয়ার্সফোর্ড ।


সপ্তম শতাব্দীর আলঙ্কারিক ভামহর কাছেই আমরা প্রথম কাব্যের সংজ্ঞা পাই  : " শব্দার্থ সহিতৌ কাব্যম্।" পরবর্তী সময়ে আচার্য রুদ্রট   ( " ননু শব্দার্থৌ কাব্যম্।" ), মণ্মট ( " তদদোর্থে সগুণাবনলঙ্কৃতৌ পুনঃ ক্কাপি।" ), বিদ্যাধর ( " শব্দার্থৌ বপুরস্য।" ), এমনকি কালিদাসের ( " বাগর্থৌ ইব সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপত্তয়ে।" )     ভাষ্যে ভামহরই প্রতিধ্বনি। তবুও ভামহর  ' সহিতৌ ' শব্দ নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকে। কাব্যের স্থানে ' সাহিত্য ' পরিভাষা প্রথম প্রয়োগ করেন আচার্য রাজশেখর  : " শব্দার্থয়ো র্যথাবৎ সহভাবেন বিদ্যা সাহিত্যবিদ্যা "। ভামহর ' সহিত ' শব্দের গুণবাচক বিশেষ্য রূপে ' সাহিত্য ' শব্দনির্মাণ। রাজশেখরের মতে , শব্দার্থের যে সম্পর্ক , তাই-ই সাহিত্য। শব্দ ও  অর্থের বাহুল্যশূন্য মিলনে গড়ে ওঠা অলৌকিক বিন্যাসভঙ্গিকে আচার্য কুন্তক সাহিত্য বলেছেন।বক্রোক্তিবাদী কুন্তকের স্পষ্ট অভিজ্ঞান :"বাচকো বাচ্যং চ ইতি দ্বৌ সম্মিলিতৌ কাব্যম্ "।
সহিতৌ ও সম্মিলিতৌ সমার্থক। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে  : " সহিত শব্দ হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি। অতএব ধাতুগত অর্থ ধরিলে সাহিত্য শব্দের মধ্যে একটি মিলনের ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। সে যে কেবল ভাবে-ভাবে, ভাষায়- ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন তা নহে ----- মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানের, দূরের সহিত নিকটের, অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগ-সাধন সাহিত্য ব্যতীত আর কিছুর দ্বারাই সম্ভবপর নহে " ( সাহিত্য )।

মনুষ্য হৃদয়ের  ভাবজাত বচনের  রচনই  হল কবিতা। শব্দার্থ হল ভাষা বা বচন। শব্দ স্মৃতি। শব্দ অভিজ্ঞতা। শব্দ গান। শব্দ বাইরের দরজা।।   কাব্যভাষার অর্থবোধক ও স্বাধীন একক মুক্ত রূপিমই হল শব্দ।  শব্দ থেকে শব্দাতীত জগৎ ছোঁয়ার দক্ষতাই হল কবির রচন। বচনের রেচনেই রচনের সিদ্ধি। বচনের রেচন- সংঘটনের উপরেই স্রষ্টার মূল্যায়ন হয়। সাহিত্যের ভাষা ' highly organized '। সাহিত্যের ভাষার লক্ষ্য ' expression '। পবিত্র সরকার লিখেছেন  : " এখানে ভাষা বক্তব্যকে অতিক্রম করে নিজেই সামনে এসে দাঁড়ায়।বলে ----- ' আমাকেও লক্ষ্য করো  , এখানে 'আমি ' অর্থের চেয়ে কম লক্ষণীয় নয়,কখনও কখনও অর্থের চেয়ে 'আমিই ' বেশি করে চোখে পড়তে চায়।" ( কবিতার ভাষা ) এই কারণেই সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে নিভাষা।

অষ্টম শতাব্দীর আলংকারিক আচার্য বামনের " কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলঙ্কারাৎ " মন্তব্য এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করে যে , সমগ্র কাব্যালোক- কূটমন্তব্যগুলিই অলঙ্কার-শাস্ত্র রূপে পরিচিতি পেয়ে যায়। অলঙ্কার-সংজ্ঞায় ষষ্ঠ শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডীর অভিমত  : " কাব্যশোভাকরান্ ধর্মান অলঙ্কারান্ প্রচক্ষতে।" অর্থাৎ , কাব্যের শোভাই অলঙ্কার। তাঁর মন্তব্যে সংস্কৃত ' অলম্ ' ধাতুর বাচ্যার্থ ' ভূষণ ' বিধৃত। বামনেও তা পুনরাবৃত্ত  : " সৌন্দর্যম্ অলঙ্কারঃ "যদিও অনেকেই অলঙ্কারের সংকীর্ণ অর্থ শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার মান্যতা দিয়ে বামনের অলঙ্কারবাদকে অতিব্যাপ্ত ও অব্যাপ্ত দোষে দুষ্ট বলে আক্রমনেও উৎসাহিত হলেন। অলঙ্কার থাকলেই বাক্য কাব্য হয়----- তা  যে অতিব্যাপ্ত বচন , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কেননা নিরলঙ্কৃত বাক্যের সার্থক কাব্য হয়ে ওঠার পর্যাপ্ত উদাহরণ মেলে। আবার অলঙ্কৃত বাক্যের ব্যর্থ কাব্যে পর্যবসিত হওয়ার ঝুরি ঝুরি দৃষ্টান্তও আছে।

বামন তাই " কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ" গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানালেন :" রীতিরাত্মা কাব্যস্য"। এই প্রথম কাব্যের স্বরূপ আলোচনায় 'আত্মা' শব্দের সংযোগ ঘটল। ফলে দেহ ও দেহাতীত ধারায় কাব্যচেতনার উন্মেষও ঘটল। পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিকে বামন রীতি বলে চিহ্নিত করলেন। অলঙ্কারকে রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু বললেন।
বামন তাই " কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ" গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানালেন :" রীতিরাত্মা কাব্যস্য"। এই প্রথম কাব্যের স্বরূপ আলোচনায় 'আত্মা' শব্দের সংযোগ ঘটল। ফলে দেহ ও দেহাতীত ধারায় কাব্যচেতনার উন্মেষও ঘটল। পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিকে বামন রীতি বলে চিহ্নিত করলেন। অলঙ্কারকে রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু বললেন। অর্থাৎ , অলঙ্কার ব্যবহার বা বর্জন কবি- ব্যক্তিত্বের মর্জি। ফলত অলঙ্কার গৌণ হয়ে পড়ল। রীতির ইংরেজি পরিভাষা রূপে style শব্দ ব্যবহার হলেও দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। style ব্যক্তিত্ব-সম্পৃক্ত ; রীতি ভৌগোলিক অনুষঙ্গ জাত। বস্তুবাদীরা কাব্যের স্বরূপ নির্ণয়ে  অলঙ্কার ও রীতিবাদীদের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। তাঁদের মতে , " কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভর করে বস্তু বা ভাবের বিশিষ্টতার উপর।" বস্তু হল বক্তব্য, ভাব মনুষ্য-চিত্তবৃত্তি। গভীর বক্তব্য এবং মহৎ ভাবের উপাচারে কাব্যের শ্রেষ্টত্ব নির্ণীত হয়। বস্তুবাদীরা মনে করেছেন , মহাকবিদের সৃষ্টিতে বিষয়বস্তুর অতলান্তিক রূপ এবং মহৎ ভাবেরই স্ফুরণ ঘটে  অভিনব শব্দার্থ , অলঙ্কার , রচনাভঙ্গির চলাচলে। কিন্তু ধ্বনিবাদীরা সম্পূর্ণ বিপরীত পথে জোরের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন  :" শ্রেষ্ঠ কাব্যের প্রকৃতিই হল বাচ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। "

কাব্যের এই বাচ্যাতিরিক্ত ধর্মান্তরের অভিব্যঞ্জনার পারিভাষিক রূপ ধ্বনি।ধ্বনি- কারিকার প্রবক্তা অজ্ঞাত। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা          ' ধ্বন্যালোক '-এর বৃত্তিকার নবম শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য আনন্দবর্ধন। দশম-একাদশ শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য অভিনব গুপ্তের লোচন টীকায় যার সর্বভূতেষু রূপ প্রাপ্তি। ধ্বন্যালোক গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছদেই লেখা হয়েছে  : "  কাব্যাস্যাত্মা  ধ্বনিঃ "। শব্দার্থের মধ্য দিয়ে যে- কথাবস্তু প্রকাশ পায় , তা কাব্য হলে , অভিধান- নির্ভর কাব্যচর্চার জগৎ উন্মুক্ত হত। এই পথ অবারিত না হওয়ার কারণ , শ্রেষ্ট সৃষ্টি বাচ্যার্থ নির্ভর হয়েও বাচ্যাতিরিক্ত বিষয়ের ব্যঞ্জনা দান করে। রবীন্দ্রনাথের গান " ফাগুন লেগেছে বনে বনে " ছাপাখানায় ' আগুন ' হয়ে যাওয়ার কারণ ব্যঞ্জনাবোধের অভাব। আনন্দবর্ধন কাব্যব্যঞ্জনাকে রমণীদেহের লাবণ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন  :
            প্রতীয়মানং পুনরন্যদেব   
                   বস্ত্বস্তি বাণীষু মহাকবীনম্।
            যত্তৎ প্রসিদ্ধাবয়বাতিরিক্তং
                   বিভাতি লাবণ্যম্ ইবাঙ্গনাসু।।
শেলিও লিখেছেন  : " A great poem is a fountain for ever over-flowing with the waters of wisdom and delight ; and after one person and age has exhausted all its divine influence which their peculiar relations enable them to share , another succeeds , and new relations are ever developed , the source of an unforeseen
and unconceived delight. " ( A Defence of Poetry)

তবে যে-কোনো ব্যঞ্জনাই ধ্বনি নয়। ধাঁধা-হেঁয়ালির ব্যঞ্জনা যেমন ; একবার পর্দা সরে গেলে আগ্রহ হারায়। কৌতূহল সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়। কাব্যের ধ্বনির রেশ থেকে যায়। ঘণ্টাধ্বনির স্বননের মতো। " যে-বাঁশিতে বাতাস কাঁদে , সেই
বাঁশিটির সুরে সুরে " দূরে দূরে ভেসে বেড়ায়। ডিজে-নৃত্যে শরীর ক্লান্ত হয় , শাস্ত্রীয়-নৃত্যে দেহমনে অনির্বচনীয় স্ফূর্তির সঞ্চার ঘটে। শব্দ ও অর্থ ব্যঙ্গ্যতে প্রতিষ্ঠিত হলে ধ্বনি হয়ে ওঠে।
আনন্দবর্ধন ধ্বনির তিনটি সরল শ্রেণিবিভাগ করেছেন  : বস্তুধ্বনি , অলঙ্কারধ্বনি ও রসধ্বনি। বস্তু বা অলঙ্কারের ব্যঞ্জনায় বাচ্য কাব্য হয়ে ওঠে না। কাব্যের ধ্বনি রসধ্বনি। রসের ব্যঞ্জনায় বাক্য কাব্য হয়। রস ' সহৃদয়হৃদয়সংবাদী '। রস ও কাব্য অলৌকিক মায়াজগৎ গড়ে তোলে।  ভাবের রসমূর্তি দানে কবিকে লৌকিক পরিমিতত্ব অতিক্রম করতে হয়। কবির এই গুণকেই দার্শনিক ক্রোচে Poetic ldealization বলেছেন। Poetic ldealization জাত ভাব-বর্ণনা ( বিভাব-অনুভাব ) সহৃদয়ের বাসনালোকে  অলৌকিক রসমণ্ডিত হয়ে ওঠে।ওয়ার্ডসওয়ার্থ ' Lyrical Ballads '-এর মুখবন্ধে সেটাই লিখেছেন  : " Poetry takes its origin from emotion recollected in tranquility "তারও আগে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ( চতুর্দশ শতাব্দী) ' সাহিত্যদর্পণ ' গ্রন্থে জানিয়ে গেছেন  :
      বিভাবেনানুভাবেন ব্যক্তঃ সঞ্চারিণা তথা।
      রসতামেতি রত্যাদি স্থায়ী ভাবঃ সচেতসাম্।।


ভরতের " নাট্যশাস্ত্র " থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ত্রিশটির বেশি কাব্যতত্ত্বমূলক মৌলিক গ্রন্থ এবং একাধিক টীকা-টিপ্পনি জাত আলঙ্কারিকদের মূল ভাবনা  :

ক) গুণপ্রস্থান  : শব্দ ও অর্থের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ গুণমানের বৈচিত্র্যময় প্রকাশেই কাব্যের উৎকর্ষতা। কাব্যশোভার ধর্মবিশেষই হল গুণ।যেমন - শ্লেষ , প্রসাদ , সমতা ,সুকুমারতা , ওজঃ, কান্তি , মাধুর্য ,সমাধি প্রভৃতি।                       
 খ) অলংকারপ্রস্থান  : শব্দ ও অর্থের শিল্পিত মণ্ডনকলাই কাব্যসৌন্দর্যের আকর।প্রতিভা অনন্ত,অলঙ্কারও অনন্তপ্রকার।অলঙ্কাররসাদিরও  পুষ্টি ঘটায়।
গ) বক্রোক্তিপ্রস্থান  : কবির বাঙ্ময়ের প্রধান আকর্ষণ বক্র উক্তি অর্থাৎ উক্তিবৈচিত্র বা শব্দের শিল্পিত প্রয়োগসুলভ বাগবৈদগ্ধ্য।প্রারম্ভিক উপলব্ধিময় দৃষ্টির মৌলিক ঐক্য, প্রাণগত সমগ্রতা ও  সারূপ্যের ভিত্তিতে নির্মিত গুণ, অলঙ্কার , ধ্বনি সবই বক্রোক্তির অন্তর্ভুক্ত।
ঘ) ধ্বনিপ্রস্থান  : গুণ ,অলঙ্কার,বক্রোক্তি প্রভৃতি বিশিষ্ট  বাগব্যবহারলব্ধ  অর্থ যে সৌন্দর্য , চারুত্ব বা রমণীয়তা নামক মানসিক রসাস্বাদন ঘটায় , তাই ধ্বনি। শ্রেষ্ঠ কাব্যে কাব্যার্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সহৃদয় পাঠকের অনুভববেদ্য হয়।
ঙ) রসপ্রস্থান  : সহৃদয় চিত্তের আনন্দময় সম্বিৎ রস। কাব্যের বিভাব-অনুভাব এবং স্থায়ী- সঞ্চারী চিত্তবৃত্তির সংযোগে সহৃদয়ের বাসনালোকে রসের নিষ্পত্তি।
প্রতীচ্যের স্রষ্টা- কূটতার্কিকদের অনেকেই কাব্য- কবিতা নিয়ে নানান সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন। প্রাচ্যবাদীদের মতোই সেইসব কলাকৈবল্যবাদী ব্যক্তিক কূটভাষ কখনও কাব্যের শরীর অথবা আত্মাভিত্তিক। প্রসঙ্গত কতকগুলি স্মরণ করা যাক  :
 
মালার্মে  : কবিতা রচিত হয় শব্দে , আইডিয়ায়
                নয়।
ইয়েটস  : কবিতা হল---- রক্ত , কল্পনা আর                         বোধের যৌথযাত্রা।
কার্লাইল  : কবিতা হল মিউজিক্যাল থট।
জনসন  : কবিতা হল মেট্রিক্যাল কম্পোজিশান।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ  : কবিতা সব জ্ঞানের শ্বাসপ্রশ্বাস
               আর সূক্ষ্ম আত্মা।
কোলরিজ  : গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে
               সাজানো।আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট
               শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।
শেলি  : কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই
             সার্থক হয় যখন কবিমনের পরিতৃপ্তিতে
             পূর্ণতা আসে।
কিটস্  : কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম                             অপরিমেয়তায় , একটি মাত্র ঝংকারে
             নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই
             সর্বোত্তম চিন্তা। যা ক্রমশ ভেসে উঠছে
             তার স্মৃতিতে।
মেকল  : কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প ,
             যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে ,
             যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।
টি এস এলিয়ট : কবিতা রচনা হল বক্তব্যকে                   কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।

অর্থাৎ  কবিতার দুটি দিক---- অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ। অন্তরঙ্গে বিষয়ের বুদবুদ ; বহিরঙ্গে প্রকাশ- প্রসাধন। হাঁটা ও হাঁটার ভঙ্গি এক নয়। দুয়ের মধ্যে ঝুলবারান্দা আর রান্নাঘরের তফাৎ। একটায় রুচি অপরটিতে ভাঁড়ার উপচে পড়া জীবনফসল।  তুল্যবিচারে , বিষয় অপেক্ষা প্রকাশ মুখ্য। বহু দীর্ঘজীবী কবির জীবনফসল অপরিমেয় কিন্তু ঝুলবারান্দায় বসলে তাদের ঠাণ্ডা লাগে।  তাই কবিতায় অপ্রকৃতের কাছে হার মেনে প্রকৃত বারবার হার মানা হার গলায় পরিয়ে দেয়। যেমন , ভোরের বর্ণনায় দীনবন্ধু   লিখেছেন  :

" ভোর হল রে ফর্সা হল ফুটল কত ফুল।
কাঁপিয়ে পাখা নীল পতাকা জুটল অলিকুল"।।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  :
   " আলোর রং যে বাজল পাখির রবে "।

নজরুল লিখেছেন ;
 " ভোর হল দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে।
   ওই ডাকে জুঁই শাখে ফুল-খুকি ছোটো রে।।
   রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই।
   দারোয়ান গায় গান শোনো ওই রামা হৈ "।।

জীবনানন্দ লিখেছেন  :

 ভোর , 
 আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো                                                      কোমল নীল 
 চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ
                  টিয়ার পালকের মতো সবুজ। 
 একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে ; 
 পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে                                          গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো 
 কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে 
 যে-মুক্তা আমার নীল মদের
                             গেলাসে রেখেছিল। 

 চারটি বর্ণনার মধ্যে জীবনানন্দের কবিতাংশ সহৃদয়-চিত্তে উপভোগ-মাত্রা অনায়াস অতিক্রম করে।সত্যেন্দ্রনাথ,নজরুলের রচনা চিত্রকাব্যের অতিরিক্ত কিছু নয়। আলোর রং বেজে ওঠার মধ্যে যে ইন্দ্রিয়-বিপর্যয় , তা রবীন্দ্র-রচনের কলাকৈবল্য। কিন্তু জীবনানন্দীয় বচনের রেচন পাঠকের মদির কল্পনাশক্তির প্রত্যাশার ঘনিষ্টতা দাবি করে। চিত্র ও চিত্রকল্পের যোজন তফাৎ উপলব্ধ হয়।

যত ধুলো খাই , তত প্রেম পাই। যতদিন মানুষ ততদিন প্রেম , যতদিন প্রেম ততদিন মানুষ। প্রেমের কবিতা লিখতে লিখতে কখন তা পরমের ছোঁয়ায় বিনিসুতোর মালা হয়ে যায়।  চিরন্তন এই অনুভূতি প্রকাশে চণ্ডীদাস লিখেছেন  :
   " পিরিতি বলিয়া এ তিন আখর
                      এ তিন ভুবন সার
   এই মোর  মনে  হয়  রাতিদিনে
                      ইহা বই নাহি আর।"

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  :
   " অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে 
      আমরা দুজন ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের                                                         স্রোতে।"

জীবনানন্দ লিখেছেন :
" হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি
                                              পৃথিবীর পথে ,
  সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে
                                               মালয় সাগরে
  অনেক ঘুরেছি আমি , বিম্বিসার অশোকের
                                               ধূসর জগতে "

বিষয় একই , কিন্তু বচনের রেচন  ভিন্নমাত্রিক।
শব্দ - নৈঃশব্দ্য , চিত্র - চিত্রকল্প, রূপ-অরূপ, গ্রন্থিবন্ধন- গ্রন্থিমোচন, পূর্ণতা- শূন্যতা, মোহ- মোচড়, নিরাভরণ-আভরণ, আলো-আলেয়া সবই কবিব্যক্তিত্বের প্রজ্ঞা-মেধা-বোধ-বোধি-মন- মনন-আত্মরতি-আত্মক্ষয় সঞ্জাত নির্বাচন।
বাঙ্ময়ের নব নব বিনির্মাণ এবং সৌন্দর্যচেতনার মানস প্রতিভাসে তা এতটাই রহস্যপূর্ণ যে, যুক্তি- বুদ্ধি- বিচারের শাণিত সরণিতে সমীক্ষণ হা হতোস্মি  :
             
       কবিতার কোনও কোনও শব্দ নিরর্থক
       কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা
       শুধু নয় , সেই শব্দে অমোঘ টান অবিরত
       যেন অনন্ত ঈশ্বরের ডিজাইন।
                   
                          ( অনিকেত : লেখক )
   
   
   
   

প্রবন্ধ : কুমারেশ তেওয়ারীর কলমে 
কবি, কবিতা ও কমিউনিকেশন
কুমারেশ তেওয়ারী


এক ভাস্কর একটি অসাধারণ ভাস্কর্য নির্মাণ করে সেটিকে লুকিয়ে রেখে দিলেন তার ঘরেরই কোনো অন্ধকার কোণায়। তাহলে লাভ কী হলো? হয়তো শিল্পী মানসিকভাবে সুখী হলেন কিন্তু সেই আত্মতুষ্টির সামগ্রিক মূল্য কতটা। তিনি ও তার তৈরি সৃষ্টির সার্থকতা তখনই যখন সেই ভাস্কর্যটিকে নিয়ে আসা হবে দর্শকের সমক্ষে। যখন আলোচিত হবে তার ভালো-মন্দের বিভিন্ন দিক।

তাহলে কি দেখা যাচ্ছে যে কোনো শিল্পের উত্তরণের ক্ষেত্রে তার দর্শক-স্রোতার একটি বড় ভূমিকা আছে। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। কোনো কবি যতই উন্নাসিক হয়ে বলুন না কেন—তিনি পাঠকের কথা ভেবে কবিতা লেখেন না। নিজের জন্য লেখেন। তার পুরোটা সত্য নয়। কবিকে পাঠকের কাছে যেতেই হয়। আর এখান থেকেই কবিতার ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন শব্দটি জন্ম নেয়। কবি ও কবিতার অবশ্যই একটা দায়বদ্ধতা (কখনই প্রেসারজাত নয়) আছে পাঠককে কমিউনিকেট করার।  মোদ্দা  কথা হলো কবি যদি তার পাঠকের কাছে পৌঁছতে নাই-ই চাইবেন তবে বিভিন্ন পত্রিকার তার লেখা প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারে কেন তার এত আকুলতা এবং উৎকন্ঠা।  কেনই বা গাঁটের কড়ি খরচ করে বই প্রকাশের উদ্যোগ। তিনিও তো ওই ভাস্করের মতো নিজের কবিতা সন্তানদের মোটা জাবদা খাতায় বন্দি করে, রাখতে পারতেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। 

তবে কমিউনিকেট করার প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয় একজন পাঠকেরও কিছু দায়বদ্ধতা থাকে নিজেকে কবিতার প্রকৃত পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। এজন্যই নিজেকে কবিতা পাঠের যোগ্য করে তোলার জন্য তাকেও অন্তত কিছুটা পড়াশোনা করতেই হবে। এখন তো কবিতার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একরৈখিক থেকে হয়েছে বহুরৈখিক। বহুস্তরীয় কবিতায় অনেক বেশি বেশি করে এসেছে বিমূর্ততা। বিজ্ঞান,ভূগোল,ইতিহাস,পুরাণ,মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় আরও বেশি করে ঢুকে পড়ছে কবিতায়। যার জন্য অন্তত কবিতার খাতিরে কিছুটা পড়াশোনা তো করতেই হবে পাঠককে। তবে যেহেতু কবিতা চেতন-অবচেতনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক বিমূর্ত শিল্প তাই কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে পাঠকের বোধই তার প্রধান অস্ত্র। শুধুমাত্র কোনও একাডেমিক জ্ঞান বা পড়াশোনা দিয়েই কবিতাকে ধরা বা বোঝা সবক্ষেত্রে সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে সাফল্যের বদলে ব্যর্থতাই হয়তো বেশি আসতে পারে। বিশেষ করে কবিতা রচনার সময় কবির মধ্যে অবচেতন মনের প্রভাব বেশি থাকলে কবিতার মধ্যে যে আলো-আঁধারির আবহ তৈরি হয় বা কবিতার শরীরে যে রহস্য ঢুকে অশরীরী হয়ে বসে থাকে সেই রহস্য বা আলো-আঁধারিটুকুই অনেকক্ষেত্রেই কবিতার প্রধান সম্পদ হয়ে ওঠে। ওই আলো-আঁধারির মধ্যে ঢুকিয়ে তার রহস্য উন্মোচনের জন্য যেন পাঠককে আহ্বান করে কবিতা। তখন যে ঘোরের মধ্যে কবি রচনা করেছেন সেই কবিতা প্রকৃত পাঠকও যেন সেই ঘোরের দ্বারা সংক্রামিত হয়। এক বোধ ও না-বোধের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া অনুরণন গ্রাস করে পাঠককে। পাঠক বুঝতে পারেন তিনি ভিজে যাচ্ছেন অথচ কিসে সেটা ধরতে পারেন না। এই ভিজে যাওয়াটুকুই পাঠকের কাছে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। তিনি তখন খুঁজতে চান না তার এই ভিজে যাওয়ার উৎসটিকে।

একাকি গায়কের নয় তো গান—এই কথা দিয়েই শেষ করি এই আশা নিয়ে কবি ও পাঠকের মেলবন্ধনই বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আগামীর পথে। 

যেহেতু কবিতা চেতন-অবচেতনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক বিমূর্ত শিল্প তাই কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে পাঠকের বোধই তার প্রধান অস্ত্র। শুধুমাত্র কোনও একাডেমিক জ্ঞান বা পড়াশোনা দিয়েই কবিতাকে ধরা বা বোঝা সবক্ষেত্রে সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে সাফল্যের বদলে ব্যর্থতাই হয়তো বেশি আসতে পারে। বিশেষ করে কবিতা রচনার সময় কবির মধ্যে অবচেতন মনের প্রভাব বেশি থাকলে কবিতার মধ্যে যে আলো-আঁধারির আবহ তৈরি হয় বা কবিতার শরীরে যে রহস্য ঢুকে অশরীরী হয়ে বসে থাকে সেই রহস্য বা আলো-আঁধারিটুকুই অনেকক্ষেত্রেই কবিতার প্রধান সম্পদ হয়ে ওঠে। ওই আলো-আঁধারির মধ্যে ঢুকিয়ে তার রহস্য উন্মোচনের জন্য যেন পাঠককে আহ্বান করে কবিতা। তখন যে ঘোরের মধ্যে কবি রচনা করেছেন সেই কবিতা প্রকৃত পাঠকও যেন সেই ঘোরের দ্বারা সংক্রামিত হয়। এক বোধ ও না-বোধের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া অনুরণন গ্রাস করে পাঠককে। পাঠক বুঝতে পারেন তিনি ভিজে যাচ্ছেন অথচ কিসে সেটা ধরতে পারেন না। এই ভিজে যাওয়াটুকুই পাঠকের কাছে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। তিনি তখন খুঁজতে চান না তার এই ভিজে যাওয়ার উৎসটিকে। 
তবে কবিতার শরীরে কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া এই রহস্যটিই আসলে জন্ম দেয় এই বহুল প্রচারিত শব্দের—কমিউনিকেশন। কবিতার সঙ্গে পাঠকের কমিউনিকেশন। আর এখানেই যাবতীর দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ-বিক্ষোভ। অনেক কবিই এই রহস্যকে ঢেকে দেন অভেদ্য কালো কাপড় দিয়ে। ফলে পাঠক কবিতার ভেতরে ঢোকার চাবিটি খুঁজে পান না কিছুতেই। ভেতরে ঢোকার ন্যুনতম সুযোগও না পাওয়াও পাঠকের ভেতরে সামান্যতম অনুরণনেরও জন্ম দিতে পারেনা সেই কবিতা। হয়তো এটাই সেই কবিতার ব্যর্থতা। অন্যদিকে যখন কোনও কবি তার কবিতাকে একটা অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ে ঢেকে দেন। পাঠক সেই কবিতাকে দেখতে পায় তাকে স্পর্শ করতে পারে তার আবছা অন্ধকারে ঢাকা গলিগুলোতে বোধের আলো ফেলতে পারে সবশেষে অনুরণিত হতে পারে। এখানেই সেই কবিতার একটা সফল কবিতা হয়ে ওঠা এখানেই তার উত্তরণ

তবে কবিতার শরীরে কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া এই রহস্যটিই আসলে জন্ম দেয় এই বহুল প্রচারিত শব্দের—কমিউনিকেশন। কবিতার সঙ্গে পাঠকের কমিউনিকেশন। আর এখানেই যাবতীর দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ-বিক্ষোভ। অনেক কবিই এই রহস্যকে ঢেকে দেন অভেদ্য কালো কাপড় দিয়ে। ফলে পাঠক কবিতার ভেতরে ঢোকার চাবিটি খুঁজে পান না কিছুতেই। ভেতরে ঢোকার ন্যুনতম সুযোগও না পাওয়াও পাঠকের ভেতরে সামান্যতম অনুরণনেরও জন্ম দিতে পারেনা সেই কবিতা। হয়তো এটাই সেই কবিতার ব্যর্থতা। অন্যদিকে যখন কোনও কবি তার কবিতাকে একটা অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ে ঢেকে দেন। পাঠক সেই কবিতাকে দেখতে পায় তাকে স্পর্শ করতে পারে তার আবছা অন্ধকারে ঢাকা গলিগুলোতে বোধের আলো ফেলতে পারে সবশেষে অনুরণিত হতে পারে। এখানেই সেই কবিতার একটা সফল কবিতা হয়ে ওঠা এখানেই তার উত্তরণ।

একাকি গায়কের নয় তো গান—এই কথা দিয়েই শেষ করি এই আশা নিয়ে কবি ও পাঠকের মেলবন্ধনই বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আগামীর পথে।