প্রবন্ধ : সুজিত রেজের কলমে
প্রবন্ধের শিরোনাম : কবিতা মাঘরজনীর সবিতা
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
-
কবিতা একলা মানুষ ও একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরের একসুরে গাওয়া গান :
" অন্তর মাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই ,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই ,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই ,
কোথা ভেসে যাই দূরে।
( অন্তর্যামী : রবীন্দ্রনাথ )
কবিতা শিল্পের সংসারে একাকিত্বের শিল্পিত সংরাগ :
" সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে
নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।
তাকে বলি : এই তো তোমারই
ঠিকানালেখা চিঠি, ডাকে দেব,
তুমি মন পড়া জানো নাকি ?
এলে কোন ট্রেনে ?
আসলে এ নির্জনতা নয়। ফুটপাথে
কেনা শান্ত, নতুন চিরুনি।
দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ
কালো চুল লেগে আছে।"
( রাক্ষস : উৎপলকুমার বসু )
কবিতা সামাজিক স্খলন-বিচ্যুতির পরিণামী ক্রোধের তলদেশ থেকে উত্থিত আগুনের ফুলকি :
" যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে
ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক
হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ
চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-----
( এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না :
নবারুণ ভট্টাচার্য )
কবিতা সম্পর্কের উন্নতি-অবনতি-স্থিতাবস্থার সাপেক্ষে স্থিতধী অথবা অস্থির চিত্তঘোর :
" ভালোবাসা সবই খায়-----
এঁটোপাতা, হেমন্তের খড়
রুগ্ন বাগানের কোণে পড়ে থাকা
লতার শিকড়
সবই খায়, খায় না আমাকে
এবং হা করে রোজ আমারই
সম্মুখে বসে থাকে । "
( সব হবে :
শক্তি চট্টোপাধ্যায় )
কবিতা অধরা সৌন্দর্যের সন্নিধানে অহেতুক বিহারবিলাসী প্রবণতা :
" শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝঙ্কার
আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।। "
( প্রেমের কবিতা : বুদ্ধদেব বসু )
কবিতা মেধা-মনন-হৃদয়ের ঘোর লাগা শব্দকুহক ও মায়াজালবদ্ধ ধ্বনিপুঞ্জে স্খলিত জ্যোৎস্না :
" কবিতা কী শুধু দণ্ড দুই কারিগরি কুশলতা
চিত্র ও সঙ্গীতময় শব্দের মচ্ছব
কেবল ছন্দের সম্মোহন আর অণৃত ভাষণ?"
( হে কবিতা কোথায় ট্রিগার :
কবিরুল ইসলাম )
কবিতা অভূতপূর্ব , অনাস্বাদিত বিস্ময়-ব্যাপ্তির মনোরম একোক্তি :
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের
অন্ধকারে হয়েছে হলুদ ,
হিজলের জানালায় আলো আর
বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো
রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা
রূপ হয়ে ঝরেছে দু'বেলা
নির্জন মাছের চোখে---- পুকুরের পাড়ে
হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ---- মেয়েলি হাতের
স্পর্শ লয়ে গেছে তারে ;
কবিতা রমণীয় , কমনীয় , রসময় রচনা :
" তোমার যোগ্য গান বিরচিব বলে
বসেছি বিজনে, নব নীপবনে,
পুষ্পিত তৃণদলে।
শরতের সোনা গগনে গগনে ঝলকে ;
ফুকারে পবন, কাশের লহরী ঝলকে ;
শ্যামসন্ধ্যার পল্লবঘন অলকে
চন্দ্রকলার চন্দনটীকা জ্বলে। "
( নান্দীমুখ : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ) )
মহামুনি বাল্মীকির নিখাদ দুঃখবাদী উচ্চারণে কবিতার নিদ্রাভঙ্গ :
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমবীবধঃ কামমোহিতম্।।
তারপর কালিদাসের পূর্ব মেঘের উত্তর মেঘে সরণ---- অজয়ে এসেছে বন্যা জয়দেবের ভাঙা সংস্কৃত ছন্দের টানে ----বিদ্যাপতির ব্রজবুলিতে মিশে গেছে সেই তরঙ্গনাদ----চণ্ডীদাসের রামী মাথায় তুলে নিয়েছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল ফুলিয়া-পুঁটুলি।
সৃষ্টির সোনার তরী ধীরে সমীরে যমুনা তীরে,ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি মেখেছে। সমান্তরালে সৃষ্টি ও স্রষ্টার অন্যোন্য সম্পর্ক নির্বাপনে , রহস্যময় সৃষ্টি ব্যাখ্যাত নয় জেনেও , নিরাসক্ত পরিচ্ছিন্ন তাত্ত্বিক-মনে জেগেছে অনন্ত-অন্তহীন কৌতূহল। কবে তার ইতি সকলেরই অজানা। তাই বোধহয় , অ্যারিস্টটল বলেছিলেন :" কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি , ইতিহাসের চেয়েও বড়।" সমসাময়িক ( আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী ) আচার্য ভরতও একই মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। এর কারণ , কাব্যচেতনা বিজ্ঞানের মতোই সর্ববাদীসম্মত। এমনকি , যেখানে বিজ্ঞান-দর্শনের শেষ , সেখান থেকেই কাব্যের বহতার সূত্রপাত। কবি তাই ঋষিতুল্য , মেধাবী , ক্রান্তদর্শী , মনীষী , প্রাজ্ঞ এবং সর্বজ্ঞ । কবি মনুষ্যচরিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বোদ্ধা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্বুদ ঝঙ্কৃত সুর কবির কানেই অনুরণিত হয়। কবিকে বিশ্ববিধাতার চেয়েও অধিক শক্তিধর বলে মনে করেছেন অনেকেই। তাঁদের অভিমত, ঈশ্বর বিশ্ববিধানে নিয়মনিগড়িত , কিন্তু কবি-কল্পতাঁদের অভিমত, ঈশ্বর বিশ্ববিধানে নিয়মনিগড়িত , কিন্তু কবি-কল্পনার ভাবরাজ্য সর্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র। প্রতিভাগুণ কবির সহজাত ; যদিও বুৎপত্তি ও অভ্যাসের দ্বারা প্রতিভা অমিত শক্তি অর্জন করে। এই শক্তি তূরীয় , দিব্য , অতিলৌকিক , ঐশ্বরিক, অনিঃশেষ , ইহজন্মীয় ও জন্মান্তরীয়। কবির রচনা তাই হৃদ্য, সুন্দর , রমণীয় , বিচিত্র , মনোরম , অত্যাশ্চর্য ও অদ্ভুত।
যার ব্যাখ্যায় , খ্রিস্টপূর্ব আমলেই , প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্যে সাহিত্যতত্ত্ব - নন্দনতত্ত্ব- সমালোচনাশাস্ত্র- সৌন্দর্যশাস্ত্র- কাব্যজিজ্ঞাসা- কাব্যমীমাংসার সূত্রপাত। নাট্যশাস্ত্র ( ভরত ), কাব্যাদর্শ ( দণ্ডী ), কাব্যালঙ্কার ( ভামহ ), কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তিঃ ( বামন ), দশরূপক, ( ধনঞ্জয় ), ধ্বন্যালোক ( আনন্দবর্ধন ), কাব্যপ্রকাশ ( মণ্মট ), কাব্যালঙ্কার ( রুদ্রট ),
কাব্যালঙ্কার সারসংগ্রহ ( উদ্ভট ), অভিনবভারতী ( অভিনব গুপ্ত ), রসগঙ্গাধর ( জগন্নাথ ), বক্রোক্তিজীবিতম্ ( কুন্তক ), কাব্যমীমাংসা ( রাজশেখর ), ঔচিত্যবিচারচর্চা ( ক্ষেমেন্দ্র ), সাহিত্যদর্পণ ( বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ), দশরূপক ( ধনঞ্জয় ), সরস্বতীকণ্ঠাভরণ ( ভোজরাজ ), ( উজ্জ্বলনীলমণি ( শ্রীরূপ গোস্বামী ) প্রভৃতি গ্রন্থ প্রাচ্য আলঙ্কারিকদের উপাচার। প্রতীচ্যেও সমান্তরাল প্রবাহ : Poetics ( অ্যারিস্টটল ), Ars Poetica ( হোরেস ), Sublime ( লংগিনাস ), An Apology for Poetry ( ফিলিপ সিডনি ), A Philosophical Enquiry into the Origins of the sublime and the Beautiful ( এডমান্ড বার্ক ), An Essay on Criticism ( আলেকজান্ডার পোপ ), What is Poetry (জন স্টুয়ার্ট মিল ), Preface to the Lyrical Ballads , Poetry and Poetic Diction ( উইলিয়ম্ ওয়ার্ডসওয়ার্থ ), A Defence of Poetry ( পি বি শেলি ), Biographia Literaria ( সামুয়েল টেলর কোলরিজ ), The Four Ages of Poetry ( টমাস্ লভ্ পিকক ), What is Poetry ( জন স্টুয়ার্ট মিল ), The Poet ( রালফ্ ইমারসন ), The Poetic Principle ( এডগার অ্যালান পো ), Poetry for Poetry's Sake , Oxford Lectures on Poetry ( ব্রাডলি ), The Study of Poetry ( ম্যাথু আর্নল্ড ), Practical Criticism (আই এ রিচার্ডস্ ), The Idea of Great Poetry ( এবারক্রম্বি ), Poetry and Abstract Thought (পল ভ্যালেরি ) The Hero as Poet ( কার্লাইল ) Principles of Criticism ( ডাবলিউ বি ওয়ার্সফোর্ড ।
সপ্তম শতাব্দীর আলঙ্কারিক ভামহর কাছেই আমরা প্রথম কাব্যের সংজ্ঞা পাই : " শব্দার্থ সহিতৌ কাব্যম্।" পরবর্তী সময়ে আচার্য রুদ্রট ( " ননু শব্দার্থৌ কাব্যম্।" ), মণ্মট ( " তদদোর্থে সগুণাবনলঙ্কৃতৌ পুনঃ ক্কাপি।" ), বিদ্যাধর ( " শব্দার্থৌ বপুরস্য।" ), এমনকি কালিদাসের ( " বাগর্থৌ ইব সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপত্তয়ে।" ) ভাষ্যে ভামহরই প্রতিধ্বনি। তবুও ভামহর ' সহিতৌ ' শব্দ নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকে। কাব্যের স্থানে ' সাহিত্য ' পরিভাষা প্রথম প্রয়োগ করেন আচার্য রাজশেখর : " শব্দার্থয়ো র্যথাবৎ সহভাবেন বিদ্যা সাহিত্যবিদ্যা "। ভামহর ' সহিত ' শব্দের গুণবাচক বিশেষ্য রূপে ' সাহিত্য ' শব্দনির্মাণ। রাজশেখরের মতে , শব্দার্থের যে সম্পর্ক , তাই-ই সাহিত্য। শব্দ ও অর্থের বাহুল্যশূন্য মিলনে গড়ে ওঠা অলৌকিক বিন্যাসভঙ্গিকে আচার্য কুন্তক সাহিত্য বলেছেন।বক্রোক্তিবাদী কুন্তকের স্পষ্ট অভিজ্ঞান :"বাচকো বাচ্যং চ ইতি দ্বৌ সম্মিলিতৌ কাব্যম্ "।
সহিতৌ ও সম্মিলিতৌ সমার্থক। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে : " সহিত শব্দ হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি। অতএব ধাতুগত অর্থ ধরিলে সাহিত্য শব্দের মধ্যে একটি মিলনের ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। সে যে কেবল ভাবে-ভাবে, ভাষায়- ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন তা নহে ----- মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানের, দূরের সহিত নিকটের, অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগ-সাধন সাহিত্য ব্যতীত আর কিছুর দ্বারাই সম্ভবপর নহে " ( সাহিত্য )।
মনুষ্য হৃদয়ের ভাবজাত বচনের রচনই হল কবিতা। শব্দার্থ হল ভাষা বা বচন। শব্দ স্মৃতি। শব্দ অভিজ্ঞতা। শব্দ গান। শব্দ বাইরের দরজা।। কাব্যভাষার অর্থবোধক ও স্বাধীন একক মুক্ত রূপিমই হল শব্দ। শব্দ থেকে শব্দাতীত জগৎ ছোঁয়ার দক্ষতাই হল কবির রচন। বচনের রেচনেই রচনের সিদ্ধি। বচনের রেচন- সংঘটনের উপরেই স্রষ্টার মূল্যায়ন হয়। সাহিত্যের ভাষা ' highly organized '। সাহিত্যের ভাষার লক্ষ্য ' expression '। পবিত্র সরকার লিখেছেন : " এখানে ভাষা বক্তব্যকে অতিক্রম করে নিজেই সামনে এসে দাঁড়ায়।বলে ----- ' আমাকেও লক্ষ্য করো , এখানে 'আমি ' অর্থের চেয়ে কম লক্ষণীয় নয়,কখনও কখনও অর্থের চেয়ে 'আমিই ' বেশি করে চোখে পড়তে চায়।" ( কবিতার ভাষা ) এই কারণেই সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে নিভাষা।
অষ্টম শতাব্দীর আলংকারিক আচার্য বামনের " কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলঙ্কারাৎ " মন্তব্য এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করে যে , সমগ্র কাব্যালোক- কূটমন্তব্যগুলিই অলঙ্কার-শাস্ত্র রূপে পরিচিতি পেয়ে যায়। অলঙ্কার-সংজ্ঞায় ষষ্ঠ শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডীর অভিমত : " কাব্যশোভাকরান্ ধর্মান অলঙ্কারান্ প্রচক্ষতে।" অর্থাৎ , কাব্যের শোভাই অলঙ্কার। তাঁর মন্তব্যে সংস্কৃত ' অলম্ ' ধাতুর বাচ্যার্থ ' ভূষণ ' বিধৃত। বামনেও তা পুনরাবৃত্ত : " সৌন্দর্যম্ অলঙ্কারঃ "যদিও অনেকেই অলঙ্কারের সংকীর্ণ অর্থ শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার মান্যতা দিয়ে বামনের অলঙ্কারবাদকে অতিব্যাপ্ত ও অব্যাপ্ত দোষে দুষ্ট বলে আক্রমনেও উৎসাহিত হলেন। অলঙ্কার থাকলেই বাক্য কাব্য হয়----- তা যে অতিব্যাপ্ত বচন , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কেননা নিরলঙ্কৃত বাক্যের সার্থক কাব্য হয়ে ওঠার পর্যাপ্ত উদাহরণ মেলে। আবার অলঙ্কৃত বাক্যের ব্যর্থ কাব্যে পর্যবসিত হওয়ার ঝুরি ঝুরি দৃষ্টান্তও আছে।
বামন তাই " কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ" গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানালেন :" রীতিরাত্মা কাব্যস্য"। এই প্রথম কাব্যের স্বরূপ আলোচনায় 'আত্মা' শব্দের সংযোগ ঘটল। ফলে দেহ ও দেহাতীত ধারায় কাব্যচেতনার উন্মেষও ঘটল। পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিকে বামন রীতি বলে চিহ্নিত করলেন। অলঙ্কারকে রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু বললেন।
বামন তাই " কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ" গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানালেন :" রীতিরাত্মা কাব্যস্য"। এই প্রথম কাব্যের স্বরূপ আলোচনায় 'আত্মা' শব্দের সংযোগ ঘটল। ফলে দেহ ও দেহাতীত ধারায় কাব্যচেতনার উন্মেষও ঘটল। পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিকে বামন রীতি বলে চিহ্নিত করলেন। অলঙ্কারকে রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু বললেন। অর্থাৎ , অলঙ্কার ব্যবহার বা বর্জন কবি- ব্যক্তিত্বের মর্জি। ফলত অলঙ্কার গৌণ হয়ে পড়ল। রীতির ইংরেজি পরিভাষা রূপে style শব্দ ব্যবহার হলেও দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। style ব্যক্তিত্ব-সম্পৃক্ত ; রীতি ভৌগোলিক অনুষঙ্গ জাত। বস্তুবাদীরা কাব্যের স্বরূপ নির্ণয়ে অলঙ্কার ও রীতিবাদীদের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। তাঁদের মতে , " কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভর করে বস্তু বা ভাবের বিশিষ্টতার উপর।" বস্তু হল বক্তব্য, ভাব মনুষ্য-চিত্তবৃত্তি। গভীর বক্তব্য এবং মহৎ ভাবের উপাচারে কাব্যের শ্রেষ্টত্ব নির্ণীত হয়। বস্তুবাদীরা মনে করেছেন , মহাকবিদের সৃষ্টিতে বিষয়বস্তুর অতলান্তিক রূপ এবং মহৎ ভাবেরই স্ফুরণ ঘটে অভিনব শব্দার্থ , অলঙ্কার , রচনাভঙ্গির চলাচলে। কিন্তু ধ্বনিবাদীরা সম্পূর্ণ বিপরীত পথে জোরের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন :" শ্রেষ্ঠ কাব্যের প্রকৃতিই হল বাচ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। "
কাব্যের এই বাচ্যাতিরিক্ত ধর্মান্তরের অভিব্যঞ্জনার পারিভাষিক রূপ ধ্বনি।ধ্বনি- কারিকার প্রবক্তা অজ্ঞাত। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা ' ধ্বন্যালোক '-এর বৃত্তিকার নবম শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য আনন্দবর্ধন। দশম-একাদশ শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য অভিনব গুপ্তের লোচন টীকায় যার সর্বভূতেষু রূপ প্রাপ্তি। ধ্বন্যালোক গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছদেই লেখা হয়েছে : " কাব্যাস্যাত্মা ধ্বনিঃ "। শব্দার্থের মধ্য দিয়ে যে- কথাবস্তু প্রকাশ পায় , তা কাব্য হলে , অভিধান- নির্ভর কাব্যচর্চার জগৎ উন্মুক্ত হত। এই পথ অবারিত না হওয়ার কারণ , শ্রেষ্ট সৃষ্টি বাচ্যার্থ নির্ভর হয়েও বাচ্যাতিরিক্ত বিষয়ের ব্যঞ্জনা দান করে। রবীন্দ্রনাথের গান " ফাগুন লেগেছে বনে বনে " ছাপাখানায় ' আগুন ' হয়ে যাওয়ার কারণ ব্যঞ্জনাবোধের অভাব। আনন্দবর্ধন কাব্যব্যঞ্জনাকে রমণীদেহের লাবণ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন :
প্রতীয়মানং পুনরন্যদেব
বস্ত্বস্তি বাণীষু মহাকবীনম্।
যত্তৎ প্রসিদ্ধাবয়বাতিরিক্তং
বিভাতি লাবণ্যম্ ইবাঙ্গনাসু।।
শেলিও লিখেছেন : " A great poem is a fountain for ever over-flowing with the waters of wisdom and delight ; and after one person and age has exhausted all its divine influence which their peculiar relations enable them to share , another succeeds , and new relations are ever developed , the source of an unforeseen
and unconceived delight. " ( A Defence of Poetry)
তবে যে-কোনো ব্যঞ্জনাই ধ্বনি নয়। ধাঁধা-হেঁয়ালির ব্যঞ্জনা যেমন ; একবার পর্দা সরে গেলে আগ্রহ হারায়। কৌতূহল সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়। কাব্যের ধ্বনির রেশ থেকে যায়। ঘণ্টাধ্বনির স্বননের মতো। " যে-বাঁশিতে বাতাস কাঁদে , সেই
বাঁশিটির সুরে সুরে " দূরে দূরে ভেসে বেড়ায়। ডিজে-নৃত্যে শরীর ক্লান্ত হয় , শাস্ত্রীয়-নৃত্যে দেহমনে অনির্বচনীয় স্ফূর্তির সঞ্চার ঘটে। শব্দ ও অর্থ ব্যঙ্গ্যতে প্রতিষ্ঠিত হলে ধ্বনি হয়ে ওঠে।
আনন্দবর্ধন ধ্বনির তিনটি সরল শ্রেণিবিভাগ করেছেন : বস্তুধ্বনি , অলঙ্কারধ্বনি ও রসধ্বনি। বস্তু বা অলঙ্কারের ব্যঞ্জনায় বাচ্য কাব্য হয়ে ওঠে না। কাব্যের ধ্বনি রসধ্বনি। রসের ব্যঞ্জনায় বাক্য কাব্য হয়। রস ' সহৃদয়হৃদয়সংবাদী '। রস ও কাব্য অলৌকিক মায়াজগৎ গড়ে তোলে। ভাবের রসমূর্তি দানে কবিকে লৌকিক পরিমিতত্ব অতিক্রম করতে হয়। কবির এই গুণকেই দার্শনিক ক্রোচে Poetic ldealization বলেছেন। Poetic ldealization জাত ভাব-বর্ণনা ( বিভাব-অনুভাব ) সহৃদয়ের বাসনালোকে অলৌকিক রসমণ্ডিত হয়ে ওঠে।ওয়ার্ডসওয়ার্থ ' Lyrical Ballads '-এর মুখবন্ধে সেটাই লিখেছেন : " Poetry takes its origin from emotion recollected in tranquility "তারও আগে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ( চতুর্দশ শতাব্দী) ' সাহিত্যদর্পণ ' গ্রন্থে জানিয়ে গেছেন :
বিভাবেনানুভাবেন ব্যক্তঃ সঞ্চারিণা তথা।
রসতামেতি রত্যাদি স্থায়ী ভাবঃ সচেতসাম্।।
ভরতের " নাট্যশাস্ত্র " থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ত্রিশটির বেশি কাব্যতত্ত্বমূলক মৌলিক গ্রন্থ এবং একাধিক টীকা-টিপ্পনি জাত আলঙ্কারিকদের মূল ভাবনা :
ক) গুণপ্রস্থান : শব্দ ও অর্থের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ গুণমানের বৈচিত্র্যময় প্রকাশেই কাব্যের উৎকর্ষতা। কাব্যশোভার ধর্মবিশেষই হল গুণ।যেমন - শ্লেষ , প্রসাদ , সমতা ,সুকুমারতা , ওজঃ, কান্তি , মাধুর্য ,সমাধি প্রভৃতি।
খ) অলংকারপ্রস্থান : শব্দ ও অর্থের শিল্পিত মণ্ডনকলাই কাব্যসৌন্দর্যের আকর।প্রতিভা অনন্ত,অলঙ্কারও অনন্তপ্রকার।অলঙ্কাররসাদিরও পুষ্টি ঘটায়।
গ) বক্রোক্তিপ্রস্থান : কবির বাঙ্ময়ের প্রধান আকর্ষণ বক্র উক্তি অর্থাৎ উক্তিবৈচিত্র বা শব্দের শিল্পিত প্রয়োগসুলভ বাগবৈদগ্ধ্য।প্রারম্ভিক উপলব্ধিময় দৃষ্টির মৌলিক ঐক্য, প্রাণগত সমগ্রতা ও সারূপ্যের ভিত্তিতে নির্মিত গুণ, অলঙ্কার , ধ্বনি সবই বক্রোক্তির অন্তর্ভুক্ত।
ঘ) ধ্বনিপ্রস্থান : গুণ ,অলঙ্কার,বক্রোক্তি প্রভৃতি বিশিষ্ট বাগব্যবহারলব্ধ অর্থ যে সৌন্দর্য , চারুত্ব বা রমণীয়তা নামক মানসিক রসাস্বাদন ঘটায় , তাই ধ্বনি। শ্রেষ্ঠ কাব্যে কাব্যার্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সহৃদয় পাঠকের অনুভববেদ্য হয়।
ঙ) রসপ্রস্থান : সহৃদয় চিত্তের আনন্দময় সম্বিৎ রস। কাব্যের বিভাব-অনুভাব এবং স্থায়ী- সঞ্চারী চিত্তবৃত্তির সংযোগে সহৃদয়ের বাসনালোকে রসের নিষ্পত্তি।
প্রতীচ্যের স্রষ্টা- কূটতার্কিকদের অনেকেই কাব্য- কবিতা নিয়ে নানান সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন। প্রাচ্যবাদীদের মতোই সেইসব কলাকৈবল্যবাদী ব্যক্তিক কূটভাষ কখনও কাব্যের শরীর অথবা আত্মাভিত্তিক। প্রসঙ্গত কতকগুলি স্মরণ করা যাক :
মালার্মে : কবিতা রচিত হয় শব্দে , আইডিয়ায়
নয়।
ইয়েটস : কবিতা হল---- রক্ত , কল্পনা আর বোধের যৌথযাত্রা।
কার্লাইল : কবিতা হল মিউজিক্যাল থট।
জনসন : কবিতা হল মেট্রিক্যাল কম্পোজিশান।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ : কবিতা সব জ্ঞানের শ্বাসপ্রশ্বাস
আর সূক্ষ্ম আত্মা।
কোলরিজ : গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে
সাজানো।আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট
শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।
শেলি : কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই
সার্থক হয় যখন কবিমনের পরিতৃপ্তিতে
পূর্ণতা আসে।
কিটস্ : কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায় , একটি মাত্র ঝংকারে
নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই
সর্বোত্তম চিন্তা। যা ক্রমশ ভেসে উঠছে
তার স্মৃতিতে।
মেকল : কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প ,
যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে ,
যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।
টি এস এলিয়ট : কবিতা রচনা হল বক্তব্যকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।
অর্থাৎ কবিতার দুটি দিক---- অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ। অন্তরঙ্গে বিষয়ের বুদবুদ ; বহিরঙ্গে প্রকাশ- প্রসাধন। হাঁটা ও হাঁটার ভঙ্গি এক নয়। দুয়ের মধ্যে ঝুলবারান্দা আর রান্নাঘরের তফাৎ। একটায় রুচি অপরটিতে ভাঁড়ার উপচে পড়া জীবনফসল। তুল্যবিচারে , বিষয় অপেক্ষা প্রকাশ মুখ্য। বহু দীর্ঘজীবী কবির জীবনফসল অপরিমেয় কিন্তু ঝুলবারান্দায় বসলে তাদের ঠাণ্ডা লাগে। তাই কবিতায় অপ্রকৃতের কাছে হার মেনে প্রকৃত বারবার হার মানা হার গলায় পরিয়ে দেয়। যেমন , ভোরের বর্ণনায় দীনবন্ধু লিখেছেন :
" ভোর হল রে ফর্সা হল ফুটল কত ফুল।
কাঁপিয়ে পাখা নীল পতাকা জুটল অলিকুল"।।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
" আলোর রং যে বাজল পাখির রবে "।
নজরুল লিখেছেন ;
" ভোর হল দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে।
ওই ডাকে জুঁই শাখে ফুল-খুকি ছোটো রে।।
রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই।
দারোয়ান গায় গান শোনো ওই রামা হৈ "।।
জীবনানন্দ লিখেছেন :
ভোর ,
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল
চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ
টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে ;
পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো
কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে
যে-মুক্তা আমার নীল মদের
গেলাসে রেখেছিল।
চারটি বর্ণনার মধ্যে জীবনানন্দের কবিতাংশ সহৃদয়-চিত্তে উপভোগ-মাত্রা অনায়াস অতিক্রম করে।সত্যেন্দ্রনাথ,নজরুলের রচনা চিত্রকাব্যের অতিরিক্ত কিছু নয়। আলোর রং বেজে ওঠার মধ্যে যে ইন্দ্রিয়-বিপর্যয় , তা রবীন্দ্র-রচনের কলাকৈবল্য। কিন্তু জীবনানন্দীয় বচনের রেচন পাঠকের মদির কল্পনাশক্তির প্রত্যাশার ঘনিষ্টতা দাবি করে। চিত্র ও চিত্রকল্পের যোজন তফাৎ উপলব্ধ হয়।
যত ধুলো খাই , তত প্রেম পাই। যতদিন মানুষ ততদিন প্রেম , যতদিন প্রেম ততদিন মানুষ। প্রেমের কবিতা লিখতে লিখতে কখন তা পরমের ছোঁয়ায় বিনিসুতোর মালা হয়ে যায়। চিরন্তন এই অনুভূতি প্রকাশে চণ্ডীদাস লিখেছেন :
" পিরিতি বলিয়া এ তিন আখর
এ তিন ভুবন সার
এই মোর মনে হয় রাতিদিনে
ইহা বই নাহি আর।"
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
" অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে
আমরা দুজন ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে।"
জীবনানন্দ লিখেছেন :
" হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি
পৃথিবীর পথে ,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে
মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি , বিম্বিসার অশোকের
ধূসর জগতে "
বিষয় একই , কিন্তু বচনের রেচন ভিন্নমাত্রিক।
শব্দ - নৈঃশব্দ্য , চিত্র - চিত্রকল্প, রূপ-অরূপ, গ্রন্থিবন্ধন- গ্রন্থিমোচন, পূর্ণতা- শূন্যতা, মোহ- মোচড়, নিরাভরণ-আভরণ, আলো-আলেয়া সবই কবিব্যক্তিত্বের প্রজ্ঞা-মেধা-বোধ-বোধি-মন- মনন-আত্মরতি-আত্মক্ষয় সঞ্জাত নির্বাচন।
বাঙ্ময়ের নব নব বিনির্মাণ এবং সৌন্দর্যচেতনার মানস প্রতিভাসে তা এতটাই রহস্যপূর্ণ যে, যুক্তি- বুদ্ধি- বিচারের শাণিত সরণিতে সমীক্ষণ হা হতোস্মি :
কবিতার কোনও কোনও শব্দ নিরর্থক
কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা
শুধু নয় , সেই শব্দে অমোঘ টান অবিরত
যেন অনন্ত ঈশ্বরের ডিজাইন।
( অনিকেত : লেখক )
No comments:
Post a Comment