মুক্তগদ্য :
" রাস্তা থেকে লিখছি তোমাকে "
- ধীরাজ কুমার রায়
( ১)
অনন্যা,
ঠিক এই মুহূর্তে তোমরা কেমন আছো - জানিনা | বাড়ি আসছি | আর সামান্য পথ বাকি | টিপলুর জন্য একটা নতুন জামা কিনেছি | ওর খুব পছন্দ হবে ! তবুও লিখছি তোমাকে | লিখছি এই ভেবে যে - শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবো তো !
বান্টিও তো আমিনার কাছে ফিরতে চেয়েছিলো ! ছোট্ট রিয়াজ ওর পথ চেয়ে দিন গুনছে | শরীরটা একটু খারাপ ছিলো বলে - বাকিরা ওকে জোর করে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিলো | আমিও নামলাম | আমার কাঁধে ভর করে বেশ কিছুটা পথ এসেছেও ! তার পরে বসবে বলে - মাটিতে শুয়ে পড়লো | জল চাইলো আমার কাছে | বোতলটা খুলে মুখের কাছে ধরলাম | চোখ বন্ধ দেখে ডাকলাম - " বান্টি , এই বান্টি ! " সাড়া নেই | সজোরে ডাকলাম - "বান্টি...... "
কোনো সাড়া পেলাম না ! সামনের শূন্য রাস্তাটা আমার গলা নকল করে জোরে ভেংচি কাটলো | বুঝিয়ে দিলো - বান্টি কোনো দিনই আর আমিনা ও রিয়াজের গল্প বলবে না !
বান্টি এখন পরিযায়ী মৃতদেহ | ভিন রাজ্যের পুলিশ এসেছে | একটু আগে এলেও তো রিয়াজ নতুন জামাটা পরে বলতে পারতো - " আব্বু , খুব পছন্দ হয়েছে জামাটা ! "
ওরা (পুলিশ ) কেউ কাছে আসছে না কিন্তু ! অথচ হাজারো প্রশ্নে বিরক্ত করছে আমাকে আর মৃত পরিযায়ী বান্টিকে ! "কোথায় ছিলাম, বাড়ি কোথায় ? হেঁটে ফিরছি কেন ? ওর করোনার লক্ষ্মণ ছিলো কিনা ! " ইত্যাদি -ইত্যাদি |
কিকরে বোঝাবো ওদের যে - বান্টির করোনা ছিলনা ! ছিলো শুধুই রিয়াজ - আমিনা আর অপরাধী তিনটে পেট !
( ২)
অনন্যা,
আমি এখনো অবশিষ্ট এক - তৃতীয়াংশ রাস্তা থেকে লিখছি তোমাকে | আমার কোলে এখনো নিশ্চিন্তে - অনন্ত ঘুমে বান্টি | সামনে ঈদ | রিয়াজের জন্য কেনা নতুন জামাটা আমার হাতে | ভাবছি - জামাটা পৌঁছাতে পারবো তো ? বান্টি বলেছিলো, - রিয়াজকে খুব মানাবে ! আমিনা আর রিয়াজ কেমন আছে অনন্যা ?
পুলিশ এবার সাজ পোশাকে সদলবলে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে | বোধহয় বান্টিকে নিতে এসেছে ! ওরা এতো জোরে কেড়ে নিলো বান্টিকে ! আমি কিছুতেই ওকে আটকাতে পারলাম না ! কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা ? আমাকে নিলোনা কেন ?
আমি বড্ড একা এখন ! পিঠে আমার আর বান্টির দুটো ব্যাগ | হাতে টিপলু সোনা আর রিয়াজের জন্য কেনা জামা দুটো |
অনেক্ষন পর দাঁড়ালাম | আমাকে বাড়ি যেতে হবে তো ! তুমি কি টিপলুকে কোলে - উঠোনে দাঁড়িয়ে আমার রাহা দেখছো ? আমিনা আর রিয়াজও কি একই ভাবে বান্টির অপেক্ষায় ? টিপলু এই এক বছরে অনেকটা বড়ো হয়েছে না ? রিয়াজও একই রকম হয়েছে বোধহয় ! ওরা তো সমবয়সী | মাঝে মাঝে আমিনাদের বাড়ি যেও | খোঁজ নিও - ওরা কেমন আছে !
( ৩ )
অনন্যা ,
আমিও ঠিকমত হাঁটতে পারছিনা কেন - বলতে পারো ? পা দুটো কাঁপছে ! ভয় পেওনা ! হাঁটতে আমাকে হবেই ! মুম্বাই থেকে প্রায় এক তৃতীয়াংশ পথ তো চলে এসেছি ! আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি - তুমি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে | টিপলু চেঁচিয়ে ডাকছে - " বাবা "......
টিপলু ' অ - আ ' লিখতে পারে এখন ? ' বাবা ' বানানটা প্রথমে শিখিও !
মাথাটা ঝিম ঝিম করছে ! ও কিছু না , দুদিন ঠিকমতো খাওয়া হয়নি - সেজন্য বোধহয় ! আসলে বান্টি এতো বেশি রিয়াজ আর আমিনার কথা বলছিলো যে খাওয়ায় মন দিতে পারিনি ! তোমরা ঠিকমতো খেও কিন্তু !
টিপলুকে ঠিক সময় খাইয়ে ঘুম পাড়িও ! ও কি খুব দুস্টুমি করে আজকাল ? এখনো বিরক্ত করে কি - বাবা কখন আসবে ?
তুমি কি কোনো শব্দ পেলে ? আরে না না ব্যাগের শব্দ | আমিই রাখলাম মনেহয় ! আজ তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলেছো ? পারলে একটু বেশিই তেল দিও আজ ! হাওয়ায় নিভতে দিও না ! অন্তত আজ রাতটুকুর জন্য |
চোখ টানছে | আমি ঘুমিয়ে গেলে - তুমিও টিপলুর পাশে একটু ঘুমিয়ে নাও ! আর কতক্ষন জাগবে তুমি ? ঘুম থেকে উঠে দেখো - আমি হয়তো পৌঁছে গেছি |
No comments:
Post a Comment