পার্থপ্রতিম পালের ছোটগল্প
আত্মসুখ
পার্থ প্রতিম পাল।
শহুরে জীবনযাপনে হাঁপিয়ে উঠেছিল নিধি।কোটি টাকার ডুপ্লেক্সে কোনো প্রতিবেশী নেই। কেউ কারো বাড়িতে যাতায়াত করেনা কোনো আমন্ত্রণ- নিমন্ত্রণ ছাড়া।মাঝে মাঝে নিধি ভাবে ওদের যদি একটি সন্তান থাকতো তবে বার্থডে পার্টিতে সকলকে নিমন্ত্রণ করতে পারতো।একাকীত্ব কিছুটা হলেও ঘুচে যেতো।নিজের পরিবারের কেউ নেই কাছেপিঠে, সবাই ওপার বাংলায়।মাঝে মাঝে ভাবে বাবা কেন যে ওকে বিয়ে দিতে গেল হোটেল ব্যাবসায়ীর কাছে, না দিলেই বোধ হয় ভালো হতো।আর নির্মাল্য কেন যে আমার মত এক পদ্মা তীরের গ্রাম্য মেয়েকে বিয়ে করেছে এটা আমার কাছ বড় বিষ্ময়!কিন্তু বছর তিনেকের দুজনের সংসারে কোনো ঝুট ঝামেলা হয়নি আমাকে বরং ও বিশেষ যত্নেই রাখে।কোনো ত্রুটি আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। সন্তান যে আমাদের এখনো নেই তারজন্য কোনো আফসোস করতে দেখিনি!কেন ওর আফসোস নেই বিষ্ময় জাগে আমার কাছে।যখন নানান প্রশ্ন জাগে আমার মনে তখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকি। আর খাঁচায় বন্দি টিয়াকে দানা দিই, ওর সাথে কথা বলি।টিয়া আর আমার মাঝে কোনো তফাৎ খুঁজে পাইনা।একটু তফাৎ অবশ্য আছে... সারাদিনের শেষে আমার কাছে অবশ্য নির্মাল্য ফিরে আসে।টিয়ার কাছে কেউ আসেনা,হয়তো বা তার ঠিকানা জানে না!তাই মাঝে মাঝে প্রচন্ড রাগে ডানা ঝাঁপটিয়ে ঠোঁট দিয়ে খাঁচার সরু সরু শিকগুলো কাটার চেষ্টা করে আর ক্যা ক্যা করে।দু-তিন দিন টানা না খেয়ে কাটিয়ে দেয়...
নিধি আর নির্মাল্য আজ বেরিয়ে পড়েছে বটল গ্রীন কালারের অডি নিয়ে। শহর থেকে বেশ দূরে...মফঃস্বলীয় সাওতাল ডিহির নিবিড় জঙ্গল আর পাহাড় নদীর কোলে হোগলা পাতায় মোড়া ছোট্ট ছোট্ট কটেজ। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে সাঁওতাল মেয়ের মতই একটা উদোল গায়ে দাঁড়িয়ে আছে কটেজ গুলো।ভেতর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে নীল আলো।সাওতাঁল মেয়েরা যেমন ভাবে শাড়িটাকে সর্বাঙ্গ শরীরে পেঁচিয়ে কোমরে যেভাবে গুঁজে দেয় ঠিক তেমনি কটেজের ভেতরে এক একটা লোভনীয় বস্তু গুঁজে দেওয়া রয়েছে।দুজনে রাত্রি যাপন করবে।ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসছে.. জ্যোস্না রাতে মায়াময় এক আরব্য রজনীর মোহময়ী পরিবেশ।রাত গভীর হয়ে আসছে...ঘরে চলে এসেছে শ্যাম্পেনের বোতল আর ইলিশ ভাজা তার সঙ্গে চিকেন ললিপপ।অনেকদিন পর ইলিশের গন্ধ পেলাম। ইলিশের গন্ধ পেলে আমি টিয়া পাখির মত হয়ে যাই,দাঁত দিয়ে নখদিয়ে কামড়িয়ে, আঁচড়িয়ে আমার সাধের ডুপ্লেক্স ভেঙে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে।নির্মাল্যর প্রতি মায়া হয় ওর মায়াবী মুখ আর পাতলা ঠোঁটের মধ্যে এক অসীম রহস্য। মৃগনাভির হরিণের মত মন যখন ছটফট করে তখন ওকে দেখলে আমার টিয়াপাখি মন অবশ হয়ে আসে।আজকের এই কৃত্রিম রাজকীয় পরিবেশ আমার কাছে বিষময় হয়ে ওঠেছে।
পদ্মাপাড়ের মেয়ে আমি। ইলিশের গন্ধ আমার সর্বাঙ্গ শরীরে। মেঠো হাওয়া আর ভ্যাপসা ইলিশের গন্ধে আমাদের শৈশব কেটেছে।পদ্মার পলিমাটি আমার গায়ে হাতে পায়ে লেগে থাকতো।বাবার আরত ছিলো, অনেক মাঝি আসতো ; নৌকো নিয়ে যেতো। দিনের শেষে ওরা তাজা তাজা রূপোলি ইলিশ নিয়ে আসতো।রুপোলী ইলিশের আঁশ মাখানো হাট্টাগাট্টা যুবকরাও আসতো।মোটা মোটা পদযুগল,নধর উরু,চওড়া বুক প্রচন্ড পৌরুষ। ভীষণ সাহসী ওরা। ওদের লগির ঘা, পদ্মার বুককে শতছিন্ন করে এগিয়ে চলে যায় ওদের নৌকা।একবার এক সুঠাম যুবা আমাকে নৌকো করে নিয়ে গেছিল। স্রোতের বিপরীতে লগির ঘায়ে নৌকা হু হু করে এগিয়ে চলছে আর রুপোলি ইলিশ দুধারে ছিটেছিটে পড়ছে।যুবা মাঝি তবু এগিয়ে চলেছে।মাঝে মাঝে নৌকাতে দুএকটি ইলিশ পড়ে গিয়ে ছটফট করছে।আমিও ইলিশের মত ছটফট করছি --মাঝির বাহুবল আর উদোল শরীর দেখে।কী সুঠাম দেহ...গা বেয়ে যে পরিশ্রমের ঘাম কপাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তা আরো আকর্ষণীয় করে তুলছে আমাকে। আমি পদ্মায় ভেসে চললাম ;না যুবার সাথে প্রেমের সমুদ্রে ভেসে চললাম বুঝতে পারছি না।ও আমার পাশে বসুক, গল্প করুক চাইতে লাগলাম।হঠাৎ বলে উঠলাম..
....মাঝি ভীষণ ভয় করছে, চারদিকে গভীর জল।
..ভয় নেই।আমি আছি।আরো ইলিশ দেখতে পাবে।
...মাঝি নৌকো দুলছে, আমি পড়ে যাবো!
মাঝি একলাফে লগি ফেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে।"আমি আছি" কোনো ভয় নেই।আমি আত্মসুখের চেয়েও মহাসুখ অনুভব করছি হৃষ্টপুষ্ট বাহুডোরে।উত্তাল পদ্মার বুকে আমার হৃদয় মহাউত্তাল হয়ে উঠলো।নৌকা ভেসে চললো আমরা দুজনে ভেসে চললাম...
এ রকম সুখ আমি আর পাইনি!'আমি আছি'-শব্দ দুটি এখনো আমার কানে বাজে।এখন আমার মনে হয় কাঁদিয়ে যারা চলে যায় তারা ভালোবাসে অনাবিল।আমি ইলিশ ভাজা হাতে নিয়ে ওকে ভালোবাসতে লাগলাম,ঐ রকম সুখ অনুভব করতে লাগলাম।নির্মাল্য ততক্ষণে অনেক পেগ নিয়ে নিয়েছে,আমার দিকে এক পেগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো….
... নাও,লজ্জা করোনা।আমি আর তুমিই এখানে আর কেউ নেই।
...না তুমিই নাও।আমার ওসব ভালো লাগে না।
...নাও, কিচ্ছু হবে না।আজকাল সব মহিলারাই নেয়।
...অভিরুচির ব্যাপার।আমার ইচ্ছে করেনা!
...তাহলে তুমি,ইলিশ ভাজা খাও।
বুঝতে পারলাম নির্মাল্য "ওসব" শব্দের মানে বুঝতে পারেনি।আমি হাতে ইলিশ ভাজা নিয়ে নীল আলোর মধ্যে ডুবে রয়েছি।আর নির্মাল্য বালিশে মাথা গুজে, দুবাহু ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। বুঝতে পারছি ঐ বাহুতে জোর নেই,বলিষ্ঠতা নেই-বন্ধন নেই।আমি আত্মমগ্ন হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সেই পদ্মার উত্তাল ঢেউ, মাঝির বাহুডোরে আমি, নৌকো ভেসে চলছে ওপরে নীল আকাশ..যৌবনবতী ইলিশেরা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে...
বাইরে জোছ্নার সাদা আলোয় ভরে উঠেছে নিবিড় সাওতাল ডিহির গভীর অরণ্য।ঝিঁঝি পোকার নিরন্ধ্র ডাক আমাকে উত্তাল করে তুলছে ক্রমাগত।গভীর রাতে, কটেজের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ করে আমি ছুটে চললাম অজানার সন্ধানে... আমার সঙ্গে সঙ্গে চলছে গোল চাঁদ।সমস্হ শক্তি দিয়ে জঙ্গলের লতা,কাঁটা গুল্ম ভেদ করে এগিয়ে চলছি...আমার শরীর থেকে রক্ত ঝড়ছে! তবু, আমি এগিয়ে চলছি...
হঠাৎ!মাথার ওপর তাকিয়ে দেখি আমারই সযত্নে লালিত -"টিয়া পাখি"; আমার সঙ্গে উড়ে চলছে।কী আশ্চর্য! ওর একটা -দুটো পালক খসে খসে পড়ছে...
"আমরা, এগিয়ে চলছি"....
No comments:
Post a Comment