Saturday, July 25, 2020


প্রতিশোধ (ছোটগল্প )

সৌরভ সরকার 








সেকেন্ড ইয়ারে যখন আমাদের বখাটে হিসাবে তখন যথেষ্ট নাম হয়েছে পাড়ায় । টিঙ্কু , ডিসু, নির্মাল্য , আর আমি তখন টপ গিয়ারে। সকাল দশটা বাজতে না বাজতে চোখ মুছে বঙ্গা দার এককাপ চা পেটে পড়তে না পড়তে শুরু হয়ে যেত আমাদের রোজনামচার ছ্যাবলামি । দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ে যেত । বেলা পাঁচ টার আগে স্নানে যাওয়া ঘোর পাপ ছিল । স্নান আর খাওয়া টুকু ছাড়া বাড়ি ফেরার কোন প্রশ্নই ছিল না। সন্ধ্যা বেলায় চলে যেতাম পাঁচ মাথা মোড়ের রকে সেখানে আসত টিপু মস্তান । তিনি ছিলেন আমাদের আইডল , এককথায় রকস্টার । টিপু দার মুখ নিসৃত সেইসব বানী আমরা হা করে শুনতাম । তার মাঝে সবে আমরা সিগারেটে হাত পাকিয়েছি । কিন্তু টিঙ্কু আর ডিসু ছিল আপার লেভেলে। মদ গাঁজা তে তখন ওরা ফার্স্ট ডিভিশন । নির্মাল্য আর আমাকে এই নিয়ে অনেক কথা শুনতে হত এমনকি টিপু দার কাছে । টিঙ্কু শুনিয়ে শুনিয়ে বলত “ওদের পুরুষ করতে পারলাম না ” । আমরা দুজন সিগারেটের উপরে উঠতে ভয় পেতাম । ভয় ছিল কন্ট্রোল হারিয়ে যাওয়ার , বাড়ি ফেরার । কিন্তু একটা ভয় আমাদের চারজনেরই ছিল । বাম জ্যাঠা । বাম জ্যাঠা ছিল আমাদের আনঅফিসিয়াল গার্জেন । জমজমাট আড্ডা যে কতবার ভেস্তে দিয়েছে বাম জ্যাঠা তা গুনে বলা যাবে না । খুব অপমান করতেন । সেসব অপমানের পর কারো আড্ডা দেওয়ার মন থাকত না । সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন সৌম্য তোর উচ্চ মাধ্যমিকের অঙ্কের নম্বর যেন কত ? আমি উচ্চ মাধ্যমিকে অঙ্কে একত্রিশ পেয়েছিলাম । ডিসুর কাছে জানতে চাইতেন ওর জয়েন্টের ফলাফল । একে একে সবার দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন করে উদাহরণ দিতেন অরুপ অভয় বিনয়ের । অরুপ অভয়ের রেজাল্ট ছিল দারুণ। বাম জ্যাঠার ভায়ের ছেলে বিনয় ছিল ভদ্রতার দৃষ্টান্ত । মুখ গুঁজে বাড়িতে বসে কেরিয়ার বানাতো ওরা । বাম জ্যাঠা আপাদমস্তক তুলোধোনা শেষে বাজখাঁই গলায় বলতেন “যাও বাড়ি যাও.. বখাটে হয়েছে এক একটা..” । এতো গেলো একটা সিচুয়েসান । সিগারেট খেতে ধরা পড়লে তো রক্ষা ছিল না । সবার বাবাকে বাজারের মধ্যে জোরে জোরে জিজ্ঞেস করতেন “ছেলে ভাত ছাড়া আর কি কি খাচ্ছে একটু দেখবেন .. অন্ধ হয়ে আছেন নাকি আপনারা “। অপমানিত বাপ ক্ষুধার্ত বাঘের চেয়েও খারাপ । চামড়া তুলে দেওয়া হত প্রত্যেকের । যদিও কেউ ঘুণাক্ষরেও একে অপর এর বাড়ির চুড়ান্ত লাঞ্ছনা নিয়ে মুখ খুলতাম না । শেয়ার না হওয়া রাগে বাম জ্যাঠার অবর্তমানে নতুন শেখা খিস্তি গুলো প্রয়োগ করে শান্তি পেতাম । টিঙ্কু রাগে চিৎকার করে করে বলত এসবের প্রতিষোধ একদিন নেবোই আমি .. নির্মাল্য বলত বুড়ো যা বাড়িয়েছে খুব বেশি দিন সহ্য করতে হবে না দেখিস..বুড়োর দিন ঘনিয়ে আসছে ..

দুদিন যেতে পারে নি সন্ধ্যা নাগাদ টিঙ্কু আমি নির্মাল্য টিপু দার বানী শুনছি হটাৎ ডিসুর ফোন। বাম জ্যাঠা কে একটা গাড়িতে মেরে দিয়ে বেরিয়ে গ্যাছে । তড়িঘড়ি সবাই মিলে ছুটলাম ঘটনাস্থলে । পৌঁছে দেখি বাম জ্যাঠার বাইকটা রাস্তার একপাশে দুমড়ে পড়ে আছে । বাম জ্যাঠার প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছে । এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ছুটলাম আমরা । ভর্তি করা হলো । আমাদের পকেট তখন বরাবরের মতই ফাঁকা কিছুই ভালো করে ভাবার সময় ছিল না তখন ।
টিপু দা সব খরচ দিলো ।বিনয় কে ফোন করে বাড়ির লোককে খবর দিতে বলল নির্মাল্য । নির্মাল্য কে খুব ভাঙাচোরা দেখাচ্ছিল । ব্যাপার টা জিজ্ঞেস করে বিপদে পড়লাম। হাসপাতালের করিডোর ভর্তি লোকের সামনে “ভাই আমি এটা কি বলে ফেললাম ” বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল আমাদের সবচেয়ে প্রাকটিক্যাল নির্মাল্য । আমাকেও যে একটা অপরাধবোধ ঘিরে রেখেছে সেটা ওর সামনে প্রকাশ করলাম না ।
ততক্ষণে বাম জ্যাঠার বাড়ির লোকজন চলে এসেছেন । কান্না কাটির পর্ব শেষ হলে রাত দশটা নাগাদ ডাক্তাররা জানালেন ইমিডিয়েট রক্ত লাগবে । হাসপাতালে ব্লাড ব্যাঙ্কে ঐ রেয়ার গ্রুপ টি নেই । ঐ রাতে মহকুমা সদরের ব্লাড ব্যাঙ্কে ছুটলাম ডিসুর বাইকে । এদিকে টিঙ্কু কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কোথাও । ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকেও ঐ নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত পাওয়া গেল না । বাধ্য হয়ে টিঙ্কু কে ফোন করলাম । ফোন ধরে ব অক্ষরের খিস্তি দিয়ে টিঙ্কু জানাল ঐ একই গ্রুপ ওর নিজের আর ও যথারীতি শুয়ে পড়েছে ।
হাসপাতালে যখন আমি আর ডিসু ফিরলাম ততক্ষণে নেশাড়ু টিঙ্কুর রক্ত বাম জ্যাঠার শরীরে।

সাতদিন আমরা সকাল বিকাল হাসপাতালে যেতাম । হাসপাতাল টাকেই আড্ডার জায়গা বানিয়ে ফেললাম। কিন্তু একদিনও বাম জ্যাঠা তার অতি প্রিয় কেরিয়ার ওরিয়েনটেড অরুপ অভয় এমনকি নিজের অতি ভদ্র ভাইপো তাঁর সাথে দেখা তো দূর খোঁজ ও নিল না । ঐ ঘটনার পর আমাদের অপমান তো দুরের কথা কিছুই বলতেন না বাম জ্যাঠা। আসলে খুব ধাক্কা খেয়েছিলেন ।

এক মাস পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাম জ্যাঠা এক অদ্ভুত কান্ড শুরু করে দিয়েছিলেন যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি । ষাট বছর বয়সে বাম জ্যাঠা আপাদমস্তক একজন চ্যাইন স্মোকার হয়ে গেলেন । বঙ্গার দোকানে রোজ দু প্যাকেট নেভি কাট বেশি বিক্রি শুরু হল ।
আর আমাদের অজান্তে ঠিক এ ভাবেই টিঙ্কুর দেওয়া রক্ত অলৌকিক ভাবে প্রতিশোধ এর রূপ নিল ।






No comments:

Post a Comment