ব্যক্তিগত গদ্য : সত্যম ভট্টাচার্য
একটি গোল পৃথিবীর গল্প
সত্যম ভট্টাচার্য
ঘটনা এক(ষাটের দশক)
কালো পিচ রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজে ছাওয়া চা বাগান। তার মাঝে মাঝে গাছ। সেগুলো শেডট্রি। দূরে ফ্যাক্টরী দেখা যায়।সাদা ধোঁয়া ওঠে তার চিমনি দিয়ে।বাতাসে চায়ের গন্ধ ভাসে।ফ্যাক্টরী পেরিয়ে আরো দূরে ডানা মেলে দিয়ে থাকে সবুজ পাহাড়।মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হয় সেখানে আর বৃষ্টি হলেই সে পাহাড় যেন তার সবটুকু নিয়ে চলে আসে আরো হাতের কাছে।কি বলতে চায় সে আসলে?এদিকে বাগানের বুক চিরে চলে গেছে ট্রেনলাইন।কালো ধোঁয়া উড়িয়ে হুইসল বাজিয়ে সেখান দিয়ে চলে যায় ট্রেন।বাগান পেরিয়েই পাহাড়ি নদী। বর্ষাতে তার উথালপাতাল জল ।অন্যসময়ে সে নদী কিন্তু প্রায় খাঁ খাঁ করে।শীতে লোকজন নেমে যায় পিকনিকে।পুজোর সময় ঠাকুর ভাসান হয় ।ব্রিজ দিয়ে চারিদিক কাঁপিয়ে ঝমঝম করে চলে যায় ট্রেন।আর চা বাগানের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা সামান্য চড়াই নিয়ে চলে যায় বাগানের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের দিকে।সে পথের দুপাশে আদিবাসী-নেপালী মহিলারা দল বেঁধে চা পাতা তোলে।ভাগ করে নেয় হাজার দুঃখের কথা চকচকে হাসিতে।হাজার কষ্টেও কিন্তু সে হাসি অমলিন থাকে বরাবর ।
ট্রাক্টরে করে সে বাগান থেকে অনেকের সাথে পাশের গঞ্জের স্কুলে পড়তে যেতো দুই বোন,সাথে থাকতো ছোট একটি ভাই।তাদের মা নেই।অনেকদিনই তাদের খাওয়া হোতো না সকালে,সেভাবেই স্কুল। দিদিমণিরা জানতে পারলে তাদের ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন টিফিন বেলায়।এরপর স্কুল শেষ হলে ফেরার পালা,দাঁড়িয়ে থাকে তারা কোনো জায়গায় একসাথে।তারপর কোনোদিন হাঁটতে হাঁটতে ,কোনোদিন আবার পাথর বোঝাই ট্রাকে করেই তাদের ফিরতে হয়।
দিন কাটে, সময় যায়।দেখতে দেখতে একসময় সেই দুই বোন সবুজ চা বাগানের মায়া কাটিয়ে নতুন বন্ধনে বাঁধা পড়ে চলে আসে শহরে।কিন্তু স্মৃতিদের ভিড়ে কখোনো কি একা থাকা যায়?(নচিকেতা)।তাই তাদের কথায় উঠে আসে সেই গঞ্জের বিভিন্ন জায়গার নাম,তাদের স্কুল, দিদিমণিরা,সেই সবুজে ছাওয়া চা বাগান,রাতের অন্ধকারে পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতির পাল অথবা বাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে কাটানো বিনিদ্র রাত।
লং শট(ক্যামেরা প্যান)
ঘটনা দুই(নব্বই দশক)
মফস্বল থেকে একটি ছেলে পড়তে আসে শহরের স্কুলে।ব্যস্ত রাস্তায় নদীর ওপরের ব্রীজ পেরিয়ে সে একমনে হাঁটে স্কুলের দিকে।আর লোকজন ভিড় পেরিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তার লাজুক চোখ খুঁজে নেয় এক শ্যামলা বর্ণের কমলা স্কার্টকে।একবার দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়।বিনুনি দুলিয়ে পিঠে ব্যাগ নিয়ে সেও হাঁটে স্কুলের দিকে।কাছেই থাকে।ছেলেটি চেনে তার বাড়ি। যেতে আসতে দেখেছে ।সে দেখে সকালের মিঠে রোদ কি মোহময় হয়ে ওঠে সেই কমলা স্কার্টে লেগে।আহা রোদ্দুর কি মিঠে আর নরম হয়ে তখন নেমে আসে শহরের বুকে।ব্রীজের ওপরের প্রতিদিনের যানজটকে তার তখন আর কোন কিছুই মনে হয় না।সে সব যেন ফানুস হয়ে উড়ে যায় আকাশে।মুখোমুখি তখন ব্রীজ পেরোয় সেই বালক আর কমলা স্কার্ট।
এখানেও দিন যায়,সময় কাটে।আর সময়ের সাথে সাথে যে জল বয়ে যেত ব্রীজের নীচের নদীতে, তাতে ভেসে ভেসে আলাদা হয়ে যায় সেই ছেলেটি আর কমলা স্কার্ট।কার যে ঠিকানা লেখা হয় কোথায় কে জানে।
আবার কয়েক বছর পর কিভাবে জানি তাদের দেখা হয়ে যায় শহরের কলেজে।এবারে একই বিষয়ে স্নাতক।ছেলেটি অবাক হয়ে যায়।তার মানে এতদিন যাকে সে দেখেছে ব্রীজের ওপর,সেও তার সাথে একই ক্লাসে পড়ে।তখনও গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসে সে-গোবেচারা,খানিক লাজুক।ওদিকে মেয়েটি কিন্তু বেশ ডাকাবুকো।ছাত্র রাজনীতিতে কলেজে তার বেশ নামডাক।এবারে দুজনের খানিক কথা হয় বটে,সহপাঠী তারা।কিন্তু বন্ধুত্ব টাইপের কিছু হয় না তাদের দুজনের মধ্যে।
লং শট
জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার
ততদিনে সত্যিই কুড়িটি বছর বাদ চলে গিয়েছে জীবনের খাতা থেকে।ছেলেটি হরিপদ কেরানী হয়ে গেলেও সে কিন্তু তোরঙ্গ থেকে মাঝেমাঝেই খুঁজে বের করে তার পুরোনো প্রিয় জিনিসগুলো।তার মায়ের বেড়ে ওঠার চা-বাগান,পুরোনো স্কুল ,সেই গঞ্জ যা এতদিনে আর গঞ্জ নেই,হয়ে গিয়েছে ঝকঝকে মহকুমা শহর।মাঝেমাঝেই সে গিয়ে দাঁড়ায় সেই শহরে।বড় প্রিয় জায়গা তার এটি।কত ধর্ম-বর্ণ-ভাষাভাষীর মানুষ একসাথে মিলে বাস করে এই শহরে।যেন এটিই প্রকৃত ভারত।এক অদ্ভুত আকর্ষণ তার কাছে এই শহরের।তার মা-বাবাও জন্মের পর তাকে নিয়ে থাকতে এসেছিলো এখানেই।
ক্যামেরা প্যান
নিঝুম জৈষ্ঠ্যের দুপুরে ঘু ঘু ডেকে যায় অবিরত।হরিপদ কেরানী শহরের এক চিলতে ফ্ল্যাটে শুয়ে শুয়ে ভাবে তার পুরোনো গ্রামের বাড়ির কথা।কিভাবে সেখানে বিকেল নামতো আর তা পেরিয়ে সন্ধ্যে হতেই হাজার জোনাকী জ্বলে উঠতো চারিদিকে।সে ভাবে এরকম সময়েই তার মা বান্ধবীদের সাথে স্কুল থেকে চা বাগানের মধ্য দিয়ে বাড়ির পথ ধরতো।এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাত তার মুখবইয়ে ভেসে ওঠে শহরের সেই মেয়েটির মুখ।কুড়ি বছর পেরিয়ে সে এখন দেখতে একদমই অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।কিন্তু চোখ,চোখ তো সেই একই রয়ে গিয়েছে। হরিপদ কেরানি মুখবই হাতড়ে দেখে সে সুন্দর গান শোনাচ্ছে সেখানে বসে ।অনেক ভেবেচিন্তে হরিপদ কেরানী বন্ধুত্বের ডাক পাঠায়।পারবে কি তাকে চিনতে সে মেয়ে?আশা নিরাশার দোলাচলে কাটতে থাকে সময়।একসময় সে মেয়ে গ্রহণ করে বন্ধুত্বের ডাক।কথা হয় তাদের।মেয়েটি এখন সেই গঞ্জের স্কুলের দিদিমণি,স্কুল কোয়াটার্সেই তার সংসার।হরিপদ কেরানী আরেকবার পেয়ে যায় আরেক পুরোনো তোরঙ্গের হদিস।বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবে জীবন কি এরকমই জুড়ে থাকার গল্প?
একটি গোল পৃথিবীর গল্প
সত্যম ভট্টাচার্য
ঘটনা এক(ষাটের দশক)
কালো পিচ রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজে ছাওয়া চা বাগান। তার মাঝে মাঝে গাছ। সেগুলো শেডট্রি। দূরে ফ্যাক্টরী দেখা যায়।সাদা ধোঁয়া ওঠে তার চিমনি দিয়ে।বাতাসে চায়ের গন্ধ ভাসে।ফ্যাক্টরী পেরিয়ে আরো দূরে ডানা মেলে দিয়ে থাকে সবুজ পাহাড়।মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হয় সেখানে আর বৃষ্টি হলেই সে পাহাড় যেন তার সবটুকু নিয়ে চলে আসে আরো হাতের কাছে।কি বলতে চায় সে আসলে?এদিকে বাগানের বুক চিরে চলে গেছে ট্রেনলাইন।কালো ধোঁয়া উড়িয়ে হুইসল বাজিয়ে সেখান দিয়ে চলে যায় ট্রেন।বাগান পেরিয়েই পাহাড়ি নদী। বর্ষাতে তার উথালপাতাল জল ।অন্যসময়ে সে নদী কিন্তু প্রায় খাঁ খাঁ করে।শীতে লোকজন নেমে যায় পিকনিকে।পুজোর সময় ঠাকুর ভাসান হয় ।ব্রিজ দিয়ে চারিদিক কাঁপিয়ে ঝমঝম করে চলে যায় ট্রেন।আর চা বাগানের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা সামান্য চড়াই নিয়ে চলে যায় বাগানের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের দিকে।সে পথের দুপাশে আদিবাসী-নেপালী মহিলারা দল বেঁধে চা পাতা তোলে।ভাগ করে নেয় হাজার দুঃখের কথা চকচকে হাসিতে।হাজার কষ্টেও কিন্তু সে হাসি অমলিন থাকে বরাবর ।
ট্রাক্টরে করে সে বাগান থেকে অনেকের সাথে পাশের গঞ্জের স্কুলে পড়তে যেতো দুই বোন,সাথে থাকতো ছোট একটি ভাই।তাদের মা নেই।অনেকদিনই তাদের খাওয়া হোতো না সকালে,সেভাবেই স্কুল। দিদিমণিরা জানতে পারলে তাদের ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন টিফিন বেলায়।এরপর স্কুল শেষ হলে ফেরার পালা,দাঁড়িয়ে থাকে তারা কোনো জায়গায় একসাথে।তারপর কোনোদিন হাঁটতে হাঁটতে ,কোনোদিন আবার পাথর বোঝাই ট্রাকে করেই তাদের ফিরতে হয়।
দিন কাটে, সময় যায়।দেখতে দেখতে একসময় সেই দুই বোন সবুজ চা বাগানের মায়া কাটিয়ে নতুন বন্ধনে বাঁধা পড়ে চলে আসে শহরে।কিন্তু স্মৃতিদের ভিড়ে কখোনো কি একা থাকা যায়?(নচিকেতা)।তাই তাদের কথায় উঠে আসে সেই গঞ্জের বিভিন্ন জায়গার নাম,তাদের স্কুল, দিদিমণিরা,সেই সবুজে ছাওয়া চা বাগান,রাতের অন্ধকারে পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতির পাল অথবা বাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে কাটানো বিনিদ্র রাত।
লং শট(ক্যামেরা প্যান)
ঘটনা দুই(নব্বই দশক)
মফস্বল থেকে একটি ছেলে পড়তে আসে শহরের স্কুলে।ব্যস্ত রাস্তায় নদীর ওপরের ব্রীজ পেরিয়ে সে একমনে হাঁটে স্কুলের দিকে।আর লোকজন ভিড় পেরিয়ে প্রায় প্রতিদিনই তার লাজুক চোখ খুঁজে নেয় এক শ্যামলা বর্ণের কমলা স্কার্টকে।একবার দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়।বিনুনি দুলিয়ে পিঠে ব্যাগ নিয়ে সেও হাঁটে স্কুলের দিকে।কাছেই থাকে।ছেলেটি চেনে তার বাড়ি। যেতে আসতে দেখেছে ।সে দেখে সকালের মিঠে রোদ কি মোহময় হয়ে ওঠে সেই কমলা স্কার্টে লেগে।আহা রোদ্দুর কি মিঠে আর নরম হয়ে তখন নেমে আসে শহরের বুকে।ব্রীজের ওপরের প্রতিদিনের যানজটকে তার তখন আর কোন কিছুই মনে হয় না।সে সব যেন ফানুস হয়ে উড়ে যায় আকাশে।মুখোমুখি তখন ব্রীজ পেরোয় সেই বালক আর কমলা স্কার্ট।
এখানেও দিন যায়,সময় কাটে।আর সময়ের সাথে সাথে যে জল বয়ে যেত ব্রীজের নীচের নদীতে, তাতে ভেসে ভেসে আলাদা হয়ে যায় সেই ছেলেটি আর কমলা স্কার্ট।কার যে ঠিকানা লেখা হয় কোথায় কে জানে।
আবার কয়েক বছর পর কিভাবে জানি তাদের দেখা হয়ে যায় শহরের কলেজে।এবারে একই বিষয়ে স্নাতক।ছেলেটি অবাক হয়ে যায়।তার মানে এতদিন যাকে সে দেখেছে ব্রীজের ওপর,সেও তার সাথে একই ক্লাসে পড়ে।তখনও গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসে সে-গোবেচারা,খানিক লাজুক।ওদিকে মেয়েটি কিন্তু বেশ ডাকাবুকো।ছাত্র রাজনীতিতে কলেজে তার বেশ নামডাক।এবারে দুজনের খানিক কথা হয় বটে,সহপাঠী তারা।কিন্তু বন্ধুত্ব টাইপের কিছু হয় না তাদের দুজনের মধ্যে।
লং শট
জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার
ততদিনে সত্যিই কুড়িটি বছর বাদ চলে গিয়েছে জীবনের খাতা থেকে।ছেলেটি হরিপদ কেরানী হয়ে গেলেও সে কিন্তু তোরঙ্গ থেকে মাঝেমাঝেই খুঁজে বের করে তার পুরোনো প্রিয় জিনিসগুলো।তার মায়ের বেড়ে ওঠার চা-বাগান,পুরোনো স্কুল ,সেই গঞ্জ যা এতদিনে আর গঞ্জ নেই,হয়ে গিয়েছে ঝকঝকে মহকুমা শহর।মাঝেমাঝেই সে গিয়ে দাঁড়ায় সেই শহরে।বড় প্রিয় জায়গা তার এটি।কত ধর্ম-বর্ণ-ভাষাভাষীর মানুষ একসাথে মিলে বাস করে এই শহরে।যেন এটিই প্রকৃত ভারত।এক অদ্ভুত আকর্ষণ তার কাছে এই শহরের।তার মা-বাবাও জন্মের পর তাকে নিয়ে থাকতে এসেছিলো এখানেই।
ক্যামেরা প্যান
নিঝুম জৈষ্ঠ্যের দুপুরে ঘু ঘু ডেকে যায় অবিরত।হরিপদ কেরানী শহরের এক চিলতে ফ্ল্যাটে শুয়ে শুয়ে ভাবে তার পুরোনো গ্রামের বাড়ির কথা।কিভাবে সেখানে বিকেল নামতো আর তা পেরিয়ে সন্ধ্যে হতেই হাজার জোনাকী জ্বলে উঠতো চারিদিকে।সে ভাবে এরকম সময়েই তার মা বান্ধবীদের সাথে স্কুল থেকে চা বাগানের মধ্য দিয়ে বাড়ির পথ ধরতো।এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাত তার মুখবইয়ে ভেসে ওঠে শহরের সেই মেয়েটির মুখ।কুড়ি বছর পেরিয়ে সে এখন দেখতে একদমই অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।কিন্তু চোখ,চোখ তো সেই একই রয়ে গিয়েছে। হরিপদ কেরানি মুখবই হাতড়ে দেখে সে সুন্দর গান শোনাচ্ছে সেখানে বসে ।অনেক ভেবেচিন্তে হরিপদ কেরানী বন্ধুত্বের ডাক পাঠায়।পারবে কি তাকে চিনতে সে মেয়ে?আশা নিরাশার দোলাচলে কাটতে থাকে সময়।একসময় সে মেয়ে গ্রহণ করে বন্ধুত্বের ডাক।কথা হয় তাদের।মেয়েটি এখন সেই গঞ্জের স্কুলের দিদিমণি,স্কুল কোয়াটার্সেই তার সংসার।হরিপদ কেরানী আরেকবার পেয়ে যায় আরেক পুরোনো তোরঙ্গের হদিস।বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবে জীবন কি এরকমই জুড়ে থাকার গল্প?
No comments:
Post a Comment