Showing posts with label অনুগল্প. Show all posts
Showing posts with label অনুগল্প. Show all posts

Saturday, February 24, 2024

 

     ডিলিট   
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
----------------------------------------------------
   হঠাৎ পিছনে তাকাতে ভয় হল। ডোরাকাটা নি:শ্বাস। কালো হলদে বাতাস যেন রেলিং বারান্দায়। একেই সন্ধে থেকে দোয়েলটা একাই বসে আছে ঠায় কার্নিশে। কোন বাড়ি নেই ঘর নেই ওর। অথচ দেখ,  ভোর ভোর সঙ্গী ঠিক এসে যাবে, ধরবে ছুয়ে দেবে, চিৎকার চেঁচামেচি, ঘুমের বারোটা বেজে গেছে ততক্ষণে, ঐ ডোরাকাটা নি:শ্বাস ফেলছে... এত দেরি কেন বাপু, খাওয়া মানে টুকটাক ঘোরো ফের, এত বড় ঘর দোর নিয়ে আছ, মেঝেময় পায়চারি কর তারপর শুয়ে এক ঘুমে সকাল কর, তা না, আজে বাজে সব ভয়, আজে বাজে সময়ের উপর হাত। আর টুকটাক এলোমেলো প্রেম। 
ডোরাকাটার দীর্ঘশ্বাস শোনে, সে কি রে বাপু তোরা! এ বয়সেও.... না থুড়ি, তুই ত বয়সী হবিই না বলেছিস কোনদিন। কে যেন তোকে সেই বরটি দিয়েছিল...  ঐ যে উর্বশীর মত না কি রম্ভা কে জানে! হোকগে যাক, এই যে ভারি রিল্যাক্স মুডে রান্না করেছিস খেয়ে নিয়েছিস... এখন বাপু জপ ধ্যান কর, তা না! একটু করে রান্নাঘর বর্তন মাজাঘষা আবার ভেজা হাতেই হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ! কাকে করিস বাপু দেখি দেখি,... ঘাড়ের কাছে গরম নি:শ্বাস। -ও বাব্বা! ডোরাকাটা পড়বে কি ঐতো অন্ধকার, ঐতো কেরামতি, নিজের পেজ নিজে ছাড়া খোলার উপায় নেই। আর মুহূর্তে সব গায়েব!  এতো সেই দশ বারো বছর আগেও পারতিসনা। 
নির্বোধের মত ছোট্ট হ্যান্ডসেটে পিং পিং বাজলেই ডোরাকাটা গুঁফো ফুলে ঢোল, কান খাড়া। রান্নাঘরে বেজায় রগরগিয়ে রান্নাবান্নার মধ্যেও, সব এদিক সেদিক খবর আদান প্রদান, এ পত্রিকা সে পত্রিকায় লেখা ফ্যাক্স! বারে বা! এত শিখলি কোথায়!... গুঁফো ডোরাকাটা আরো ঝাপটে আসে। গায়ের গন্ধটা কেমন বোঁটকা মত। কেন রে এত সৌখিন আয়োজন, জামাকাপড়ের চাকচিক্য, বয়স মেরে কেটে পঞ্চাশ তাও এদিক ওদিক ধরবে কে আর!... সেই তো আগুন আগুন লম্ফ ঝম্প ডিঙোতে ডিঙোতে বোকা বোকা প্রস্থান। নাটকের যবনিকা পাত। বিশ্ব নাট্য দিবস গেল চলে, তুই করলিটা কি? কিছুই না, শুধু পরিকল্পনা মনে মনে আর মেসেজ ভারাক্রান্ত ছবিগুলো আঙুলের চাপে গায়েব করে দেওয়া নয়তো ঐ দুর্মুখদের যাবতীয় কথোপকথনেই আর রঙ চঙ ঢঙেই বারোমাস। 
এ যাবত তো ডোরাকাটার আরও হাসি পায়, থুড়ি, হাসি না, রাগ আর নিজের ব্যর্থতার প্রতি ঘৃণা জেগে সুপার ইগো কমপ্লেক্স । 'আমি কম কিসে! 'তোরা যতই দেখা বাপু আমি ঐ তোদের পুছিইনা।... আবার বাঘের ছালের পোড়া গন্ধ রান্নাঘর পর্যন্ত, ঐ মহিলার নাম কি! কে জানে, সকাল সকাল সব কাজ ফটফটে কমপ্লিট। দৌড় যেন কচি খুকি টি। এ কাজ, সে কাজ এ ঘর, সে ঘর, না না, দু তিন দিন ঘরদোর এলোমেলো দু-কলম না লেখা সময় কাটে অস্থির অস্থির। 
কেনরে! গুঁফো ভাবে নির্ঘাৎ এলোমেলো প্রেম। পুরুষ পুরুষ। সে ভাবে না, ভাবনাটা মানুষ মানুষ হতে পারে। যে দু'হাতে আগলে এগিয়ে নেবে। ঐ ডোরাকাটার গন্ধ নি:শ্বাস আর চোখ বাঁচিয়ে কোন শান্তির জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে... যতদিন বাঁচবে সে কি হয়!  হয়না। এ যাবত টিফিন ঘর বা মিড ডে মিলের ঘরের রান্নাবান্না, ডিম মাংস কাঁচা অথবা রান্না করা, সেল্ফ হেল্প মাসিদের গাউন, স্কার্ফ, মাস্ক, মাথার টুপি সব ঠিকঠাক আছে কিনা, হাতে গ্লাভস নিয়ে পাঁপড় বিতরণ করছে কিনা এসব দেখতে দেখতে ফটাফট ছবি চলে আসতে থাকে গ্যালারিতে। এক একরকম ড্রেসে ক্ষুদে ছেলে মেয়েগুলো কখনো ফল কখনো থালায় ডিম ভাত মাংস ভাত এক্সিবিট প্রোডাক্ট হয়ে গ্রুপগুলোয় এন্ট্রি পাচ্ছে। অনেকে মুখ দেখিয়ে বেশ আনন্দ আনন্দ ভাব। ঐ সময়টা ডোরাকাটা পিছনে দাঁড়াতে চাইলেও ভয় পায়। না বাবা! ভিড় টিড়...  এখানে ওর ঘাড়ের উপর নি:শ্বাস ফেললে মার খাওয়ার ভয় আছে। এখানে ঐ হলদে, আকাশী শাড়ি মহা মাতব্বর। 
এখানে ঐ চলে আসাটা বন্ধ করতে পারলে বেশ হত।... হুঁ হুঁ বাবা! হবেনা হবেনা। ও এখন আকাশ ছোঁয়া আর মেসেজ গায়েব করে চেয়ারে বসে বসে। 
ডোরাকাটা সব বোঝে, কে যেন কানে কানে কথা বলে, ওর ভেতরে বৃষ্টি আনে। ওর জ্বর হয় আর ও লিখতে থাকে অনর্গল ঝরনা, সুরে কথা বলে বেহিসেবী। কবিতার কথাগুলো সেভাবে নামতে নামতে ছোটে নির্ভেজাল ভাল থাকবে বলে। ইচ্ছের দৌড়ে ও জেতে। আর ডোরাকাটা একটা ঝোপের ভিতর লুকিয়ে হ্যান্ডসেটে একের পর এক ইউটিউবে পর্ণগ্রাফি দেখে। প্রেমে পড়েনা। সেসব প্রেম ট্রেম পাওয়ারও ক্ষমতা দরকার। ডোরাকাটার অদ্ভুত সুন্দর পশমের মত শরীরের দিকে ফিরেও তাকায় না হরিণী। 
সবুজ খোঁজে আর লাফ দিয়ে সাদাটে রাস্তা পেরোয়। এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যের কাছে। সে একা সে সবুজ ঘর সামলে রাখে। অরণ্য সামলায় আর ডোরাকাটার গন্ধ পেলেই সরে সরে ফিরে আসে গুহার ভিতর। এদিক ওদিক এলোমেলো শিঙগুলো
লতায় পাতায় শাখায় জড়িয়ে পড়তে চায়। হরিণী ওর পেলবতা নিয়ে দৃঢ়তার অঙ্গীকারে ঐ গায়েব হয়ে যাওয়া হ্যান্ডসেটের সমস্ত মেসেজ গুলো মন থেকে ঘষে ঘষে তোলে। আবার ভরে, আবার মোছে।
   এভাবেই ওরা সমান্তরাল রাস্তায় হাঁটে পাহাড় পেরোয়। হরিণী কিনে ফেলে পাহাড়টাই পুরো। এবার ও ঐ কচি বাচ্চাদের আর একটু বড়দেরও সত্যিকারের খাবার তুলে দেয় । এত কালের জমানো সব খাবার। আর ঐ অ্যান্ড্রয়েড সেটটাকে দূরে পাহাড়ী ঝরনায় ফেলে দেয় ও। সেটা নীলচে আলোয় ভাসতে ভাসতে চলে। 
-----------------------------------------

শ্রীমান মূর্তিমান

শোভন মণ্ডল



           সবাই তাকে শ্রীমান মূর্তিমান বলে ডাকে। তার যে একটা পিতৃপ্রদত্ত নাম আছে সেটা অনেকে জানেই না। বাবা আদর করে নাম দিয়েছিল অনির্বাণ। কিন্তু নিজের কাছের লোকই সেই নাম ভুলতে বসেছে। আসলে এর পিছনে রয়েছে তার ‘কাজ'। সে স্ট্যাচু সেজে পয়সা ইনকাম করে। আগে বিয়েবাড়ি, জন্মদিন বাড়ি বা কোনো অনুষ্ঠানে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। কিন্তু বছর খানেক একটা স্থায়ী কাজ পেয়েছে। একটা পার্কে রঙ মেখে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ।বিকেল ৩টে থেকে ৬টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা স্থির হয়ে দাঁড়াতে হবে । কোন দিন চার্লি,  কখনো যীশু কখনো ভেনাস হয়ে একটা নির্দিষ্ট বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। নিথর,  স্থির। চোখের পলক পড়ে না।  সে হয়ে উঠেছিল ওই পার্কের বিশেষ একটা আকর্ষণ। মাইনেটা খারাপ পেত না। মাস শেষ হলে হাতে হাতে ছয় হাজার। মোটামুটি তার সংসার চলে যেত।

         সমস্যাটা দেখা দিল দু'বছর পর। অনির্বাণ গায়ে রূপালী রঙ মেখে মূর্তি সাজতো। এই রঙের বেশি ব্যাবহারে সারা শরীরে কী সব যেন বেরোতে লাগলো। ডাক্তার দেখালে জানা গেল এরপর যদি আর এই রঙ মাখা হয় তবে পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাবে। অনির্বাণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এই কাজ বন্ধ করলে সে খাবে কী?  সে জোর করেই মনস্থির  করলো যা হয় হবে,  এই কাজ সে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু স্ত্রীর কথায় এই সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। ভগবানের অসীম করুণা যে এই সময় সে একটা কাজও পেয়ে গেল। পুরীতে একটি হোটেলে ওয়েটারের চাকরী। শ্রীমান মূর্তিমান শীঘ্রই শহর ত্যাগ করলো। 

      বছরের মাঝে দু'বার এলেও একদিনের বেশি বাড়িতে থাকতে পারেনি সে। স্ত্রীকে টাকা দিয়ে ফিরে গিয়েছিল পুরীতে। এবারে এক সপ্তাহের ছুটি পেয়েছে। দু'দিন আয়েশ করে কাটানোর পর কী মনে হলো সে বাস ধরে পৌঁছে গেল সেই পার্কে,  যেখানে সে স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়ে থাকতো।

      পার্কটার নতুন রঙ হয়েছে। গেটের সিকিউরিটিরও পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নেপালী একটা লোক। ওকে চেনে না। পাঁচ টাকার টিকিট। অনির্বাণ টিকিট কেটেই ঢুকলো। মিনিট তিনেক হাঁটার পরই সেই জায়গায় এসে দাঁড়ালো। ঝোপঝাড়, আগাছার জঙ্গল। খুব কাছে যেতে পারলো না। কিন্তু যা দেখলো তাতেই গায়ে শিহরন খেলে গেল।  যে বেদীতে সে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো সেখানে একটা পুরুষ মূর্তি। রূপালী রঙ। অনির্বাণ  অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।  না,  কোনো নড়ন চড়ন নেই। ওর মতো কেউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে ?  মন বলছে,  হতেই পারে না।

কাছে আর গেল না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। 

ফেরার সময় সারা রাস্তা সে বিড় বিড় করে মনকে বোঝাতে লাগলো,   “ওটা কংক্রিটের মূর্তি। জীবন্ত মূর্তি হতেই পারে না। হতেই পারে না.... “




Tuesday, August 3, 2021

 অণুগল্প



 মূল্যবোধ 

অম্বরিশ ঘোষ 



অনন্তর স্ত্রী কিন্তু বিষয়টা বুঝে ফেলেছিল আগেই । চোখ পাকিয়ে অনন্তকে বলতো , "এর নাম বুড়ো বয়সের ছুকছুকানি" । বিষয়টা কম বয়সে অনন্তর মধ্যে নামমাত্র ছিল । কিন্তু বয়সটা সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ হওয়ার পর বিষয়টা একদম জাঁকিয়ে বসেছে । কমবয়সী সুন্দর গড়নের মেয়ে দেখলেই চোখ আটকে যায় আজকাল । তবে স্বস্তি এইটুকুই যে বউ এই নতুন বেড়ে ওঠা আবেগের মাত্র পনেরো-কুড়ি শতাংশের  খবর জানে । আর এতে অপরাধটা কোথায় ? চোখ দিয়ে একটু মেপে-ঝেপে যদি মস্তিষ্কে একটু হ্যাপি হরমোন ক্ষরণ হয় , হোক না !  আজকাল হাট-বাজার- উৎসব-আয়োজনে বেশ সময় কাটে অনন্তর । আজ সোমবার । সকালের চা হাতে নিয়ে পেপারের চোখ বোলাচ্ছে অনন্ত । স্টাডি রুম । দরজা প্রায় ভেজানো । নীল রঙের পর্দা এক-আধটু নড়ছে । গরম চা গলা বেয়ে নামছে ।  পর্দার ওপারে কাজের মেয়েটা উল্টো দিকে ঘুরে ঘর মুছছে ।  কিন্তু ভীষণ অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে । এ'টুকুই সমস্যা ।  তবে কল্পনাশক্তিরও তো একটা ক্ষমতা আছে । দৃষ্টি আর কল্পনা মিলে কয়েক মুহূর্ত ব্যাপারটা জমে ক্ষীর ।  সেই কয়েক মুহূর্ত বাদেই সরে গেল পর্দা । স্ত্রী স্যান্ডউইচ নিয়ে ঘরে ঢুকলো । পর্দা সরতেই চোখে একটা ঝটকা লাগল । নিমেষে সে ঝটকা হার্ট-ব্রেন ছুঁয়ে পৌঁছে গেল সারা শরীরে । যাকে অনন্ত দেখছিল সেটা ওরি মেয়ে রিচা । বডি ফিট রাখতে মোছা ঘরই একটু মোছামুছি । স্ত্রী চলে গেল স্যান্ডউইচ নিয়ে ।  কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছিল শরীরটা । ঘণ্টাখানেক বাদে রিচা এসে হাত খরচের টাকা চাইলো । টাকাটা হাতে নিয়ে বলল ," আজ একটু তাড়াতাড়ি যাচ্ছি ,  বাবা ! স্যার সামাজিক মূল্যবোধের উপর একটা বিশেষ ক্লাস নেবেন " । চলে গেল রিচা । শুধু একটা কথা জানতেও পারলো না । নিজের অজান্তে মূল্যবোধের কি সাংঘাতিক একটা ক্লাস আজ ও বাবাকে করিয়েছে !

Sunday, August 1, 2021

 অণুগল্প 


কার্নিশ : সোমনাথ ঘোষাল 





লোকটার জ্বর। কেউ নেই তেমন। ঘরের জিনিসপত্র ছাড়া। দুটো ঘর। পুরোনো কোয়ার্টারে থাকে। অবসর নিয়েছে শরীর। বাইরে থেকে পাড়ার লোকজন খাবার দিয়ে যায়। 

রোজ দুপুরে কার্নিশে একটা বেড়াল আসে। বেড়ালটাই এখন খোঁজ নেয়। ভয় পায় না। তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। দুপুরের মাছটা রোজ ছুঁড়ে দেয়। তারপর নিজের ভাত ডাল তরকারি আর মাছের ঝোলটুকু খেয়ে, মৌরি চিবিয়ে চিবিয়ে বেড়ালের সঙ্গে গল্প করতে থাকে। নিজের হাবিজাবি কথা। বেড়াল ঝিমোয়। ঢুলে পড়ে ঘুমে। আবার তাকায়। 

জানলাটা খোলাই আছে। বেড়ালটা জানলার দিকে তাকিয়ে। সারা দুপুর জেগে আছে বেড়ালটা। ঘুম আসছে না। দু তিন দিন হয়ে গেল। জানলাটা খোলাই আছে!


অনুগল্প 



 পোস্টবক্স "  ✍️সোনালী জানা



হাওড়া স্টেশনে সারিবদ্ধ চকচকে চেয়ারগুলো | কতো মানুষ আসছে | বসছে | সময় হলে উঠে যাচ্ছে | এগারো নং প্লাটফর্মের সোজাসুজি ডানদিকের একেবারে শেষ চেয়ারটা, আমার ভারি পছন্দের |

বসে বসে দেখি মানুষের সমাগম | স্রোত | হইচই, ছুটোছুটি |একটা হুইসেল, একটা গন্তব্য |

তাকিয়ে দেখি | আর খুঁজি | গত বছরও ঠিক এই দিনে এখানে বসেছিলাম | বসেছিলো সেও |
পাশাপাশি কতো কথা, কতো স্বপ্ন | আরও কাছাকাছি | ক্রমশ স্পষ্ট হয় নিঃশ্বাসের শব্দ |

অজান্তেই হাত চলে যায় সিটটায় | হ্যাঁ অনুভব করছি সেই উষ্ণতা, ছোঁওয়া, চেনা গন্ধটা |

কিন্তু এখন সে কোথায়? কেউ জানে না |বড়ো অদ্ভুদ! একটা জলজ্যান্ত মানুষ কী ভাবে উবে যেতে পারে? ঠিকানা, ফোন সব পাল্টে দেয় ?
এখন তাহলে কীভাবে জানাবো আমার জমে থাকা কথা?

ধীরে ধীরে বের করি চিঠিটা | যেটা বারবার পাঠাই, কিন্তু ফিরে ফিরে আসে |
হঠাৎ কেন জানিনা ওই লাস্ট চেয়ারটাকেই পোস্টবক্স মনে হয় | সযত্নে রেখে আসি চিঠিটা |

যদি সে আসে |




Tuesday, January 5, 2021

শেষ দেখা

 সুবিনয় দাস 


  রাত তখন প্রায় ১২ টা। ট্রেনটা কোন স্টেশনে এসে দাঁড়াল সুবীর ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। ক্লান্ত শরীর নিয়েই সে আপার বার্থ থেকে শুনতে পারছিল কাটনি বা সাতনা হবে। হঠাৎ সে ট্রেনের কোনাকোনি জানলা দিয়ে দেখতে পায়, অসংখ্য যাত্রীর ছোটাছুটি। কি হল? সে বুঝতে পারল না। নীচের বার্থ গুলিতে যারা ছিল, তারাও তীব্র বেগে বাইরে বেড়িয়ে গেল। ট্রেনে ওঠা হয়েছে তো সেই সকালে, পেটে একটি দানাও পরে নি। 

  মায়ানগরি মুম্বাইতে সুবীর গিয়েছিল কাজের সন্ধানে। বর্তমান বঙ্গভুমির এমনি হাল, যা কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। বাংলার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বাড়ি থেকে কমপক্ষে একজন করে সদস্য জীবিকার সন্ধানে বঙ্গ বহির্ভূত এলাকায় পারি দেয়। সুবীরও তাদের মধ্যে একজন। মুম্বাইতে নির্মাণ শিল্পে শ্রমিকদের বেশ চাহিদা। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে ছন্দপতন ঘটাল অজানা এক মারণ ভাইরাস। আক্রান্তের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন স্থানকে লাল-সবুজ-কমলা করা হল। মুম্বাই অতিদ্রুত লাল অঞ্চলের শিরোপা গ্রহন করল। সুবীরের মনে আছে লকডাউন না কি যেন একটা হরতালের মতো চালু হওয়াতে সমস্ত দোকানপাট, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেল। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল ‘এদেশে কতই না হরতাল হয়েছে, কতই না বন্ধ হয়েছে। এই বন্ধও কয়েকদিনের’। কিন্তু এই বন্ধও তো আর খুলে না। মালিক এক সপ্তাহ খাওয়াল, পরের তিন সপ্তাহে নিজের জমান টাকা ফুরাল। আলিপুদুয়ারের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সুবীরের অসুস্থ বৃদ্ধ বাবার ফোন আসে – ‘বাবা দিনকাল বেশি বালা না, আমি আর কয়দিন বাঁচুম জানি না? তর মুখটা দেহনের খুব ইচ্চা করতাচে রে’। সুবীর মাস ছয়েক আগে যখন মুম্বাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে পারি দেয়, সে দেখেছিল বাবার শরীর ভাল নেই। বয়স হয়েছে। আজ যখন কাতারে কাতারে ঘরছাড়া জীবিকাসন্ধানী মানুষেরা ঘরে ফিরার ইচ্ছায় রাস্তায় নেমেছে, সেও তখন ক্ষুদা ক্লান্তি আর শুন্য পকেটকে সঙ্গী করে ট্রেনে উঠে পরেছে। ঘরে ফিরবে বলে। বাবার অপত্য আবদার পুরন করবে বলে। 

  একটুও কাল বিলম্ব না করেই সুবীর ক্লান্ত, ক্ষুদাপীড়িত দেহটাকে এক ঝটকায় কিছু শক্তি সঞ্চয় করে নিচে নেমে পরে। এক লহমায় পৌঁছে যায় ট্রেনের দরজায়। বাইরে তখন অগণিত যাত্রীর খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি। সুবীরও আগ-পিছু, ভাল-মন্দ না ভেবেই কারাকারি-মারামারিতে অনশগ্রহন করে। হাতে লাগল দশটি চিপসের প্যাকেটের একটি চেইন আর দুখানা কেকের প্যাকেট। খাদ্য সংগ্রহের সংগ্রামে থুঁতনিতে কখন যে কার হাত সজোরে এসে লাগল, সুবীর বুঝতে পারেনি। ট্রেনে ফিরে, বার্থে বসে মনে হল ঠোঁটটা কেটে গেছে। আরও দুদিনের যাত্রা। তারপর নিজ গ্রাম। আগামী দুদিন কেটেছিল এই দশখানা চিপসের প্যাকেট আর দুটি কেক দিয়েই। আলিপুরদুয়ারে ট্রেন সকাল পাঁচটা নাগাদ দাঁড়াবে। 

  তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। ট্রেন তাদের নামিয়ে দিয়ে গৌহাটির উদ্দ্যেশ্যে চলে যাবে। দূরে দেখা যাচ্ছে পুলিশের কড়া নজরদারি। ট্রেনের সমস্ত কোচ থেকে এই জীবিকাসন্ধানী লৌহমানবরা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ শিরোপায় ভূষিত হয়ে লাইন দিয়ে নামছে। সুবীরের জানা ছিল বাইরের রাজ্য থেকে আগত এই ঘর ফেরৎ শ্রমিকদের চৌদ্দদিনের কোয়ারিন্টনে যেতে হয়। তারপর সব ঠিক থাকলে, বাড়িতে। আর সন্দেহ হলে অনিশ্চিতপুরের যাত্রা। 

  ‘কিন্তু, বাবা তো অসুস্থ। আমাকে দেখতে চায়!’         

সাতপাঁচ ভেবে সুবীর চালাকি করে। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে সে কোচের ভিতর দিয়ে শেষের কোচটিতে পৌঁছে যায়। আলো আঁধারি অবস্থায় কোন ভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। কোনক্রমে সে নিজ গ্রামে পৌছায়। তার ভাবনাই ছিল অসুস্থ বাবার মুখখানা দেখে সে নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দিবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশের অতন্দ্র প্রহরায় সে ধরা পরে। নিমেশে তার সমস্ত আশা নিরাশার রুপ নেয়। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল- 

 ‘একটি বার স্যার, একটি বার শুধু। বাবার মুখখানা দেখেই ফিরে আসব’।   

নিয়মের কাছে পুলিশেরও হাত-পা বাঁধা-

 ‘আপনি রেড জোন থেকে ফিরে এসেছেন, আমরা এত বড় রিস্ক নিতে পারিনা, বোঝার চেষ্টা করুন’। 

  সুবীরকে কোয়ারিন্টনে পাঠান হয়। বাবার সাথে দেখা হয় নি। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা জানতে পেরেছিল সুবীর ফিরেছে। বাবা দেখল সুবীর তার চোখের সামনে এসে বলছে- ‘বাবা আমি ফিরছি, এই দেহো, আমি, আমি তোমার সুবীর’। সকাল আটটা নাগাদ বয়স্ক বাবা সুবীর সুবীর বলে হঠাৎ নিস্তব্দ হয়ে গেল। না ফিরার দেশে তিনি পারি দিয়েছেন। মরদেহ উঠানের মাঝে রাখা হল। সুবীর তখনও কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে, পাশে দুজন পুলিশকর্মী। নিস্তব্দ, নিথর সুবীরের চোখ থেকে অঝোরে জল বয়ে যায়। মুখে শুধু একটিই কথা-

  ‘বাবা শেষ দেখাটা! 

   শেষ দেখাটা! 

   শেষ দেখাটা আর হল না! 

   ক্ষমা কর আমায়’।  


Friday, November 20, 2020

 ভুল 

সোমনাথ বেনিয়া

ব‌উটি প্রতিদিন তুলসীমঞ্চে সন্ধ‍্যাবেলায় প্রদীপ জ্বালাতো তার স্বামীর আরোগ‍্য কামনায় আর সকালে নিভে যাওয়া প্রদীপ আনার সময় একটি তুলসীপাতা তুলে আনতো তার স্বামীকে মধু দিয়ে খাওয়ানোর জন‍্য।
     একদিন সকালে সেই ব‌উ ঘুম থেকে উঠে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুমাচ্ছে আর তার মুখের উপর প্রদীপ শিখার মতন একটি উজ্জ্বল আভা তৈরি হয়ে আছে। সেটা দেখে সে ভীষণ খুশি হলো। বিছানা থেকে নেমে সে তুলসীমঞ্চে গেল এবং দেখলো এক অদ্ভুত ব‍্যাপার যে প্রদীপটি তখন‌ও এক‌ই ভাবে জ্বলছে যেমনটি সে সন্ধ‍্যাবেলায় জ্বালিয়ে গিয়েছিল। সাধারণত প্রদীপটি নিভে যায় এবং সকালে সেটাকে তুলে আনার সময় একটি তুলসীপাতা তুলে এনে ঘরে ঢোকে। তাই সে অবাক‌ই হোলো। কিন্তু অতশত না ভেবে সে প্রদীপের শিখাটি এক ফুঁয়ে নিভিয়ে একটি পাতা তুলে এনে ঘরে ঢুকলো। তারপর স্বামীকে ডাকতে গিয়ে দেখে তার মুখের উজ্জ্বল আভা চলে গিয়ে সেখানে পোড়া দাগের কালশিটে ছোপ পড়ে আছে ...

নির্জন পার্ক

শোভন মণ্ডল

এই পার্কটা বেশ নির্জন। ঊর্মি দু'দিন ছাড়া এখানে আসে। ঝিলের ধারে এই বেঞ্চটা তার খুব পছন্দ। লোকজন খুব একটা এদিকে আসেনা। একটা গভীর ঝোপ জায়গাটাকে আড়াল করে রেখেছে।

অন্যদিনের মতো ঊর্মি এখানে এসে বসলো।ব্যাগটা পাশে রেখে রুমালটা বের করে ভালো করে মুখ মুছলো। ঢকঢক করে বোতল থেকে জল খেল খানিকটা। তারপর যথারীতি কালো ব্যাগটা থেকে ল্যাপটপটা বের করে কোলের ওপর রাখলো। খটখট করে টাইপ করতে লাগলো। আসলে সে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। বিভিন্ন আর্টিকেল লিখে সংবাদপত্রে মেল করে পাঠায়। এই পার্কের বেঞ্চটাই তার কাজের ডেস্ক হয়ে উঠেছে বেশ কিছুদিন। অনেকক্ষণ কাজ করার পর ল্যাপটপটা মুড়ে রেখে একটু আড়মোড়া ভাঙলো সে।

বেলা পড়ে এসেছে। তবে বিকেলের আলো এখনও ঝিলের ওপরে খেলা করছে। এইসময়ই একটা বৃদ্ধ লোক লাঠি হাতে বেঞ্চির কাছে এসে ইতস্তত করছিল বসার জন্য। ঊর্মি ব্যাগদুটো আর জলের বোতলটা নিজের দিকে সরিয়ে নিয়ে কিছুটা জায়গা করে দিল। বৃদ্ধমানুষটিকে তবুও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঊর্মি মৃদু হেসে বললো,  বসতে পারেন।

বৃদ্ধ বসলেন। দুচোখে প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট।

খুব স্টাইলে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ মাই সান

ঊর্মি কোনো কথা বললো না। আবার ল্যাপটপ খুলে কাজ শুরু করলো। আলো কমে যাবার আগেই লেখাটা শেষ করতে হবে তার।

অনেকক্ষণ কাজে মগ্ন থাকার পর বৃদ্ধের একটি কথায় তাল কাটলো ঊর্মির।

--তোমার নাম কী মা?

--ঊর্মি

--তোমার অসুবিধা হচ্ছেনা তো? 

--এ মা,  অসুবিধা হবে কেন? অবাক হয়ে বললো ঊর্মি।

-- আসলে জানো তো মা, আগে এখানে প্রায়ই আসতাম। আমার স্ত্রী আর আমি এই বেঞ্চিটাতে এসেই বসতাম। উনি চলে যাবার পর আর আসিনা। তবে বছরে এই একটি দিন...

বলে বৃদ্ধ যেন চোখ মুছলেন। ঊর্মি কাজের কথা ভুলেই গেছে।

--কোন দিন...?  মুখ ফুটে প্রশ্নটা করেই ফেললো।

Monday, October 26, 2020

 অণুগল্প


 সরীসৃপ সঙ্গ (২) 

               অম্বরীশ ঘোষ 




আগে কখনো সুস্নেহ  এভাবে চমকে ওঠেনি । টিভিতে মুভি দেখছিল ও । হঠাৎ দেখল যে কিচেনের জানালা দিয়ে একটা বড়সড় কালো কুচকুচে সাপ মা বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল । সে কি গতি সাপটার !  মা-বাবাকে বাঁচানোর জন্য সুস্নেহ ঢুকলো ওই ঘরে । খাটের নিচ থেকে শুরু করে ঘরের সর্বত্র খুঁজলো ভয়ে ভয়ে । না , কিছুই নেই । কিন্তু নিজের চোখে দেখা ঘটনা ! পরের দিন আবার প্রায় একই সময় । এবং তাজ্জব ব্যাপার , আবার সেই একই ঘটনা । ওই বিশাল বড় কালো কুচকুচে সাপটা কিচেনের জানালা দিয়ে ঢুকলো । বীভৎসভাবে এঁকে বেঁকে গিয়ে ঢুকলো মেয়ের পড়ার রুমে। আঁতকে উঠে সুস্নেহ ঢুকলো মেয়ের ঘরে । পিতৃস্নেহে ভয়-ডর বাদ দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলো  ঘরের সর্বত্র । না কোথাও কিচ্ছু নেই ! আজ বাড়ির সকলে বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে চাইছে না । সকলে বলছে যে সুস্নেহর কোথাও নিশ্চয়ই একটা ভুল হচ্ছে । কিন্তু সুস্নেহ কি করে নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবে ! তৃতীয় দিন বিষয়টার বীভৎসতা একেবারেই আলাদা । একই সময়ে স্ত্রী ইচ্ছে করেই নজর রাখছে  জানালাটায় । সুস্নেহ একটু অস্থির মন নিয়ে টিভিতে খবর শুনছে । আবার জানালা দিয়ে ওই কালো মিশমিশে সাপটা ঢুকে পড়ছে । সুস্নেহ বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে সাপটার দিকে । সাপটা একটু থেমে দাঁত বের করে তাকালো ওর দিকে ।  তারপর অন্যদিনের চাইতেও বেশি গতিতে এসে ঢুকে পড়ল ওর বুকের ভেতর । বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে বসে পড়ল সুস্নেহ । কিন্তু বুকে কোন ক্ষতচিহ্ন না থাকায় কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারল না ।

Saturday, July 25, 2020

অনুগল্প.....

রজনীগন্ধা
সুকান্ত আচার্য্য


সমীরণ বাবু আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন, রজনীগন্ধার সুবাস আসছে, সেই চেনা সুবাস। ওকে যখন প্রথম দেখেছিলেন ঠিক এমনই সুগন্ধ আসছিল ওর খোঁপায় বাঁধা রজনীগন্ধা থেকে। তারপর সেই সুবাস মেখে নিয়েছিলেন বিবাহ বাসরে। একদিন উঠোন ভরে উঠেছিল ওরই লাগানো রজনীগন্ধা গাছে, সেই চেনা সুবাসে মেতেছিল চারিদিক।

         আজও ওই চেনা গন্ধটা ভেসে আসছে , তবে এটা আসছে দেওয়ালে টাঙানো ওর ছবি থেকে। এক বছর আগে এমনই এক অভিশপ্ত দিনে ওকে বিদায় জানিয়েছিলেন রজনীগন্ধার মালায় ঢেকে। সেই চেনা গন্ধটা সেদিনও ভেসে আসছিল এমন ভাবেই।

অনুগল্প : রঙ্গন রায়ের কলমে 
ভাঁজ
রঙ্গন রায়



        কথায় বলে 'এমন ভাঁজ দেবোনা!' কিন্তু এরকম ভাঁজ কেউ কখনোই দেননি কাজল বাবুকে। কাজেই ভাঁজ সম্পর্কিত কোনো স্বচ্ছ ধারণা তাঁর থাকবার কথা নয়। মুশকিল টা হলো সেদিন যেদিন ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে তিনি পায়ে মাটি পেলেন না এবং  বিছানা থেকে নামার পথেই স্রেফ হারিয়ে গেলেন। অনন্ত শূন্যতার  পর কাজল বাবুর মনে হল তিনি একটা মাঠের মধ্যে এসে পড়েছেন। নরম সবুজ মোলায়েম ঘাস। এটা কি করে হল? বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাঠে? না , ব্যপারটা গোলমেলে। নির্ঘাৎ স্বপ্ন এখনো রানিং। কিন্তু যখন একটা বলের মত কিছু এসে সজোরে তার বাম  কাঁধে আঘাত করলো এবং তিনি ব্যাথায় ককিয়ে উঠলেন তখন ব্যাপারটাকে আর স্বপ্ন বলে চালানো গেলোনা। এরপরই বাঁশির শব্দ। এবং একপাল লোককে তিনি তার দিকে ছুটে আসতে দেখলেন।
- আরে কী হয়েছে জগন্নাথ দা! কোন জায়গায় লেগেছে? এটা নিশ্চয়ই দক্ষিণ পাড়ার লেন্ডুর কাজ। জানে তোমাকে কাবু করলেই ম্যাচ ওদের হাতে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
তারপরই হৈহৈ লেগে গেলো মাঠের মধ্যে। কাজল বাবু শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। বোঝার চেষ্টা করেও মাথায় ঢুকছেনা কিছুই। এরা তাকে জগন্নাথ দা বলছে কেন? আর ফুটবলার?  তিনি কোনোদিন ফুটবল পায়ে ছোঁয়ানো কেন টিভিতে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের ম্যাচ অবধি দেখেননি।
একটুপরেই কারা যেন মাঠের তুমুল মারামারি আর গন্ডগোল থামালো এবং ফের খেলা শুরু হল। কাজল বাবু ওরফে জগন্নাথ  দা নিজের দিকে তাকিয়ে সত্যিই ঘাবড়ে গেছেন। লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে ঘুমিয়ে উঠে যদি দেখা যায় কারোর গায়ে ফুটবলের জার্সি তাহলে শুধু অবাক নয় আরোও অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু এখন কাজল বাবু সবার সাথে ছুটছেন। কাঁধে ওরা কী যেন স্প্রে করে ব্যাথা কমিয়ে দিয়েছে। শুন্য মস্তিষ্কে দৌড়তে দৌড়তে কাজল বাবু বুঝলেন কেউ তাকে লেঙ্গি মারলো এবং তিনি পড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য!  এবার তিনি মাঠে পড়লেন না। একটা অনন্ত কালো গহ্বরের  মধ্যে দিয়ে পড়ে যেতে লাগলেন।

- এই তো মশায় ফিরেছেন। উফফফ কী টেনশনে পরে গেছিলাম। আপনি না ফিরলে তো এই বউ বাচ্চা সব আমাকেই সামলাতে হত! কী কষ্টই না হত তখন!
- মানে!
- মানে আর কিছুই না। এরকম ভাঁজ মাঝে মাঝে প্রকৃতি দেয়। মানে  আপনি আমার সময়ে আর আমি আপনার সময়ে চলে যাই। এটা হয়। ডাইমেনশনাল ব্যাপার স্যাপার বুঝলেন কি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা ৫-১০ মিনিটেই সাঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু এর বেশি হয়ে গেলেই চাপ। তার আর ফেরা হয়না। এই যেমন আপনি পাক্কা ১১ মিনিটে ফিরলেন। আমার তো ভয় শুরু হয়ে গেছিল মশাই!
- এই এটা কেরে? কী সব বকে যাচ্ছে। এই আপনি কে? আমার ঘরে ঢুকলেনই বা কী করে?  আর ডাইমেনশন টাইম , এটা কী ফিজিক্সের ক্লাস হচ্ছে নাকি! সকাল সকাল দিলেন তো মেজাজটা চটকে। 
- সেটাই। আসলে আমি তো প্রায়ই এই ভাঁজের মধ্যে পড়ে, উহু , পড়ে যাইই বা বলি কি করে। আমিই তো এই ভাঁজের স্রষ্টা !
- মানে?
- এটা ফোর্থ ডাইমেনশনাল ব্যাপার , আপনার নিরেট আর্টসের বুদ্ধিতে এসব ঢুকবেনা। আমার পরিচয় যদি জানতেই চান তো দিতে পারি। তবে স্বয়ং অর্জুন অবধি আমার পরিচয় সহ্য করতে পারেনি কিন্তু! 
- এই গাঁজাখোর টা কোত্থেকে এলোরে! এই মোহিনী , শুনছো!
- আমি সেই এগারো নম্বর ফুটবলার। দেখুন এই জার্সিটাই তো আপনি পরে ছিলেন তাইনা? আমার নাম জগন্নাথ। পাড়ার সকলের জগন্নাথ দা।
বলে লোকটা  বিছানা থেকে নামতে গেলো এবং কাজল বাবু নিজের চোখকে সত্যিই  বিশ্বাস করতে পারলেননা , লোকটা একদম ভোজবাজির মতই অদৃশ্য হয়ে গেল!

- আজ্ঞে কর্তামশায়ের ঘুম ভাঙলো? আজকে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে আমার পুজো দিতে যাওয়ার কথা না? আর তুমি এতক্ষণ ধরে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছো ? কোনো কান্ডজ্ঞান নেই তোমার! ছিঃ! স্বয়ং জগন্নাথও কোনোদিন তোমার পুজো নেবেনা এই বলে দিলাম। হ্যাঁ। 
কাজল বাবু পাশ ফিরে উঠতে গিয়ে দেখলেন তার বা কাঁধে এখনো ব্যাথা রয়ে গেছে।