শেষ দেখা
সুবিনয় দাস
রাত তখন প্রায় ১২ টা। ট্রেনটা কোন স্টেশনে এসে দাঁড়াল সুবীর ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। ক্লান্ত শরীর নিয়েই সে আপার বার্থ থেকে শুনতে পারছিল কাটনি বা সাতনা হবে। হঠাৎ সে ট্রেনের কোনাকোনি জানলা দিয়ে দেখতে পায়, অসংখ্য যাত্রীর ছোটাছুটি। কি হল? সে বুঝতে পারল না। নীচের বার্থ গুলিতে যারা ছিল, তারাও তীব্র বেগে বাইরে বেড়িয়ে গেল। ট্রেনে ওঠা হয়েছে তো সেই সকালে, পেটে একটি দানাও পরে নি।
মায়ানগরি মুম্বাইতে সুবীর গিয়েছিল কাজের সন্ধানে। বর্তমান বঙ্গভুমির এমনি হাল, যা কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। বাংলার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বাড়ি থেকে কমপক্ষে একজন করে সদস্য জীবিকার সন্ধানে বঙ্গ বহির্ভূত এলাকায় পারি দেয়। সুবীরও তাদের মধ্যে একজন। মুম্বাইতে নির্মাণ শিল্পে শ্রমিকদের বেশ চাহিদা। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে ছন্দপতন ঘটাল অজানা এক মারণ ভাইরাস। আক্রান্তের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন স্থানকে লাল-সবুজ-কমলা করা হল। মুম্বাই অতিদ্রুত লাল অঞ্চলের শিরোপা গ্রহন করল। সুবীরের মনে আছে লকডাউন না কি যেন একটা হরতালের মতো চালু হওয়াতে সমস্ত দোকানপাট, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেল। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল ‘এদেশে কতই না হরতাল হয়েছে, কতই না বন্ধ হয়েছে। এই বন্ধও কয়েকদিনের’। কিন্তু এই বন্ধও তো আর খুলে না। মালিক এক সপ্তাহ খাওয়াল, পরের তিন সপ্তাহে নিজের জমান টাকা ফুরাল। আলিপুদুয়ারের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সুবীরের অসুস্থ বৃদ্ধ বাবার ফোন আসে – ‘বাবা দিনকাল বেশি বালা না, আমি আর কয়দিন বাঁচুম জানি না? তর মুখটা দেহনের খুব ইচ্চা করতাচে রে’। সুবীর মাস ছয়েক আগে যখন মুম্বাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে পারি দেয়, সে দেখেছিল বাবার শরীর ভাল নেই। বয়স হয়েছে। আজ যখন কাতারে কাতারে ঘরছাড়া জীবিকাসন্ধানী মানুষেরা ঘরে ফিরার ইচ্ছায় রাস্তায় নেমেছে, সেও তখন ক্ষুদা ক্লান্তি আর শুন্য পকেটকে সঙ্গী করে ট্রেনে উঠে পরেছে। ঘরে ফিরবে বলে। বাবার অপত্য আবদার পুরন করবে বলে।
একটুও কাল বিলম্ব না করেই সুবীর ক্লান্ত, ক্ষুদাপীড়িত দেহটাকে এক ঝটকায় কিছু শক্তি সঞ্চয় করে নিচে নেমে পরে। এক লহমায় পৌঁছে যায় ট্রেনের দরজায়। বাইরে তখন অগণিত যাত্রীর খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি। সুবীরও আগ-পিছু, ভাল-মন্দ না ভেবেই কারাকারি-মারামারিতে অনশগ্রহন করে। হাতে লাগল দশটি চিপসের প্যাকেটের একটি চেইন আর দুখানা কেকের প্যাকেট। খাদ্য সংগ্রহের সংগ্রামে থুঁতনিতে কখন যে কার হাত সজোরে এসে লাগল, সুবীর বুঝতে পারেনি। ট্রেনে ফিরে, বার্থে বসে মনে হল ঠোঁটটা কেটে গেছে। আরও দুদিনের যাত্রা। তারপর নিজ গ্রাম। আগামী দুদিন কেটেছিল এই দশখানা চিপসের প্যাকেট আর দুটি কেক দিয়েই। আলিপুরদুয়ারে ট্রেন সকাল পাঁচটা নাগাদ দাঁড়াবে।
তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। ট্রেন তাদের নামিয়ে দিয়ে গৌহাটির উদ্দ্যেশ্যে চলে যাবে। দূরে দেখা যাচ্ছে পুলিশের কড়া নজরদারি। ট্রেনের সমস্ত কোচ থেকে এই জীবিকাসন্ধানী লৌহমানবরা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ শিরোপায় ভূষিত হয়ে লাইন দিয়ে নামছে। সুবীরের জানা ছিল বাইরের রাজ্য থেকে আগত এই ঘর ফেরৎ শ্রমিকদের চৌদ্দদিনের কোয়ারিন্টনে যেতে হয়। তারপর সব ঠিক থাকলে, বাড়িতে। আর সন্দেহ হলে অনিশ্চিতপুরের যাত্রা।
‘কিন্তু, বাবা তো অসুস্থ। আমাকে দেখতে চায়!’
সাতপাঁচ ভেবে সুবীর চালাকি করে। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে সে কোচের ভিতর দিয়ে শেষের কোচটিতে পৌঁছে যায়। আলো আঁধারি অবস্থায় কোন ভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। কোনক্রমে সে নিজ গ্রামে পৌছায়। তার ভাবনাই ছিল অসুস্থ বাবার মুখখানা দেখে সে নিজেই পুলিশের হাতে ধরা দিবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশের অতন্দ্র প্রহরায় সে ধরা পরে। নিমেশে তার সমস্ত আশা নিরাশার রুপ নেয়। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল-
‘একটি বার স্যার, একটি বার শুধু। বাবার মুখখানা দেখেই ফিরে আসব’।
নিয়মের কাছে পুলিশেরও হাত-পা বাঁধা-
‘আপনি রেড জোন থেকে ফিরে এসেছেন, আমরা এত বড় রিস্ক নিতে পারিনা, বোঝার চেষ্টা করুন’।
সুবীরকে কোয়ারিন্টনে পাঠান হয়। বাবার সাথে দেখা হয় নি। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা জানতে পেরেছিল সুবীর ফিরেছে। বাবা দেখল সুবীর তার চোখের সামনে এসে বলছে- ‘বাবা আমি ফিরছি, এই দেহো, আমি, আমি তোমার সুবীর’। সকাল আটটা নাগাদ বয়স্ক বাবা সুবীর সুবীর বলে হঠাৎ নিস্তব্দ হয়ে গেল। না ফিরার দেশে তিনি পারি দিয়েছেন। মরদেহ উঠানের মাঝে রাখা হল। সুবীর তখনও কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে, পাশে দুজন পুলিশকর্মী। নিস্তব্দ, নিথর সুবীরের চোখ থেকে অঝোরে জল বয়ে যায়। মুখে শুধু একটিই কথা-
‘বাবা শেষ দেখাটা!
শেষ দেখাটা!
শেষ দেখাটা আর হল না!
ক্ষমা কর আমায়’।
No comments:
Post a Comment