Monday, August 31, 2020

প্রবন্ধের শিরোনাম : দর্শক- দর্শন - সুজিত রেজ

 প্রবন্ধের শিরোনাম :  দর্শক- দর্শন 

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ 

সুজিত রেজ




বছরে শতখানেক নাটক দেখার সুযোগ অতি সৌভাগ্যের। নিশ্চিতরূপে  অধমের মস্তকে ভরত-অ্যারিস্টটলের আশীর্বাদ। গুচ্ছেন নাটক দেখার নেপথ্য কারণ---- " বাড়ির পাশে আরশিনগর " (রবীন্দ্রভবন)। কাঁকতালেই বলা যায়। ইচ্ছে হলে নাট্যবিরতিতে বৌয়ের হাতের চা-পানও সম্ভব। তাছাড়াও , নাটক দেখায় আমার কোনও বাছবিচার নেই। বড়-মেজো- সেজো-ন' সব দলেরই প্রযোজনায় হাজির হই।

আর নাটকের প্রতি প্যাশন যে তীব্র ; সেই ছোটবেলাথেকেই------ যেদিন ফুলকাকার রূপান্তর ও  পরিচালনায় বঙ্কিমের " কপালকুণ্ডলা "-য় মা কালীর ভূমিকায় মঞ্চে উঠেছিলাম। তখন আমি ক্লাস টুয়ের ছাত্র। মেক্আপ করার পর আয়নায় রক্তাক্ত লোলজিহ্বা ( দন্ত পিষ্ট টিনের পাত ) ও

কালিবরণ দেখে কাপড়ে-চোপড়ে হয়েছিল। সেইদিন থেকেই-------


মন মোর নাটকের সঙ্গী 

উড়ে চলে দিগ্‌দিগন্তের পানে

নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে

রিমিঝিম   রিমিঝিম   রিমিঝিম॥


মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে

ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে।

ঝঞ্জনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে।

কলকল কলমন্দ্রে নির্ঝরিণী

ডাক দেয় প্রলয়-আহ্বানে॥


বায়ু বহে পূর্বসমুদ্র হতে

উচ্ছল ছলো-ছলো তটিনীতরঙ্গে।

মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে

তাল-তমাল-অরণ্যে

ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে॥



নাটক দেখতে গিয়ে কখনও চমকাই , কখনও দুঃখ পাই। নাট্যদলগুলির প্রযোজনার মান শেয়ার বাজারের সেনসেক্স-এর মতো ওঠানামা করে। শিল্পের স্বভাব বোধহয় তাই-ই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি হতাশ হই দর্শকের মান ও নগণ্য উপস্থিতি দেখে। কোনো কোনো দলের কল-শো দেখতে ভিড় উপচে পড়ে  ;  আবার , পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত নাট্যোৎসবে ওই দলেরই , একই নাটক দেখার জন্য দর্শকদের মধ্যে কোনও উৎসাহ থাকে না , প্রবেশ অবাধ থাকলেও। হয়ত কল-শোর আয়োজন করে স্থানীয় কোনও সংস্থা বা সংগঠন ; তাদের প্রচার ও কানাকানি প্রভাব ফেলে। 



চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় দর্শকদের একাধিক শ্রেণি চিহ্নিত করা যায। প্রথমত , জাম্বু-দর্শক।   নতুন বিয়ের পর , শালা-শালি-মাসশাশুড়ি- পিসশ্বশুর সহ সদলবলে নাটক দেখা। বিরতিতে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও , দু'হাতের মুঠোয় মোবাইলের সঙ্গে পাঁচ-ছ প্যাকেট ঘটি ভাজা নিয়ে , গলদঘর্ম দেহে জামাইবাবুর এন্ট্রি। দশ মিনিটের মধ্যে এক্সিটের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বধূটির বিরহিনী হয়ে ওঠার মহড়াও চলে এই অবকাশেই।  সিনেমার বদলে নাটক বেছে নিয়ে  নিজের রুচিবোধের প্রমাণ রাখার তাগিদও থাকে  জামাইবাবুর  ষোলো আনা। 



দ্বিতীয়ত , হুজুগে- দর্শক। নাটক হচ্ছে , যাওয়া যাক। এঁদের অনেকেই , নাট্যবিরতিতে হিসি করতে গিয়ে আর ফিল্ডিং করতে পছন্দ করেন না। এঁদের সংলাপপ্রীতি তারিফ-যোগ্য। তবে শোনার চেয়ে বলার দিকে অতিমাত্রিক ঝোঁক। গম্ভীর ট্র্যাজেডিকে এঁরা অনায়াসে কমেডিতে রূপান্তরিত করে নেয়। ফলে, নিয়তির তাড়নায় ট্র্যাজিক নায়কের পৌরুষ যখন ভুলুণ্ঠিত , পাশের সিটের দর্শকের চোখ ছলছল , এঁরা তখন ' হেসে খলখল ' । তালি দেওয়ার জন্য এঁদের হস্তযুগল সদাই উচাটন। 



তৃতীয়ত , মোবাইল-দর্শক।  আমৃত্যু মোবাইলে চোখ রাখার ধনুক ভাঙা পণ এঁদের। নাটক শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত  এঁরা বন্ধুদের হাঁড়ির খবর নিতে ব্যস্ত।  ওল খেয়ে গলা কত ডিগ্রিতে কুটকুট করেছিল , বৌয়ের সর্দিতে বেলাডোনা কেন কাজ করছে না---- নাটক তো শুরু হয়নি বলে নেওয়া যেতেই পারে। থার্ড বেল বাজার পর , ঘোষক যখন বলেন , অনুগ্রহ করে আপনার মোবাইল নিষ্ক্রিয় করে রাখুন ,  এঁরা শুধু ' বয়েই গেছে ' বলে না , কাঁচা খিস্তিও মারে। অভিনয়ের মাঝপথে এঁদের মোবাইল বেজে ওঠে  : ' যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে '। প্রসঙ্গক্রমে , দুটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নেওয়া যেতে পারে।দুটিই চাঁটি মারার ঘটনা। চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে নান্দীকারের         ' অজ্ঞাতবাস '-এর অভিনয় চলাকালীন , এক দর্শকের মোবাইল বেজে উঠলে , রুদ্রপ্রসাদবাবু বিরক্ত হয়ে সাময়িক অভিনয় বন্ধ করে দেন। নাট্যবিরতির পরের অভিনয়ে ওই দর্শকেরই মোবাইল আবার জেগে ওঠে : ' মার ঝাড়ু মার ঝাড়ূ মেরে ঝেঁটিয়ে বিদায় কর '। পাশের দর্শক চার অক্ষরের কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলে ওঠেন  :       ' ঝাড়ু মেরে তোকেই হল থেকে বিদেয় করে দেব '। ঠিক তৎক্ষণাৎ , তাঁর বুকপকেটে আলো জ্বলে ওঠে। গান বেজে ওঠে : ' তোমার হল শুরু আমার হল সারা '। এরপর শুধু  চাঁটি - চাঁটি-চড়চাপাটি। দ্বিতীয় চাঁটির ঘটনার সাক্ষীা হলুম এই জানুয়ারিতেই। প্রথামাফিক থার্ড বেল বাজল। দর্শকদের উদ্দেশে মোবাইল নিষ্ক্রিয় করার অনুরোধ জানানো হল। ড্রপ সিন নড়ছে--- সরবে-সরবে করছে। মোবাইল  বেজে উঠল। না কোনও গান নয় , বিএসএনএল মার্কা রিং টোন। ক্রি-ক্রি-ক্রি-----ং। একজন  বয়স্কার গলা পাওয়া গেল :   " যা বাবাঃ ! কোথায় রাখলাম রে ফোনটা "। একজন সহদর্শক বেশ জোরে চেঁচিয়ে বললেন : " বন্ধ করুন। অভদ্র "। ততক্ষণ বেশ কয়েকবার রিং হয়ে সুকণ্ঠী জানিয়ে দিলেন : দ্য পারসন য়ু আর কলিং , ইজ্ নট আনসারিং। আবার রিং ----- ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। পাশের দর্শককে বললেন :" দেখুন তো , ডিসপ্লেতে কার নাম ---- আমি চোখে ভালো দেখি না "। ততক্ষণে তাঁর মাথায় চাঁটি পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বুঝে যাই নাটকও শুরু হয়ে গেছে।


চতুর্থত ,  সহৃদয়-দর্শক। এঁরা চান আগের তিন শ্রেণির দর্শকের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশাধিকার বন্ধ হোক। ভিড়ের সংসর্গে উপভোগ-বিব্রত হতে চান না তাই । এঁরা  কিউবদ্ধ হয়ে হলে প্রবেশে সঙ্কোচ বোধ করেন।। এঁরা যে নাট্যপরিধিতে স্বতন্ত্র গ্রহের জীব , তা তাঁদের চলন-ধরণ-করণ-গড়ন থেকে বোঝা যায়।  এঁরা নগদ বিদায়ে প্রবেশপত্র গ্রহণে গড়িমসি করেন। নাট্যদলগুলির আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার প্রত্যাশায় তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন। নাট্য আকাদেমির সদস্য তো হলে কেল্লা ফতে ! নাটক শুরুর আগে ও সমাপ্তির পর সাজঘরে ঢুঁ মারেন। নাট্যবিরতিতে সিগরেটের ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে নাট্যার্ধ নিয়ে কচুকাটা করেন। পরার্ধে পরিণতির সম্ভাবনা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন। এঁরা মনে করে থাকেন , শিশির-শম্ভু-অজিতেশের পরে বাংলা নাট্য কলাবৌ। ঘোমটা তুলবে কে---- কবে--- জানার জন্য গণেশের দ্বারস্থ হয়ে লাভ নেই।  এঁদের চলভাষ রুদ্ধ ,  কটাক্ষ শুদ্ধ , কথন দুর্বোধ্য।


এবার ছুঁচো গেলার পালা। পাশে বিসলারি রাখতেই হল। আমার আবার গলায় লকগেট। কখনও খাদ্যনালি , কখনও শ্বাসনালি খোলে  আবার অচানক বন্ধও হয়। তখন পিঠে -পেটে প্রেসার দিতে হয়। " পিঠে খেলে পেটে সয় '----    প্রবচন উদ্ভবের  কারণ বুঝি এখন। ছুঁচো কেত্তন করতে - করতে কেমন পারা ভারত-নাট্যম দেখাবে ভগাই জানে। কেন না , প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক  আমি  কোন শ্রেণির দর্শক । তার উত্তর না- দিয়ে শঙ্খ বাজানোই বুদ্ধিমানের কাজ  : 


তোমার কোনো ভিত্তি নেই 

তোমার কোনো শীর্ষ নেই                        

             কেবল তক্ষক

তোমার কোনো উৎস নেই

তোমার কোনো ক্ষান্তি নেই

               কেবল ছন্দ 

তোমার কোনো মিথ্যা  নেই

তোমার কোনো সত্য নেই

               কেবল দংশন

তোমার কোনো দৃষ্টি নেই

তোমার কোনো শ্রুতি নেই

                 কেবল সত্তা


       


          

No comments:

Post a Comment