পরিবারের তরুণতম স্বর... আগামী ও অক্সিজেন.
নীলাদ্রি দেব
বাংলা কবিতা একটা আস্ত পরিবার. একটা অনন্ত জার্নি. সীমাহীন কোন পথ. পথের ধারে পেভার্স ব্লকের উপর দাঁড়িয়ে প্রায় সামনে থেকে পথটিকে ছুঁয়ে দেখলে যা কিছু অনুভব হয়, তার ওপর কতটাই বা মন্তব্য করা যায়. শুধু জড়িয়ে ধরাই এক ও একমাত্র পথ বলে মনে হয়. তাই কবিতার কাছে বারবার নত হই. যে সমৃদ্ধ ইতিহাস আমাদের বাংলা কবিতার, সেখানে নতুন কী আসছে বা এল, সে নিয়ে ভাবা যেতে পারে. যদিও নতুন সংযোজন বলেও কি কিছু হয়? যা বলা হয়েছে, তাই খানিকটা নতুন মোড়কে উঠে আসে সময়ের স্রোতে. সৃষ্টি যদিও এক রহস্যময় কুয়াশার নাম. এই সৃষ্টি চলছে. কবিতার পথ প্রশস্ত হচ্ছে. বদল ঘটছে চারপাশের, কবিতা যাপন ও উদযাপনের. আলোর তীব্রতা জোরালো হচ্ছে. এর মধ্যেও সাধক সাধনা করছেন. স্পটলাইটের নিচে মাছ বিক্রি হচ্ছে. হাই মাস্ট বাতির নিচে কলাপাতায় বিতরণ চলছে শিন্নি. এত এত শ্বাস, বিশ্বাসের পরও ভূগোলের বেড়া ভেঙে তরুণ প্রজন্ম সিরিয়াস কবিতার সাথে পরিচিত হচ্ছেন, জড়িয়ে যাচ্ছেন. প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম এই ভূগোলের বেড়া ভাঙতে এতটা কার্যকর হতে পারে, বছর পনেরো বা কুড়ি আগেও তা ভাবা সম্ভব হয়নি. যা হোক, সময়ের সাথে সাথে এগুলো আমাদেরই প্রাপ্তি. যদিও ভূগোল ভেঙেছে, তবু পুরোনো অভ্যেস ভাঙা শক্ত ও সময়সাপেক্ষ. এখনও, কেন্দ্র বা প্রান্ত না থাকলেও, কোথাও একটা থেকেই গেছে এর ছাপ ও ছায়া. কলাগাছের শেকড়েরই মতো.
না. স্বীকৃতি একটি কঠিন অঙ্ক. এ বিষয়টি তোলা থাক. কাজ নিয়ে কিছু কথা হোক. প্রান্তিক অঞ্চলে বসে কাজ করা তরুণ প্রজন্ম নিয়ে কথা হোক. যারা শুধুই পাঠক চান, পোডিয়াম নয়. এমনই কয়েকজন নন, বেশ কয়েকজন ছড়িয়ে আছেন উত্তরের বিভিন্ন জেলায়, জনপদে. কোচবিহারেও. তাঁদের থেকে চার কবির কবিতা যাপনের খানিকটা অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি. একটি কবিতা, বা তা প্রসঙ্গে সামান্য কথায় কবিকে চেনা যাবে না, তবে খানিকটা আগ্রহ তৈরি হলেই ওঁদের কবিতার পাঠক হিসেবে আমার ভাল লাগবে.
••
ঝুমঝুমি
তোমার আমার মধ্যে মাঝে মাঝে তুমুল ঝগড়া হোক। মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকো। বালিশের ঘন অন্ধকারে বেজে উঠুক দীর্ঘপ্রেমের ঝুমঝুমি। অপেক্ষার একটা শব্দ আছে । যাক না ভেস্তে বাইরে ডিনার করার পুরোনো প্ল্যান। আমার মনের কথা বলেই ফেললে। চলো শান্তিপুর ঘুরে আসি। সম্পর্ক খতিয়ে দেখলে বুঝতে পারি প্রেমে কোনো প্রশ্নচিহ্ন থাকতে পারে না। কোনো ভলান্টিয়ার বাতাসে শান্ত হয় না প্রেমের মন্দাক্রান্তা ছন্দ।
খোকন বর্মন. ওপরের এমন উচ্চারণ খোকনের. সদ্য কুড়ির এই যুবকের. কোচবিহারের এক প্রান্তিক অঞ্চলে বসেও খোকন বাংলা কবিতার মায়াভুবনে এমন অক্ষরের চাষ করছেন. কবিতার কাছে সবসময় সৎ এই কবিতাপাগল শুধু সম্ভাবনাময় নয়, পরিশ্রমীও. লেখা ও পড়ার ভেতরে ডুবে থেকে খোকন দীর্ঘ এক আশাবাদ লিখে রাখছেন. আমরা তাকিয়ে থাকব ওঁর সুন্দর আগামীর দিকে.
••
অস্ত ও জন্মের কথা
আপাতকালীন বৃষ্টির পর রোদ উঠলে জীবনের গন্ধ পাই
অনিশ্চিত পথে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরি
অনেকটা পিছিয়ে এসে গুনতে শুরু করি ভুল-মেদ-ক্ষমা-কান্না
মিথ্যে মুহুর্তের কাছে যেদিন আত্মসমর্পণের গল্প-বিচ্ছেদ...
গন্ডি কেটে রাখি মননের চারদিকে; ভবিষ্যতের কথা বলা বারন।
প্রতিটি মুহুর্তেই আমরা এগিয়ে যাই অনিয়ন্ত্রিত
কাটাকুটির দিকে
দাগ কেটে কেটে এগিয়ে যেতে গেলে হিসেবে ভুল হয়,
গাছেদের মতো মা হতে চাই না আপাতত, এখন আমায় সন্তান হতে দাও;
অনিশ্চয়তা আসলে একধরনের অসুখ... যা মৃত্যুর পরেও ঘুরপাক খায়।
প্রতি মুহূর্ত একেকটি জন্মদিন... প্রতিটি সূর্যোদয়েই লেখা থাকে সূর্যাস্তের কথা...
নাদিরা আহমেদ মুক্তি লিখেছেন ওপরের এই কবিতাটি. দিনহাটায় বসে লিখছেন নাদিরা. বাংলা কবিতার সাম্প্রতিকতম এই সংযোজন লিখে রাখছেন সহজ জীবনের কথা. এই কথার ভেতর থেকে যাচ্ছে সংকেত, মায়াময়তা. অকারণে জটিল না করে তুলে এমন এক উচ্চারণ করছেন, যেখানে স্মার্টনেস থেকে অনেক বড় আন্তরিক স্পর্শ. ওঁর সুন্দর আগামীর পথে আমরাও পথিক বন্ধু হয়ে ওঁর পাশে থাকব.
••
সম্পর্ক
তিন
দ্রুত সরে যাচ্ছে চাঁদ
রাত থেকে নামিয়ে আনছি স্বপ্ন
তারাদের দেশে ঘুমিয়ে আছে
নাম না দেওয়া সম্পর্ক।
উনুন ধরাও, কারফিউতে বিলি করো খিচুড়ি
ভিখারীকে দাও দু ফোটা জল
মদ ঢেলে দাও বড়বাবুর গ্লাসে
উন্নতি লুকিয়ে রাখো
তোমার দুটো অসম স্তনের মাঝে।
সম্পর্কে জল দাও
মিথ্যে থেকে বেরিয়ে এসে...
সপ্তর্ষি বনিক কোচবিহারে বসে বাংলা কবিতা লিখছেন. সময়ের কথা সময়ের ভাষ্যে বলছেন সপ্তর্ষি. স্মার্ট অথচ সজীব, প্রাণবন্ত কথোপকথনের ছলে পাঠকের সাথে কথা বলছেন তিনি. কী এক ঘোর বিছিয়ে ধরেন এই যুবক কবিতার অক্ষরে অক্ষরে. আসলে তরুণতমরাই পারেন গতিপথ তৈরি করতে. সপ্তর্ষির আগামী সুন্দর থেকে আরও সুন্দর হয়ে উঠুক.
••
কবিতা
রাত্রি গভীর হলে পাখিদের কান্না পায়
গভীর ঘুম থেকে স্ত্রী কে তুলে দিয়ে তার নরম পালকের নীচে সে ঘুমায়
গোপনে সে কাঁদে
একটু একটু করে ক্ষয়ে আসছে জীবন
ঘর, বাড়ি, আঙিনা জুড়ে গভীর বিষাদেরা নোঙর ফেলেছে
গোপনে তার কান্না পায়...
প্রতিটি মানুষের ভিতর কেউ কেউ অসহায় বাস করে
তোমার ভিতর আমি
কিংবা আমার ভেতর পাখি
যারা গাছ-পাতা-জল না পেয়ে পেয়ে অজান্তে
একটু
একটু
করে
ক্ষয়ে যায়, ঝড়ে যায় রোজ...
অভ্রদীপ বসু. সে অর্থে কনিষ্ঠতম অভ্র. ওঁর লেখার আলপথ সবে তৈরি হচ্ছে. আর এর মধ্যেই স্বতন্ত্র এক ভাষা. উচ্চারণ. যেন বাস্তব, কল্পনা মিলে মিশে এক হয়ে উঠছে. ভনিতা নেই, মাছ ঢেকে রাখবার শাক নেই. স্পষ্ট. আনকাট. দিনহাটায় বসে অদ্ভুত এক কবিতাভুবন গড়ে তুলছেন নিজেরই অক্ষরে. আসলে ওঁরাই আমাদের প্রাপ্তি.
মূলত 2015 পরবর্তী সময়ে এসেও ধারাবাহিকতা, সংযম, আগ্রহ ও ইচ্ছেশক্তি দিয়ে ওঁরা বাংলা কবিতা পরিবারকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন. এসব অক্ষর, উচ্চারণ সমসাময়িক তরুণ কবিদের থেকে পেয়ে সাধারণ পাঠক হিসেবে আমি, আমরাও শিখছি. যদিও এ চারজনই নয়. আরও অসংখ্য কলম উঠে এসেছে. আসছে.
স্বাগত নতুন.
বিকাশ দাস বিল্টু, রাজিব পাল, মানিক রায়, সুলগ্না বাগচী, আরণ্যক চক্রবর্তী, তুলী চক্রবর্তী, সৌরদীপ বর্ধন, দুর্গেশ বর্মন, রাহুল ঘোষ, নিশীথ কুমার সেন, মাসুদ হাসান, অমিত বিশ্বাস থেকে হিমাদ্রী শেখর... এমন সম্ভাবনাময় অনেক কবিই সেই জার্নির অক্সিজেন.
তাই আরও একবার বলতে ইচ্ছে হয়, জয় হোক. জয় হোক কবিতার. বন্ধুতার. বৃহত্তর কবিতা পরিবারের.
No comments:
Post a Comment