Monday, August 31, 2020

 


কবিতা ও যাপনে শূন্যদশক এবং প্রথম দশকের চার কবি
বাবলি সূত্রধর সাহা

জন্মদিন- ২৪.১০.১৯৭৯, ধূপগুড়ির মেয়ে বিবাহ সূত্রে আলিপুরদুয়ারে থাকেন।
কাব্যগ্রন্থ - সময়, মহাকালের স্রোত, অনেক আগুনের শিখা, কাচপোকাদের প্রেম।
সম্মান বলতে সকলের অনেক ভালোবাসা পেয়েছেন। লেখা পড়ে কারোর মননে যদি ছুঁয়ে
যায় সেটাই প্রকৃত সম্মান। বই পড়া নেশা। যা পেয়েছেন জেনেটিক্যালি বাবার
থেকে। আর গান শোনা, আবৃত্তি করতে ভালোবাসেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কবি বিকাশ দাস (বিল্টু)

একটি কবিতার নির্মাণ করেন কবি। কবিতার সাম্রাজ্যে তিনিই একমার অধিপতি।
এখানে পুরোপুরি স্বাধীন তিনি। এই মুক্তির নেশায় কবি সৃষ্টি করেন অসংখ্য
শব্দছক। একটা ধোঁয়াশার মতো অবয়বহীন আদল মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। কখনও
বিচ্ছিন্ন থাকে, আবার কোন একটা সময় সেটাই কবিতা হয়ে ওঠে। জীবনে সেতু
বন্ধনের কাজ করে কবিতা। এই কবিতার জন্যই আজ আমার দূর - দূরান্তরের অজানা
মানুষগুলো হয়ে উঠেছে একান্তই প্রিয় আত্মজন। সেই রকমই কবিতা মিলিয়ে দিল
কবি বিকাশ দাস (বিল্টু) কে। মাথাভাঙ্গার শিবপুরে বিকাশের জন্ম ও বেড়ে
ওঠা।প্রথম দশকের কবি বিকাশ দাসের লিখতে আসা ২০১৬ সালে। কবিতা লেখার সাথে
তিনি "আল্পনার কবিতা" পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। গৃহশিক্ষকতার পাশাপাশি তার
নেশা লেখা, প্রকৃতির রুপ, রস, গন্ধে মজে থাকা। একান্তই যা নিজের তাকে
হারিয়ে মানুষের বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর সমতুল্য। সেই না থাকার স্রোতে বিকাশ
তার প্রেম, স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেও লেখেন - "একবার না হয় কাছে ঘেঁষো/
ঘ্রাণ নাও কাদা মাটি,সোঁদা মাটি কিংবা পিঠের ঘামে লেপটে থাকা পারিজাত
সুগন্ধির"।
অসাধারন নিজস্বতা আছে বিকাশের কবিতায়। কবিতায় কেন আসা?  আদৌ কি এর কোন
উত্তর হয়! কিছুটা হয়তো কারণ থাকে। কবি বিকাশ তাঁর প্রিয় সঙ্গীকে হারিয়েও
কবিতার মাঝে খুঁজে পেয়েছেন তাকেই। তাই তো তিনি "আল্পনার কবিতায়” নিজেকে
ঢেলে সাজিয়েছেন। মেধাবী ছাত্র এবং উজ্জ্বল জীবন হতেই পারত!  তা না হয়ে
কবি অসহায় ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা ছাড়াও "
বিরহী প্রেমের ঝংকার"" নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আছে।

গভীর বোধ থাকলেই এমনটা লেখা যায় - "তাই তো এখন রোদে হাঁটলেও / ছায়ার সাথে
পাপকে হাঁটতে দেখিনা আর!"  খুব অল্প সময়ের তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে
উঠেছেন সকলের কাছে। "মা" আমাদের বটবৃক্ষ সম। সেই মা কেই তিনি কবিতায়
এঁকেছেন। " কান্নাকে কোঁচায় ভরে / ফুল হাতে মা ক্যামন বিলিয়েই চলছেন আলো
উঠোন জুড়ে।" মায়াময় নস্টালজিয়ায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কবি বিকাশের
কবিতা পাঠকদের এক আলাদা ভুবনে নিয়ে যাবে। এই আশা নিয়েই বলছি আপনার লেখা
চিরকালীন হয়ে উঠুক বিকাশ দাস।

কবি খুরশিদ আলম

কবির মন খারাপ খুব ক্ষনস্থায়ী। বিষাদের মেঘ কেটে গেলেই কবি বেরিয়ে পড়েন
রসিকবিল অথবা চিলাপাতার গভীর জঙ্গলে। সবুজে ডুব দিয়েই কবি খুরশিদ আলম
লিখে ফেলেন ঈশ্বরের পরিধি। "যে জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসে সংখ্যা অথবা সরণি/
তাকে ছুঁতে চাওয়ার আগে / আমরা নাম দিই ঈশ্বর"। অনবদ্য খুরশিদের
চিন্তাধারা। প্রথম দশকের কবি খুরশিদের জন্মস্থান আলিপুরদুয়ার জেলার
দক্ষিণ পারোকাটা। লেখাতে আত্মপ্রকাশ ডিঙি পত্রিকার মাধ্যমে। ২০১৪ সাল
থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে চলেছেন তিনি। স্বভাবে লাজুক এই কবি ভ্রমণ
প্রিয়। অত্যন্ত বিপন্ন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলছি। মানবিকবোধগুলো আজ
হারিয়ে যেতে বসেছে সবার। কবির মননে দাগ কেটে যায় এই ভাবনাগুলো। তাই
খুরশিদ লিখতে পারেন "প্রতিটি স্বপ্ন ভঙ্গের ভেতরেও থাকে / এক একটি
স্বপ্নের বসবাস।" কতটা বোধ আর জহুরীর চোখ থাকলে এতটা গভীরে ডুব দিয়ে
কবিতার মণিমানিক্য তুলে আনা যায় অতল সাগর থেকে।

কবির মননে বারবার আঘাত হেনেছে স্বপ্ন। খুরশিদের পরিনত লেখা পাঠকের দৃষ্টি
আকর্ষণ করে আর আগামীতেও করবে। সামনের দিনগুলোতে খুরশিদের আরও সম্ভাবনাময়
জীবন আশা রাখছি। কবি এগিয়ে চলুক তাঁর স্বপ্ন নিয়ে। সূর্যাস্তের সময় যে
সারা দিনের আশা আকাঙ্খা ডুবে যায়না, তারই প্রতিফলন ফুটে উঠেছে খুরশিদের
লেখায়। " সংখ্যা অথবা সংখ্যার অনুপাত/ সূর্যাস্ত বলতে ডুবে যাওয়া নয়। "

কবি মিহির দে


কবিতা আমাদের অক্সিজেন যোগায়। কবিতার আকাশে কবি মুক্তির আনন্দ খুঁজে পায়।
দিন শেষে মনের জানালা খুলে দিয়ে কবিতাতেই সমর্পিত হই আমরা। এমনই এক
সমর্পিত কবি হলো আলিপুরদুয়ারের প্রথম দশকের কবি মিহির দে। ২০০৮ এর
পরবর্তী সময়ে লিখতে আসা মিহিরের ভালো লাগা ঘুরে বেড়ানো। অজানা অচেনা ছবি
তোলা, ছিপ দিয়ে মাছ শিকার করা তার ভীষন ভালো লাগার বিষয়। ২০১১ সাল থেকে
কবি মিহির দে "কবিকুঞ্জ" নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এ ছাড়াও "
হিরণ্যগর্ভ " নামে অনলাইন পত্রিকার চরৈবেতির সম্পাদক।
কবিতা যাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নতুন পথ দেখায় তিনিই লিখতে পারেন  -"
শ্মশান ছুঁয়ে যে নদী / তারও একটা নীরবতা আছে।" কি কঠিন বাস্তব অথচ করুন
আর্তি ফুটে উঠেছে তার লেখায়। অথবা " ছড়ানো কড়ির ভেতর / জেগে ওঠে আমাদের
সংসার।"  সামাজিক এবং একান্তই ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন এই লেখাতে পাওয়া
যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন কবি। অত্যন্ত হৃদয় দিয়ে তিনি
লেখেন।একটা নিস্তব্ধ পুকুরে ঢিল পড়লে যেমন চক্রাকারে একটি আলোড়ন ওঠে
তেমনই  আলোড়ন ওঠে মিহিরের কবিতা পড়ে।

কবির বেঁচে থাকার রসদ থাকে কবিতার মাঝেই।প্রকৃতির আলো, হাওয়ার টানে
বেরিয়ে পড়েন ডুয়ার্সের সবুজ বনাঞ্চলে।খুঁজে পান পানবাড়ির কাঠবাড়ি।" কতদিন
যাইনি পানবাড়ির কাঠবাড়িতে/ যেখানে রোদ্দুর হেলান দিয়ে থাকে বাঁশের
মাচায়"। কবির দেখার চোখ অসাধারণ!  রোদ্দুরকে তিনি হেলান দিয়ে থাকতে
দেখেছেন। অত্যন্ত গভীরে ডুব দিয়ে তিনি শব্দকে মিশ্রিত করেন কবিতার
সমীকরণে। নীরবে কবিতার সাধনা করে চলেছেন মিহির। স্বভাবে বিনয়ী এই তরুন
কবির লেখাতে একটা স্বচ্ছতা, স্বাতন্ত্রতা আছে।কবিতার মিছিলে তাঁর লেখাটি
নজর কাড়ার মতোই। "বুনো মহিষের পালে নিজেকে জড়াতে পারিনা/ মিশে যাই হরিণের
দলে।"
অসম্ভব দক্ষতায় নিজের মননকে মিশিয়ে দিতে পারে প্রকৃতির ফুল, ঘুঘুর ডাক,
পিঁপড়ের  অস্তিত্বে।কবির ভাবনায় কারো অভিযোগ নেই জেনেও বৃষ্টি নামে।"
বেলে মাছ ধরা ছেলেটির কোন অভিযোগ নেই/ এ কথা জেনেও বিকেলের হাটে বৃষ্টি
নেমে আসে।"  দুর্দান্ত এক পারদে নিয়ে গেছেন কবির কবিতা। বাংলা সাহিত্যে
কবি মিহির দে নিজের দক্ষতা প্রমান করে চলেছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে। আমরা
পাঠকেরা তাঁর লেখা কবিতার সফলতা আশা করছি  প্রতি মুহূর্তে।

কবি জাকির হোসেন স্মৃতিজিৎ

ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকে কবির ওপরে। "যার দুঃখ সইবার ক্ষমতা থাকে তাকেই
ঈশ্বর দুঃখ দেন। আর যিনি কবি বা লেখক তাঁর দুঃখ, হতাশা থাকবেনা এমনটা
কখনই নয়। তাহলে যন্ত্রনা, কষ্ট কি ঈশ্বরের আশীর্বাদ কবির কাছে!"  না এর
কোন ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। যেমনটা জানা নেই কবি কখন ঠিক কি ভেবে
কবিতা লেখেন। কিন্তু জাকির হোসেন স্মৃতিজিৎ মনে করেন "সকলের মাঝে গিয়ে
বহু হতে চেয়েই কবিতা লেখা।"  শূন্য দশকের কবি জাকির হোসেন স্মৃতিজিৎ
ইদানীং প্রায় সব পত্রিকায় লিখছেন " স্মৃতিজিৎ" নামে। কোচবিহার জেলার
খোচাবাড়ি গ্রামে কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছাত্র জীবন থেকে লেখার প্রতি
অনুরক্ত ছিলেন। লেখার পাশাপাশি তিনি ছবি আঁকতে এবং গান গাইতে ভালোবাসেন।
এ ছাড়াও কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন এবং তাতে অভিনয়
করেছেন। শব্দের নৈবেদ্য সাজাতে তিনি ভালোবাসেন।
সত্যিই কবিতা আমাদের কাছে ঈশ্বর। অক্ষরের উপাচারে নিজস্ব অনুভূতির
উদযাপনেই তিনি লিখে  যান একান্ত চেতনা। "এখনও দূরত্ব বেঁচে আছে বলে
দিলখোলা আকাশটা / নীল খামে পাঠায় সন্দেশ"। জাকিরের কবিতায় আলাদা একটা
মাত্রা আছে। কবি তাঁর বাঁচার স্বার্থকতা খুঁজে পায় কবিতার নির্মাণ করে।
স্বার্থকতা, ব্যর্থতা, হতাশা সবকিছুরই বোধ ও ক্ষরণ আছে। সেই প্রকাশেই কবি
বুঁদ হয়ে থেকে সৃষ্টি করেন কবিতার অন্তরীপ।" চলো মেখে নিই ঘাসের আদর,
অন্তরীপ ঢেউ/ নীলকণ্ঠ পাখির ঠোঁটের উদার আকাশের গান"।
এরই মাঝে কবির প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে তিনটি কাব্যগ্রন্থ- "নাম রেখেছি
অন্বেষা", " আমার ঈশ্বর ও মাকড়শা", "যে আকাশ আঁকতে চেয়ে"। আরো দুটি
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। শব্দের মিছিলে কবি হেঁটে চলেছেন তার
নিজস্ব কষ্ট আর আনন্দ নিয়ে। কবি লিখে যান, "একদিন কলম ধরা হয়নি/ মন
মস্তিস্ক আর কলম... / তিনটেকেই কেমন যেন ভোঁতা মনে হয় আজকাল।" কবির জীবনে
মাঝে মধ্যেই হতাশার মেঘ এসে ভীড় করে। নিজের অস্তিত্বকে তখন দুর্বল মনে
হয়। তবে ক্ষণিকের  এই মেঘ বাদলে আবার নতুন সূর্য এসে আলোয় ভরিয়ে দেয় এক
কবির জীবন।

জাকির হোসেন অসম্ভব উষ্ণতার মোড়কে কবিতাকে সাজিয়েছেন। "ঘরের লীনতাপ শুষে
বিহ্বল জর্জর / হৃদয় বোঝে তাই বন্ধুত্বের উষ্ণখোলা হাত।" এই উষ্ণ হাতেই
কবি পেয়েছেন  "নীতীশ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার" আল্পনার স্মৃতি পুরস্কার" এবং
একলব্য স্মারক"। কবি লিখতে থাকুন তাঁর শব্দাবলী। দীর্ঘ এই কবিতার ভ্রমণে
স্মৃতিজিৎ তার লক্ষ্যে পৌঁছাক। তার একনিষ্ঠ পাঠকেরা অপেক্ষা করে থাকবে
আগামী সৃষ্টির জন্য।

2 comments:

  1. আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই কবিতা করিডোর ও আলোচককে আমার মতো একজন সামান্যকে নিয়ে আলোচনার জন্য.

    ReplyDelete
  2. বেশ জানা গেল কিছু নতুন তথ্য সমসাময়িকদের সঙ্গে। সমালোচকের নাম দেখে আমার সেই 'ইবলিশ' শুরুর প্রথম দিকের কথা মনে পড়ল, ঠিক প্রথমদিকের নয় কিছুদিন পরের। ইবলিশের তৃতীয় সংখ্যায় (২০১৪) সমালোচকের 'রূপকথা' বলে একটি কবিতা বেরিয়েছিল। চলুক এভাবে আরও পরিচয় করানো এবং আরও বেশি সবিস্তার ও সগভীর ভাবে। ভালো থাকুন সকলে।

    ReplyDelete