Friday, November 20, 2020

        " চা-ফুল এবং ভাতের মিছিল "

           - ধীরাজ কুমার রায় |

                 কালো কম সাদা বেশি , এমন দাড়ির ঝোপে হারিয়ে গেছে চোপসানো গাল | উপর-নীচ দুই সারিতে মেরে-কেটে ছয়-সাতটি দাঁত কোনো রকমে বজায় রেখেছে নিজের অস্তিত্ব | ঠোঁট দু'টো আপ্রাণ চেষ্টা করছে - একটুকরো নির্ভেজাল হাসি উপহার দিতে , পারছে না | কাঁঠাল পাতার ভেঁপুর মতো - বেজে ওঠার আগে কেঁপে যাচ্ছে বারংবার | উঠছে নামছে , দ্রুতলয়ে | স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছি তার দিকে | বুঝতে পেরে এগিয়ে এলো | জিজ্ঞেস করলুম , " কি ব্যাপার মোহরাদা তুমি ঠিক আছো তো ? তোমার শরীর কাঁপছে কেনো ? সকাল - সকাল ছাইপাশ গিলেছো ! " একসঙ্গে এতো প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না বোধহয় | অপ্রস্তুত হয়ে - একটা পুরোনো প্লাস্টিকের কেরিব্যাগ এগিয়ে দিলো আমার দিকে | " কি আছে ওতে ? "
....." চা ফুল, আপনার জন্য | বেশি না কুড়িটা টাকা দিলেই হবে !"......এবার অসময়ে মেঘ জমলো - আমার চোখে | মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম , বৃষ্টি অনিবার্য | ছাতা বা বর্ষাতি ছাড়াই পথে নেমে - অকাল বৃষ্টিতে আমি দিশেহারা | আকাশ মুখ ভার করে থাকলো, একটা নিশ্চিত আড়াল চাইছি এবার ! বড্ড অপ্রস্তুত আমি, দ্রুত এগিয়ে গেলাম অফিস ঘরের দিকে | অনেক সময় সমস্যা হাতে রেখে সমাধান খুঁজতে হয় , অবশিষ্ট হাতে রাখা বিয়োগের মতো | অফিসের জানালার দিকে তাকালাম , বাইরে বিস্তৃত সবুজ বুক নিয়ে চিৎহয়ে শুয়ে আছে খেলার মাঠ | একটা বক একপায়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ,মাঠের পাশে উঁচু নদী-বাঁধের উপর | গতবছর করম পুজোর আগের দিনই অনেক গল্প করেছিলাম আমরা | সুযোগ পেলেই অদ্ভুদ সাইকেল যাত্রার রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা শুনতাম তার কাছে | সর্বশিক্ষা মিশনের বিজ্ঞাপনের খুঁটিতে আজও তার আশ্চর্য সাইকেলটা রাখা | কেরিয়ারে হ্যান্ড-পাম্প , হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগে সারাইয়ের যন্ত্রপাতি | বছর পাঁচেক আগেও খড়িবাড়ি, মেটেলি, কেরন , বান্দাপানি , অবাধ বিচরণ এই দু'চাকার যানবাহনেই | পথে কোনো সহযাত্রীর সাইকেল বা বাইকের পাঙচার সারিয়ে একবেলা খাওয়ার সংস্থান হয়ে যেত অনায়াসে | বাইরে এলাম | দেখি , তীর্থের কাকের মতো এখনো দাঁড়িয়ে | একের পরে এক সিঁড়ি ভেঙে নামছি আর ভাবছি - ঋষি অগস্ত্য ফেরেনি, আমি ফিরেছি ! ফিরেছি আবার পাহাড়টার মুখোমুখি | বিধ্বস্ত |
              মোহরা রাজগোর | তার সঠিক বয়স উদ্ধার করতে পারিনি গত সতেরো বছর ! সরুগাওঁ চাবাগানের আদিবাসী সমাজের মানুষ | লকডাউন  বিপন্ন করেছে জীবন | ছানিপড়া একজোড়া চোখ - আমাকে বিদ্ধ করতে থাকলো করুণ দৃষ্টিতে | আহত হলাম | অপরাধ বোধ নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলো | সত্যি তো, দীর্ঘ লকডাউনে কিকরে বেমালুম ভুলেগেছি অসহায় বৃদ্ধের কথা ? মানবিকতার বাটখারায় একপ্রান্তে রাখলাম নিজেকে, অন্যপ্রান্তে অস্তাচলে যাওয়া সূর্যের মতো মানুষটাকে | ক্রমশঃ হাল্কা হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছি আমি এবং আমার বাটখারা ! আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজেকে ভারী প্রমান করে নীচে নামানোর | ব্যর্থ হতে থাকলো আমার মিথ্যে প্রয়াস ! মনে হলো আরও গভীরে নেমে যাচ্ছে মোহরাদা | হাত বাড়িয়ে যত সহজে আকাশ ছুঁতে পারবো - তার অনেক নীচে নেমে গেছে ওর বাটখারা ! চারপাশে ছড়ানো শিশির ভেঁজা অজস্র চা-ফুল আর এক খানি শূন্য অ্যালুমিনিয়ামের থালা | হঠাৎ তীব্র বেগে ছুটতে শুরু করলো থালাখানিও | আমার বিরুদ্ধে জমে থাকা সমস্ত অভিযোগ সম্মিলিত ভাবে চিৎকার করে উঠলো একসময় | স্পষ্ট দেখছি , পাড়ার মোড়ে - বিক্ষুব্ধ গরম ভাতেরাও মিছিলে স্লোগান তুলছে , " ধিক ধিক ধিক্কার !"....
    ........ " মাস্টার বাবু , ফুলগুলো নেবেন না ? "..... এবার সত্যি চমকে উঠলাম | কতটা সময় ধরে ভাবছিলাম আমি ! হাত বাড়ালাম প্যাকেটটার দিকে | আশ্বিনের হাল্কা শিশির তখনো লেপ্টে আছে - ফুলগুলোর শরীর আঁকড়ে | বুঝলাম, ভোরবেলা ঘর ছেড়েছে ফুলগুলো | 

No comments:

Post a Comment