কবিতা করিডোর
নতুন কলম ও উল্লাস...
আমরা এখানে নতুন কলমের বন্ধুদের তুলে আনার চেষ্টা করছি। যারা লেখালেখিতে
আনকোরা। এদের অনেকের লেখাই কবিতা করিডোরে প্রথম আত্মপ্রকাশ করছে। তাদের
লেখাগুলো ডায়েরিতে বন্দী ছিল। থাকলো কিছু নতুনের খোঁজ।
ভাবনা গদ্য
চুমকি বিশ্বাসের জন্ম ১৬ই এপ্রিল ১৯৯৯, আলিপুরদুয়ার বিবেকানন্দ কলেজের
তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছবি আঁকতে ভীষণ ভালোবাসে। দাদু দিদার কাছেই মানুষ।
থাকে আলিপুরদুয়ার জেলার টটপাড়া, খাটাজানীর কাছে। শামুকতলার ক্রিয়েটিভ
আইডিয়াস ফোরাম এর সাথে যুক্ত থেকে সমাজসেবায় অংশ নেবার পাশাপাশি
সংস্কৃতিচর্চার সাথেও যুক্ত। নিজে লেখালেখির সাথে নাটকে অভিনয় করে
প্রসংশা কুড়িয়েছে।
আমার দুর্গা, আমার ত্রিনয়নী
চুমকি বিশ্বাস
বিশ্বাস করুন। সত্যি। আমার দূর্গার মহাদেব নেই। একটা দোকানে সাজানোর কাজ
করে। ওই যে সুন্দরী করে তোলার কারখানা। আসামের কোনো এক শহরে। তৃনয়নী
দূর্গা আমার। বড় নয়নী দাদু-দিদার কাছে মানুষ। পশ্চিমবাংলার এক প্রত্যন্ত
এলাকায় তৃতীয় নয়নীকে নিয়ে বাস। বাঁশ ঝার ঘেরা দাদু-দিদার সাথে থাকে।
দুজনেরই বয়স হয়েছে। দিদা বিড়ি বাধে। মামা আর মা দূর্গা কিছু টাকা পাঠায়
মাসে মাসে। প্রথম নয়ানীর আবার আঁকাআকির শখ।
আমার দূর্গার জীবন বড়ো কষ্টের। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হয় তাকে। তার
স্বপ্ন বড় নয়ানীকে আকাশ ছোঁয়াতে চায়। বড় নয়নী কলেজের শেষ সীমানায় বন্দী।
এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ছাড় পেলেই শুরু হবে কালি-কলমের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে
তাকে জিততে হবেই। এটাই তার লক্ষ্য। দ্বিতীয় নয়নী মা দূর্গার সহায়ক হয়ে সব
সময় পাশে থাকছে। সে নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এইদিকে তৃতীয় নয়নী ইস্কুলে
দশমিকের দশে আটকে। তার ইচ্ছে হাজার রকম। কখনো পাখি হয়ে আকাশে ওড়ার ইচ্ছে।
কখনো বা মাছ হয়ে গভীর জলে সাতার কাটা, আবার কখনোবা পাখা মেলে ময়ূরের মতো
নাচানাচি করা। তবে সেও আপন মনের মানুষ। মনে তার আষাঢ়ের বন্যা। দেখলে মনে
হয় শরতের শিউলি। তার যুদ্ধও কিছু কম নয়। একদিকে মহাদেবকে দেখেনি, আবার
অন্যদিকে মা দূর্গার ভালোবাসা দূর থেকেই অনুধাবন করেছে। বড় নয়নী তাকে
হাজার তারার মাঝে ধ্রুবতারা মনে করে। আবার কখনো পাঁকের কমল। তবে দুজনের
সম্পর্ক খুবই ভালো। কখনোদীপাবলীর বুড়িমার চকলেট বোম। কখনো আবার ঝলমলে
আলোর রোশনাই।
আমার দূর্গার তুলনা হয়না। ঘরে বাইরে দুদিকেই সমান। একদিকে সংসারের
টানাপোড়েন, আর একদিকে দেশ বিদেশ সামলাতে হয়। হাজার বাঁধার মধ্যেও হাসি
সরেনি মুখ থেকে। দুঃখকে পথে চলার সাথী বানিয়ে অনর্গল চলেছে। আমার মা,
আমার দূর্গা। তোমায় প্রণাম...
নতুন কলম
………………………………………………………………
দেবপ্রিয়ার জন্মদিন দুহাজার সনের ২রা জুন। থাকে আলিপুরদুয়ার জেলার চেপানী
এলাকায় খাপসাডাঙ্গা বাজারে। মায়ের সাথে থাকে। কলেজ পড়ুয়া। নিদারুন
দারিদ্র্য তার নিত্য সঙ্গী। মায়ের পাশে দাঁড়াতে চায়। কিছু করতে চায়। লেখা
ডায়েরীর পাতায় সীমাবদ্ধ ছিল। আজ উড়লো নতুনের পথে। কন্যাশ্রী সহ বিভিন্ন
নাটক করে ইতিমধ্যেই মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
-------------------------------------------------------------------
হাত বাড়াই
দেবপ্রিয়া পন্ডিত
মেসোর কাকতাড়ুয়ার কাপড় উধাও
মাথায় চোখ মুখ স্পষ্ট এখনো
ঢ্যাড়শের ক্ষেত লঙ্কা ক্ষেতের রূপ নিয়েছে
এত ছোট গাছে লঙ্কা!
হাত ভালো কার্তিক দা'র
একটা ফানি নিউজ
যখন ছোট ছিলাম বাড়িতে বেড়াল ছিল একটা
আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট
অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছিল
মাকে বলেছিলাম,
আমার একটাও বেড়াল হচ্ছেনা কেন?
ফানি নিউজ থাক, কাকতাড়ুয়ায় ফিরি...
রোদে পুড়ছে, ঠান্ডায় কাঁপছে, বৃষ্টিতে ভিজছে
কেউ কি ওকে একটা ভালো পোশাক দেবে?
আরে মশাই, আমাদের তো অনেক আছে
এভাবেই কাকতাড়ুয়ারা গল্পে গল্পে...
………………………………………………………………………………
নতুন কলম
চা বাগানের গদ্য
আলিপুরদুয়ার জেলার কোহিনুর চা বাগানের ছেলে প্রসেনজিৎ দাসের জন্ম -
৭.১২.২০০০, কামাখ্যাগুড়ি শহীদ ক্ষুদিরাম কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ওরও
পৃষ্ঠার মুক্তি বলতে পারি। চা বাগানের শ্রমিকের ছেলে। টিউশন করে নিজের
পড়াশুনো চালাচ্ছে। সংস্কৃতির সাথে যুক্ত।
===========================================================================================
চা বাগানের কথারা
প্রসেনজিৎ দাস
চা বাগানের সৌন্দর্য দেখতে চান! তবে উঠতে হবে ভোর চারটেয়। যখন সূর্যের
কিরণ মেঘ ফুটে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকবে... এক অসীম আগমন লক্ষ্য করবে।
শিরীষের ডালের মাঝে যখন তুমি দেখতে পাবে এক অপূর্ব রূপের আগমন। দেখতে
পাবে চা বাগানের মাঝে বর্ষার শেষ পর্যায়ে শরৎের শুরু। মায়ের আগমন
অনুভূতিটুকু লেগে থাকবে মনে। চা বাগানের মাঝে দেখতে পাবে জলধারা। জলে
অনেক মাছ। পাশেই ঝিঝি পোকার ডাক। সাথেই বিভিন্ন পাখির ডাক আর থাকবে
পাশের মহল্লা থেকে আসা মোরগের ডাক। লক্ষ্য করবে, চা বাগানের পাতার আর
ঘাসের উপর শিশির বিন্দুদের খেলা। বাগানের আকাশে সাদা বক উড়বে।
এক মনোরম মৃদু আর হালকা সুমিষ্ট বাতাস অনুভব করবে তুমি। যেখানে প্রাণ
খুলে নিতে পারবে শ্বাস... সময় পাঁচ টা ত্রিশ বাগানের গো ডাউন হতে ভো ভো
ভোওওও করে একটা সংকেত ধ্বনি শুনতে পাবে। কিছুক্ষণ পর শুনতে পাবে মন্দির
থেকে আগত শ্যামা সঙ্গীত যা তোমার ভালো লাগবেই। দেখতে পাবে লজ্জাবতী গাছের
ডালে সুন্দর গোলাপি ফুলগুলো। সূর্য উঠেছে পুরোপুরি এবার। আবার আমাকে গরু
নিয়ে যেতে হবে আমিতো রাখাল ছেলে।
দুপুরে যখন ঝলসানো সূর্যের কিরণ পড়বে বাগানে, তখন সূর্য থাকবে মাথার
উপরে। বাগান থাকবে উষ্ণময়। তখন তুমি বাগানের বড় বড় গাছের নীচে বসলে পাবে
শীতের দেশের এক ঝলক আনন্দ। যা তৃপ্তি দেবে হৃদয়কে। আকাশ থাকবে ঘন নীল,
সেই নীলে ডুবতে চাইবে মন। কিন্তু সূর্য মামার তেজে বেশিক্ষণ ঘুরতে
পারবেনা। বিকেল যখন নামবে আকাশের রং বদলে যাবে। মনে হবে কেউ যেন মেঘে লাল
লাল রং করে দিয়েছে। পাখিরা বাসায় ফিরবে।
চা বাগানের কিছু ছায়া গাছে ওদের বাসা। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খেলবে। আর
বাগানের কর্মচারীরা বাড়ি ফিরবে কাজ থেকে। সূর্য দেখা যাবে গাছের ডালের
মাঝে। বিকেল ৫ টার সময় আবারও ছুটির ভেঁপু বাজবে ভো ভো ভোওওও... চা বাগান
এর কারখানা থেকে বাড়ি ফিরবে সবাই। চা বাগান এর মাঝদিয়ে হেঁটে যাবার সময়
পাখিদের কলতান। মিঠেল হাওয়া জুড়িয়ে দেবে প্রাণ মন। আস্তে আস্তে রাত
নিঝুম হতে থাকে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুরু হয়। ধীরে ধীরে চা বাগান ঘুমিয়ে
পড়ে...
নতুন কলম
বরুণ কুমার দেব পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজসেবায় তার মন।
সন্চালনাতেও যুক্ত আছেন। ৬ই অক্টোবর কবির জন্মদিন। ডায়েরিবদ্ধ লেখার
প্রথম প্রকাশে আমাদেরও আনন্দ। থাকেন, বারবিশা, জোরাইতে।
মানব সভ্যতা
বরুণ কুমার দেব
মানব সভ্যতার দম্ভ গগনচুম্বী সাজে
মহাকালের প্রলয় নিনাদ, হৃদস্পন্দনে বাজে!
মাইক্রোস্কোপিক ভাইরাস -
আঁকে সভ্যতার কপালে প্রলয়ের ভাঁজ
সভ্যতার হৃদযন্ত্র যাদের রক্তে
স্পন্দিত হয় নিরন্তর
আজ তাদেরই হৃদযন্ত্র
ক্ষুদার্থ শরীরে অসার।
মানব সভ্যতা হোঁচট খায়
প্রবাসী শ্রমিকের পায়ের শব্দে
শ্রান্ত শরীরে খিদের পেটে
ঘুমিয়ে পড়ে শিশু মায়ের বুকে।
সভ্যতার পর্দায় তুলে ধরে
জীবন সংগ্রামের কাহিনীকে
ছোট্ট শিশুটি লাগেজের আলিঙ্গনে
দুঃখের ধারাপাত পড়তে থাকে
পুলিসের লাঠি শ্রমিকের পিঠে এঁকে দেয় সভ্যতার ছাপ!
উড়োজাহাজে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ভাইরাস
তোমাদের সভ্যতায় হয় মাফ
সভ্যতার চাকায় পীষ্ঠ
ওদের রক্তাত্ম রুটির জীবাশ্ম
জীবন সংগ্রামের একুশ শতকের বিশ্ব
খেলার জন্য ডাকছে শিশু
মৃত মায়ের আঁচল টেনে
সাড়া দেয় না সন্তানেরে, নিঃস্ব শিশু
প্রশ্ন করে সভ্যতারে!
...........................................................
নতুন কলম
………………………………………………………………………………………………………………………………
পাঞ্চালী দেবনাথ, জন্ম দিন - ১১.২.১৯৯৪, বাংলায় স্নাতোকোত্তর।
আলিপুরদুয়ার জেলার চেপানীতে থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানোর
পাশাপাশি বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে, সাজতে ও সাজাতে ভালোবাসে। প্রথম
প্রকাশে রইলো ওর একটি কবিতা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………
বাকি থাকা কথা
পাঞ্চালী দেবনাথ
আজও বেদনার মতো বেজে চলেছো তুমি
আমার হৃদয়ের একতারায়
সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছি অনেক দূরে,
থেমে থাকোনি, তাই ফিরতে পারিনি অকপটে
পুরোনো দিনগুলি মনে পড়ে
মন নিংড়ে বেরোতে চায় ধূসরিত স্মৃতিগুলি
গভীর প্রেমের অজস্র শিশিরবিন্দু
শুকিয়ে যেতে চায় বেদনার তাপে,
বেলা গড়াতে থাকে...
সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যাওয়া সামনের দিকে
বুঝবার আর বোঝাবার সময়
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেছে আগেই -
ঘনিষ্ঠ দিনগুলিতে যা বোঝাতে পারিনি
এখন কি করে বোঝাবো তোমায় ?
আছে পড়ে শুধু সেই কথা
বাকি থাকা কথারা...
প্রশ্ন
শুভেন্দু সরকার
হে পৃথিবী, থমকে দাঁড়াও
শোন, আমার কয়েকটা প্রশ্ন
আমিতো ভেবেই পাইনা
কিসের আশায় করছো তুমি সূর্যকে বন্দনা
কী তোমার অভিলাষ?
কবে হয়েছিল এর শুরু, কবে হবে শেষ
কিসের অঙ্গীকারে বাঁধা তুমি?
সূর্যের সাথে কিসের লেনাদেনা?
অথবা প্রেম বন্ধনে বাধা
এমন কী প্রেম যার প্রতিশ্রুতিতে
শত শত ব্যথা বুকে নিয়ে
সবুজে আচ্ছাদিত ফুলে ফলে সুরভিত
শীতল পানীয় সম্ভারে সাজাও তারই পূজার ডালি
এত তারাদের ছেড়ে একই পথে প্রদক্ষিণ
আমরাওতো সাতপাকে বাঁধি,
আধুনিকের বেশে অন্য কোথাও চলে যাই
তোমার কি নেই কোন আধুনিকতা?
............................
শুভেন্দু সরকার, গানবাজনা নিয়ে চর্চা করেন। থাকেন আলিপুরদুয়ার জেলার কামাখ্যাগুড়িতে। কম্পিউটার প্রশিক্ষক। নাটকেও রয়েছে আগ্রহ।
নতুন কলম
...................................
সুমিত দেবনাথের জন্ম আলিপুরদুয়ার জেলার শামুকতলায়। জন্মদিন- ১১.৮.৯১, সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এই অসম সময়েও দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে।
...............................................
যুগ ত্রাস
সুমিত দেবনাথ
ধ্বংসের মুখেূমুখি আমরা
আসবে কি জয়,
সত্য কি থাকবে চাপা
হবে সৃষ্টির ক্ষয়?
সন্ত্রাসীরা বসায় থাবা
দেয়যে তারা হানা,
দেশের ক্ষতি করছে
নেই তাতে মানা।
পাষাণ বুকে ফুঁড়ছে শহর
দিচ্ছে মাথাচাড়া,
সত্য নাকাল আজ
পড়ছে কি ধরা?
যুব সমাজ ধুঁকছে
নেশা ছাস চোখে,
ভাঙছে সমাজ দ্যাখো
সন্ত্রাসবাদের কোপে।
শিশুর জোটেনা দুধ
যায়নাতো দেখা,
ছাড়ুন ওসব, বেচতে দিন
সত্যিটা এখন বাঁকা!
উলঙ্গ রাজার কাপড়
গিয়েছে কেমন খুলে,
মুখ বুজে পড়ে থাকি
যাই সব ভুলে।
সত্যে যখন মিথ্যাচার
মুখ ফুটে বলবে কেউ,
লাগাম পড়ান মুখে
সত্য গুনছে ঢেউ!
আজ যখন নিদ্রালোকে
বিশ্বময় সন্ত্রাস,
নিঠুর ব্যথা বাজছে বুকে
আজকের যুগ ত্রাস!
গল্প
শুভ
মলয় রায়
শুভর বয়স আট বছর মত হবে, ক্লাস থ্রীতে পড়ে। আর পাঁচটি ছেলের মতই। বিশেষত্ব বলতে তেমন কিছু নেই তবে ব্যবহারটা মিষ্টি। শুভ যত দুস্টুমি করুক না কেন মিষ্টি মুখের মিষ্টি হাসিটা দেখলে রাগ কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়।শুভ পাড়া গাঁয়ের একমাত্র ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। বাবা জজমানি করে কোন রকম সংসার চালায়। মা প্রতিদিন গীতা বা অন্যান্ন ধর্মীয় বই পাঠ করে।পরিবার আর পারিপার্শিক পরিবেশটাই শুভকে মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।
ক্লাস থ্রীতে পড়ার সময় রোজ বিকেলে ওরা খেলার মাঠে খেলতে যেত।একদিন দেখে দুটি অচেনা ছেলে মাঠের বাইরে দাড়িয়ে ওদের খেলা দেখছে।তার পরের দিনও দেখে। ছেলে দুটি ওদের সঙ্গে খেলতে না এসে ওরা মাঠের বাইরে দাড়িয়ে থাকতো। নতুন ছেলে, চেনা জানা নেই ভয়ে হয়তো ওরা কিছু বলছে না, তাই শুভরাই ওদের সঙ্গে কথা বলতে গেল। শুভ বলল, "তোমরা কি আমাদের সঙ্গে খেলবে"? দুই ভাই একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। "তা, তোমাদের নাম কী"? ওরা দুই ভাই, বড়োজনের নাম শম্ভু, ছোটজনের নাম শঙ্কর। ওদের বাড়ি কোথায় বললেও শুভরা ঠিক বুঝলো না। কিন্তু এতটুকু বুঝলো ওরা হাসপাতালে থাকে। ওদের বাবা হাসপাতালে চাকরি করে। আট দশবছরি সনাতন সংস্কৃতিতে বড়ো হওয়া ছেলে পুলে। সব মানুষকে ভালোবাসতে শেখা ওদের অন্তরে তাই ওরা খুব সহজেই শম্ভু এবং শঙ্করের সঙ্গে মিশে গেল। শম্ভু আর শঙ্করও এত ভালো বন্ধু পেয়ে খুব আনন্দিত। এরপর থেকে ওরা একসঙ্গেই খেলে।
শম্ভু বড়ো, বয়স ১০/১১ হবে হয়তো। শম্ভু ছেলেটা খুব দুস্টু। ঐ বয়সেই বিড়ি খাওয়া শিখেছে। প্রতিদিন খেলা শেষ করে একটা বিড়ি খায়। ও আবার বিড়ি নাকের ফুটোতে দিয়ে, আঙ্গুল চাঁপা দিয়ে টেনে, মুখ দিয়ে সুন্দর করে ধোঁয়া ছাড়ে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। তাই দেখে সবার আনন্দ যেমন হচ্ছিল, ভিতর ভিতর ভয়ও হচ্ছিল কারণ বাড়ির কেউ দেখে ফেললে সকলকেই বকবে। তবুও ওরা শম্ভুকে কিছু বললো না। এভাবেই প্রতি বিকেলে একসঙ্গে খেলা চলতে লাগল।
কিছুদিন যাবার পর শুভ জানতে পারল ওরা পড়াশুনা করেনা। ওরা ইস্কুলে ভর্তি হয়নি, বলা ভালো ওদের বাবা মা ভর্তি করায়নি। এখানেই শুভর মনটা খারাপ হয়ে গেল। শুভরা একদিন বন্ধুরা মিলে শম্ভুদের বাড়ি গেল। বাড়িতো নয় কোয়ার্টার। আর দশটা বন্ধুদের বাড়ি গেলে যেমন, শম্ভুদের বাড়িটা অমন নয়। অন্য বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে যে খাতিরটা পায়, শম্ভুদের বাড়িতে সেটা পেলনা। বাড়ির ভিতরে কেউ ডাকলো না, বসতেও বললো না। বাইরে থেকেই ওরা শম্ভুর মার সঙ্গে কথা বললো। শম্ভুর মা বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেদের মুখে একটি দুর্গন্ধ লাগলো। ছেলেরা একটু অস্বস্তি বোধ করল। শুভ শম্ভুর মাকে কাকিমা ডেকে জানতে চাইল, "কাকিমা ওদেরকে স্কুলে পাঠাওনা কেন"? শম্ভুর মা ঠিক বাংলা বলতে পারেনা, হিন্দি বাংলা মিশিয়ে কী কী বলল সেটা আবার শুভরা বুঝতে পারলো না। শুধু এটুকু বুঝল, ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায় যাবে'খন।
পরেরদিন ওরা স্কুলে গেল। শম্ভু ক্লাস ফোরে ভর্তি হোল, শঙ্কর ক্লাস থ্রীতে ভর্তি হোল। ছোট বেলায় ছেলেরা সারাদিন এ-ওর বাড়িতে যেত, ও এর বাড়িতে আসত; এমনি করে শম্ভুরা দুই ভাই একদিন শুভদের বাড়িতে এল। শুভর মা ওদের খুব আদর করে দুধ, কলা, মুড়ি খেতে দিল। ওরাও খুব তৃপ্তি নিয়ে খেল। এত প্রেম, এত ভালোবাসা, এত স্নেহ ওরা এর আগে পায়নি কখনো। শম্ভু আর শঙ্করের পোশাকআশাক, সারা গাঁ খুব নোংরা ছিল। প্রতিদিন স্নান করে না এটা পরিস্কার বোঝা যায়। তাই দেখে শুভর মা ওদের বলল, "বাবা, প্রতিদিন খুব সুন্দর করে স্নান করবে। গায়ে নোংরা জমে থাকলে সেখান থেকে শরীরের অনেক রোগ, ব্যাধি হয়তো তাই"।
এভাবে সব শিশুরা একসাথে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিলে মিশে, পাড়ার দূর্গা পূজা একসঙ্গে করে বড়ো হয়ে উঠল। শম্ভুর পড়াশুনা বেশীদূর এগোয়নি ঠিকই কিন্তু কবে যে বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, সেটা কেউ খেয়াল করেনি।আজ শম্ভু খুব ভালো ড্রাইভার আর ওর ভাই শঙ্কর, শঙ্কর বাঁসফোর মাধ্যমিক পাশ করে CISF জওয়ান। আজ ওদের বাবা নেই, কিন্তু ওদের মা আজও হাসপাতালের সুইপার।
......................................
মলয় রায় নতুন করে লিখছেন। জন্ম তারিখ- ৩০/০৬/১৯৭৬, আলিপুরদুয়ার জেলার ভাটিবাড়িতে থাকেন। ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। চেপানী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজীর শিক্ষক।
No comments:
Post a Comment