Sunday, May 6, 2018

অন্ধকারে কেবল সর্বনাম

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

শার্সির বাইরে অন্ধকার নামছিলো অল্প অল্প করে। ঘরের ভেতর তখনো একটু আলো রয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসা একটা ঘরে ওরা তিনজন কথা বলছিল। তিনটে শরীর ঘরের তিনদিকের কোণে। সাদা মার্বেলের মেঝেতে বসা। ওরা একে অন্যের দিকে চেয়ে কথা বলছিল, যেমন হয়ে থাকে সচরাচর। বাইরের অন্ধকার যে ক্রমশ ঘন হয়ে, ঘুরপাক খেতে খেতে শার্সি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে আসছে সেদিকে ওদের খেয়াল ছিল না। কথার আলোয় মশগুল ছিল ওরা। ওদের মুখনিঃসৃত শব্দেরা একে অপরের গায়ে লেগে, আলতো ছুঁয়ে, ঠোক্কর খেয়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একটা যাত্রাপথ তৈরী করছিল তিনজনের মধ্যে। প্রথম থেকে দ্বিতীয় জনের মধ্যে। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় জনের মধ্যে। প্রথম থেকে তৃতীয় জনের মধ্যে। আবার দ্বিতীয় থেকে প্রথম জনের মধ্যে। আবার তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় জনের মধ্যে। আবার তৃতীয় থেকে প্রথম জনের মধ্যে। ইত্যাদি। শব্দের এই দ্বিমুখী যাত্রাপথের দৌলতে ওদের তিনজনের মধ্যে একজন থেকে আরেকজন পর্যন্ত আলোর এক রেখাপথ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। ঘনায়মান অন্ধকারের ঘরে কথার আলোর এক ত্রিভুজ। এই ত্রিভুজ ওদের ভুলিয়ে দিচ্ছিলো, বাইরের অন্ধকার জানালার কাঁচ বন্ধ থাকলেও ভেতরে সেঁধিয়ে আসতে পারে। ঘরে একটা টিউবলাইট ছিল বটে কিন্তু কথার আলোয় মশগুল ত্রয়ী মেঝে থেকে উঠে সেটা জ্বালিয়ে উঠতে পারছিল না। ওদের অজান্তেই ঘরটা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ।

ক্রমশ...

তারপর যখন শেষ গামলা অন্ধকার কেউ হঠাৎ করে ঢেলে দিলো ঘরটার ওপর, ওদের টনক নড়লো। ওরা বলাবলি করলো অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা, আলো জ্বালাবার কথা কিন্তু কে আর আড্ডার রণে ভঙ্গ দিতে চায়। আলোর সুইচটা ঘরের চতুর্থ কোণে, যেখানে কেউ নেই। তিনকোণে বসে থাকা তিন বন্ধু হাসাহাসি করলো; বললো, আরেকজনকে দরকার ছিল যে ওই কোণটাতে বসে ত্রিভুজটাকে চতুর্ভুজ বানিয়ে দিতে পারতো। সে সহজেই হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালাতে পারতো। তারজন্য উঠতেও হতো না। তিনবন্ধু যখন এভাবে চতুর্থ বন্ধুর অভাব বোধ করছে, ঘরটা ততক্ষণে জমাট অন্ধকারে ভরে গেছে। ওরা ঠিক করলো অন্ধকারেই কথা বলবে। ঠিক করলো কথার ত্রিকোণী আলোয় ভরসা রাখবে।   

---তাহলে বল, এই যে এক নাগাড়ে বলে গেলাম আমার আর ওর ব্যাপারে। কি মনে হয়, বল দেখি?
---কি আবার মনে হবে, আমি তো বরাবরই জানি তুই আর ও একে অন্যকে ভালোবাসিস।
---ও-টা কে? এখানে তোরা দুজন ছাড়া আমি যে আছি, সেও তো একটা ও।
---নানা, তোর কথা বলছি না। ও ওর সঙ্গে যার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলছিল, তার কথাই বলছি।
---বেশ, তাকে বরং 'সে' বলা যাক, সুবিধা হবে।
--- ডান।
---কিন্তু নাম নেওয়া যাবে না কেন? বুঝতে সমস্যা হবে তো?
---তা হবে, কিন্তু এই খেলার একটা নিয়ম আছে। যতক্ষণ আলো আছে, নাম নেওয়া যায়, কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে কেবল সর্বনাম। ইন দ্য ডার্কনেস, নো প্রপার নেমস! 
---কি গেরো!
--- ব্যাক টু দ্য পয়েন্ট। বেশ, তা নয় বুঝলাম যে আমি আর সে একে অপরকে ভালোই বাসি। বাট হোয়াট আবাউট ও?
--- উফ এই ওটা আবার কে?
---এই ওটা তুই রে, তুই।
---আমি, ওহ আচ্ছা। 
---দ্যাখ, আমার যা মনে হল তুই ওকেও ভালোবাসিস, আর সে-কেও। ওকে তুই বরাবরই ভালোবাসতিস। ও তোর ছোটবেলার বন্ধু। আমারও অনেক আগের বন্ধু। আর সেকেও তুই যবে থেকে সম্পর্কে আছিস তবে থেকে ভালোইবাসিস। সেও বাসে। বাকিটা কম্প্যাটিবিলিটি যেটা একটা কঠিন ব্যাপার। 
--- রাইট, জাস্ট কঠিন কেস । দেয়ার ইজ নো এবিলিটি ইন কম্প্যাটিবিলিটি।
---তাহলে তুই কি বলতে চাইছিস? আমি যে ও, আর ও যে আমি--এই নাম না নেওয়াটা না, জাস্ট ঘেঁটে দিচ্ছে, যাক--মানে আমরা দুজন লিটারালি একসঙ্গে ২৪ ঘন্টা ঘর করিনা বলে এই কম্প্যাটিবিলিটি প্রব্লেমটা আমাদের ক্ষেত্রে হয়না। নাহলে মুড়ি-মুড়কি সব এক! ইজ দ্যাট দ্য ওনলি ডিফারেন্স? 
---ওনলি কিনা জানি না বস, তবে হয়তো ইটস এ মেজর ডিফারেন্স।
---ঘর করাটা অন্য জীব বস। জাস্ট আ ডিফারেন্ট ব্রিড অলটুগেদার।
---তাহলে সমাধান কি?
---সমাধান মানে? আমি কি লাভ গুরু নাকি? তবে একটা কাজ করতে প্যারিস।
---কি?
---হোয়াই ডোন্ট ইউ টু হ্যাভ সেক্স?
--- আমরা?
--- হ্যাঁ।
---হোয়াট?
---আমরা বন্ধু বস?
---সো?
---আর আমি যতটুকু জানি আমি স্ট্রেট।
---কতটুকু জানিস?
---উফ, আই মিন, আমি ছেলেদের সঙ্গে সেক্স করতে চাই...
---তার মানে এই নয় যে মেয়েদের সঙ্গে করতে চাস না। ইউ ক্যান সুইং বোথ ওয়েস।
---আমি তো বরাবরই বলে এসেছি আমি বাই-কিউরিয়াস। ও রাজি না হলে কি করবো বল!

ঠিক এইসময় দরজায় শব্দ হয়। গর্তের ভেতর একটা চাবি ঘরঘর করে একপাক ঘুরে নেয় আর দরজা খুলে ঢোকে ওদের চতুর্থ বন্ধু। 'কি রে তোরা কি অন্ধকার ঘরে ভূত নামাচ্ছিস নাকি'--এই বলে ও ঘরে ঢুকে ঘরের একমাত্র খালি কোণটায় গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দেয়। ত্রিভুজটা আলোর সমুদ্রে ভেসে যায়। ওরা হঠাৎ আলোয় চোখ ছোট ছোট করে ঐ চতুর্থ বন্ধুর দিকে মাথা তুলে তাকায়। ওরা তিনজন বসে। আর চতুর্থ জন দাঁড়িয়ে। ত্রিভুজটা চতুর্ভুজের দিকে যাত্রা করে দুটো আলাদা সারফেস খুঁজে পায়। একটা বসে থাকা সারফেস। আরেকটা দাঁড়িয়ে থাকার। অন্ধকার ঘরটা আলোয় মিলিয়ে যায়।

No comments:

Post a Comment