শোকের ভেতর একটা দাউ দাউ সোনাপাড়া
সুবীর সরকার
১।
তো,সেই নদী করতোয়া আর তার গম্ভীর সেতু অতিক্রম করে নদীপার্শ্বের নানান দৃশ্যপট কলাবাগিচা অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম ঘোড়াঘাট।ইতিহাসপুরাণমিথ বিনির্মিত হয়ে সুপ্রবীন এই ঘোড়াঘাট পরগণার হাওয়াবাতাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে কবি এগিয়ে এলেন প্রসন্নতা নিয়ে।আমি সিগার ধরালাম।কবি মজে গেলেন ধূমায়িত চায়ের কাপে।কবি আজ উৎফুল্ল।তার মাথার চুল যেন চাঁদ ধোয়া।শরীরে আবহমানের বাংলাদেশ।এই কবি আমাদের দোস্ত।এই কবি অসুখজড়ানো অসুখফেরত।এই কবি বেঁচে থাকতে চাওয়া বেঁচেবর্তে থাকা জীবনঘনিষ্ঠ এক মিরাকলের মতো।এই কবি আমার কাছে আশ্চর্য এক বিষ্ময়।কবি থাকেন বসবাস করেন নদীপুকুরবিলখালজমিজিরেত ধানের গন্ধে ভরা আশ্চর্যতম এক গ্রাম সোনাপাড়ায়।কবিতাগ্রাম সোনাপাড়া।এই কবি মাসুদার রহমান।অজস্র জন্ম ধরে আমি যার দিকে যাচ্ছি।যার দিকে ভাসিয়ে দিচ্ছি আকুতিভরা চোখ।আর করতোয়ার পানসা জলে পানসি ভাসে।মেঘ ভাসে আসমানে।
দিগন্ত টিগন্ত পেরিয়ে আসে কবি।মাথার ওপর আকাশের মেঘলা আলো।জীবন ও মরণের এই পৃথিবী আর তার বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা জীবনযাপন,দৈনন্দিন মাসুদারকে অন্যমনষ্ক করে দেয়।চিরকালীন সব জিজ্ঞাসারা ঘিরে ধরলে সে ঘোরের ভিতর ডুবে যেতে থাকে।উচারণের মৃদুমন্দের ফাঁকে ফাঁকে বুনে দিতে থাকে কবিতার পর কবিতা-
‘আকাশ স্বচ্ছ হলে পড়া যাবে ঈশ্বরের সমাধি-ফলক
দাঁড়াও বাংলাদেশ,ওপারে অন্য গ্রহলোক’।
দৃশ্যের পর দৃশ্যের জন্ম দেখে মাসুদার।ধানবাংলার পাখি,পাখিদের জন্যই মনোরম হয়ে ওঠা ভোরবেলাগুলি;তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় ডিলিরিয়ামের দিকে।ওপার বাংলা থেকে আসা ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ পত্রিকার পাতায় সে আকূল হয়ে খুঁজতে থাকে অপর কবিতার ভুবনমায়া।দীর্ঘ অসুখের দিকে কখন কিভাবে যেন চলে যাওয়া!আর অসুখ থেকে ফিরে আসলেই বারীন ঘোষালের চিঠিগুলি তাকে আশ্রয় দেয়।ঘুমোতে যাবার আগে তার কন্ঠে ঝরে পড়েন আল মাহমুদ-
‘তাড়িত দুঃখের মতো চারপাশে
অস্পষ্ট স্মৃতির মিছিল’।
২।
সোনাপাড়ার পথে পথে ক্ষেতে ক্ষেতে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে উত্তরের আকাশের বিস্তৃতির দিকে সঙ্গনিঃসঙ্গতা নিয়ে তাকিয়ে থাকা মাসুদারের।দিনের পিঠে দিন চলে যায়।উঠোনের হাঁসগুলি মোরগগুলি বেড়ালগুলি গরুগুলি মোষগুলি হালের বলদগুলি সবই থাকে চিরন্তনতা নিয়ে।মাসুদার তার ব্যর্থতাগুলি নিয়ে ভাবে।সফলতাগুলিকে উপেক্ষা করে।য়াজ বিকেলে কি তবে সে বাংলাহিলির দিকে চলে যাবে!সীমান্তের দিকে চলে যাবে!সুমাত্রাকে নিয়ে দেখা করে আসবে জিরো পয়েন্টে কবি সুরজ দাসের সাথে।ওপাড়ের বই পত্রপত্রিকারা অপেক্ষা করে আছে তার জন্য।উমাপদ কর ফোন দিয়েছিলেন।কদিন আগে ‘চিহ্নমেলা’ ঘুরে গেলেন উমা দা।সোনাপাড়াও ঘুরে গেলেন।খুব মনে পড়ে বউদির কথা।দেখা হওয়ার কথা হওয়ার আন্তরিক মূহুর্তগুলি নাড়া দিয়ে যায়।সুমাত্রাকেও।না,এসব থাক।আজ কোথাও যাবার নেই।বরং প্রশান্ত গুহ মজুমদারের ‘কাহাদের কথা’ বইটি নিয়েই বসা যাক।সাধুভাষায় লিখিত টানা গদ্যের কবিতাপুস্তক।
৩।
শোকের ভিতর আগুনের ভিতর রক্তপাতের ভিতর কতবার যাওয়াআসা।কত কত জন্মজন্মান্তর জুড়ে কবিতাবুনন।সেই বুননের হলকায় অর্ন্তদহনে ছিন্ন হতে হতে মাসুদারের যাপনটা ক্রমবর্ধিত হতে হতে একসময় পাখামেলা ব্রিজে লালন সহ তার উঠে পড়া।হাওয়ায় অগোছালো চুল।যেন বরফকুচি।মাসুদার চারপাশে পূর্ণদৃষ্টি মেলে।তার দৃশ্যসীমায় আসা খন্ডগুলি দৃশ্যসীমানার বাইরে বুঝি চলেও যেতে থাকে।আর তখন আবুল হাসানের কবিতার অন্তরীক্ষর কথা মনে পড়ে।আবুল হাসান তাকে উন্মনা করে তোলে-
‘জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন’।
জীবনের পরতে পরতে কি এক রহস্য!কি এক ইশারা!সরে আসতে আসতে কুহকের টানে কেবলই জড়িয়ে পড়া।তখন মাঠগুলি পুকুরগুলি রাস্তাগুলি পুকুরের অনন্ত হাঁসগুলি সোনাপাড়ার ভরাফসলের সব ধানবাড়িগুলি জন্মান্তরের অতিলৌকিকতায় জেগে থাকে।ভরভরন্ত হয়ে আকাশের পাখিগুলির দিকে দিনকালগুলির দিকে ধ্রুবসত্যের মতো অমোঘ হয়ে ওঠে।সোনাপাড়ার রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে আব্বার কাশীর শব্দ আম্মার মোনাজাত মিঠুভাইএর হাসি লালনের বিবাগী হাঁটাচলা সুমাত্রার দৌড়ে যাওয়া।প্রহরের হাততালি থেকে মাসুদার বাস্তবে ফেরে।তার ঘোর ভেঙ্গে যায়।ইণ্ডিয়া থেকে সোনালি আপা,মানে কবি সোনালি বেগমের ফোন আসে।কত কথা হয় আপার সাথে।ক্যানভাস ভরে ওঠে রঙ ভাঙবার শিসে।মাসুদার তার কবিসত্ত্বার হাড়হিম অস্তিত্বের সংকট টের পায়।তার ভাবনাচৈতন্যপ্রবাহে তরঙ্গ তরঙ্গ বিদ্যুত।কবিতায় কি বলবে সে?জীবনের শিকড় স্পর্শ করতে গিয়েও সে কিন্তু বিভ্রান্ত হয়।বিচলনচলনজনিত বিভ্রান্তির ভিতর খেই হারাতে হারাতে সে আদতে কবিতার ভিতর দর্শন অনুসন্ধান করতে থাকে।মহাজীবনের চিরসত্যিগুলি মাঠ মাঠ ধান আকাশ আকাশ পাখি নদী নদী পানির মতো আপাতবিষ্ময় বহন করে।মাসুদার জানে,মাসুদার টের পায় কবির নিঃসঙ্গতা।কবির সংকট।কবির উদাসীন বিষ্ময়গুলিও।সে দ্রুত তার পাঠকক্ষের নির্জনতায় শামসুর রহমানের ‘স্মৃতির শহরে’ ডুবে যায়।এই গ্রন্থ তার চোখে পানি আনে।আবেগ আনে।ঠিক তখন সুমাত্রা কাঁচের বড় গ্লাসে চা এনে দেয়।
সুবীর সরকার
১।
তো,সেই নদী করতোয়া আর তার গম্ভীর সেতু অতিক্রম করে নদীপার্শ্বের নানান দৃশ্যপট কলাবাগিচা অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম ঘোড়াঘাট।ইতিহাসপুরাণমিথ বিনির্মিত হয়ে সুপ্রবীন এই ঘোড়াঘাট পরগণার হাওয়াবাতাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে কবি এগিয়ে এলেন প্রসন্নতা নিয়ে।আমি সিগার ধরালাম।কবি মজে গেলেন ধূমায়িত চায়ের কাপে।কবি আজ উৎফুল্ল।তার মাথার চুল যেন চাঁদ ধোয়া।শরীরে আবহমানের বাংলাদেশ।এই কবি আমাদের দোস্ত।এই কবি অসুখজড়ানো অসুখফেরত।এই কবি বেঁচে থাকতে চাওয়া বেঁচেবর্তে থাকা জীবনঘনিষ্ঠ এক মিরাকলের মতো।এই কবি আমার কাছে আশ্চর্য এক বিষ্ময়।কবি থাকেন বসবাস করেন নদীপুকুরবিলখালজমিজিরেত ধানের গন্ধে ভরা আশ্চর্যতম এক গ্রাম সোনাপাড়ায়।কবিতাগ্রাম সোনাপাড়া।এই কবি মাসুদার রহমান।অজস্র জন্ম ধরে আমি যার দিকে যাচ্ছি।যার দিকে ভাসিয়ে দিচ্ছি আকুতিভরা চোখ।আর করতোয়ার পানসা জলে পানসি ভাসে।মেঘ ভাসে আসমানে।
দিগন্ত টিগন্ত পেরিয়ে আসে কবি।মাথার ওপর আকাশের মেঘলা আলো।জীবন ও মরণের এই পৃথিবী আর তার বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা জীবনযাপন,দৈনন্দিন মাসুদারকে অন্যমনষ্ক করে দেয়।চিরকালীন সব জিজ্ঞাসারা ঘিরে ধরলে সে ঘোরের ভিতর ডুবে যেতে থাকে।উচারণের মৃদুমন্দের ফাঁকে ফাঁকে বুনে দিতে থাকে কবিতার পর কবিতা-
‘আকাশ স্বচ্ছ হলে পড়া যাবে ঈশ্বরের সমাধি-ফলক
দাঁড়াও বাংলাদেশ,ওপারে অন্য গ্রহলোক’।
দৃশ্যের পর দৃশ্যের জন্ম দেখে মাসুদার।ধানবাংলার পাখি,পাখিদের জন্যই মনোরম হয়ে ওঠা ভোরবেলাগুলি;তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় ডিলিরিয়ামের দিকে।ওপার বাংলা থেকে আসা ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ পত্রিকার পাতায় সে আকূল হয়ে খুঁজতে থাকে অপর কবিতার ভুবনমায়া।দীর্ঘ অসুখের দিকে কখন কিভাবে যেন চলে যাওয়া!আর অসুখ থেকে ফিরে আসলেই বারীন ঘোষালের চিঠিগুলি তাকে আশ্রয় দেয়।ঘুমোতে যাবার আগে তার কন্ঠে ঝরে পড়েন আল মাহমুদ-
‘তাড়িত দুঃখের মতো চারপাশে
অস্পষ্ট স্মৃতির মিছিল’।
২।
সোনাপাড়ার পথে পথে ক্ষেতে ক্ষেতে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে উত্তরের আকাশের বিস্তৃতির দিকে সঙ্গনিঃসঙ্গতা নিয়ে তাকিয়ে থাকা মাসুদারের।দিনের পিঠে দিন চলে যায়।উঠোনের হাঁসগুলি মোরগগুলি বেড়ালগুলি গরুগুলি মোষগুলি হালের বলদগুলি সবই থাকে চিরন্তনতা নিয়ে।মাসুদার তার ব্যর্থতাগুলি নিয়ে ভাবে।সফলতাগুলিকে উপেক্ষা করে।য়াজ বিকেলে কি তবে সে বাংলাহিলির দিকে চলে যাবে!সীমান্তের দিকে চলে যাবে!সুমাত্রাকে নিয়ে দেখা করে আসবে জিরো পয়েন্টে কবি সুরজ দাসের সাথে।ওপাড়ের বই পত্রপত্রিকারা অপেক্ষা করে আছে তার জন্য।উমাপদ কর ফোন দিয়েছিলেন।কদিন আগে ‘চিহ্নমেলা’ ঘুরে গেলেন উমা দা।সোনাপাড়াও ঘুরে গেলেন।খুব মনে পড়ে বউদির কথা।দেখা হওয়ার কথা হওয়ার আন্তরিক মূহুর্তগুলি নাড়া দিয়ে যায়।সুমাত্রাকেও।না,এসব থাক।আজ কোথাও যাবার নেই।বরং প্রশান্ত গুহ মজুমদারের ‘কাহাদের কথা’ বইটি নিয়েই বসা যাক।সাধুভাষায় লিখিত টানা গদ্যের কবিতাপুস্তক।
৩।
শোকের ভিতর আগুনের ভিতর রক্তপাতের ভিতর কতবার যাওয়াআসা।কত কত জন্মজন্মান্তর জুড়ে কবিতাবুনন।সেই বুননের হলকায় অর্ন্তদহনে ছিন্ন হতে হতে মাসুদারের যাপনটা ক্রমবর্ধিত হতে হতে একসময় পাখামেলা ব্রিজে লালন সহ তার উঠে পড়া।হাওয়ায় অগোছালো চুল।যেন বরফকুচি।মাসুদার চারপাশে পূর্ণদৃষ্টি মেলে।তার দৃশ্যসীমায় আসা খন্ডগুলি দৃশ্যসীমানার বাইরে বুঝি চলেও যেতে থাকে।আর তখন আবুল হাসানের কবিতার অন্তরীক্ষর কথা মনে পড়ে।আবুল হাসান তাকে উন্মনা করে তোলে-
‘জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন’।
জীবনের পরতে পরতে কি এক রহস্য!কি এক ইশারা!সরে আসতে আসতে কুহকের টানে কেবলই জড়িয়ে পড়া।তখন মাঠগুলি পুকুরগুলি রাস্তাগুলি পুকুরের অনন্ত হাঁসগুলি সোনাপাড়ার ভরাফসলের সব ধানবাড়িগুলি জন্মান্তরের অতিলৌকিকতায় জেগে থাকে।ভরভরন্ত হয়ে আকাশের পাখিগুলির দিকে দিনকালগুলির দিকে ধ্রুবসত্যের মতো অমোঘ হয়ে ওঠে।সোনাপাড়ার রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে আব্বার কাশীর শব্দ আম্মার মোনাজাত মিঠুভাইএর হাসি লালনের বিবাগী হাঁটাচলা সুমাত্রার দৌড়ে যাওয়া।প্রহরের হাততালি থেকে মাসুদার বাস্তবে ফেরে।তার ঘোর ভেঙ্গে যায়।ইণ্ডিয়া থেকে সোনালি আপা,মানে কবি সোনালি বেগমের ফোন আসে।কত কথা হয় আপার সাথে।ক্যানভাস ভরে ওঠে রঙ ভাঙবার শিসে।মাসুদার তার কবিসত্ত্বার হাড়হিম অস্তিত্বের সংকট টের পায়।তার ভাবনাচৈতন্যপ্রবাহে তরঙ্গ তরঙ্গ বিদ্যুত।কবিতায় কি বলবে সে?জীবনের শিকড় স্পর্শ করতে গিয়েও সে কিন্তু বিভ্রান্ত হয়।বিচলনচলনজনিত বিভ্রান্তির ভিতর খেই হারাতে হারাতে সে আদতে কবিতার ভিতর দর্শন অনুসন্ধান করতে থাকে।মহাজীবনের চিরসত্যিগুলি মাঠ মাঠ ধান আকাশ আকাশ পাখি নদী নদী পানির মতো আপাতবিষ্ময় বহন করে।মাসুদার জানে,মাসুদার টের পায় কবির নিঃসঙ্গতা।কবির সংকট।কবির উদাসীন বিষ্ময়গুলিও।সে দ্রুত তার পাঠকক্ষের নির্জনতায় শামসুর রহমানের ‘স্মৃতির শহরে’ ডুবে যায়।এই গ্রন্থ তার চোখে পানি আনে।আবেগ আনে।ঠিক তখন সুমাত্রা কাঁচের বড় গ্লাসে চা এনে দেয়।
No comments:
Post a Comment