Thursday, July 6, 2017

কবিতা করিডোর , অনুগল্প সংখ্যা , জুলাই

সম্পাদকীয়

জীবনে চাহিদা নিয়েই বেঁচে থাকা । আমিও থাকি । সময় একটা ফ্যাক্টর । শুধু সময়ের দিকে তাকিয়ে নয় বিবর্তনের ধারা পথেই ছোটগল্পের পরবর্তী প্রজন্ম রূপে অনুগল্প এলো । অনুগল্প আকারে শুধু ছোট বলে নয় বরং অনেক বেশি আঁটসাঁট বাঁধনে বাঁধা  । আর এই  সাহিত্য প্রকরণ নিয়েই এবারের সংখ্যায় পরীক্ষা নিরীক্ষা ।
                                       শুভঙ্কর  পাল
                                  বারবিশা , আলিপুরদুয়ার


 এই সংখ্যায় অনুগল্প লিখেছেন --
পাখি --  বেবী সাউ
পুনরাবৃত্তি --অরিন্দম ভাদুরি
মহাশূন্যের মানুষ -- রঙ্গন রায়
সোনা বন্ধু -- শুভঙ্কর পাল
                                 

পাখি/ বেবী সাউ

ঘুম থেকে উঠেই ভেবেছে, আজ সময় করে খুলবেই। জানলাটা। জং ধরেছে যদিও। জং ধরেছে না বলে বরং ধরতে আরম্ভ করেছে বলা ভালো। পোষা জানলা। কত রাত কেটেছে এর কোলে। লোহার রেলিংএ নোনা জলের ঝাপট আছে ঠিকই  কিন্তু আকাশও। আজকাল সুখ বলতে তো এই জানলা খুলে ঠায় বসে থাকা। আনাগোনা। যাতায়াত। নারিকেল তেলও এনে রেখেছে জংকাটার জন্য।  কতদিন সময় পাচ্ছে না বলে জানলাটা খোলা হচ্ছেনা, আজ এই ইচ্ছেতে যেন মন মেতে উঠেছে। অনেকদিন পরে নিজের ফ্রেশ হওয়াটাকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তানিয়ার। সবটাই জানলা বিষয়ক হলেও এই কথাটি শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে অনির সঙ্গে। উফ...আবার!

তাড়াতাড়ি কলেজের কিছু কাজ,  এই যেমন সেমিনারের নোটস, ক্লাসের সাবজেক্টের প্রিপেয়ার করতে করতে দশটা বেজে গেল। একটু মার্কেটে বেরোতে হবে। ছুটি নেই এই সপ্তাহে আর। ঘরে খাবার মতোও কিছু নেই। একাই থাকে। মা বলছিল একজন বান্ধবীর সঙ্গে থাকার জন্য। কিন্তু এই একাকীত্ব মুহূর্তটাতে আরও একলা হওয়ার প্রয়োজন ছিল তার। ইচ্ছেমত নিজের পঙ্গুত্বটাকে দেখতে চেয়েছিল সে। ভাবতে চেয়েছিল অনি ছাড়া কতটা একা হওয়া যায়। কতটা সহ্য করা যায় কষ্ট। কিছুতেই অনি থেকে আলাদা হতে পারছিল না সে। স্কুটি নিয়ে বেরোবে। দুপুরে ঝাল ঝাল খিচুড়ি। বেশী টাইম লাগবেনা। খেয়েই জানলাটা খুলবে ঠিক করল।

হঠাত্‍ সমস্ত  দুপুর জুড়ে ছেয়ে এল মোষকালো মেঘ। ব্যালকনীর মানিপ্যান্ট দুলছে। বড় বড় ফোঁটা। জামাকাপড় তুলতে এসে দেখে, একটা ঝড়ঝাপটা পাখি এসে বসেছে ব্যালকনীর তারে। জুবুথুবু, কষ্টকাতর অথচ চোখ দুটিতে অপার এক মুক্তির আলো। চকচক করছে। এক মুহূর্তে মুগ্ধ হয়ে গেল তানিয়া। এক বিস্তারিত আকাশ যেন উড়ে বেড়াচ্ছে কাচের ওপারে। উড়ে যাচ্ছে বিষন্ন মনখারাপ, অনির ছেড়ে যাওয়া। মিথ্যে আশ্বাস। ভুল ছিল বন্ধ জানলার কথা, অতীতের। বরঞ্চ এক স্বাধীনসত্ত্বা ভরপুর এক মন নিয়ে তানিয়া অনেকদিন পর বৃষ্টি দেখে। ভেজে জলের ঝাপটে। বিদ্যুতের শব্দে ভেঙে ফেলে জমে থাকা কাচের পাহাড়। বৃষ্টি কমল যখন ভেজা পাখির চোখে এক অদ্ভুত আকাশ। যেখানে সাতটি রঙ নিয়ে রামধনু খেলছে। ভরপুর মুক্তি।

চিত্র ঋণ : ইন্টারনেট





পুনরাবৃত্তি

———————

☆অরিন্দম ভাদুরি

বালিগঞ্জের দু'কামরার ছিমছাম স্বচ্ছল ফ্ল্যাট | বাসিন্দা প্রদীপ্ত,তৃধা আর ওদের মেয়ে স্নেহা | গোলাপি রঙের ফ্ল্যাটে হালফ্যাশানের টিভি,মাইক্রোওয়েভ,ফ্রিজ,আর দু ঘরে তিন বাসিন্দা | প্রদীপ্ত আর স্নেহা দিন শেষে এসি-র ঘরে ঘুমিয়ে,ঠিক তখনই,পাশের ঘরে ইন্টারনেটে অতৃপ্ত লবিডোর তাড়নায় সঙ্গী শিকারে ব্যস্ত তৃধা |

হাঁচির প্রবলেম থাকায় প্রদীপ্তর প্রতি রাতের অভ্যাস একটি করে সেট্রিজিন,সঙ্গে ২৫ ডিগ্রির এসি | নামী বেসরকারি স্কুলে পড়া স্নেহা ব্যতিব্যস্ত হোমটাস্ক নিয়ে,তাই স্কুল ও বাড়ির পড়া শেষে এই ঘুম তার বড় প্রিয় | প্রদীপ্ত আর তৃধাও খুব কনশাস ওর পড়াশোনা নিয়ে,এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে পাওয়া সীট !

ভোর পাঁচটায় দিন শুরু হয় বাড়িটার | স্নেহাকে রেডি করা,প্রদীপ্তকে জাগানো,টিফিন তৈরি | স্কুলবাসে মেয়েকে তুলে দিয়ে ফিরেই প্রদীপ্তর প্রস্তুতি অফিসের | নিখুঁত গৃহবধূ,প্রকৃত সংসার !

প্রদীপ্ত চলে যাওয়ার পরেই এক নিমেষে রূপ বদলে যায় তৃধার | মুহুর্মুহু ফোন,কোনওমতে চটজলদি দুপুরের রান্না,স্নান,কাজল,লিপস্টিক,পরকীয়া | ইলিয়ট পার্ক,নন্দন,বেওয়ারিশ চুমু,আর আলগা শরীরী সুখের মাঝে ৬ ঘন্টা স্কুল শেষে মোড়ের মাথায় মেয়েকে রিসিভ করার তাড়া | স্কুল শেষে ক্লান্ত স্নেহা কোনোমতে মুখে চাট্টি গুঁজে ঘরে ঢুকে এসি চালিয়ে এলিয়ে পড়ে বিছানায়,সন্ধের পড়ার আগে একটু বিশ্রাম চাই |

দরজা খুলে যায় দু কামরার ফ্ল্যাটের,অতিথি | কিছু পরে শীৎকার ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘরময় !

ষষ্ঠেন্দ্রীয় বলে একটা কথা আছে,যা ঘুমের মধ্যেও পরিচিত গলার চীৎকার পৌঁছে দেয় স্নেহার কান অবধি ! নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দ্যাখে টেবিলের ওপর শান্তিনিকেতনের ব্যাগ,দরজার পাশে চামড়ার চটি,পাশের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ ! ভয় আর বিস্ময় মাখা মানসিক দোটানায় এসির ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঘুমের মধ্যে অপেক্ষা করতে থাকে পবিত্র বিকেলের | বিকেল আসে,দুপুরের দুঃস্বপ্নের লেশমাত্র নেই ! রোজের দুঃস্বপ্নের সাথে বন্ধুত্ব করে নিয়ে স্নেহা ব্যস্ত হয়ে পড়ে হোমটাস্কে,একটু পরেই বাবা আসবে | রান্নাঘরে মা ব্যস্ত থোড়-বড়ি-খাড়ায় | দুপুরের ঘটনা আবছা হয়ে আসে,কিন্তু মা চীৎকার করে কেন ?

দিন যায়,বছর যায়,স্নেহা এখন ক্লাস নাইন | এই সময়ে যা হয়,কিছু অকালপক্ক ছেলেমেয়ের সংস্পর্শে চীৎকার আর শীৎকারের তফাত জানতে পারে সে ! চীৎকার যন্ত্রণা,শীৎকার সুখ | সে সুখ গোলাবাড়ির কষা মাংসে বা বিরাট কোহলির সেঞ্চুরিতে নেই,বরং অন্য কিছু !

বান্ধবী বাড়তে থাকে,বন্ধুও |

সময় নিজের স্রোতে বয়ে চলে | লিবিডোর ডাকে তৃধা প্রায়দিনের মতোই বেরিয়ে পড়ে একটু উষ্ণতার খোঁজে,স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পর | আজ স্নেহার ছুটি | স্বার্থ চরিতার্থ করে তৃপ্ত তৃধা পাটভাঙা ঘরোয়া হয়ে বাড়ি ফেরে | এতবার কলিং বেল বাজাতে হচ্ছে কেন ? একগোছা চাবি ওর কাছেই থাকে,তাই দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে আর্তনাদের সাথে হাত থেকে চাবিগোছা পড়ে যায় মেঝেতে ! বেডরুমের বিছানার চাদর কোনোমতে টেনে লজ্জা ঢাকছে স্নেহা,পুরুষ বন্ধু ব্যস্ত জিনসের জিপার আটকাতে !

হিস্ট্রি রিপিটস্ ইটসেল্ফ...

চিত্র ঋণ : ইন্টারনেট



                                   মহাশূন্যের মানুষ
                                                     রঙ্গন রায়

তিস্তার তীরে ফাঁকা বালিয়াড়ি তে বসে আছে অভিজিৎ। উঠতে পারছেনা। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা। উষ্ণতায় গা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ জলজ বাতাস এসে খেলে যাচ্ছে শরীরে। ঘড়িতে সাতটা বাজে। শীতের বেলায় এ অতিরিক্ত রাত। নাক থেকে শ্লাঘা - চোখ থেকে জল পড়ছে তার। প্রচণ্ড সর্দি গর্মি। তার ওপর জ্বর। সমস্ত শরীর টালমাটাল।  উঠে পড়তে হয় এই বেলা, কারন চারিদিকে নেমে এসেছে কালি, তারমধ্যে কোয়াশারা ঢুকে যাচ্ছে এর ওর শরীরে। ঘোরের মাথাতেই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল অভিজিৎ।  এখন খুব ঠান্ডা লাগছে। গায়ে শাল রয়েছে একটা,কিন্তু শীত মানছেনা। উঠে সবে দু-পা চলতে গিয়েই মাথা ঘুরে পড়ে গেল সে। শরীরে একটা দারুন কাঁপুনি। শুয়ে পড়লেই চোখে অজস্র তারা। শীতের সন্ধ্যায় চোখে কালপুরুষ নেমে এলো। এক এক করে নেমে আসছে ধ্রুবতারা, বৃশ্চিক, সপ্তর্ষি মন্ডল। নীল আলো গুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই আদুরে বালিয়াড়ি ছেড়ে উঠতে চাইলোনা অভিজিৎ।  এইতো পরম শান্তি।  কে এখন এই বালিশ ছেড়ে ঝাপ দেবে মহাশূণ্যে? কৃষ্ণগহ্বর গুলো গিলে নিক তাকে। মাথার ভেতর নেমে আসুক আকাশগঙ্গা।  সে তো আত্মসমর্পনেই বেড়িয়েছে।


!
                                                               
 চিত্র ঋণ : ইন্টারনেট



সোনা বন্ধু / শুভঙ্কর পাল

গাঙ চিল একটি পাখি । যেভাবে জীবনানন্দ লেখেন গাঙ চিল নিয়ে কবিতা । কবিতার ভিতর ডানা মেলে উড়ে যায় । উড়তেই থাকে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যেখানে অপু ও দুর্গা মুক্তির আনন্দে পথ হারায় । সেখানে জলার ধারে রোববারের সন্ধ্যা নামে মেঘের গায়ে নোলক কেটে । ধূসর ছায়া শরীরে ওর ,  মেঘ বাসা বেঁধে ছিল  । তাই নেমে আসতেই হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিও নেমে এল ।  ঘন্টা খানেক পরে মেঘ ধুয়েমুছে গেলে দেখা যায় সন্ধ্যা তখনও গাঢ় হয়ে ওঠেনি । ছেলেরা মাঠ থেকে ফিরছে কাদা মেখে ।  অপু আর দুর্গা ওদের সাথেই ফিরে আসে । ফেরার পথে  সেই চেনা বটতলায় থমকে দাঁড়ায় মোহন বাঁশির সুরে । নিধুয়া কি করুন রাগিণী বাজিয়ে চলেছে । সাজু রূপাই আর নকশীকাঁথার  গান  । চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে দুর্গার ।  অপু গানের কথা সেভাবে না বুঝলেও এটা বুঝেছে দিদির ভীষণ কষ্ট । অপু নিজেও কাঁদে । কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে । মা বুঝে উঠতে পারেনা কান্নার কারণ কি ।  ছেলেটি আধো আধো বলে  দিদির খুব কষ্ট তাই না ।  ওর বরটা কি নিষ্ঠুর । একটি বারের জন্যেও আসতে পারে না ।
পরদিন  হঠাৎ বাইরে পিয়নের কলিং বেল বেজে ওঠে । পিয়ন চেঁচিয়ে বলে চিঠি এসেছে । এতকাল পরে কোথা থেকে চিঠি মা চমকে ওঠে । পিয়ন জানায় গুজরাট থেকে রেজেস্ট্রি চিঠি । সই সেরে চিঠি হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলিয়ে মা পাথর হয়ে যায় । আবার আকাশে মেঘ করে , ঘন কালো মেঘ । যেন গুমরে গুমরে কেঁদে উঠছে । মায়ের চোখে জল । দুর্গা মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায় । মাকে জিগেস করে কার চিঠি । মা তবুও চুপ করে থাকে । শুধু হাত দুটি বাড়িয়ে মেয়ের কপাল থেকে সধবার চিহ্ন মুছে দিয়ে অঝোরে কাঁদে । মেয়েটি পাথর হয়ে থাকে । বাড়ির সামনে দিয়ে নিধুয়া বাঁশি বাজিয়ে যায় ' সোনা বন্ধু ছাড়িয়া গেলে কেমনে ধরি মোর জীবন ও যৌবন '

চিত্র ঋণ : ইন্টারনেট