Sunday, May 6, 2018


অমিয় বিশ্বাসের প্রবন্ধ 


চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জনম
তারে তোমরা বলবে কি।

ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হল 
এগারো মাসে তিনটি সন্তান
কোনটা করবে ফকিরি। 

ঘর আছে তার দুয়ার নাই
লোক আছে তার বাক্য নাই গো
কে তাহার আহার যোগায়
কে দেয় সন্ধ্যা বাতি। 

লালন ফকির ভেবে বলে
ছেলে মরে মাকে ছুঁলে গো
এই কথার অর্থ নইলে 
তার হবেনা ফকিরি।।
----------
১।অ

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জনম
তোমরা তারে বল কি।

সকালে চার পায়ে হাঁটে
দুপুরে দুই পায়ে হাঁটে
সন্ধ্যেতে হয় তিনটি মাথা
আজব কথা শুনেছি। 

ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হল
এগার মাসে তিনটি সন্তান
কোনটা করবে ফকিরি। 

ঘর আছে তার দুয়ার নাই
মানুষ আছে বাক্য যে নাই
কে জোগায় তার খানাপিনা, 
কে জোগায় সন্ধ্যাবাতি। 

মদন শাহ ফকিরে বলে 
ছেলে মরে মাকে ছুঁলে
এসব কথার অর্থ নইলে
হবেনা তার ফকিরি। 
-----
উপরিউক্ত গানটি বাউলের প্রশ্নোত্তরী দেহতত্ত্ব গানের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাউল গান সন্ধ্যা ভাষায় রচিত যাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন ‘আলো-আঁধারি’ ভাষা, যার একটি বাহ্য অর্থ আছে কিন্তু তার সাঙ্কেতিক পরিভাষা না জানলে প্রকৃত অন্তর্নিহিত অর্থ পাওয়া যায় না। অনেকের মতে কথাটি সন্ধা ভাষা (অভিসন্ধায় ভাষিতম) বা অভিসন্ধি মূলক ভাষা (intentional language) ।  এই ভাষায় লৌকিক প্রবচন, হেঁয়ালী থেকে শুরু করে যোগ-তন্ত্র, বৈষ্ণব-সুফিবাদের তাত্বিক পরিভাষার সচেতন প্রয়োগ দেখা যায়। 
 
বাউল গানের মৌখিক পরম্পরায় অনেক সময় গানের কথার বা পদকর্তার নামের পরিবর্তন দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে একই গান সামান্য পরিবর্তন সহ একাধিক পদকর্তার নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে। কোন কোন ক্ষেত্রে অনামী পদকর্তার গানে নামী পদকর্তার ভনিতা ব্যবহার করে তার প্রামান্যতা সিদ্ধ করা হয়। চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে গানটি বিখ্যাত লোকশিল্পী গোষ্ঠগোপাল দাস তাঁর ক্যাসেট রেকর্ডে লালন ফকিরের ভণিতা দিয়ে গেয়েছেন। কিন্তু বর্তমানের কোন গবেষকের গ্রন্থে গানটি লালন ফকিরের পদ হিসেবে স্থান পায়নি। অন্যান্য গবেষণা গ্রন্থে ও বিভিন্ন বাউল তত্ব শিল্পীদের মতে গানটি মদন শাহ ফকিরের রচিত। উত্তর বঙ্গের প্রখ্যাত বাউল তাত্বিক শিল্পী তরনী সেন মহন্ত গানটিকে মদন শাহ ফকিরের পদ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং এর উত্তর পদ রচনা করেছেন।  
 
বাউল গানের অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যেও বহুত্ব লক্ষ্য করা যায়। একই গান সাধনার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। বাউলের ভাষায় ‘ একটি কথার চারটি অর্থ/ স্থুল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ’। 
চাঁদ বা চন্দ্র বাউল গানে একটি বহুল্প্রচলিত সাঙ্কেতিক শব্দ যা একাধিক অর্থ বহন করে। তন্ত্রে চন্দ্রের একটি অর্থ মন। আবার হঠযোগে চন্দ্র-সূরয দেহের ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ী। বাউল গানে, লৌকিক তন্ত্রে চার চন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায় যথা কামচন্দ্র, ভাবচন্দ্র, জ্ঞান চন্দ্র ও ধ্যান চন্দ্র বা গরল, উন্মাদ, রোহিনী ও মান চন্দ্র। সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রের কথাও বাউল গানে ঘুরে ফিরে এসেছে। অনেকের মতে চার চাঁদ হল মানব দেহ নির্গত মল, মূত্র, রজ, বীজ আবার কারো মতে বৌদ্ধ তন্ত্রের চারটি চক্র যা মানবদেহে ধারণা করা হয়।  গানটির মূল বিষয় মানব দেহ ও সৃষ্টি তত্ব। তাই অনুমান করা যায় ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে অর্থে রজ-বীজের( ডিম্বানু-শুক্রানু) বা নারী-পুরুষের মিলনকে নির্দেশ করা হয়েছে। ঝি বা কন্যা রজবতী হলে তার মাতৃত্বের সূচনা ঘটে (‘ঝি কে মা যায় না বলা / না হলে তার রজস্বলা’- বাউল তরনী সেন মহান্ত)।   
তন্ত্র মতে গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাসে জীবের দেহে ষড় রিপুর প্রবেশ ঘটে, নবম মাসে নব দ্বার যুক্ত হয়। একাদশতম মাসে জন্মের পূরবে মন বুদ্ধি ও অহংকার এই তিন সন্তানের জন্ম। ভাব, ভক্তি ও বৈরাগ্য মনের ধর্ম তাই মনই ফকিরি করে। 
জীব গর্ভে থাকাকালীন মাতৃনাড়ীর মাধ্যমে আহার করে, তখন প্রাণ থাকলেও তার প্রকাশ নেই। 
শৈশবে মানুষ হামাগুড়ি দেয় বা চার পায়ে হাঁটে, যৌবনে দুই পায়ে দাঁড়ায় আবার বৃদ্ধাবস্থায় তার মাথা দুই হাঁটুর কাছে নেমে আসে।
 সকল রজোবতী নারীই মা আর পুরুষ মাত্রেই পুত্র। হঠযোগ অনুসারে বিন্দু পতনং মরণম/ বিন্দু ধারণং জীবনম। তাই রমণ কালে বিন্দু বা শুক্রের পতনকে ছেলের মৃত্যু বলা হয়েছে। 

 
২। (ক)
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না
ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাব না
না না না ছেড়ে দিব না। 

ভুবনমোহন গোরা, মনীজনার মনহরা
রাধার প্রেমে মাতুয়ারা  
ধুলায় যায় গড়াগড়ি। 
যেতে চাইলে যেতে দেব না
না না না ছেড়ে দেব না। 

যাব ব্রজের কুলে কুলে আমরা মাখব পায়ে রাঙা ধুলি
চলে গেলে যেতে দেব না’না যেতে দেব না। 

যে ডাকে চাঁদ গৌর বলে ভয় কি গো তার ব্রজের কুলে 
দ্বিজ ভূষণ চাঁদে বলে চরণ ছেড়ে দেব না। 
-----
২।(খ)

তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না
ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাব না। 
যাব ব্রজের কুলে কুলে মাখব ব্রজের পদধুলি
জয় রাধা নামে পাগল হয়ে রইব মগনা। 
ভুবনমোহন গোরা গোপী/মনীজনার মনহরা
আমি নয়নে নয়ন দিয়ে আরতো ফিরব না
কত লক্ষ জনম ভ্রমন করে সাধের মানবজনম পেয়েছিরে
দ্বিজদাসের এই ভাবনা মানব জনম আর হবেনা
আমি ভজলে হরি বংশিধারী নিদয় হোয়ো না। 

পশ্চিম বাংলার বাউল গানের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হৃদ মাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেব না’। বহু গ্রামীন বাউল শিল্পী থেকে শুরু করে শহুরে লোকশিল্পী ও ব্যান্ড এই গানটিকে বিভিন্ন ভাবে ও যন্ত্রানুসঙ্গে পরিবেশন করেছেন। 
মৌখিক ঐতিহ্যের বাউল গানে একই পদ সামান্য পরিবর্তন সহ একাধিক পদকর্তার নামে প্রচলিত হতে দেখা যায়, এই গানটিও তার ব্যতিক্রম নয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন রেকর্ডিংয়ে গানটির পদকর্তা হিসেবে দ্বিজ ভূষণ চাঁদ এর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্ণদাস বাউলের রেকর্ডিংএ গানটির কোন ভণিতা নেই।  আবার পুরনো রেকর্ডিং-এ দ্বিজদাসের ভনিতায় এবং দ্বিজদাসের গানের সংকলনে গানটি পাওয়া যায়। 
শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণের আগের নাম গৌরাঙ্গ বা সংক্ষেপে গৌর। বাংলার বৈষ্ণব ও বাউলদের কাছে তিনি রাধা-কৃষ্ণের যুগল অবতার। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ রাধাপ্রেম আস্বাদন করতে পারেননি তাই কলি যুগে সেই অভিপ্রায়ে তিনি গৌরাঙ্গ অবতার হলেন। তিনি বহিরঙ্গে রাধা, অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ। তাই গৌর ভজনাই একাধারে রাধা কৃষ্ণ যুগল ভজন। 
কৃষ্ণ যেমন ব্রজ ছেড়ে মথুরায় গেছিলেন আর ফিরে আসেননি রাধা ও অন্যান্য গোপীদের কাছে, তেমনি চৈতন্যও বাংলা ছেড়ে নীলাচলে চলে গেলেন এবং সেখানেই অন্তর্হিত হলেন। কৃষ্ণের প্রতি রাধা ও অন্যান্য গোপীদের যে বিরহ ও প্রেম গৌরের প্রতি নদীয়াবাসীর সেই একই ভাব যা নদীয়া-নাগরী ভাব নামে পরিচিত। 
বর্তমান পন্থী সহজিয়া বাউলদের কাছে গৌর নিত্য বর্তমান, তার স্থান হৃদয়ে। বহু লক্ষ জন্মের পর পাওয়া যায় এই মানব জন্ম। এই মানব জন্মেই গৌর প্রেম আস্বাদন করতে হয়, তাই মানব জন্ম অমূল্য। শ্রীকৃষ্ণ যেমন রাধা প্রেম আস্বাদন করার জন্য গৌর রূপে জন্ম গ্রহন করলেন তেমনি গৌর প্রেম আস্বাদন করার জন্য বাউল নিজেই গৌর ভাব ধরে রাধা নামে বিভোর হয়ে ব্রজের পথে হাঁটতে চায়। 

ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে
ফাঁদ বসাইছে ফান্দি রে ভাই পুঁটি মাছো দিয়া
ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে।
ফান্দে পড়িয়া বগা করে টানাটুনা
ওরে আহারে কুংকুরার সুতা হল লোহার গুনা রে।
ফান্দে পড়িয়া বগা করে হায় রে হায়
ওরে আহারে দারুণ বিধি সাথী ছাইড়া যায় রে।
উড়িয়া যায় চখুয়ার পঙ্খী বগীক বলে ঠারে
তোমার বগা বন্দী হইছে ধল্লা নদীর পারে রে।
এই কথা শুনিয়া বগী দুই পাখা মেলিল
ওরে ধল্লা নদীর পাড়ে যাইয়া দরশন দিল রে।
বগাক দেখিয়া বগী কান্দে রে
বগীক দেখিয়া বগা কান্দে রে। 

কুচবিহার অঞ্চলের এই গানটি একটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গান ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া ও ধুবরি জেলা, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, কিছু অংশে উত্তর দিনাজপুর ও দার্জিলিং জেলা এবং বাংলাদেশের দিনাজপুর ও রংপুর জেলার অন্যতম প্রধান লোকসঙ্গীত।
লোকশিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমেদের কন্ঠে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ভাওয়াইয়া গানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পিরিতি এবং বিরহ-বিচ্ছেদ অন্যতম প্রধান বিষয়। ধীর বা মধ্য লয়ে এই ধরনের গান মূলত দরিয়া অঙ্গের চিন্তন ও গড়ান পরযায়ের মধ্যে পরে। দোতারায় বাজে দরিয়া ডাং বা দরিয়া-কারফা।  
ভাওয়াইয়া গানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, তোর্সা, খিরল, করতোয়া, মানসী, ধারালা বা ধল্লা, কালজানি, রায়ডাক, মহানন্দা প্রভৃতি অসংখ্য নদী। অতীতে তরাইয়ের এই নদীগুলিতে ফাঁদ পেতে শিকার করত ফান্দি জনজাতির মানুষেরা। তাই সহজেই গানের রুপক হিসেবে এসেছে আঞ্চলিক নদী ও মানুষের কথা। বগা-বগীর কাহিনীর রূপকে মানব-মানবীর প্রেম ও বিচ্ছেদ, ফান্দি ও পুঁটিমাছের রূপকে সমাজের বিভিন্ন  অনুশাসন ও প্রলোভনকে এই গানের মাধ্যমে চিত্রিত করা হয়ছে।  
  
আজি গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে 
হস্তির নড়াং হস্তির চড়াং কাকোয়া বাঁশের আড়া
ওরে কি সাপে দংশিলক বন্ধুয়া বন্ধুয়া পা হল মোর খোঁড়া রে।
রোজায় ঝাড়ে গুণীকের ঝাড়ে দেখিয়ার আগল দিয়া। 
ওরে মুই নারীটা ঝাড়ং বন্ধুয়া কেশের আগাল দিয়া রে। 
খাটো-খুটো মাহুতরে তোর মুখে চাপ দাড়ি
 আরে ও সত্যি কইরা বল রে মাহুত কোন বা দেশে বাড়ি
হস্তির নড়াঁই হস্তির চড়াঁই হস্তির পায়ে বেড়ি  
আমি সত্য কইরা কইলাম নারী গৌরিপুরে বাড়ি
হস্তির নড়ান হস্তির চড়ান হস্তির পায়ে বেড়ি
আরে সত্য কইরা কনরে মাহুত ঘরে কয়জন নারী রে।
হস্তির নড়ান হস্তির চড়ান হস্তির পায়ে বেড়ি
আমি সত্য কইরা কইলং কন্যা বিয়া নাহি করি রে।। 
 

উপরিউক্ত গানটি আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের গান যা গোয়ালপাড়িয়া ভাওয়াইয়া গান নামে পরিচিত। লোকশিল্পী প্রতিমা বড়ূয়ার কন্ঠে গানটির প্রথম রেকর্ডিং প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে বহু শিল্পী গানটি বিভিন্ন ভাবে পরিবেশন করেছেন।  
ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছে আঞ্চলিক প্রকৃতি ও গাড়িয়াল, মাহুত, ফান্দি, মহিষাল প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন। 
মাহুতের কাজ জঙ্গল থেকে ফাঁদ পেতে হাতি ধরা, পোষ মানানো আর মানুষের কাজে তাকে চালনা করা। তাই তার জীবন বিপদসঙ্কুল। মাহুতের কাজে তাকে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হয়। তাই একবার চলে গেলে তার ফেরার আশা কম।  
ভিনদেশি মাহুতের সাথে কন্যার এই অসামাজিক প্রেম যেন অজানা সাপের দংশনের রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। মাহুতের সাথে কন্যার কথোপকথনের মাধ্যমে গ্রাম্য তরুনীর তরুণ মাহুতের প্রতি মোহ, প্রেম, সংশয় গানটির মূল ভাববস্তু। 

No comments:

Post a Comment