Sunday, May 6, 2018

কবিতা করিডোর , বৈশাখী সংখ্যা , (এপ্রিল , ২০১৮)

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : শিলাদিত্য বসাক

সম্পাদকীয় ইচ্ছে করেই রাখলাম না । সবাই মুক্তভাবে খুঁজে ফিরুক লেখার ভিতর তার ভিতর কার কথাগুলি । জানি কৃষ্ণচূড়া ফুটে উঠলে নতুন বছর আসে । আর আসে বলেই সূচীপত্রে নিজেদের আটকে রাখিনি । আয়োজনে ত্রুটি থাকলে তার দায় আমার । তবে লেখা সমন্ধে কোন দায় সম্পাদকের নয় ।

উত্তর পূর্বাঞ্চল বিভাগ :
কবিতা :


সিপিয়া রঙ সময়

 দেবলীনা সেনগুপ্ত

সময়ের রঙ এখন সিপিয়া
এই সিপিয়া রঙের সময়ে
কোন কথা বোলো না।
চুপ করে থাকো আর
চোখে রাখো নিরীহ নিরীক্ষণ
সতর্ক শ্বাপদের মতো
পার করো প্রহরার ক্ষণ ।
সমস্ত প্রশ্নচিহ্ন
বিকলাঙ্গ ভাসিয়ে দাও
প্রশ্নহীন আনুগত্যে
নতজানু সভ্যতার কাছে ।
শোন, কথা বোলো না
দেখো, কথা বোলো না
গুণে রাখো পাতাদের অসহায় খসে পড়া
তারাদের অকাল পতন
শস্যক্ষেত্র জ্বলে গিয়ে বধ্যভূমি হওয়া
ভুলে যাও অনাবিল স্বাধীন চারণ
এই বিপ্রতীপ সত্য সব
আগুন ও লাভা হয়ে
জমা থাক বুকের ভেতর

ইতিহাসের  পাতায় লিখো
অসহ্য উদগীরণ
ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির
জ্বলন্ত স্বাক্ষর।

যুদ্ধ

কমলিকা মজুমদার

প্রতিটা রাতের পর রাত নামলে
আমি মার দিকে চেয়ে থাকি
বেডরুমের জিরো পাওয়ার বাল্বে
বুঝে নিতে চাই বলিরেখা
হাত ছোঁয়াই আর মাপি
যুদ্ধ এখনো কতটা বাকি
যতদিন কাঁটাতারে সৈন্য বহাল
আমার ঘুমটাও যে সুনিশ্চিত
এটাকেই কি স্বার্থপরতা বলে?

ফাঁকি

অনুরাগ ভৌমিক

এই চলে যাওয়া ফাঁকি,

ফাঁকি দিয়ে সমস্ত ‍রচনা;
অথবা সমস্ত এর পর...

দিন দিন ছেড়ে যায় যৌবন,
উড়ে যায় পোষমানা পাখি।

পরশি-দেয়াল টপকায় না
ঘসা কাচ।

শুধু শিউলি বৃক্ষে বসে থাকে
মিশুকে জ্যোৎস্না...

হত্যা 

তমা বর্মণ 

তর্কশাস্ত্রে বেঁচে থাকতে তীব্র অনিচ্ছে।

যা হয় হবে।
ভালোমন্দ ভাবা নিবারণ স্যারের কাজ

একটি সম্মতির মধ্যরাত জেগে...
অতো বাঁচামরা নিয়ে আজকাল কে ভাবে!

মুদির দোকানে দাঁড়ালে
সব সমানুপাত।

লাভ ক্ষতি আছে?

জীবন জাতীয়সর্বভুক প্রাণী,
বন্ধ্যা গর্ভিণী সব খায়।

একশো বাহান্নোটা টুকরো আমিও প্রমাণলোপাটে রাখতে চাই...

আলোর নীচে

জাদু

মূল অসমিয়া : চন্দন গোস্বামী 
বাংলা ভাষান্তর :অর্জুন দাস 

জাদুকরের জাদুতে  একদিন
গলতে শুরু করে পাথরটা

পাথরের এক অংশ জল
আরেক অংশ মাটি

যার কথায় কোনো এক সুরংগ ভেদ করে
রক্তের নদী বয়ে আসে
সাগরের ঢেউ ধুয়ে নেয় উঠোন

অন্য এক ফেরার পথে
গানের পাখিরা উরে যায়
আগুন-সৃষ্ট ঢোলের শব্দে

মাছ লেজ নাড়ালেই
একটি মালার ভিতর চন্দ্র

পাতালের রূপকথা
পলাশ সাগরে ঝিলমিল তারা

উচ্চিংড়ের ডাকে লুকিয়ে থাকে রোদ্দুর

মাঠে বীজের স্তুতি
জাদুকরের কথায়

বিশ্বাসের জন্যই যুদ্ধে নিমজ্জিত জীবের প্রাণ
হিংসার জন্য হিংসা
অহিংসার জন্য অহিংসা
জাদুর পথে অনেক পথ
মহাপথের প্রান্তে অসত্যর ছায়া
ঢেকে রাখে সত্য

প্রত্যেকটা শব্দই তাই কবিতা
কে প্রথম শারী কবিতার স্রষ্টা
কে স্রষ্টা হবেন শেষ শারী কবিতার
বলো হে জাদুকর!


ডিজিটাল পদাতিক

আবু আশফাক্ব চৌধুরী

প্রাচীন বসন্ত হাওয়া মরু মেঘ অস্থির
পাহাড়ের পরিয়ায়ী সুখ লেপটে থাকে গায়
বনফুল অর্ধমৃত রাতদিন নীরব পাহারায়
দুদণ্ড বিশ্রামহীন সময় এ ধরিত্রীর

ত্রিকোণ গুহা থেকে ওঠে আসে সন্তান সন্ততি
নতুন সংকল্প ঘেরা চোখ মুখে আতসবাজি
অন্ত্যমিলে ছন্দ হারা বন্ধ চোখ অন্ধ আরতি
ডিজিটাল পদাতিক উর্ননাভ সূতোর কারসাজি...


রিফিউজি 

পিংকি পুরকায়স্থ চন্দ্রানী 

নাম তার বনময়ূরী,
বাড়ী হাইটেক এপার্টমেন্টের ওপারে।
যেখানে জন্ম নিতে চলেছে,
ভবিষ্যতের এয়ারপোর্ট।
আপাততঃ সেখানে আকাশ,
মিলে মিশে যায় মাটির টানে,
আর চাঁদ ঝুলে থাকে সারাটা রাত,
স্বপ্নের ঝাড় বাতির গন্ধ নিয়ে। 
সকাল বিকেল জানালায় চোখ রেখে দেখতে পাই,
তার সুখের সংসার,
ঘাস জংলার আড়ালে আবডালে,
ছড়ানো ছেটানো তার গুছিয়ে রাখা আসবাব।
এই কিছুকাল আগেই তো মা হোল সে,
কোলে দুটো দুধের সন্তান।
তাদের জন্যে সযত্নে বুনে চলে,
রঙিন পালকের উত্তরীয়।
বৃষ্টি মাখা কোনও এক অবেলায়,
তারা নেচে উঠবে বলে। 
তবু মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে তার বুক,
মনে পড়ে সেই খাণ্ডব দহনের ইতিহাস।
যখন ইশ্বর ও ঈশ্বর-সখা গৃহদাহের পর,
সাজিয়েছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থ নামের সুখের সংসার।
সেই থেকেই তারা ঘর হারায় প্রতিদিন,
রিফিউজি নেমপ্লট বনময়ূরীর দোর গোঁড়ায়।

তোমারই জন্য

অপাংশু দেবনাথ

 হাওয়ায় ওড়ে স্বপ্ন গুঁড়ো,
             বাতাসে প্রাণকপাট
খুলে নামে পুনশ্চ  অন্ধকার।
রাত্রি ছিঁড়ে একা সে আদিম       
                       বাজাই বাঁশী।

এ শরীর জানে যাকে ছলে
         দগ্ধ করেছি এ যাবৎ
কান্না জড়িয়ে বেড়েলকাটা পথে।
শ্বেতকান্না আমাকেই মাটিমুখী করে।
যতোবার কেঁদেছি বেঁচেছি প্রাণে।
কান্নার প্রকৃত সুর জানো তুমি।

জমিন জুড়ে যতো হরিৎ দেখো
তোমরই জন্য, তাতে স্বপ্ন রুয়ে রেখেছি


চরিত্রগত  শব্দসুখ

নীলাদ্রি ভট্টাচার্য 

আধশুকনো মনের দাগ
অধরা জায়গা নিয়ে বসে
আছে ফসল কবিতা।
নিয়মিত উনুন ছোঁয়া ঘামের
ঘনিষ্ট টানাপোড়ন শব্দছাদ
বেয়ে উর্ধ্বে ওঠে।
ভাত ফুটার  প্রহরী  দার্শনিক আওয়াজ
গৃহস্থের মেঘবাহার চোখ,
প্রচ্ছদময় মোড়ে তারা খিদের
করাঘাত মগ্ন  কাব্যভাঁজ।
মানুষের ছায়ায় মানুষ ভিড়ের   দ্বিপ্রহরের দ্বন্দ্ব,
ধীরে ধীরে কবি আঘাতের
নিরাকার রস খুঁজে সৃষ্টিমত্ত মাটির বেহালা।


ভয়

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

মধ্যরাতে ভীতু হাওয়ায়
শাখা মেলে পাল্টে যাওয়া
বিকল্প বাঁধন
আঙুলের সভ্যতায় দীর্ঘ হচ্ছে
নির্দেশ আর বাইসন
গৃহস্থালি প্রজাপতি মেঘের পাঁচালি ভেঙ্গে
তীব্র করে কারসাজি


কবিতা এক জীবন- মিছিল

অভীক কুমার দে


বুকের অতৃপ্ত বাতাস 'আহ্'
নিয়ে আসে দিনের শেষে।
রাতের ধারা মুছে দেয় আলো।
অবুঝ ছায়াপথ ঘোলাস্বপ্নে
আকাশ সাজায়। অথচ বাইরে ভিন্ন শূন্যতার ভিড় এবং
ভেতরে স্বপ্নজাগা ভোর।
এখানেই বাস করে নীরব আর সরব অনুভূতি।
ভেতর:- কবিতা কি শুধুই
উপশমের মনোপারদ ?
বাহির:- বর্ণময় কর্মজীবনের
বর্ণনা, তোমার চারদিকের আমি, আমি আর আমি
যেমন। তুমি যাকে তুমি বলো।
দৃশ্য:- রূপ, রঙ,শব্দ, ছন্দ,
ব্যথা, আনন্দ, ভয়, অশ্রু, সুখ এসব গায়ে মেখে চেনা বকের
ডানায় ছড়িয়ে থাকা আকাশ অথবা তরল নদীর সাগরসুখ।
ভেতর:- যদি প্রতিফলকের
ভাষা না বোঝা যায় ? যদি
উত্তেজক অন্ধ চোখে কিংবা অন্ধ স্নায়ুতে ? দর্শনক্ষুধায়
ঝাঁপিয়ে পড়ে যদি কাল্পনিক সীমানা ?
বাহির:- মানে ?
দৃশ্য:- রাতের বাহারি ভাষা
মতোই গোল্লাছুট, অন্ধকার।
লক্ষ্যবস্তুর অভিমুখে
অনুমানের অনুভব।
ভেতর:- একটি নদী সাগর চেনে,
একটি নদী আকাশ।
জলের তরল গোপন জানে,
শূন্য চেনে বাতাস।
বাহির:- জানি। দৃশ্যেরই
প্রতিফলন রূপকের ভেতর।
দৃশ্য:- তরঙ্গের পর তরঙ্গে
কখনো কান্নার সুর, কখনো
সুখের গুল্ম জাগে।

শব্দ ও নিঃশব্দের ভেতর।
একখণ্ড দ্বীপ। বাইরের বর্ণনায়
মিশে উর্বর জমি। শব্দের শিশু
বড় হয়, আকাশ ছোঁয়।
কবিতা এক জীবন- মিছিল।
কবি তার জমি চেনা শিশু।

সময় 

শতদল আচার্য

আমাদের তেড়ে আসা
যে সময় ।
দশকে দশকে পরীক্ষা
বাস্তুভিটা ,জীবন নিয়ে নতুন নতুন
ফন্দি-ফিকির।

পূর্বপুরুষের ঠিকানা লিখা আছে ,
কালচক্রের ইতিহাসে।
উনিশের পাতা উল্টালে
সারিবদ্ধ বিশ্বাসঘাতক
চেতনার ফুল আর বিষাদের ছাই ।

চলো ,আমরা এভাবেই যাবো
আমাদের ট্রেন থামবে একদিন
এই পথে ।



৩ টি অনুগল্প

আকাশ

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় 

হাতে একখণ্ড 'ছেলাইজ'। বেকা তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। বেকা ভিখারী। যা হোক দিনটা কষ্টেছিষ্টে পার হবে। মংলার চায়ের দোকানের বাইরে একটা টিউবল আছে। টুকরা-টাকরা যেদিন যা জোটে তাই গিলেই সে সেখানে যথেচ্ছ জলযোগ করে। খিদেটা তখন মালুম হয় না। আজ এই  'ছেলাইজ' খেয়েই কেভি স্কুলের গেটের কাছে সিমেন্টের ছাউনিতে পড়ে থাকবে সে। আগে সে নাটমন্দিরে থাকতো। সেখানে কিছুদিন থেকে এক পাগলির আস্তানা। ঘুমোতে দেয় না।
    ছেলাইজ হাতে বসে আছে বেকা। কাছে একটা নেড়ি প্রবল ল্যাজ নাড়ছে ।অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরছে নেড়িটা। পেছনে হারু মণ্ডলের খাল। পানায় ভর্তি প্রায়। সাথে চিপস, কুড়কুড়ের ছেঁড়া প্যাকেট।  মাঝখানটায় একটু ফাঁকা। জল দেখা যায়।
    " কি আচরিত! তোর দেখং একফোঁটাও ধৈজ্জসহ্য।  নাই রে জজসাহেব!"
     নেড়ির দিকে চেয়ে বলে ওঠে বেকা। ওই নামেই সে নেড়িটাকে ডাকে। নেড়িটাও সাড়া দেয় বেশ!
   "তোক না দিয়া মুই কোনোদিন খাং?"
নেড়িটা পূর্ববৎ পাক খেতে থাকে। ল্যাজ নাড়ে অস্থির ভাবে।
   'বইস তো খানেক'
জজসাহেবের বসতে বয়েই গেছে! তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই যেন।
   পুরোপুরি সন্ধে হয়নি এখনো। তবে আকাশচারী পাখিরা একটু যেন চঞ্চল হয়েছে। একটু একটু আঁধার ঘনিয়ে এলে যেমন হয়! শালিখ, ঘরচিরিকা, আর দুটো পাতিকাক। শুধু এইটুকু মাত্র আকাশ বেকার। বেকা আকাশে তাকায়।
    হঠাৎ একটা পাতিকাক কোত্থেকে উড়ে এসে ছোঁ মারে তার ছেলাইজে।বেকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলাইজ ঠোঁটে ধরে খালের ওপর দিয়ে উড়ে যায় কাকটা। কিন্তু ঠোঁটের ছেলাইজ ঠোঁট ফসকে খালে পড়ে যায়। কাকটা উড়ে গিয়ে বসে খালের ওপারে ঝুলে থাকা ফোনের তারে, দোল খায়। টাল সামলাতে না পেরে আবার উড়ে যায়। এবারে কাকটা গিয়ে বসে হারু মণ্ডলের আমের ডালে। আমগাছে সন্ধেরা আগে আসে। গাছের নিচ থেকে ওপর অব্দি তাই এখনই কেমন আবছা অন্ধকার ।
   ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও খুব অবাক হয়নি বেকা। জোরেজোরে হাসতে থাকে সে। হেসে গড়িয়ে পড়ে। এদিকে জজসাহেবের অবস্থা কে দেখে! একবার উপরে তাকিয়ে ভৌ ভৌ করছে তো একবার হেসে গড়িয়ে পড়া বেকার পাছা শুঁকছে।
    এলা! মোর উপর বিশ্বাস না কইল্লে কী ফল হয় বুঝলু রে, কাউয়া! বেশি ছঠফঠ ভাল নোয়ায়! দ্যাখ না, তোর আমও গেইল ছালাও গেইল!
     কিছুতেই আর হাসি থামে না বেকার। কাকটা ক্রমশই ঢাকা পড়ছে অন্ধকারে। সে কিছু শুনেছে কি না বোঝা গেল না।
বেকা উঠে দাঁড়ায়।
কুকুরটার খুব আশাভঙ্গ হয়েছে। ল্যাজে বিপন্নতার হালকা দোল।
    "মুনসিপালের ডাসবিন যাবু রে জজসাহেব? চ..."
বেকা হাঁটা দেয়।

........

নোটিশ




গতরাতটা একত্রিশের ছিল। রাতের বাজিগুলোর খোলটাগুলো এখনো পরে আছে এখানে ওখানে। ভোর হয়েছে সবে। নতুন বছর! ভোরটার নাম  এন আর সি! নীল নীল কুয়াশা মাখা! আকাশেও কী অদ্ভূত কুয়াশার মেঘ! মেঘ শব্দে কালাচানের মনে পড়ল মেঘনা। বাবার মুখে সে শুনেছে মেঘনা পূর্ববঙ্গের একটি নদী। ওই নদীর পারেই নাকি ছিল ভিটে। একসময় পুড়ে যায়! অসমে আসার পরেও তো কতবার পুড়ল! তৃতীয়বার উচ্ছেদ হয়ে যে বার তার বাবা পর্বতঝোরার পাহাড়ে আশ্রয় নেয় তখন সে খুব ছোট। তারপর তো বাবা মারাই গেলেন। মারা যাবার সময় কোনোমতে শুধু এটুকু বললেন--
     কালাচান রে, বাপ হক্কলরে দেহিস! পলাইস না!   
     আমি মনে হয় বাইচ্চা গেলাম! মল্লে তো আর মানষে   
     বাঙালি থাকে না!
বলেই চারিদিকে একবার মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখলেন। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া তরল বেরোলো। তিনি চোখ বুঝলেন।
      মরে তিনি ডেডবডি হলেন প্রথমে। তারপরে হলেন চন্দ্রবিন্দু।
বালিশ নেই, খড়ের বিছানা! তীরের ফলার আগুনে ঝুপড়ির পর ঝুপড়ি পুড়ছে! আর বাবা পালাচ্ছেন আন্ডাবাচ্চা সহ! শহরের হাইওয়েগুলো তখন চিৎকার করছে আলীকুলিবঙালি! আলীকুলিবঙালি! সে মানেই বুঝতো না এসবের! কী করেই বা বুঝবে? সবে তো নয় বছর তখন!
    সবশেষে এই পাহার-জঙ্গল। এখানে বাঘ আছে--দূর থেকে ডাক ভেসে আসে! তবে মানুষরূপী বাঘ খুব একটা নেই!
   অনেকদিন পর একদিন পিওন এলো। কালাচানের ছেলেটি খাম হাতে নিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞাসা করল--এইডার ভিতরে কি লরচর করে গো?
    ইয়ার ভিতিরা বাঘ আছে, বাপই, বাঘ...
পিওন চলে গেল!
    খামের ভিতরে সত্যই বাঘ কি ছিল না!
আজকের ভোরটার নাম এন আর সি। বাবা মৃত্যুশয্যায়  বলেছিলেন " কালাচানরে পলাইস না!
কালাচান পালিয়ে যায়নি। সে পালাবে না।

.......

দেয়ালচিত্র





ছবি কখনো সখনো রক্তমাংসের হয়ে যায়! তবে এই ট্রান্সফরমেশনটার জন্য দরকার একটা নিঝুম শোবার ঘর, সেই ঘরে একটা ঝুলকালিমাখা বন্ধ ঘড়ি, গভীর এক নিশুতি রাত আর ঘুমোনোর ভান করে রাত জেগে শুয়ে থাকা একজোড়া চোখ।
     না ঠিক স্বপ্ন নয়। ঠিক উইশ ফুলফিলমেন্টও বলা যাবে না একে! ব্যাপারটা এতো ফ্রয়েডিয় নয় মোটেই।
     এই যেমন দেখতে পাচ্ছি এখন, এই মুহুর্তে...জীবন্ত হচ্ছে ছবিটা! আমি সূর্যোদয় দেখার মতো তাকিয়ে আছি দেয়ালে। দেয়ালের খানিকটা জায়গায় ছবিটার আবির্ভাব হচ্ছে। স্পন্দন জাগছে ছবিটার গায়ে। দৈর্ঘ প্রস্থে বাড়ছে। জ্বলজ্বল করে উঠছে দুচোখের তারা। তারপরে নাক...শ্বাস...শ্বসন প্রক্রিয়া। গালের ডান পাশের টোল...হাসি। শরীরের বাকি অংশগুলোও আকার নিচ্ছে।
        মেয়েটির নামকরণ করেছি-- ছবি। জানিই তো এ ছবি ক্ষণিকের রক্তমাংস, লালা। আর কিছু নয়। দেওয়ালেই ফিরে যাবে আবার রিভার্স একসনে!
       ছবি আমার দিকে তাঁর মাংসল দু হাত বাড়িয়ে দেয়। সে আমাকে নিছক হাগ নয়, আলিঙ্গন দিতে চায় ! তবে কি ছবি আমার পছন্দ-অপছন্দ জানে! তাই কি পরনে তার সাদামাটা ডুরে কাটা শাড়ি!  প্রসাধনহীন মুখ! লিপস্টিকহীন শুষ্কঠোঁট!
    ছবির শরীর দেখছি--- জীবন্ত। লুকিয়ে নয়, সরাসরি-- আঁড়াল সরে গিয়ে যে দেখা, তেমন। এভাবে সমগ্রতায় কোনোদিন কোনো শরীর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। জীবন্ত শরীর আমাকে ডাকছে। দেয়ালজুড়ে মেঘ, আকাশ... ভাবছি সাড়া দেব। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরব ছবির শরীর।
    ছবিকে জড়িয়ে ধরি, ঠেসে ধরি বুকে। সুডৌল একটা অনুভূতি।  সুরের ওঠানামার মতো। ক্রমশ ডুবে যেতে থাকি।
ছবি হেসে ওঠে খিলখিল করে। কথা বলে ওঠে:

     হায়! যদি প্রেমিক হতে...যদি তুমি শুধু প্রেমিকই   
     থাকতে সেদিন! বিয়েটা তো দেয়ালই ছিল শুধু।     
     সিঁদুরের টিপ যেমন, শেষে দেয়ালই আশ্রয় হয়ে 
     যায়!
ছবি এসব কী বলছে! আমি অবাক চোখে তাকাই ওর দিকে!
      ছবি কি তাহলে সব জানে, মানে জেনে গেছে! সন্দেহ-ভালবাসার ঘাতক হাত কীভাবে এক নিশুতি রাতে বিষ খাইয়ে দেয়ালে গেঁথে দিয়েছিল ওকে!

আড্ডা  করিডোর : সম্পাদনায় সব্যসাচী ঘোষ 

শ্যামলছায়ার আড্ডা /  প্রবীর রায়



জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা মোড় থেকে একটু এগিয়ে গেলেই উকিলপাড়া। বড়্র রাস্তার ওপরেই বড় লোহার গেট খুলে সবুজ রাস্তা ধরেই  শ্যামলছায়ার আড্ডাঘর। দেখতে দেখতে পঁচিশ বছরেরও বেশী হয়ে গেল এই আড্ডার বয়েস। আমার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়েই কেটেছে উত্তর বাংলায়। সে সময় এবং পরে স্থায়ী বাসস্থান শ্যামলছায়া।

আশীর দশকের শেষ দিকে জলপাইগুড়ি শহরের তিনজন সদ্য কৈশোর পার হওয়া ছেলে শুভ্র চট্টোপাধ্যায় নীলাদ্রি বাগচি দেবাশিস কুণ্ডুর সাথে সুযোগ পেলেই আড্ডা হত। তখন ওরা  এরকা নামে একটা কাগজ করত। ওদের সাথে কবিতা ভাবনায় অনেক জায়গাতেই মিলে গেল। শুরু হল সংহত কবিতা আন্দোলন। এরকাকে কেন্দ্র করে শুরু হল আড্ডা। তখন কত নতুন লিখতে আসা কবিরা  আসতো আড্ডায়। তাদের অনেকেই  এখন কবিতা লিখছেনা। কেউকেউ শিল্পের অন্য শাখায় আছে।কোচবিহারে সুবীর সরকার আর আলিপুরদুয়ারের শৌভিক দে সরকারের দেখাও পেতাম মাঝে মাঝে।এরকাকে কেন্দ্র করেই জমে গেল শ্যামলছায়ার আড্ডা।

পরের দিকে ওদের প্রভাবেই খেলাধুলার জগত থেকে কবিতায় চলে এলো অতনু  বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় শ্যামলছায়া থেকে শেষ সংখ্যা বেরিয়ে বন্ধ হয়ে গেল এরকা।অতনুর সম্পাদনায় শ্যামলছায়া থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল এখন বাংলা কবিতার কাগজ। এখনকে কেন্দ্র করে আড্ডার পরিসর আরও বর্ধিত হল।

শুধু জলপাইগুড়ি নয়,পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে,এমনকি বাইরে থেকেও অনেকেই সুযোগ পেয়ে এই আড্ডায় নতুন ভাবনার খোরাক দিয়ে গেছেন। বিশেষ ভাবে মনে পড়ছে উত্তম দাশ অতীন্দ্রিয় পাঠক সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দ ঘোষহাজরা  অজিতেশ ভট্টাচার্য বারীন ঘোষাল স্বপন রায় রঞ্জন মৈত্র প্রনব পাল উমাপদ কর ধীমান চক্রবর্তী প্রবাল বসু কাজল চক্রবর্তী বিশ্বরূপ দে সবকার সন্দ্বীপ দত্ত … আরও কত কবি ও লিটল ম্যাগাজিন করা মানুষজন।

দীর্ঘ সময়ে এ যেন এক অনিবার স্রোত। পুরনো মুখ সরে গিয়ে নতুন মুখ এসেছে। কিছু পুরনো মুখ আবার ফিরে এসেছে কবিতায়। প্রতি রবিবারের আড্ডায় অনেকেই এসেছে  দূর থেকে। মালবাজারের সব্যসাচী ঘোষ ময়নাগুড়ির দুর্জয় দাস  । মেয়েরা ঘর সংসার সামলে প্রতি রবিবারে না পারলেও সুবিধে মত আড্ডায় চলে আসে। অনিন্দিতা গুপ্তরায় জয়শীলা গুহবাগচী  শ্রেয়সী গাঙ্গুলী অর্পিতা বাগচির মত অনেকেই আছে এই তালিকায়।        ১/

এই আড্ডায় নাটক আবৃত্তি ছবি আঁকিয়ে গাইয়ে সবার জন্যই অবারিত দ্বার। শুধু কবিতামনস্ক হলেই হল।এই আড্ডা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে করলাভ্যালী, নীর, অ পূ র কাগজ প্রকাশিত হয়েছে তাও কি কম আনন্দের। এই আড্ডার  ইচ্ছাতেই প্রকাশিত হল জল্প ই পত্রিকা। নতুন লিখতে আসা কয়েকজন শুরু করল।এই পত্রিকা এখন অনেকেরই আগ্রহের বিষয়।

যে আড্ডা স্বাভাবিক ভাবে চলা শুরু করেছিল তার গতিও স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক। প্রতি রবিবারে মত  আগামী প্রতিটি রবিবারও আড্ডায় আমাদের অপেক্ষা থাকবে নতুন কবির জন্য।
                                                                              
খনন করিডোর :সম্পাদনায় সব্যসাচী ঘোষ 



গৌতম গুহরায় , কবিতা ও লিটিল ম্যাগাজিনের উল্লেখযোগ্য নাম । ৮ টি কাব্যগ্রন্থ । আরও ১০ টি নিবন্ধ , অনুবাদ গ্রন্থ । শৈশব থেকেই কবিতায় । সম্পাদিত পত্রিকা দ্যোতনাও বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লিটিল ম্যাগ বলে সমাদৃত । খনন করিডোরের সামনে অনেকটাই দ্বিধাহীন ভাবে খুলে দিলেন বুকের জমি । এরপর আমরা ক্রমশ কবির ভেতরে প্রবেশ করি ,  


প্রশ্ন - আপনি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করেন । কবিতায় এর প্রভাব পড়ে কি ? তাতে কবিতার কি কোন ক্ষতি হয় ?
উত্তর – কেউ রাজনীতির উর্ধে নন । প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে যুক্ত হয়তো সকলে নয় , তবুও তার চিন্তা চেতনায় রাজনীতির মতাদর্শ তৈরি হয় । সেখান থেকেই তার ব্যক্তি রাজনীতির শুরু । নীতিগত ভাবে সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন আমি দেখি , যেখানে শ্রেণি , অর্থ , জাত কোন বৈরিতা তৈরি করবে না। এর প্রভাব তাই আমার লেখায় আছে এবং থাকবেও । 
কবিতায় নিজস্ব এই বিশ্বাসের প্রতিফলন থাকা ভীষণ জরুরি সেখান থেকে সরে আসা মানেই অসততাকে প্রশ্রয় দেওয়া । 

প্রশ্ন – একটা ভিন্ন সময়ে আমরা আছি । কবিতা এই সময়ে কতটা সহায় হতে পারে । 
উত্তর – সভ্যতার ইতিহাস বলে মানুষের যখন অস্তিত্ব বিপন্ন হয় তখন চেতনা যাদের অস্ত্র তারাই অগ্রভাগে থেকে পথ দেখান । কবিতা সেখানে প্রথম সারিতেই । রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখেন লেখক শিল্পীর হাটে তো অস্ত্র নেই , তাদের সৃজন দিয়েই সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে । আমিও মনে করি এই বিপন্নতার সময় সেই দৃপ্ত উচ্চারণ জারি রাখতেই হবে । 
প্রশ্ন – চার দশক কবিতায় রয়েছেন , আজ এখান থেকে পেছন ফিরে তাকালে কিরকম অনুভূতি হয় ? 

উত্তর – কবিতার সঙ্গে আমার যাপন সেই শৈশব থেকে , ১০ বছর বয়সে বসুমতি পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশিত হয় । এরপর প্রায় ৪৪ বছর , অনেক কিছু অতিক্রম করতে হয়েছে , অনেক অভিজ্ঞতা অনেক যন্ত্রণা । আমার কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে আসে লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশের তাড়না । সেও প্রায় চার দশক হল । আজ মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তাকাই এই সব লিটিল ম্যাগাজিন , আমাদের ঘাম রক্ত লেগে থাকা আয়ুধগুলোর দিকে । সেই শৈশব থেকে , তথন আমরা ১৪/১৫ , কি উৎসাহ নিয়ে বুকের চিৎকারগুলোকে একত্রিত করে প্রকাশের যন্ত্রণা থেকে কাগজ করা , নাটক করা , কবিতা লেখা ! আজ ভাঙা সময়ের সামনে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছি , আর দেখছি ৪০ বছর ধরে যত্নে লালিত প্রেম , অপ্রেমগুলোর দিকে । সামনে তাকিয়ে আছে আমাদের অপমানগুলো , আমাদের ঘৃণা , আমাদের অহংকার , আমাদের উল্লাস , আমাদের কান্নারা । তবুও এই আমাদের শক্তিস্থল , আমাদের স্বপ্ন । 
স্বপ্ন আমাদের মান অপমানের মেঘ ভেঙে নামা সহস্রধারার ক্ষুব্ধ জল / স্বপ্ন আমাদের কথা ও না কথার জমাট স্লোগান , আমাদের বাঁচা মরা / আমাদের যাবতীয় ইচ্ছার জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী দিন ও রাত / স্বপ্ন আমাদের বাঁচা ও বাঁচানোর গুমগর্জন । 

প্রশ্ন – অনুবাদকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন । এটা আপনার মেধার সাক্ষ্য বহন করে । সাম্প্রতিক অনুবাদ কাজ বিষয়ে কিছু জানান । 
উত্তর – একজন কবি আসলে একজন বিশ্বনাগরিক । সেখানেই যোগসূত্র তৈরি হয় । সেকারণেই অন্য ভাষার কবিতা পড়া জরুরি। কিশোর বয়সে অরুনেশ ঘোষ র‍্যাবোর “নরকে এক ঋতু” তুলে দেন । লোকনাথ ভট্টাচার্যের সেই অবিস্মরণীয় অনুবাদে তছনছ হয়ে যাই । ফরাসি ভাষা জানতে ফরাসি ভাষার একটি প্রশিক্ষনেও এই তাড়না থেকেই যোগ দিই । র‍্যাবো ছাড়াও সম্প্রতি গুন্টার গ্রাস কে নিয়ে একটি কাজ করেছি । 
প্রশ্ন – কর্পোরেট স্টাইলে কাগজ হচ্ছে , এতে ভাল হবে তো । 
উত্তর – চাকচিক্য বাড়বে , আর্থিক সমৃদ্ধি আসবে কিন্তু কাগজ স্বপ্নহীন হবে , আপোষহীন মনোভাব হারিয়ে যাবে । 
প্রশ্ন – প্রিয় কবি কে ও কেন ?
উত্তর – র‍্যাবো , জীবননান্দ , বিনয় মজুমদার ও শঙ্খ   ঘোষ । সাম্প্রতিক কালে জহর সেনমজুমদার । 
  

     



অন্ধকারে কেবল সর্বনাম

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

শার্সির বাইরে অন্ধকার নামছিলো অল্প অল্প করে। ঘরের ভেতর তখনো একটু আলো রয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসা একটা ঘরে ওরা তিনজন কথা বলছিল। তিনটে শরীর ঘরের তিনদিকের কোণে। সাদা মার্বেলের মেঝেতে বসা। ওরা একে অন্যের দিকে চেয়ে কথা বলছিল, যেমন হয়ে থাকে সচরাচর। বাইরের অন্ধকার যে ক্রমশ ঘন হয়ে, ঘুরপাক খেতে খেতে শার্সি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে আসছে সেদিকে ওদের খেয়াল ছিল না। কথার আলোয় মশগুল ছিল ওরা। ওদের মুখনিঃসৃত শব্দেরা একে অপরের গায়ে লেগে, আলতো ছুঁয়ে, ঠোক্কর খেয়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একটা যাত্রাপথ তৈরী করছিল তিনজনের মধ্যে। প্রথম থেকে দ্বিতীয় জনের মধ্যে। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় জনের মধ্যে। প্রথম থেকে তৃতীয় জনের মধ্যে। আবার দ্বিতীয় থেকে প্রথম জনের মধ্যে। আবার তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় জনের মধ্যে। আবার তৃতীয় থেকে প্রথম জনের মধ্যে। ইত্যাদি। শব্দের এই দ্বিমুখী যাত্রাপথের দৌলতে ওদের তিনজনের মধ্যে একজন থেকে আরেকজন পর্যন্ত আলোর এক রেখাপথ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। ঘনায়মান অন্ধকারের ঘরে কথার আলোর এক ত্রিভুজ। এই ত্রিভুজ ওদের ভুলিয়ে দিচ্ছিলো, বাইরের অন্ধকার জানালার কাঁচ বন্ধ থাকলেও ভেতরে সেঁধিয়ে আসতে পারে। ঘরে একটা টিউবলাইট ছিল বটে কিন্তু কথার আলোয় মশগুল ত্রয়ী মেঝে থেকে উঠে সেটা জ্বালিয়ে উঠতে পারছিল না। ওদের অজান্তেই ঘরটা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ।

ক্রমশ...

তারপর যখন শেষ গামলা অন্ধকার কেউ হঠাৎ করে ঢেলে দিলো ঘরটার ওপর, ওদের টনক নড়লো। ওরা বলাবলি করলো অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা, আলো জ্বালাবার কথা কিন্তু কে আর আড্ডার রণে ভঙ্গ দিতে চায়। আলোর সুইচটা ঘরের চতুর্থ কোণে, যেখানে কেউ নেই। তিনকোণে বসে থাকা তিন বন্ধু হাসাহাসি করলো; বললো, আরেকজনকে দরকার ছিল যে ওই কোণটাতে বসে ত্রিভুজটাকে চতুর্ভুজ বানিয়ে দিতে পারতো। সে সহজেই হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালাতে পারতো। তারজন্য উঠতেও হতো না। তিনবন্ধু যখন এভাবে চতুর্থ বন্ধুর অভাব বোধ করছে, ঘরটা ততক্ষণে জমাট অন্ধকারে ভরে গেছে। ওরা ঠিক করলো অন্ধকারেই কথা বলবে। ঠিক করলো কথার ত্রিকোণী আলোয় ভরসা রাখবে।   

---তাহলে বল, এই যে এক নাগাড়ে বলে গেলাম আমার আর ওর ব্যাপারে। কি মনে হয়, বল দেখি?
---কি আবার মনে হবে, আমি তো বরাবরই জানি তুই আর ও একে অন্যকে ভালোবাসিস।
---ও-টা কে? এখানে তোরা দুজন ছাড়া আমি যে আছি, সেও তো একটা ও।
---নানা, তোর কথা বলছি না। ও ওর সঙ্গে যার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলছিল, তার কথাই বলছি।
---বেশ, তাকে বরং 'সে' বলা যাক, সুবিধা হবে।
--- ডান।
---কিন্তু নাম নেওয়া যাবে না কেন? বুঝতে সমস্যা হবে তো?
---তা হবে, কিন্তু এই খেলার একটা নিয়ম আছে। যতক্ষণ আলো আছে, নাম নেওয়া যায়, কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে কেবল সর্বনাম। ইন দ্য ডার্কনেস, নো প্রপার নেমস! 
---কি গেরো!
--- ব্যাক টু দ্য পয়েন্ট। বেশ, তা নয় বুঝলাম যে আমি আর সে একে অপরকে ভালোই বাসি। বাট হোয়াট আবাউট ও?
--- উফ এই ওটা আবার কে?
---এই ওটা তুই রে, তুই।
---আমি, ওহ আচ্ছা। 
---দ্যাখ, আমার যা মনে হল তুই ওকেও ভালোবাসিস, আর সে-কেও। ওকে তুই বরাবরই ভালোবাসতিস। ও তোর ছোটবেলার বন্ধু। আমারও অনেক আগের বন্ধু। আর সেকেও তুই যবে থেকে সম্পর্কে আছিস তবে থেকে ভালোইবাসিস। সেও বাসে। বাকিটা কম্প্যাটিবিলিটি যেটা একটা কঠিন ব্যাপার। 
--- রাইট, জাস্ট কঠিন কেস । দেয়ার ইজ নো এবিলিটি ইন কম্প্যাটিবিলিটি।
---তাহলে তুই কি বলতে চাইছিস? আমি যে ও, আর ও যে আমি--এই নাম না নেওয়াটা না, জাস্ট ঘেঁটে দিচ্ছে, যাক--মানে আমরা দুজন লিটারালি একসঙ্গে ২৪ ঘন্টা ঘর করিনা বলে এই কম্প্যাটিবিলিটি প্রব্লেমটা আমাদের ক্ষেত্রে হয়না। নাহলে মুড়ি-মুড়কি সব এক! ইজ দ্যাট দ্য ওনলি ডিফারেন্স? 
---ওনলি কিনা জানি না বস, তবে হয়তো ইটস এ মেজর ডিফারেন্স।
---ঘর করাটা অন্য জীব বস। জাস্ট আ ডিফারেন্ট ব্রিড অলটুগেদার।
---তাহলে সমাধান কি?
---সমাধান মানে? আমি কি লাভ গুরু নাকি? তবে একটা কাজ করতে প্যারিস।
---কি?
---হোয়াই ডোন্ট ইউ টু হ্যাভ সেক্স?
--- আমরা?
--- হ্যাঁ।
---হোয়াট?
---আমরা বন্ধু বস?
---সো?
---আর আমি যতটুকু জানি আমি স্ট্রেট।
---কতটুকু জানিস?
---উফ, আই মিন, আমি ছেলেদের সঙ্গে সেক্স করতে চাই...
---তার মানে এই নয় যে মেয়েদের সঙ্গে করতে চাস না। ইউ ক্যান সুইং বোথ ওয়েস।
---আমি তো বরাবরই বলে এসেছি আমি বাই-কিউরিয়াস। ও রাজি না হলে কি করবো বল!

ঠিক এইসময় দরজায় শব্দ হয়। গর্তের ভেতর একটা চাবি ঘরঘর করে একপাক ঘুরে নেয় আর দরজা খুলে ঢোকে ওদের চতুর্থ বন্ধু। 'কি রে তোরা কি অন্ধকার ঘরে ভূত নামাচ্ছিস নাকি'--এই বলে ও ঘরে ঢুকে ঘরের একমাত্র খালি কোণটায় গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দেয়। ত্রিভুজটা আলোর সমুদ্রে ভেসে যায়। ওরা হঠাৎ আলোয় চোখ ছোট ছোট করে ঐ চতুর্থ বন্ধুর দিকে মাথা তুলে তাকায়। ওরা তিনজন বসে। আর চতুর্থ জন দাঁড়িয়ে। ত্রিভুজটা চতুর্ভুজের দিকে যাত্রা করে দুটো আলাদা সারফেস খুঁজে পায়। একটা বসে থাকা সারফেস। আরেকটা দাঁড়িয়ে থাকার। অন্ধকার ঘরটা আলোয় মিলিয়ে যায়।

গাথাশোলোক
সুবীর সরকার

সাঁতার কাটা বা না কাটাটা বড় কথা নয়। সন্তরণশীল এক যাপন নিয়েই তো মানুষের জন্মের পর জন্ম কেটে যায়। ভাবনাস্রোতের বাঁধনহীনতায় টুংটাং দোতারার সুর জটপাকানো স্বপ্নের ভিতর অনেকানেক পাখির ডানাঝাপটের আশ্চর্য দৃশ্যপট হয়ে চোখে ভাসে। তখন আলোহীন সাঁতারহীন এক জীবনযাপনের নেশার টানে ইয়াসীন মাতব্বর উঠে দাঁড়ায়। দীর্ঘ হাই তোলে। শরীরের পেশীসমুহের ভিতর একসময় স্থিতাবস্থা এলে মাতব্বর দীর্ঘ এক হাঁটার জন্য পরিক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কোথা থেকে যেন দোতারার আওয়াজ উঠে আসে। কে বাজাচ্ছে কে জানে! মাতব্বর হাঁটা শুরু করে জোতদারটারির জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল অতিক্রম করে তাকে দ্রুত পৌঁছতে হবে একুশ ঘোড়ার ধনকান্ত জোতদারের বাড়ির খোলানে।
সে কবেকার কথা মাতব্বর জানে না। মাতব্বরের প্রবীণ চোখের তারায় তারায় এখনো কী জীবন্ত সব দৃশ্যপট। তখন চারধারে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। চা-বাগান। রাজবংশী, আদিবাসীদের বসত। গুটিকয় মুসলিম টাড়ি। বাগানবাবু ফরেস্টবাবু। ধনকান্তের বাপ তখন জোতদার। আধিদৈবিক জীবনের বর্ণময় যৌথতা। আর খুব মনে পনে জার্মান সাহেবের কথা। মাতব্বর তখন ছোট। বাবা-দাদার সঙ্গে হাটগঞ্জে ঘুরে বেড়াত। কত কত মানুষ। হাটের পথে ধুলোর ঘুর্ণী। সন্ধে পেরিয়ে অনেক রাতে কতবার বাড়ি ফেরা। গরুর গাড়ির ক্যাঁচর কোঁচর শব্দ। গাড়ির ধুরায় কালিপড়া লণ্ঠনের দুলুনি। ছইয়ের ভিতর থেকে লণ্ঠন আলোর কম্পনরেখায় ভৌতিকতা দেখা যেত। যেন নদীর জলে ধরাছোঁয়ার খেলা। একবার শালকুমারের জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে এসেছিল। গোটা দিন সেই বাঘ দাপিয়ে বেড়িয়েছিল ফালাকাটা শহর। শেষেকোচবিহারের রাজার এক শিকারী ভাই এসে সেই পাগলা বাঘকে মেরে ফেলেছিল। মাতব্বরের এক নানুভাই ইয়াসিনউদ্দিনকে এক চাঁদনীতে শিঙের গুতোয় শুইয়ে ফেলেছিল বাইসন। এত এত স্মৃতির জটে আটকে যেতে যেতে চার কুড়ির মাতব্বর যেন ফের ধাক্কা খায়। পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে কোন এক কুহকের দেশে যেন বারংবার ফিরে আসতে থাকে জার্মান সাহেবের ঘোড়া, বন্দুক ও বাজখাই চুপি। কত কত বাজার হাট নদীর ঘাট ঘাটোয়াল রাখাল বন্ধু মইষাল একোয়া হাতির মাহুত বুধুরাম,হাসতে হাসতে নেমে আসছে মথুরা হাটের খুব ভিতরে। প্রবেশপ্রস্থানের নিয়তিতাড়িত সম্ভাবনায় পাতলাখাওয়া শুটিং ক্যাম্পের হরিণেরা একযোগে নাচের একটা ঘোর তৈরি করতেই একধরনের নতুনতর নাচই যেন বা বিনির্মিত করে তুলতে থাকে। মাতব্বরের হাঁটাটা জারি থাকলেও এক পর্বে দোতারা আর বাজে না।
কালজানি নদীর কাছাড়ে আটকে পড়লে কে তাকে উদ্ধার করবে? নদীর পাড়ের জঙ্গলে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। ডাকে। অথচ ঘাটোয়াল আসে না। বাউদিয়া ঘাটোয়াল ঘাটবাসর ছেড়ে কোন পালার আসরে গেছে বাঁশিয়ালের শাকরেদ সেজে। ঘাটের শূন্যতায় চরাচরবাহী ব্যপ্ততায় লীন হবার সমাধানসূত্র নিয়ে মাতব্বর নেমে পড়ে প্রাক শীতের আশ্বিনা নদীর জলে। পাহাড়ি নদীর শীতলবরফগলা জল তার পায়ের পাতা গোড়ালি উরু ও কোমর স্পর্শ করলেও শরীরময় একাগ্রতায় সে হাটফেরত মানুষের ঘরে ফিরবার শৈশবস্মৃতির ভিতর কেমনধারা ডুবেই যায় যেন আর বাঘের নদী পেরিয়ে এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল পারাপারের সফলতার মতো নদীটা ঠিক সে পেরিয়েই আসে, তারপর শরীরময় হাসির তাড়সে কাঁপতে কাঁপতে নাভির তলদেশ থেকে গান তুলে আনতে থাকে— ‘হালুয়া রে হালুয়া/পাতলাখোয়ার হালুয়া/হালুয়া রে হালুয়া ডোবোরহাটের হালুয়া...’ গানের মত্ততায় গানের উজানস্রোতে টেনে সাজানো ছড়ানো আকাশময় মেঘরোদের পৃথিবী মায়াবন্দর দিয়ে সে যথারীতি পৌঁছেই যায় ঘোড়া জোতদারের বাড়ির অন্দরে। অবশ্য জোতদারী নেই এখন আর। রাজা নেই। জার্মান সাহেব মরে ভূত। কিন্তু জোতদারটাড়ি আছে। রাজারহাট রাজারদিঘী সাহেবপোতা এসকল রয়ে গেছে স্মৃতির শস্যবরণ নকসাদার শাড়ির পাড়ের চিক্কনতার মতো।
মাতব্বর জোতদারবাড়ির জোড়শিমূলের গাছের গোড়ে বসে পড়ে। ক্লান্তি না থাকলেও সে ঘুমিয়ে পড়ে। নিন্দের আলিসায় টোপ পাড়ে। ঘুম ও জাগরণ নিয়ে তার দীর্ঘ দীর্ঘ জীবন কেমনধারা কেটে গেল। পর্ব পর্বান্তরে স্মৃতিচিহ্নিত যাপনবিন্দু দিয়েই সে উজান ভাটির স্বপ্নকাতর জীবন কাটিয়ে দিল। বাইচের নাও বেয়ে তবে কি চলে যাওয়া যায় আর কান্দাকান্দির মেলায়। বাওকুমটা বাতাসের ঘুর্ণীতে আঁতকে উঠে ভয়ার্ত শেয়ালের কান্নায় সচকিত হলেও নতুন নতুন সুর স্বপ্নের ধারাবাহিকে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে চোরাবালিছোঁয়া হাওয়া, ফালাকাটা শহরের আতঙ্কিত বাঘ্য।স্মৃতির দীর্ঘ অভিশাপের ভার বহনের ক্লান্তি শোকের দিনগুলিতে ফিরে যাবার উদগ্র বাসনার মতো কখনো হামলে পড়লেও জীবন চোরকাটা বাবলাবনঝাড়ের আবহমানতায় বহুধাব্যাপ্ত হয়ে উঠতে  থাকে। ইয়াসীন মাতব্বরের চারকুড়ি বৎসর অতিক্রান্ত শরীর সচেতন ভাবেই আরো আরো ঘুমের ভিতর ডুবে যেতে থাকে। ভূগোল ইতিহাসের বহুস্বরের মধ্যে তার ঘুমজড়ানো অস্তিত্ব একসময় মুছে যায়। ঘুম না ভাঙাটাই তখন চিরসত্য। মরণঘোরের মতো স্পষ্টতর ক্রমে। বৃত্তান্তের আরো আরো ক্রমবর্ধমানতায় মাতব্বর স্বয়ং নবীকৃত চিরনতুন বৃত্তান্তের রূপকথা হয়ে বৃত্তান্তকে মান্যতা দিতে গিয়েও বৃত্তান্তের চিরবিষন্নতায় লীন হয়ে যেতে যেতে তীব্র এক ঘুমের বৃত্তের অত্যাশ্চর্যে চিরায়ত কোন বৃত্তান্তই বুঝি তীব্র বাজনার মতো ঢের বাজতে থাকে আর বৃত্তান্তের দিকে তুমুল বৃত্তান্ত হয়ে হেঁটে যেতে থাকে শুভ্র হাঁসের দল।
তবু তো পেরিয়ে আসতে হয় অসংখ্য ঝাড়-জঙ্গল-বাবলাবন-কলার বাগান। গহিন  ছমছমে বৃহৎ কোনও অরণ্যভূমিতে প্রবেশ করবার আগে যেমন আট-দশটা সংক্ষিপ্ত সাঁকোহীন নদী। জীবন ছন্দময় প্রবাহিত হয়।বাইসন হানা দেয়। হাতি মানুষ মারে। অথচ জীবন থেমে থাকে না। শোকপালনের অবকাশই দেয় না। মাঠ প্রান্তরের ভিতর বছরের পর বছর সাহেবদের কবর শুয়ে থাকে। আরও জীর্ণ ও পুরাতন হয় ক্রমে ক্রমে। মকবুল বয়াতির দোতারার ডাং কোন কোন শীত রাতে ওম ও উষ্ণতা ছড়ায়। উষ্ণতর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় শামিল হয় পাখি ডাক, মনশিক্ষার গীত- ‘কচুপাতের পানি যেমন রে/ও জীবন/টলমল টলমল করে...’ বিধ্বস্ত পুরুষ উঠে দাঁড়ায়। তার সর্ব অঙ্গে দৃঢ়তা জমে। আর অন্ধকারেই রাস্তা খুঁজে পায় সে। তখন আঙিনায় নাচগানের আসর। ঢোল-সানাই। আর নজরুল ইসলামের মরমিয়া গান-‘আইসো মোর কালাচান/যাও খায়া যাও বাটার পান...'
জোতদারের ধানের গোলায় আগুন। অথচ উদ্বেগহীন জোতদারের মুখে তখন তেভাগার গল্প। লাল পতাকা, কৃষকজনতা ও বারুদ বন্দুকের গাথাগল্প। গল্পপথে রক্তের দানা ফন্দিফিকির ও সমূহ চক্রান্তকথা। আগুন প্রায় নিভে আসে অথচ গল্প শেষ হতে চায় না। আদতে এক গল্প কিছুদূর গিয়েই নানা প্রশাখায় বিভক্ত। তাই এমন ধারাবাহিকতার মজাদার ফানুষ। এইসব গল্প খুঁটে খাই আমি। আমোদিত হই। আর বাড়ি ফিরবার পথে সন্ধে ও রাত্রির মধ্যপর্বে প্রায়শই বাঁশবাগান পড়ে। বাঁশবনের ভিতর অগণন জোনাকি। মন্দ আলোর নদী। সামন্তরক্তের মতো। লোককথার ঝোলা কাঁধে অপরূপ সব কথোয়াল হেঁটে যান। তাঁরা হেঁটে যেতেই থাকেন। আর ভালোবাসার পাশে সন্ত্রাস-রক্ত-লালসার আগুন। জন্ম ও মরণ লেখে বাজপাখি। শীত আসে। উত্তর বাংলার মাঠে মাঠে কুয়াশা। সাদা বকের দল আসর বসায়। কুয়াশার ভিতর তারা উড়েও যায়। কুয়াশা পাতলা হতে থাকে। রোদ ভাসিয়ে নিয়ে যায় শীতসকাল। রোদ, মানে শীতের রোদ সর্বদাই সংক্রামক। কিঞ্চিত উদাসও করে হয়তো বা। মিনিটে মিনিটে আবার পাল্টে যায় রোদের রঙ ও রেখা। রোদ প্রায়শ টেনে নিয়ে যায় আমাকে নদীর কাছে। নদী কখনো প্রবীণ হয় না জানি। এও জানি নদী থাকলেই নদীচর থাকবে। আর নদীচর মানেই বালির নকশাকাটা সুবিশাল সামিয়ানা। নদীর সাথে মাঝি মাল্লা ডিঙি নৌকো আর সারিগান এসবের আশ্চর্য যোগাযোগ। আবার শীতের নদী অন্যরকম। সে হাওয়া বাতাসের। সরষেখেতের আর তরমুজবাগানের। নদী আমাকে টানে। উসকে দেয়। ঝাউগাছের পৃথিবীতে একা থাকবার কোন কষ্ট থাকে না। চাঁদওভীষণমাত্রায় ডাকে আমাকে। নদীপথে কাহিনী তৈরী হয় কতশত। আর কাহিনী সমূহে মিশে যেতে থাকে লোকগান। লোকবাজনা। নদীকে উপাস্য ভেবে আমাদের উত্তরবাংলায় গান বাঁধা হয়। পুজোর ফুলে ভরে ওঠে নদীগর্ভ। উত্তরবাংলার রাজবংশী মহিলারা দলবদ্ধ হয়ে নাচে। তিস্তা বুড়ির পুজো হয়। বাজে ঢাক আর ঢোল। এই ভাবে অন্ধকার ও আলোয় পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকি আমি। আবেগ টেনে আনে চোখের জল। আবার চোখের জল দিয়ে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক এঁকে রাখি বিকেল। বিকেল প্রসঙ্গে খুব, খুব চলে আসে পুকুরঘাট। নৈঃশব্দ খানিকটা। পুকুরঘাটে কেউ কেউ হারিয়ে ফেলে নাকছাবি। রুপোর বিছে। লণ্ঠনের মৃদুআলোয় শুরু হয় অনুসন্ধান পরব। আবার কুয়াশা নামে। কুয়াশা জড়ানো হাসপাতালের বারান্দায় এলোমেলো আর একা আমি হাঁটি কিঞ্চিত আলগোছে।
অতিরিক্ত মদ্যপানের পর একটা ফাঁকা মাঠ অতিক্রম করি। কখনো কখনো ফাঁকা মাঠে বসেই মদ্য পান করি। আমার কোন নির্দিষ্ট ব্র্যাণ্ড নেই। যা জোটে তাই খাই কেন না আমার কোন অাভিজাত্য নেই। তবে সামান্য ক্রোধ ও অসাধারণ অহংকাররয়েছে।অহংকার পতনের মূল একথা সত্য। তবে আমি নিশ্চিত আমার পতনের কোন সম্ভাবনাই নেই। কেন না আমার অহংকারের শ্রেণীচরিত্র আলাদা। আমার অহংকার পতন শব্দটাকে তাড়া করছে খুব। আমার অহংকার মিলিত হচ্ছে ব্যক্তিত্ব শব্দটির সাথে। অতিরিক্ত মদ্যপানের পর আমি তাই অহংকারি হয়ে উঠি আর অতিক্রম করি ফাঁকা মাঠ। আর মাঠ ধরে রাখে শীত ঋতু। অজস্র পদচিহ্ন। তবে মদ্যপান করাটা সত্যিই ভাল নয়। মদ্যপান আমাদের নষ্ট করে দেয়। যেমন জীবনানন্দকে কারুবাসনা। তবে নষ্ট শব্দটায় আমার তীব্র আপত্তি আছে। জীবনে আসলে কিছুই নষ্ট হয় না। সমগ্র আয়ুপথ জুড়ে কেবল অর্জন আর পাওয়া। তবুও মদ্যপান সমর্থনযোগ্য নয়। যেমন সমর্থন করা যায় না ঘন ঘন আয়নায় মুখ দেখা। এতে আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সুখ কমে যায়। আর সুখ কমে গেলে অসুখ আসে। স্থিতি ও গতি ব্যহত হয়। মদ্যপান করাটা ঠিক নয় তবুও মদ্যপানের জন্য খামারবাড়ির উঠোন বেছে নেওয়াটাই যথাযথ। উঠোন জিনিসটা আমার প্রিয়। দোলাচল কেটে যায়। সবচেয়ে ভাল হয় যদি মদ্যপানের সময় হ্যাজাকবাতি বা সরু সরু মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মোমের আলোয় মাতালদের নাচ আর লোকশিল্পীর মুখচোখ ভীষণই ভাল বা মায়াময় দেখায়। মায়াময় আর মায়ামমতা কিছুতেই এক নয় জেনেও আমাদের কান্নাকাটির শব্দে বিঘ্নিত হয় আমাদের ভোজসভা। মদ্যপান করাটা বাঞ্ছনীয় নয় যদি মদ্যপান আমাদের অন্যায় কাজের দিকে এগিয়ে দেয়,কিংবা সোজাসোজি একটানে খুলে দেয় যাবতীয় মুখোশ।











                                                                       সৌগত বালীর অনুগল্প

কুকুরোনিবাস

তাড়াহুড়োয় ট্রাম বাস ফেরতা লোকটা অবাক দেখতে থাকে ট্রাউজার পরে ধোপ দুরস্ত কুকুরের ভীড়ে উপচে চারদিক । একটা কালসিটে নেড়ি ভাড়া চাইল আর লোকটা হাওড়া ওব্দি কেটে সিটে বসতে গিয়ে দেখলো পাশের সিট থেকে লোম ছড়িয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা করছে প্যাসেঞ্জারটা । লোকটা আর সহ্য করতে পারে না বাস থেকে নেমে আসে । কিন্তু সেখানেও ডগ শো চলছে । লোকটার পাগল পাগল লাগে একি কোনো দুরূহ বিমারি মানুষটা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে সরু গলি ধরে ।লোকটা লক্ষ্য করে ইদানীং গলি ক্রমশ সরু আরো সরু হয়ে গলা টিপে ধরছে অথবা সেখানেও ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ । তখনতো অনেক রাত লোকটা বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছে বুঝতে পারছিল এখুনি আরো আরো মেরুদণ্ড হীন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বেরিয়ে আসবে কেউ আর দেখো দেখো লোমে ভরে উঠছে তোমারও শরীর তুমি পালাও বুঝলে লোকটা পালাতে থাকে ও ভাবতে থাকে একটা ম্যাজিসিয়ান চাই কিম্বা হ্যামলিনের লোকটা।।।


অমিয় বিশ্বাসের প্রবন্ধ 


চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জনম
তারে তোমরা বলবে কি।

ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হল 
এগারো মাসে তিনটি সন্তান
কোনটা করবে ফকিরি। 

ঘর আছে তার দুয়ার নাই
লোক আছে তার বাক্য নাই গো
কে তাহার আহার যোগায়
কে দেয় সন্ধ্যা বাতি। 

লালন ফকির ভেবে বলে
ছেলে মরে মাকে ছুঁলে গো
এই কথার অর্থ নইলে 
তার হবেনা ফকিরি।।
----------
১।অ

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জনম
তোমরা তারে বল কি।

সকালে চার পায়ে হাঁটে
দুপুরে দুই পায়ে হাঁটে
সন্ধ্যেতে হয় তিনটি মাথা
আজব কথা শুনেছি। 

ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হল
এগার মাসে তিনটি সন্তান
কোনটা করবে ফকিরি। 

ঘর আছে তার দুয়ার নাই
মানুষ আছে বাক্য যে নাই
কে জোগায় তার খানাপিনা, 
কে জোগায় সন্ধ্যাবাতি। 

মদন শাহ ফকিরে বলে 
ছেলে মরে মাকে ছুঁলে
এসব কথার অর্থ নইলে
হবেনা তার ফকিরি। 
-----
উপরিউক্ত গানটি বাউলের প্রশ্নোত্তরী দেহতত্ত্ব গানের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাউল গান সন্ধ্যা ভাষায় রচিত যাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন ‘আলো-আঁধারি’ ভাষা, যার একটি বাহ্য অর্থ আছে কিন্তু তার সাঙ্কেতিক পরিভাষা না জানলে প্রকৃত অন্তর্নিহিত অর্থ পাওয়া যায় না। অনেকের মতে কথাটি সন্ধা ভাষা (অভিসন্ধায় ভাষিতম) বা অভিসন্ধি মূলক ভাষা (intentional language) ।  এই ভাষায় লৌকিক প্রবচন, হেঁয়ালী থেকে শুরু করে যোগ-তন্ত্র, বৈষ্ণব-সুফিবাদের তাত্বিক পরিভাষার সচেতন প্রয়োগ দেখা যায়। 
 
বাউল গানের মৌখিক পরম্পরায় অনেক সময় গানের কথার বা পদকর্তার নামের পরিবর্তন দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে একই গান সামান্য পরিবর্তন সহ একাধিক পদকর্তার নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে। কোন কোন ক্ষেত্রে অনামী পদকর্তার গানে নামী পদকর্তার ভনিতা ব্যবহার করে তার প্রামান্যতা সিদ্ধ করা হয়। চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে গানটি বিখ্যাত লোকশিল্পী গোষ্ঠগোপাল দাস তাঁর ক্যাসেট রেকর্ডে লালন ফকিরের ভণিতা দিয়ে গেয়েছেন। কিন্তু বর্তমানের কোন গবেষকের গ্রন্থে গানটি লালন ফকিরের পদ হিসেবে স্থান পায়নি। অন্যান্য গবেষণা গ্রন্থে ও বিভিন্ন বাউল তত্ব শিল্পীদের মতে গানটি মদন শাহ ফকিরের রচিত। উত্তর বঙ্গের প্রখ্যাত বাউল তাত্বিক শিল্পী তরনী সেন মহন্ত গানটিকে মদন শাহ ফকিরের পদ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং এর উত্তর পদ রচনা করেছেন।  
 
বাউল গানের অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যেও বহুত্ব লক্ষ্য করা যায়। একই গান সাধনার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। বাউলের ভাষায় ‘ একটি কথার চারটি অর্থ/ স্থুল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ’। 
চাঁদ বা চন্দ্র বাউল গানে একটি বহুল্প্রচলিত সাঙ্কেতিক শব্দ যা একাধিক অর্থ বহন করে। তন্ত্রে চন্দ্রের একটি অর্থ মন। আবার হঠযোগে চন্দ্র-সূরয দেহের ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ী। বাউল গানে, লৌকিক তন্ত্রে চার চন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায় যথা কামচন্দ্র, ভাবচন্দ্র, জ্ঞান চন্দ্র ও ধ্যান চন্দ্র বা গরল, উন্মাদ, রোহিনী ও মান চন্দ্র। সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রের কথাও বাউল গানে ঘুরে ফিরে এসেছে। অনেকের মতে চার চাঁদ হল মানব দেহ নির্গত মল, মূত্র, রজ, বীজ আবার কারো মতে বৌদ্ধ তন্ত্রের চারটি চক্র যা মানবদেহে ধারণা করা হয়।  গানটির মূল বিষয় মানব দেহ ও সৃষ্টি তত্ব। তাই অনুমান করা যায় ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে অর্থে রজ-বীজের( ডিম্বানু-শুক্রানু) বা নারী-পুরুষের মিলনকে নির্দেশ করা হয়েছে। ঝি বা কন্যা রজবতী হলে তার মাতৃত্বের সূচনা ঘটে (‘ঝি কে মা যায় না বলা / না হলে তার রজস্বলা’- বাউল তরনী সেন মহান্ত)।   
তন্ত্র মতে গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাসে জীবের দেহে ষড় রিপুর প্রবেশ ঘটে, নবম মাসে নব দ্বার যুক্ত হয়। একাদশতম মাসে জন্মের পূরবে মন বুদ্ধি ও অহংকার এই তিন সন্তানের জন্ম। ভাব, ভক্তি ও বৈরাগ্য মনের ধর্ম তাই মনই ফকিরি করে। 
জীব গর্ভে থাকাকালীন মাতৃনাড়ীর মাধ্যমে আহার করে, তখন প্রাণ থাকলেও তার প্রকাশ নেই। 
শৈশবে মানুষ হামাগুড়ি দেয় বা চার পায়ে হাঁটে, যৌবনে দুই পায়ে দাঁড়ায় আবার বৃদ্ধাবস্থায় তার মাথা দুই হাঁটুর কাছে নেমে আসে।
 সকল রজোবতী নারীই মা আর পুরুষ মাত্রেই পুত্র। হঠযোগ অনুসারে বিন্দু পতনং মরণম/ বিন্দু ধারণং জীবনম। তাই রমণ কালে বিন্দু বা শুক্রের পতনকে ছেলের মৃত্যু বলা হয়েছে। 

 
২। (ক)
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না
ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাব না
না না না ছেড়ে দিব না। 

ভুবনমোহন গোরা, মনীজনার মনহরা
রাধার প্রেমে মাতুয়ারা  
ধুলায় যায় গড়াগড়ি। 
যেতে চাইলে যেতে দেব না
না না না ছেড়ে দেব না। 

যাব ব্রজের কুলে কুলে আমরা মাখব পায়ে রাঙা ধুলি
চলে গেলে যেতে দেব না’না যেতে দেব না। 

যে ডাকে চাঁদ গৌর বলে ভয় কি গো তার ব্রজের কুলে 
দ্বিজ ভূষণ চাঁদে বলে চরণ ছেড়ে দেব না। 
-----
২।(খ)

তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না
ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর পাব না। 
যাব ব্রজের কুলে কুলে মাখব ব্রজের পদধুলি
জয় রাধা নামে পাগল হয়ে রইব মগনা। 
ভুবনমোহন গোরা গোপী/মনীজনার মনহরা
আমি নয়নে নয়ন দিয়ে আরতো ফিরব না
কত লক্ষ জনম ভ্রমন করে সাধের মানবজনম পেয়েছিরে
দ্বিজদাসের এই ভাবনা মানব জনম আর হবেনা
আমি ভজলে হরি বংশিধারী নিদয় হোয়ো না। 

পশ্চিম বাংলার বাউল গানের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হৃদ মাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেব না’। বহু গ্রামীন বাউল শিল্পী থেকে শুরু করে শহুরে লোকশিল্পী ও ব্যান্ড এই গানটিকে বিভিন্ন ভাবে ও যন্ত্রানুসঙ্গে পরিবেশন করেছেন। 
মৌখিক ঐতিহ্যের বাউল গানে একই পদ সামান্য পরিবর্তন সহ একাধিক পদকর্তার নামে প্রচলিত হতে দেখা যায়, এই গানটিও তার ব্যতিক্রম নয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন রেকর্ডিংয়ে গানটির পদকর্তা হিসেবে দ্বিজ ভূষণ চাঁদ এর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্ণদাস বাউলের রেকর্ডিংএ গানটির কোন ভণিতা নেই।  আবার পুরনো রেকর্ডিং-এ দ্বিজদাসের ভনিতায় এবং দ্বিজদাসের গানের সংকলনে গানটি পাওয়া যায়। 
শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণের আগের নাম গৌরাঙ্গ বা সংক্ষেপে গৌর। বাংলার বৈষ্ণব ও বাউলদের কাছে তিনি রাধা-কৃষ্ণের যুগল অবতার। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ রাধাপ্রেম আস্বাদন করতে পারেননি তাই কলি যুগে সেই অভিপ্রায়ে তিনি গৌরাঙ্গ অবতার হলেন। তিনি বহিরঙ্গে রাধা, অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ। তাই গৌর ভজনাই একাধারে রাধা কৃষ্ণ যুগল ভজন। 
কৃষ্ণ যেমন ব্রজ ছেড়ে মথুরায় গেছিলেন আর ফিরে আসেননি রাধা ও অন্যান্য গোপীদের কাছে, তেমনি চৈতন্যও বাংলা ছেড়ে নীলাচলে চলে গেলেন এবং সেখানেই অন্তর্হিত হলেন। কৃষ্ণের প্রতি রাধা ও অন্যান্য গোপীদের যে বিরহ ও প্রেম গৌরের প্রতি নদীয়াবাসীর সেই একই ভাব যা নদীয়া-নাগরী ভাব নামে পরিচিত। 
বর্তমান পন্থী সহজিয়া বাউলদের কাছে গৌর নিত্য বর্তমান, তার স্থান হৃদয়ে। বহু লক্ষ জন্মের পর পাওয়া যায় এই মানব জন্ম। এই মানব জন্মেই গৌর প্রেম আস্বাদন করতে হয়, তাই মানব জন্ম অমূল্য। শ্রীকৃষ্ণ যেমন রাধা প্রেম আস্বাদন করার জন্য গৌর রূপে জন্ম গ্রহন করলেন তেমনি গৌর প্রেম আস্বাদন করার জন্য বাউল নিজেই গৌর ভাব ধরে রাধা নামে বিভোর হয়ে ব্রজের পথে হাঁটতে চায়। 

ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে
ফাঁদ বসাইছে ফান্দি রে ভাই পুঁটি মাছো দিয়া
ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে।
ফান্দে পড়িয়া বগা করে টানাটুনা
ওরে আহারে কুংকুরার সুতা হল লোহার গুনা রে।
ফান্দে পড়িয়া বগা করে হায় রে হায়
ওরে আহারে দারুণ বিধি সাথী ছাইড়া যায় রে।
উড়িয়া যায় চখুয়ার পঙ্খী বগীক বলে ঠারে
তোমার বগা বন্দী হইছে ধল্লা নদীর পারে রে।
এই কথা শুনিয়া বগী দুই পাখা মেলিল
ওরে ধল্লা নদীর পাড়ে যাইয়া দরশন দিল রে।
বগাক দেখিয়া বগী কান্দে রে
বগীক দেখিয়া বগা কান্দে রে। 

কুচবিহার অঞ্চলের এই গানটি একটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গান ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া ও ধুবরি জেলা, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, কিছু অংশে উত্তর দিনাজপুর ও দার্জিলিং জেলা এবং বাংলাদেশের দিনাজপুর ও রংপুর জেলার অন্যতম প্রধান লোকসঙ্গীত।
লোকশিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমেদের কন্ঠে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ভাওয়াইয়া গানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পিরিতি এবং বিরহ-বিচ্ছেদ অন্যতম প্রধান বিষয়। ধীর বা মধ্য লয়ে এই ধরনের গান মূলত দরিয়া অঙ্গের চিন্তন ও গড়ান পরযায়ের মধ্যে পরে। দোতারায় বাজে দরিয়া ডাং বা দরিয়া-কারফা।  
ভাওয়াইয়া গানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, তোর্সা, খিরল, করতোয়া, মানসী, ধারালা বা ধল্লা, কালজানি, রায়ডাক, মহানন্দা প্রভৃতি অসংখ্য নদী। অতীতে তরাইয়ের এই নদীগুলিতে ফাঁদ পেতে শিকার করত ফান্দি জনজাতির মানুষেরা। তাই সহজেই গানের রুপক হিসেবে এসেছে আঞ্চলিক নদী ও মানুষের কথা। বগা-বগীর কাহিনীর রূপকে মানব-মানবীর প্রেম ও বিচ্ছেদ, ফান্দি ও পুঁটিমাছের রূপকে সমাজের বিভিন্ন  অনুশাসন ও প্রলোভনকে এই গানের মাধ্যমে চিত্রিত করা হয়ছে।  
  
আজি গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে 
হস্তির নড়াং হস্তির চড়াং কাকোয়া বাঁশের আড়া
ওরে কি সাপে দংশিলক বন্ধুয়া বন্ধুয়া পা হল মোর খোঁড়া রে।
রোজায় ঝাড়ে গুণীকের ঝাড়ে দেখিয়ার আগল দিয়া। 
ওরে মুই নারীটা ঝাড়ং বন্ধুয়া কেশের আগাল দিয়া রে। 
খাটো-খুটো মাহুতরে তোর মুখে চাপ দাড়ি
 আরে ও সত্যি কইরা বল রে মাহুত কোন বা দেশে বাড়ি
হস্তির নড়াঁই হস্তির চড়াঁই হস্তির পায়ে বেড়ি  
আমি সত্য কইরা কইলাম নারী গৌরিপুরে বাড়ি
হস্তির নড়ান হস্তির চড়ান হস্তির পায়ে বেড়ি
আরে সত্য কইরা কনরে মাহুত ঘরে কয়জন নারী রে।
হস্তির নড়ান হস্তির চড়ান হস্তির পায়ে বেড়ি
আমি সত্য কইরা কইলং কন্যা বিয়া নাহি করি রে।। 
 

উপরিউক্ত গানটি আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের গান যা গোয়ালপাড়িয়া ভাওয়াইয়া গান নামে পরিচিত। লোকশিল্পী প্রতিমা বড়ূয়ার কন্ঠে গানটির প্রথম রেকর্ডিং প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে বহু শিল্পী গানটি বিভিন্ন ভাবে পরিবেশন করেছেন।  
ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছে আঞ্চলিক প্রকৃতি ও গাড়িয়াল, মাহুত, ফান্দি, মহিষাল প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন। 
মাহুতের কাজ জঙ্গল থেকে ফাঁদ পেতে হাতি ধরা, পোষ মানানো আর মানুষের কাজে তাকে চালনা করা। তাই তার জীবন বিপদসঙ্কুল। মাহুতের কাজে তাকে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হয়। তাই একবার চলে গেলে তার ফেরার আশা কম।  
ভিনদেশি মাহুতের সাথে কন্যার এই অসামাজিক প্রেম যেন অজানা সাপের দংশনের রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। মাহুতের সাথে কন্যার কথোপকথনের মাধ্যমে গ্রাম্য তরুনীর তরুণ মাহুতের প্রতি মোহ, প্রেম, সংশয় গানটির মূল ভাববস্তু। 

কিছু  ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি 
-------------------------------------------------------------------
প্রিয় [সম্পাদক + পাঠক] সমীপেষু,

আজ সকালে ~ মা যখন 'ব্যক্তিগত জরায়ু থেকে' পড়ছিলেন, তখন একটা কথা শেয়ার করেছিলাম।শিল্প এক বিশেষ যাপন থেকে আসে।সেই যাপন সৎ হলে, শিল্পের গুনগত প্রকৃতিও সৎ হয়।অর্থাৎ সদর্থক ও সৎ চিন্তনই সঠিক রাস্তা বা মার্গ দর্শন করায়।কিন্তু এই সৎ বা সততা বিষয়টি কিরকম?তার পরিধি-র রেখাচিত্রটিও কিরকম? তা কি খুব জটিল?না কি সরল একটি সমীকরণের প্রক্রিয়া বিশেষ?যেখানে 'x' ফ্যাক্টর অনুধাবন করতে পারলে, যেরকম খুশী সমাধান সম্ভব।এ সবই যেন ভিন্নভিন্ন বলয়-উপবলয়ে ঘুরছে।অতএব এই প্রশ্নগুলির উত্তরগুলোও স্থান-কাল-পাত্রভেদে হয়তো একেক রকম হতেও পারে ~ ভিন্নভিন্ন বলয়-উপবলয়ের শ্রেণীগত গঠন সম্পর্কিত।তবে মোদ্দা কথাটি হলো যা আত্ম-আবিষ্কারের সপক্ষে, তার দ্বারা কিন্তু সঠিক মনন-টিও দিশা পায়।আর মন থেকেই কিন্তু মানবিক & আত্মা থেকেই আত্ম।এখন আত্ম-আবিষ্কার এতো জরুরী কেন?বামপন্থি মতে একটি সুন্দর কথা আছে।যখন মত ও পথ নিয়ে দ্বিধা ~ তখনই প্রয়োজন আত্ম-সমালোচনা।ধর্মীয় জায়গায় এখানেই আসে কনফেস্ বা স্বীকারোক্তি।গুরুবাদ বলে ঈশ্বরের কাছে।দর্শন বলে আত্মার কাছে।আমরা কোনটা নেবো ~ সম্পূর্ণ আত্ম-অভিরুচি।জানতে ইচ্ছে হয় : দ্রৌপদী-র বস্ত্রহরণ সকলের সমক্ষে হয়েছিল, প্রকাশ্য রাজসভায়।কেউ কি করেছিল আত্ম-সমালোচনা?হয়তো করেছিল।তাও এই গূঢ় প্রশ্নটি থেমে থাকে না।আত্ম-সমালোচনার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলেও, তা কি সঠিকভাবেই হয়েছিল বা বলা ভালো প্রক্রিয়াগত অনুশীলনে তা কি সঠিক ছিল? 
:
কেউ বলতেই পারেন ~ হঠাৎ সাহিত্য ছেড়ে এসব প্রসঙ্গ কেন?কিন্তু সাহিত্য কি যাপনের বাইরে থেকে সত্য এবং নিশ্চিত?তার ভেতরে কি কোনো অন্তর্বর্তী অবস্থান নেই?শুধুই কি ভেবে নেওয়া অহেতুক আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু?না কি কানপাতলা কিছু কথায় অহেতুক উদ্বেল আবেগ?আজ যা ঘটছে, ক্রমাগত ভাবে ঘটছে, যেভাবে ঘটছে : তাকে এড়িয়ে যেতে পারছি না।কিন্তু কেন?কেন বারবার প্রয়োজনীয় প্রসববেদনা ঘটাচ্ছে আত্মার বার্তা।কেন মস্তিষ্ক সমস্ত নেশা, সমস্ত ঘোর কাটিয়ে বারংবার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে ~ সেই শুদ্ধ জ্যোতির মুখোমুখি? 
:
এর উত্তরে বলি ~ কোনো রকম লবিবাজি না করে কিছু অগ্রজ পত্রিকা বহু তরুণ কবিদের এগিয়ে দিয়েছে অতীতে।বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেয় তারা এই কাজ এখনো করছে।আর তা তারা করছেন ~ বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা ভাষার প্রতি দায়বদ্ধ হয়েই।সাহিত্যের এই তরুণদের ভিতর আমিও একজন।হয়তো কোনো লেখা কবিতা নাই হতে পারে, কিন্তু সেটা যে কবিতা নয় হিজিবিজি (যারা হিজিবিজি নামের সাথে পরিচিত, তাদের জন্য আরো বললাম), তা ঠিক করবে কে ~ আমি?তাহলে কি আমিই শেষ কথা?
এই প্রশ্ন অনেকেই বলবেন আত্ম-অহংকার, কিন্তু আমি তা বলি না।কারণ, প্রকৃত যাপনে (বলা উচিৎ প্রকৃত শিল্পবোধ যাপন) আমার সময়ের কাছে ~ আমার চিন্তনই শেষ কথা।সময় পাল্টাবে ~ বোধ পাল্টাবে ~ চিন্তন পাল্টাবে : এটাই ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি।বিজ্ঞান সময়কে ব্যাখ্যা করে একটা বলয়ের মতোই, বলয়ের কেন্দ্রে আছে ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্গত প্রতিটা অংশ / প্রতিটা ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র তরঙ্গ।সুতরাং আমরাও বা এর বাইরে কেন?আমার সময় ~ আমার আত্ম-অবস্থান, আপনার সময় ~ আপনার আত্ম-অবস্থান।মজার কথা, এটা প্রমাণিত যে প্রত্যেকটি সময়-বলয় কিন্তু স্বতন্ত্র, কখনোই পরস্পর বিরোধী নয়।কিন্তু এখানেই সেই জায়গা ~ এই চিন্তন কিসের জন্য?যখন নিজেরাই সময়ের পরিচর্যা ছেড়ে প্রত্যেকে প্রত্যেকের পরস্পর বিরোধীতায় দিনের মুহূর্তগুলোর অলস ব্যায় করায় মত্ত।চিন্তন & [চিন্তন + যাপন] যদি সৎ হয়, তা হবে আত্মার খোঁজ।তা যদি, আরেকজনের সময় ও সময়যাপন-কে আঘাত করে, কোথায় সেই সততা।
:
এই সময়পর্বে, অনেকেই বলছেন দুর্বোধ্য / অনেকেই বলছেন কোষ্ঠ-কাঠিন্য লেখা, পাঠককে পাঠ বিমুখ করে তুলছেন / আবার অনেকেই বলছেন নির্বোধ শব্দের জাগলারি।তাদের কাছে প্রশ্ন : আমরা কি পাঠকের সময়পর্বকে চিহ্নিত করে, তাকে বলতে পারছি ~ আপনি কোন সময়পর্বে রয়েছেন?যেখানে কম্পিউটার শুধু '০' এবং '১' ছাড়া কিছু বোঝে না, সেখানে আমরা যে কোনো কাজে / যে কোনো ভাষায় কম্পিউটারের সাহায্য নেবো, প্রযুক্তিকে চাইবো ~ আর শিল্পবোধে সেই প্রযুক্তির কথা বললেই বলবো, সাধারন পাঠকের সময়ের অভাব।একটি গ্রুপে বলেছিলাম ~ '০' লিখলে বা আঁকলে পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় তা 'শূন্য' বা 'জিরো' বোঝায়।তাহলে নূন্যতম স্থান ব্যবহার করে, এক কথায় '০' না লিখে কেনো লিখবো 'শ+ঊ+ন+য্' বা 'জ+ই+র+ও'।আরেকটি জায়গায় লিখলাম '♨' অর্থাৎ লিখলাম না 'দাউদাউ করে জ্বলছে লেলিহান অগ্নিশিখা' বা 'দ+আ+উ+দ+আ+উ, ক+র+এ, জ্+ব+ল+ছ+এ, ল+এ+ল+ই+হ+আ+ন, অ+গ্+ন+ই+শ+ই+খ+আ'।কেন বারবার ভূল? ~ এটা ন্যানোপ্রযুক্তির যুগ।আর সৌমিত্র রায় বা তারকনাথ দলুই বা রাহুল গাঙ্গুলী যা লিখছে ~ তা অন্য কেউ লিখলেই কপিপেস্ট শুধু নয়, দুর্বোধ্য এবং জোর করে লেখা।কেন এটা বোঝা যাচ্ছে না, যে স্বতন্ত্র পরিকল্পনা থাকলে কপিপেস্ট নয়, হওয়া সম্ভব নয়।কিছুদিন আগে শ্রদ্ধেয় প্রয়াত বারীন ঘোষাল একটি তথ্যচিত্রে বলছেন : যদি আধূনীক লিখতে হয়, মনে-প্রাণে-শরীরে-যাপনে তাকে আধূনীক হতে হবে।যদি, অধূনান্তিক লিখতে হয় ~ মনে-প্রাণে-শরীরে-যাপনে তাকে অধূনান্তিক হতে হবে।যদি নতুন কবিতা লিখতে হয়, মনে-প্রাণে-শরীরে-যাপনে তাকে নতুন হতে হবে।তেমনিই তথ্যপ্রযুক্তি সময় মনে করলে, তাকে লিখতে হলে মনে-প্রাণে-শরীরে-যাপনে তাকে তথ্যপ্রযুক্তি সময়যাপনে বিশ্বাস করতে হবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?কেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, এই যাপন একটা পথ।একটা অনুসরণ, যেখানে প্রকৃত স্বতন্ত্রতা না থাকলে চলা সম্ভব নয়।এখানে ~ সৌমিত্র রায়, তারকনাথ দলুই বা রাহুল গাঙ্গুলী বা অন্য যে কেউ, প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে পথ চলছে।
:
সম্প্রতি একটি এরকমই তরুনদের সুযোগ দেওয়া পত্রিকার হোয়াটস্ আপ গ্রুপে এক তরুণ কবির লেখায় বলা হলো ~ কবিতা সে লেখে না, লিখে দেয় রাহুল গাঙ্গুলী।যেহেতু সে রাহুল গাঙ্গুলীর কবিতা যাপনকে অনুসরণ করার চেস্টা করে ~ এই অপমান উভয়পক্ষেরই।আবার, লেখা থেকে কথা প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত আক্রমণ এতোটাই চালানো হলো, ভেঙে দেওয়া হলো তার উৎসাহ এবং আন্তরিকতা।এবং করা হলো এতোটাই সাংঘাতিকভাবে, যে সে আর লিখতে চাইছে না : ঘেন্নায় এবং অভিমানে।এই দায় আমারই ~ যেহেতু আমিই তাকে এনেছিলাম এখানে বা অতীতেও বহু-কে এনেছিলাম, তারা বেশ কিছু কারণে ছেড়ে গেছে বা কেউ এখনো আছে।
হ্যাঁ বহু তরুণ কবিবন্ধুকে চেস্টা করেছি নানান্ ভাবে সাহায্য করতে, কোনোরকম স্বার্থপর পাওনা ব্যতিরেকে।তাতে কি তার অস্তিত্ব কিছু কম হয়ে গেছে?তার সময় ~ তার শিল্প ~ তার উপলব্ধি ~ তার অনুভূতি ~ তার চিন্তন : সে তো তারই একান্ত, আমার নয়।আমরা কি বলি "কবিগুরুর লেখা অনেক গানের সুর ~ বিদেশি লোকসঙ্গীত থেকে নেওয়া।অথবা কবিগুরুর সুর যখন বিখ্যাত সুরকার কোনো ভিন্ন ভাষার ছায়াছবিতে হুবুহু প্রয়োগ করেন", এ সবই কপিপেস্ট???
আর ব্যক্তিগত আক্রমণ? যখনই আমাদের কাছে সঠিক প্রত্যাত্তুর নেই, বলা ভালো তার উত্তরটি যখন দেখছি ~ সঠিক এবং সৎ, তখনই দাঁতনখ বার করে তাকে আক্রমণ করা অথবা সেই আক্রমণটিকে প্রশ্রয় দেওয়া।
:
কি হবে এই অসৎ কবিতা চর্চা করে ~ যেখানে শুধু নাম আছে, স্মৃতি নেই।একথা কি তাহলে ভুলে যাব, কাজের উদ্দেশ্য সঠিক হলে, আজ না হোক কাল ~ সেই কাজের সময়বলয়টি সর্বজনগৃহীত হবে।না হলে, কেন প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত কবিদের আমরা স্মৃতি থেকে স্মৃতিতে সঞ্চার করি, ভিন্ন সময়বলয়ে থাকা পাঠকের ভিতর সঞ্চার করাই ~ তাকে এক সময়পর্ব থেকে আরেক সময়পর্বে উত্তরণের দরজাটি দেখিয়ে দিই।পত্রিকা একদিন কালের নিয়মে গতিপথ হয়তো পরিবর্তন করবে।কিন্তু আমার মতো অনেকেই মনে রেখে দেবে সেইসব কবিতার সংকলন, যা বাংলা কবিতার গতিপথ বদলে দিতে পেরেছিল।মনে রাখা থাকবে সেই হিজিবিজি, যার কনসেপ্ট নিয়েছিল এয়ারটেলের মতো কর্পোরেট সংস্থারা।তাহলে কেন আজ বিভিন্ন জায়গাগুলি কিছু সময়ের জন্য হয়ে উঠছে কৌরব রাজসভা? কেন আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ~ শুধুমাত্র বিশৃঙ্খলতা দিয়ে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ?
অতীতে আমাদের ভিতর বহু মননশীল আলোচনা হয়েছে।অংশগ্রহণ করেছি সবাই।বিতর্ক হয়েছে, তর্ক হয়েছে ~ তারপরেও তা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয়েছে (আমার টাইমলাইনে দুটি যেমন উদাহরণ আছে)।তা ছিল তথ্যে সমৃদ্ধ, মেধায় সমৃদ্ধ, সৎ উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ।আর আজ ~ কোথায় সেইসব?যারা ভাবেন উপলব্ধিহীন প্রচুর পরিমাণে নীরস পাঠ করে শুধুমাত্র তাথ্যিক হয়ে থাকবেন ~ খুব করুণা হয়।কারণ, উপলব্ধি হলো ~ সেই পথ ও দিশার অভিমুখ অনুসন্ধান।আর পাঠ হলো সেই বহিরাগত সহায়তা, যার সাহায্যে আমরা পথ অতিক্রমণ করবো দ্রুত (যেমন, গরুর গাড়ি, মোটরগাড়ি, জাহাজ, এরোপ্লেন, ইত্যাদি)।অতএব আর যাই হোক, পরিকল্পনাহীন বা উপলব্ধিহীন বা অনুভূতিহীন শক্তিক্ষয়ে থাকা ক্ষতিকর ছাড়া আর কিছু দিতে পারবে না বলেই আত্মবার্তা।তাই এই প্রকার নিরথর্ক কবিতা চর্চায় আর থাকতে চাইনা।কারণ, যে হাত চারাগাছকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করে, সেই কচি চারাগাছটির উপর আঘাত মানে ~ তার সাথে জুড়ে থাকা প্রকৃতির সেই হাতটিকেও আঘাত করা।আর যতোদিন না আত্ম-সমালোচনা পর্ব শুরু হবে ~ এই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলিও ঘটবে।সুতরাং নিজের আত্ম-সমালোচনাই হোক আত্ম-প্রতিবাদ।আর তাই ছেড়ে যেতে চাই সেইসব বন্ধুদের।আসলে এই প্রক্রিয়াটি বড়ো জরুরী, কারণ বারংবার বাংলা সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কতিপয় ব্রুটাসের জন্যই।আর এটা ভুলে গেলে চলবে না, আগামী পৃথিবীতে আত্ম-অবস্থান যতো ছোটো হচ্ছে, প্রকৃতির অন্তর্বস্থানের স্পেস আরো বাড়ছে।হয়তো একদিন, সমস্ত অবস্থান মিলেমিশে এক হয়ে যাবে।অতএব, বন্ধ হোক সাহিত্যের ভিতর রাজনীতি, বন্ধ হোক অহেতুক ধ্বংসের প্ররোচনা।শুদ্ধ ও স্বচ্ছ হয়ে উঠুক আত্মবার্তা।সকলে ভালো থাকবেন, সৎ প্রচেষ্টায় থাকবেন।শান্তি।উপরের কথাগুলি আরো একবার কয়েক লাইনে
:
[কবিতারা পেরোতে চায় আগাম চৌকাঠ
যারা বারুদ নিয়ে বাঁচে
পোড়া ছাই নাভির চেয়েও দামী
বাতাসে ভাসমান পালক।কখনো পালকেও_____

ইতি : রাহুল গঙ্গোপাধ্যায় 


মাতব্বর বৃত্তান্ত --- এক মিথকথার দেশ
                 বিপ্লব সরকার


"অনেক রোদের বিস্তারিতের ভিতর আদ্যন্ত ডুবে থাকতে থাকতে নদীপ্রান্তরের পাথারবাড়ির নকশিবিষাদটুকু সারাজীবন ধরতে গিয়েও শেষাবধি অধরাই থেকে যায়।" কবি ও গদ্যকার সুবীর সরকারের সাম্প্রতিকতম গদ্যের বই "মাতব্বর-বৃত্তান্ত" পড়ে ওঠার পর মনে হল গদ্যকারের এই উদ্ধৃতাংশটিই "মাতব্বর-বৃত্তান্ত"কে যথার্থ বর্ণনা করতে পারে। আসলে বইটি গদ্যকারের নিজস্ব চারণভূমি অর্থাৎ উত্তরের হাওয়া-বাতাস, নর-নারী, গাছ-গাছালির রূপকময় বর্ণনা। যার মধ্যে মিশে আছে উত্তরের প্রাণের গান, ভাওয়াইয়া গানের মিথকথা। গানের ভিতর লুকিয়ে থাকা জীবন কিংবা জীবনের প্রয়োজনে উঠে আসা গান কিভাবে বেঁধে রেখেছে উত্তরের দিগন্তবিস্তৃত মাঠের সবুজ ঘাস ও তাকে ছুঁয়ে থাকা রূপকথা, সে সবই যেন মিথকথার মতো বর্ণনা করে গেলেন তিনি। যাকে ছুঁয়েও যেন ঠিক ছুঁয়ে ওঠা হল না। এখানেই কিন্তু গদ্যকার বাজিমাৎ করে দিয়েছেন। কারণ, আদৌ কি সবকিছু ছুঁয়ে থাকাই জীবন? যেটুকু অধরা, অছোঁয়া সেখানেই তো জীবনের অপর গল্প, যা জীবনকে জীবনী করে তোলে। লেখকের অন্তঃস্থলে অগাধ বিষাদ। তাই বলে বিষাদু চরিত্র হয়ে ওঠা নয়। বরং নিজস্ব বিষাদের ভিতর পাড়ি দিয়েই তিনি গড়ে তোলেন তাঁর পছন্দসই রূপকল্পের দেশ। যেখানে আছে উত্তুরে হাওয়া-জঙ্গল, মাহুত-হাতি, রাজবাড়ী ও রাজকন্যা। আছে বাওকুমটা বাতাস, আছে জীবনের গান, প্রাণের গান, প্রেমের গান লোকগান। অথবা তাঁর নিজস্ব উচ্চারণে--"আর মাটির উঠোন থেকে অনিবার্য কিছু গান গোটা জীবন আমার সঙ্গে থেকে যাবে। আর জীবনের বৃত্তে ঘনঘন আছড়ে পড়বে উড়ন্ত ঘোড়া, হস্তশিল্প এবং উৎসবগাথা।"
                   লেখক যদিও আবহমানতার কথা বলেন, কিন্তু একজন সচেতন পাঠক জানেন-- কোনোকিছুই আবহমান নয়। দেশের যেমন সীমা আছে। কালেরও তেমনি সীমা আছে। জীবন যত দ্রুতগতিময় হয়ে উঠছে, হারিয়ে যাচ্ছে শীতল হাওয়া ও সম্পর্কের যোগসূত্রগুলি। যান্ত্রিকতায় যন্ত্রমানব হয়ে ওঠার গল্প তো সকলেরই জানা। অতএব, আসন্ন সেই দিন কিন্তু জরুরী হয়ে উঠবে মাটির ঘ্রাণ, সবুজ পাতার গল্প এবং রূপকথার রাজকন্যা ও গ্রামীণ হাটের সরগম। কিংবা এমন একটা মাতব্বরকাহিনী, যার সংস্পর্শে রক্তে বইবে শান্ত শীতল স্রোত। পরিশেষে, সুবীর সরকারের গদ্য মানেই তাঁর ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যতা। একম্ অদ্বিতীয়ম্ ছন্দে, অনুভবে এবং দার্শনিকতায় তিনি রচনা করেন তাঁর গদ্যগুলো। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। উত্তরভুমি চষে বেড়ানো তিনি "মাতব্বর-বৃত্তান্ত" - এ খুব সঞ্চারণশীল বৃত্তান্ত রাখলেন রাখালবন্ধু-মইশাল, নদীঘাট-বাজারহাট, জোতদার-মাতব্বর, মাঘময়ূর-গোয়ালঘর, ভালুক মিঞা-নানুভাই, ইয়াসিনউদ্দিন-ধনকান্ত প্রমুখ এবং বর্ণজ্জ্বল হিজড়াযাপন থেকে ছন্দপতনের কাহিনী। পাতায় পাতায় কালো অক্ষর থেকে খুব আলতোভাবে সেসব মূর্ত ও বিমূর্তরা এসে ঢুকে পড়ে পাঠকের অন্দরে এক একটা মায়ামিথচরিত্ররূপে।
গ্রন্থ : মাতব্বর-বৃত্তান্ত
প্রকাশক : গাঙচিল
মূল্য : ২০০ টাকা
মানিক সাহার কবিতা 
অনুবাদ কবিতা 

সম্পূরন সিং কালরা (জন্ম 18 আগস্ট, 1934), তাঁর গুলজার নামেই জনপ্রিয়। হিন্দি চলচিত্রের প্রবাদপ্রতিম গীতিকার হলেও  একজন  কবি এবং চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি প্রথম সাড়িতেই অবস্থান করেন।
গুলজার প্রধানত উর্দু এবং পাঞ্জাবিতে লেখেন। এছাড়াও হিন্দীর বিভিন্ন উপভাষার পাশাপাশি ব্রজভাষা, খরিবোলি, হরিয়ানভি এবং মারওয়ারীতেও তাঁর লেখা রয়েছে। তাঁর কবিতার স্তবক বিন্যাসে আমরা ত্রিভেনীর ধরণ দেখতে পাই। তাঁর রচনাগুলি তিনটি সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। এবং তিনটিই খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর কাব্য সংকলনগুলির নামও খুব সুন্দরঃ চান্দ পোখরাজ কা, রাত পশমিনি কি এবং পন্দরাহ পাঁচ পঁচত্তর।
অনুদিত কবিতাগুলি 'রাত পশমিনি কি' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কাব্যের ভূমিকায় গুলজার রসিকতা করে লেখেনঃ আশা করছি, এবং দুঃশ্চিন্তাও করছি যে এখন লোক (এই কাব্যগ্রন্থ নিয়ে) কী বলবে, আর এর চেয়ে বড় ভয় এই হচ্ছে যে এমন না হোক যে কেউ কিছুই বলল না।





দুর্ঘটনা

সে কি পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করে নেবে?
না কি চোখ আরো বিস্ফারিত হবে?
না কি শুধু --- সব কিছু নিভে যাবে?
পড়তে পড়তেও সে লোকজনের আর্তনাদ শুনছিল।
আর, পোপটের দোকানের উপর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া
 রক্তের ছিঁটের উড়ে যাওয়াও দেখে নিয়েছিল!

রাতের একটা বাজল যখন, সে আবার
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল,
আর ফুটপাতে এসে দেখল,
চক দিয়ে আঁকা লাশের নকশা সেখানেই পড়ে আছে
যাকে সে ছাদের চিলেকোঠা থেকে নিচে ছুড়ে ফেলেছিল...!!


বেলুন

নিস্তব্ধতা ভরা ছিল এক বেলুনের মতো ঘরে,
তোর ফোন আসার শব্দ হওয়ার আগে পর্যন্ত।
বাসি এই পরিবেশ এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠেছিল
শ্বাস হালকা হয়ে গিয়েছিল, নাড়ি কাঁপছিল,
বিষন্নতার জাল চোখ থেকে নেমে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য...

আবার তোমার আওয়াজকে শেষবারের মতো 'খুদা হাফিজ'
বলে চলে যেতে দেখেছিলাম!

এক নিস্তব্ধতা ভর্তি হয়ে আছে
বেলুনের মতো এক শরীরে,
তোমার শেষ ফোন আসবার পর থেকে...!

আত্মহত্যা

এক মুহূর্তের ঝগড়া ছিল -
চারপাশ এমনভাবে চমকে উঠল যেন
কাঁচ ভেঙে পড়ার শব্দ।

সমস্ত জায়গায় উড়তে থাকা, জ্বলতে থাকা গল্প!
দৃষ্টিতে, কথায়, আদব-কায়দায়
চিন্তা-ভাবনা আর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ভেতর।
রক্তের এক সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল, যা সেদিন
                                             নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ---!
সেই শব্দের টুকরো উঠিয়ে মাদুর থেকে সেই মৃতদেহ
কেউ তার কব্জির শিরা কেটে নিয়েছে---
একটুও শব্দ করেনি,
যাতে কেউ জেগে না যায়!!

Thursday, May 3, 2018


বাংলাদেশ বিভাগ 


কবিতা করিডোর – বৈশাখী সংখ্যা ( এপ্রিল ) 

১. মুজিব ইরম 
কবিবংশ

আদিপুস্তকোত্তর ১লা কুলজি

লিখিয়াছি কবিবংশ আদি সে-কিতাব, তবুও তো ধরে রাখি অতৃপ্তি অভাব। বংশ বংশ করি বেশ কেটে গেলো কাল, রক্তে জাগে সেই ভাষা যাবনী মিশাল। শ্রীকর নন্দীর বাণী দেশী ভাষা কহে, কবি শেখর এ-বংশে লৌকিক বিছারে। বঙ্গবাণী নাম ধরি আব্দুল হাকিম, ভাষাবংশে আদিগুরু আমি সে তো হীন। কী প্রকারে তার নামে প্রণামিব হায়, আতারে-পাতারে খুঁজি মনে ন জুয়ায়। সেই তো হয়েছে শুরু আমাদের দিন, ভুসুকুপা তস্য গুরু বাঙ্গালী প্রাচীন। আরো এক বংশবাতি সগীরের নামে, বৃন্দাবন দাস নমি চৈতন্য প্রচারে। বড়ুচণ্ডীদাস ভনে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মুকুন্দ রামের নামে পরাই চন্দন। রামাই পণ্ডিত রচে পাঁচালি সঙ্গীত, প্রভুর চরণে মজে নিজ মত্ত চিত। সেই যে বাঁধিল গীত কানা হরিদত্ত, এ-মূর্খ রচিবে কী যে ভবেতে প্রমত্ত। বিজয় গুপ্তের নামে বংশবাতি পায়, ইরম মাগিছে দয়া বংশগরিমায়।

পরিশিষ্ট প্রণাম: প্রণামে-সুনামে গড়ি শব্দ-বাক্য-মিথ, পয়ারে-খেয়ালে শুধু গাই বংশগীত। অন্ধকার যুগে বাঁধি গয়েবি কামোদ, পটমঞ্জরীতে সঁপি সেই সুদবোধ। আমি যে বাঁধিবো তাল কুলিন রাগিনী, ভূর্জপত্রে নতজানু দয়া কী মাগিনী! তুমি কন্যা বেঁধো সুর মর্জি যদি হয়, এই বংশে জেগে থাকে চর্যাবিনিশ্চয়।


কবিবংশ

২য় ও সর্বশেষ কুলজি

সেই কবে ভাববশে ভুলিয়াছি ধাম, বিপ্রদাশ পিপিলাই ধরিয়াছি নাম। জয়দেব হয়ে রচি গোবিন্দের গীত, ছিটিয়েছি পুষ্পঢেউ কামের কিরিচ। রচিয়াছি চম্পূকাব্য কোনো এক কালে, বন্দনা করেছি কতো আনে আর বানে। আমিও শ্রীহট্টে জন্মে রাধারূপ ধরি, কবেই ছেড়েছি বাড়ি শব্দ শব্দ জপি। জৈন্তা পাহাড়ে ইরম দেখিয়াছি রূপ, বামেতে বন্ধুবাড়ি ডানেতে অসুখ। তবুও আলোর ডাক তবুও স্বপন, শ্রীহট্টে জন্মিয়া ভ্রমি বিস্তীর্ণ ভুবন। রচিতে প্রেমের শ্লোক তুচ্ছ করি কাম, বলেছি সহস্র বার নারীকে প্রণাম। জমিয়েছি দূরবাসে একজন্ম ঋণ, অকূল পাথারে ভাসি দলহারা মীন। সন্ধ্যাভাষা ভুলি নাই গুহ্য অন্তমিল, আমারও রক্তে ছোটে চর্যার হরিণ।

মোনাজাত: তুমি পুত্র কবিবংশের লোক...ধরিও বংশের খুঁটিÑ জন্মভিটা যেন আর না থাকে বিরান। তোমার তরিকা যেন সত্য হয় প্রেমÑ দি¦ধাহীন করে যেও বংশের বয়ান...পুত্র তুমি, পিতা তুমি, তুমি বংশের মানÑ তোমাকে স্বাগত বলি, জানাই সেলাম!

২. গিরীশ গৈরিক

আমি অভিজিৎ রায় বলছি


নিমগাছের সমস্ত শরীরজুড়ে তিক্ততারই ব্যাকরণ
অথচ নিমফুল মধু ডেকে আনে নীল প্রজাপতি
নৃ-মুণ্ডের অন্ধকারে এখনো যারা কাশফুল চাষাবাদ করে
এখনো যাদের চোখে শ্লোগানের পঙত্তি দাউদাউ করে জ্বলে
আমরা নিমফুল হাতে তাদের অপেক্ষায় আছি

সাদা কাকের কুহু কুহু রিংটোন ভাতের থালায় মেখে
কোকিলের প্রার্থনায় নত হলে-শকুনের আনাগোনা বাড়ে
কিংবা বিড়াল ও ইঁদুর এক খাঁচায় পোষ মানালে
শাকচুন্নি বাতাসে ডানা ভাঙা রোদ ফিসফিস করতেই পারে

এভাবে বেজিদের রক্তে কোবরা হত্যার এক প্রকার নেশা জন্মে
অথচ সাপ ও বেজির দ্বন্দ্ব এখন মানুষের রক্ত থেকে পবিত্র গ্রন্থে

নারিকেলের ভেতর জল শুকালে পচন ধরে
তেম্নি জলহীন নদীগর্ভ জনহীন মরুভূমি হলে
সেই মরুভূমির ইট চাপা ঘাসের কান্না সূর্য শুনতে পায় না


শ্লোক


এই অভিধানে গুড় জাতীয় কোনো শব্দ নেই
কেননা তার বাড়ির পাশে খুনি পিঁপড়েদের বসবাস
যৌনতাত কিংবা মহুয়াবসন্ত শব্দবীজ বুনতে পারে
কিন্তু কলসির তলা ফুটো হলে-কৌমার্য ঘুঙুর আর বাজে না
এ সকল বিষয় অধ্যয়ন করে বুঝেছিÑজন্মদাগ ঘষে ওঠানো যায় না
বিষয়টা বাহিরের নয়-ভেতরের
কপালের ভাঁজ গুনে জীবনের অর্থ না জানলেও
খেজুরগাছের খাঁজ গুনে বলতে পারি তার বয়স কত
কিংবা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে চোখ রেখে বলতে পারি
কাঁদতে পারা মানুষের একটি বড় গুণ
যদিও আমি জন্মের সময় কাঁদিনি বলে-মা জ্ঞান হারিয়েছিলেন
যেমন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেÑব্যবচ্ছেদবিদ্যায় ব্যবহৃত ব্যাঙ


দুধের সর


তুমি বিষধর গোখরার মতো সুন্দর
অথচ সুন্দরবনের সুন্দরী বৃক্ষের মতো মমতাময়ী
তোমার ছোবল কিংবা শীতল ছায়া
কোনটা পেতে কোনটা হারাই
সে ভাবনায় তোমায় নিরাপদ দূরত্বে ভালোবাসি
যতটা দূরত্বে কোন ফল-ফুলকে ভালোবেসে
                               বড় হয়ে ওঠে






৩. তাহিতি ফারজানা


“চতুর দর্পণ”

খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মদের ছিপি খুলে
একটি দর্পণ তুলে এনেছি আমি।
সব ভয়, সব বজ্রবিদ্যুৎ যে গিলে ফেলে জন্মান্ধ ক্ষুধায়।
যার ভেতর লুকিয়ে থাকে ইউরেনাস,
স্রেফ উত্তর দিতে অভ্যস্ত সে ক্রীতদাস
সব কৌতূহল জমা রাখে বিশ্বস্ততায়।

গৃহীত হাসি সে ফিরিয়ে দেয় আবার হাসবার জন্য
হতাশার হলুদ পাণ্ডুলিপি
পাঠিয়ে দেয় নায়াগ্রার তলদেশে।

ভীষণ ভান জানে সে, মনে হয় নিছক কাঁচ।
অথচ তোমার সম্মুখে দর্পণ,
তোমার ক্ষোভে ভেঙে পড়ে দেবতাসমেত।

“দূরের গান”

গাছের বাকল কেটে নেয়া ক্ষত থেকে রাত বাড়ে,
বাড়ে শহরের হৃদস্পন্দন।
ইমারত জুড়ে একে একে
বৈদ্যুতিক বাতির নিভে যাওয়া দেখি।

কোথাও প্রেম, কোথাও অনাহূত শোরে
খুন হয় নৈঃশব্দ্য-
সবাই ঘুমালে সেইসব দূরবর্তী সংসারেরা অবিকল মানুষ হয়ে
হাঁটাচলা করে।

দূরত্ব এক সর্বভুক পিরানহা
এ কথা ভেবে সর্বোচ্চ দূরত্বের দিকে ঢিল ছুড়তে থাকি।
দূর তখন সূর্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা রাবার বন
মহিষের কাধে ঝিম মেরে বসে থাকা কাক
জল আর তীরের বিভেদ মোছা কোন পরিসীমা।

ঘন রাতের পিঠে হাত রেখে
কাঠমিস্ত্রির মত দূরত্বকে বার্নিশ করি।
চকচকে আরও...

দূরে মুহুর্মুহু ভেঙে পড়ে দৃশ্য।



4.  কুশল ইশতিয়াকের কবিতা 


আলোর স্কুটার

আলোর স্কুটারে আমি মধ্যরাত বসে আছি
আলোর স্কুটার— আমাকে কোথায় নিয়ে যাও?
তোমার পায়ের নিচ থেকে রাস্তা সরে গেলে
তোমাকে দ্রুতই বুঝি ধরে ফেলে অন্ধকার
রাস্তা ছেড়ে তুমি কি এখন চলেছো আকাশে?
আমাকে কোথায় নিয়ে তুমি দিচ্ছো এ উড়াল?
শনি নাকি দূর বৃহস্পতি,— নাকি আরো পার
হয়ে বহুদূরে তোমার ঊজ্জ্বল বাড়িঘর?
ওখানে কি আমি রয়ে যেতে পারি চিরকাল?
মুমূর্ষু যে চাঁদ করে আছে অপেক্ষা আমার,
একদিন যাব ভাবি—  মৃত প্রেমিকার বাড়ি
জ্যোৎস্নালোকে সে চিহ্ন আমি খুঁজে পাব নাকি?
ছায়াপথ নিহারিকা মিলেমিশে একাকার
দ্রুতই তোমাকে ধরে ফেলে বুঝি অন্ধকার
শনির বলয় ভেদ করে—চলো দেখে আসি
কোথায় লুকিয়ে তোমার আশ্চর্য বাড়িঘর!





রূপকথা

ছোটবেলা থেকেই আমি তুলার এক বালিশে
ঘুমাই
জন্মের আগেই আমার মা তা করে রাখছে
সেলাই
এই বালিশটা ছাড়া আমার আসতে
চায় না ঘুম
ভাবছি কবর কেমন হবে আন্ধার
নিঝুম

জগত সকল সম্পদ আমি ফিরায় দিতে চাই
কবর তলে রাইখো বালিশ— আপন কিছুই নাই

৫. ঈফতেখার ঈশপ 

রেণুকা//

ফুয়াদ আল খতিব।শাদা পায়রাগুলো শুশ্রূষায় ব্যস্ত অসহায় কিছু করুণ মুখ।জানালায় খেলছে ইলশেগুঁড়ি আর রেলিং এ আমরা দু'জন।
ডুবোজ্বরে তুমি নাকাল। কপালে হাত রেখে বোঝা যাচ্ছে না তখনকার উষ্ণতা। তাছাড়া নেই কোন থার্মোমিটার; কি করা যায়....??
বুকে হাত দেয়া ভালো না,বুকে হাত দিলে পাপ হয়-রেগে যান ঈশ্বর! কি করা যায়...??কিভাবে মাপা যায় উষ্ণতা আর কিভাবে তোমাকে?
তারপর আলোগুলো নিভিয়ে দিলে;এলো অন্ধকার। ক্লান্ত কেউ কেউ তবু খোঁজে যাচ্ছে আঁধার ! আচমকা আমার দিকে এগিয়ে এলো একটা ত্রিভুজ আর দু'টো পাহাড়!
তারপর....
আর কিচ্ছু মনে করতে পারছি নে....
এতো সময় কোথায় ছিলেম??


৬. জাহিদ সোহাগের কবিতা 
বিবাহিত কবিতা

বাকি আছে আমার শরীরে র্যঁদা টেনে সমান করে নেয়া। যাতে তোমার সাথে আমার ক্ল্যারিকাল প্রেম আরো সহজ হয়। তুমি ডালভাতে আর একটু আলুভর্তা মেখে নিতে পারো।
বাগানে পোষা ফোয়ারাটিকে দেখে দেখে ভাবতে পারো পদ্মাপাড়ের ছেলেও কেনো শহরে এসে ঘুমিয়ে পড়ে!
আর তুমি সুযোগ বুঝে, র্যঁদা টেনে টেনে, প্রয়োজনে বাটালি দিয়ে নকশা কেটে, পেরেক ঠুকে দিও, যাতে তোমার সাথে আমার মহিমান্বিত দাম্পত্যের প্রদর্শনী হয়।

ইনসমেনিয়া

অথচ একটাও ওষুধ নেই পাকস্থলি থেকে লতিয়ে উঠবে ঘুমের ডালপালা,
আমি ভাবি, এইমাত্র পুনঃপুন ব্যর্থতা নিয়ে যে অটো স্টার্ট নিল,
তারও নির্ঘুম আছে
ফুটে থাকে তারও কয়েকটি বাতি; আর আকাশের শিশুরা ‘ওই তো, ওই তো খসে গেল’ বলে আঙুল তুলে দেখায় ছোট বোনকে, মানুষের নক্ষত্র।

ওষুধ পেলে এইসব গল্প গরুর চামড়ার ভেতর
লবণ দিয়ে রাখা যেত। আর অচেনা কেউ, দূরের বা কাছের,
কোনোদিন জুতা পায়ে ইটপাথর ভেবে, আকাশে, ঠুকে ঠুকে যেত
দেবশিশুদের চোখ।   


৭. অপরাহ্ণ সুসমিতো’র  কবিতা

১//
তোমার চিবুকের কাছে পড়ে আছে সোনালী ডিম,রাজ্যের আলসেমী
রিমরিম প্রতাপ জানাজানি কুসুম,মাখন বাটি সুর ঝালর মীড় উঁচু বাতি
আমি তোমাকে ছুঁয়ে রাখি আনমনা থাকি কেবল ডাকি কেবল ডাকি ।

কোনদিকে যাই আলুথালু রাত গাঁথা চম্পা মাখি
নোনা জল নেই কোথাও তোমার পায়ের ঝিনুকে এত ডানকানা মাছ
হেসে দাও ভোরের নীরব সুনসান আলো,ও শব্দ মহিমা ওলো নূপুর
ওলো পৃথিবীর মেয়ে দুপুর,তোমার শাড়ি চুমকি ..এসো নাচি এসো সাজি ।

কাছে যদি এই তমাল এই কানন তবু দূরে থাক রুপার গ্লাস
তোমার মায়ার বাহন খিলখিল অভিন্ন করিডোর,শীতের ভূবন পাখি
তুমি কি জানো না আমি প্রতিদিন চামচে তোমার নাক ফুল দেখি
আহ কন্ঠ জুঁই গালিচায় শুই তবু ডাকি তোমার নাম ধরে ডাকি ।

তোমার জমিন সমান আমি তোমার নাম নিয়ে বাঁচি ।

২//
সন্তাপে করজোড়ে মিনতি জানাই
দেহের মধ্যে মরিচের চারা লাগাই
তারে আতকা বে-দ্বীন জিগাই

যারে তুমি আগাছা বলো
আমি তার নামে ভাসান নামাই ।

কামিয়াবী মন্ত্র জানি না
অধম অপরাহ্ণ আমি
তীর্থ কারে ডাকি? মানি না

উপাসনার চাইতে আমি দামী
ঘরের পিছনে দাঁড়াইয়া থাকো মা
পাহারা দিয়ো আমি বা প্রথমা

তোমারে বিস্কুট কিনে দিব
দিয়ো পুরানা হাড়ি পাতিলের কটকটি
আমি মা তোমারে
আদর করে ডাকবো বিস্কুটি ।



ফাঁকা চেয়ারগুলো
তুহিন দাস

আমি উঠলেই চেয়ারটা শব্দ করে,
যেভাবে তুমি বলছো আরেকটু থাকো,
আরেকটু থাকো—তুমিও পাশে,
কিন্তু চেয়ারগুলোর একা বসে থাকা দেখে
নিজেকে আরো নিঃসঙ্গ লাগে!


নিজেকে আর কবি মনে হচ্ছে না


নিজেকে আর কবি মনে হচ্ছে না, যা লিখছি
তা ছাপতে দিতে পারছি না। আজকাল বেশ ঘুম
পায়, আকাশ থেকে নিদ্রাগুঁড়ো ঝরে পড়ে,
আমি সত্যিই বুঝতে শুরু করেছি এই লম্বাটে
দুপুরচক্র আর আসবে না; কোথাও কেউ নেই,
শুধু স্তব্ধতা ও মৌনতা গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে
ফাঁকা খাটে, যেন দুই বোন। নিজেকে ঝরাপাতা ভাবি,
মনে মনে বলি: ঝরাপাতা নিয়ে বিষণ্ণতার কি আছে?
সে এখনও তার মতো করে দামী। শুনতে কি পাও
দূরবনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগাক্রান্ত বয়সী গাছেদের
আত্মচিৎকার? আমার কানে ভেসে আসে তা,
অতঃপর নদীর কাছে যাই শান্তি পেতে, সেখানে
সুউচ্চ ব্রীজের ‍উপর দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি প্রতিটি
প্রজাতির গাছ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পর বাড়ে না,
নামে দ্রুতবেগে সারি সারি অন্ধকার, খুঁজি না
গহীন-গোপন, জলের ধারার মতো সহজ জীবন
গড়ায়, বোধের পাহাড় হতে মাঝে মাঝে নামিয়ে
আনি ভারী সব পাথরখণ্ড; টোল খাওয়া জ্যোৎস্নায়
ঝাঁকে ঝাঁকে নীল মাছি উড়ে যায়।


চিত্রকর্ম : তুহিন দাস 
      সভা
  সুতনু হালদার

এর মধ্যেখানে কয়েকটা
       বর্ণচোরা সম্পর্কের চোরাবালি
                      ইতিউতি হার্ডডিস্ক পুরণের জন্য ব্যাকুল
                                     উদাসিনতায় ভরপুর...

আমরা চিরটাকাল হালকা হতেই চেয়েছি!
নিয়নের আলোতে সেই হ্রাসমান দেহ
পর্যবেক্ষণ করতে কোন হিরণ্যগর্ভের
                   প্রযোজন একান্তই অবাঞ্চনীয়...

প্রখরতার সাথে সমস্ত
                        ওজস্বী তৎসম শব্দকে প্রথাগত ভাবে
         অভিস্রাবন প্রক্রিয়ায়  বিয়োগান্তিক
আলোচনায় অসমাপ্ত রেখে
প্রুফশিট পরুষ আর পুরুষাকারের মাখামাখি!

নারীবাদের প্রস্তাব আরও কিছু পরে আলোচিত হবে...

Wednesday, May 2, 2018

     একটি অবনী চাই
                          অভিজিৎ মহন্ত ll

শহর.... মফস্বল... নদীচরে...
             একটি অবনীর মতো অবনী চাই ...
 হাড়-মজ্জা থেকে যারা ইতিহাস হয়ে গেছে
           তাদের রক্তে একটি অবনী চাই ,
 শুন্য দশকের যে সব গাছ পাতা ঝরিয়ে বড় হচ্ছে -
             তাদের কোশে একটি অবনী চাই l
 ধুতি-পাজামার খোলস ছাড়িয়ে
           ছুটে চলেছে ট্যাবলেট… স্মার্টফোন
                   ছুটে চলেছে কুর্তি ... টি-শার্ট.... ।

রোজ রাতে জ্যামিতি ভুল করে প্রবেশ করে সাহিত্যে
             বিনয়-গায়েত্রী দিশাহীন সন্তরণ
টরিসেলির শূন্যস্থান পূরণের মাটি থেকে জন্ম নেয় কবর
      তার উপর নিমগাছের মতো দাড়িয়ে রয়েছি আমরা.....!
যেকরেই হোক এদশকে একটা অবনী চাই....
         অবনীর মতো অবনী চাই;   
যে রোজ রাতে শুন্য চৌকাঠে এসে
               শেকল নাড়িয়ে বলবে ....
                           শক্তি…….! বাড়ি আছো..... ll


সঞ্জীব সেনের কবিতা 
চর্যাপদের গান 


একটি স্বপ্ন বিলাসী মন আর তেঁতুল লোভী কুমীরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই
কুমীর ফিরে আসে তেঁতুলের লোভে
নীচে পরে থাকা তেঁতুল চেটে খায়
এসব দেখলে দস্যুর চোখ লাল হয়
সাপ আর সাপলুডো একসাথে খেলতে পারে যে, সে তস্কর ছাড়া আর কেউ না,
এক ভ্রমণবিলাসী নদী আর অন্ধধীবর দীর্ঘ দিনের আলাপে তাদেরও প্রেম হয়,
ঝড় ভুলে মাঝ দরিয়ায় বসে থাকে,
আর আরেক দিকে, দিনদুপুরে দাঁড়কাক ডাকলে ভয় হয়, রাত্রিবেলা সমবেত সারমেয় চিৎকরে আচলে দাঁত কাটে
সেও যখন দরজায় খিল তুলে নিজে থেকে সোহাগের কাছে যায়
এই দৃশ্যে পক্ষী দম্পতির কৌতূহল জন্মায়
তাঁদেরকে বলি তোমরা কি চর্যাপদের গান শোনোনি,






আকাশ সাহার কবিতা 
দীর্ঘতম কবরখানায় আলো জ্বলে

মরা চাঁদ আবার বহুদিন পর
তার আলোকধারা কে
শতবর্ষে পৌঁছে দিয়েছে.
ভেজা ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে
অপলক চাহনিতে
তাকিয়ে দেখি কবরখানায়
আবার উৎসবের ঢল নেমেছে
আবার
প্রাণের লহমায়
জীবন ফিরে যাচ্ছে
তার বিলুপ্ত কড়িবর্গের ভিতরে..
কঙ্কালে আবিষ্ট শরীর
তার সারা গায়ে
রক্তের ক্ষতচিহ্ন
প্রাণভোমরা খুঁজে নিয়ে সে তাকিয়ে দেখে
আমার মুখের কিঞ্চিৎ বিস্মৃতি
আজ অপরিচ্ছিন্নভাবে
ঠিক একই আছে.
ভাঙা জোসনার স্নানের ধারায়
অলসতা কাটিয়ে ওঠে ,
কবরের গাছপালা,মাটি.কফিন ,
আর কফিনের ভিতরে থাকা
মিশর বা বেবিলনের ওষুধমাখানো মমি
এরাও একাধারে
বুনেটে বাধা
একসময়কার
রোদ ঝলমলে মানসী
স্তব্ধ নৈরাশটা বহুবছরপর
এমন দীর্ঘ কবরখানায়
দিবাস্বপ্নের
ঝলসানি এনেছে
সিগারেট আর লাল ওয়ান
নিয়ে
বহু প্রতিক্ষনের
আজ হয়তোবা
শেষ সময়
দীর্ঘ একটা নিঃস্বাস নিয়ে
ফিরে তাকালাম,সেই শীতল দীর্ঘ
কবরখানার দরজায়
আর এই মুহূর্ত থেকে
আমার সাদা শরীরের
সমস্ত রক্ত চুষে নেয়
কফিনে বন্দি করা,
মরা চাঁদের
অন্ধকার কলঙ্ক,
রাত্রির নির্মিশেষে
বীভৎসতা...