Sunday, February 2, 2020

কবিতা করিডোর , বইমেলা সংখ্যা , ২০২০


কবিতা করিডোর ,  বইমেলা সংখ্যা ,  ২০২০



সম্পাদকীয়

এই শীত যাবে যাবে করেও আরো কয়েকটি দিনের অতিথি । অতিথি নারায়ণ বলে কথা । তাই এখনো গরম পোশাক জড়িয়ে নিচ্ছি খুব আদরে । আদর কে না বোঝে ? এই আদরের ডাকে অনেকেই সাড়া দেয় । ডাক পাঠায় ।  তাদের লেখা আমার মেইল বক্স ভরিয়ে দেয় । চারদিকে হল্লা হল্লা হল্লাময় দিন । বড্ড ভয় ! ভয়কে উপেক্ষা করেই কলম সৃষ্টি করে যায় । বইমেলা ভরিয়ে তোলে দেশ বিদেশের কতো লেখা , বই । আর এই ভিড়ের মধ্যেই ' কবিতা করিডোর '  নির্ভীক যোদ্ধার বেশে সকলের সামনে হাজির হবার সাহস দেখায় নিজের সম্ভার ও সম্ভবনা নিয়ে । ইচ্ছে করেই সূচীপত্র দিচ্ছি না । লিঙ্ক এ ক্লীক করে ভালোবেসে লেখা পড়ে মতামত দিলে খুশি হবো । লেখার সমস্ত দায় লেখকের , সম্পাদক কোন ভাবেই দায়ী নয় ।
ধন্যবাদান্তে
শুভঙ্কর পাল
সম্পাদক : কবিতা করিডোর
যোগাযোগ : subhabrb@gmail.com
মুঠোফোন : ৯৯৩৩৭৭০৫৪১
প্রচ্ছদ : সমীরণ ঘোষ
অলংকরণ চিত্র  : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত 
মিলটন  রহমানের তিনটি কবিতা 


আবরার

আমার চোখে কোন জল নেই, চোয়াল খটখটে
এখানে সেখানে আঠার মতো লেগে আছে রোনাজারী
বধির হয়ে আছি শুনতে পাই না কিছু, হায় বন্ধুরা
চোখেতো কিছুই দেখি না, এমনকি মায়ের মুখও
বুঝতে পারছি না, আমার কি তাহলে সব গেলো?
নাকি আমার দেশ, চিন্তুক, করাহারি ভোতা হয়ে গেলো।
আমাকে কেনো কেউ শুনতে পাই নি, কেনো শুনতে পায় না
আমার মা ঠিকই শুনতে পায়, আমিও মাকে
প্রতিক্ষণ কথা হয়, কান্না বিনিময়, চোখের জল
আমার চোখে তো জল নেই, সব জল মায়ের চোখে
হাতও কাজ করছে না, মা‘র চোখের জল মুছি কি করে!
বাবার চোখে লাফিয়ে উঠছে বাংলাদেশ
বাবার দু‘হাতে লাফিয়ে উঠছে ভাঙাচূড়া একটা মানচিত্র
কারা ভেঙেছে? ওরাইকি তবে শুষে নিয়েছে আমার সব?
আমি কি কোথাও নেই আর? 
পড়ার টেবিল, ক্লাসের টেবিলে, বিকেলের গানে
সন্ধ্যের পুষ্পানন্দে, রাতের নিশুতি নওবতে
আমি কি কোথাও নেই?
মা কেবল কাঁদছে কিছুই বলে না
ঘরের দাওয়া থেকে কেবল দেখছে, আমি
কিভাবে শুয়ে আছি শুতীব্র মাটির বিছানায়।
যে পথের ধুলোয় এখনো গড়াগড়ি দেয় আমার শৈশব
যে পথে বাবার হাতে ভর করে পার হয়েছি সেতু
আমি সেই পথের ধারে শুয়ে আছি
আমিতো অনেক কথা বলছি
আমাকে যারা বেদম পেটালো তাদের জন্য করুনা
আমার রাজনীতিকদের জন্য বিন¤্র ঘৃণা
আর তোমার জন্য, হে তোমার জন্য হে পিতা
স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ওদের অস্তিত্ব তুলে নিচ্ছি
কেউ না শুনলেও আমার কথা শুনতে পাচ্ছে মা
তুমিই সবাইকে বলে দাও মা, আমি সর্বত্র আছি
আমার গ্রামের কৃষক-মুটে-মজুর, বাউল-ভবঘুরে
আমার প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায়, খেলার মাঠে
বাবার কাধে লেগে আছি বড় ভার
তুমি আমার সব কথা বলে দাও মা
তুমিতো আমাকে শুনতে পাও!
আমার দেশওতো আমার মা, আমার মাটির গৌরব
সে কি আমাকে শুনতে পায়?
আমি তাকে খাবলে ধরেছি শকুনের মতো
হিংস্র শকুনের হাত থেকে রক্ষা করবো বলে। 


পিতার হাত

যাবার আগে ডান হাত উঁচিয়ে পিতা কি বলে গেলেন?
আমি মুহুর্তেই সহস্র বার্তা উড়ে যেতে দেখলাম
দেখলাম ফেরেশতা একটি চকচকে হৃদপিন্ড হাতে
উঠে গেলেন বিস্তৃত আকাশের দিকে।
কিছু মানুষ কিংবা দূতেরা কলেমামুখে ছড়িয়ে পড়লো
পুরো তল্লাটে জেগে থাকা অসংখ্য পুস্পোদ্যানের দিকে
জ্বল জ্বল করে জ্বলে ওঠা চোখ নিয়ে একটি বিড়াল
মাটিতে নেতিয়ে পড়লো প্রচন্ড কান্নায়
আমার মা তাকে কোলে তুলে বললেন, এখানেই থাক।
আমরা এক একজন ওই হাতের ঈশারায় আকাশ বিদীর্ণ করে
পুরো শূণ্যতা ভরিয়ে তুললাম রোনাজারির শেষ অশ্রুপাতে
তখনো আমি দেখলাম-
পিতার আঙ্গুল বেয়ে উর্ধ্বে উঠে গেলো একঝাঁক সাদা পায়রা
তারা পাখায় ভর করে নিয়ে গেলো সহ¯্র তারার জিকির
এক এক করে পাশ থেকে উঠে বার্তা নিয়ে ফেরেশতারা চলে গেলো
পিতার হৃদপিন্ড বেয়ে তারা হাওয়ায় বিলিয়ে দিলো আতরের ঘ্রাণ
পিতার দু‘চোখ থেকে আলোর নহরের মতো উঠে আসা
স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব এমনকি সড়কের পাথরেরা
একটি শোক অথচ আলোকরশ্মি হাতে তৈরী করলো দীর্ঘ মিছিল। 
পিতা-
তুমি এ কোন নতুন বিশ্বে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলে আমাদের?
পৃথিবীতে তোমার বিচরণ শেষে কেনো বুঝতে হলো-
তুমি সেই মহাপ্রাণ, যেখানে কেবলই মানব মঙ্গলের বাতি জ্বলে
সৃষ্টির সেরা মাকলুকাতের হাতের প্রতিটি আঙ্গুল উচ্চস্বরে জিকির করছে
তোমার নাম, আকাশের প্রতিটি ভাঁজে তুমি জেগে উঠছো
তুমি কোথাও যাও নি জেনে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছি, পিতা
জেগে উঠে তোমাকে দেখবো বলে!

গান



আয়, তোকে দেখতে মন চায়
আমাদের উঠোনের রক্তজবার মতো
সকাল গড়িয়ে দুপুর তারপর বিকেল হতে
বুকে কুড়িয়ে নেয়া অস্তগামী রেলের মতো
তোকে দেখতে ইচ্ছে করে।
নিষুতি রাতে হাসনাহেনা মৌতাতের সাথে
আমি যে পরীনৃত্যে জেগে রইতাম 
ভোরে গন্ধরাজের যে নি:শ্বাস নিয়ে
চোখের শীতলতর গভীরে রেখে দিতাম
তার মতো তোকে দেখতে মন চায়
অনন্তত আর কিছ ুনা হোক তুই চলে আয়
কাঠালিচাপার মতো হলুদ বিকালে, কিংবা
দুধঘাসের মতো ধবল-সবুজ প্রহরে
আমি উঠোনে বসে আছি প্রচন্ড শীকড় গেড়ে
আমাদের মোরগফুলের মতো লাল কিংবা বেগুনি
আসতে আসতে যখন শুনবি কোন বন্যবিহারে
গান বেজে উঠছে, সেখানে নেমে যাবি
আমি ওই গানবাজির কবুতর 
তোর জন্য বসে আছি প্রাগৈতিহাসিক বৈরাগী
তোকে আরেকবার দেখবো বলে।

সুবীর সরকারের কলমে বুক রিভিউ 
তলোয়ারের ডানা থেকে এক নতুন গল্পের ঘ্রাণ 


মাঝে মাঝে আমরা
আশ্চর্য ভ্রমণে যাই।
আশ্চর্য স্পর্শ হয়
আশ্চর্য চোখের কথা...

এই এত সব আশ্চর্য!
কোথা থেকে আসে,
এই এত সব আশ্চর্য যোগ করলে...
শুধু তুমি শুধু আমি

আমাদের বুকভর্তি গুনগুন...

কি তীব্র এক দর্শন!কি প্রবল এক জীবনবোধের বিস্ফোট!সাদামাটা কতগুলি শব্দ দিয়ে কবি এক আবহমান জীবনের ম্যাজিক গুছিয়ে রাখছেন।সম্প্রতি পাঠ করলাম তরুণ কবি বিশ্বজিৎ-এর কবিতার বই-'তলোযারের ডানা থেকে'।চার ফর্মার এই বইটির প্রথম কবিতাটি দিয়েই শুরু করলাম এই লেখাটি।এর আগেও বিশ্বজিৎ এর একটি বই পাঠ করেছি আমি।আর ওর কবিতা তো নিয়মিতই পড়া হয়।
বিশ্বজিৎ একটা ঘোর জড়িয়ে হাঁটেন।আত্মপীড়ন ও আত্মখনন  জড়ানো তার কবিতাজীবন।বিশ্বজিৎ বলেন-
দিন ও রাতের মাঝে,
কেটে কেটে যাচ্ছে মুগ্ধতা...
কিংবা-
নিজেকে দেখে নিজেই হাসি
গল্প বানাই।
আকাশের মাঝে ফেরি করি,
সমস্ত পাওয়ার গান।
কবিতায় কবিতায় এক তাঁতকল।নিজেকে অতিক্রম করতে করতে অতিক্রমনের এক জায়মান বিস্তারের কুহকে ডুবে যাচ্ছেন কবি।তার এই চলাচলের বৃত্তায়নে এক ভাঙনের দেশে বসে থাকা বেহালাবাদকের করুন সুর পাঠকের শিরা উপশিরায় কেমন ধাক্কা দেয়!এক মায়া।এক চুম্বক প্রাবল্য!একজন কবি তো এখানেই জিতে যান,কেননা পাঠক দুলে ওঠে আর বিষ্মিত হন।বিশ্বজিৎ সেই কত কত জন্ম ও জন্মান্তর থেকে আবহসঙ্গীত  শোনাতে থাকেন-
'কিছুই বলার নেই।

কিছুই বলার ছিল না।

চারিদিকে শুধু বয়স বাড়ছে'।
সামান্য কতগুলি শব্দ।সামান্য তিনটি লাইন।অথচ কি অসামান্য।কি মোক্ষম।কি জরুরী হয়ে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে।
প্রান্তে বসবাসকারী এই তরুণ কবি বিশ্বজিৎ অত্যন্ত মগ্ন থাকেন।অবিরাম পলায়ন করে তিনি দুপুর রৌদ্রে এসে দাঁড়ান।অনবরত এক দাউদাউ খোঁজ জাগিয়ে রাখেন নিজেরই ভেতর।দেশকাল নদী মেঘ প্রেম সম্পর্ক বিয়োগব্যথার মতো হাইফেন হয়ে বুঝি উড়ে যেতে থাকে দিক ও দিগরের দিকে।মানুষের মনোজগতের আলো ও অন্ধকারগুলি খুব নিখুঁত হয়ে ওঠে বিশ্বজিৎ-এর ভাষ্যে-
'চারিদিকে  এত চিৎকার
হাসি,একই কথা বলে।
একই নামে বারবার ইতিহাস গড়ে তোলা
পুরনো দাগ,নতুন জুতো
সেজে ওঠা ঘরবাড়ির গল্প'
আবার সে দেখে,দেখে ফেলে এবং আমাদের দেখায়-
'জুয়া ও জুয়াড়ির মাঝে
                 একপলক শারদীয়...'
বিশ্বজিৎ কবিতায় কবিতায় ধ্যান ছড়িয়ে দিচ্ছেন।তার কবিতায় মন্ত্রের মগ্নতা।উচ্চকিত শব্দের ক্লান্তি বহন করে না সে।কবিতা তার বেঁচে থাকবার আবাদভূমি।অন্নজল।কি সহজিয়ায় এই তরুণ লেখেন,লিখে ফেলেন-
'আরও রাগি হয়ে উঠছি,
নতুন ম্যাজিকের শহরে'...
বিশ্বজিৎ-এর কবিতা পৃথিবীতে ভরা হাটের গমগম।অদ্ভুত যৌথতার ইশারা।এই কবি ভালোবাসার কথা মায়ার কথা জীবনের কথা বলেন।প্রবল নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন হিরণ মিত্র।ঝকঝকে এই বইটির প্রকাশক:স্রোত পাবলিকেশন।
শক্তিশালী তরুণ কবি বিশ্বজিৎ আমাদের বাংলা কবিতার অর্জন ও অহংকার।আমি এই তারুণ্যকে কুর্নিশ করি।
ভালোবাসা,ভাই বিশ্বজিৎ...
শুভঙ্কর পালের কবিতা 



নীলিমা দেবের কবিতা 
এক চিলতে কুয়াশা  


এই তো আগুন টিপে টিপে বেলা করছে দু-একটা  চুরির সাহস 

 স্কুল পাশ ফিরলেই  ঘরময়  ছিটিয়ে পড়া সূর্যাস্ত
তাড়াহুড়ো করে রাত ঢুকে পড়ছে সেলাইমেশিনে

ড্যামেজ হয়ে পড়ে থাকা আকাশে পাখির গুজব কত কি শেখায়!
শাড়ির আঁচলে কাঁপছে যৌথ শীত
লালসার আকৃতি নেই

কাচ-কাচ স্বর্গে নিরুত্তর রাস্তার  সংক্ষেপ
সব রাস্তারা মা হয় না
শিশিরের কৌটোয় সেলাই এর পর  সেলাই

কে যে সাঁতলাচ্ছে রাধা-রং !

উনুনখোলা ডিসেম্বর   


মানিক সাহার দুটি কবিতা 


লাল চোখ 


জলে ডুব দিয়ে থাকি। যতক্ষণ না চোখ লাল হয়ে যায়। জ্বালা করে। কঁচুপাতার চশমা বানিয়ে তার ভেতর দিয়ে সূর্য দেখি। চোখ ঠান্ডা হয়। তারপর টক আম। কে কত জোড়ে টকাস করতে পারে তার প্রতিযোগিতা।
যারা টক ভালোবাসে আমি তাদের দিকে মোহবিষ্ট হয়ে তাকাই। মনে হয় একটা ফোয়ারা আছে তাদের শরীরে। তাদের মুখের ভেতর। ঝরঝর করে তার জল নেচে ওঠে। যেমন করে নাচতো সেই দুই মাস থাকতে আসা পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া মেয়েটি।
নাচতে শুরু করলে সে কেমন যেন অপ্সরা হয়ে যেত। ওর শরীর থেকে রহস্যময় চুম্বক বেড়িয়ে আসতো। আমি নিচু হয়ে ওর পা দেখতাম। গোড়ালি দেখতাম। গোছ দেখতাম। ও হেসে উঠলে দেখতাম ওর বুকের ভেতরে একটি দাম্ভিক সাপ খেলা করছে।
যখন দুপুরবেলায় জলে নামি, জলে ডুবে চোখ খুলে থাকি। দেখি মেয়েটি নাচতে নাচতে পোশাক খুলে ফেলছে। গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে অপ্সরা মনে হয়। জিভ বের করে আমাকে ছুঁতে আসে। দাম্ভিক সাপ হয়ে পাথর হয়ে যাওয়া দৃষ্টিকে চেটে নেয়। আর আমার চোখ লাল হতে থাকে। আমি কঁচুপাতার চশমা পরে বাড়ি ফিরতে থাকি। মাঝে মাঝে ভাবি মেয়েটিকেও ডাক দেব। অথচ ওর নাম কিছুতেই মনে করতে পারিনা।



এক বিষ্যুদবারের সন্ধ্যায়


এক বিষ্যুদবারের সন্ধ্যায়, আলোর লোভে পর্দা সরাতে গিয়ে, সারা শরীর ঠকঠক করে কেঁপে উঠেছিল । পর্দা যা ঢেকে রাখে তার গভীরে থাকে রহস্য মনোরম। ডুবে যেতে যেতে আলোর ধার ধরে আমি তখন ভেসে থাকার চেষ্টা করছি আর আমার জিভ ঠান্ডা হয়ে আসছে।
আলোর প্রবঞ্চনায় চোখ চলে গিয়েছিল মোহরের মায়াময় দেহে। যত রহস্য ছিল এতদিন আলো তাকে ভেঙে দিচ্ছিল। আমি কাঁদতে পারছিলাম না। আমার পাপিষ্ঠ চোখ  মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মোহরের শাড়ি কেমন করে ওর পায়ের কাছে লুটিয়ে আছে । বাতাস বেইমানের মতো ওর চুল নিয়ে খেলছিল। আলো ছুঁয়ে দিচ্ছিল চোখ আর বুকের উজ্জ্বল দুই মণি।
আমার মৃত্যুর আগে, আমি বুঝতে পারছিলাম, অধ্যাবসায় আর বিদগ্ধ পাঠের বাইরে এক মর্মান্তিক অথচ সুন্দর পৃথিবী আছে। তার কথা কেউ কেউ জানে। তার ছবি কোনদিন মোছা যায়না। তাকে বহু যত্নে গোপন করে রাখতে হয়।
লাল চোখ
জলে ডুব দিয়ে থাকি। যতক্ষণ না চোখ লাল হয়ে যায়। জ্বালা করে। কঁচুপাতার চশমা বানিয়ে তার ভেতর দিয়ে সূর্য দেখি। চোখ ঠান্ডা হয়। তারপর টক আম। কে কত জোড়ে টকাস করতে পারে তার প্রতিযোগিতা।
যারা টক ভালোবাসে আমি তাদের দিকে মোহবিষ্ট হয়ে তাকাই। মনে হয় একটা ফোয়ারা আছে তাদের শরীরে। তাদের মুখের ভেতর। ঝরঝর করে তার জল নেচে ওঠে। যেমন করে নাচতো সেই দুই মাস থাকতে আসা পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া মেয়েটি।
নাচতে শুরু করলে সে কেমন যেন অপ্সরা হয়ে যেত। ওর শরীর থেকে রহস্যময় চুম্বক বেড়িয়ে আসতো। আমি নিচু হয়ে ওর পা দেখতাম। গোড়ালি দেখতাম। গোছ দেখতাম। ও হেসে উঠলে দেখতাম ওর বুকের ভেতরে একটি দাম্ভিক সাপ খেলা করছে।
যখন দুপুরবেলায় জলে নামি, জলে ডুবে চোখ খুলে থাকি। দেখি মেয়েটি নাচতে নাচতে পোশাক খুলে ফেলছে। গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে অপ্সরা মনে হয়। জিভ বের করে আমাকে ছুঁতে আসে। দাম্ভিক সাপ হয়ে পাথর হয়ে যাওয়া দৃষ্টিকে চেটে নেয়। আর আমার চোখ লাল হতে থাকে। আমি কঁচুপাতার চশমা পরে বাড়ি ফিরতে থাকি। মাঝে মাঝে ভাবি মেয়েটিকেও ডাক দেব। অথচ ওর নাম কিছুতেই মনে করতে পারিনা।












এক বিষ্যুদবারের সন্ধ্যায়

এক বিষ্যুদবারের সন্ধ্যায়, আলোর লোভে পর্দা সরাতে গিয়ে, সারা শরীর ঠকঠক করে কেঁপে উঠেছিল । পর্দা যা ঢেকে রাখে তার গভীরে থাকে রহস্য মনোরম। ডুবে যেতে যেতে আলোর ধার ধরে আমি তখন ভেসে থাকার চেষ্টা করছি আর আমার জিভ ঠান্ডা হয়ে আসছে।
আলোর প্রবঞ্চনায় চোখ চলে গিয়েছিল মোহরের মায়াময় দেহে। যত রহস্য ছিল এতদিন আলো তাকে ভেঙে দিচ্ছিল। আমি কাঁদতে পারছিলাম না। আমার পাপিষ্ঠ চোখ  মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মোহরের শাড়ি কেমন করে ওর পায়ের কাছে লুটিয়ে আছে । বাতাস বেইমানের মতো ওর চুল নিয়ে খেলছিল। আলো ছুঁয়ে দিচ্ছিল চোখ আর বুকের উজ্জ্বল দুই মণি।
আমার মৃত্যুর আগে, আমি বুঝতে পারছিলাম, অধ্যাবসায় আর বিদগ্ধ পাঠের বাইরে এক মর্মান্তিক অথচ সুন্দর পৃথিবী আছে। তার কথা কেউ কেউ জানে। তার ছবি কোনদিন মোছা যায়না। তাকে বহু যত্নে গোপন করে রাখতে হয়।
শেষের সংলাপে

উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়



মেয়ে টি ঘুমিয়ে,
ক্লান্ত পরীর ডানা কেটে নিয়েছে সারমেয় সভ্যতা,

কতগুলো শর্ত জেগে আছে
কতগুলো আরোপিত শর্ত সমন্বয়
জন্ম দিচ্ছে বাতাসে বিষ ফুল

আরও একটা প্রতিবাদ মানুষ গড়তে চাইছে
চাইছে যুক্তির আকাশ...
বেওয়ারিশ 
নির্মাল্য ঘোষ 


একটা মন তুলে রেখে দিতে হয় 
রেকাবে...
আমি শব্দ রেখেছি...
বেছে বেছে...
পেশাদারি  ভাবে...
একটা ছায়াকে ভাঙ্গা সহজ নয়...
ঠিক যেমন সহজ নয়
রক্তক্ষরণ দিয়ে সবকিছু লেখা
প্রেম প্রেম খেলা এখনও চলে 
হোক না সে নকল...
একটা অধ্যায় পুরো ফাঁকা
ছাপা হবে না কোনো দিনও....
তবু অস্তিত্বহীন লড়ে চলে অস্ফুট স্বরে-
যদিও...
সব কিছুই অস্তিত্বহীন ছায়া...
একটা বেওয়ারিশ স্মৃতি
একটা আগাগোড়া গন্ধ...
একটা ঘুম পাড়ানি গান 

জ‍্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়
বেশ বুঝতে পারছি,


নিজেকে নিয়েই ব‍্যস্ত হয়ে পড়ছি প্রতিদিন
নিজের চারিদিকেই মশারি টাঙিয়ে ফেলেছি
মশারির খুঁটগুলো এতদূরে বা কোথায়
যে রেখে এসেছি, আর মনেই পড়ে না
সবাই বলছে, আমি নাকি অসামাজিক
আমি নাকি কথা বলতেই ভুলে গেছি
জানি না, হয়তো তারা সত্যি
কিন্তু আমি যে আর, কারো কথা
শুনতেই পাই না, শুধু কথা দেখি
শব্দগুলো বর্ণ হয়ে যায়
বর্ণগুলো লেখা

লেখার শর্তেই আজ আমি বড্ড একলা







গল্পের মতো
 নীপবীথি ভৌমিক


মিথ্যেকেই আজকাল ছায়া বলেই সাজিয়ে নিই।
  জানি, যারা সব সত্য বলে হারিয়ে গিয়েছিল প্রাচীন প্রবাদ-অরণ্যে, 
 তাঁরা ঘুমিয়ে আছে কেউ বা
  ফুল হয়ে, কেউ আবার নদী হয়ে।

আজকাল হেমন্তকে বড় অদ্ভুত লাগে জানো!
 পাখিরা আসে না এপথে।‌ বিসমিল্লার নহবত ও 
        বসে না পড়ন্ত রোদের গায়ে।
   
  তাই বলি, আমাকে ভুলতে দাও বরং নিজেকেই...
        
        শীত আসুক শীত !
    গল্পের গায়ে লেখা হোক নতুন উপন্যাস ।
প্রেমের অণু কবিতাগুচ্ছ
আরিফুর রহমান

     
দিব্যি
💚
একটা পথ খুঁজছি,
যে তোমার নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দেবে 
আমার আশীর্বাদ।

অবাক হলে?
আমি তোমার মাথা খেতে কী করে যাবো বলো?
   
    
মৌমাছি
💚
রাই সরষের দিনগুলোতে আমাদের কোনো কষ্ট নেই, পুষ্প আছে
অথচ এই তো গেলো একেকটা দিন
চুমু ছাড়া কিছু খাইনি দু'জন
সত্যি চুমু ছাড়া কিছু পাইনি দু'জন!     


দাম্পত্য
💚
এই শীতেও থার্মোমিটারের পারদ
কতটুকু উঠলো বা কত নিচে থাকলো না
অথবা শিশিরের ঝরে যাওয়া
টুপ্ টাপ টুপ্ টাপ কান্না
আমরা ছাড়া কেউ জানে না
কিংবা জানলো না!      


প্রলাপ
💚
তুমুল জ্বরের দিনে জলপটি খুঁজি
খুঁজি খুঁজি খুঁজি
আরও খুঁজি,
খুঁজতে খুঁজতে তোমাকে পেয়ে যাই     

তারপর নিজেকেই হারিয়ে ফেলি! 


সে রাতে কারফিউ ছিলো
💚  
'তোমার হবো' বলতে যাবো, শুনি
শহরে নৈঃশব্দের করুণ কলরব
ঘোর কুয়াশা আটকালো, ও রব!
'বলা হয়নি' জেনেছিলো যামিনী

'তুমি ভোর অব্দি অপেক্ষায় ছিলে'
দখিনা বাতাসে আজও এ বিলাপ শুনি।

জায়গির
সমীরণ ঘোষ 


কাচের ফিনকি খুলে তোমাকে লিখছি
চামড়া ফুঁড়ে রক্তশূন্য হাঁস উড়ে যায়
চাঁদের মাংস মুখে রাত্রিকোরক।ভাঙা কুঠিবাড়ি। ভাঙা নীলচাষ
মদের গন্ধে খুব শীত নামে। লোমের আস্তর লাগে সন্ধের
মিয়ানো ভাষায়। ভেড়ির দিগন্ত থেকে ফিনকির রেল
খোলে অবিচ্ছিন্ন খুনের ইশারা
তোমাকে লেখার খেলা পৃষ্ঠার ঠান্ডা মৃত দেশ
রাত্রি পেঁচিয়ে আনে অবলুপ্ত জিভের নেশায়



অরুণাভ ভৌমিকের গুচ্ছ কবিতা 

১।        দাও।
     

কে যেন কবিতা ছুঁড়ে দিচ্ছে সাদা মেঘের
পর্যটন বৃত্তান্তে, মেঘের স্তব্ধতা চাইছে
উৎসব পরিক্রমা, নিথর ছিটকিনি খুলে
বেরিয়ে আসছে নতুন কবিতা একটুকরো
পাখির বাসার অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র হাতে নিয়ে

টুকি তো মলয়ের বউয়ের নাম
ওদের ব্রিফকেসে সামুদ্রিক ভালবাসা
সে কেন আমাকে দেবে মিনিটে মিনিটে
মিসড কল দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায়
যখন রচিত হচ্ছে জীবন অনুপ্রাস ছন্দে

এতসব দেখেশুনে অতিথি বৎসল একজন
পেরিয়ে যাচ্ছে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন
পেরিয়ে যাচ্ছে এবড়ো থেবড়ো এপিসোড
নোটেশনে চুমুক তার এপিটাফে সমুদ্দুর
শব্দ করে বাড়িয়ে দেওয়া চুমু!

২।    বিড়াল
 

আমার বারান্দার কিনারে
একটুকরো রোদ এসে জড়সড়...

একটা বিড়াল দেখতে পেয়ে
চুপিচুপি সেদিকে এগোতেই
জানালার পর্দাটা একটু দুষ্টুমি করল
আর একটুকরো ছায়া এসে
আর একটুকরো ছায়া এসে...

বিড়ালটা ছায়ার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে
বিড়ালটা ছায়ার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে একটুকরো... আড়মোড়া... টুকরো টুকরো...

৩।   সরলবর্গীয়
  

বিনিময়ে উদ্যোগ থাকে
একাদশ বর্ষে এসে আর এসব মনে হয় না
কাজু কিসমিস - এই নাকি ওর জৌলুস
ওর হাত ভর্তি, ওর দু'হাত ভর্তি
ওতে কি ভয় ধরা আছে!

পরের লাইনে যেতে যেতে আনমনা
একটু যেন আনমনা
লোকটা কি দেখছে   আকাশ নাকি রুমাল
আমাদের সব্যসাচী দেখেনি এমন প্রীতিলতা
আমরা সামুদ্রিক অস্মিতার সরলবর্গীয় অমিত্রাক্ষরে!

৪। ‌‌‌‌‌‌‌। দিন যায়
 

আকাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে আকাশ
জলের থেকে নেমে আসছে জল
আমি তখন একটা মেঘের গায়ে মেঘ আঁকলাম

আমি ধার করি সারারাত
চাঁদের মত নয়
প্রতিক্রিয়াশীল রুমালে থাকে নির্ঝরের গান

আমার আড়াল সে তো আমি-ই
অভ্যস্ত রোদ উদাসীন উদাস

বাবার চশমার গায়ে লেগে থাকে অফুরান মাঠ!

৫।  ছন্দহীন কবিতায় আমার বাবা
              

আমার বাবার গল্পে পাহাড় প্রমাণ স্তব্ধতা
আমার বাবার গল্পে মেলে ভিটেবাড়ির স্নিগ্ধতা

আমার বাবা কোনদিন রবীন্দ্রনাথ শোনেন নি
এমন নয় তার আকাশে মেঘ কখনো ভাসেনি

আমার বাবা তো অজানা গ্ৰামের স্বচ্ছতোয়া নদী
তার ভেলায় চাপেনি কখনো কোন নরভূক যুবতী

আমার বাবা ছিলেন আকাশে ওড়ার জলপথ
আমার বাবা ছিলেন স্বচ্ছ নদীর অবগাহনের স্রোত

আমার বাবা বহুকাল আগের নির্জন এক পুরুষ
পরের জানালায় দাঁড়াননি এমনি সে এক মানুষ

আমার বাবার যাত্রাপথে ছিল যে কাঁটার মুকুট
দীর্ঘ পথের একপাশ দিয়ে হেঁটেছিলেন নিশ্চুপ

আমার বাবার হাতে ছিল কত যে রোদ্দুর গোটা
আমার বাবার বাগানে ছিল কত  অশ্রুর ফোঁটা

আমার বাবার ডাইরীতে কবিতা গড়িয়ে যায়
এককোনে তার লেখা হয়েছিল নষ্ট মতবাদ হায়

আমার বাবার বারান্দা জুড়ে শুধুই গোলাপ চাষ
মরচে পড়া ছবিতে ছিল যে তার শরতের আকাশ

তাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি কিংবা শুধুই ভাঙতে
বাবা ছিলেন বনস্পতি এক শীতল ছায়া পেতে!

৬।    ক্ষিধের এপিসোড ৩৭

           

ঝরা পাতার উঠোনে ভাসে দু'ফোটা অশ্রু
অক্ষরে ধরি না তাকে

অতল কুয়ো, তার একপায়ে চটি
সাদা পাতা শুষে নিচ্ছে মোমবাতির অন্ধকার

অদূরে গ্লাসের বুদবুদে ডুবে যাচ্ছে
গ্ৰাম ও সভ্যতা

পাতা চাপা ঘাসের মত মেয়েটা ছিটগ্ৰস্ত
অশ্রুকণায় ভাসে ওর বিপন্ন বিস্ময়

ভোরবেলা শুষে নিলে শীত, শীতবিন্দু
ঘাসের চাদরে ফুটে ওঠে নরম লজ্জা!

৭। ল্যান্ডস্কেপ
  

রোদের বিনিময়ে পশ্চিমের বৃষ্টিতে সাদা ছবি
উদাসীন মানচিত্রে অবয়বহীন বায়োডাটা

গেরস্থালি ফিরে আসছে ল্যান্ডস্কেপ ছুঁয়ে!

৮।  রোজনামচা
 

মাসিক কবিতাপত্রে ছাপা হচ্ছে জেলখানার দিনগুলি
আনকোরা অস্তিত্বে ভাসছে কত যে এলিমেন্ট

সব গান উপশম হলে হাতের শরীরে এক সূর্যাস্ত!






 প্রিয়জন খুঁজি, পরিজন খুঁজি 
       বিকাশ দাস (বিল্টু )


বিষাক্ত শ্বাসে জলে নোঙর ফেলে দু চোখ 
প্লাবিত জলধারায়  বয়ে যায় বাবার চিতা 

ভাঙনের ভূমিতে দাঁড়িয়ে মাটি খোঁজা, ছায়া খোঁজা 
মেঘের সাথে রোদের কেমন ছায়া আধারি লুকোচুরি খেলা 

পাড়ে  পাড়ে আছড়ে পড়ে জলধারা,কথার কলিরা  থেমে যায় 
            ঢেউ উঠে,বড়ো বড়ো ঢেউ
                                             ভাঙে পাড় 

মাঝি বয়ে চলে নাও
                       এলোকেশী মানসাই পাগলিনী 

প্রিয়জন খুঁজি,প্রিয়মুখ খুঁজি,ভূমি খুঁজি 
ছেড়া পালে তান  খুঁজি, 
                              গান খুঁজি,প্রাণ খুঁজি 
গান ধরি, জল ছলছল চোখে সাগর দেখি
                                              জল শুধুই জল, ভূমি নেই , বাবা নেই 
                    ছাইভস্মও নেই 
                                        শ্মশানও নেই 

            বিলীন সব মানসাইয়ের গর্ভে
ভালোবেসে
রৈবতী বন্দোপাধ্যায়


তোর চোখেতে মায়া কাজল

ভালোবাসায় আঁকা,

তোর বুকেতে রঙ্গীন স্বপন
আদর সোহাগ মাখা,
কিশোর বেলার যে সব ছবি
স্মৃতির মুকুরে ভাসে
জীবন নদী বয়ে চলে
তুই তো নেই পাশে,
পুতুল খেলা ,সাঁতার কাটা
সেসব গেলে চলে,
মাথার চুলে রূপালী রেখা
সময় কথা বলে।
ভালোবেসে মনের আশায়
কাটিয়ে দিলাম দিন,
মনের খাতায় আঁকা আছে
সেই স্বপ্ন,রঙ্গীন।
আমি তো আজ ভালোই আছি
তুই পরবাসে,
এই জীবন যদি চলে যায় 
পরজীবন তো আসে।
হয়ত 
সোমনাথ বেনিয়া



দাঁড়িয়ে থাকা সহজ নয় বলে গাছ হয়ত ছায়া দেয়
জলের উপরিতল শান্ত, বিষাদ বাতাস উদাস কোথাও
হয়ত নিয়ম, তাই কি চিলেকোঠায় দুপুর আরামপ্রিয়
প‍্যাঁচালো সিঁড়ি বেয়ে নির্জনের বিনুনি ঝোলে, কোমল
তখন‌ই ফেরিওয়ালার ডাক গলির বাঁকে কাকভোর
ইচ্ছে নিয়ে প্রেমিক মন নিষেধের রাতে দুরন্ত খেলা
এই হারিয়ে যায়, কোন হৃদয় তার চেয়ে বেশি বলো
নিজের অক্ষরের বিবৃতিসূচক বাক‍্য চাওয়া
দেখো, পরিদের যাতায়াত মেঘের নিঝুম লিপিমালা
কিছু ভুল অপরিহার্য সুগম নিশ্বাসে, পড়ন্ত বিশ্বাসে!
কবিতা 
মন্মন্তর যাপন
দেবাশীষ চট্টোপাধ্যায়

যথেষ্ট খিদের জন্মে,এখনো পোষা ভাতের মুখ থেকে ঢেকুরের ক্লান্তি নামেনি,ক্রমেই বাসি বরফের ছায়ায়,ছিদ্র ছিদ্র হয়ে ফুঁটে উঠি এমন!
আজ তীব্র প্রতিধ্বনির তৃষ্ণা মেটাতে,আমি আর আমার চরিত্রের পিঠে পলাতক সংকেত টেনে দেখেনি-ওরা কেউ মানুষ নয়,ওরা কোন যান্ত্রিক জলচাবিও নয়,শুধু দীর্ঘযৌবন কামড়ে একটি শিশুর জন্মকালীন আঙ্গুলে স্পর্ধার পতাকা বেধেছে!অনুর্বর নদী চেয়ে প্রতিটি মাসুলের উচিত চোখে রুমাল বেধেছে,এক এক করে গুনে নিয়েছে দেহের সমস্ত রং,আরো কাল্পিকছায়ার লব্ধিকরনে,সভ্যতার গণিততত্ত্ব খুলে দেখেছে,শত মন্মন্তর আলোকবর্ষ কিছু!
ঝুরোগল্প 

কাজল সেন 


রিমঝিম বৃষ্টি 

সময়ের বৃষ্টি বলে এখন আর কিছু হয় না।  নিয়ম মেনে বর্ষাকালের দুটো মাস টানা বৃষ্টির দিনগুলোর কথা ভাবলে মনটা উদাস হয়ে যায় রঘুবরের। আহা! সেসব কী দিনই না ছিল! প্রচন্ড গরমের দিনগুলো কোনোরকমে পার করে বর্ষার জলে চুপচুপে ভিজে ফুলে ঢোল হবার মজাটাই ছিল আলাদা। ঘরে সদ্য আসা নতুন ছোটবৌমাকে সেইসব হারানো দিনের গল্প করতে বসে চোখদুটো কখন যেন জলে ভরে ওঠে তাঁর। নতুন ছোটবৌমা অবাক হয় তার নতুন দাদাশ্বশুরের ভাবাবেগ লক্ষ্য করে। তার অবশ্য কোনো দোষ নেই। সে বেচারি তো জন্মেই ছিল বর্ষার খটখটে দিনে। সে বছর সারা বর্ষাকালেই ভালো বৃষ্টি হয়নি। ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই জলের অভাবে সরাসরি খড় হয়ে গেছিল। চারিদিকে আকাল। বাজার অগ্নিমূল্য। সাংঘাতিক গরমে অনেক মানুষ নাকি পাগলাও হয়ে গেছিল। এসবই অবশ্য তার শোনাকথা। তার তো কিছু বোঝার বয়সই হয়নি তখনও। একটু বড় হয়ে অবশ্য সে জেনেছে, প্রাকৃতিক এইসব বিপর্যয়, মানে সারাবছর ধরেই গরমের লাম্পট্য, শীতে ঠান্ডার অহেতুক টানাটানি অথবা বাড়াবাড়ি, বর্ষাকালে আকাশে কালো মেঘের নিষ্ঠুর কৃপণতা, এসবই নাকি এখন প্রাকৃতিক  স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই সবকিছুর জন্য দায়ী অন্য কেউ নয়, বরং মানুষ নিজেই। নতুন ছোটবৌমা বোঝার চেষ্টা করে, তার দাদাশ্বশুরের এই যে হারানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে মনোবেদনা, তার সঙ্গে  কি মিশে আছে মূর্খ ও জ্ঞানপাপী মানুষের অজ্ঞানতা ও স্বার্থপরতার জন্য ধিক্কারও!

রঘুবর গল্প শোনান নতুন ছোটবৌমাকে, বুঝলে নতুন ছোটবৌমা, একদিন ঠিক তোমার মতোই নিতান্ত ছেলেমানুষ টুকটুকে ফর্সা কাজলটানা চোখ টলটলে লাবণ্যে ভরা আমার নতুন বৌকে নিয়ে এসেছিলাম এই ঘরে। তখন বর্ষাকাল। সারা আকাশ জুড়ে ঘোলাটে গভীর মেঘ। আর সেদিন কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! সব কিছু যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবার জোগাড়। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছিল। মজা লাগছিল। কালরাত্রি পার করে পরের দিনই ছিল বৌভাত আর ফুলশয্যা। আমার তো আর তর সয় না! বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি আর ঘরে ফুল দিয়ে সাজানো পালঙ্ক,  সে যে কী রোমান্টিক ব্যাপার!

রঘুবরের কথার ধরনে লজ্জা লাগে নতুন ছোটবোমার। কীসব যে বলেন দাদাশ্বশুর! সে তো এই দিন পনেরো হলো এসেছে বাড়ির বৌ হয়ে। ফুলশয্যার রাত এখনও তার মনে টাটকা, তরতাজা। তবে শ্রাবণের এই দিনগুলোয় আকাশে নেই মেঘের ঘনঘটা, কানে ভেসে আসছে না নিরন্তর বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। বরং গুমোট আবহাওয়া শরীরটাকে অস্থির করে তুলেছে। বিনবিন করে ঘাম বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে যাবতীয় অন্তর্বাস। চিটচিটে আঠালো কী যেন লেপ্টে আছে আপাদমস্তক।

কথা বলতে বলতে রঘুবরের দুটো চোখ কখন যেন বুজে আসে। অনেকদিন হলো স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে। চোখ বুজে আসে নতুন ছোটবোমারও। অদেখা দিদাশাশুড়ির শরীরের আদল তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। সে অনুভব করে, আকাশটা কখন যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আর রিমঝিম বৃষ্টির শব্দে তার শরীর এক  আশ্চর্য শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে।   

ঝুরোগল্প

কাজল সেন


রিমঝিম বৃষ্টি

সময়ের বৃষ্টি বলে এখন আর কিছু হয় না।  নিয়ম মেনে বর্ষাকালের দুটো মাস টানা বৃষ্টির দিনগুলোর কথা ভাবলে মনটা উদাস হয়ে যায় রঘুবরের। আহা! সেসব কী দিনই না ছিল! প্রচন্ড গরমের দিনগুলো কোনোরকমে পার করে বর্ষার জলে চুপচুপে ভিজে ফুলে ঢোল হবার মজাটাই ছিল আলাদা। ঘরে সদ্য আসা নতুন ছোটবৌমাকে সেইসব হারানো দিনের গল্প করতে বসে চোখদুটো কখন যেন জলে ভরে ওঠে তাঁর। নতুন ছোটবৌমা অবাক হয় তার নতুন দাদাশ্বশুরের ভাবাবেগ লক্ষ্য করে। তার অবশ্য কোনো দোষ নেই। সে বেচারি তো জন্মেই ছিল বর্ষার খটখটে দিনে। সে বছর সারা বর্ষাকালেই ভালো বৃষ্টি হয়নি। ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই জলের অভাবে সরাসরি খড় হয়ে গেছিল। চারিদিকে আকাল। বাজার অগ্নিমূল্য। সাংঘাতিক গরমে অনেক মানুষ নাকি পাগলাও হয়ে গেছিল। এসবই অবশ্য তার শোনাকথা। তার তো কিছু বোঝার বয়সই হয়নি তখনও। একটু বড় হয়ে অবশ্য সে জেনেছে, প্রাকৃতিক এইসব বিপর্যয়, মানে সারাবছর ধরেই গরমের লাম্পট্য, শীতে ঠান্ডার অহেতুক টানাটানি অথবা বাড়াবাড়ি, বর্ষাকালে আকাশে কালো মেঘের নিষ্ঠুর কৃপণতা, এসবই নাকি এখন প্রাকৃতিক  স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই সবকিছুর জন্য দায়ী অন্য কেউ নয়, বরং মানুষ নিজেই। নতুন ছোটবৌমা বোঝার চেষ্টা করে, তার দাদাশ্বশুরের এই যে হারানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে মনোবেদনা, তার সঙ্গে  কি মিশে আছে মূর্খ ও জ্ঞানপাপী মানুষের অজ্ঞানতা ও স্বার্থপরতার জন্য ধিক্কারও!

রঘুবর গল্প শোনান নতুন ছোটবৌমাকে, বুঝলে নতুন ছোটবৌমা, একদিন ঠিক তোমার মতোই নিতান্ত ছেলেমানুষ টুকটুকে ফর্সা কাজলটানা চোখ টলটলে লাবণ্যে ভরা আমার নতুন বৌকে নিয়ে এসেছিলাম এই ঘরে। তখন বর্ষাকাল। সারা আকাশ জুড়ে ঘোলাটে গভীর মেঘ। আর সেদিন কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! সব কিছু যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবার জোগাড়। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছিল। মজা লাগছিল। কালরাত্রি পার করে পরের দিনই ছিল বৌভাত আর ফুলশয্যা। আমার তো আর তর সয় না! বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি আর ঘরে ফুল দিয়ে সাজানো পালঙ্ক,  সে যে কী রোমান্টিক ব্যাপার!

রঘুবরের কথার ধরনে লজ্জা লাগে নতুন ছোটবোমার। কীসব যে বলেন দাদাশ্বশুর! সে তো এই দিন পনেরো হলো এসেছে বাড়ির বৌ হয়ে। ফুলশয্যার রাত এখনও তার মনে টাটকা, তরতাজা। তবে শ্রাবণের এই দিনগুলোয় আকাশে নেই মেঘের ঘনঘটা, কানে ভেসে আসছে না নিরন্তর বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। বরং গুমোট আবহাওয়া শরীরটাকে অস্থির করে তুলেছে। বিনবিন করে ঘাম বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে যাবতীয় অন্তর্বাস। চিটচিটে আঠালো কী যেন লেপ্টে আছে আপাদমস্তক।

কথা বলতে বলতে রঘুবরের দুটো চোখ কখন যেন বুজে আসে। অনেকদিন হলো স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে। চোখ বুজে আসে নতুন ছোটবোমারও। অদেখা দিদাশাশুড়ির শরীরের আদল তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। সে অনুভব করে, আকাশটা কখন যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আর রিমঝিম বৃষ্টির শব্দে তার শরীর এক  আশ্চর্য শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে।   

নীলকণ্ঠ(অনুগল্প )
কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর
 


ঘড়ির কাঁঁটায় তখন প্রায় দুটো। হঠাৎ বিছানায়  উঠে বসলো। সামনের দেওয়ালে টিকটিকিটা একটা পোকাকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই খপ্ করে ধরে ফেলল। পাশে স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে ঘুমাচ্ছে। আশ্বিন মাস পড়ে গেছে। হালকা ঠাণ্ডা পড়েছে। ফ্যান চলছে। অনুপম বুঝতে পারলো, তবু সে দরদর করে ঘামছে। "অভিরূপ স্যার বলতেন--অনুপম তোর কলেজে পড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে। সে যাইহোক চাকরিটা সে নিজের যোগ্যতাই পাই না। পার্টি করে দিয়েছে।" জানে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার।  এ-ও জানে কেউই জানবে না। মনে রাখবে না। তবু এইটাই তাকে অনেকরাত্রি ঘুমাতে দেয়নি।   
--কী গো আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছো?
স্বপ্নের বিষয়টা নীলা আগে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে, আর করেনা।এর উত্তর হয়তো কোনদিনই পাবে না।

প্রবীর রায়ের অনুগল্প 

ছায়াপথ


ছায়াটা গুটিয়েছিল পায়ের কাছে।এবার আস্তে আস্তে লম্বা হতে চাইল।একটু ডানদিকে হেলে তাকিয়ে রইল।সবুজ ঘাসের এই একটুকরো মাটিকে বাগান বানানো যেত।কিন্তু ধার দিয়ে কয়েকটা জবা আর পাতাবাহার গাছ ছাড়া আর কাউকেই জায়গা দেওয়া যায়নি।শীতের দুপুরের রোদ্দুর আর নিজের সাথে ছায়ার খেলাটা পিঠ জুড়ে আরাম ছুঁয়ে থাকার মত। কৃষ্ণ এলো এমন সময়।

দাদা,কেমন আছেন?
ভাল,তুমি?
একটু বুঝতে এলাম,দাদা।আমি এই দেশের লোক,এর নাকি প্রমাণ দিতে হবে?
আজ কাজে বেরোও নি?
যাবো দাদা।কাল ভবেশ বলছিল, প্রমাণ না দিতে পারলে নাকি ক্যাম্পে আটকে রেখে দেবে?
একটা ছায়া দুলে উঠল।আর একটা ছায়া স্থির।

তোমাকে তো ছোটবেলা থেকে দেখছি। তুমিতো এদেশেরই লোক।
হ্যাঁ,সবাই জানে তো। আচ্ছা,পঞ্চায়েত প্রধান যদি লিখে দ্যায়?
দরকার নেই,তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। মন্ত্রীমশাই বলেছেন,হিন্দুদের ভয় নেই।
কিন্তু ভবেশদার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল আসামে।ওকেও তো বিদেশী বলেছে। অনেক হিন্দুও নাকি ক্যাম্পে আছে।
এই বাংলায় ওসব হবে না
হলে পরে কীভাবে বাঁচবো দাদা?

পাশের বাড়ীর ছায়াটা বড় হতে হতে দুটো ছায়াকে ঢেকে দিল। আলো কমে আসছে কৃষ্ণের মুখে। রোদ সরে যাওয়ায় অল্প ঠান্ডা ভাব।

আসি দাদা, কাজে যাওয়ার পথে একটু দেখা করে গেলাম।

যে মাটিতে জন্মালো ,বড় হলো, সেই মাটি হয়তো তার আর থাকবেনা।কার কাছে গেলে নিশ্চিন্ত হতে পারে ,ভাবতে ভাবতে কৃষ্ণ ছায়ার রাস্তায় ডুবে যেতে থাকে।
সত্যম ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত গদ্য 
এক চিলতে আলো
                           

    শীতকাল আসলেই আমাদের পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয়।ঝুপ করে নেমে পড়া সন্ধ্যেতে কখন যে ঢেকে যায় মানুষজন-মাঠঘাট-বাড়িঘর।কোনো কোনোদিন পাড়ার আলো জ্বলে না আর সেদিন  কি ভালোই যে না লাগে এই অন্ধকার।তখন ব্যালকনিতে বসে বসে লোকের কাজ শেষে ঘরে ফিরে যাওয়া দেখা যায়।এমনিতে অন্ধকার, কিন্তু আকাশের আলো তখোনো মুছে যায় নি।পশ্চিমদিক থেকে কে যেন গাঢ় কমলা রঙ ছড়াচ্ছে সেখানে।তখনই কোথা থেকে যেন মনের বারান্দায় এক চিলতে আলো এসে পড়ে।কোন বাড়ির জানালা থেকে এই আলো তা ঠিক বোঝা যায় না।হতেও পারে বা এ চাঁদের আলো।তখন দুধ সাদা জ্যোতস্নায় ধুয়ে যায় আমাদের চরাচর-ছাদ- ছোট্ট একটু মাঠ-পেছনের বাড়ির পুকুর।সেখানে তখন পাড়ে এসে চুপ করে পিঠে আলো নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে মহাশোল মাছ।কবে যে তাকে পাহাড়ী নদী থেকে কে তুলে নিয়ে এসে এই পুকুরে ছেড়েছিলো কে জানে।সে কি একা না কি কোন সঙ্গী আছে তার সেখানে বা হয়তো প্রেমিকা।
   সামনাসামনি হওয়াতে কত কথাই না বলা রয়ে গেলো আমাদের।অসংখ্য বুদবুদে সূর্যের আলো পড়ে রামধনুর যে রং ছড়ালো তা মিলিয়ে গেলো অচিরেই।তখন শুধু শীত আর কুয়াশা ছড়িয়ে থাকতো আমাদের মফস্বলে।হাত ছাড়িয়ে চলে যেতো কেউ আর ঘন গাঢ় কুয়াশায় মিলিয়ে যেতো সে।সে সময় এতো ক্রিসমাস আসেনি।আসেনি এত কেক-প্যাস্ট্রি-প্যাটিস।আর্চিস যেন কাকে বলে?না এসব নাম স্কুলে শুধু বলে এলিট ক্লাসেরা।তখন মনে রঙ লেগে ডানা মেলতে শুরু করেছে প্রজাপতির পাখারা।শুধু উড়ে উড়ে বেড়ায় সারাক্ষণ।সারাদিন চোখের সামনে বাস থেকে হাত নেড়ে চলে যায় ড্রিমগার্ল।নড়ে চড়ে ঘুরে বেড়ায় বইয়ের পাতায়।তার স্কুলের কমলা স্কার্ট থেকে রঙ লেগে লেগে রঙ্গীন হয়ে যায় আমাদের মফস্বলের পথঘাট।
   সন্ধ্যে নামে।দলা দলা কুয়াশারা জড়ো হয় দূরে হ্যালোজেন আলোর চারপাশে।আর তারপর উড়ে যায়।আসে বড়দিন।প্রেমের কথা বলতে বুকের বাজনা খুব জোড় বাজে।সে যখন বাড়ি ফিরে যায় সন্ধ্যেবেলায় মোড়ের মাথা থেকে হাঁটতে হাঁটতে,তার এই চলে যাওয়াটি হয়ে ওঠে সব থেকে মনোরম।এই তো মোক্ষম সময় বলার।এইরকমই একটি সন্ধ্যের প্রতিক্ষায়ই তো সে ছিলো জীবনভর।বহু কষ্টে পয়সা জমিয়ে শহর থেকে উড়ে চলে আসে আর্চিস আর তার নিল খাম ধীরে ধীরে রং ভরে নেয় নিজের হৃদয়ে।যেন তাকে নিয়ে সে পাড়ি দেবে কোনো স্বপ্নের দূরদেশে।হৃদয় নিঙড়ে আসা আসা সে রঙ গাঢ় হতে থাকে শীতের সন্ধ্যেয় লেপের নীচে।বাড়ির ভয়ে সমস্ত কিছু গোপন।ওদিকে আজ একটা কিছু যা হোক হয়ে যাবে।তো সেই সন্ধ্যেতেই হাঁটতে হাঁটতে যখন সে ফিরে যাবে, হাঁটু গেড়ে বসে চেয়ে নিতে হবে তার হাত।হোক না তা পাড়ার এঁদো গলি,তবু আজ সেখানেই নামবে জন্নত।
   কিন্তু কি যে হয়।সেই সন্ধ্যেতে ড্রিমগার্ল আর পথে নামে না।আর ওদিকে সান্ধ্য খবরে প্রকাশ পায় সংবাদ-কাল তারা বড়দিনের ছুটিতে।একি মোক্ষম পরিহাস।এতবড় আর্চিসকে কোথায় লুকোনো যাবে আজ।কোথায় আজ সেই মনোরম চলে যাওয়াটি।ধীরে ধীরে ক্রমঃশ নিথর হয়ে আসে পথঘাট-রাস্তা-মানুষজন।শীত যেন আরো চেপে বসতে থাকে মনের ভেতর।কি করবে-কোথায় যাবে-কে রাখবে বুকের ভেতরের পতপত ওড়া এই নিশানটি,কিচ্ছু বোঝা যায় না।আর তো কোনদিন উড়তে পারবে না সে।নিজেকে মেলে দিতে পারবে না আর বাতাসে।সব কিছু শেষ হয়ে গেলো আজ এই শীতের সন্ধ্যায়।এরপর রাত বাড়বে।গুড়ো গুড়ো রেণুর মতো ঝরে পড়তে থাকবে হিম।আরো গাঢ় হবে কুয়াশারা।তার চেয়ে থাক।সব থাক বুকের ভেতরকার এই পকেটের গোপন অন্তরালে।টুকরো করে ফেলা যাক এই তিল তিল করে গড়ে তোলা আর্চিস।ডানা ছেড়া প্রজাপতির মতো তারা ঝরে ঝরে পড়ুক জঙ্গলে আর জঞ্জালে।শীত বাড়ুক,এতো বাড়ুক যেন সব জমে যায়,এই বুকের ভেতরের মরে যাওয়া প্রেমের মতো।আর কিছু তো পারা যাবে,বরং কড়া তামাকই একমাত্র পারে আপাতত সব ভোলাতে।তাই একের পর এক সব জ্বলে পুড়ে যাক সেই নেশায়।টলতে টলতে আর শীতে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকার সেই সন্ধ্যায়,এমনই এক চিলতে আলো এসে পড়েছিলো মুখের ওপর।কোথা থেকে যে এসেছিলো সে আলো বা আজো যে কোথা থেকে আসে সে তা বোঝা যায় না।তবু বড় ভালো লাগে এই আলোকে-অন্ধকারকে-সেই সেদিন থেকেই আজন্ম সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে যে তারা।

মধ্য যামিনী ও অতঃপর
অর্থিতা মণ্ডল


মধ্যযামে কফিন থেকে বেরিয়ে আসে শোক
অতঃপর আপনি পানপাত্র তুলে ধরেন
এদিকে অস্থি ভেসে যাচ্ছে পুণ্যতোয়া জলে
পুড়ে যাওয়া গেরস্থালি ঠোঁটে নিয়ে কবে যেন উড়ে গেছে শকুন।
পানীয় হাতে  আপনি উন্মুক্ত আগুন হলে
চিত্রকরি গুহা নারী পবিত্র গোষ্ঠি মাতা
বহুবার ফিরে আসে সে তুমিও চুমুক দাও খুব
এভাবেই জমে ওঠে শোক বারবার জমিয়ে  রাখো অনন্ত প্রহর,
এ'এক কবর স্থান প্রাগৈতিহাসিক নিরুপায় সংকেত
আপনিই ঈশ্বর হন গুহা নারীর ভ্রূণে ঈশ্বরী রোপণ
অকহতব্য
অনিরুদ্ধ দেব



ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখলে বুকের ভিতর থেকে উঠে আসে পুরনো শ্রাবণের মাইজভান্ডারী গান।
উঁচু টিলার ওপর উবু হয়ে বসে তাকিয়ে আছি দূরে, অনেক দূরে
যে দূরত্বে কেউ কারোর নয়। সব ধ্রুবক। সব সত্য।
দিগন্তের কাছে ধানের শীষে জমে আছে অগ্রহায়ণের ভার্জিন শিশির 
কুমারীর স্তনের মতো।
জলের ছায়ার ভেতর থেকে উঠে আসছে সারি সারি জাফরানি প্রজাপতি।
জোনাকির নিওন আলোর মতো করে তার রূপ দেখে বটের পাতায় একদিন লিখেছিলাম সারেগামার সুরেলা ষড়যন্ত্র।
আকাশের আজ মন খারাপ। বোধহয় মেঘের অশ্রুর সাথে ঝরে পড়বে আমাদের সব অকহতব্য ধ্বনিমধুর শিলালিপি।
প্রহর

মিতালি চক্রবর্তী 

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তমতে অপরাহ্ন আমাকে গিলে খায়,উপভোক্তার মত। 
আমি অভ্যাসের আশাবাদ চর্চা করি আপন শরীরে, 
সমস্ত মেদুরতা অনায়াসে ধারন করি
গর্ভকালীন অবসাদে। 
শাস্তির বহনযোগ্যতা 
গ্রাস করে আমাকে, 
স্পর্ধায় তুলে নিই ঘাড়ে
ভারী দন্ডপতাকার, 
অজানা শক্তির অপার
শাস্তির জন্য নতজানু হয়ে থাকাটাই ভবিতব্য মেনে নিয়ে সীমান্ত ঘেরাটোপে বসে পড়ি,,,
তুমুল বৃষ্টির শব্দে 
যেখানে শব্দের ফোঁটারা লাল
ভিজে গেছি কতবার সেই ধারাপাতে। 
ব্যথা এবং উচ্ছাস 
ষুগপৎ আঁকড়ে ধরে আমাকে সশরীর 
আত্মিক আস্কারায়,
ভেজা জনমপঞ্জিকার সময়সারনীতে
অনিচ্ছার স্বেদবিন্দুতে 
সোহাগ মিলিয়েছে চূড়ান্ত বিরোধে।।


হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের  দীর্ঘ কবিতা 
অন্য সুরের বৃত্তে





" কোথায় তুমি ! " ------
কথা শুনে তুমি এত রেগে গিয়েছিলে
যেন এক আকাশ রোদ্দুর পেরিয়ে
মুখ চোখ লাল করে বাড়ি ফিরেছিলে
আমি তো অত কিছু ভাবি নি
দেখতে না পেয়ে মন বলে ফেলেছিল
যেভাবে হাওয়ার যাত্রাপথ থেকে
একটু সরে গিয়ে হাওয়ার বয়ে যাওয়া দেখে
আমি সর্বত্র তোমাকেই দেখতে চেয়েছিলাম
দুপুর থেকে একটু একটু করে রোদ সরে গিয়ে
দিনের সারা শরীর কেমন পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিল
সবাই আমাকে পাড়ার পুরোনো বটগাছের নিচে
আমার ঠাকুরদার কাছে নিয়ে গেল
কেউ তো আমাকে চেনেই না
জামা পুরোনো হলেই কি পুরোনো হয়ে যায় ?
আমি মুখ খুলতেই সবাই আমাকে লাথি দেখালো
আমার কথার যত গয়না ছিল
সব ওরা টেনে খুলে ফেলতে চাইলো
গয়নাই আমাকে রাস্তা দেখিয়ে এনে
নদীর ধারে বসিয়ে দিল

ডাকের মধ্যে কে যেন শুনতে পেয়েছিলো
চারদেয়ালের গণ্ডির স্থবিরতার গানের সুর
পায়ের গতিবিধি দেখে
অনেকে নাকি বুঝতে পেরেছিল
আমি অধিকারের গণ্ডি পেরিয়ে
অনেক দূরে চলে যেতে চাই
শীতের রোদে পিঠ দিয়ে
সবাই গল্প জুড়ে দিয়েছিল
বসন্তকালের কাক ডাকা ভোরের গল্প
ঠাণ্ডা হাওয়ায় কেউ পাশ ফিরে শোওয়ার কথা ভাবে নি
একজনও কেউ তার পাশের জনকে খোঁজে নি
এখানে আমার ডাক নিয়ে 
গল্প হওয়া তো দূরের কথা
একজনও কেউ আমায় নিয়ে আগ্রহ দেখায় নি
শুধুমাত্র ডাকের এক ভিন্ন সুরের জন্য
আমার গায়ে ভিন গ্রহের ছাপ দিয়েছিল
জেনে গিয়েছিলাম আমার সুরে 
গলা মেলাতে একজনও কেউ জেগে উঠবে না
নদীর পাড়ে এখন আমি হাত পা ছড়িয়ে বসে
জলের গভীর তলদেশ থেকে
যে সুর আমার বুকে আশ্রয় নিয়েছিল
তাকে এখনও তেপান্তরের মাঠ দেখানো হয় নি

আমি সবকিছু ভুলে যেতে চাইছিলাম
যেন আমার সঙ্গে কারও কিছুই হয় নি
যা কিছু দোষ সব আমার সুরের
চেনা মুখের আড়ালে সব সরিয়ে নিয়ে গিয়ে
আবার ভোরের অপেক্ষায় থাকব

নদীর পাড়ে শুয়ে আমি সারারাত গান শুনবো।

অনুরূপা পালচৌধুরী।

জলগুল্মের জাবরান 


হাঁটছে না হাপিত্যেশ তেঘড়ি মাঘের নিমকাঠ
ঘুমলেস মরিচ অবশিষ্ট দরজার লুম্বিনী চাঁদপাশা
চার্চিল চুমুদের তড়িঘড়ি ১জোড়া জলবায়ু
আগুনের পেশী খুঁড়ে কেমোটিক টার্সেল
মেঘ টানলে বেকসুর ময়দান দানোমেলেই
জ্বর খুনে কবুলিক লিকটাউন মুরশেদ 
শিটমহলের ডানা টুপ টুপ টোকা পান্ডু
কপচার ফেলে স্টাপুলিড চার্মমেঘ
পোকার সাদায় ঘটফিল কাটা জাহান্টম

মেঘ অদিতির কবিতা 

চড়ুই 
অত্রি ভট্টাচার্য্য



কাছাকাছি যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে, বলো রেলিঙের
বক, তাঁর বাধ্য মাছ, তোমরা
কি সন্ধির কথা ভাবছ? এই কমাদাড়ির
আবহ যার রচনা, অদ্বৈতে দ্বিরাগমন
বন্ধুরা কষ্ট ক’রে তুলে ধরেছে। আজও ধরছে।
পটের শরীর থেকে মালার নীল
খসে খসে পড়ছে, নদী থেকে
অনেক দূরে।
লোকবসতীতে।

ক্ষয়ীষ্ণু বিনুনীটি ছাড়া সবই, সমর্পণসহ,
কটু ও বিস্বাদ। প্রাপ্তির নাম চড়ুই, তার
ফ্যাকাশেও বস্তুতঃ হতাশা, সম্পর্কের
অনেকদিন ফুরোতে ফুরোতে
হাতে তালি পড়ে থাকে। দুধ
অনাথ হয়ে বয়ে যায়।
অনুচিতের নুড়ি ধরে টানাটানি চলে
সারা বসন্তশহর।

সবাই তো উড়ছে হে পাখি তোমার
মনোপলি বস্তুতঃ অন্তর্হিত তোমার প্রাণের গাছ
আজ আর তোমাকে নেয় না। শব্দ দিয়ে
ঘেরাও হচ্ছে না ফাঁকা শীতপ্রাসাদ এ কন্ঠবিপ্লব
ফুরিয়ে পাথর। আজ তোমার ঘনিষ্ঠ গান-ও
দরজার অভাবে ভেঙেছে ।
তার নিষ্ক্রিয়তার শর্তে কোনও বাড়ি আর
কোলাহলে নেই।

অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা 

চিত্র ঋণ : টনি এন্ডারসন


বেহালার ছড়, 
আর হাঁটু ছড়ে
ছোটবেলার খেলা। 
বাতাসে বিষণ্ণতার মৃদু আয়োজন।।
শব্দ দিয়ে শঙ্খপ্রদীপ 
গড়িয়ে নেবার আঙ্গিকে 
রাতের মনে শ্রবণ পেল 
দৃশ্য জোড়া সঙ্গীকে

৩ 
মনে পড়লে তোকে,  
মধ্যিরাত ফিরিয়ে দেয়, 
সফেন সুদূর প্রভাত।। 
সূর্যাস্ত পরবর্তী ধূলিকণা,  
গোধূলি না বলে,  
নাম দিলাম তার, 
ভালোবাসা।।

৩ 
কুয়াশার নাম রাখলাম হেমন্ত।  
অন্যপ্রান্তে কার স্বর শোনা যায়? 
জঙ্গল পেরিয়ে চেলো বেজে ওঠে।  
আজ কোমা রিপোর্টের নাম দিয়েছি 
বিশ্বস্ত ভালোবাসার চিঠি।  
দিগন্তে সন্ধ্যা নামেনি তখনো, 
কে যেন বলেছিল তখনি,
'ওপারে একটা পিয়ানো রাখা থাকবে।'
ঠিক জেনো, ঠিক যেন, অধরা
হারমোনিকা আর বসন্তমালতীর সুবাস খেলবে। 
সেদিন ভায়োলিনের আদরে ডাক দেব হেমন্তকে,
বলবো, 'ওহে বিধুরা, ওপার যে নেই, হয় না তো!
এপারেই চলো বাজাই বিষণ্ণতার অফুরান বাঁশি।'


অশ্লীল কবিতারা

পৌলমী গুহ



তীব্র হতে হতে হয়নি,
এমন বেদনায় আড়ি পেতে থাকি।
দাগ মিটে গেলে,
অনুরোধ এঁটো লাগে।
আর কোনোও ঘোলাটে ব্যথা
বারবার মনে করিয়ে দেয়,
আমারও আবেগ ছিলো।



ঈশ্বর বহমান।
এই ভরসায় ভেড়া গুনে চলি।
অথচ, ঘুম ঘোড়ায় পরিণত হলে,
সকাল কেমন মৃত হয়।




একটি বেদনার কান্ডারী,
শরীর ঘেঁটে অশ্রু ধার করে।
অপরজন কাব্য।
উভয়ের যোগাযোগ নেই।

উদয় সাহা 

|| দুটি কবিতা ||


১.সময় যাপন 


বুকে বুকে জ্বলে আগুন
মুখে মুখে ঘোরে নৈঃশব্দ
সীমান্ত শুধুই রক্ত চায়

হাতে হাতে থাকে বারুদ
চোখে চোখে স্থায়ী হিংসা
বিপ্লব শুধুই রক্ত চায়

ঠোঁটে ঠোঁটে ছোটে ভয়
পায়ে পায়ে বিভাবরী
সন্ত্রাস শুধুই রক্ত চায়

দিকে দিকে ছবি ঘৃণার
মাঠে মাঠে  কনভয়
যুদ্ধ শুধুই রক্ত চায়

জেগে থেকে কিংবা শুতে
রক্তক্ষয় যেকোনো ইস্যুতে ... 


২. ভোরের দিব্যি 

আমি শত্রুকে সূর্য ভাবি 
ভিজে চিড়ার দেশ ; ধুম 

আমাদের ভাতের থালায় রাত
শাসক মানে বিলাসজনিত ঘুম 

সর্বনাম সব ঘুচে যাক 
ভোরের নাম থাকুক গ্রামে 

জল দিয়ে লেখা হোক গান 
আমাদের ভাইয়েরা সব এক খামে  

ফাঁকা মাঠে দোল খাক শাড়ি 
সৈকতে স্বপ্নের আনাগোনা

ভেঙে যাক মূক - বধিরের ঘর  
ভুল হোক গোধূলির জাল বোনা 

এই টুকুইতো বাঁচা ---
শীতের রোদ, সাদা বকের ভ্রমণ 

আমি শত্রুকে সূর্য ভাবি   
পুব থেকে পশ্চিমে গমন