Monday, June 15, 2020

কবিতা করিডোর , জুন সংখ্যা , ২০২০

কবিতা করিডোর , জুন সংখ্যা , ২০২০
সম্পাদক : শুভঙ্কর পাল
সহ সম্পাদক : সব্যসাচী ঘোষ
উত্তর পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক : রাজেশচন্দ্র দেবনাথ
বাংলাদেশ বিভাগের সম্পাদক : ফারহানা রহমান
প্রচ্ছদ : মনতোষ বসাক
চিত্র ঋণ : গুগল ইন্টারনেট
ইমেল : subhabrb@gmail.com
বি .দ্র. : লেখা শুধু মেইলে পাঠালে গৃহীত হবে ।

সম্পাদকীয় :
ঘড়িতে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় ঘণ্টা বাজে । আসলে সময় থমকে থাকে না । সারা পৃথিবী যখন সংকটে তখনও সে চলছে । শুধু জীবন ও জীবনের অর্থগুলো বদলে যাচ্ছে । হয়তো সব একদিন ঠিক হবে ! এই বিস্ময়ের ভিতর আশাবাদের বীজ লুকিয়ে আছে । আবার পাখিরা গান গাইবে । বাঁশী নিয়ে ম্যান্ডেলা তার রিক্সাটা ঠিক চালিয়ে নিয়ে যাবে এই মেঠো পথে । আমরা পুবের সেই সূর্যোদয় দেখবার জন্য অপেক্ষায় থাকছি ।
সীমিত পরিসরে কিছু লেখা নিয়ে কবিতা করিডোর জুন সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে । লেখায় পরিবেশিত সমস্ত তথ্য ও লেখার যাবতীয় দায় লেখকের । উপস্থাপনায় কিছু ত্রুটি থাকলে সে সব দায় সম্পাদকের ।
ধন্যবাদ ॥ 
সিঁড়ি  
 অমিত কুমার দে 
চিত্র ঋণ : মনতোষ বসাক 

সিঁড়িটার সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি কোনদিন
আসা যাওয়ার ফাঁকফোকরে ওই যতটুকু যা
আমার পায়ের পাতা পায়নি খুব একটা
                      জুতো বা চটির নিচটুকুই সই
কখনো বসা হয়নি তার কোন ধাপে
সিঁড়ির হাতলে হাত দিয়ে
                     দাঁড়িয়েছি বলেও মনে পড়ে না
সবচেয়ে দ্রুতগামী সময়টা অদ্ভুতভাবে
                     সিঁড়ির বেলাতেই ঘটে গেছে
ফিরবার সময় সিঁড়ি তাকিয়ে তাকিয়ে
                     শুধুমাত্র আমার ক্লান্তি দেখেছে

পঞ্চাশ অতিক্রান্ত একটা মানুষ কোন একদিন
                            সিঁড়ির সঙ্গে একা হয়ে যায়
অনেকটা সময় ধরে সে সিঁড়ি ভাঙতেই থাকে ....


মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়
বিদ্রোহ


বেয়নটের ডগে আমার মাথা
বুলেট ভর্তি বন্দুকের নলে শুয়ে স্বপ্ন দেখছি
স্বাধীনতার পর বুড়ো হয়ে যাওয়া দেশ
আমাকে ছেঁড়া ভারতবর্ষের মানচিত্র দেখায়।

আমার শুকনো হাড়ে হাওয়া লাগলে আগুন জ্বলে
আগুন আমাকে ছোবল মারে
আগুন আমাকে চুমু খায়
আমি ফুল ফোটার শব্দ শোনার জন্য বোবা যৌবন প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি।
কাকে বলে মৃত্যু , কাকে বলে জীবন
জানতে জানতে পঞ্চমুন্ডি আসনে বীজমন্ত্র জপ করি
কারা আল্লা বা ঈশ্বরকে কলার উল্টিয়ে থাপ্পড় মারে?
ধর্মগ্রন্থের উপর নোংরা দু’পা রেখে
এঁকে  দেয় নোংরা জলকাদার শীলমোহর
ভারতীয় সংবিধান আইন কানুন নিয়ম শৃঙ্খলা
চীৎকার করে ওঠে –পেচ্ছাপে পথ ভাসায়।

মসনদের অধীশ্বর উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়
লজ্জাহীন চোখে অন্ধকার মোচড় খায়
হাতড়িয়ে শেকড় খুঁজতে গিয়ে শূন্যতা জাপটে ধরে।
চুক্তিপত্রে সই করতে করতে আঙুলগুলো খসে গেছে
অনুবাদ গল্প
আংটির মালকিন 
মূল রচনাঃ নাদিন গর্ডিমার 
অনুবাদঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

 ( জন্ম ১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর তিনি দক্ষিন আফ্রিকার গোয়েটনে জন্মগ্রহণ করেন । বিশ্বের বর্ণবাদবিরোধী সরব যোদ্ধাদের মধ্যে তিনি অন্যতম । বর্ণবাদকেন্দ্রিক এবং পরবর্তী সময়ের সমস্যা এবং শঙ্কাগুলোই তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ।লিখেছেন ছোটগল্প , উপন্যাস এবং প্রবন্ধ । প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্য তিরিশটিরও বেশি । তার মধ্যে পনেরটি উপন্যাস ।বার্গার্স ডটার , দ্য লেট বুর্জোয়া অয়ার্ল্ড , জুলাই’স পিপল এবং মাই সানস স্টোরি ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয় এবং সফল উপন্যাস । ১৯৭৪ সালে দ্য কনজারভেশনিস্ট উপন্যাসের জন্য তিনি বুকার পুরস্কার পান । ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ।নোবেল কমিটি তাঁকে একজন মহৎ মহাকাব্যিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন । বর্ণবাদী সরকারের হাতে বারবার নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁর বই । তবু আদর্শে অবিচল থেকেছেন তিনি। ২০১৩ সালে নব্বই বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।)

সব ফালতু। দুদিনের জন্য আসবে তারপর জীবন তছনছ করে দিয়ে চলে যাবে। এখন বোতল খুলে বিরহযাপন ছাড়া তার কোন কাজ নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে বুঝল তার কপালে আর যাই থাক বউ ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। এরপর সে একা একা থাকার কথাই ভাবল । এর চেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।
সে দেখল ঘরটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। দামি পেন্টিং, কাচের মূল্যবান সামগ্রী, সৌখিন জিনিস, ঘর সাজানোর নানা উপকরণ এমনকি সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা বিদেশী মদের যে বোতল ছিল যাওয়ার সময় তাও নিয়ে চলে গেছে তার স্ত্রী। শুধু অদরকারি ভেবে তাকেই পরিত্যাগ করেছে চিরকালের মতো । তাকে একা নয়, তার সাথে কিছু বইপত্তর রেখে গেছে। যে বইগুলো সে তার প্রথম স্ত্রীর সাথে ঘুরতে ঘুরতে বইয়ের বিভিন্ন দোকান থেকে নানা সময়ে কিনেছিল। সে দেখল প্রতিটি বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় তার প্রথম স্ত্রী ভালোবেসে তার নাম লিখে রেখেছিল। সে মায়া বাড়াল না। ঘরটাকে সাফসুতরো করার জন্য বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এখন নারীসঙ্গ ছাড়াই কেটে যায় তার প্রতিটি দীর্ঘ রাত। অন্ধকার ছিঁড়ে ফালাফালা করতে করতে সে বুঝতে পারল এরা আসলে সবাই ভবঘুরে। প্রমোদবালিকার মতো তারা বেড়াতে এসেছিল, চলে গেছে। ভ্রমণের আনন্দ কি সে নিজে চায়নি? চেয়েছিল। চাইলেও সে সুদীর্ঘ যাত্রাপথে যথার্থ সহযাত্রী চেয়েছিল।
ঘরে তার মন বসছিল না। বাধ্য হয়ে সমুদ্রের ধারে একটি পরিচ্ছন্ন হোটেলে উঠল সে। যেখান থেকে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে সে দেখতে পায় ডোরাকাটা রঙিন দাগের পাথরের ওপর মহিলারা নোনা বিবর্ণ জাজিমে শুয়ে থাকে আনন্দে আর শরীরে সুগন্ধি তেলের প্রলেপ পড়ে । মাথার চুল সাজিয়ে রাখে কৃত্রিম ফুলের মালায়। জল থেকে যখন স্নান সেরে মহিলারা উঠে আসে, তখন চুল থেকে স্বচ্ছ জলের ফোঁটা নেমে আসে মসৃণ আভায়। তাদের আঢাকা শরীরে বিচ্ছুরিত আলোর প্রতিফলন চোখ জুড়িয়ে দেয়। একেবারে ছবির মতো হাতের তালু থেকে কানের লতি পর্যন্ত সামনে-পেছনে আলোর চমকানি। তাদের স্তন উন্মুক্ত। তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে তারা অধোমুখ-ত্রিভুজাকৃতির উজ্জ্বল কাপড় পরে। যা চোখকে টেনে নিয়ে যায় দুই নিতম্বের মাঝখান দিয়ে টানা একটা সুতোর দিকে। লোকটির যতদূর দেখতে পায় – মহিলারা সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে বলে তাদের সম্পূর্ণ নগ্ন বলেই তার মনে হচ্ছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও জড়িয়ে যায় দৃশ্যের বাঁধনে।
 খালি চোখে পুরুষশূন্য মনে হলেও সে দেখতে পেল দু একজন পুরুষও রয়েছে সেখানে। তবে সে এখন আর তাদের দেখতে পাচ্ছে না। চোখ বুজে সে সমুদ্রের ঘ্রাণ নারীর মেয়েলি আশ্চর্য গন্ধ – সুগন্ধি তেলের সৌরভে ভরে নিতে চাইল স্মৃতিকোষ। সফেন তরঙ্গগুচ্ছের মাঝখানে সে নিজেকে মেলে দিল। তারপর সাঁতার কেটে সে যেতে লাগল অগভীর দূরের দিকে যেখানে যুবতী মায়েরা তাদের শরীরের সাথে লেপটে নিয়েছে সন্তান। তাদের ভেজা শরীর থেকে এক মায়াবী গন্ধ ভেসে আসতে লাগল।এই তেজস্বী রূপের দিকে তাকিয়ে সে মোহিত হয়ে যেতে লাগল। জলের মধ্যে সে নিজেকে চঞ্চল্ভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগল। তারপর উঠে এল রৌদ্রকিরণে আচ্ছাদিত বালির উপর। সেখানে প্রাচীন ভাস্কর্যের মতো শুয়ে আছে নারীরা। সে তাদের পাশে গিয়ে একসময় শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে দেখল তার মাথার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সুন্দরী ফর্সা রমণীরা। তাদের পায়ের মসৃনতা জুড়ে রয়েছে এক নিরাভরণ প্রান্তর। ভিজে চুলের জল এসে পড়তে লাগল তার গায়ে।
এভাবে একা থাকতে থাকতে সে একসময় সাগরের বুকে পাথর ছুড়তে শুরু করল । জলে সেই পাথরের স্পর্শে আন্দোলনের ঢেউ উঠল কিছুক্ষণ তারপর মিলিয়ে গেল। বাচ্চাদের মতো এইভাবে খেলা করতে করতে একটা পাথরের দিকে তার চোখ চলে গেল। পাথরটার মধ্যে রয়েছে এক অদ্ভুত রহস্যের দাগ, লুকানো অভ্রর বিক্ষিপ্ত অংশে আলোর আশ্চর্য মায়া। এর কেন্দ্রে রয়েছে সমুদ্রের তৈলাক্ত মসৃণ হাতে গড়া কাচের মতো সমতলবিশিষ্ট হীরকের মতো বিষমকোণী চতুর্ভুজ।
 পাথরের মতো হলেও তা আসলে যে সে পাথর নয়। গোলাকার স্বচ্ছ হলুদাভ রত্ন কাটার বাদামি পাথর, সেখানে রয়েছে নীল আর সবুজ কাচের বোতল, যা নীলাভ সবুজ মুক্তো আর পান্নার মতো দেখতে। ছোট বাচ্চারা সেগুলো ঝুড়িতে সংগ্রহ রাখছে । চারদিকের এতসব ঐশ্বর্যের সমারোহের ভেতর থেকে একদিন বিকেলে সৈকতে একটি সত্যিকারের আঙটি তার হাতে এসে ধরা পড়ল।  রঙিন কাচের টুকরোর মধ্যে হীরের একটি নীলকান্তমণি আংটি।সে সহজেই বুঝতে পারল এটি কোন মহিলার মহিলা হাত থেকে খুলে রাখেনি। তাই যদি হত তাহলে তা নামানো থাকত কোন  পাথরের উপর। এখানে যারা রোদের মধ্যে উপুড় হয়ে আছে তাদের কারোরই এমন অবস্থা নয় যে এত দামি আঙটিকে তাচ্ছিল্য করতে পারে। কোনো ধনীর দুলালি, বড়লোকের আয়েশি স্ত্রী সাঁতার প্রতিযোগিতায় বা নৌবিহারে ডুব দিতে গেয়ে ফ্যাশনের ছলে শরীরের অপ্রোজনীয় পোশাকের মতো খুলে রেখেছিল এই আংটি।তারপর ভুলে গেছে।  অথবা অসতর্ক মুহূর্তে আংটিটি হাতের আঙুল থেকে পিছলে পড়ে গেছে। হয়তো তখনই  টের পায়নি। বাড়ি ফিরে এসে বুঝতে পেরেছে ওটা হারিয়ে গেছে। আর পাওয়া যাবে না ।হয়তো বা ছুটে গেছে ইন্স্যুরেন্স নীতিতে কী আছে জানতে। এদিকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধীরে ধীরে আংটিটি মাটির ভেতর ডুবে যেতে যেতে এটি সত্যিকার অর্থে একটি সুন্দর আংটিতে পরিনত হয়েছে। আংটিটি যদিও প্রায় ছয় ইঞ্চি মাটির নিচ থেকে এলোপাতাড়ি আঙুলের খোঁচায় তুলে আনা হয়েছে। তবু সে এটার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন এখনই এর মালিক জেনে ফেলবে সমস্ত তথ্য। আর তাকে জেলে ভরে দেবে চুরির অপরাধে। তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। আনন্দে , ভয়ে, উদ্বেগে। 
 ওদিকে সেই মহিলাদের কেউ তাকে দেখছে কীনা সে লক্ষ্য করতে লাগল। দেখল কেউ কেউ তাকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে তাদের নগ্ন মোমের মতো শরীরে তেল মাখছে, বিন্দুমাত্র বিকার নেই তাদের। বরং তাদের আচরণে কোথাও যেন উপচীয়মান আনন্দেরই বহিঃপ্রকাশ আছে। আংটি হারালে যা স্বাভাবিক ছিল না। কেউ কেউ বাচ্চাদের শরীর মুছে দিচ্ছে মাতৃস্নেহের নরম লাবণ্যে । ছোট আয়নায় তাকিয়ে তাদের কেউ কেউ চোখের ভ্রু ঠিক করে নিচ্ছে। কেউ কেউ দেখে নিচ্ছে জলের সিক্ততায় কতখানি মাধুর্য উঠে এসেছে বুকে।
এই ভিড়ের মধ্যেই সে চুপিচুপি আংটিটা নিয়ে আসে হোটেলে। আর ভাবতে থাকে এটা কি ঠিক হচ্ছে? ন্যায়সম্মত হচ্ছে ? সে কেন চোরের মতো এরকম আচরণ করবে ? এটা পুলিশের হেফাজতে রাখলেই কি ভালো হত না ? সারিবদ্ধ প্রশ্ন তার মাথার ভেতর কিলবিল করতে লাগল। না, সে পুলিশের কাছে গেল না। একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিল; যার বয়ান ছিল এরকম- “ গতকাল  দুপুরে নীল দিগন্তের সৈকতে একটি আংটি পাওয়া গেছে। উপযুক্ত প্রমাণ সহ যোগাযোগ করুন। নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেওয়া আছে নীচে। ” হোটেলের রুম নম্বর দিতেও সে ভুল করেনি। বিজ্ঞাপন প্রকাশের দিন থেকেই পরপর ফোন আসতে শুরু করল তার কাছে। ফোনে ফোনে সে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। সকালের দিকে কিছু পুরুষের ফোন এসেছিল। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম ছিল- ‘ আমার স্ত্রী আজ সৈকতে একটি হীরের আংটি হারিয়ে ফেলেছে।  তারপর থেকে ওর এতই মনখারাপ যে কথা বলতে পারছে না।’
সে তখন বলল- কীরকম আংটি ?
পুরুষকণ্ঠগুলি থেকে একই ধ্বনি উচ্চারিত হল- হীরের দামি আংটি
সে বলল- আপনি বিশদে বলুন।
কেউ কেউ মিথ্যে বর্ণনায় ভরিয়ে তুলল গলার আওয়াজ। কেউ কেউ তৎক্ষণাৎ সংযোগ কেটে দিল।কিছু কিছু মহিলাও ফোন করল দুপুরের দিকে ।তাদের মধ্যে যারা মধ্যবয়সী বলে সে অনুমান করতে পারল তাদের স্বরে  কথার চেয়ে কান্নার প্রকোপ ছিল বেশি। কারো কারো অতিনাটকীয়তা তাকে বিরক্ত ও ক্লান্ত করল। যেসব মহিলার বয়স কম এবং যাদের কণ্ঠস্বরের মধ্যে এক  মায়াবী জ্যোৎস্না ছিল , তাদের প্রতিটি কথা যেন তাকে অদ্ভুত ভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। সে মুগ্ধ ও সম্মোহিত হতে লাগল এই জাদুতে। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে সে ডাকল হোটেলের ঘরে। বলল- আসুন, মনে হচ্ছে এই আংটি আপনার হতে পারে। আপনি যথার্থ প্রমাণ দিয়ে তা সংগ্রহ করুন।

‘আংটিটি ঠিক কেমন আপনি বলুন ।’
খোলা ব্যালকনি। সমুদ্র থেকে বাতাস বয়ে আসছে মৃদু। সে একটা আরাম কেদারায় মেয়েটির মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করল। মেয়েটির মুখ থেকে উপচে পড়ে চিত্রিত হাসি।যার অন্য তাৎপর্য  আছে, সে খুব কৌশলী জবাব দেয়- জানেন তো , পুরনো আংটি আমার মায়ের। মা মারা যাওয়ার শুধু ঐ স্মৃতিটুকুই আমার কাছে ছিল, আর কিছু নেই। নিমেষেই হাসিকে কান্নায় রূপান্তরিত করে দেয় মেয়েটি। এরকম বেশ কয়েকজন মেয়ে আজ সকাল থেকেই এসেছে। তাদের সবাই প্রায় সুশ্রী, আকর্ষণীয়, কেউ কেউ অসম্ভব সুন্দরী। তাদের পোশাক মনোরঞ্জক এবং চিত্তচাঞ্চল্যকর। এদের সবার উদ্দেশ্য ভুলিয়ে ফুসলিয়ে কোনরকমে দামি আংটিটি হাতিয়ে নেওয়া।কেউ কেউ এসেছে অন্য উদ্দেশ্য নিয়েও। আংটি পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই। অন্যকিছু দিয়ে আপাতত দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নেওয়া যাবে। কেউ সঠিক বিবরণ দিতে পারেনি। বরং প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গেছে চতুর ভাবে। কল্পনার ভেতর দিয়ে এক মনগড়া সত্যের ইমারত গড়েছে। তবে এর মধ্যে একজন তার আংটির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিল যা বাস্তবের সাথে মিলে যায়। রঙ, আকার, আকৃতি, সবকিছু ঠিক ঠিক বলেছিল। কম বয়স হলেও তার চেহারায় সেরকম জৌলুস ও আভিজাত্য ছিল না। শরীরে তেজ উদ্দীপক কোন আলোড়ন দেখতে পায়নি লোকটি। অকাট্য যুক্তি প্রমাণগুলিকে বিশ্বাস করতে গিয়েও সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল- ‘আপনাকে অহেতুক এত প্রশ্ন করার জন্য আমি দুঃখিত। আংটিটা ঠিক এরকম নয়। আপনি অনেকদূর থেকে এসেছেন, আমার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই।’
মেয়েটি বলল- না, না, তেমন কিছু নয়। আমি তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সমুদের দিক থেকে শান্ত এক আলো এসে পড়ছে তার গালের উপর। গম্ভীর হয়ে আছে সে। ঠিক তখনই একজনের ফোন এল তার কাছে। সুন্দর সুরেলা গলা। জলতরঙ্গ বেজে উঠছে প্রতিটি শব্দের কম্পনে। সুনিয়ন্ত্রিত স্বর। কোন অভিনেত্রী বা গায়িকার মতো। যা সহজেই মনকে আবেশে ভরিয়ে দেয়। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সে বলে চলেছে- দেখুন এ আংটি আমার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি তা আশাও করি না। তবু যদি লেগে যায়... 
সে বলল- আসুন , সব কথা ফোনে হয় না।
মহিলার বয়স চল্লিশ বা তার আশেপাশে।অথচ চেহারায় যেন সে চির তরুণী। প্রকৃত নিখুঁত সুন্দরী বলে কোন শব্দ হয় না। তবু এই মহিলাকে তার কাছাকাছি ধরে নেওয়া যায়। চুলে অন্ধকার বিদিশার নিশা। কপালে সুন্দর একটি টিপ। চোখের উজ্জ্বল সবুজ দৃষ্টি মাদকতায় ভরিয়ে দেয় যেকোন পুরুষের মন। নরম মোমের মতো মসৃন ত্বক তা যেন আরও সুন্দর হয়ে নেমে এসেছে বুকের উপত্যকায়। সে যেন আংটি পরার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে এরকম ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিল তার আঙুল । লোকটি তার সপ্রতিভ আঙুলে দেখল স্বপ্নময় লাবণ্যের ছোঁয়া। মহিলাটি চোখের উপর চোখ রেখে বলতে শুরু করল- আসলে যে জিনিসের সাথে আত্মিক বন্ধন তাকে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। তাকে যথার্থভাবে দেখাতে গেলে বুক চিরে দেখাতে হয়। এটা প্লাটিনাম আর সোনার মেলবন্ধনে তৈরি।দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে করতে কখনও মনে হয়নি তাকে লোভীর মতো একদিনেই সব দেখে নিই। মনে হয়েছে সে তো আমারই আছে, সারাজীবন ধরে দেখলেই হবে একটু একটু করে। ফলে আমি এই মুহুর্তে সবকিছু বলতে পারব না। কিছু হীরকখণ্ড ছিল, অনেকগুলো পান্না আর চুনির রঙিন পাথর। লালমণি চুনী। সব পাথর যে অবিকৃত আছে এমন নয় ঝরে গেছে, পড়ে আছে। রঙও মলিন হতে পারে।
 হোটেলের ড্রেসিং টেবিলের বাঁ দিকের ড্রয়ার খুলল লোকটা। একটা খাম বার করল নিঃশব্দে- দেখুন তো এই খামের মধ্যে যে আংটি আছে , সেটা আপনার কী না। মহিলার চোখে স্থির অবনত দৃষ্টি। সে দ্রুত আংটিটি তুলে নিল খাম থেকে। ডান হাতের মধ্যমায় পরতে গিয়ে সে দেখল ঢুকছে না কোনমতেই।জাদুকরের মতো হাত সাফাইয়ের ভঙ্গিতে লোকটির দিকে পিছু ঘুরে সে দ্রুত সংশোধন করে নিল প্রাথমিক ভুল। এখন তার অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে সেই আংটি।
লোকটি বলল- আজ রাতে আপনাকে আমার সাথেই খেতে হবে। একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না।
মহিলা অনামিকার দিকে তাকাল ,কী সুন্দর মানিয়েছে আংটিটি। তার মুখে ফুটে উঠল সম্মতির ইশারা। চাঁদ উঠছে। তার বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের জলে।
লোকটি বলল- আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, অনেকদিন পর এই আংটির যথার্থ মালকিনকে আজ খুঁজে পেলাম।

প্রা ন্ত ক থা
সু বী র স র কা র


১।
সাঁতার কাটা বা না কাটাটা বড় কথা নয়। সন্তরণশীল এক যাপন নিয়েই তো মানুষের জন্মের পর জন্ম কেটে যায়। ভাবনাস্রোতের বাঁধনহীনতায় টুংটাং দোতারার সুর জটপাকানো স্বপ্নের ভিতর অনেকানেক পাখির ডানাঝাপটের আশ্চর্য দৃশ্যপট হয়ে চোখে ভাসে। তখন আলোহীন সাঁতারহীন এক জীবনযাপনের নেশার টানে ইয়াসীন মাতব্বর উঠে দাঁড়ায়। দীর্ঘ হাই তোলে। শরীরের পেশীসমুহের ভিতর একসময় স্থিতাবস্থা এলে মাতব্বর দীর্ঘ এক হাঁটার জন্য পরিক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কোথা থেকে যেন দোতারার আওয়াজ উঠে আসে। কে বাজাচ্ছে কে জানে! মাতব্বর হাঁটা শুরু করে জোতদারটারির জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল অতিক্রম করে তাকে দ্রুত পৌঁছতে হবে একুশ ঘোড়ার ধনকান্ত জোতদারের বাড়ির খোলানে।
সে কবেকার কথা মাতব্বর জানে না। মাতব্বরের প্রবীণ চোখের তারায় তারায় এখনো কী জীবন্ত সব দৃশ্যপট। তখন চারধারে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। চা-বাগান। রাজবংশী, আদিবাসীদের বসত। গুটিকয় মুসলিম টাড়ি। বাগানবাবু ফরেস্টবাবু। ধনকান্তের বাপ তখন জোতদার। আধিদৈবিক জীবনের বর্ণময় যৌথতা। আর খুব মনে পনে জার্মান সাহেবের কথা। মাতব্বর তখন ছোট। বাবা-দাদার সঙ্গে হাটগঞ্জে ঘুরে বেড়াত। কত কত মানুষ। হাটের পথে ধুলোর ঘুর্ণী। সন্ধে পেরিয়ে অনেক রাতে কতবার বাড়ি ফেরা। গরুর গাড়ির ক্যাঁচর কোঁচর শব্দ। গাড়ির ধুরায় কালিপড়া লণ্ঠনের দুলুনি। ছইয়ের ভিতর থেকে লণ্ঠন আলোর কম্পনরেখায় ভৌতিকতা দেখা যেত। যেন নদীর জলে ধরাছোঁয়ার খেলা। একবার শালকুমারের জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে এসেছিল। গোটা দিন সেই বাঘ দাপিয়ে বেড়িয়েছিল ফালাকাটা শহর। শেষেকোচবিহারের রাজার এক শিকারী ভাই এসে সেই পাগলা বাঘকে মেরে ফেলেছিল। মাতব্বরের এক নানুভাই ইয়াসিনউদ্দিনকে এক চাঁদনীতে শিঙের গুতোয় শুইয়ে ফেলেছিল বাইসন। এত এত স্মৃতির জটে আটকে যেতে যেতে চার কুড়ির মাতব্বর যেন ফের ধাক্কা খায়। পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে কোন এক কুহকের দেশে যেন বারংবার ফিরে আসতে থাকে জার্মান সাহেবের ঘোড়া, বন্দুক ও বাজখাই চুপি। কত কত বাজার হাট নদীর ঘাট ঘাটোয়াল রাখাল বন্ধু মইষাল একোয়া হাতির মাহুত বুধুরাম,হাসতে হাসতে নেমে আসছে মথুরা হাটের খুব ভিতরে। প্রবেশপ্রস্থানের নিয়তিতাড়িত সম্ভাবনায় পাতলাখাওয়া শুটিং ক্যাম্পের হরিণেরা একযোগে নাচের একটা ঘোর তৈরি করতেই একধরনের নতুনতর নাচই যেন বা বিনির্মিত করে তুলতে থাকে। মাতব্বরের হাঁটাটা জারি থাকলেও এক পর্বে দোতারা আর বাজে না।
কালজানি নদীর কাছাড়ে আটকে পড়লে কে তাকে উদ্ধার করবে? নদীর পাড়ের জঙ্গলে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। ডাকে। অথচ ঘাটোয়াল আসে না। বাউদিয়া ঘাটোয়াল ঘাটবাসর ছেড়ে কোন পালার আসরে গেছে বাঁশিয়ালের শাকরেদ সেজে। ঘাটের শূন্যতায় চরাচরবাহী ব্যপ্ততায় লীন হবার সমাধানসূত্র নিয়ে মাতব্বর নেমে পড়ে প্রাক শীতের আশ্বিনা নদীর জলে। পাহাড়ি নদীর শীতলবরফগলা জল তার পায়ের পাতা গোড়ালি উরু ও কোমর স্পর্শ করলেও শরীরময় একাগ্রতায় সে হাটফেরত মানুষের ঘরে ফিরবার শৈশবস্মৃতির ভিতর কেমনধারা ডুবেই যায় যেন আর বাঘের নদী পেরিয়ে এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল পারাপারের সফলতার মতো নদীটা ঠিক সে পেরিয়েই আসে, তারপর শরীরময় হাসির তাড়সে কাঁপতে কাঁপতে নাভির তলদেশ থেকে গান তুলে আনতে থাকে— ‘হালুয়া রে হালুয়া/পাতলাখোয়ার হালুয়া/হালুয়া রে হালুয়া ডোবোরহাটের হালুয়া...’ গানের মত্ততায় গানের উজানস্রোতে টেনে সাজানো ছড়ানো আকাশময় মেঘরোদের পৃথিবী মায়াবন্দর দিয়ে সে যথারীতি পৌঁছেই যায় ঘোড়া জোতদারের বাড়ির অন্দরে। অবশ্য জোতদারী নেই এখন আর। রাজা নেই। জার্মান সাহেব মরে ভূত। কিন্তু জোতদারটাড়ি আছে। রাজারহাট রাজারদিঘী সাহেবপোতা এসকল রয়ে গেছে স্মৃতির শস্যবরণ নকসাদার শাড়ির পাড়ের চিক্কনতার মতো।
২।
মাতব্বর জোতদারবাড়ির জোড়শিমূলের গাছের গোড়ে বসে পড়ে। ক্লান্তি না থাকলেও সে ঘুমিয়ে পড়ে। নিন্দের আলিসায় টোপ পাড়ে। ঘুম ও জাগরণ নিয়ে তার দীর্ঘ দীর্ঘ জীবন কেমনধারা কেটে গেল। পর্ব পর্বান্তরে স্মৃতিচিহ্নিত যাপনবিন্দু দিয়েই সে উজান ভাটির স্বপ্নকাতর জীবন কাটিয়ে দিল। বাইচের নাও বেয়ে তবে কি চলে যাওয়া যায় আর কান্দাকান্দির মেলায়। বাওকুমটা বাতাসের ঘুর্ণীতে আঁতকে উঠে ভয়ার্ত শেয়ালের কান্নায় সচকিত হলেও নতুন নতুন সুর স্বপ্নের ধারাবাহিকে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে চোরাবালিছোঁয়া হাওয়া, ফালাকাটা শহরের আতঙ্কিত বাঘ্য।স্মৃতির দীর্ঘ অভিশাপের ভার বহনের ক্লান্তি শোকের দিনগুলিতে ফিরে যাবার উদগ্র বাসনার মতো কখনো হামলে পড়লেও জীবন চোরকাটা বাবলাবনঝাড়ের আবহমানতায় বহুধাব্যাপ্ত হয়ে উঠতে  থাকে। ইয়াসীন মাতব্বরের চারকুড়ি বৎসর অতিক্রান্ত শরীর সচেতন ভাবেই আরো আরো ঘুমের ভিতর ডুবে যেতে থাকে। ভূগোল ইতিহাসের বহুস্বরের মধ্যে তার ঘুমজড়ানো অস্তিত্ব একসময় মুছে যায়। ঘুম না ভাঙাটাই তখন চিরসত্য। মরণঘোরের মতো স্পষ্টতর ক্রমে। বৃত্তান্তের আরো আরো ক্রমবর্ধমানতায় মাতব্বর স্বয়ং নবীকৃত চিরনতুন বৃত্তান্তের রূপকথা হয়ে বৃত্তান্তকে মান্যতা দিতে গিয়েও বৃত্তান্তের চিরবিষন্নতায় লীন হয়ে যেতে যেতে তীব্র এক ঘুমের বৃত্তের অত্যাশ্চর্যে চিরায়ত কোন বৃত্তান্তই বুঝি তীব্র বাজনার মতো ঢের বাজতে থাকে আর বৃত্তান্তের দিকে তুমুল বৃত্তান্ত হয়ে হেঁটে যেতে থাকে শুভ্র হাঁসের দল।
তবু তো পেরিয়ে আসতে হয় অসংখ্য ঝাড়-জঙ্গল-বাবলাবন-কলার বাগান। গহিন  ছমছমে বৃহৎ কোনও অরণ্যভূমিতে প্রবেশ করবার আগে যেমন আট-দশটা সংক্ষিপ্ত সাঁকোহীন নদী। জীবন ছন্দময় প্রবাহিত হয়।বাইসন হানা দেয়। হাতি মানুষ মারে। অথচ জীবন থেমে থাকে না। শোকপালনের অবকাশই দেয় না। মাঠ প্রান্তরের ভিতর বছরের পর বছর সাহেবদের কবর শুয়ে থাকে। আরও জীর্ণ ও পুরাতন হয় ক্রমে ক্রমে। মকবুল বয়াতির দোতারার ডাং কোন কোন শীত রাতে ওম ও উষ্ণতা ছড়ায়। উষ্ণতর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় শামিল হয় পাখি ডাক, মনশিক্ষার গীত- ‘কচুপাতের পানি যেমন রে/ও জীবন/টলমল টলমল করে...’ বিধ্বস্ত পুরুষ উঠে দাঁড়ায়। তার সর্ব অঙ্গে দৃঢ়তা জমে। আর অন্ধকারেই রাস্তা খুঁজে পায় সে। তখন আঙিনায় নাচগানের আসর। ঢোল-সানাই। আর নজরুল ইসলামের মরমিয়া গান-‘আইসো মোর কালাচান/যাও খায়া যাও বাটার পান...'
৩।
জোতদারের ধানের গোলায় আগুন। অথচ উদ্বেগহীন জোতদারের মুখে তখন তেভাগার গল্প। লাল পতাকা, কৃষকজনতা ও বারুদ বন্দুকের গাথাগল্প। গল্পপথে রক্তের দানা ফন্দিফিকির ও সমূহ চক্রান্তকথা। আগুন প্রায় নিভে আসে অথচ গল্প শেষ হতে চায় না। আদতে এক গল্প কিছুদূর গিয়েই নানা প্রশাখায় বিভক্ত। তাই এমন ধারাবাহিকতার মজাদার ফানুষ। এইসব গল্প খুঁটে খাই আমি। আমোদিত হই। আর বাড়ি ফিরবার পথে সন্ধে ও রাত্রির মধ্যপর্বে প্রায়শই বাঁশবাগান পড়ে। বাঁশবনের ভিতর অগণন জোনাকি। মন্দ আলোর নদী। সামন্তরক্তের মতো। লোককথার ঝোলা কাঁধে অপরূপ সব কথোয়াল হেঁটে যান। তাঁরা হেঁটে যেতেই থাকেন। আর ভালোবাসার পাশে সন্ত্রাস-রক্ত-লালসার আগুন। জন্ম ও মরণ লেখে বাজপাখি। শীত আসে। উত্তর বাংলার মাঠে মাঠে কুয়াশা। সাদা বকের দল আসর বসায়। কুয়াশার ভিতর তারা উড়েও যায়। কুয়াশা পাতলা হতে থাকে। রোদ ভাসিয়ে নিয়ে যায় শীতসকাল। রোদ, মানে শীতের রোদ সর্বদাই সংক্রামক। কিঞ্চিত উদাসও করে হয়তো বা। মিনিটে মিনিটে আবার পাল্টে যায় রোদের রঙ ও রেখা। রোদ প্রায়শ টেনে নিয়ে যায় আমাকে নদীর কাছে। নদী কখনো প্রবীণ হয় না জানি। এও জানি নদী থাকলেই নদীচর থাকবে। আর নদীচর মানেই বালির নকশাকাটা সুবিশাল সামিয়ানা। নদীর সাথে মাঝি মাল্লা ডিঙি নৌকো আর সারিগান এসবের আশ্চর্য যোগাযোগ। আবার শীতের নদী অন্যরকম। সে হাওয়া বাতাসের। সরষেখেতের আর তরমুজবাগানের। নদী আমাকে টানে। উসকে দেয়। ঝাউগাছের পৃথিবীতে একা থাকবার কোন কষ্ট থাকে না। চাঁদওভীষণমাত্রায় ডাকে আমাকে। নদীপথে কাহিনী তৈরী হয় কতশত। আর কাহিনী সমূহে মিশে যেতে থাকে লোকগান। লোকবাজনা। নদীকে উপাস্য ভেবে আমাদের উত্তরবাংলায় গান বাঁধা হয়। পুজোর ফুলে ভরে ওঠে নদীগর্ভ। উত্তরবাংলার রাজবংশী মহিলারা দলবদ্ধ হয়ে নাচে। তিস্তা বুড়ির পুজো হয়। বাজে ঢাক আর ঢোল। এই ভাবে অন্ধকার ও আলোয় পূর্ণ হয়ে উঠতে থাকি আমি। আবেগ টেনে আনে চোখের জল। আবার চোখের জল দিয়ে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক এঁকে রাখি বিকেল। বিকেল প্রসঙ্গে খুব, খুব চলে আসে পুকুরঘাট। নৈঃশব্দ খানিকটা। পুকুরঘাটে কেউ কেউ হারিয়ে ফেলে নাকছাবি। রুপোর বিছে। লণ্ঠনের মৃদুআলোয় শুরু হয় অনুসন্ধান পরব। আবার কুয়াশা নামে। কুয়াশা জড়ানো হাসপাতালের বারান্দায় এলোমেলো আর একা আমি হাঁটি কিঞ্চিত আলগোছে।







বোশেখ মাস ও লকডাউন (ব্যক্তিগত গদ্য )
সত্যম ভট্টাচার্য


খুব ভয় লাগছে, সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, খুব ভয় লাগছে আমার।যেভাবে সবাই হেরে যাচ্ছে এই করোনা ভাইরাসের কাছে দিনের পর দিন, যেভাবে বিশ্বের তাবড় তাবড় আধুনিক পরিকাঠামোর দেশগুলো স্রেফ হাল ছেড়ে দিচ্ছে, ভাবতে সত্যিই খুব ভয় লাগছে যে সেখানে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের অশিক্ষিত-অজ্ঞ-নিরক্ষর মানুষের দেশ এই ভারতবর্ষের কি হাল হবে।তাই স্রেফ নিজের বেচে থাকার জন্য চোখ ঘোরাতেই হচ্ছে অন্যদিকে।

বৈশাখ মাস এবার এভাবেই চলে গেল।কোথায় পয়লা বৈশাখ, কোথায় হালখাতা,কোথায়ই বা বাজার ম ম করা পাকা আমের গন্ধ।খুব মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে দোকান ঘুরে ঘুরে হালখাতা করে তারপর মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেসব প্যাকেটে কমন আইটেম থাকতো লাড্ডু আর কচুরি। কিন্তু সেই সব ঠান্ডা কচুরি খেয়ে পেটভর্তি গ্যাস হয়ে গেলেও সেকালে ওসব কিছুই মনে হত না।স্রেফ এক ফুঁয়ে উড়ে যেতো সব। যতদূর মনে পড়ে এ সময়টায় পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো আমাদের। তখন মাঝেমধ্যেই দাদুরা ঘুরতে আসতো বাড়িতে, তাদের একশোটা পাকা চুল তুলে দিলে একটাকা মিলতো।কয়েকটা তুলেই বলতাম একশোটা হয়ে গেছে। দাদুরাও সব বুঝে ঝিমুতে ঝিমুতে একটাকা দিয়ে দিতো। সেই এক টাকার যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।  রাতে ভাইবোনেরা একসাথে দাদুর কাছে পড়তে বসা ছিলো  লন্ঠনের আলো্য, ছিলো পড়া শেষ হলে দাদুর মুখে গল্প শোনা। সে গল্প শোনার লোভে তাড়াতাড়ি অঙ্ক কষার চক্করে প্রায় সবারই অঙ্ক ভুল হয়ে যেতো। সে সব ঘু ঘু ডাকা ঝিম ধরানো দুপুরে মন যেন চলে যেতো কোথায় ভেসে ভেসে। শরীরে শিহরণ জাগতো অরণ্যদেব-ডায়ানা-ডেনকালি-তুফান-বাঘা আর অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদে ।সময় না কাটা সে সব দুপুরে আলমারি(যাকে আমরা সেকালে মিটসেফ বলতাম)তার কোনো নিভৃত কোন থেকে ক্রমশ কমে যেতো আচার অথবা গুড়ো দুধ।এরপর যখন ডানা গজালো ধীরে ধীরে, কাউকে কাউকে  দেখে অন্যরকম ভালো লাগতে শুরু করলো,তখন ঘু ঘু ডাকা দুপুরে তার নামে লেখা হতে লাগলো কবিতা।সে সব দিনে তখন সবসময় সাথে  সমরেশের অর্জুন, সুনীলের কাকাবাবু,স্বপনকুমার ,অথবা আরো কত কত বই,সেই সব দিনের চিরসঙ্গী।
আমাদের ছোটবেলায় গ্রীষ্মের ছুটি দেওয়া হত দীর্ঘ এক মাসের।আর মফস্বলের  নিম্নবিত্ত বাঙালী পরিবারে কোথায় তখন গরমের ছুটিতে বাইরে ঘুরতে যাবার কনসেপ্ট। তাই সেই ছুটি আর শেষই হতে চাইতো না তখন। দিন কাটতো ঘরে এরকম বন্দী হয়েই প্রাইয়।তারপর যখন টিভি এলো,সকালে ছুটি ছুটি চালু হল।তাতেই হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ, সোনার কেল্লা আমাদের প্রথম দেখা। ভালো জায়গা পাবার জন্যে শুরুর বেশ খানিক আগে চলে যেতাম সে বাড়িতে যেখানে ছুটি ছুটি দেখবো। যে বন্ধুর বাড়িতে টিভি থাকতো,সে সময় তাই তার খাতির একটু যেন বেড়ে যেতো। সে ফুটবলে তখন নিয়মিত গোল করতো আর ক্রিকেটে শুরুর দিকে ব্যাট।সে সব না দিলে সে বিরস বদনে বলতো-না রে, বাবা না করেছে টিভি দেখতে। এসমস্ত ভাবি দিনরাত আর ভাবি কবে সকালে উঠে শুনবো সব ঠিক হয়ে গেছে। শুনবো ওষুধ বেরিয়ে গেছে এই মহামারীর রোগের।কাল থেকে বাড়িতে বাড়িতে আসবে লিস্ট নিতে যেমন ভোটার লিস্টের সময় আসে।কিন্তু না,সে সব হয় কিছুই হয় না।সকালে মোবাইল অন করতেই একগাদা ভয় দেখানো খবর ঢুকে পড়ে,টিভি খুললেই দেখি চারিদিকে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। সাবান দিয়ে ঘষে হাত ধুতে ধুতে  দেখি হাত লাল হয়ে থাকে আজকাল।
বাসা 
   নীলাদ্রি ভট্টাচার্য

              
                
যোগাযোগহীন আলপথে পরিপূর্ণ হোক নিরন্তর বৈশাখের গায়ের রঙ 
আরও দূরে অবাধ্য হৃদয়ের শেষভাগ  নীমপুষ্পের আপোসে ঘুঘু


অন্নহীন ডাক 
আগুনি মায়া পরম দুপুর উনান 
খুব কাছাকাছি ব্রত স্নেহের গৃহ জল

তারপর বর্ষা......অন্তর পশলা ডাঙা..শব্দ....এক বাদল ঘন মাধুকরী।
.


নববর্ষ

শতদল আচার্য


কোন এক শুরুর গল্প বলেছিল দেবু
আকাশ থেকে নামছিল যত তারা
বসন্ত পাতা ঝড়ানো পথে
আর হেঁটে যাচ্ছিল
নতুন স্বপন নতুন আশা ।

এরকম কত শত গল্প শুরু হয়
কতো আশায় কতো আশায়
গল্পগুলি শাখা মিলে হেঁটে যায় ।

এরকম একটা নববর্ষে
শুরু হয়েছিল
আমাদের গল্প


নববর্ষে নববর্ষে আবার নতুন পাপড়ি আসে

কানে কানে
 যাদব দত্ত 


কানে কানে এইমাত্র ভোর হলো 
কাঁঠাল আঠার হাত চোখ থেকে সরাও
দিনের পা'গুলোতে তোমারও একটা দুটো পা 
মিরর না আনমিরর পাল্কি বেরোবে 
প্রাণ ভরিয়ে আলপনা না উল্কি গভীর 
না ছলকানো ডিমনালেক বাঁক সরাও
বাস্তবের ধোঁয়া ওঠা গেরিলা স্যুপ সরাও
প্রতিনিয়ত কার ঢেউ কে জঙ্গি ছায়া 
আর মধ্যিখানে চর আমারও খুব প্রিয় 
কাঠুরিয়া নির্মেদ বাদাম পাহাড় গুনবে 
যার পিঁড়ি পেতে দিয়েছে নীল চোখ 
মনমরা কাঠের সুর ও থালা তোমারই
তার নীচ থেকে ফুটো রোদ ধরে উপরে উঠছি 
মেঘে মেঘে আমগাছের এই পূণ্যস্রোত
সাথে চলেছে নড়াচড়ায় ধানগাছের 
থোড়গুলির গভীর সঙ্গীত 
দিনেও দুধের ভেতর খলবল করতে 
                         থাকা মেলামেশা 

                



সুকান্ত দাস 
সরীসৃপ


ভিড় থেকে কোন মুখ আর চেনা মনে হয় না। আজ তীব্র লালারস। কাছেপিঠে ছিল বিজাতীয় সাপ। হাতে লেহনযন্ত্র। নতজানু আত্মার শেষ ছিটেফোঁটা
সরীসৃপ নালীতে তীব্র চুমুক। পাল্টে যাবার ধরণও বিজাতীয়। কেউ কোনদিন কথা রাখেনা। মুখ নীচু হয়ে ওঠে
বাঁশির আওয়াজটা ক্ষীণ হয়ে আসে। পাপের ধূলিকণা। জন্ম নিচ্ছে স্মৃতির গণিকারা। লোকাল প্যাসেঞ্জারে পাশে বসে থাকা – অমলিন
যে মইটার উচ্চতা মাপব ঠিক হয়েছিল তাতে ঘুণপোকা বাসা করে নিয়েছে। 
 
আজ তোমার সম্ভাব্য দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী
 
 
শেষবার রঞ্জনাকে


পরিক্রমা শেষ চোখের দুপাশে সমুদ্র তিমির একটি রাত হাসি এঁকেছিল।
খামখেয়ালিতে এড়িয়ে যাওয়া গতকাল আজ লেটার বক্সে চিঠি জমেছে। মরিচার ছোপ
 শুশ্রূষা কোন এক জাদু আত্মার নাম চাবি চেয়েছিল বলে ব্লকলিস্ট আর কোন গোপন আঁতাত নেই
এইবারে চারুকলা ঠিক জন্মাবে জননাঙ্গ ও উন্মুক্ত বাগিচায়
 
আমি বদ্ধ ঘরের জাতিস্মর না দেখা বৃষ্টিচোর, গাভিন সমুদ্র -- বিরল স্মৃতিঅভ্যাস নিয়ে
নৌকা ভারী করি
 
 
 
ছায়া তৈরির পন্থা 
 সুজিত মান্না



থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দীঘির ওপর এসে বসলো বৃষ্টি

যে ছায়া তৈরির পদ্ধতি নিয়ে এত অহংকার করতো সূর্য 

আজ তাকে বলতে শুনছি
– শিখবে কেউ ছায়া তৈরির পন্থা?

দীঘির পাড় ধরে 
তার হেঁটে যাওয়ার সময়
কেউ দরজা খুলেনি –

বাতাসের নির্মম হাত যখন 
ভেঙে দিচ্ছে সেতু – উড়িয়ে দিচ্ছে 
                               গাছেদের দেহ –
                               
সূর্য তখনো নিচু মাথায় হেঁটে পার হয়ে গেছে নদী

তার সুর দেখে মনে হয়েছে – অটল থাকা এক সর্বনাশ করা
জেদের জাদুকর

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স          
           উমাপদ কর


৩১
জানালার ফাঁকফোকরে দুটো সঙ্গমি বেড়ালের গোঙানি
        শোনাচ্ছে বাতাসের যথেচ্ছ বিউগল,
    বাথরুমের ঘুলঘুলি ঢেকে-রাখা-কাচ গলে বাঘ-গর্জন
                 সাগরপারের হু-হু,
যুদ্ধোল্লাসী বাতাস গায়ের ঝাল ঝারছে গাছে, চালাঘরের ঠান্ডায়
        কী সওয়াই না সইছে গাছ! জিমন্যাস্টিক,
    আছড়ে পড়তে হবে জেনেও চালার টিন, টালি, শন, খড়,
          পাটকাঠি, অ্যাসবেস্টাস, হোগলা, পলিথিন-জোড়া-টায়ার
                উড়ছে ভরশূন্য, পতনক্ষণ-স্থান না-জেনে

বহুদূর থেকে ফাঁকায় ফাঁকায় আসেন তিনি
     মেঘ-মুকুটে বাতাস-রাজ, পথে জোটান
           ঘাঘরা ঘোরানো অজস্র নর্তকী, লাস্য, হাস্য, কাম-ক্রোধ,
     চলনে বিচলন রাখেন, নেশারু মাতাল-পা-ফেলা, বদলে ফেলা পা
                বাতাসের রণ-পা, বাদশা-বেগম হুকুমত—
কোথায় সে সর্বংসহা? জলকেলি শেষে জলহস্তীগুলো বদলে যায় লক্ষ-শুঁড়ের হাতিতে—

অতএব, সুতরাং, কাজেকাজেই, ফলত-গুলিকে ধারণ করতে
              তুই পার্বতী হয়ে গেলি
     বাতাসের জটাজুট তোকে লুফছে ফের ছুঁড়ছে, অঝোরে কাঁদছে মেঘ-মুকুট
         ধর্ষিত হবি জেনেও আঁচল ওড়ালি, দেহধাঁধা আলগা করে বুক পেতে দিলি
উড়েও গেলি, ভেসেও গেলি, নর্তকীর তালে তালে ঘুরেও গেলি,
              যদি হুংকার কিছু কমে, যদি কলাবাগানে মত্ত-হাতিগুলো একটু থামে
          যদি ফাঁপানো ঢেউ-জলের মাথা কিছুটা নেমে আসে—

সব হলো পার্বতী, যা তুই চেয়েছিলি; বিল্লি-ফোঁস, বাঘ-গর্জন, মত্ত-হাতির দাপাদাপি
              ঢেউয়ের মাথা সব নেমে এল--
      কালের নিয়মে ধর্ষণ শেষে হত্যা এখন নিয়মমাফিক
             তোর টুকরো টুকরো শরীর বাতাস-রাজ ফেলেছে খণ্ড-ভূ জুড়ে
                         হতে পারে একান্নটা—
পীঠ নয়, পুজো নয়, ত্রাণ চাইছে ওরা---

২১/০৫/২০২০
৩৩
বুধমণ্ডলীতে নাচ দেখালে উলুপী
    দেখলাম ‘উমপুন’-এর সঙ্গে তুমি খুব যাও--
         কী নেত্য গো তোমার!
আর বাদ্যি! ওহো-হো! ঝম্পন অর্কেস্ট্রা—
       স্বকৃত, বাজাচ্ছিল তোমার লাস-ভরা নাভি,
গাছগুলো খুরে খুরে দণ্ডবত, ফিরেও তাকাওনি, শুইয়ে দিলে ঘুমে
       আমি এক পঙ্গু— ব্যালকনি প্রিয়, শেফালি গাছটার
                     প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলাম, মঞ্জুর--
             আজ গিয়ে দেখি, অসময়ে দু-একটি কুঁড়ি

বড়োসড়ো একটা আসর নির্মাণ করে ভেঙেছিলে তার ঠাঁটবাট
    উড়িয়েছিলে ক্যানেস্তারা, নিভিয়েছিলে সহস্র বাতিদান
           ঘরছাড়াদের ঘরগুলো সব লাশ
              এ ওর ঘাড়ে ও ঘরে
                 পোস্টমর্টেম
                  প্রতিক্ষায়

                  সাগরের
                ঢেউয়ে তোমার
            স্টেপিংগুলো ‘নাচ ময়ূরী নাচ’
         মুদ্রাগুলোর নয়া-সংস্করণ তিন ভুবন-পার
     তাল-লয়-ছন্দের একঘেয়েমি ভেঙে তনছট অঢেল হাসি
মাইরি উলুপী ওরফে উমপুন স্বর্গে এ-নাচনে নিশ্চিত অভিশাপ ছিল কপালে

আসর ভাঙলে যখন, ঘোরের রাত ঘুমোয়নি
      তোমার পদক্ষেপের ছাপ-ছোপে শ্রোতা-দর্শকদের ভিরমি
          হয়তো আবারও নাচবে নয়া-সাজে নতুন কোনো নাম ভাসিয়ে
আমি লজ্জার মাথা-খাওয়া, আবার তোমার ঠোঁটের কাঁপন
         থাইয়ের মাখন, ভুরুর সেকেন্ড-ব্র্যাকেট, চোখ-টেপা খেজুড়
                 স্তনঢাকা চেলিটার ফেলে ফেলে দেওয়ার
             প্রতীক্ষায় থাকব, আলবিদা বলতে তো পারিনি তোমাকে… 
২৩/৫/২০২০।
৩৪
নাই নাই-গুলো ড্রামবিট হয়ে উঠছে
      করুণ বেহালা এখানে অচল
                      একটা স্যাক্সাফোন দরকার

উম্পুন কেমন ভুলিয়ে দিল
      সাবানজলে বারবার হাত-ধোওয়া
                       মাস্ক ঝুলে থাকল ব্র্যাকেটে

‘উদ্ধার’ শব্দটাকে নেড়েচেড়ে দেখছে লক্ষ মানুষ
     ‘আশা’ বুদ্‌বুদ্‌ হয়ে করুণ প্রার্থনা সঙ্গীত
             শুয়ে পড়া গাছেরা বাঁচিয়েছে
                             এবার কি মারবে!

মিঠেজল লোনাজল মিলেমিশে মীমাংসা
   হেলিকপটার দু-চার পাক আকাশ
          ওই একটু সবুজ ধোঁয়া
           তরমুজ খেত

শান্ত বাতাস মৃদু, চিকন বাঘের পায়ের ছাপ, নীল-সাদা আকাশে
               চিতা কিছু জ্বলছে
ছেঁড়াখোড়া সবুজ, বনানী ইজ্জত খোওয়া, ভালো আছে চারা-ছেলেমেয়ে
               কবরের মাটি ভেজা

বিউগল বেজে উঠলে অনাহারীরা তন্দ্রা ছেড়ে উঠে বসবে
         ইভাক্যুই-ক্যাম্পগুলোতে আলো জ্বলবে সন্ধ্যায়
               ক’দিন বাদেই মরা আধমরা ঘরগুলোকে
                           ওরা ঠিক খুঁজে পাবে
                                        যেমন আগেও পেয়েছে

২৪/০৫/২০২০।


   -"রবিবার"-
অভিষেক মোহিন্তা 

রবিবার বুড়ো হয় না,
রবিবারের বয়স বাড়ে না,
চামড়ায় ভাঁজ পড়ে না,
সব সময় রিংকেল ফ্রি।
রবিবার বুড়ো হয় না।
রবিবারের কোষ্ঠকাঠিন্য 
শত জনমেও ছিল না,
তাই ভুঁড়িভোজে কোন বাঁধা নেই।
রবিবার চির সবুজ,
চির নবীন। 
রবিবার গান গায়,
ছবি আঁকে, কবিতা লেখে,
গল্প পড়ে, গিটার বাজায়,
নাচ করে, আরো কত কি,
রবিবার চির নবীন।
রবিবার চির যৌবনের
জোয়ারে ভেসে আছে।
রবিবার লংড্রাইভে যায়,
রবিবার চুমু খায়,
গোপন গোপন খেলা করে,
অন্দরে, বাইরে, নির্জন দুপুরে।
রবিবার  ভাতের পাতে দুপুরে
খাসির মাংসে ডুব দেয়।
রাতে দেয় মদের গেলাসে।
রবিবার প্রেম, পরকীয়া করে
আইন স্বীকৃত পদ্ধতিতে।
রবিবার বয়স বেঁধে রাখার
মন্ত্র জানে,
তাই রবিবারের
বয়স লুকাতে হয় না
বা পার্লারে যেতে হয় না।
রবিবার বুড়ো হয় না,
রবিবারের বয়স বাড়ে না।।
 


নৌকাঘাটে বসে একদিন 
সুমন মল্লিক


গাছের নীচে বসে ক্লান্তি খুলে রাখছি
সদ্য পাওয়া ব্যথা ভাসিয়ে দিচ্ছি জলে
এমন সময় বৃষ্টি এলো, বৃষ্টি এসে
ভিজিয়ে দিলো সব, জুড়িয়ে দিলো প্রাণ
বৃষ্টি থামার পর বুকের সাদা কাগজে
এসে বসলো একটি ডানাভাঙা দোয়েল


এই নিঃসঙ্গ নদীবাঁধ, এই শান্ত স্নিগ্ধ বাতাবরণ
এখানে কোন পাপ ধেয়ে আসবে না, কোনদিনও...


ওপার থেকে ভেসে আসছে মন্দির-ধ্বনি
এপারে পার ভাঙে বর্ষার অস্থির নদীজল
মাঝখানে একটা অদৃশ্য নৌকো –
তাতে দিগন্তে পাড়ি জমিয়েছে প্রিয়তম অপরাধিনী


পাশ ফিরে তাকাই না এখন
পাশে কেউ নেই
নাগরিক বসবাসে মাঝে মধ্যে এখানে এসে বসি
দিনে আসি না, বিকেলের পরই অধিক মনোরম
বৃষ্টি না থাকলে জোনাকির উড়ান দেখে দেখে
মুগ্ধ ও পুণ্য করে তুলি মানসচক্ষু


অন্ধকারে ভয় লাগে না আর
এই অন্ধকারেই মাঝে মাঝে
অক্ষরেরা আলো হয়ে ফুটে ওঠে তারার মতো
যেমন এই চাঁদিনি সন্ধ্যায়
তমসামধুর এই নৌকাঘাটে বসে
আমি অফুরান করে তুলছি অবিচল বোধোদয়


অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

১. 

শব্দ-গন্ধ-বিষ।
আঠা দিয়ে জুড়ে গেছি
কাগজের শেকল।
সময় জুড়ে
সমর্থ সাহসের মত ছিল
অবাধ সে ছোটবেলা।
এখন শব্দের আঠা খুলে গিয়ে
বেসামাল বেশেকল
হয়েছে বিকেল।
তপ্ত হয়েছে বিষ,
রিক্ত হাতের সন্ধ্যাবেলা।

২.  

অতীতের গির্জা
আলো ফেলে
ভবিষ্যতের সন্ধ্যায়।
বন্ধুরা ছিল আলোয়
থেকে যাবে অন্ধকারে।।

৩.

পথপ্রান্তে এসে
ফিরৎ ফিরলে
দেখা যায়
পথ নয়
প্রপঞ্চ সব গুল্মঘর।।

৪. 

অনেকগুলো, অনেক বছর পর, 
ছোট্ট মেয়েটা কত্ত বড় হলো! 
কোলের থেকে নেমে স্বয়ম্ভর,  
আগলে রাখলো বাতাস, স্মরণগৃহ।। 
স্মৃতির তাপে অতীতঘরের আলো,  
বড় হয়েও ছোট্ট মেয়েই থাকুক,
পাকা চুল পাকা দাড়ির চোখে,
আমি বরং অতীত আকাশ দেখি।
হাতে নিয়ে ছোট্ট মেয়ের তুলি
বসে বসে সময়গাড়ি আঁকি
আঁকি পাহাড়, আঁকি নদী, চূড়া
আগের মত আবার বেড়িয়ে আসি।


৫. 

শিরার অবাধ্য গভীরতার কথা বললে,
অতীতসুলভ সে চিকিৎসা মনে পড়ে।।
ধমনীপ্রবেশ সুনিশ্চিত হলে,
হাওয়াপাইপের ভিতর,
স্যালাইনের সঙ্গে মিশে যায়,
শরীর হতে বহির্মুখী রক্ত।।
বাথরুমের মাকড়সাদের সুগন্ধে মেরে ফেলার পর,
সহসা ফেটে ছড়িয়ে যাওয়া পা বরাবর,
অল্প একটু কান্না পড়ে থাকে।।








মধ্যরাতের সংলাপ
--------------------
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়



( ছাব্বিশ )


দুর্ঘটনার উৎসবিন্দু থেকে উড়ে আসা কিছু যান্ত্রিক ছায়ার সঙ্গে অতীতে দেখা হয়েছিল বলে মনে পড়ে, যাবতীয় লালের শরীর নিয়ে কেউ কেউ সেই উৎসবিন্দুতে ঘর পেতেছিল, সময়মতো সঠিক জায়গায় থেমে যাওয়াটাই যাদের আদর্শ তাদের সঙ্গে কোনো সংঘাত নেই বলেই প্রচারিত সত্য, আমরা হাসি ধরে রাখতে পারি নি, অথচ সেই হাসির গভীর থেকেই উঠে এসেছিল এমন কিছু সমীকরণ যাদের শরীর সমগ্রে নিহিত ছিল লাল বিন্দুর রহস্য, জলের গভীরে ছিল যাদের যাতায়াত তারা প্রচার চালিয়েছিল দিনভর, অদৃশ্য তারের শরীরে ঠাঁই হওয়া যেসব বাক্যবন্ধ সারি সারি শুয়ে আছে হিমঘরে, সভ্যতার শব্দে যা এখনও বিভিন্ন দিবসে মঞ্চে উষ্ণতা দেয় 


( সাতাশ )


দুয়ার থেকে হাত উঠে গেলে অনেকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়, কেউ যেন পা দিয়ে রেখেছিল চলাচলের পথ, উঠে গেলে যতটা মাটি এক জায়গায় এসে জড়ো হয় চিরস্থায়ী পথের রেখা আঁকার জন্যে ঠিক ততটাই মাটি এখন দুয়ারে ছড়িয়ে আছে, মেঘ এলে চিনে নেবে ঠিক, মাটির কণায় কণায় ধরা মেধাবী তেজ, বৃষ্টির তালে তালে সব ফোঁটা ঝরে গেলে খোলা হবে অতীত পাঠশালা, বর্ণমালায় মাথা দুলিয়ে গুরুমশাই আঙুলে আঙুলে দিয়ে দেবে গোপন বিদ্যুৎ , তারপর ভেজা ভেজা সন্ধেয় হ্যারিকেনের আলোয় দুয়ার জুড়ে বাদল পোকা, অন্ধকারের ঘনত্ব আর বাদল পোকার বাতাসে বাঁক নেওয়াই বলে দেবে কতদূরে আছে রান্নাঘর


( আঠাশ )


রাতের চোখের মতো এখানে ওখানে জ্বলে আছে কয়েকটা আলো, মনে হয় এখনো যেন ঠিক ঘুম ভাঙে নি, অথবা অনেকক্ষণ পাতা খুলে রেখে ভারি হয়ে গেছে, বছর কয়েক আগে একবার শুধু চৌমাথায় গায়ে গা লাগিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল ভিড়ের রাজ্যে, শুধু মাথা উঠে এসেছিল তার, হাত দিয়ে কিছু লিখেছিল প্রচলিত রাস্তার বিপরীতে, কেউ কেউ জেনেছিল কথা খুব রেগে গেলে ঝড় উঠে যায়, ধুলোমাটি কাদা হলে ঝড় নামে দেখা মেলে হাওয়া, এবার তো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আগুনের সঙ্গে হোক সখ্যতা, দোষ নেই মাটি ভারি হলে তবু থাক ডানা, জল থাক গোপনে গোপনে যেন ঝড় উঠলে আগুনের চোখে মাটি ডানা মেলে দিতে পারে


( ঊনত্রিশ )


একদিন হঠাৎ করেই সব জানলা খুলে দিয়েছিলাম, একঘেয়ে লাল ভোর আর হলুদ দুপুরের রঙে কিছু একটা মাখাতে চাইছিলাম, জানি এগুলো কিছু লিখে রাখার নয়, জানলা খোলার অনেক ব্যাখ্যা হয়েছিল, অথচ ব্যাখ্যা তো একটাই, মানে একলাইনের একটাই উত্তর বাতাস চেয়ে পাঠানো, জানি এগুলোও কিছু লিখে রাখার নয়, আপ্রাণ চেষ্টাতেই শুধু আষাঢ়ের জানলা থেকে দেখেছিলাম শ্রাবণ, বৃষ্টি চেয়েছিলাম কিন্তু এত বৃষ্টি যে কিছুই দেখা যায় নি, রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল হাঁটু সমান জল, পায়ে পায়ে অতি কষ্টে যখন রাস্তায় ওপারে গিয়েছিলাম তখন সব বাস চলে গেছে, একটা কথাই শুধু লিখে রাখব কেউ ছিল না


( ত্রিশ ) 


ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেও প্রথম বাস ফেল করার দুঃখ দ্বিতীয় বাসে উঠে অনেকটাই কেটে যাবে, উঠেই জায়গা পেলে আরও কিছুটা, আর ঘাম ঝরানো দুপুরে জানলা দিয়ে হাওয়া আসতে শুরু করলেই শেষ অংশটুকুও হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাবে, বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো আস্তে আস্তে মরে আসবে, খুলে যাবে একটার পর একটা জামার বোতাম, শেষ বোতামে হাত দিতেই ঠিকানা এসে যাবে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রথম দ্বিতীয় কোনো বাসই তখন আর মাথায় থাকবে না, ছায়ার শরীর দীর্ঘ হবে, চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে একের পর এক বাস, সাইকেল রিক্সা মোটরের পাশ কাটিয়ে আপনি তখন বিকেলের আড্ডায় 




                   

ফোনের পাখি 
সব্যসাচী ঘোষ


ফোনে কথা বললে এখন মানুষের সঙ্গে ফ্রিতে
পাখির ডাক পাওয়া যায়
সকালে বসন্তবাউরি, বিকালে বেনে বৌ
আর রাতদুপুরে কোকিল
প্রেমের সঙ্গে পাখি যায়, যাবেই
কিন্তু রাগ, ক্ষোভ, উদ্বেগ, সর্বোপরি মৃত্যু সংবাদ?
সবেতেই পাখিরা এসে গিয়েছে
ধানের খই খাবার মত ওরা সব সংবাদ খুটে খায়

যাপনচিত্র
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী


বর্তমানকে খুঁটিয়ে দেখার অপর নাম পর্যবেক্ষণ,
যত দেখি নির্নিমেষ
তত বেশী করে বুঝি, দেখার শেষ নেই
মরুভূমির মাঝে যেমন সতত দৃশ্যমান মরীচিকা

দুজনে মুখোমুখি বসার অপর নাম আলাপচারিতা,
যত বসে থাকি
তত ইচ্ছা হয় আরও কাছে যাওয়ার
মেঘ যেভাবে ইশারায় পাহাড়কে অলক্ষ্যে ছুঁয়ে যায়

একজন পশ্চিমে অন্যজন বিপরীত মুদ্রায় স্থিত
একটি ঘর থেকে আর একটি ঘরের দূরত্ব অল্প 

নীলবর্ণ ছুরি
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

জ্যোৎস্নার গায়ে  বোরোলিনের গন্ধ
রাত্রি একটা ভালো লাগা নিয়ে
গান গায় ছাদে
টুপ করে পাতা নামে কবিতার
আইশোলেশন শব্দ মুছে স্মৃতির ভীড়
ভিড়ে যাচ্ছে নৌকা জঙ্গলের কিনারে

সেলাই হবে না এসব কিছুই
অর্ধেক অন্ধকার যখন
রাক্ষুসীর গল্প শোনায়
আরেক অন্ধ লেখে একটি আকার

যা আছে তা চেনা নয়
চোখের হাসির উপর
খিল দিতে নেমে আসছে নীলবর্ণ ছুরি

২.
পুনর্জন্ম


পৃথিবীর অসুখ বলে
সে ক্রমশ ম্রিয়মান
এতো এতো রসালো ফলের সমাহারে
লিখে রাখে মৃত প্রজাপতির কাহিনী

স্রোত চিনি
বিপরীত রূপটিকেও
সুর আসার পর
নদীর প্রেমে ভেসে যায় তার শুখা দেহ

জন্ম আবারো ঘ্রাণ পায়
এ সুবাস মৃত্যুর নয়
অসংখ্য নষ্ট কবিতার পর
একটি সফল উল্লাস বলে জেগে থাকে বৃক্ষশরীরে

৩.
ধোয়া


হাত ধুয়ে ফেলছি প্রতিদিন
গন্ধ ভাসছে সাবানের
ফেনার সঙ্গে
শরীর স্পর্শ করে উড়ে যাচ্ছে
এক কাল্পনিক আকাশে
যা তৈরি করতে অনেক সময় লেগেছিল
চার দেয়ালের ভিতর
কত গোপন কত অন্ধকার
কত আলোলিকার কথা
ফুরতে চায় না
মাঝে একটা শৈশব ফিরে এসে
ছবি দেখায় দোলনার 
দুলতে দুলতে একটা গাছ
ডালে ডালে পাতায় 
লাফ মারছে ডানাওয়ালা পরি
ধরা পড়ছে না কিছুতেই

ইউক্যালিপটাস
           সোমা সাহা পোদ্দার


    আবাসনের কিনারা বরাবর তাকাতেই
অনেকটা জুড়ে ইউক্যালিপটাস এর বাগান বাড়ি ।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি জুরে বিছিয়ে দেওয়া ছায়া পথ
         কেড়ে নেয় ছোটদের দুপুর ।
               ঘরমুখো হতেই ---
         শহুরে ভির ঠেলে যেন এক
 নির্জনতার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া ।
সন্ধ্যার পায়চারিতেও যোগ হয় অন্যমাত্রা ,
     এভাবেই  আরও কিছুটা পথ ---
মাঝে মাঝে এক অজানা শব্দ কেড়ে নিচ্ছে ঘুম
কারা যেন ঝরা বুকে চিৎকার করছে
   কিছু বোঝার আগেই হাত বাড়াই
   ঘুম ভেঙ্গে যায় শব্দ যাপন চিত্রে ।

হঠাৎ ই  ঘন বনের  হাল্কা হয়ে আসা
   বেজে যাচ্ছে ফোন  বনদপ্তরে
        প্রশ্নেরা ……উঠে আসে
ইউক্যালিপটাসের বেশি শোষন ক্ষমতায়
     জলের যোগানে  কাঁটার নির্দেশ ।
দুপুর নামতেই বাকি চিহ্নও মুছে গেল
সঙ্গে   ছায়াপথ ছোটদের দুপুর  আর সেই শব্দেরা ,
   অন্য শব্দে  আরেক আবাসন গড়ার নেশায়  ।

একটি প্রশ্ন
          শোভন মণ্ডল

সেই সব দিন আমাদের জন্য নয়
এ কথা মেনে নেওয়া ভালো
দীর্ঘ যুদ্ধের পর পড়ে আছে ছেঁড়া জুতো,  নীরব অস্ত্র, অগুন্তি মৃতদেহ
আমরা কোন কিছু ছুঁয়ে দেখিনি
বিষন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করিনি একটিও
ভাঙা হাট থেকে ফিরে গেছে যান
পথে লেগে সাঁজোয়ার দাগ

আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি
বিবর্ণ,  ফুটিফাটা হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি
আর মনে মনে বলেছি,  কৃষ্ণেন্দু  আর রীণা ব্রাউনের মিলন হলে
কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো !



বৃষ্টি আসার আগে
         

সেদিন মেঘ করেছিল

আমাদের গ্রামে নেমে এসেছিল ভিনদেশী হাওয়া
পাঁচিলের গা ঘেঁষে পেঁপে গাছটা আর সোজা থাকতে পারেনি
দুলছিল নারকেল গাছ,  সুপুরির মাথা
 ঘন্টা বাজছিল মন্দিরে

সবাই দেখেছে,  শুনেছে

এই ঘোর বর্ষায়
মাঠ পেরিয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু ছুটে গেছি
ওই যে শেষপ্রান্তে
আমাদের  প্রিয় নদীর কাছে,
আমরা দেখেছি
কেমন লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে
       সে খুলে ফেলেছিল তার বুকের আঁচল


প্রায়স্তব্ধ শ্বাসমূলের কবিতা 
নীলাদ্রি দেব 


জয়ের প্রতীক আঁকা পতাকার ছায়া 
    বারবার মিশে গেছে সাগরের জলে 
চেনা ছায়া দীর্ঘ হয় 
ক্রমে আলোর অভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হলে
ঢেকে যায় মানুষের মুখ
যে মুখে মুখোশ জড়িয়েছিল অবিচ্ছেদ্য ভাবে
ছায়াপথ ঘুরে এসে খুঁজে নেয় সময় অসুখ 
সময়ের দিকে দোষ!
দোষ আর কত দেবে?
যে সময়ে নত হওয়া, স্তব্ধতা...
         খানিকটাও জরুরি ছিল, 
                       উবে গেছে স্মৃতিচিহ্ন থেকে
ওদিকে মৃত সব মাছের শরীর 
কাঁটা আর আঁশের দোহাই
   মাটি নয়, দেশ নয়,
   আজন্ম উঠে আসা চিৎকারে 
      অন্তত পৃথিবীকে প্রাণের পিণ্ড বলে ভেবো 

যেদিন ঐ সমুদ্রের তীরে আলান কুর্দির শেষ কান্না
    শুনেছিল লাল কাকড়ার ছোট শিশুটি 
    শুনেছিল শেষ প্রশ্বাসের শব্দ 
সেদিনই বার্তা রটে গেছে 
                     রটে গেছে সূর্য শিবিরে 

যেদিন যশোরের এতগুলো গাছ
   মৃত্যুভয়ে প্রতিটি শ্বাসের মাঝে 
                   জুড়ে নিল ফুসফুসের ডাক
   পত্ররন্ধ খুলে দিল রাত নটা আটান্নয় 
যেদিন সন্ধ্যার আগে হঠাৎ বেড়ে গেল বাষ্পমোচন
তুমি কান্না বলে ভাবনি তো 
ভাবেনি তো কেউ  
তাই এই গোপন স্বীকারোক্তি 
যার সাথে নাভিমূল, জুড়ে আছে সূর্য শিবিরে 

এত এত অভিযোগ, স্তূপ 
জ্যোৎস্না ঘেঁটে ভিড়ের ভেতর 
              কোনো এক সূত্র উঠে আসে
ফেলে আসা পথে 
    স্পর্শ আর দাগ বেয়ে স্তব্ধ রেস মাঠ 
ইঁদুরের গর্তের ওপর সাজানো পলির স্তর 
      ঘাসে ঘাসে শিশিরের দানা 
      মেঘেদের শেষতম আর্দ্র ভাগফল 

এতসব বয়ে চলা মানুষ শরীর 
                উবু, আরও উবু হয়ে আসে 
নুব্জ তো হতে হয় বয়সের ভারে!
তবে কেন মৃত্যুপরোয়ানা... মেনে নিতে এত ভয়?
আত্মসমর্পণের আগে বাকরুদ্ধ, নতজানু আজ 
                                               সময়েরই কাছে
যুদ্ধ!
যতটা যুদ্ধ ভেবেছ তুমি 
         হয়তো বা ক্ষমার প্রলেপ 
এত বড় হৃদযন্ত্র নিয়ে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ছে একা 
        ঘন এক কুয়াশার মতো 
       শীতরাতে মায়ের চাদর 
যার নিচে আমাদের ত্রস্ত হামাগুড়ি, অন্ধ চিৎকার
সমস্ত দৌড়ের শেষে শুধু শ্বাসবায়ু ঘনীভূত হয়
শুধরোবার শেষ ইচ্ছেগুলো 
                                কিছুটা বরফ গলিয়ে জল 

বাঁচার শর্ত সব নদীর মতো 
মানুষ বয়েই চলে 
স্রোতে স্রোতে আলোর খিদে, আগামীর গান
আমার বারো চন্দ্রমাস
-এ কে এম আব্দুল্লাহ



বেইজমেন্টের দরজা খুলতেই
বেরিয়ে এলো
অনেকগুলো বিগত শুভনববর্ষ। 
শুভেচ্ছার সাথে শুয়ে আছে আবেগ
একই বর্ণ—
একই গন্ধ—
ধূলো টুলো সরিয়ে দেখি ; দাবার
ঘোড়ার মতো বসে আছে পাশে ;
আকাংখ্যার কঙ্কাল।
স্বপ্ন 
সুমনা ঘোষ 


ঝাপসা আমার কবিতারা ,
রবিহীন কোন বৈশাখে ।
বেদনারা বুকে চেপে আছে 
সেসবের কে বা খোঁজ রাখে ।
কতদিন হয়নি যে লেখা,
ডায়েরির পাতাগুলো কাঁদে।
কলমেরা নিয়েছে যে আড়ি ,
প্রেমহীন বিষাদের ফাঁদে। 
খাবারের হাহাকার কান্নায় 
মুখ ঢাকে এক মুঠো ভাত ।
গ্রামে গ্রামে দিতে গিয়ে ত্রান 
জাগি কত ঘুমহীন রাত।
স্বপ্ন এখন শুধু দেখি 
মিটাবো কেমন করে জ্বালা! 
অভুক্ত সকলের মুখে
 তুলে দেব এক থালা ভাত।।

মৌন ফাগুন   
ছবি ধর  

আমিও  চললাম  সেখানে 
পাখীদের  দরবার বসে  রোজ  যেখানে  
অর্গানিক  বাগিচা  ভরপুর  অম্লজানে  l
দিনভর  কুহুতান  টুকরো টুকরো   দানা  আর  সবুজের  টানে l
 পাহাড়ের ঢাল  বেয়ে  ঝর্ণা  কলমে  লেখা  
জল নামে  সেখানে l
চখাচখি   আর  বালিহাঁস  লুকোচুরি  খেলে  
 দ্বীপ  জেগে থাকা  নদীর  মাঝখানে l
যেখানে পলাশ  শিমূল  বাতাসে  ছড়ায়  ফাগুন
কৃষ্ণচূড়ার  গাছে  গাছে  ফুলের  পাপড়িতে   যেনো  জ্বলছে  আগুন l
   পাতায়  পাতায়  করতালির গুঞ্জন 
কলহ নেই  কোন   , চুপকথা  অন্তহীন  l
এক অদ্ভুত  বসন্ত  বিরাজমান   - 
আমি  একনিষ্ঠ   মৌন  শ্রোতা  হবো  সেই  ফাগুনের l

শতানীক রায় 


পৌরাণিক পদ্ম নেই  

বৃষ্টি নিয়ে আমাকে কেউ ভাবতে বলছে না এতে অবশ হলাম। সকালে হাওয়া দিশাহারা হয়েছে। মানুষ আর লবণের কারিগর তুমি। হঠাৎ করে উদয় হও আর মিলিয়ে যাও। পৌরাণিক পদ্ম নেই। গন্ধ নিয়ে যারা খেলা করে তাদের গান সম্পর্কে অদ্ভুত বিরাগবোধ কাজ করে। কাজ করে সূর্যের প্রার্থনা। আরাম। গ্রহণপর্বের এই কথাগুলো জানেন কবি। কবির ওজনহীন অবস্থা না শেষ হওয়া গানের মতো যত ছুঁতে যাই ততটাই দৃশ্য ভেঙে গলে যায়



আকস্মিক একটা বাড়ি 

কলোরাডো নদীর তীরে আকস্মিক একটা বাড়ি অদ্ভুত বড়ো হয়ে উঠেছে। প্রাচীন অর্জুনগাছ একটা প্রাচীন ওকগাছকে ঘিরে রাখে। একটা আলোহীন বিষাদ একজন মানুষকে আলোকিত করছে। তাকে কলোরাডো বুঝতে শেখাচ্ছে গাছ আর শরীরের পার্থক্য। পার্থক্য তাকে শেখাচ্ছে শরীর সম্পর্কে। কলোরাডো নদী কখনো ওকগাছ হবে না। অর্জুনগাছ কখনো শুধু শুধু নদী হবে না
রাহুল গাঙ্গুলী


১টি তরল সূত্র & অগস্ত্য বিরোধীতা
--------------------------------------------------------------------
পরাপ্রান্তিক             সরুনল
                              একটুআধটু ডাইনোসর

                              হুহু ছায়াজল 
                                                }}} 
                                                 হাওয়াকল ♪

এভাবেই ~ ?  ?  ?  ভা ঙ চু র

# ভাসমান মসৃণ _______

(১/২) পিঠ বেছে নিলাম
                                   বাকিটা নগ্নতা 

                                                 চু         চু
                                                 ই         ই
                                                য়ে       য়ে
       
                                                   থৈথৈ 

                                     বিপরীতে মোম


++++++++


লকডাউন পরবর্তী করোনাদিন
--------------------------------------------------------------------
এক্কাদোক্কা  ||  দোক্কাএক্কা
                     
                     এগিয়েপিছিয়ে চাল _____

                      ♛}  →
                              →  { ♞ 
                    ¿  ¿  ¿  ¿  ¿  ¿  ¿   ↓↑
                                                  ♚ 
                                              ∠45⁰ ↓↑
                                                           ⚀₀₋₁

# [N O D E]ⁿ   ☞ ☜  ◑ )))) টুপ্ আপাততো

আসলে ______

মেরুনরঙের খোলাপাতা   ~       বেশ হতো
                                          আনাগোনাহীন আলাপ