Saturday, February 24, 2024

কবিতা করিডোর, ফেব্রুয়ারি সংখ্যা, ২০২৪


 

 সম্পাদকের কলম

দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল কবিতা করিডোর । আসলে ব্যক্তিগত জীবনে কিছু সমস্যা মাঝে মাঝে ছেদ টেনে দেয় । আর ছেদ দীর্ঘতর হয়ে ওঠে কোন গভীর অসুখ দেখা দিলে ।  চোখের সমস্যায় দীর্ঘদিন জেরবার হবার পর এখন কিছুটা আরমে । যদিও চোখের সমস্যা আছে কিন্তু কবিতা বা সাহিত্য চর্চা নিয়ে যে টান সেটা কখনোই মরে যায়নি তাই কবিতা করিডোর প্রকাশ করার চিন্তা পুনরায় দেখা দিয়েছে । আর প্রকাশ করতে গিয়ে যা কিছু লেখা সঞ্চয় ছিল সেগুলোই প্রকাশ করা হলো । নতুন করে কারো লেখা চাওয়া হয়নি । প্রকাশনের কোন ভুল ত্রুটি থাকলে অবশ্যই  ক্ষমা করে দেবেন । পরবর্তী সংখ্যাগুলোর জন্য পরবর্তী সময় লেখা চেয়ে নেব। ধন্যবাদ।

কলমে - শুভঙ্কর পাল

 সম্পাদক -কবিতা করিডোর 

বারবিশা,আলিপুরদুয়ার

৭৩৬২০৭

মোবাইল -৯৯৩৩৭৭০৫৪১

মেইল আইডি - subhabrb@gmail.com

নন্দন তত্ত্ব নিয়ে লেখা - শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 






 টেকনিক্যাল

       --- শশিভূষণ পাত্র

একটা ছাদ দেওয়া হোক

নির্বাচিত অসুখ ধারনায় মেকানিক প্রয়োজন
ছেঁটে ফেলো বিকল যান্ত্রিক সমস্যা,
আঘাত-গর্তে রাখো শহুরে সমাধান
কাঠি বাছায় জটিলতা নিপাত যাক।
সেলামি ও তোপ দিয়ে কি শোক যাত্রা হয়?

স্মৃতি সৌম্য বিলাসিতা, মাত্র
নাগা সন্ন্যাসীর পথ ধরেছি
পরোয়ানাহীন, কোন মৃত্যু যন্ত্রনা

যুদ্ধে জীবিত হব
দীর্ঘায়ু তরবারির কোপ দিয়েছি।
ক্লান্তির পর ফিরে... একটা পৃথিবী, শুধু আমার।
বাছাটা সময়ের মতো হোক
দেওয়া হোক অবশেষে একটা ছাদ।

            


নীল পাখি মশাল হাতে
   -------------------

ভুলে যাওয়া শর্ত হলে

বেঠিক অপশাসনের যুগে অন্তহীন জটিলতা
মোড়ক পাতায় ত্রিভূজের জন্ম হওয়া,
ভিড় করা জ্যোৎস্নার বালিশ খামে
অনুগদ্য জনতার প্রবৃত্তি
        লোকালয় সংজ্ঞা হানে
         অবাঞ্ছিত দেবতার চিহ্নিত দূত।

বেখেয়ালি সূত্ররা
ইকোনমিক্সের ফাঁদে হড়কে পড়ে।
ঘুরে ফিরে তর্ক যুদ্ধ আসে।
নীল পাখিগুলো
জলপাই আনতে উড়ে গেছে

মশাল হাতে।

 

     ডিলিট   
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
----------------------------------------------------
   হঠাৎ পিছনে তাকাতে ভয় হল। ডোরাকাটা নি:শ্বাস। কালো হলদে বাতাস যেন রেলিং বারান্দায়। একেই সন্ধে থেকে দোয়েলটা একাই বসে আছে ঠায় কার্নিশে। কোন বাড়ি নেই ঘর নেই ওর। অথচ দেখ,  ভোর ভোর সঙ্গী ঠিক এসে যাবে, ধরবে ছুয়ে দেবে, চিৎকার চেঁচামেচি, ঘুমের বারোটা বেজে গেছে ততক্ষণে, ঐ ডোরাকাটা নি:শ্বাস ফেলছে... এত দেরি কেন বাপু, খাওয়া মানে টুকটাক ঘোরো ফের, এত বড় ঘর দোর নিয়ে আছ, মেঝেময় পায়চারি কর তারপর শুয়ে এক ঘুমে সকাল কর, তা না, আজে বাজে সব ভয়, আজে বাজে সময়ের উপর হাত। আর টুকটাক এলোমেলো প্রেম। 
ডোরাকাটার দীর্ঘশ্বাস শোনে, সে কি রে বাপু তোরা! এ বয়সেও.... না থুড়ি, তুই ত বয়সী হবিই না বলেছিস কোনদিন। কে যেন তোকে সেই বরটি দিয়েছিল...  ঐ যে উর্বশীর মত না কি রম্ভা কে জানে! হোকগে যাক, এই যে ভারি রিল্যাক্স মুডে রান্না করেছিস খেয়ে নিয়েছিস... এখন বাপু জপ ধ্যান কর, তা না! একটু করে রান্নাঘর বর্তন মাজাঘষা আবার ভেজা হাতেই হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ! কাকে করিস বাপু দেখি দেখি,... ঘাড়ের কাছে গরম নি:শ্বাস। -ও বাব্বা! ডোরাকাটা পড়বে কি ঐতো অন্ধকার, ঐতো কেরামতি, নিজের পেজ নিজে ছাড়া খোলার উপায় নেই। আর মুহূর্তে সব গায়েব!  এতো সেই দশ বারো বছর আগেও পারতিসনা। 
নির্বোধের মত ছোট্ট হ্যান্ডসেটে পিং পিং বাজলেই ডোরাকাটা গুঁফো ফুলে ঢোল, কান খাড়া। রান্নাঘরে বেজায় রগরগিয়ে রান্নাবান্নার মধ্যেও, সব এদিক সেদিক খবর আদান প্রদান, এ পত্রিকা সে পত্রিকায় লেখা ফ্যাক্স! বারে বা! এত শিখলি কোথায়!... গুঁফো ডোরাকাটা আরো ঝাপটে আসে। গায়ের গন্ধটা কেমন বোঁটকা মত। কেন রে এত সৌখিন আয়োজন, জামাকাপড়ের চাকচিক্য, বয়স মেরে কেটে পঞ্চাশ তাও এদিক ওদিক ধরবে কে আর!... সেই তো আগুন আগুন লম্ফ ঝম্প ডিঙোতে ডিঙোতে বোকা বোকা প্রস্থান। নাটকের যবনিকা পাত। বিশ্ব নাট্য দিবস গেল চলে, তুই করলিটা কি? কিছুই না, শুধু পরিকল্পনা মনে মনে আর মেসেজ ভারাক্রান্ত ছবিগুলো আঙুলের চাপে গায়েব করে দেওয়া নয়তো ঐ দুর্মুখদের যাবতীয় কথোপকথনেই আর রঙ চঙ ঢঙেই বারোমাস। 
এ যাবত তো ডোরাকাটার আরও হাসি পায়, থুড়ি, হাসি না, রাগ আর নিজের ব্যর্থতার প্রতি ঘৃণা জেগে সুপার ইগো কমপ্লেক্স । 'আমি কম কিসে! 'তোরা যতই দেখা বাপু আমি ঐ তোদের পুছিইনা।... আবার বাঘের ছালের পোড়া গন্ধ রান্নাঘর পর্যন্ত, ঐ মহিলার নাম কি! কে জানে, সকাল সকাল সব কাজ ফটফটে কমপ্লিট। দৌড় যেন কচি খুকি টি। এ কাজ, সে কাজ এ ঘর, সে ঘর, না না, দু তিন দিন ঘরদোর এলোমেলো দু-কলম না লেখা সময় কাটে অস্থির অস্থির। 
কেনরে! গুঁফো ভাবে নির্ঘাৎ এলোমেলো প্রেম। পুরুষ পুরুষ। সে ভাবে না, ভাবনাটা মানুষ মানুষ হতে পারে। যে দু'হাতে আগলে এগিয়ে নেবে। ঐ ডোরাকাটার গন্ধ নি:শ্বাস আর চোখ বাঁচিয়ে কোন শান্তির জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে... যতদিন বাঁচবে সে কি হয়!  হয়না। এ যাবত টিফিন ঘর বা মিড ডে মিলের ঘরের রান্নাবান্না, ডিম মাংস কাঁচা অথবা রান্না করা, সেল্ফ হেল্প মাসিদের গাউন, স্কার্ফ, মাস্ক, মাথার টুপি সব ঠিকঠাক আছে কিনা, হাতে গ্লাভস নিয়ে পাঁপড় বিতরণ করছে কিনা এসব দেখতে দেখতে ফটাফট ছবি চলে আসতে থাকে গ্যালারিতে। এক একরকম ড্রেসে ক্ষুদে ছেলে মেয়েগুলো কখনো ফল কখনো থালায় ডিম ভাত মাংস ভাত এক্সিবিট প্রোডাক্ট হয়ে গ্রুপগুলোয় এন্ট্রি পাচ্ছে। অনেকে মুখ দেখিয়ে বেশ আনন্দ আনন্দ ভাব। ঐ সময়টা ডোরাকাটা পিছনে দাঁড়াতে চাইলেও ভয় পায়। না বাবা! ভিড় টিড়...  এখানে ওর ঘাড়ের উপর নি:শ্বাস ফেললে মার খাওয়ার ভয় আছে। এখানে ঐ হলদে, আকাশী শাড়ি মহা মাতব্বর। 
এখানে ঐ চলে আসাটা বন্ধ করতে পারলে বেশ হত।... হুঁ হুঁ বাবা! হবেনা হবেনা। ও এখন আকাশ ছোঁয়া আর মেসেজ গায়েব করে চেয়ারে বসে বসে। 
ডোরাকাটা সব বোঝে, কে যেন কানে কানে কথা বলে, ওর ভেতরে বৃষ্টি আনে। ওর জ্বর হয় আর ও লিখতে থাকে অনর্গল ঝরনা, সুরে কথা বলে বেহিসেবী। কবিতার কথাগুলো সেভাবে নামতে নামতে ছোটে নির্ভেজাল ভাল থাকবে বলে। ইচ্ছের দৌড়ে ও জেতে। আর ডোরাকাটা একটা ঝোপের ভিতর লুকিয়ে হ্যান্ডসেটে একের পর এক ইউটিউবে পর্ণগ্রাফি দেখে। প্রেমে পড়েনা। সেসব প্রেম ট্রেম পাওয়ারও ক্ষমতা দরকার। ডোরাকাটার অদ্ভুত সুন্দর পশমের মত শরীরের দিকে ফিরেও তাকায় না হরিণী। 
সবুজ খোঁজে আর লাফ দিয়ে সাদাটে রাস্তা পেরোয়। এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যের কাছে। সে একা সে সবুজ ঘর সামলে রাখে। অরণ্য সামলায় আর ডোরাকাটার গন্ধ পেলেই সরে সরে ফিরে আসে গুহার ভিতর। এদিক ওদিক এলোমেলো শিঙগুলো
লতায় পাতায় শাখায় জড়িয়ে পড়তে চায়। হরিণী ওর পেলবতা নিয়ে দৃঢ়তার অঙ্গীকারে ঐ গায়েব হয়ে যাওয়া হ্যান্ডসেটের সমস্ত মেসেজ গুলো মন থেকে ঘষে ঘষে তোলে। আবার ভরে, আবার মোছে।
   এভাবেই ওরা সমান্তরাল রাস্তায় হাঁটে পাহাড় পেরোয়। হরিণী কিনে ফেলে পাহাড়টাই পুরো। এবার ও ঐ কচি বাচ্চাদের আর একটু বড়দেরও সত্যিকারের খাবার তুলে দেয় । এত কালের জমানো সব খাবার। আর ঐ অ্যান্ড্রয়েড সেটটাকে দূরে পাহাড়ী ঝরনায় ফেলে দেয় ও। সেটা নীলচে আলোয় ভাসতে ভাসতে চলে। 
-----------------------------------------

 নান কিং

সুমন মল্লিক


টেবিলের চারদিকে চারজন ব্যর্থ প্রেমিক
ছোলা ভাগ করে খাচ্ছে – সঙ্গে কৃষ্ণবর্ণ পানীয়৷
সন্ধের এই সময়টা নান কিং ফাঁকাই থাকে৷

চারটি স্ফটিক পানপাত্র৷
একটিতে তৃপ্তির অপেক্ষা৷
একটিতে মিলনের অপেক্ষা৷
একটিতে প্রেমের অপেক্ষা৷
একটিতে ভাগ্যের অপেক্ষা৷

১, ২, ৩, ৪
ডুব, ডুব, ডুব, ডুব

জ্বালাপোড়া পাকস্থলি থেকে বুক হয়ে
বেরিয়ে আসছে মুখ দিয়ে কথার সঙ্গে
আর চারটি চেয়ার যেন 
উড়ে যাচ্ছে চারটি ভেঙে যাবার মুহূর্তে

আজ নান কিং-এ ডুবে যাবার দিন৷ কবিতার ছুটি৷ 

 শুভ্রনীল চক্রবর্ত্তীর কবিতা

আমার ভারতবর্ষ 


আজ তাপমাত্রা ৪০ ছাড়িয়েছে, 
পথে যাদের থাকার কথা ছিল তাদের হঠাৎ দেখতে পারছিনা - 
সুড়ঙ্গের ভেতর সুড়ঙ্গ বানাচ্ছে পিঁপড়ের দল 
খাদ্যের সন্ধানে আবহাওয়া দপ্তর ___ 

তাপমাত্রা ৪০ হোক অথবা ৪ ওরা রোজ এখানেই থাকে, আমার সাথে রোজ চোখাচুখি হয় -
         কথা বলার সাহস পাইনি কোনোদিন, 
         
যে ছেলেটা গোলাপ বেঁচবে বলে জন্মেছিল - 
       সিগন্যাল শুধু একা তারই __ আমরা তো ক্ষণিকের অতিথি 
       
বৃষ্টির দিনে দেখেছি প্লাস্টিক জড়িয়ে ওদের শরীর কেঁপে ওঠে উষ্ণ হাতে _ আমি লজ্জায় চোখ সরিয়ে নি,
    আমার সাহস হয়না আর ওদের কে নতুন ফুটপাথ কিনে দেওয়ার 

এভাবেই ইশারায় ওরা আমার খুব কাছের হয়ে ওঠে, পিঁপড়েদের জন্য আমি একটা দেশলাই বাক্স কিনি __ কিনি নতুন সুড়ঙ্গ ___ নতুন ফুটপাথ 

এভাবেই সিগন্যালে রোজ আমায় দ্যাখে 
আর মুচকি হেসে চলে যায় 
        - আমার ভারতবর্ষ 

 অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

দীপ্তি প্যাভেলিয়ান 


তাহলে শেষ পর্যন্ত কালি ও থেকে গেল ধোঁয়ার আসেপাশে। 

কিছুদিনের এই এঁকে এঁকে ওঠায় দুপুরের যে হাট ছিল 

তাকে আলাপ করেছি লেবুর হুইলে। 

#

তাও নতুন রোদের তুমি ঠিকানা দিলে না।

#

গেলে না ভূগোল কেটে ইতিহাস ছিঁড়ে রেখে। 

#

ছুটিকে আর গাইতে বোলো না। ওরা শরীরের চরে দ্বীপ বসিয়ে গেছে। 

যাদের আজকাল ডিয়ার লিখতেই সেই প্রীতি 


বুকের নৌকায় প্রথম লিরিলেই টানতে ভাল লাগে।



আমি ও দু এক লাইন.....


ধিক্কারের আরো কিছু নতুন শব্দ চাই


থুতু যতটা গিলেছি ততটাই উগড়ে দিই সারা শরীরে যখন


কোথাও ঈশ্বরের বাচ্চারা  মানুষ লুকোচ্ছে নতুন মুন্সিয়ানায়

#

সকাল হলেই আবার কত কত মানুষ


ভিজে যাচ্ছে যারা চুরির অচেনা গন্ধে



অনিবার্য


আকাশ পুড়ছে

#

মাটির কিছুটা ওপরে তখন সেইসব লিখিত কর্মকাণ্ড

#

তথ্যানুযায়ী ক্লাসরুম খুলে যাচ্ছে প্রসবের বেওয়ারিশ ঠিকানায়

মাতৃত্বকালীন ছুটি চেয়ে নিতে।

#

একটা সাদা কাগজও নতুন করে কোথাও পৌঁছে দিতে।


 দীপান্বিতা রায়ের কবিতা

সহজ 

রোদটুকু দিলে,
অর্জন  এত সহজ তো নয়,
বলো সঙ্গত রাখি কোন রাগে !

 ঘোর বৈশাখ  দিনে,
এই নীল ধুপছায়া,
এই তুমি ছুঁয়ে যাও কত সংলাপে।


বলো সঙ্গত রাখি কোন রাগে,
যদি  অক্ষয় কিছু থাকে,
পূণ্য আলোর মতোন,

আমাকেও বিভাজনে দাও?
খন্ডিত এই আলো বিবরণী
কতটুকু ঘিরে আর আমার  যাপন?
 

স্পর্ধার অভিধানে  প্রকট ছুঁয়েছি
সাত্বীক  ব্যবধান হলে।
রেখেছ চোখে  কবেকার মায়া।


কেন বোধের আড়ালে,
তুমি ঘন হয়ে নীরবতা হলে,
বর্জন  এতো সহজিয়া?

 ক্যানভাস 

- রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

রং সত্ত্বাকে ঢেকে ফেলল, উল্লম্ব ও কৌণিক রেখা

আমাকে প্রকাশ করল, তুলির আঁচড়ে 

জ্যামিতিক অবয়ব ফুটে উঠল 

ক্যানভাসে। তার পর অস্থির সময়

বয়স বাড়িয়ে দিয়ে গেল, এক রাশ ধুলোর আস্তরণ

জমল ছবির উপর, সুতরাং 

শুধু স্মৃতিটুকু সঙ্গে নিয়ে 

লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা। যেভাবে

আলো-আঁধারের খেলা চিরকাল চলে

অনেকটা সেভাবেই। হন্যমান এই মানবশরীর

এক দিন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই 

বিলীন হবে জানি, কিন্তু আমার মন

ক্যানভাসের ফ্রেমে বন্দী থেকেও চাইবে

তোমাকে ছুঁয়ে যেতে।


 (নেপালি কবিতা)


‌‌পূজা উপাধ্যায়ের কবিতা
     অনুবাদ: বিলোক শর্মা

১. ফাল্গুনের স্কেচ

এক অঞ্জলি লাল রং দিয়ে
রাঙিয়ে দিলাম আকাশ

এক মুঠো ধূলো
ছড়িয়ে দিলাম বাতাসে

সবুজতায় ভরা
ইতিহাসের বিচ্ছিন্ন স্বপ্ন দিয়ে
এঁকে দিলাম পথ আর উঠানের চিত্র

বেঁচে রইল একটা শুকনো নদী

তাকে তো বহুদিন হল
মনের মধ্যেই বয়ে চলেছি।


২. কবিতা

কবিতা হল
একটা পথ
যেখান থেকে দেখি আমি
জীবনের‌ সৌন্দর্য্য

একটি পথের পেছনেই তো থাকে
পৃথিবীর সব ঐশ্বর্য্য
যেখানে‌ সটান দাড়িয়ে পড়ি আমি
হাতে একটি কবিতা নিয়ে।

পরিচয়:
লখিমপুর, অসমের যুব কবি পূজা উপাধ্যায়, পেশায় শিক্ষিকা। কবির একটি নেপালি কবিতা সংকলন 'অসমর্থ শহর' প্রকাশিত রয়েছে। কিছু সাহিত্যিক পুস্তকের সম্পাদনাও করেছেন।

মাদারীহাট, ডুয়ার্সের সাহিত্যিক বিলোক শর্মা কবি ও অনুবাদক হিসেবে পরিচিত। পেশায় কৃষি আধিকারিক, পাঞ্জাবের জলন্ধরে চাকরীরত। কবির নেপালিতে একটি কবিতা সংকলন ও বাংলায় দুইটি অনুবাদের বই প্রকাশিত রয়েছে।)

 নিজার কাব্বানির ১০টি কবিতা।। 

( ফারহানা রহমান অনূদিত) 


১. যখন ভালোবাসি।। 


যখন ভালোবাসি

নিজকেই মনে হয় সময়ের রাজা 

পৃথিবী এবং এর সবকিছুর মালিক বনে যাই  

এবং নিজের ঘোড়াটির পিঠে চড়ে সূর্যের গভীরে ঢুকে যাই

প্রেমে পড়ে গেলে

আলোর তরল রশ্মি হই

অদৃশ্য চোখের কাছে 

এবং আমার নোটবুকের কবিতাগুলো

হয়ে যায় মেমোসা ও পপি ফুলের প্রান্তর, 


যখনই ভালোবেসে ফেলি 

আমার আঙুলগুলো থেকে ঝর্না প্রবাহিত হয়  

জন্মায় তখন জিভে গুল্মলতা 

 

প্রেমে পড়ে গেলে  

পেড়িয়ে কালের পরিক্রমা 

অনন্তকালের পথে চলে যাই 

যখন নারীর প্রেমে পড়ি  

দুনিয়ার সব গাছপালাগুলো 

আদুল পায়েই ছুটে আসে আমার দিকে... 


(When I Love by Nizar Qabbani)


২. একটি ছোট্ট প্রেমের চিঠি।। 


প্রিয়তমা, আমার অনেক কিছুই বলার আছে

হে আমার মহামূল্যবান, কোথা থেকে শুরু করব বোলো?

তোমার ভেতর যা কিছু আছে তা সবই রাজকীয়

ওগো তুমিই সে যে কী না তাদের তৈরি করা রেশমের মথ 

থেকে আমার কথাগুলোকে অর্থবহ করে তোলো

এই হোলো আমার গান আর এটি আমি

এই ছোট বইটি আমাদেরকে ধারণ করে

আগামীকাল যখন এর পৃষ্ঠাগুলোতে ফিরবো  

একটি প্রদীপ আর্তনাদ করবে

বিছানাটি গান গাইবে

তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে এর অক্ষরগুলো সবুজ হয়ে উঠবে 

এর কমাগুলো প্রান্তসীমায় উড়ে যাবে

তবু এটা বোলো না; কেন ছিল এই যৌবন ? 

(A Brief Love Letter by Nizar Qabbani) 


৩. আলো লণ্ঠনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।। 



লণ্ঠনের চেয়ে আলো গুরুত্বপূর্ণ, 

নোটবুকের চেয়েও বেশি জরুরী হচ্ছে কবিতা, 

আর ঠোঁটের চেয়ে চুমুর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।


তোমাকে লেখা আমার চিঠিগুলো 

আমাদের উভয়ের চেয়ে মহত্ত্বর এবং গুরুত্বপূর্ণ। 

তারাই একমাত্র প্রমাণপত্র 

যেখানে মানুষ আবিষ্কার করবে

তোমার সৌন্দর্য

আর আমার উন্মাদনা।


( Light is More Important Than The Lantern by Nizar Qabbani) 


৪. প্রেম তুলনীয়।। 


হে আমার নারী, আমি তোমার অন্যান্য প্রেমিকদের মতো নই 

অন্য কারও কি উচিত হবে তোমাকে মেঘ এনে দেওয়া?  

যখন আমি তোমাকে বৃষ্টি দেই

তার কি উচিত হবে তোমাকে লণ্ঠন এনে দেওয়া, 

যখন আমি তোমাকে চাঁদটিকেই এনে দেই  

তার কি উচিত হবে তোমাকে গাছের ডালপালাগুলো দেওয়া  

আমি যখন তোমাকে সব গাছগুলোই দেই  

আর অন্য কেউ যদি তোমাকে একটি জাহাজ দেয়

আমি দেবো তোমাকে ভ্রমণ। 


( Love Compared by Nizar Qabbani ) 


৫. ভাষা।।



একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে

সে কিভাবে পুরানো শব্দগুলোই ব্যবহার করবে? 

একজন নারী কি এমন প্রেমিককে কামনা করবে

যে ব্যাকরণবিদ এবং ভাষাবিদ হিসেবে মিথ্যে বলে 

আমি যে নারীকে ভালবেসেছিলাম

তাঁকে কিছুই বলিনি

কিন্তু তাঁর জন্য প্রেমের বিশ্লেষণগুলোকে জড় করে 

একটি সুটকেসের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম

এবং সমস্ত ভাষা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম।    


( Language by Nizar Qabbani) 


৬. প্রতিবার তোমাকে যখন চুমু দেই।।


যতবার আমি তোমাকে চুমু খাই 

দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর

অনুভব করি

আমি তাড়াহুড়ো করে 

একটি লাল ডাকবাক্সে প্রেমপত্র দিচ্ছি।


( Every Time I Kiss You) 


৭. আমার প্রেমিকা আমাকে জিজ্ঞাসা করে।। 


আমার প্রেমিকা আমার কাছে জানতে চায়

আমার আর আকাশের মধ্যে পার্থক্য কী?

হে আমার প্রেম! পার্থক্য আছে

আর সেটি হচ্ছে 

যখন তুমি হাসো

আমি আকাশের কথা ভুলে যাই। 


( My Lover Asks Me by Nizar Qabbani) 



৮. ওহ আমার প্রেম।। 



ওহ! আমার প্রেম 

তুমি যদি আমার মতো পাগলপ্রায় অবস্থায় থাকতে 

তুমি তোমার সব গহনা ফেলে দিতে  

হাতের সব কাঁকন বেঁচে দিতে

আর আমার চোখের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতে।  


( Oh, My Love by Nizar Qabbani) 



৯. সমুদ্রে প্রবেশের সময়



শেষ পর্যন্ত প্রেম হোলো 

আর আমরা ঈশ্বরের স্বর্গে ঢুকে পড়লাম

পিছলে পড়লাম 

মাছের মতো

জলের ত্বকের নিচে।

আমরা সমুদ্রের মহামূল্যবান মুক্তারাশি দেখেছি 

আর বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি

অবশেষে ভয়ভীতি ছাড়াই ভালোবাসা হোলো 

চাওয়া-পাওয়াগুলোও কী ভীষণ মিলে গেলো 

ফলে আমিও উজাড় করে দিলাম আর তুমিও তাই দিলে

আর আমরা দুজনেই ছিলাম দুজনের কাছে উন্মুক্ত। 

সবকিছু কী দারুণ সহজে ঘটে গেলো 

ঠিক যেন সুগন্ধি জল দিয়ে লেখার মতো

ঠিক যেন মাটি ফুঁড়ে কোনো এক ঝর্না বয়ে যাওয়ার মতো। 


( On Entering The Sea by Nizar Qabbani) 


 


১০. সংলাপ।।


কখনো বোলো না যে আমার প্রেম 

একটি আংটি অথবা হাতের বালা ছিল 

আমার ভালোবাসা হচ্ছে অবরোধ 

এটি হচ্ছে তাঁদের মতো বেপরোয়া এবং উদ্ধত 

যারা তাদের মৃত্যুর দিকে পাল তোলার অন্বেষণ করে। 

এটি বোলো না যে আমার প্রেম 

একটি চাঁদ ছিল। 

আমার প্রেম ছিল আসলে একটি স্ফুলিঙ্গের বিস্ফোরণ। 


( Dialogue by Nizar Qabbani)


কবি পরিচিতি 

নিজার তৌফিক কাব্বানি একজন সিরিয়ান, কবি, লেখক, প্রকাশক এবং কূটনীতিক ।  তিনি আরব বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত সমসাময়িক কবি এবং সিরিয়ার জাতীয় কবি হিসেবে বিবেচিত। ১৯২৩ সালের ২১ মার্চ  নিজার কাব্বানি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে একটি মধ্যবিত্ত বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আপাত সরল অথচ গভীর ব্যঞ্জনাময় কবিতা লিখে তিনি কবিতাপ্রেমিদের মন্ত্রমুগ্ধ করে  রেখেছিলেন। তাঁর কাব্যশৈলীতে প্রেম, কামোত্তেজকতা, নারীবাদ, ধর্ম এবং আরব জাতীয়তাবাদের চেতনা অন্বেষণ, সরলতা এবং কমনীয়তার সমন্বয় ঘটেছে।

তবে নিজার কাব্বানি নারীমুক্তি ও নারী অধিকারের পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার কবিকণ্ঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এবং একারণেই তাঁকে নারীবাদী কবি হিসেবে অভিহিত করা হয়। 


 কাব্বানী 'মিঠনাহ আল-শাহম' নামে দামেস্কের একটি পাড়াতে বেড়ে ওঠেন এবং ১৯৩০ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত দামেস্কের ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক কলেজ স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  ১৯৪৫ সালে আইন বিষয়ে স্নাতক হন। পরবর্তীতে  কাব্বানি সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য কাজ  করেন।  বৈরুত, কায়রো, ইস্তাম্বুল, মাদ্রিদ এবং লন্ডন সহ বেশ কয়েকটি রাজধানী শহরে সাংস্কৃতিক দূত হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৯ সালে, যখন সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়, কাব্বানী চীনের দূতাবাসে ভাইস-সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। তিনি এই বছরগুলিতে প্রচুর লিখেছিলেন এবং এই সময়ের কবিতাগুলি তার সেরা কবিতা ছিল। তিনি ১৯৬৬ সালে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কূটনৈতিক কাজ চালিয়ে যান। তখন তিনি বৈরুতে তার নিজের নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কাব্বারি ৩০ এপ্রিল ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি লন্ডন শহরে মৃত্যুবরণ করেন। 



মুহূর্ত 

শঙ্খ মিত্র

বাতাসের বিশ্বাসঘাতকতায় ভরসা রাখতে হয়
অনুমান ক্ষমতার ওপর
তুমি বলেছিলে ঘুমের ভিতর কান্না পায় না আর
অথচ প্রতিটি দহনের পর
চোখ হয়ে ওঠে ডালিম ফুলের মত লাল

এর কোন ব্যত্যয় ঘটেনি এ যাবৎ কালে

জলের শরীরে সদ্য ফুটে উঠল একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র
তোমার চিবুক থেকে আলো ছড়িয়ে দিল
আশ্চর্য অনির্বচনীয় তিল

এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ
কিছুটা স্থিতি ও সংক্ষিপ্ত পরিধির ভিতর
একে একে অভিনীত হলো পদাবলী পর্যায়

সমস্ত বৈধ শপথ ভেঙে গিয়ে
ধীরে ধীরে খুলে গেল কঠিন আগল ও সংযম 

 পাঁচ টুকরো কবিতা

অরুণাভ ভৌমিক

১। এই সময়

শূন্য থেকে উঠে আসে অজানা হাত
মুখে তার কঠিন রেখা

আমি আঁকি, তবু আঁকি
ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে ঘটনার স্রোত!

২। প্রগতিশীলতা

কতকিছুই তো কুঁচকে যায়
কুঁচকে যায় জানালার রোদ
কিংবা একটুকরো বিকেল

এখন খুঁজি... খুঁজে ফিরি
একটুকরো পুরনো স্বাদ!

৩। লোভ

আজ দিনভর কবিতার লীনতাপ
অস্থির আকাশে তবু শীতকাল

কবিরও লোভ হয়, হতে থাকে
দুঃখের রেওয়াজে চলে গোলাগুলি!

৪। তৃষ্ণা

অসুখে থাকে না কোন ভ্রমণকথা
অন্তরঙ্গতার নরম স্বপ্ন

ক্লান্ত সর্বাঙ্গে শুধু
তৃষ্ণার আবহমান অনুভব!

৫। পদক্ষেপ

পরবর্তী পদক্ষেপে ভেসে ওঠে জল
এ কেমন ইঙ্গিতবাহী উদ্যোগ

কে যেন ফিসফিসিয়ে ওঠে শৈশব সারল্যে!

 চোখ 

 নীলাব্জ চক্রবর্তী

 

 

 

ক্যামেরা অর্থে কোনও কাগজের চোখ

ঠাণ্ডা

দেখি

সম্পর্ক একটা গাছ

ফেনার ভেতর

কে একটা দশকের বারবার নাম

বইছে

কাঁচের ওষুধে

আরও ভারী হয়ে আসে এই নোনাজল

এভাবে আয়না করছি

এভাবে

রিপিট

সাধনা

মানে

ঝুমকা বিষয়ক কয়েকটা সাদাকালো ফ্রেমের সুর...


আঁশ বটিতে লেগে থাকে রক্ত 

সঙ্গীতা মুখার্জী 

শুভ হয়ে ওঠার দ্রাঘিমারেখা থেকে 
অন্য কোনো হাতের শব্দ লেখা থাকে,
যাকে ধার করে জীবন চলতেই পারে।
কিন্তু রূপক নামক স্থানে ছিদ্র 
তাই বিগলিত অনুপাত থেকে অক্ষর কথা শুরু;
রান্নার আঁশ বটিতে লেগে থাকে রক্তের রঙ।
সুখী হতে চাইলে রুটিন মতো মেপে দু হাত পিছনে অথবা আগে...
শক্ত করে ধরে থাকার প্রয়াস বৃথা,
সাধ্য মতো প্রয়াসে কষ্ট বাড়ে,
জমানো টাকার মূল্যের চেয়ে
ঘামে ভেজা পকেট উৎকৃষ্ট হয়ে যায়
চরম অনিশ্চয়তা কাটাতে।

তুমি আমার জন্ম দাও
অথচ আমি জীবিত অবস্থায়
মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত হই।

শ্রীমান মূর্তিমান

শোভন মণ্ডল



           সবাই তাকে শ্রীমান মূর্তিমান বলে ডাকে। তার যে একটা পিতৃপ্রদত্ত নাম আছে সেটা অনেকে জানেই না। বাবা আদর করে নাম দিয়েছিল অনির্বাণ। কিন্তু নিজের কাছের লোকই সেই নাম ভুলতে বসেছে। আসলে এর পিছনে রয়েছে তার ‘কাজ'। সে স্ট্যাচু সেজে পয়সা ইনকাম করে। আগে বিয়েবাড়ি, জন্মদিন বাড়ি বা কোনো অনুষ্ঠানে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। কিন্তু বছর খানেক একটা স্থায়ী কাজ পেয়েছে। একটা পার্কে রঙ মেখে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ।বিকেল ৩টে থেকে ৬টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা স্থির হয়ে দাঁড়াতে হবে । কোন দিন চার্লি,  কখনো যীশু কখনো ভেনাস হয়ে একটা নির্দিষ্ট বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। নিথর,  স্থির। চোখের পলক পড়ে না।  সে হয়ে উঠেছিল ওই পার্কের বিশেষ একটা আকর্ষণ। মাইনেটা খারাপ পেত না। মাস শেষ হলে হাতে হাতে ছয় হাজার। মোটামুটি তার সংসার চলে যেত।

         সমস্যাটা দেখা দিল দু'বছর পর। অনির্বাণ গায়ে রূপালী রঙ মেখে মূর্তি সাজতো। এই রঙের বেশি ব্যাবহারে সারা শরীরে কী সব যেন বেরোতে লাগলো। ডাক্তার দেখালে জানা গেল এরপর যদি আর এই রঙ মাখা হয় তবে পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাবে। অনির্বাণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এই কাজ বন্ধ করলে সে খাবে কী?  সে জোর করেই মনস্থির  করলো যা হয় হবে,  এই কাজ সে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু স্ত্রীর কথায় এই সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো। ভগবানের অসীম করুণা যে এই সময় সে একটা কাজও পেয়ে গেল। পুরীতে একটি হোটেলে ওয়েটারের চাকরী। শ্রীমান মূর্তিমান শীঘ্রই শহর ত্যাগ করলো। 

      বছরের মাঝে দু'বার এলেও একদিনের বেশি বাড়িতে থাকতে পারেনি সে। স্ত্রীকে টাকা দিয়ে ফিরে গিয়েছিল পুরীতে। এবারে এক সপ্তাহের ছুটি পেয়েছে। দু'দিন আয়েশ করে কাটানোর পর কী মনে হলো সে বাস ধরে পৌঁছে গেল সেই পার্কে,  যেখানে সে স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়ে থাকতো।

      পার্কটার নতুন রঙ হয়েছে। গেটের সিকিউরিটিরও পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নেপালী একটা লোক। ওকে চেনে না। পাঁচ টাকার টিকিট। অনির্বাণ টিকিট কেটেই ঢুকলো। মিনিট তিনেক হাঁটার পরই সেই জায়গায় এসে দাঁড়ালো। ঝোপঝাড়, আগাছার জঙ্গল। খুব কাছে যেতে পারলো না। কিন্তু যা দেখলো তাতেই গায়ে শিহরন খেলে গেল।  যে বেদীতে সে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো সেখানে একটা পুরুষ মূর্তি। রূপালী রঙ। অনির্বাণ  অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।  না,  কোনো নড়ন চড়ন নেই। ওর মতো কেউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে ?  মন বলছে,  হতেই পারে না।

কাছে আর গেল না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। 

ফেরার সময় সারা রাস্তা সে বিড় বিড় করে মনকে বোঝাতে লাগলো,   “ওটা কংক্রিটের মূর্তি। জীবন্ত মূর্তি হতেই পারে না। হতেই পারে না.... “




 

অজয় সাহার কবিতা 
"খোলা চিঠি"

জ‍্যোৎস্না নগরের মায়াবী রূপ দেখছি।
না কোন নিয়মের গণ্ডী নেই,
ওখানে গাভীর মতো ভেসে বেড়ায় মেঘমালা।
জানি গো জানি, বৃষ্টি নামলেই ভিজিয়ে দেবে মানব জমিন।
বেশ লাগে, স্বপ্নালোকে নীলাম্বরীর ভেজা ডানায় ভেসে থাকতে।
জান, তখন আমার মানব জমিনে চলে শব্দের বীজবপন।
আহা....হা, এমন কতো শব্দমালা জুড়ে জুড়ে
বুনে ফেলি বৃক্ষসম কবিতা।
কেউ কেউ হেসে বলে, ধ‍্যুৎ, তুই দেখছি আস্ত পাগল?
স্বপ্ন কি সত‍্যি হয়?
ওসব বোকারা বলে বুঝলি বোকারা।
আমি জোর গলায় বলি,
চাইলেই সত‍্যি হয়, এ আমার বিশ্বাস।
বেশ কাটছিল , বিশ্বাসকে ভালোবেসে।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো মাস.....বছর....।

এখানে আর বর্ষা নামে না,
ঘন মেঘের ঘনঘটা এখন আমার মানব জমিনে,
স্বপ্নেরা পিঠের উপর বজ্রচাবুক হানে।
আমার চারপাশে এখন অমাবস‍্যার ঘোর অমানিশা।
কবিতারা আর ধরা দেয় না মনের গহীনে কলমের ডগায়।
স্তব্ধ হয়েছে বাতাস।
ওগো বন্ধু এসো, তোমার জলভরা কলস উপুড় করে দাও
এ তপ্ত ধরণীর বুকে,
সব কালো মেঘ সরে যাক
এ হৃদয়াকাশ হোক সূচিস্নাত।
জানি, তোমার কোন ঘর নেই,
নেই কোন ঠিকানা।
অপেক্ষার বাতায়নে আঁখিজলে বসে আছি,
জানি, আমার এ খোলা চিঠি
নিশ্চয়ই পৌঁছবে কোন এক দিন।

 "উদভ্রান্ত"

 স্বপন কুমার সরকার।
        
        
মেঘেদের হাঙ্গার স্ট্রাইক দেখে 
ভীত সন্ত্রস্ত সূর্যের শাসন!
ওরা লড়াই করেই চাইছে 
গোটা আকাশের আধিপত্যে।

চাতকের হাসিতে উল্লসিত বৃষ্টি
মধ্যিখানে ফায়দা লুটছে
প্রবাদের সেই গৌরী সেন
সে কি আর বেশিক্ষণ!

ভরসাহীন নৈঋত কখন ঝড় তোলে
ককটেল করা মন নিয়ে
সদাশিব সারাক্ষণ
দীর্ঘ শ্বাস থেকে চুরি করছে আয়ু।

নিষেধ ভাঙার মজা লুটছে
মান্ধাতার অনুশাসন
অকাজের তেজ উন্মত্ত সুরে
ধরেছে বিদ্রোহের গান।

 গানদীঘির কবিতা

সুবীর সরকার

১.
রাজবাড়ীর আলো সাগরদীঘির জলে
পৌষের ঘন হয়ে ওঠা শীত
শহরে ছড়িয়ে পড়ে সুরেন বসুনিয়ার ভাওয়াইয়া
ঘোড়া ছোটাচ্ছেন রাজকুমার ইন্দ্রজিৎ।
২.
সাগরদীঘি সাক্ষী আছে তিরিশ হাতির শিকার
                                                            মিছিল
জলে শুড় ডোবানো পাটহস্তি।
মেজর জেনকিংস পটেটো চিপস খাচ্ছেন।
আর সাগরদীঘির পাশে ব্রজেন শীলের ঘোড়া
৩.
ফেলে আসা ঘরবাড়ির গল্প সাগরদীঘির কাছে রেখে
                                                                আসি
 তারপর সাগরদীঘিতে বেড়াতে আসে
                                      তোর্সাচরের জোনাকি
 আর জোতদার খুঁজে পান হারিয়ে যাওয়া
                                                      ঘোড়াটিকে
 ৪.
 সাগরদীঘির কিনারে কিনারে কত কত কাহিনি
 জলে নেমে যায় রাজবাড়ীর হাঁস।
 মহারানী ইন্দিরা দেবী হাওয়া খেতে আসেন
 হেমেন দাদু শোনাতে থাকেন কামতা রাজ্যের কথা
 ভুলগুলি ধরিয়ে দেয় শেষাবধি সাগরদীঘি 
 ৫.
রাজপুরুষের হওয়া লেগে কেমন বদলে গেল আমাদের সাগরদীঘি!অনুপ্রবেশকারী বাঘ শহরে
ঢুকলে সবার আগে জেনে যায় সাগরদীঘি।
কেননা সেই বাঘ তো ভোররাতে জল খেতে আসে
                                               সাগরদিঘীতেই
৬.
শহর ঘুমিয়ে পড়লে সাগরদীঘি আত্মকথা লেখে
সাইবেরিয়ার পাখি আর ডুবে মরা অবিনের মুখ
আত্মকথা থেকে বারবার বেরিয়ে আসতে চাইলে
সাগরদিঘী তোর্সা পীরের ইতিকথার দিকে হাত
                                                         বাড়ায়



 আঁতুড়ের গন্ধ 

 মাহফুজ রিপন

এরিস পর্বতের গুহায় জন্ম দেবশিশুটির
তাকে প্রদক্ষিণ করে শিমুলতুল মেঘ।
বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় আঁতুড়ের গন্ধ।
লজেন্সের খোসার মতো পড়ে আছে শরীর
অন্তরীক্ষ জুড়ে মানবতার করুন নিনাদ।
খুনিদের রক্তাক্ত হাত পাথর হয়ে ওঠে-
নাবিকের হাল-মাস্তুল সব ছিঁড়ে গেল।
দেবশিশুর কান্নায়, কালিন্দীর
জলের রঙ বদল হয়ে যায়..!

দুটি কবিতা:

বিশ্বজিৎ

নিয়ম
-----------
যতটা বদলে গেছি
বদলে গেছ।
মুহূর্ত নিয়মে চলে না
পালটার পর পালটা,
হাজিরা খাতায়-চোখের জরুরি।
ভেজালের গায়ে,বিশ্বাস লেগে আছে

ব্যবধান-
একদিন সবাই শিখে যায়...
            -----

দুর্গম
----------------
দৈনন্দিন ভেঙে
চাঁদ আঁকছি।
হয়ত অথবা হতে পারে
আমগাছ,পেয়ারাগাছ
আরও অন্ধ...

শূন্যস্থান এখনও ভরাট হল না

 কৌশিক দাসের গদ্য কবিতা 

মহাদেব এখন কুপোকাত


পূর্ণিমা অমাবস্যার মতো মানুষে-মানুষে যৌনতা যখন জোয়ার-ভাটা আনে, তখন আমার শিব ঠাকুর হতে ইচ্ছা হয়।
ইউফ্রেটিস-তুরানী জাতি অমরত্ব চেয়ে একসময় সর্পদেবীর পুজো করতো 
তারা কখনও চায়নি কোনওদিন ভোরের বিছানায় সর্পদেবীর পাশে শুতে।

বাসুকি সজাগ থাকলে, মহাদেব স্বস্তিতে থাকতো।
মহাদেবের ইচ্ছে হয়েছিল কখনও পার্বতীকে লুকিয়ে পদ্মার সাথে এক রাত কাটাবে।

বাসুকি এখন বিষের জ্বালা অনুভব করছে!
এখন শিব ঠাকুরের গলা থেকে নেমে এসে সে পাতাললোকে আশ্রয় নিয়েছে বোন পদ্মার ঘরে।
সমুদ্র মন্থনের দড়ির মতো আরও একবার সে আটকে রয়ে গেছে।

নমনীয়তায় ভাঁজ পড়ে যাওয়া শিরদাঁড়াটা সেখানে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।
কৌলীন্য আর কুপ্রথায়, মহাদেব এখন রোজ খাবার খাচ্ছে রাস্তায় ভিখারীদের সাথে শাল পাতার থালায়।

পদ্মার রূপে কামাতুর শিব এখন শিশ্ন হাতে সম্ভোগ মেটাতে চাইছে।
লাস ভেগাসের দরজায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের মাঝে ল্যানকাং দ্বীপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নির্দ্বিধায়।

স্পর্শকাতর আবদারে মোহিনী পদ্মা দ্বিধাগ্রস্থ এক যেন সুইফট পাখীর মতো আকাশে উড়তে থাকা শিব ঠাকুরের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।
পেঙ্গুইন হয়ে সে কেবল মাটিতে ভাসতে থাকে 
আর পদ্মার জনক ডাকে হেজহগ প্রাণীর মতো কিউরিয়াস মাইন্ডের সাথে শীতল হয়ে যায়।

বাসুকি মায়ের মাটির মূর্তি তখন যেন ভুরিশ্রবা সাত্যকির শিরচ্ছেদ করছে আর পদ্মা অর্জুন হয়ে জনক শিব ঠাকুরের বাহু দ্বিখণ্ডিত করে যজ্ঞ কুণ্ডতে মা গঙ্গার জল ঢালছে। 

বুকের পশ্চিমদিকে রাক্ষস-তল হ্রদকে হত্যা করে মানস সরোবরে ডুব দিতে-দিতে ভেলায় পদ্মাকে সঙ্গে নিয়ে মহাদেব গিয়ে ঠেকে শাম্বালা নগরের পর্বতের চূড়ায়।

লেমিং প্রাণীর মতো অভিমানী পার্বতী সেইবার আত্মহত্যা করেছিল ডলফিনের মতো নিশ্বাস চেপে পতি নিন্দা শুনে।
অতৃপ্ত মাদ্রীর মতো পরলোকে ভগবান শিবের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার জন্য সে স্বেচ্ছায় সহমরণে যেতেও রাজি।
রাজা কুন্তিভোজ ঠিক যেমন দুর্বাসা মুনির সেবায় পাঠিয়ে ছিলেন মানস কন্যা কুন্তীকে, তেমনি পার্বতীলোকে ভগবান শিব এনে তুললেন সর্পদেবী কন্যা পদ্মার স্বয়ং মূর্তিকে।

ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক
সতী এখন শিব-পদ্মার সম্পর্ক-এর মাঝে লাইমলাইটে সতীন খুঁজে বেড়াই।
ফ্রেন্স অ্যাঞ্জেল ফিশ-এর মতো ভগবান শিবের পতি-ভালবাসায় সতী অন্ধ করে দেয় পদ্মার একটি চোখ।
মানস কন্যার দুঃখে শিব ঠাকুর এখন বেলপাতা চিবোচ্ছে আর কামদেব বিষ্ণুর সাথে সলাপরামর্শ করছে, হিমালয় পর্বতের ছাদে শুয়ে।

সিরিজ কবিতা 

-মিন্টু দাস   

          ১
বারবার সমুদ্রের কাছে ফিরতে চেয়েও
পিছিয়ে যাই রোজ!!
ভালো থেকো নীলাঞ্জনা।
অজানা সমুদ্দুর থেকে
উড়িয়ে এনো লবণাক্ত বালি....!
.                   ২
আমাদের সকাল শুরু হয় কান্না দিয়ে
সন্ধ্যার আগেই ডুবে যায় বিশ্বাস!!

তুমি নিশ্চয় ভালো আছো
সমুদ্রের জলীয় বাতাসে?
ভিজছো কেমন বলো স্নান ঘরের
স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে?

                  ৩
আবার কখনও দেখা হলে
মোহনার গল্প শুনিও!
শিখিয়ে দিও বেঁচে থাকার ট্রিক্স!
আমি ভুলে গেছি কিভাবে হাসতে হয়!
আর বেঁচে থাকা কাকে বলে?

                 ৪
কোনো একদিন দেখা হলে
চোখে চোখে অনেক কথা হবে
হৃদয়ের মোম যদি গলে!

আমার বুকের ভিতর তো
বয়ে যায় নদী আর
হাজার প্রদীপ জ্বলে!
               ৫
নদীর বিষন্ন হাওয়ায় বসে থেকেছি দীর্ঘক্ষণ
সমুদ্রের লোনা বাতাসে মিশিয়ে দিয়েছি কান্না।
তুমি আমাকে জীবনের গল্প শুনিও না
আমি জানি বাস্তবতা কাকে বলে !

                 ৬
উড়ে যাচ্ছে বালি উড়ে যাচ্ছে নুন
জল আছাড় খেয়ে পড়ছে
রুক্ষ পাথরের গায়ে!
আমিও ভুলে গেছি স্মৃতি
ভালো লাগে নাকো আর
বিট নুন লেবু চায়ে!

 শোকচিহ্ন

দেবাশিস সাহা

সাপ রঙের রাস্তায়
পড়ে আছে এলোমেলো খই
কানা আধুলি আর ভাঙাচোরা পায়ের ছাপ

কে যেন এসে
আমাদের পাড়ায়
এঁকে দিয়েছে শোকচিহ্ন

হ্রদে নেমে
ভালোবাসা তছনছ করে দিয়ে
চলে গেলো একটা গোঁয়ার রাত

অজান্তেই একটা রাস্তা
এসে যায় ঘর পর্যন্ত
লালটুকু নিয়ে চলে যায়

চলে যায় চোখ ছাড়িয়ে

মিথ্যেগুলো পড়ে থাকে
সত্যের কঙ্কাল কাঁধে
হেঁটে যায় শ্মশানবন্ধু

শোক গায়ে ঘুমিয়ে পড়ে পাড়া



অসুখ

অসুখের ভিতর 
যাতায়াত করে অন্ধকার 

লালারস রক্ত-আমাশা

শাপ লেগে গেছে হাড়ে

দূরে দূরে সরে যায়
প্রিয় ছাদ 
বোগেনভোলিয়াকে জড়িয়ে জড়িয়ে 
সূর্যস্নান করে শালিখ দম্পতি 
পড়ে থাকে আত্মাহীন খোলস

এই অবসরে
খোলসে খেলা করে প্রিয় ঈশ্বর 

তুমি খোলস সাজিয়ে তুলছো
কান্নার অলংকারে
গোপনে পাচার করে দিচ্ছো অসুখ

অসুখের গভীরে 
নামহীন গোত্রহীন এক সুখ
যাতায়াত করে জন্মের পর জন্ম। 



ভৌগোলিক ভুল 


শোওয়ার ঘরে ঘটে যাওয়া 
ভৌগোলিক ভুল
টেনে বেড়াতে হয় বৃত্ত বরাবর 

পিয়াস জাগলেই
মনে হয় 
কোথাও জল খসছে

কেউ কেউ এই জীবনকে শরবত ভাবে
বোতাম খুলে রাখা রাস্তায় 
কার পায়ের ছাপ

হাসিটুকু মেখে থাকলে
গড়িয়ে গড়িয়ে আসে ভাত

সেলাই এঁকে চলে যায় প্রসব বেদনা। 

প্রাণজি বসাক এর কবিতা 

রূপ মহল


ঘুরে ফিরে ইউটার্ণ নিতে নিতে বেজে ওঠে সাইরেন 

ছড়িয়ে দিতে দিতে জারিত বোধ রোদের আস্ফালন


ফুটন্ত ফুল আর তোমার আত্মভোলা রূপ কেন যেন

বুকের গহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতে আঁধার উচাটন 


আলোর খেলায় মহাজগৎ ভালোবাসাও এক খেলা 

রোদে পুড়ে পুড়ে ভালো নির্মিত বাসা রূপগন্ধ মেলা

বিবাহরাত্রি

শৌভিক দত্ত


সমস্ত বাউল জুড়ে বিবাহরাত্রি হয়

সমস্ত বাউল জুড়ে ভাঙা তাস মাটির গেরুয়া

তুলোচাষে গতিবিধি, মলাটে নামাজ ভেসে যায়

ছয়রাত্রি ছদ্মবেশ ছয়লাপ ছয়লাপ জনগণ

প্রথার গভীরে ঐ বলিরেখা দাহ্য হয়ে নামে

                                                আচমন ধরে রাখে জ্বলানেভা সাঁতার গুমোট

                                                  চমক ফেরী করে নরম দোয়াতে রাখা ভাষা

                                                প্রাতরাশে সারসার অস্থির শুনানী পড়ে থাকে


ঘুমসই
                                           

আসে না
এভাবে
ফর্সা কোনও উত্তর
তার ছলাকলা
বোতাম গড়িয়ে দেখি
মৌলিকের নড়াচড়া
টিপসই
ছিপ হয়ে নামে
হেরে ওঠার আগের পর্দা
ঈশ্বরের বাদামে
গোটাতে গোটাতে
ঘুমভাঙ্গা হাট
হাতের ওপাশে
কিছু নির্জন রেখে গেছে ...

দৃশ্য বদল

বিবেকানন্দ বসাক

রোদ পড়লে সর্ষে ক্ষেতে রং ছড়িয়ে পড়ে
পুকুরের জলে মেঘেদের ডুবসাঁতার 
রিয়েল লাইফ থেকে দৃশ্য বদল হয়
প্রলম্বিত ছায়ার কাছে ঝুঁকে পড়ে গাছ
আলপথে শিশুর পায়ের ছাপ ধরে 
প্রজন্মের পথচলা চিনে নেয় কেউ...

অভিনেতা

উত্তম দেবনাথ
--------------------

সারারাত জেগে থাকে চাঁদ
নিজেকে সূর্য হিসেবে আঁকবে বলে
হাঁটতে হাঁটতে শতসহস্র জন্ম মৃত্যুর পর চাঁদ 
এগিয়ে যায় নিজেকে নিখুঁত অভিনেতা গড়বে বলে।

পথে পথে মৃত মানুষের হাতে
একতারা দেখতে দেখতে ভুল গান গেয়ে ওঠে
সুর ছড়িয়ে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবহেলিত পাড়া গাঁয়ে।

লজ্জাবতী চাঁদকে সূর্য ভেবে
মনের পাতা খুলে দিলে উপোস থাকতে হয় ক্লোরোফিলের অভাবে।

বিপ্লবী বটবৃক্ষ সূর্য ও চাঁদদের  শিক্ষক।

ফসিলের আয়না

অনুপ মণ্ডল


লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি যথেচ্ছ যতিচিহ্ন;কখনও জাম্পকাট
প্ররোচিত ডানা থেকে
ঝরে পড়ে ইতিবৃত্তের প্রাচীনতম মুখ,বিনম্র ফসল
বাতাসকে হেনস্থা না করেই প্রক্ষালন করি
মুখ পরাঙমুখ হয়
হাতের কারুণ্য থেকে দুবেলা জল গলে গলে পড়ে
অন্ধ হাতের বারংবার পেলবতা
আমার অবাধ্যতাকে মসৃণ করে তুলেছে

পুরুষের প্রকৃত বিভব আবিস্কার করে গুহার দেয়ালে
আদিম পোয়াতি নারী
দু'পায়ের ফাঁকে রাখে প্রাথমিক আগুন
কয়লার আঁচড়ে একের পর এক ম্যামথ শিকার
জলের নিম্ন মেধায় বন্যার সম্ভাবনা ছিল কি?
সময়ের খণ্ডন কিংবা নতমুখী বিশ্বাস!
পুরুষের মধ্যে কোনও বিনিময় মূল্য ছিল না!

রাগমোচনের স্বচ্ছতা প্রাক-আদিম নারীর আয়নায় গচ্ছিত আছে

ঝিমিয়ে পড়া জীবনে একজন পার্টনারশিপ দরকার

সম্পা পাল 


ধরুন আপনি ঝিমিয়ে পড়েছেন

রাস্তা এখনও ঢের বাকি

সূর্যটা মাথার ওপরে গনগনে।

নুন ,জল বাড়িতেই ছেড়ে এসেছেন ...


ড্রইংরুমে ভারত -পাকিস্তান টানটান উত্তেজনায়

ধীরে ধীরে স্কোর বোর্ডে সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

নির্বাক চোখ ধারাভাষ্যের দিকে ।


একটু ভেবে দেখুন তো!

এসময়ে একজন ভালো পার্টারনশিপ হলে কেমন হয় ?


বাকি রাস্তা এবং স্কোর বোর্ড !


তাহলে আর দেরি কিসে ?




 উল্লাস

পাপড়ি গুহ নিয়োগী

 

প্রতিটি মিছিলের হা মুখে দুরারোগ্য অসুখ

রঙের নেতৃত্বে এস্রাজ বাজায় শেয়াল

নোনা দেয়াল। হেঁটে যাচ্ছে পিঁপড়ের সারি    

 

বিজয় মিছিলে উড়ছে পাখির পালক

 


মঞ্চ


সম্পর্কের ভেতর ঢুকে পড়ে মূকাভিনয়

কথা হা করে বোবাস্পর্শ খোঁজে

চোখের জলে লাল কাগুজে নৌকা

 

নাটকের দর্শক হয়ে ওঠে বটগাছ


 

নেই-নেই

পাখি নেই গাছ নেই
পুকুরের মাছ নেই
কয়লার আঁচ নেই
মন লাগে কাজে না।


বৈশাখী ঝড় নেই
ডাল মড়মড় নেই
ছায়াঘেরা ঘর নেই
সেই সুর বাজে না।


পাড়া প্রতিবেশী নেই
বন্ধুও বেশি নেই
চারিদিক মেসিনেই
ভরে গেছে ভাইরে।

ধান নেই মাঠ নেই
পুকুরের ঘাট নেই
পুরানো সে অতীতেই
চল্ ফিরে যাইরে।

অভিজিৎ মান্নার কবিতা

নানা রঙের দিন 

তাদের সাথে খেলা গুলি 
রইলো পড়ে পথের বাঁকে 
জো‌ৎস্নাগোলা রাতের মাঝে 
হঠাৎ জেগে ঘুমের ফাঁকে ।
এত্ত এত্ত স্মৃতির চৃড়া 
টপকে যায় মাথার ছাদ 
নানা রঙের দিনের বিকেল 
এখন কেমন অন্য স্বাদ ।
কে দিবিরে ফিরিয়ে সেসব 
চোর কা৺টাতে হুড়োহুড়ি 
আকাশ থেকে নামিয়ে দেনা 
ফেলে আসা স্বপ্নপুরী। 

 বুদবুদ


রূপবিলাস মণ্ডল


কোন এক সন্ধ্যায় তোমার

হৃদয়ের‌ উষ্ণ  প্রস্রবণ ,

উষ্ণতা আমায় ঢেলে দিয়ে

শীতলতা করেছ বরণ।

জীবনের ধারাপাত জুড়ে

যোগ বিয়োগের এই খেলা ,

বিষন্ন  আকাশ বুকে করে

বিশ্ব পথে হেঁটেছি একেলা।

ক্ষণিকের অতিথির মতো

কিছু পথ ধরেছিলে হাত,

হাত ছেড়ে কোথায় হারালে,

কুসুমিত শুভ্র প্রভাত!

আমার প্রগাঢ় অনুতাপ

তোমায় নামায় মেঘ করে,

বৃষ্টি, সে দূরে সরে রয়

স্বপ্নের ক্রন্দসী পারে।

নিত্য এ আসা যাওয়া খেলা

বুদবুদ ঊর্মিমালায় ,

প্রেম আর অপ্রেম মিলে

জন্মায়, অসীমে মিলায়।



মানবতার ফেরিওয়ালা


শৈশব আর কৈশোর গেছে চুরি

স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে যৌবন,

উদ্ভ্রান্ত এ সময়ের অভিঘাতে

স্বপ্নের এক ফেরিওয়ালা প্রয়োজন।

সে স্বপ্ন  হবে মানবতা প্রতিরূপ

জীবনের তরে সঞ্জীবনীর মতো,

দুচোখে আঁকবে স্বপ্নের  অঞ্জন

দূরীভূত হবে হতাশা-দুরাশা যতো।


দিকে দিকে আজ বিপন্ন মানবতা

আর্ত কান্না বিষিয়েছে প্রতিদিন,

মানবতা হীন জীবন পশুর মতো

ফেরিওয়ালা করো মানবতা উড্ডীন।

গান্ধী ,নেতাজী যে স্বপ্ন দেখেছিলো

সেই স্বপ্নই বয়ে নিয়ে চল তবে,

সবাইকে যদি স্বপ্ন দেখাতে পারো

দেশ জননীর স্বপ্ন সফল হবে।

যে স্বপ্ন খোঁজে জাতপাত হীন বিশ্ব

মানবতা আনো,যেখানেই খুঁজে পাও ,

ঈর্ষা এবং হিংসা মুক্ত পৃথিবী ,

যুদ্ধ চাইনা, যুদ্ধ থামিয়ে দাও।

সাম্যের তরে এক হোক গোটা দুনিয়া

গভীর স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাক মন,

স্বপ্ন দেখুক শ্রমিক  মজুর কৃষক

পৃথিবীটা হোক আনন্দ নিকেতন ।


আসল কথা


আসল কথা বলতে গেলেই

ভরিয়ে দিচ্ছে নকল কথায় ,

সবাই হয়ে মন্ত্র মুগ্ধ

বোকার মতো হাততালি দেয়।

তুলছে না কেউ  আসল কথা

ভুলছে সবাই অভিনয়ে,

এরা ভাবছে ওরা বলুক

সত্য ডোবে অবক্ষয়ে।


কার প্রাপ্তি কে হাতড়ায়

কার অধিকার ধুলায় লুটায় !

নকল লড়াই বাধিয়ে  দিয়ে

নেপোয় শেষে  দ‌ই মেরে দেয়।

তোমায় যারা শোষণ করে

তাদের নিয়ে মাথায় তোল,

নিজের কথা, দেশের স্বার্থ

তোমায় ভোলায়, তুমি ও ভোলো।


এসব প্রশ্ন কে করবে?

বলবে যারা নেশার ঘোরে ,

প্রতিবাদের ঝাণ্ডা ঢেকে

সহজ পথে স‌ওদা করে।

সত্যি কথা, আসল কথা

সবাই মিলে বলতে হবে,

না হলে ওই শোষক শ্রেণীর

মর্জি মতো বাঁচতে হবে।


মেকি কথা মিটিয়ে দিয়ে

তোল সবাই  আওয়াজ তোলো

আসল প্রশ্ন উপেক্ষিত,

আসল কথা সবাই বলো।


বেসকালার 

নীলাদ্রি দেব 

খুব গুরুতর অথচ উদাসীন 
নাদুস বিকেলের পেটে চৌকো গল্প 
বিপ্রতীপে ছায়ার দৈর্ঘ্য বাড়ে  
মোম গলে যায় বলেই 
    সলতের সাদা খুঁজতে ভুলে যাই 
সহজাত বোধ, দাবাবোর্ড মিশে যায়


জ্যামিতি 


শুরু ও শেষের মাঝে বিন্দু দূরত্ব 
বিন্দু বিন্দু জুড়ে রেখা 
জ্যামিতির যন্ত্র নড়ে উঠলে
         হঠাৎ কেঁপে ওঠে মাটি
আছি আর নেইগুলো কত ঠুনকো
অথচ 
গান নয়, দীর্ঘ হচ্ছে হলুদ বিচার

শিল্পী  

বেবী সাউ 

স্রোত হেরে যায়। যেদিকে গভীর। কোনও শ্যাওলাঘন নীপবন 
তাকে ফেরাতে পারেনি 

অতিথি সময় মাত্র... ফেরা নিয়ে আসে।
বুকের আঁচলে লেখে চাল, ডাল, দু'টি বেগুন কাহন...  

তারপর হেঁটে  যায় 
মৃত কফিনের দিকে।  

মস আর শ্যাম তরুবর 
পথ এঁকে দেয়।  ছায়াঘন। অন্ধ। 

 ১। মৃত্যুর পরদিন

  অরুণাভ ভৌমিক।

আমি তো কখনো কিছু চাইনি
চাইনি মৃত্যুর পরদিন
জীবনের আস্বাদ

গভীর বিষাদময় স্থির প্রান্তিক আমি
চাই নি জল কিংবা তুচ্ছ
অকাল বৃষ্টির মতো তুমুল প্রার্থনা

আমি কখনো কিছু চাইনি
চাইনি মৃত্যুর পরদিন
এক আকাশ মেঘ

একরত্তি এক সামাজিক বালিকা
কখনো হাঁটেনি সঙ্গে
রাত্রিকে পাশে নিয়ে

সদর দরজা জুড়ে পড়ে আছে
অনন্ত বিষাদ
ঝরা পাতার হলুদে
দেখেছে কি কেউ

আমি তো কখনো কিছু চাইনি
কেন যে তবু দুফোঁটা শিশির বিন্দু
বিষাদের জল মুছে দেয়
অপেক্ষার...!

২। দু'টুকরো কবিতা
    অরুণাভ ভৌমিক।

(ক) নিঃসঙ্গতা

একটা হাত সংগকথা
বুকের জ্যামিতি অন্যরকম

মানুষ নিঃস্ব হলে বাড়ছে রোদের তেজ

(খ) জল

জল ছুঁয়েছে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ
জেনেছে আচমন জলের প্রবাহে
ধারাবাহিকতার অনন্ত ছায়াপথে
সে কি এসাইনড টু কিল
সে কি এসাইনড টু বি কিলড!


 


পুরনো বাড়ির আত্মকথা

দেবাশিস মুখোপাধ্যায় 
১.
রাত্রির শরীর এতটাই হলুদ 
সিঁড়িভাঙার ক্ষমতা কখন হারিয়ে যায়
গল্পগুলো ভিজে যাওয়ায়
জমছে না 
আনন্দ 

২.
একটা
রঙিন চশমা
জন্মের পরের অধ্যায়ে 
মৃত মানুষের ঠোঁট আঁকছে
সেখানে ফুটে আছে আর্তি প্রেমের 

৩.
ফুলহীন ফুলদানি
কাঁদলে
একটা টেবিলের দীর্ঘশ্বাস
বাড়িকে খায়  খাবার ছাড়াই
ভালবাসা নরম স্পর্শ ছাড়া পাথর 

মৃত্যুর পর

 

সমর দেব

 

একান্ন বছর পাঁচ মাস তিনদিনের শেষে

এক আবছায়া বিকেলে আমি মারা গেলাম

মৃত্যুর ঠিক আগে আমার কিচ্ছু মনে আসেনি

শুধু মনে পড়েছিল জন্মের আদি মুহূর্তটি

সেটা ছিল অঘ্রাণের মৃদু শীতের এক শেষরাত

আকাশে ব্যস্ততা ছিল তারাদের অনেকেই ততক্ষণে

ডুবে গেছে হিরণ্ময় আলোর গর্ভে

তার অনেক আগে চলে গেছে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ

প্রসূতিকক্ষে বিজলি আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছিল

সমস্ত দৃশ্য কথা বলছিল ডাক্তার নার্সেরা, তাদের

কণ্ঠের আওয়াজ আমার কানে বাজছিল

সুরেলা সংগীতের মতো তাতে আবাহন ছিল

এটুকুই জন্মমুহূর্তের স্মৃতি ভেসে উঠেছিল

শেষের বেলায়। আশ্চর্য, আমার ক্ষুধা ছিল না!