Saturday, November 30, 2019

কবিতা করিডোর , হেমন্ত সংখ্যা , ২০১৯



কবিতা করিডোর , হেমন্ত সংখ্যা , ২০১৯

প্রচ্ছদ শিল্পী : মনতোষ বসাক
অলংকরণ : শুভঙ্কর পাল
সম্পাদক : শুভঙ্কর পাল
উত্তর পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক :রাজেশচন্দ্র দেবনাথ

সম্পাদকীয় :

শীত সেভাবে জাঁকিয়ে না এলেও মন্দ লাগছে না দুপুর গড়িয়ে যাওয়া এই মিঠেকড়া রোদ । শরীরের প্রতিটি কোণায় কোণায় একটু ঘুমের আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে ।  বটের শুকনো পাতার খসখসে শব্দে একদল পাখি উড়ে গেলো ।  ওই গোলদীঘির মাথা পেরিয়ে পশ্চিমে যেতে যেতে কি জেনো বলে গেলো ! প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি আর নির্ভয়া নাম রাখতে ভয়ে শিউরে উঠছে !  কাল কী ভবিষ্যৎ এদের জন্য লেখা আছে এই নিয়ে ঘুম আসেনা বাবা -মায়েদের ।  আইন কী শুধুই বই-এর পাতায় অংক শেখাবে ?  আরো একবার ওই নর পিশাচদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান দিক আদালত । নাহলে শেষের সেদিন ভয়ংকর হয়ে উঠবে ।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে ভাষা হারিয়ে ফেলছি ।  যাকিছু নতুন সৃষ্টি তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই কবিতা করিডোর এর হেমন্ত সংখ্যার প্রকাশ ।

ধণ্যবাদান্তে
শুভঙ্কর পাল
সম্পাদক - কবিতা করিডোর
যোগাযোগ : শুভঙ্কর পাল
ই মেইল : subhabrb@gmail.com
মুঠোফোন : ৯৯৩৩৭৭০৫৪১
উত্তর পূর্বাঞ্চলের কবিতা 


বাজার

কমলিকা মজুমদার

আপেল বনে ছেয়েছে অজানা দীর্ঘশ্বাস
পোকা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে পেলব আগুন বুক
অথচ, ছায়াবন জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক
মন খারাপের মানবহীন নৈঃশব্দ্য বিকেল।

কয়েক হাজার মাইলফলক পেরিয়ে এলে
প্রতি হাটবার বিক্রি হয় ঝুড়িভর্তি ডাঁসা ফল
হাতে হাতে ঘুরে বেড়ায় অভিশপ্ত ফলেরা
দোকানির অভিজ্ঞ চোখ শুধু জানে রহস্য,
জানে, কোথায় কাটলে পচন ধরা পড়ে যায়।

হাইকু

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়


দেখতে এসো
চোখের জলের বাড়ি

২) ভিতরনারী
-----------------

মাস্তুল নেই
দাঁড় বেয়েছি একা

৩) হঠাৎ দেখা
----------------

স্নানের জন্য
তোমার গানে নামার

৪) কথা ছিল...
-----------------

কেবল  ফাঁকি

আমন ধানে ঢাকি

৫) অতীত ঋতু
-------------------

চড়ুই পাখি
কোথায় তোমায় রাখি

৬) ভাবছি বসে
--------------

দিনের শেষে
তুমিই না হয় লিখো

মুক ডায়েরি



নাবিক
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য

নাবিকের সহবাসে ব্যবহৃত পুষ্পরস
জন্ম নিলো তোমার বুক অব্দি জল
নিংড়ানো ঈষৎ অভ্যাস আঁকড়ে ধরো
ঠোঁটের নিজস্ব প্রস্থান 
আমি পথমাড়ানো ছায়ায় মাধুকরি বীর্যের
ছুড়ে ফেলা ব্যার্থ তৃপ্তি
ঘরছাড়া ঘাসে নিশিপালন সিঁদুর 
আমি তার প্রসব আছড়ানো শব্দ হাসিমুখে মুছতে থাকি
অবেলায়........বেলায় বেলায়......অবেলায় ।

সভা 

অমলকান্তি চন্দ 

বেনু পুকুরে সভা চলতে থাকে
পেছন সারিতে কানাঘুষো চলে অবিরত
বিনোদন সভা ছেড়ে চলে গেলে
ইতর কুকুরগুলো আরো কেমন লম্পট হয়ে উঠে।
সভার পেছনের সারিতে
তারও ঠিক পেছনে
 খাওয়া ও শৌচের আগে পরে
দেশীয় সাবানের কথা, দেওয়াল লিখন।
মাঝ বয়সী ভদ্র মহিলা তারই ডেমু দেখিয়ে যান  …

ডেমুতে কিছু হলুদের রং
পোক্ত কাঁচা লঙ্কার জ্বাল
সুযোগ সন্ধানী কিছু পুরুষ আতর
ম ম গন্ধ ছড়ায় …

সভা চলতে থাকে দীর্ঘক্ষণ…..


বিয়োগান্তক

নবীনকিশোর রায়

একটানা অভিনয়,
দীর্ঘ রজনী শেষে পিছনের দরজায়
টোকা পড়ে,
ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে মঞ্চে আলো
যাবতীয় রচনা যবনিকাতে এসে দাঁড়ায়।

আলো-অন্ধকার মায়া সন্মুখে
আবহে অট্টহাসি, থেমে থেমে বিরহ সংগীত
সকল দৃশ্যান্তর মুছে
মঞ্চের পর্দা টেনে দেয়...

সাদা-থানে ঢাকা যাত্রপথ
অনন্ত রেখা বরাবর এগিয়ে চলে
ব্যতিক্রমি ধারাবিরণীতে ঘোষণা হয়ে যায়,
অবসম্ভাবি  - - - এক বিয়োগান্তক দৃশ্য!

তাকে আমি চিনি                            

তমা বর্মন 

নিভু নিভু মশালের নীচে লোকটি,
বুকে শাদা কাফন তাতে আজন্মের স্লোগান—
এ দেশ সুমহান
ঘাম-পিঠ খিদের বাষ্প হয়ে জমে আঙুলের ডগায়
দুধসাদা ভাত ছড়িয়ে ঘন সরের মতো স্বপ্ন
রেগার কাজে একশত টাকা
দু-শো মিলবে নির্বাচনীর নিগূঢ় রহস্যে,
ফালাফালা একমাথা হাইব্রিড রোদ
ধাবমান ট্রাকে চড়ে লোকটি যাচ্ছে সভাপতির ভাষণে
পাক খেয়ে মরে আসা আলোয় ভিড়ের মধ্যে চষে বেড়াচ্ছে
লোকটির সন্তানসন্ততি, ভালোবাসা-স্বপ্ন বিষাদসিন্ধু
মোড়ের দোকান থেকে চেয়ে নেয়া ফিরতিপথে                                     ঠোঁটে সস্তার সিগারেট
লোকটি মহা জ্ঞানপাপী,
হানিকারক বাতাসে টেনে যাচ্ছে শ্বাস
শেডস
কুশল ইশতিয়াক 


এখন অন্ধকার দেখি, অন্ধকারের অনেকগুলো চেহারা হয়

একটার সাথে একটার খুব বেশি মিল নাই
তাপমাত্রা ও গন্ধ দিয়ে
সহজে আলাদা করা যায়

সবচেয়ে কাছের অন্ধকারটা, যেটা থাকে সবচেয়ে দূরে,
কদাচিৎ দেখি― সাবকনশাসের সবচেয়ে গোপন দরজাটা যখন খুলি

মধ্যরাত্রির মতো সেও কিছুটা এলোমেলো, তবে
এতো এতো অন্ধকারের ভিড়ে―
তাকে আলাদা চিনতে কখনো ভুল হয় না আমার

হু হু করে সে কাঁদে। কেন কাঁদে? আপন কেউ নাই তার?

অথবা হবে হয়তো আমিই তার একমাত্র অন্ধকার
বাংলাদেশের কবিতা 


মুদিরছড়া খাল

নিলয় রফিক

সুন্দর লুন্ঠনে যুদ্ধে-মাঠে দুই বীর
সময় দর্পনে জয়ে মৈনাক পর্বতে
দেবাতার মিনতির শিবে প্রশ্নমালা
রাবণের ক্লান্তহীন কাঁধে লংকায়।

বিশুদ্ধ তপস্যা ধ্যানে শেকড়ে জানালা
যাত্রা -পথে প্রাকৃতিক আকাশে গর্জন
রথের জলবিয়োগে স্বপ্ন ভাঙা মন!
নোনাজলে সূর্যমূখী প্রাসাদে উড়াল

মহাদেব পাহাড়েই অদৃশ্য জীবন
স্নানের জোড়াপুকুর পবিত্র শরীর
প্রার্থনায় নিয়তির মাটির ললাটে
আদিনাথে তীর্থমেলা পূর্ণাতা সাঁকোর।

রাবণে- মুদিরছড়া খালে ইচামাছ
অমৃত সুস্বাদু ঝোঁল পারানজুড়ায়


কুয়াশার ঝাঁপি খোলা রোদ
টিপু সুলতান


শাদা কাগুজে চিনি দধি মিশ্রিত কালোজাম
টকজল গন্ধ ওড়ে
মাছি ওড়ে,মানুষ ওড়ে...
পিঁপড়ার গুটি পা ক্যাশপ্যাট থেকে বাঁকা পথ ঘুরতে ঘুরতে
টিস্যুর মত পরিত্যক্তায় জমাট বাঁধে
দীর্ঘ ধূলির ভেতর গ্রাম ও শহর
সঞ্জীবিত সংযোগ,গল্পজোট,ধ্রুব পুরস্কার;

আজকের,ঘষামাজা সামাজিক তরুণের অভিমুখ
এক কাপ লাল চায়ের ফিরফিরে ফুঁ,
উষ্মতার ধোঁয়া,মন্থ পাঠের লোকালয়-
তীর্থঘোড়ার বেতাল ক্ষুরশব্দ,কুয়াশার ঝাঁপি খোলা রোদ
সৌমিত্র রঙের সকল গুমোটের খোলস ভাঙে।



শীতকালীন মানুষ 
মোহাম্মদ জসিম


সাঁতারু নৈঃশব্দে এসে মরে যায় শীতকালীন
                                                            খুশি—

প্রচ্ছায়া উপচে পড়া চকচকে মানুষটি আসুক!

শীতের প্রতিভা নিয়ে গণিতের বই লেখা হয়
তোমার গল্পটি তবু হিমরাতে বিকল্প আশ্রয়...

শীত ও শোকের রাতে তুমি আমি নিমগ্ন ডাহুক।



ক্যানভাস

সীমান্ত হেলাল


এই মৃত্যুর মিছিলে আমি এক নির্বাক দৃশ্য মাত্র

পেন্ডুলামে ঝুলে আছি স্থিরচিত্রের মতো-

সবাই গায়ে মাখানো বর্নিল রঙ দেখছে

ভেতরে ভেতরে কতটা-ভিজে নাজুক হয়ে আছি
তা দেখেনা কেউ

অজস্র রঙের কারুকাজে প্রচ্ছদে ঢাঁকাপড়া
আমি এক নিখোঁজ ক্যানভাস

সুবীর সরকারের ব্যক্তিগত গদ্য 

ও মোর সারিন হাতির মাহুত রে ...
সুবীর সরকার

ঘরের মধ্যে ঘর।ঘরবাড়ির বিন্যাসে অগোছালো এক ভাবভঙ্গী বিন্যাসের সামান্য অদলবদলেই অগোছানোটা অনায়াসেই সুসজ্জিত সাজানো পথঘাটের রূপধারণ করতেই পারে।চরাঞ্চল থেকে রাত্রির খুব মাঝামাঝি থেকে জল ছুঁয়ে পাক খাওয়া বাতাসের অসামান্য মৃদু এক মন্থরতা সমস্ত সংজ্ঞার তীব্র বদল ঘটিয়ে দিয়ে যাবতীয়তাটাকেই সংজ্ঞায়িত করে তোলে।চর কিন্তু চিরস্থায়ী নয়,কোন না কোন চরকে সামগ্রিকতা সহই তলিয়ে যেতে হয়,ডুবেও যেতে হয়।আবার নুতন নামের ধারাবাহিকতাকেই অব্যাহত রাখে।এখানেই তো রহস্য।রহস্যের স্থবিরতাকে সচল করে তুলতে পারলেই পুর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ডুবে যাওয়া চরের ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুথথান।সাদৃশ্য অসাদৃশ্য তখন আর কোন বিতর্কের বিষয় হতে পারে না।বিষয়হীনতাই ঘরের মধ্যে ঘরের ভিতর কেবল অন্তহীন সব ঘরবাড়ি ঢুকিয়ে দেয়।নমোপাড়া যূগীপাড়া ঢুলিপাড়া দিনাজপুর কলোনী বামনপাড়া কাঁসারীপাড়া যাবতীয় সব টুকরোটাকরায় যেন ফেলে আসা এক দেশ হয়ে পুননির্মিত হতে চায়।হতে পারাটা সম্পূর্ণ না হলেও হতে চাওয়াটাই অনায়াসসাধ্য এক যৌথতা এনে ফেলে।যৌথতার শর্তসাপেক্ষ সামর্থের বিচিত্রতরতার ব্যাপ্ত সময়পর্বের ভিতর আবহমানের সব চরাঞ্চল ঘরবাড়ি আমোদপ্রমোদ পাশাখেলা স্মৃতিময়তা নিয়ে অনিশ্চিত ললাটলিখনের মতো জীবনের খন্ডে খন্ডে ভঙ্গ বিভঙ্গের মরমিয়া গানের আবহের নৈকট্যের সারাৎসার হয়ে গন্ডীর ভিতর গন্ডী ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া পেশীময় স্মৃতিময় প্রাবল্যের দোলায় দোলায় ভাসে।ভাসতেই থাকে।ভেসে যায়।এত এত জটজটিলতায় সূর্যোদয় সূর্যাস্ত চাঁদ ও অন্ধকার সবই নিজস্ব অধিকারে মর্যাদায় ঘরবাড়ির বিন্যাসটুকু এলোমেলো করে দিতে থাকে জীবনের জরুরীতম কার্যকারণসূত্রে।
অতিক্রমণের এক পর্বে হেরম্ব পরিচিত অপরিচিত নিসর্গের গমখেত ধান পাট তামাক তালগাছ নারকেলসুপারীর সারি_ এসবের মহামহিম গাম্ভীর্যময় অস্তিত্বের সামনে এসে দাঁড়ায়।তার দাঁড়ানোটা দাঁড়াবার ভঙ্গীটা অতিরাজকীয়।নিসর্গের অতিনিবিড় প্রাণবন্তে স্নিগ্ধতায় শুশ্রূষায় হেরম্ব তার অস্তিত্বের সকল সংকটকাল যেন অতিক্রম করতে থাকে।খুঁজে পেতে থাকে আত্মপরিচয়ের শিকড়বাকড়।প্রকৃতির চিরচেনা দৃশ্যপট অচেনা সব অনুপম মানুষেরা দৃশ্যকেন্দ্রের আধোআঁধারের ঘনঘোরজাত নুতন হতে থাকা মানবশাবকের মহামান্যতাই অর্জন করে ফেলে।অতিক্রমণের পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাওয়া আসার শূণ্যশাসিত অংশগুলি থেকে সুর করে যেন পাঠ করে যাওয়া পুরাণপুস্তক আরো আরো পুরাতন হতে থাকা মরজীবন নিসর্গের কিনার ঘেঁষে সদ্য রচিত নিসর্গেরই হাত ধরে নিসর্গকে স্থাপিত করে অনিবার্য নিসর্গগাথার ভিতর।হাট থেকে হাট চরাঞ্চলে ধানবাড়ি গাননাচের হাটের মধ্যে রেখে আসা জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ খড়ম জোতদারের আধিভৌতিক পৃথিবীর জনপদের সহজিয়া আখ্যানের মরমিয়া আহ্বানের তীব্র অংশগ্রহণ করতে চাওয়া হেরম্বকে কি তবে বনভূমি চা-বাগানের হাট আদিবাসী গ্রাম ময়ূরময়ূরী বাইসন বাঘের ডাক হাতিধরা গান নুড়িপাথরশ্যাওলানদীর সব বন্ধন সম্পর্ক ছিন্ন করে আপাতত অন্য কোন পরিক্রমণের অংশীদার হতে হবে।হেরম্বর তাতে কোন ক্ষয়বৃদ্ধি নেই কারণ তার স্মৃতিকাতরতা নেই;থাকলেও স্মৃতিকাতরতাকে অজস্র স্মৃতির ছায়া উপচ্ছায়ায় সে বিনির্মাণ করে তুলবে ভিন্নরকম কোন স্মৃতিময়তায় মিশ্রিত করে দেবার সহজাত সংক্রমণে।
এই যে জটপাকানো ভূগোল ইতিহাসের ভিতর হেরম্বকে ঢুকে পড়তে হয় একধরণের বাধ্যবাধকতায়,সে ভূগোলবাহিত সময়ের কথক হয়ে উঠতে থাকে একসময়।জীবনের নিজস্ব নিয়মেই এটা ঘটে।এইসব জটপাকানো জটিলতায় হেরম্ব কি দমবন্ধ পরিবেশ পরিস্থিতির অস্বস্তিটুকু এড়িয়ে চলতে চায়;সে কি ইতিহাস ভূগোলের বাইরে খোলা বাতাসের মধ্যে আসবার তাগিদ অনুভব করে।বাধ্যবাধকতার নিঃসঙ্গতায় হেরম্ব ক্লান্ত হয় কিন্তু ক্লান্তি তাকে গ্রাস করতে পারে না,সে আবার বাধ্যবাধকতায় চলে যায়।ইতিহাসের অংশ হয়ে ভূগোলের খণ্ডাংশ হয়ে হেরম্ব নিজের মতোন এক জীবনযাপন বয়ন করতে থাকে।জীবনযাপন্টা জীবনযাপন হয়ে উঠবে কিনা সেই সংশয় গ্রাস করলেও সংশয় থেকে সে আর সংকটের দিকে কিছুতেই চলে যেতে চায় না।এটা কি তবে তার  আত্মগোপন!সে হাট হয়ে ওঠবার গোটাটাই প্রত্যক্ষ করে।হাট থেকে হাটে রাতের বনভূমি অতিক্রম করতে করতে সে প্রতিদিনের প্রতিদিন হয়ে ওঠার পর্ব-পর্বান্তর অগ্রাহ্য করে করে নির্জনতার পথে নির্জন সব সাঁকো ও শালবনের দিকে পা বাড়ায়।সে কি পলায়নের কথা ভাবে;না কি পলায়নটাই তার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট।হেরম্ব তার জটপাকানো ইতিহাস ভূগোলের এক জীবনকে জীবনযাপনের ধরাবাঁধার সঙ্গে সংযুক্ত বিযুক্ত করতে থাকে।হয়তো এও এক বাধ্যবাধকতা;তবু সাঁকো হাট নদী নদী দিয়ে সে পুরাণ ইতিহাসের সমস্ত মিথগুলোকে উপেক্ষা করতে করতে অন্য এক মিথ ইতিহাসেরই চমকপ্রদ দৃশ্যায়ন ঘটাতে থাকে।এই পর্বে তার সঙ্গে অফুরন্ত ও জটজটিল সব স্মৃতিকাতরতা কিংবা কাতরতা থেকে চুঁইয়ে পড়া স্মতিরা নিরপেক্ষভাবেই থাকে;নিরুপায় হয়েই অথবা!
চিলাপাতার হাটে ঢোল বাজাতে বাজাতে আমার নিকটবর্তী হয়েছিল জার্মান রাভা।আন্দুবস্তীতে হাড়িয়া খেতে খেতে কত কত বছর আগে জার্মান তার জীবনের নানাকিসিমের গল্প শুনিয়েছিল।কত কত বাদ্যগান মোরগলড়াই কবরখানা ধামসা মাদল!এক ফাঁকে জেনেছিলাম শিবজির বৃত্তান্ত,যাকে গিলে ফেলেছিল মেন্দাবাড়ির হাতি।মাঠে মাঠে ঘুরি।ছড়ানো রোদের মায়ায় ভরভরন্ত শীতকাল।নকসাদার।অপরূপ।প্রান্তিক সব গঞ্জবাজারে উত্তরজনপদের,নিম্ন অসমের নদীজলবাতাসে পুষ্ট হতে হতে কেমন এক চিরকালিনতাই এসে যায় বুঝি।কত সম্পর্ক।বর্ণময় এক জীবনই তো যাপন করি।
অসমের গৌরীপুর।সাদা ফিতের এক নদি গদাধর।লাওখাওয়ার বিল।৩০০ বলির দূর্গাপূজা।রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া।রাজকুমার প্রমথেশ।লালজি রাজার গল্পগাথা।আর হস্তির কন্যা প্রতিমা বড়ুয়া।জনশ্রুতিতে ‘আজার বেটি’।গৌরীপুরের পথে পথে হাঁটি।পাগলের মত হাতি খুঁজি।সেই সব মাহুতফান্দীদের খুঁজি।আমার শরীর জুড়ে গোয়ালপারিয়া লোকগান।কাঠি ঢোল।মায়াময় এক জীবন নিয়ে আমার গতজন্মের ‘মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি’।বিমল মালির বাজনা বাজে,বাজে সীতানন্দের সারিন্দা।প্রতিমা বড়ুয়ার গানের সুরে সুরে আমার আবহমানের অনুভুতিময় স্মৃতিকাতর কুয়াশাঘেরা জীবনের দিনগুলি জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকে।তুমুল এক শীতরাতে রাজবাড়ি থেকে বিমল মালির সঙ্গী হয়ে ফিরছিলাম।বিমল শোনাচ্ছিল প্রতিমার নেশাময় জীবনের হরেক গাথাগল্পগুলি।প্রতিমার জীবন,তার গান,গানময় বেঁচেবর্তে থাকবার আর্তি প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল।নাসিরুদ্দিন বিড়ি আর দেশী মদ খতে খেতে হাতিমাহুতের সে এক অন্তহীন পৃথিবী-
   ‘ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি/গদাধরের পারে পারে রে’
সে এক অদ্ভূত মানুষ!যার সঙ্গে হয়তো আর দেখাই হবে না কোনদিন।যার জন্য মন কাঁদে,বুকের ভিতর আশ্চর্য মোচড়।রাজশাহী শহরে পদ্মার পারে তার সাথে দেখা।সম্রাট স্বপন।পেশায় রিক্সাচালক।পদ্মাচরে বাড়ি।বন্ধু কবি মাসুদার রহমান ও আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দেখা পেয়ে যাই সম্রাটের।ওর রিক্সায় পরবর্তী ৩ দিন আমরা অন্তহীন ঘুরে বেড়াই।সম্রাট স্বপন ভবঘুরে,উদাসীন স্বভাবের।কিভাবে যেন আত্মীয়তায় বেঁধে ফেলে সে আমাদের।আমরা স্বপনের নদীচরের বাড়িতে যাই।বড্ড মায়াময় এই জীবন।হা হা হাসতে হাসতে প্রবল গান গেয়ে ওঠা সম্রাট স্বপনের।
আবার হেরম্ব বর্মণ কে কি করে ভুলি!সাহেবপোঁতার হাটে,পাটকাপাড়ার হাটে টর্চলাইট বিক্রি করত হেরম্ব।সে ছিল আমুদে,রসিক মানুষ।কোচবিহার রাজার শিকারযাত্রায় হাঁকোয়ালি করত।‘কুষাণ পালায়’ ছুকরি সেজে খোসা নাচতো।আবার হেমন্তের সদ্য কাটা ধানখেতে ঘুরে ঘুরে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে নিয়ে আসতো।হেরম্ব গল্প বলতো,যেন বহুপ্রজ এক কথোয়াল!পুরোন দিনের সব ধনীজোতদার,কোচবিহারের রাজারাণীরাজকুমারেরা কী জীবন্ত হয়ে বর্তমানে ফিরে আসতো যেন।
দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টির হচ্ছিল।বৃষ্টির ভিতর মৃত দিদির মৃতদেহবহনকারী আমরা।দিদির মৃতমুখ বেদনাবাহী বৃষ্টিকণায় মিশে যেতে যেতে কেমনতর এক শোকগাথা হয়ে দিদিকে নিয়ে লেখা যাবতীয় এলিজিতে গিয়ে ঝাঁপ দেয়।
গল্পের পাকে পাকে,স্মৃতির পাকে পাকে জড়িয়ে যাওয়া জীবন।অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে না!নদীতীরের বাতাসে তিরতির কেঁপে ওঠা জীবন।কাঠামবাড়ির জঙ্গল ভেঙ্গে হাতিরা বেরিয়ে আসে,হাঁটতে থাকে গজলডোবার দিকে।আমি বুঝে ফেলি,দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙিলা দালানের মাটি।








অনিন্দ্য রায়

তাস ও কবিতা 


তাস, হ্যাঁ, খেলাটি নামে ও বদনামে পরিচিত সকলেরই । ওই বাহান্নটি তাস মিলে একটি ডেক; ডেকে চারধরণের, রুইতন-ইস্কাপন-হরতন-চিড়িতন, প্রতি ধরণের ১৩টি করে, টেক্কা, দুরি... নওলা, দওলা, গোলাম, বিবি, সাহেব, মোট ৫২টি, তাদের সাফ্‌ল করা,  খেলোয়াড়দের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া, তারপর খেলা, নিয়ম মেনে। খেলাও তো বিভিন্ন, নামে ও নিয়মে, রং মেলান্তি, তিওপাত্তি থেকে পেসেন্স বা ব্রিজ।
এই খেলার ভেতর কবিতা মিশে থাকে।
যখন খেলি, নিজের ভাগের তাসগুলি হাতে নিই, সাজাই, কোনটা কখন খেলব, কোন দানে চিড়িতনের গোলাম না হরতনের সাত, ভাবি, ঠিক করি, খেলার পরিস্থিতি আর আমার গেম রিডিং অনুসারে একেকটি তাস ফেলি, এই তো খেলা ।
কবিতারই মতো ।
শব্দগুলিকে, আমার কাছে আসা শব্দগুলিকে, এলোমেলো শব্দগুলিকে সাজানো ও কার পরে কোনটি লিখব সেই ক্রম কবিতার দাবি মেনে স্থির করা, লেখা। হ্যাঁ, ‘কবিতা লেখার, প্রিয়, এটুকুই মজা’।
এভাবেই, তাস ও কবিতা, খেলা ও লেখার একটি সম্পর্ক জমে ওঠে, আমরা জানি।
 কারুটা, জাপানের একটি খেলা, তাস ও কবিতার।
 দুজন প্রতিযোগীর মধ্যে খেলা। তাস থাকে দু ধরণের, তোরিফুদা ( খেলার তাস ) আর ইওমিফুদা ( পড়ার তাস ), প্রতি ধরণের ১০০টি করে। প্রত্যেক ইওমিফুদায় থাকে একটি করে ওয়াকা। ওয়াকা হল জাপানি কবিতার ৫-৭-৫-৭-৭ অক্ষর ( syllable) বিন্যাসে পাঁচ লাইনের জাপানি কবিতা । তোরিফুদায় থাকে ওই ওয়াকাগুলির একেকটির শেষের দুলাইন  ( অন্তিম ৭-৭ অংশ )। তৃতীয় একজন একটি করে  ইওমিফুদা থেকে ওয়াকাটি পড়ে আর প্রতিযোগীরা খোঁজ করে তার শেষ অংশের তোরিফুদাটিকে। যে আগে পাবে তাসটি তার। শেষে যার সংগ্রহে বেশি তাস থাকবে সেই বিজয়ী। জাপানে এটি জনপ্রিয় খেলা। নববর্ষের সময়ে অনেকেই কারুটায় মেতে ওঠেন। এর জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতাও হয়।
নবম শতাব্দীতে চিনে প্রচলন হয় তাস খেলার। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। নানান বির্বতনের মধ্যে দিয়ে পায়  আজকের  এই বাহান্ন তাসের রূপ। রুইতন-ইস্কাপন-হরতন-চিড়িতনের এই দেশ ফরাসিদের অবদান।
তাসের দেশ – শুনলেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাখ ঠাকুরের নাটকটির কথা, তাসের রূপক বেশ জনপ্রিয় আমাদের সাহিত্য।
তো, পাঠক তাসের মতোই কবির লেখা শব্দগুলি থেকে কবিতাটি খুঁজে বের করেন, সাজান। তাঁর পাঠ এক নিজস্ব ভাবনাক্রম তৈরি করে।
পেসেন্স একটি খেলা, তাসের। একক খেলা। খেলোয়াড় ও তাঁর তন্‌হাই, বাহান্নটি তাস ও তাঁর ধৈর্য ।
তিনি সামনে নিয়ে বসেন। তাঁর কাজ নিয়ম মাফিক এলোমেলো তাসগুলিকে সঠিক সারিতে, সঠিক অবস্থানে বিন্যস্ত করা। তাহলেই খেলার শেষ।
এরমই ‘পেসেন্স কবিতা’। বাহান্নটি শব্দ, চারটি বাক্যের, প্রতি বাক্যে ১৩টি করে। কিন্তু তাদের সেভাবে লেখেন নি। লিখেছেন এলোমেলো । পাঠক ওই বাহান্নটি শব্দের সামনে বসেন, শব্দগুলির ক্রম পরিবর্তম করেন, খুঁজতে থাকেন মূল কবিতাটিকে । আর এই খোঁজের ভেতরেই তিনি তৈরি অসংখ্য শব্দ-প্যাটার্ন, অসংখ্য কবিতা।
পেশেন্স কবিতা

পাথর গিলেছে প্রেত সাবান অভ্যর্থনা মোছা তুলো ঘাম দূর্বা আরতি আর অন্ধ মঙ্গল ছুরির ফলার পণে কমিনা সনেট দৃশ্য ঘুটঘুট দীপালি হো নম্র আভা ভ্রম সাজ ছাউনি শেষ করে লিরিকে গড়িয়ে যাচ্ছে ডানাময় মুখঢাকা গাড়ি ঘুম মেঘ বিষাক্ত শূণ্যতা চুমুকে সিগ্রেট কমে ধোঁয়া উড়ে সুখ ধুত পাংশু হাত মাংস খুবলে রক্তপায়ী হয়
                 ( সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় / কাব্যগ্রন্থ ঃ আমি তো মাছির গায়ে বসি না, মাছি বসে কেন  )

তিনপাত্তি । বদনাম তাসের খেলাটি ।
খেলতে বসে দুজনে । মাঝে খেলার টেবিল ও তাস । বাটোয়ারা হয় ।প্রত্যেকের হাতে তাস তিনটি করে ।
খেলুড়েরা নিজ নিজ তাস দেখে , ফেলে ,
একের পিঠে অপরে । তিন দান ।
যার তাস বড়ো জয়ী সেই।
তো কবিতা?
ছয় লাইনের । দুটি করে পংক্তির একেকটি জোড় । তিনটি স্ট্যানজা ।
কবি এমন একটি বিষয়ে লিখবেন যা নিয়ে তাঁর মনে দ্বন্দ্ব চলছে ।একটা আইডিয়ার পিঠে আসছে তার বিপরীত আইডিয়া । থিসিস ও অ্যান্টিথিসিস ।
কবি একটি একটি করে ফেলবেন । তিনটি থিসিসের পিঠে তিনটি অ্যান্টি ।দু লাইন করে তিনটি জোড় । । তিনটি স্ট্যানজা ।
পাঠক ঠিক করবেন কে জিতল , বা আদৌ কোনো হারজিৎ হল কিনা।
সিনথেসিস । সেটাই কবিতা।
           













শিরোনামহীন পাখি
   

     অনিমেষ পাখিটিকে বাদাম দেয়
পাখিটা রোজ বাদাম খায়

পাখিটা বাদামি রং ভালোবাসে
পাখিটা বাদামি গান গায়

পাখিটা রোজ বাদাম খেতো
পাখিটা রোজ বাদামি রং হারাচ্ছে

       ( শমীক যাণ্নিগ্রাহী / কাব্যগ্রন্থ ঃ আনজান আদর )

পরপর দুটি লাইন হতে পারে দুজনের সংলাপ। হতে পারে একজনেরই মনের দুই বিপরীতমুখী ভাবনা । আবার তা যে ৬ লাইনেরই হবে, নাও হতে পারে, কিন্তু দুজনে রং মেলান্তি খেলার মতো একেকটি করে পঙ্‌ক্তি, পরের পঙ্‌ক্তিটিকে নিয়ে একটি  স্ট্যানজা, কিন্তু ভাবনাগতভাবে পঙ্‌ক্তিদুটি মিলছে না, বিপরীত অথবা তাদের মধ্যে একটা অমিল রয়েই যাচ্ছে। কবি লিখেছেন ততদূর যতক্ষণ না মিলে যায় দুটি লাইনের ভাবনা। যেভাবে রং মিলে যাওয়া অব্দি তাস ফেলে যান দুই খেলোয়াড় আর মিলে গেলে শেষ হয় একটা দান।



  ( জয় গোস্বামী / কাব্যগ্রন্থ ঃ আজ যদি আমায় জিগ্যেস করো )
দুজনের কথাবার্তা চলতে থাকে একের পিঠে অপরে । শেষ স্তবকে বদলে যায় , প্রেমিক বলে আগে, তারপর ঈশ্বর। এবং এতক্ষণ যে কথার অসাযুজ্য চলছিল তা মিলে যায়।
এবং সংলাপের মতো না হয়ে ভাবনাগত দিক থেকে


( কালীকৃষ্ণ গুহ / কাব্যগ্রন্থ ঃ স্মৃতিহীনতার মধ্যে নিস্তব্ধ পুরাণ )
 ভাবনা, পাল্টা ভাবনা- এইভাবে রচিত হয় কবিতাটি। এবং শেষ স্তবকে একীভূত হয় কবির উচ্চারণ।
এইভাবে তাসের ভাবনাগুলি, তাসখেলার ভাবনাগুলি কবিতায় এসেছে, কখনো কবির সজ্ঞানে, কখনো অজ্ঞাতে।
 তাসের খেলাগুলি আরও নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে আমাদের কাব্যভাবনাকে
এভাবেই কবিতা, এভাবেই তাস, এভাবেই আমাদের ভাবনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 
মশকরা

শ্রদ্ধা চক্রবর্ত্তী

ভুল করতে করতেই তো কুঁড়ি হলো
মা ঠাকুমারা মশকরা
করেন

অথচ এদিকে জীবন নিয়ে খেলছে সব
বারুদ নিয়ে খেলছে দলে দলে মানুষজন
ধর্ম খুঁজছে সবাই
থুড়ি ধম্মো ধম্মো...
খুঁজতে খুঁজতে একটা বিরাট বড়ো নীল রং মাখা নখের গোড়ার গিয়ে যুদ্ধ বাঁধল ভালো খারাপের...

আর ঐ যে ওরা
কালো কালো রোদ্রে পোঁড়া মুখ নিয়ে হা করে পুতুল নাচ দেখছে
আগের বছর ওরা সং খেলা দেখেছিল...
আমার বয়স সবে হলো
আমাকেও সমাজের রীতি মেনে উপোস আপোস দুটোই করতে হবে...

শুধু বয়স বাড়বে মানুষ হওয়া হবে না
আদতেও কথা বলতে শিখবো না...
ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বসন্তের রঙে রঙ খেলবো খয়েরি, সবুজ, লাল এর
পাহাড়ের গায়ে ঢলে পড়বে কয়েকশ অভিযোগ
কান্না, আনন্দ
শুধু
অভাব হবে বারে বারে সাদা রঙ নামক শান্তি রঙের..
রহস্য বিধবা
পীযূষ সরকার 


টানা আটমাস খুব সন্তর্পণে খুন হলাম আমি । মরদেহে সামান্য মাটি বা আগুন দিল না কেউ । দিন তিনেক অশৌচ না , দুবেলা হবিস না ‌! আমার অতৃপ্ত আত্মা এখন ফনীর মতো উড়ে বেড়ায় । নিজের ঘর নিজে ভাঙে , নিজের গাছ উপরে ফেলে নিজের ভবিতব্যে । পরিবারের চোখে জল । ঈশ্বরের কপালে ভাঁজ । মৃত্যুর পর এই জীবদ্দশা ,এই অস্থিরতা অলক্ষুণে বৈকি !
ময়নাতদন্ত শেষ । হতোদ্যম পুলিশ কুকুর ।
কী শাস্তি ? কী বিধান ? এ ক্ষতির দায় নেবে কে বা ?
খুনিও কাছের লোক ..
নিষ্পাপ । প্রণয়ী । রহস্য বিধবা...
সোঁ সোঁ বিকেলের দিকে
সূরজ দাশ

বসত গেড়েছি মোমগলা মাটির প্রদেশে
আমার পিতৃপুরুষ এ গাঁ সে গাঁ হয়ে ভিনরাজ্যে
পৃথিবী নাড়ায়

পাখির ডানা থেকে ছিটকে আসে রোদ
শিকড়ে আঁকে পিথাগোরাস
বুকের পাঁজরে ভাজ করা আকাঙ্ক্ষা

মাটিতে লতানো শৈশব
আর ঘরে ফেরার টান

সোঁ সোঁ বিকেলের দিকে
বিছানা পাতে খণ্ড খণ্ড চুলের গোরায়


নাকছাবি


গাছের আড়ালে ওড়ে তোমার সম্মতি
গোটানো শরীরে কত কি অদৃশ্য হয়
কত কি লুকানো যায় এইখানে
শিশিরে লুকানো যায় নিজের ঠিকানা

যে কেউ জানলা খুলে মাঠের ভেতর যেতে পারে
মানুষের ব্যবহৃত রাতে যে কেউ পেতে পারে
এই আকাশ বিছানা, বাতাসে বাতাস, পরশমণি

জোছনার চাদর জড়িয়ে , গুটিসুটি সাপ
মাছভাজার গন্ধ পেতে রাস্তায় খোঁজে ভেপারের আলো

রাতের পৃষ্ঠা ওলটাতেই কেঁদে ওঠে সারিঙ্গা মাতাল
তেপান্তরের দিকে হেঁটে যায় ঘোষপাড়ার অল্পবয়সী চাঁদ
যাবো না যাবো না করেও সরে যায় বুকের ওড়না

গল্পের ঠোঁটে লিপস্টিক
আকাশ বললো, চল,
রিক্সায় যেতে যেতে তোমাকে দেখাবো আত্রেয়ীর নাকছাবি





শব্দরূপ : রাহুল গাঙ্গুলী



কয়েকটা অতিগাণিতিক হিবিজিজী
----------------------------------------------------
আসুন।assume করি ১টি পাখি
ওড়ে।কিন্তু _____ >
ডিম পাড়ে না।চুল / পালক → তা

গরম ধোঁয়ায় জন্ম নিচ্ছে দধিচী
আবার মরছেও ]]]]]
ভাবি।এবার আমার assumption পাথর
বড়ো হচ্ছে।মৃত হতে হতে ~ হতাহত অবয়ব
আবার আয়তনহীন ০-দেওয়াল

ধ্রুবতারায় মুক্ত হয় মূকমক্ পৃথিবী
এর আয়তক্ষেত্র আকার ???  
কেনোই বা বাওয়ালির মেঘ
যেখানে রূমাল সর্বস্বান্ত
@
জীবনের নহন্যতে জ্যামিতি ~ প্রায় ১বার
বাস্তুশাপে-র উল্টানো থালায় - সোনা



এলোমেলো হচ্ছি।টেলিফোন স্ট্রাইক 
মোটকথা কোনো খবর / অখবর
অনির্দিষ্ট প্রয়োজনে ঘুমচাল

2½ চালে vertical তাপ।কেউ এগোয় / পিছোয়
হ্যাঙারে টাঙানো জামার ঘাম ~ টপটপটপ্

অঙ্কে ০ যারাই পায় : সন্যাসী / বেশ্যা 
স্বর্গদ্বার খুলে গিয়ে ~ কচি আপেলের ভাগাড়
ঈশ্বর আছে কি নেই _???
জামার বোতামে লকআউট।লকআপ

হয়তো কামান ~ আগ্নেয়গিরি / আগুন
বিপ্লবের কাঁথা : মুতছে গণতান্ত্রিক ভ্রূণ

অবরোধবাসিনী
কণিকা দাস
 
সেই কবে বিষবৃক্ষতলে এয়োস্ত্রী হয়ে ওঠা
তারপর কেটে গেছে কত যুগ
রক্তাক্ত সিঁথিতে চোখ পড়লেই মনে পড়ে
একদিন স্বাধীনতা চেয়েছিলাম
মুক্ত বিহঙ্গ ডানায় উড়তে চেয়েছিলাম।
আজও ডানা মেলে উড়তে পারি 
ঘুড়ির মতো---
সুতোটায় বড্ড বেশি ধার, রক্তাক্ত হই,
পিছুটান তাড়া করে বারংবার
লঙ্ঘনের পথ খুঁজিনি কখনো
জানি সে পথও শ্বাপদ মুক্ত নয়।
সেই কবে অগ্নি শপথ করে আত্মবলিদান। 


অনন্ত তৃষা
                  
কতদিন সাঁতার কাটিনি একসাথে
কতদিন অনন্ত জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হইনি
কতদিন নৌকার গলুইয়ে বসে সন্ধ্যায় তারা গুনিনি
ছাদের কার্ণিশে বসে অলিক ভাবনায়
জীবনকে উজাড় করিনি।
তোমার রূপোলি ভবিষ্যতে আমি ব্রাত্য
আজ বড় ইচ্ছে করে গঙ্গার বুকে 
ভাসিয়ে দিই নিজেকে
অনন্ত শয্যায় শুয়ে সূর্যের উদয়াস্ত দেখি
গোধূলি পেরিয়ে গেলে চাঁদের সাথে কথা বলি
জানি এই জীবন শুধু একান্তই আমার
অলিগলি পেরিয়ে ঢোকেনা কোন আলো
চেনা পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে না কেউ
মাঝে মাঝে শূন্যতায় ভরে থাকে মনের চৌহদ্দি
দোদুল্যমান জীবন প্রবাহে কান্ডারীবিহীন নৌকা 
পাঁক খেতে থাকে মাঝ নদীতে 
আর কতকাল জীবন চলবে স্রোতের বিপরীতে!
কেউ কথা রাখে না, রাখতে জানেনা
হতাশার অতলে জ্বলে না দীপের আলো
ফুল ফোটেনা আগের মতো 
সময় নিয়ে যায় সবকিছু চুরি করে
বাঁচতে চাই--কথাটা আর ব্যথা জাগায় না
এভাবেই একদিন সব ঋণ শোধ করে
চলে যাবো অনন্ত পারাবারে 
তখন একফোঁটা চোখের জল ঝরবে কি
পুরনো দিনের কথা মনে করে.…..




অরুণাভ ভৌমিকের কবিতা 

১। অবৈধ
  

আরতি চুমকিকে পেয়ে কাজের লোক
ছাড়িয়ে দিয়েছিল

সুধীর একগুচ্ছ বালিশ ছড়িয়ে
হেলান দিয়ে শুয়ে আছে

চুমকি বলল আমি কিন্তু 
৬-৫০ এর ট্রেন ধরব।

২। অনুভব ১
 

শহীদ মিনার থেকে নামছে কুয়াশার মাঠ
শীত ও আয়ু জুবুথুবু হয়েছে হাতলহীন চাদরে

দশ ফুট বাই দশ ফুট রোদে বাজছে গোপন রহস্য
জামার জানালায় দেখে খানাতল্লাশির আর্তনাদ

খড়কুটো নিয়ে কেউ যদি হুডখোলা শহীদ মিনার
অশান্ত নীচু প্রহরে তবে ভাসে আবরণহীন বিকেল!

৩।   খিদে ১
 

খিদে চায় অনায়াস লীনতাপ বর্ণমালার নরম স্পর্শ
অগোছালো পাতার নিচে তখন তো বৃষ্টির ঠোঁট
সে এক নড়বড়ে জন্মকাহিনী বনজ্যোৎস্নার স্তূপে
দেখে শুনে হেসে ওঠে খিদে জল মোছা আঙুলে

খিদে শিরোনামহীন খিদে অপাঠ্য ভ্রমণ কাহিনী
অসুখের জলসিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা খেলার সময়!

৪। খিদে ২
 

ওঠ
যে এক
বিমর্ষ খিদে
তোমাকে জানাচ্ছি দ্রোহ
মুঠোর উচ্চতায় রেখেছ অতল
যখন আরো কিছুটা বিমর্ষ রাতের আঙ্গুলের ডগায়!

৫। মান্দাবাড়ির জঙ্গলে
      

জঙ্গলের সঙ্গে জঙ্গলে দেখা হোল 
একজন মধ্যবয়সিনীর

কোন কথা হোল না

নৈঃশব্দ মুগ্ধ হয়ে গেল
নরম আলোতেই তার খেলা

অবাক দ্যাখে তার ছদ্ম বীতরাগ!




প্রবীর রায়ের কবিতা
______________

আনন্দম
_______

স্বাধীনতার অংশ নয় এই প্রক্রিয়া
শিকল কিংবা নীল ধোঁয়া ঘিরে ধরে
মাথার খুলি আর অভ্রান্ত মগজ
গতি হারিয়ে ফেলে

সারিসারি বেলুন লাগানো বাস পিকনিকে যাচ্ছে
গানের খই ছড়াতে ছড়াতে

পরিক্রমা
_______

ফুল রাখার পাত্রটি খালি থাকবেনা
কাল সকালে ভরে উঠবে নিবেদনের জন্য
যাকে সঙ্কলিত ধারাবাহিক বলা যায়
অথবা টিভির মেগাসিরিয়াল
শেষটুকু সহজেই ভুলে যেতে পারি
শুকনো এবং অবাঞ্ছিত
অনুরূপা পালচৌধুরী।          


            লিভিংবৃত্ত
             __________ 

                    

বেহিসাবি আলোভাঁড়ে ডুবে যাওয়া কুয়াশার লাশ নিষিদ্ধ মশালের মেঘথলি খোঁজে না।আধখোলা পাঁচিলের হিজুলিচাঁদ ফেঁটে ফেঁটে যেভাবে মগজের ভীড়ে জুড়ে যায় মাসকূটের বেলচা : ইচ্ছে করে মাটি পুঁতে দিই মাথাভর্তি নরকপাত। আমার নিয়মের অণ্ডগাছ : রোদমলের ১দাগ বায়োবট 
 

চিরদাহি দুপুরের মজ্জায় তেষ্টার সাহস কিনি।
রোদশিরের সিরাজ খুনে সূর্যখোরের নিভু নিভু আকাশটা আজকাল বড্ড দমভাঙ্গা ঘড়ির পসরায় আসামি হয়ে যায় নীলকরের নৈবেদ্য। সে টকটকে জিভখাড়ি এখন খারই ভোরের মশগুল মাটিভূজ। দ্বি-ফলার আলমুখে স্বাধীনতার পাখি উপায়বসতের ঘন পায়ের অরণ্যকাণ্ড। অথচ নদী বোনার অছিলায় নৌপথ খুলে রাখি হাত বরাবর দাহঘুম

অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা 


আমার ঈশ্বর

১।
ক্লান্তি শিখছে দরজার দুইপার। এই সকাল শুধু পুরষ্কারের দিকে তাকিয়ে আছে। পাখিদের সাথে মেখে থাকা ভবনের এই নিচতলায় ভগবানের কার্যালয়। কিছু ছবি এখনো সেখানে আহতের তালিকায়। 

রোদ গায়ে লাগতেই বুঝতে পারছি আমাদের সমস্তটাই বাজে শুরু র কথায়। গান সেতো শুনতেই পায় ছোটবেলা। থালার কিনারে আঁকা নাম আর নামের শিরোপা।

পড়তে পড়তে জানলাম ফেলে আসা পায়ের ক্লান্তিও জেনে গেছে আজ মুক্তি। 

আজ আবার শরীরে আগুন জ্বলবে মন পোড়ানোর। ভাষা হয়ে উঠবে আরেকটি প্রাচীন অধিকার।

চলো দিয়ে আসি। আসিয়া শান্তি পাই গচ্ছিত রাখি বলে।

দুই।।

ক্ষেতের অধিকার আবার রাত্রির কথা শোনাবে। নিরানীরা বসে থাকবে ঘাতকের খোঁজে বিনিদ্র অন্ধকারে। তখন কোথাও কোথাও চাঁদের আলো। হয়তো পোয়াতি মায়েদের পেটের গন্ধও টের পাবে মাটি আর ফসল। 

পাখিরাও সাক্ষি থাকছে এই লড়াই এর অংশীদার হয়ে। 

আগুন জ্বললো। যুবকের বুক চিরে বেরিয়ে এলো অচেনা বসন্ত। যুবতীর চোখ থেকে নিঃশ্বাস। সম্মতি।

একটা নতুন দিন আসছে। স্লোগান উড়িয়ে সমস্ত ছারখার করে। 

মা সেই অপেক্ষায় আছেন। ভুলে যাবেন গর্ভের যন্ত্রণা ফিরে পাওয়া অস্তিত্ব নিয়ে। 
কলঙ্কের রেহাই মাড়িয়ে।
মিথ্যে প্রতিশ্রুতি
উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়


কী এক অদ্ভুত বিশ্বাসের ভেতর শব্দ বুনছে কণ্ঠস্বর
মুখের ভেতর দপ দপ করে জ্বলছে আলো
বুকের ভেতর প্রতিহিংসার সহবাস


এ কেমন যুক্তির প্রলাপ, মানুষের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে
তোমাদের আশ্রয় যখন নিরাপদ আরো নিরাপদ কম্বলের নিচে শীত তাড়ায়
আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে দিব্যি হাততালি দিচ্ছ চা- টেবিলে

গল্পেরা সত্যিই গল্প বটে
নইলে তোমাদের শেকড়  ঘিরে কী করে সমাজ অন্তর্বাসে বেঁধে রাখে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি


যে সব আঙুরক্ষেত 
 নীলাব্জ চক্রবর্তী



এই যে ক্যাকটাস ফুলে রেখে দেওয়া
হেমন্তকালীন ভঙ্গিটি
ভাষার বিপরীত দিকে হেঁটে গিয়ে
অসমাপ্ত
এক এলো-দুপুর
এই ভ্রম
কথার পিঠে কথা
অর্থাৎ
এই লোকাসের কাটাকুটিতে
পাখি ও কবিতার একইরকম ছায়া বারবার
সকল আঙুরক্ষেতে
গান ফুটে
ভারী বাতাসে রেখে দেওয়া
জিভ কার নতুন হয়েছে...

জ‍্যো তি র্ম য়  মু খো পা ধ্যা য়




সারাটাদিন

একটা বিরক্তি ঝুঁকে দেখে আমাকে
আমিও চোখ তুলি, কোনও কথা বলে না
চোখ নামিয়ে নিই
মনে হয়, ও হাসছে
ওর চোখে ধ‍্যুস্ লেগে আছে
কুঁকড়ে যাই, ভয় লাগে

আমি'র ভয়ে আমি একা







প্রতিদিনই

দারুণ দারুণ কবিতা লিখি
প্রতিদিনই শুরু হই আমি কবিতা
তারপর যত বেলা বাড়ে
শব্দগুলো ক্ষয় হতে হতে
ক্ষত করে ফেলে আমাকে

বুঝি, আমি একটা বাতিল কবিতা


বন্ধুতা...
শৌভিক বণিক


মূর্খতা,
অন্ধ বিশ্বাস চোখের সামনে আলো জ্বাললে 
আমি ক্রমাগত অন্ধকারে ডুবে যাই
প্রিয় মুখ ঝাপসা হয়ে আসে...

বৈরিতা ভাঙছে স্বভাব সিদ্ধ আলো
উন্নাসিকতার পাঠ নিচ্ছি দিবানিশি
ঠুলি পড়া চোখে খুজছি শত্রু-বন্ধুর ফারাক
বিস্বাসের ভেতর দীর্ঘ হচ্ছে সন্দেহ
সুপ্ত মৃত্যুকাল প্রকট হচ্ছে ক্রমশ
ক্রম ভাঙছে দেশ-কাল
সম্পর্কের ভেতরবাড়িতে বাসা বাধছে ভয়
প্রিয়মুখ ঢেকে যাচ্ছে মুখোশে...

















সত্যম ভট্টাচার্যের একটি আর্টিকেল 

কেন এমন হল?
                  
 

গাড়িটা এমন এক জায়গায় কিছুক্ষণ হল আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে যে এবার কি করবো,কোন দিকেই বা যাবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে।আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে আশপাশ ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে যাবে।এই জায়গাটা এমন যে কোন দোকানপাট বা মানুষজন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,তাই কাউকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবো সে উপায়ও নেই।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি আর দেখছি একের পর এক গাড়ি তীব্র গতিতে হাইওয়ে ধরে বেড়িয়ে যাচ্ছে।কোন কোন গাড়িতে আবার তারস্বরে বাজছে গান।সবাই যেন আফিমের নেশায় মশগুল।চারিদিকে কি হয়ে যাচ্ছে এই সম্পর্কে কারুর কোন জানবার ইচ্ছেই নেই।যেমন এই জায়গা থেকে ঠিক দু কিলোমিটারের মধ্যে একজন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে স্রেফ ছেলেধরা সন্দেহে।এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ঠিকও করতে পারছি না যে অন্য কোন গাড়ীকে হাত দেখিয়ে এখান থেকে বেড়িয়ে যাবো কি না।শুধু মাঝে মাঝে ভাবছি এই উন্মত্ততাই কি একমাত্র প্রাপ্য ছিলো আমাদের?
এই এমন সবুজের দেশে যেখানে হাতে হাত ধরাধরি করে ধামসা মাদলের আওয়াজে বেড়ে ওঠা ছিলো আমাদের সেখানে কিভাবে এই ভয়ঙ্কর বিষ ঢুকে পড়লো?না কি সবই মজুত ছিলো আমাদের মনে,শুধু বাকি ছিলো দেশলাইয়ে কাঠিটুকু পড়বার।একবার দেশে সে আগুন জ্বলতেই দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।সেখানে দিল্লী না গুয়াহাটি,কাশ্মীর না কন্যাকুমারির কোন দূরত্বই আর থাকলো না।যখন সহজেই পাওয়া যাচ্ছে নির্বোধ,হাবাগোবা বা খানিকটা জড়ভরত টাইপের লোক,ব্যস তখনই এই টার্গেট।একেই পিটিয়ে থেতলিয়ে খুঁচিয়ে প্রস্রাব বিষ্ঠা গিলিয়ে তবে না শান্তি আমাদের।আরো যদি মানুষটি হয় পঙ্গু বা অথর্ব তাহলে তো কথাই নেই।কারুর মনে প্রশ্ন আসে না যে মানুষটির নিজেকে দাড় করাতে গেলে কাউকে ধরতে হয় সে কিভাবে ছেলে ধরতে পারবে।আর যেখানে আমাদের সবুজ বলয়ে বহুদিন থেকেই সঠিক পুষ্টি বা খাদ্যের অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের কোন অভাবই নেই।সে হয়তো পাশেরই কোন জায়গার বা মূকবধির বা পথ হারিয়ে ফেলে বিভ্রান্ত।তাই মারো,এদেরকেই মারো,এমনভাবে মারো যে বলার যেন কোন জায়গাই আর না থাকে।আর বাকিরা নির্বিকার থাকো,ফোনের মোবাইল ক্যামেরায় ধরো রক্তের উতসব।এমন লোককেই বানাও আমাদের নিশানা।আমাদের তো করার কিছুই নেই,তাই চলো এ নিয়েই মেতে থাকা যাক।আমাদের দৈনন্দিনের হেরে যাওয়া,প্রাপ্য পাওনা না পাওয়া,একের পর এক সবুজ লাল হলুদের আমাদেরকে নিয়ে ছেলেখেলা,আমাদের ভালোবাসার মেয়েদের স্রেফ খাবারের অভাবে স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া দিল্লী-মুম্বাইতে-আমাদের মনে এইসব হতাশা নিয়ে এসেছে।তাদেরকে কিছু করতে না পেরে আমাদের টার্গেট ঠিক হয়েছে এইসব সফট পয়েন্টেই।
কিন্তু এই উন্মত্ততার আফিমে মাতাল হয়ে আমরা যেটা করছি যে নিজেরাই নিজেদের খুন করছি আমরা।ভারতবর্ষের এই ভূখন্ডে যেখানে বাস  সাদ্রী-নেপালী-রাভা-মেচ-রাজবংশী সহ বহু ভাষাভাষী মানুষের-তাদের মিলিত সংস্কৃতি-মিলিত জীবনই বহন করতো ভারতের প্রকৃত ধর্ম-বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।কিন্তু এইরকম গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষ বিশ্বাস হারাবে মানুষে।এর আগেও সুচতুর ভাবে বহুবার এই পারস্পরিক বিশ্বাসে আঘাত হানার চেষ্টা করেছে কুচক্রীরা।সাময়িক বিশ্বাসে হয়তো চিড় ধরেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর।কিন্তু আবার সব বাধাবিঘ্ন জয় করে জীবনের মন্ত্রে একে অপরের পাশে এসে দাড়িয়েছিলো এই এলাকার প্রত্যেকটি মানুষ।কারণ এই দেশ সবার।আর বাঁচতে হলে তো এখানে এই কঠিন জীবনে,এই জঙ্গলাকীর্ণ শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেষ্টিত ভূখন্ডে,বাঁচতে হবে একে অপরের হাতে হাত ধরেই।এখানে এই চাবাগানের ঢালু ভূখন্ডে যেখানে যে কোন সময় এমনকি দিনের বেলাতেও ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে চিতাবাঘ,মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চা পাতা তোলে মায়ারাণী তামাং আর লছমী ওঁরাও।নিশ্চিন্তে চাবাগানের মাঝে একটু ফাঁকা জায়গায় নিজেদেরই করা ক্রেশে অবলীলায় বাচ্চাকে রেখে পাতা তুলতে সদ্য মা হওয়া শ্রমিক মহিলাটি।বাচ্চা যখন কাঁদে দুধের জন্য,তার মায়ের জন্য,তাকে কোলে নিয়ে স্তন্যপান করান ঘুম পাড়ান আরেক মহিলা।রাতে সাক্ষাত মৃত্যুদূত হয়ে আসে হাতি,তাকে তাড়াতে সবাই মিলে সবাই মিলে হল্লা করতে হয় একসাথে।এভাবেই আমাদের বেঁচে থাকা-কঠিন ভূখন্ডের যৌথ জীবন।এখানে প্রাইমারী স্কুলে পাশাপাশি বসে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারে সোমরা মুন্ডা আর রোশন তামাং।একসাথে খেলতে খেলতে তারা চা বাগানের পথে স্কুলে যায় আসে।এই বিশ্বাসই জীবন এখানকার।কিন্তু কিভাবে এই বিশ্বাসের জীবনে এতবড় এতবড় অবিশ্বাসের গাছ জন্মালো যে এক চা বাগানের একজন মানসিকভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে স্রেফ ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেললো খানিক দুরের আরেক চা বাগানের লোকেরা।তা সম্পর্কে জানতেই এসেছিলাম এখানে।কিন্তু এই সন্ধ্যা রাতে মনে হচ্ছে দেরী হয়ে গেছে।আর ভয়ও লাগছে খানিকটা।দিনে দিনে যে পাশবিক হিংস্রতা বাসা বাঁধছে মানুষের মনে-যে নারকীয় মনোবৃত্তিতে কিছু মানুষ মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলছে নিরীহ একলা মানুষকে-এখন অপেক্ষা করতেই হবে এই সময় কেটে যাবার।আর স্বপ্ন দেখতে হবে,আবার নতুন সকাল আসবে-আবার হাতে হাতে ধরে চলা শুরু করবে এই ভূখন্ডের সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষার লোকেরা...(সাম্প্রতিক ডুয়ার্সের বেশ কিছু জায়গায় গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে এ লেখা)

মানিক সাহার দীর্ঘ কবিতা 

তন্ত্রের রাত


আর একটু এগিয়ে গেলে মাঠ
তারপর শান্ত শ্মশান

আমি কালীমন্দির ছাড়িয়ে, মাসানবাবার পাট ছাড়িয়ে
মানুষখেকো পুকুর ছাড়িয়ে, শ্যাওড়াগাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছি

আমার গলায় কে রুদ্রাক্ষের মালা পরিয়ে দিয়েছে?
কপালে কে দিয়েছে ভস্মের টিকা?
মৃত শিশুর কড়ে আঙুল খুঁজতে আসা কাপালিক বলেছে 
-শুয়ে পড়ো।

আমার পেটের ভেতর কোটি কোটি জোনাকি ঢুকে গেছে
মাথার ভেতর কয়েক লক্ষ ঝিঁঝিঁ

কলাপাতার উপর শুয়ে 
আমার শরীরে কারা যেন তেল, হলুদ, চন্দন, ঘি লাগিয়ে দেয়
কারা যেন চাঁদ গুলে ঢেলে দেয় আমার কপালে।

আমিও কি তবে এই চিতার সঙ্গী হবো?
শরীরের প্রয়োজন কি তবে শেষ?
চোখ বুজে শুনি অবোধ্য মন্ত্র, চাপা কান্নার রোল

কেউ তো কাঁদছে না। তবে কান্না শুনি কেন?

চারদিকে কারা যেন ভীষণ নিরব হয়ে আছে
জলে ভেজা বালির উপর তাদের পায়ের ছাপ
আমার ঘিলুর পাত্র সেই এক ছাপে রেখে দেওয়া 
কে রেখেছে?
তাকে আমি চিনি না এখনো।
সে কেবল কড়ে আঙুলের খোঁজে মাটি খোড়ে
মৃত শিশুদের দেহ থেকে স্নেহ ও আঙুল কেটে নেয়

আমার দেহের পাশে সেইসব রাখে
চিতাভস্ম, কাটা আঙুল, মানুষের হাড়, বেশ কিছু জড়িবুটি
সাপের খোলস, বাংলা মদের গ্লাস, কিসের মাংস যেন তার পাশে রাখা

যে সত্য কোনদিন দেখতে চাইনি
যার প্রতি কোন মোহ নেই
কেবল শরীর নিয়ে যে আমি এতদিন কাটিয়ে দিয়েছি
এসবের মাঝে তাকে টেনে এনে কী লাভ পেয়েছে  কে জানে?

যে নারী ভীষণ সুন্দরী বলে একদিন খুব গর্ব ছিল 
যে পুরুষ অর্থ ও যশ দিয়ে তাকে হরণ করেছে বহুদিন
আমার দেহের পাশে তাদের শরীরগুলি পরে আছে
বিভৎস ও তীব্র অর্থহীন

আমাকে এখানে এনে কী লাভ হয়েছে
যাকিছু দেখেছি, দেখি তার 
কণামাত্র মনে রাখিনা।
প্রতি রাতে কেন তবে নিশী-ডাক দাও
কেন নিয়ে আসো এই শ্মশানের কাছে?

আমার চোখের মণি খুলে এই তোমাকে দিয়েছি
দেখে নাও যা কিছু দৃশ্যমান
দেখে নাও যাকিছু দৃষ্টি অগোচর।

চিরঞ্জীব হালদারের কবিতা 


আপনি কি রেগে গেলেন মাদমোয়াজেল।
হীরের নেকলেসের উপর দৃশ্যত আমার উপুড়-চুপুড় অন্তহীন আঁখিপল্লবে বিভ্রমী মৌতাত নেমে আসছে।
লক্ষ্মীমন্ত পায়ের অপরূপ জলছাপ শুকিয়ে যাওয়ার আগে পাথরের বুকে কেমন হাহাকার লেপে দেয় জানা হয়নি।
আপনি চন্দননগরের অসফল উপনিবেশীয়
ক্লোন থেকে উঠে আসা দৈবীমানবী।
রেগে গেলে মুঠো মুঠো লবণ ঢেলে দেন।
কী জানি আমি জেনে গেলাম কিনা পঞ্চপল্লব
ছাতিম নদের সাথে আপনার ভ্রমর কাহিনী।
অনেকেই বলেন ডুপ্লে সাহেবের প্রতি অপার অনুরক্তি দ্রাবিড় জন্মের ভুল কৌশলের  ভেতর
পথ হারিয়ে চন্দননগরের থার্ড লেনের
কোন এক ভাষা শ্রমিকের আঁতুড় ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন।
কোন দিন জিজ্ঞেস করতে পারবো না "কোমো ভু আপ্লে ভু"।
তাজপুরের বামনগাজীর থানে সাত মাটির কলসীতে সর্ষে তেল মানত করেছি। 
আপনাকে আজীবন যেন মাদমোয়াজেল বলে
ডাকতে পারি।
অসুখ
নীপবীথি ভৌমিক
চিত্রঋণ : ইন্টারনেট 

 ‌ সমস্ত অসুখের কাছেই যত ধার দেনা আমাদের।
  অথচ, কখনো কি সে বলেছে তোমায়
    দেনা পরিশোধের জন্য !

    শরীরের আঁচ ভাঁজ গলিপথ দিয়ে বয়ে 
   যায় সে আজন্মকাল,
  হাঁড় মজ্জায় হাত রেখে সুর তোলে নট ভৈরবের মৃদঙ্গে 

    ঋণ আমরা করি না। ঋণ হয়ে যায় আসলে।
    ভুল থেকে ভুলের ঋণে জড়িয়ে ‌জড়িয়েই 
   অসুখ এসে পরিশোধ করে জীবন ঋণের হিসেব।

         ইচ্ছে
         সুজন বিশ্বাস





থাকিতে চাইনা আমি আর ঘরের কোনে,
আমিও দেখতে চাই পৃথিবীটা ঘুরছে কেমনে!

কোন আশায় কোন নেশায় ঘুরছে সে অবিরাম,
সূর্যটাও কোনোদিন নেবে নাকি বিশ্রাম!

আমিও যাবো কখনো নরওয়েতে,
দেখিব কেমনে সূর্য কিরণ দিচ্ছে মাঝরাতে!

কলঙ্কিত চাঁদের কিসের এত অভিমান,
কেনো সে থাকে না সর্বদা বিরাজমান!

আমি দেখিতে চাই কি মায়া আছে এই জগৎ সংসারে,
কেনই  বা মানুষ বাস করে সুখের অন্ধকারে!
বিশ্বজিৎ লায়েকের কবিতা



পুড়ে যাওয়া মেঘের মতো অগ্নি


না, না সত্যি নয় প্রতিনিবৃত্ত নয় কেবল শব্দ নির্দেশে একীভূত গমন
ঘুরতে ঘুরতে ব্রহ্মে আশ্রিত এক দেওয়াল

উঁচু উঁচু বাড়ি মাথা উঁচু দৃষ্ট ফল ঘাড়ে নিয়ে জড় ও অজড় পৃথিবী
উচ্চস্বরে কাঁদছে ব্রহ্ম চতুষ্কল
মৃদুস্বরে বিড়বিড় করতে করতে ওই দেখ
পালিয়ে যাচ্ছে প্রাণ

কিলবিল করছে, 'ক'  ব্রহ্মের পাশে অন্য এক 'খ' ব্রহ্ম
চাপা অন্ধকারে নিঃসাড় হাহাকার, মুখ ডুবিয়ে শ্রুতি
পুড়ে যাওয়া মেঘের মতো অগ্নি

এক মিনিটের নীরবতা পালন করব আমরা
উল্টে পাল্টে বিষাক্ত করব ফুরফুরে মেজাজ

না না সত্যি নয় ভৌতিক নয় বিশেষণ নয়
একদিন বলে গেছি অনবরত উপপাদ্য
অগ্রাহ্য করেছি ইতি ও অমনা

ঘরের ভেতরে রেখেছি ঘর বলয় পথে ঘুরিয়ে দিয়েছি
ইহলোক-পরলোক, তুচ্ছ ব্যবধান


অপদেবতা


ঘর থেকে বাইরে বাইরে থেকে ঘরে ঘ্রাণ থেকে অঘ্রাণে
লেগে ছিল অভিতাপ
গল্পের মুড়ো এখানেই এসে ফাটল
লিঙ্গ শরীরে

মৃত অন্ধকারের মতো অভেদ কাম, গন্ধ ও রস
তোমার ক্লান্ত বেহুশ মাধ্যাকর্ষণে আজ
ব্রহ্মকমল
নাভিমূলে আজ মোহন-মোহিনী রসায়ন

এইসব আঁকা ঝাঁকি শূন্যে রাক্ষসীর ওয়াশিং মেশিন
ষোলকলা মুছে দিল ভ্রমণের আরাম
মুছে দিল চিড়িয়াখানা পার্ক অরণ্য সমুদ্র শহর

লিখতে লিখতে ভিড়ে বাজারে লোকালয়ে ভুল লিখল সব
সিঁড়ি ধরে নেমে গেল কে কোথায়
চ্যানেল পালটে পালটে তোমার রুগ্ন হাত ছুঁয়ে
আচম্বিতে জাগল মৃত অতীত
বিপন্ন ভ্রূণেরা


লঘু-সম্ভাষণ


কিছুটা নিয়েছি অব্যয় লিপি বৃক্ষ ও পাথর কি বুঝছেন প্রভু
আমার এই ইষ্ট জপ প্রীতি-সম্ভাষণ
এই সব লঘু বেঁহুশ

আমি তাহলে সাইকেল নিয়ে চলে যাই অফিসে ও মাঠে
এই শরীর তো আনন্দতার
জীর্ণ মসৃণ, হোম ও দুরাচার

হে ঈশ্বর ও আড়তদার
ব্যক্তিগত হিম নিয়ে একটু নেচে উঠব জন্ম কাঙালের মতো
বাকিটুকু ছড়িয়ে ছিটিয়ে জলের দরে লিখব
ফড়ের ইচ্ছা, বন্ধুদের লম্বা-লম্বা শ্বাস

তারপর সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ওই এক গল্প
আনন্দ, মোচন ও পতন
বাকি সব গল্প মাংস আর মাংসপিন্ডের

ভোর ভোর উঠে তুমি স্নানঘরে খল খল হেসে উঠছ
বেচারা ঈশ্বর ভাবছেন আমার চাওয়াকে কচুকাটা করে
গণ্ডুষে ভরে পান করবেন পাপ ও শর্করা
খেয়াল গাইবেন বসন্তে বসন্তে ডাক দেবেন
একটি একটি করে সব মানুষ নিরাময়ে ফিরবে
ফিরবে বিনির্মাণে


নিত্যকর্ম পদ্ধতি


আলাপচারিতায় আমি পুড়ছি আমার অবৈধ দরজায় এসে
ফিরে গেছে শাঁখা-পলা
আমি ঘাম হয়ে ঝরে গেছি চুঁইয়ে পড়েছি
তাবৎ বৃত্তের কাছে ক্ষয়ে যাওয়া রেখাটুকু নিয়ে
নিয়মিত ঢেলেছি রণকৌশল
ছোট ছোট স্টেশন ছোট ছোট জনজীবন পেরিয়ে
এই খানে এসে বর্শায় গেঁথে গেলাম

নিষিদ্ধ ভোর অনেক রঙ এখন কলোনির মাঠে
আসুন হেঁটে হেঁটে নিখুঁত শহর আর পানশালা দেখি
এখানে অগণিত বেশ্যালয়
হাঁটু মুড়ে বসে আছে অনিচ্ছুক ক্রেতা
আত্মলীন মেট্রোস্টেশন

গভীর কোনও ক্ষত থেকে ফিরছে আমার জিহ্বা
আমার ত্বক আমার নাসিকা আমার প্রদাহ, আমার ঈশ্বর
আমার সুখের দিনে এসেছে যে বধির হাওয়া
বিয়ারের ক্যানে ভরা শুদ্ধ মহাকাশ
অসম্ভবের মতো হেসে উঠল হাসপাতালের কান্নাগুলি
বাতিস্তম্ভের মতো জ্বলে উঠল নিদ্রামগ্ন অতীত



শরীর


দুদিকের অক্ষে গাঁথা ছিল মাছ গাঁথা ছিল তূণ তাতে লেগে ছিল বর্ষার মাটি
তাকে তুমি জানান দিলে খোলা জিভে আত্মহত্যাপ্রবণ
আমন্ত্রণ বৃত্তে আলগা হচ্ছে সুঠাম শরীরে লেপটে থাকা শাসন
পোড়ে জঠরাগ্নি কৃশ-ক্লান্ত সুর
একটু একটু করে মরে যাচ্ছে সরষে খেত

সকরুণ হাসি দৃশ্যটি এই রূপ ছিল না
পাহাড় জঙ্গল কেটে উঠে আসা আদিবাসী মরদের মতো
জ্যোৎস্না লাফাতে লাফাতে এসে নামল তেপান্তরে
সাদা জ্যোৎস্নায় টুপটাপ লেখা হল ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’
নীল জ্যোৎস্নায় লেখা মদ ও নারী
ধান জ্যোৎস্নায় থাকুক বাৎসায়নের দেশলাই কাঠি
খই জ্যোৎস্নায় এত এত চাঁদ গলে গলে নেমে গেল
তলপেটের নীচে

এই সময় বৃষ্টি এল মৃৎপাত্রে
প্রগাঢ় বশ্যতায় এক দু’পশলা বজ্র নামল যোনিপীঠে
তোয়াক্কা বিহীন ছাপার অক্ষরে আদিজন নাচল ধুনুচি নাচ
অন্ধকার পেট সব খেল বুনোফুল, ঘুম, আহার, ভঙ্গিমা
দু’দিকের অক্ষরে গাঁথা রইল আমার নিদ্রা, আমার জাগরণ




দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা 

রহস্য কাহিনী

 
খেলার ভেতর হত্যাকান্ড
কেউ দেখল না 
সারারাত জাগবার পর মর্জিনা
চাঁদের দিকে পিছন ফিরে
কাপড় তোলে
সমস্ত তারা সেই জলের আয়নায়
ভেসে যেতে যেতে ভাবে 
এক দিন তারাও..

কিন্তু পৃথিবী তাদের মর্জি না করে দেয় 


 ২.

রেললাইনকে কিছুতেই বোঝানো যায় না
আত্মহত্যাকারীর কথা
এমন ঝকঝকে পূর্ণিমায় টুকরো টুকরো
দেহভাষা
পড়তে কষ্ট হলেও ভিড় বাড়ছে
অত্যন্ত ক্লিভেজ যেন নজরে পড়ে যায়


৩.

বাজারে ঘাম না কিনেও কেনা হয়ে
গেলে
নিজেকে বরফের দেশে কল্পনা করে নেন শিতলবাবু
তারপর ফ্রিজের ভিতর চালান 
করে দেন তার অনুভব
ফ্ল্যাটের দেয়ালে একটি অরণ্য
ছেলের আঁকা
তারিফ শব্দটি শুনতে শুনতে দেয়ালপ্রিয় হয়ে ওঠেন
তারপর চ্যানেল সার্ফিং করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লে
দুঃস্বপ্নের বউ তার গলা কেটে 
দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে যায়

তার হৃদপিণ্ডের প্রেম আর উষ্ণ থাকে না 




৪.
সবুজ পৃথিবী নিয়ে যে ঝরনা বয়
আর রুপোর নাকছাবি তৈরি হয়
সূর্যের তরুণ আলোয়
উপত্যকার শূন্যতা ভরে যায়
এই যে যুবক শুয়ে আছো খোলামুখ
জিভের ভিতর প্রেমের চিহ্ন নিয়ে
ঘাসের বালিশে
গভীর ঘুমের আদরে বিবর্ণ সবুজে
রোদ গন্ধে বিভোর
তোমার পা দুটিকে বুনো ফুলে পেয়েছে প্রণাম ভঙ্গিমায়
শিশুর মতো অপরাধ ছাড়াই হাসি
কে দেবে উষ্ণতা তোমার শীতল রক্তে
পতঙ্গও দূরে  চলে যায় যেন অপরিচিত কেউ
তার বুকের উপর হাত রেখে সে
ঘুমে নির্বিকার
এতো শান্তি ,তার বুকের পাশের ক্ষতও বুঝতে পারে না তাকে


৫.

বৃষ্টির জলে সব রক্ত ধুয়ে যায় না
হাসিখুশি আর খেলার ভিতরে
রাক্ষসের গল্পে ঢুকে যায় সেই স্রোত
গরম মাংসের জন্য সে তোলপাড় করছিল
বালিকা শরীরে কোনো দুর্গ নেই
এই  যে প্রাচীর  ভাঙা হল অনুমতি ছাড়াই
বাগানকে ফেরত পাওয়া গেল না
পাখির বাসার কান্না
মুক্তো হতে না পারায়
সারা উঠোন জুড়ে কাচ আর কাচ
বিঁধে গেলে যন্ত্রনা সারা জীবন 
কাটাছেঁড়া হয়ে বেরিয়ে আসছে
মর্গের বাইরে
একটা ছোট্ট হাইফেন পলিথিনে মোড়া
সুরতহালের সংবাদ হাওয়ায় 
ক্রমশ ঘুড়ি আর জল


৬.

বাড়িটি বাড়াতে হবে
গাছটি বোঝে
তার সময় হলো যাবার
দুঃখ ক্রমশ ইট কাঠ পাথর
ভাতের ভিতর 
লেবুগন্ধ নেই 
সন্ধ্যার ভিতর নেই সন্ধ্যামণি
আম কাঁঠালেরা চলে গেলে
গ্রীষ্ম অতীতকাল হয়ে পড়ে
বাড়িটি বাড়তে বাড়তে
আকাশ ঢাকলে
হারিয়ে যায় চড়ুই শালিক 
এতো উচ্ছেদের পর 
নিজের শিকড়
সেও বিদেশে চলে গেলে 
শূন্য শব্দটি এই নির্মাণে বসাই
খাঁ খাঁ র ভিতর তবু কিছু ঘুঘু রয়ে গেছে


৭.

বকুল গাছের গান শুনতে
তোমার সকাল সুবাসে
বাসা খুঁজে নেয় 
তুমি পুকুরের ভিতর এক
একটি মুক্তোর পতন দ্যাখো
আকাশের উপর কালো পর্দা
সরে গেলেই সিনেমা শুরু
অন্ধকারের ভিতর তোমার অপেক্ষা
 বেশ উত্তেজনাকর
 ‎আওয়াজ আসছে ওপার থেকে
 ‎কিছু ঝিলিকের সাথে
স্থলপদ্মের পাপড়িগুলো জল
ধরে আছে স্নানের পরে
তার ভিতর তোমাকেই দেখি
গায় ভেজা চুল 
এক এক ফোঁটায় তুমি উজ্জ্বল
জলের গভীরে জল 
কোন রহস্যে খুব হেসে ওঠে


৮.

কালো আলখাল্লা পরে পীর সেজে
রোদকে হুমকি দিলে 
সে বশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে দরগায়
গাছের পাতা যেন চামর
বুলিয়ে যায় মাথায় 
নিরাময়ের পথে উড়ে আসে বাতাস
সমস্ত ষড়যন্ত্রের ভিতর 
মাকবেথের দুর্গে পাখির কলতান
ফুলের সুবাতাস 
নৈরাজ্যের মাঝেও ফড়িংয়ের
অবিরাম ওড়া 
মধু খেয়ে যাওয়া প্রজাপতি
ডানায় লেখে বহুরৈখিক কবিতার ভাব
বৃষ্টির ছোঁয়াচ লাগা সন্ধ্যায় 
ঝিঁঝিঁরা বেজে যায় অবিরাম
তুমি বধূ তবুও
গলায় কাপড় বেঁধে
সিলিং ফ্যানের প্রেমে পড়ে যাও
তোমার অভাবে 
ভিজে বিড়ালটিকে কে তবে ফেরাবে!


৯.

মৃত ঘোড়ার সাথে 
কথা হয় সন্ধ্যার রাস্তায় 
এক ক্ষয়া চাঁদের নীচে
তার কর্কশ হ্রেষায়
 কেঁপে ওঠে 
শহরের নির্জন রাস্তা
ছায়াময় আলো
অন্ধকারের কাটা মাথা
দ্রুত ছুটে যেতে 
না পারায় আতঙ্ক
তার শূন্য চোখ থেকে
ক্রমশ সংক্রমিত
তার থম মারা অবস্থা
থেকে থেকে 
মৃদু পায়ের শব্দ
ধূ ধূ দুঃখ রেখে 
হারিয়ে যায়


১০.

মেয়ে গায়
জল তরঙ্গে নূপুর ভেসে যায়
মাছরাঙা পাখিটির দেশে
দোল খায় চোখ 
আর ক্রমশ রঙ্গিন আকাশের মাঠে
খেলা চলে রোদ ও ছায়ার
মায়াবী অক্ষর গাছে গাছে
সুস্বাদু পথের জানালায় বাহবা তুলি
আরো কিছু এঁকে দিলে 
সাদা কাগজের যেমন খুশি সাজ
বাড়িতে উৎসব গন্ধ
এসব কিছুই দুঃখ ভুলানি উপকথা
ঠাকুমার কণ্ঠটি কেঁপে কেঁপে
ঝুলির ভিতর নামের মালাটি জপে
আর বর্ষার মাঠে বীজতলা
তৈরি হলে কষ্টের ভিতর
ভাতের পুরনো সুবাস ফিরে আসে 
সে ঘরে ফিরে নি কেউ বলতে পারে না


১১.

একটা ভাঙাচোরা বাড়ির নীচে
শূন্য আর স্বপ্ন বুনে
সময় কেটে যায় 
ঘুম বিদায় নেওয়ায় তার জায়গা
নিয়েছে তোমার প্রিয় নাম
এই যে বর্ষার দিনে মেলে
তোমার দীর্ঘ চুলের বাহার
মাঝে মাঝে সেখানে
সেজে ওঠে বর্শা রঙের ক্লিপ
রাত্রির শরীরে
কেঁপে ওঠে 
এক মধুর ঝড় 
ধ্বংসের ভিতর এক কালো নদী
শূন্যতার মাঝখানে গড়ে
তোলে রাত্রির এলো চুলের
অস্পষ্ট স্মৃতি 
মৃত জোছনায়
আছড়ে পড়েছে কান্না
সাগরের গুমরে গুমরে