Monday, August 31, 2020

শৌভিক বণিক

 আলিপুরদুয়ার জেলা কবিতায় শূন্য দশক---


শৌভিক বণিক 



বাংলা কবিতায় মূলত শূন্য দশকেই প্রথম নগর-গ্রাম মিলেমিশে গেলো একসূত্রে। আরও একধাপ এগিয়ে দিল স্যোসাল মিডিয়া। 

স্যোশাল মিডিয়া সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে গেলো শূন্যের কবিরা ফলস্বরূপ তাদের কবিতা প্রকাশের জন্য, আর কোন প্রতিষ্ঠানে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার প্রয়োজনও প্রায় ফুরিয়ে এলো। এবং সেই সময় থেকেই ভাঙতে লাগলো প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। এই স্যোসাল মিডিয়া-র দৌলতেই একে অপরের স্বরের সাথে পরিচয় ঘটতে যেমন সহায়ক হয়ে উঠলো। তেমনি প্রচুর কবিতা পড়ার সুযোগও ঘটলো। অজস্র চিত্রকল্পের কোলাজেরও দেখা মিলে শূন্যের কবিতায়। শূন্যের কবিরা তাদের কবিতায় ঝরঝরে আর স্মার্ট শব্দ প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন, ও তার নিপুণ ব্যবহার ঘটিয়েছেন। ন'য়ের দশকের কবিতা প্রবনতা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে ভাষা ব্যঞ্জনায় বহুমাত্রিকতার এক উন্মেষ ঘটেছে শূন্যের কবিতায়। আবার বিশ্বায়নের প্রভাবও পড়েছে বাংলা কবিতার আঙ্গিনায়। একদিকে সময়ের দাবী আর জটিল সামাজিক আবর্ত শূন্যের কবিদের প্রভাবিত করেছে নিঃসন্দেহে। স্বাভাবিক ভাবেই সেই স্রোত থেকে উত্তরের কবিরাও মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারলো না।  



আলিপুরদুয়ার জেলা কবিতায় শূন্য দশক--- 


চাঁদ-নদী-ফুল-পাখি-আকাশ নিয়ে বাংলা কবিতায় যুগযুগান্তর ধরে বহু অনুসঙ্গ এসেছে...


শূন্য দশক তার ব্যতিক্রম নয় শুধু আঙ্গিক পাল্টে গেছে 


যেমন সুব্রত সাহা কবিতায় দেখি 

,ঘামে ভেজা হাত 

      রাত্তির স্ক্রিনে 

       নামা হাফখানা চাঁদ...,



,খিলান থেকে চাঁদ সরিয়ে নিতেই সফর শুরু,


,চাঁদ সরতে সরতে বামন হয়ে গেলাম, 


,চাঁদ = চন্দ্রিমা, 


,দেখা হলে অপেক্ষায় চাঁদ 

        বুকে মৌ বসে,




আবার বাবলি সূত্রধর সাহা লিখেন


'আলোর দাহ। অপলক চাঁদের ধস্;

 পরিত্যক্ত শব্দ ভাঙে বাতাস,

ঘুমের আবর্তে প্রোথিত

বিষাদের মিথ্।

স্যাটেলাইট স্বপ্নে ছকহীন যাপন।'


শুভংকর পালের কবিতায় 

দুঃখ নদী হয়


'নদী হয়ে ওঠার আগে বিরামহীন সেই শোকাশ্রু বয়ে যায়

আর রাতের শহরে জেগে ওঠা স্বপ্নের ভিতর 


উচু উচু প্রাসাদগুলো ছাপিয়ে যায় সেই কান্নারা,


আবার কখনো তার কবিতায় বলছেন স্পর্শের ভিতর নদী হয়ে ওঠার আহ্বান দেখি।


তার সম্পর্ক শিরোনাম কবিতায় লিখেছেন... 


'স্পার্ম টেস্ট টিউবে নোতুন নাবিকের

বাইতে বাইতে ইহকাল 

জামার ভিতর আমি 

কাঁহাতক কুরবান

জন্মের ভিতর আলো ভাঙ্গচুর 

বিসমিল্লার সানাই উঠে গেছে সম্পর্কে 

দস্তানা খুলে দিচ্ছে লেপের দুপুর 

দুঃখের নিচে ভাত ঘুম 

এখানেই আঁচল পেতে দেয় মায়ের আদর।' 


বাবলি সাহা, শুভংকর পাল, সুব্রত সাহা ছাড়াও আলিপুরদুয়ারে শূন্যের আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবি 

মোনালিসা রেহমান, রামকৃষ্ণ পাল,

সোমা সাহা পোদ্দার, অম্বরীশ ঘোষ প্রমুখ...


নতুন দশক এসে তার পূর্ববর্তী দশককে  অতিক্রম করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। প্রথম দশক আবার ধ্রুপদী লেখার দিকেই বেশী বেশী জোর দিয়েছে...

অরিজিৎ চক্রবর্তী

 চিত্রশিল্পী : অরিজিৎ চক্রবর্তী 

হাজরাপাড়া , রবীন্দ্রপল্লী ,কোচবিহার 

নৃত্য  শিল্পী ও প্রশিক্ষক 






দিতুন সাহা

 চিত্রশিল্পী :দিতুন সাহা 

নিউটাউন ,কোচবিহার 

সিভিল ইঞ্জিনিয়ার 






 

চিত্রকলা
..............

কোচবিহারের চিত্রকর পাড়ায় থাকেন চিত্র শিল্পী রিন্টু কার্য্যী। নতুন ভাবনার রং তুলিতে সাজিয়ে তোলেন নিজের শিল্প কর্মকে। তাঁর ছবির নান্দনিকতা ছঁয়ে যায় আমাদের। কবিতা করিডোরের পক্ষ থেকে শিল্পীকে অনেক অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই।
..........................................….…....................................
শিল্পীর চোখে
রিন্টু কার্য্যী








সাধারণ ছবি হল চোখ দিয়ে দেখা, শিল্পের ছবি হল মন দিয়ে দেখা। ছবি মানুষের মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যম।

মন দিয়ে দেখা ছবি - একটি ছবি তখনই শিল্পস্তরে স্থান পায় যখন সেই মনের বা ঘটনার অন্তর্নিহিত অর্থ তার চিন্তাভাবনা ছবির ভাষায় প্রকাশ পায়। ছবির আলাদা করে কোন গল্প হয়না। বাস্তব জীবনে সমসাময়িক ঘটনাগুলো মনে দাগ কাটে সেটাই আমার ছবিতে প্রকাশ পায়।

মনের অজান্তেই  ছবি আঁকা শুরু ও ভালোলাগা। কষ্ট পাওয়ার অভিজ্ঞতাগুলোকে রূপ দিতে থাকি নিজের শিল্পকর্মে। পরিস্থির চাপে উপযুক্ত শিল্প শিক্ষা ও গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্য না পাওয়ায় নিজের চেষ্টায় শিল্প ও শিল্পীদের শিল্পকর্মের রস আস্বাদন ও নিজের প্রতিনিয়ত শিল্প অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন শিল্প সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করে থাকি। বিগত শিল্প জীবনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে আমার শিল্পকর্মগুলি উজ্জ্বল রং ও রেখাভিত্তিক হয়ে থাকে।


সুবীর সরকার

 

‘সময়ের উল্টোস্রোতে সাঁতার শিখিনি’
সুবীর সরকার


 
‘কুমোরটুলির দেবদেবীর মুখের ছাঁচে মৃতমুখ
এ মুখে ঘাম নেই
ব্রণ নেই
ভাঁজ নেই
আগ্নেয়গিরির উড়ন্ত ছাই ভাসিয়েছে মানবতাকে’
মাননীয় পাঠক,এই কবিতাটি লিখেছেন তরুণ কবি নীলাদ্রি দেব।পুরো কবিতাটির শরীর জুড়ে দানা দানা সময়ের ভাষ্য ছড়িয়ে আছে।সেই ভাষ্যের ভেতর সময়াতীতের এক অনন্ত নিয়ে ঢুকেই পড়তে হয় পাঠককে।
নীলাদ্রি দেবের প্রথম কবিতার বই-‘ধুলো ঝাড়ছি LIVE’ ২০১৬ তে প্রকাশিত হয়।এই কবিতাটি সেই বইয়ের প্রথম কবিতা।২০২০ তে নুতন করে আবার ‘আলোপৃথিবী’ প্রকাশনা থেকে সেই বইটি আবারও পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
শুরুর কবিতাটি পাঠ করেই আমরা বুঝে ফেলি সেই ২০১৬ তেই নীলাদ্রি দেব বুঝিয়ে দিয়েছিল,সে বাংলা কবিতা লিখতেই;বাংলা কবিতাতে থাকতেই এসেছে।
আজ নীলাদ্রির পাঠকেরা সেটা নিশ্চিতই বুঝে গেছেন।
১২ টি কবিতায় সাজানো এই বইটির প্রতীকি ও নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন শ্রীহরি দত্ত।
১২ টি কবিতা থেকে ১২ টি মহাসড়ক বেরিয়ে আসে আর পৌঁছতে থাকে জন্ম ও মরণের দিকে।অনন্ত জিজ্ঞাসা আর যাপনের তাড়না কবিকে ধাওয়া করতে থাকে।কবি তার সামগ্রিকতাকে প্রশ্নে প্রশ্নে বিক্ষত করতে থাকেন।কি এক অস্থিরতা তাকে বুঝি ঘোরের ভেতর ডুবিয়ে মারে।
নষ্টালজিক যুক্তিফাটল দিয়ে নীলাদ্রি পাথর ঠুকতে ঠুকতে আদিম হয়ে ওঠেন।আর লিখে ফেলেন_
‘হাজার বছরের কান্নায় নদী
সে নদীর তীরে,শ্মশানে
        আমার অস্তিত্বের ছাই
কপালে লেপে রাখি
জলে ছায়া ফেলে দেখি
          অ-পূর্বপুরুষ’
কেমন হিম হয়ে উঠি।শিউরে উঠি।
এক নুতন ভাষায় কবি কথা বলছেন।এক চিরায়ত বোধের ধরাছোঁয়ার খেলা।
কবি লিখছেন_
‘এ হৃদয় এখন পরিযায়ী’
অথচ_
‘সময় বাঁচাতে পারেনি
বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর
   খুঁজে পায়নি আমাকে জীবিত
এখন লাশ
লাশের ভবিষ্যত টানে পরিবার
যদিও পরিবারও একদিন লাশ
 
সময়ের উল্টোস্রোতে সাঁতার শিখিনি’
প্রথম প্রকাশের সময় নীলাদ্রির বয়স ছিল ১৯ বা ২০।আমি বিষ্মিত হই,কি প্রখর সেই বয়সেই নীলাদ্রির দেখা,অনুভূতি আর গূঢ বাস্তবতা মোড়ানো প্যাশনেট।যাপনকথাকে সংহত করে এনে কথাটুকরোর যাদুতে মুড়ে সে বলে ওঠে_
‘প্রেম তলিয়ে যাচ্ছে ডাস্টবিনে
ডিপ ফ্রিজে শক্ত হচ্ছে স্বপ্ন
কর্মব্যস্ত দিনে আধঘন্টা সময় খাচ্ছে
             ধর্ষণ সংবাদ’
বাস্তবকে তুলে আনা।উপস্থাপিত করা।এও তো কবির দায়।অবশ্য একজন কবির কি আদৌ কোন দায় থাকে!
কবি তো অভিশপ্ত।নির্বাসিত অতিথি মাত্র।কাদা হয়ে শুয়ে থাকতে হয় কবিকে ড্রেনের ধারে।
যেমন নীলাদ্রি!তিনি অকপটে লিখলেন_
 
‘মৃত্যু পরোয়ানা চাই
ট্যাগ লাগাচ্ছি দেহে’
যে সময়ে তার জীবনযাপন,যে দেশকালের ভুবনে তাকে বেঁচে থাকতে হয়,যে সমস্ত সাদা ও কালোর মধ্যে তাকে পেরোতে হয় প্রতিদিন;সেই অতিক্রমণের পরতে পরতে সংশয়,ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা কবিকে অস্থির করে তোলে,তিনি বিপন্ন হন আর ঘুম কিংবা ঘুমহীনতায় লিখে ফেলতে থাকেন,ঘন হয়ে ওঠা তীব্র এক ডিলিরিয়ামের ভেতর_
১।
‘এটিএম মেশিনের ভেতর আমাদের গ্রে ম্যাটার
সৎকারের জন্য লাইন দিয়েছে দালাল’
২।
‘অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে
    যাবতীয় অস্তিত্ব সংকট
কোনওরকম রঞ্জক দাগ কাটে না আর
তবুও শুধুই উদযাপন’?
৩।
‘রাত হয়ে এল
পরজন্মে জোনাকি হব’
তার শব্দব্যবহার,তার বুননের ম্যাজিক,তার অদ্ভূত মায়াবিন্যাস আর সঠিকভাবে থেমে যাওয়া নীলাদ্রিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।সে তার চলবার রাস্তাটা তার হাঁটবার পথটা ঠিক খুঁজে নিচ্ছেন।
সুররিয়াল কবির মতন কখনো সে লিখছে_
‘দেহ
মন
দুটোই আমার
ব্যবহার করার ধরণ একান্ত ব্যক্তিগত
#
কে তুমি,নীতিনির্দেশদাতা’?
বহুরৈখিক যাপনের আলোআন্ধারে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কবি নীলাদ্রি এক নুতনের দিকে,ভাষাপুল ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছেন;তার শরীরে পাখির পালক আর জীবন্ত হয়ে থাকা এক নদীর আখ্যান,যা আদতে উপাখ্যানের মতন।
 
ধুলো ঝাড়ছি LIVE
নীলাদ্রি দেব
প্রকাশকঃআলোপৃথিবী
প্রকাশকালঃমার্চ-২০২০

প্রচ্ছদঃশ্রীহরি দত্ত
মূল্যঃ৩০ টাকা













বিরানভূমি,দাবার বোর্ড ও নেক্রপলিস

সুবীর সরকার

 

 

'আজকাল আমাদের গল্প দীর্ঘশ্বাস হয়ে 

ভেসে বেড়ায় নেক্রপলিসে 

 

হেরে গেছি বারবার বিশ্বাস করে 

 

ইদানিং সমস্ত দৃশ্য দাঁতমুখ চেপে 

ভালো আছি, দেখাতে পারি ম্যাজিক 

 

আদতে আমরা জিভহীন জনতা'

#

উপরের কবিতাটি লিখেছেন কবি পাপড়ি গুহ নিয়োগী।জন্ম ও যাপন উত্তরাঞ্চল।লিখে চলেছেন বাংলা ভাষায়।নিজস্ব স্বর আয়ত্ত তার।তার হাঁটবার রাস্তায় কান্না ও বিষাদের স্বরলিপি।বাংলা কবিতায় পাপড়ির নিজস্ব পাঠক রয়েছে।পরিচিত নাম সে।নিরন্তর নিরীক্ষায় আর কাটাকুটির ভেতর দিয়েই এই কবির জার্নি।একটা তীব্র ঘোর তাড়া করে বেড়ায় পাপড়ি কে।সে ঘোর জড়ানো টানেল দিয়ে তীক্ষ্ণ এক একাকীত্ব নিয়েই হেঁটে যায়,হেঁটে যেতে থাকে রৌদ্র কিংবা কুয়াশায়।নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে কবি পাপড়ি গুহ নিয়োগী তার জার্নিকে চিরনতুন করে তুলতে থাকেন।শব্দ সচেতন,সময় সচেতন,দেশকাল সচেতন পাপড়ি এক দাবদাহের আর্তি বিছিয়ে দেন পাঠকের চলাচলের পরিসরে।সম্প্রতি সংগ্রহ করি পাপড়ির সদ্য প্রকাশিত এই বইটি।তারপর পাপড়ির অটোগ্রাফ নেই।ছবিও তোলা হয়।ছিলেন তরুণ কবি নীলাদ্রী দেবও।এই বইটি পাপড়ির অন্য বইগুলি থেকে অনেকটাই সরে এসেছে।পলিস বা নগররাষ্ট্রের কালো আগ্রাসনের খাবার নিচে নাগরিকের নিপীড়িত এক  অস্তিত্বসংকট পাপড়িকে উচ্চকিত করে তোলে।আসলে সাম্প্রতিক অস্থিরতা আর মানুষের বিপন্নতায় ভারি হয়ে ওঠা চারপাশ কবিকে ব্যাকুল ও আর্ত করে তুলেছে।পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া এক সময়পর্ব উঠে এসেছে এই 'নেক্রপলিস'-নামক কবিতার বইটিতে।অদ্বয় চৌধুরীর নান্দনিক ও সাংকেতিক প্রচ্ছদের ওপর অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন পাঠক।

নিজের ভেতরের দহ ও দাহ লিখতে লিখতে এক না ফুরোন গল্প শোনান কবি_

‘অন্ধকারে কুকুরের ডাক রপ্ত করে ফেলেছি

আপনি ভাঙা ঘরেও ভিক্ষে চাইছেন’

বাঘিনি পরি,বনসাই,ইঁদুরের গলি,সম্পর্কের জ্যামিতি,লুটেরার হাঁ-মুখ,গরম ভাতের জন্য হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ,ইচ্ছের মৃতদেহ,টাইটানিকের মতো ডুবে যাওয়া,রক্তমুখো মেশিনগানের শব্দ,আর সব নৈরাজ্য পেরিয়ে যেতে যেতে পাপড়ি দেখেন-

‘সম্পর্কের গর্তে চিতা জ্বলছে দেশে’

আর পাপড়ি নিজেকেই ছুঁড়ে দেন এক অমোঘ প্রশ্ন-

‘পাখিদের কি এনআরসি হয়

#

ইতিহাসে প্রমাণিত

জনসংখ্যা চিৎকার করে কাঁদতে পারে না’

আর তাই,নিজের অসহায়তা নিয়েই একজন কবিকে তার যাপনবিন্দুগুলি খুঁড়ে খুঁড়ে এক চূড়ান্ত আশ্রয়হীনতার দিকেই হয়তো চলে যেতে হয়!

কবি তার স্থির ও মগ্ন চোখে উদাসীন হয়ে পড়েন আর বিড়বিড় করে ব্লে ওঠেন-

‘জেনে গেছি

মাথা নীচু করে শাসকের সামনে দাঁড়াতে হয়’

৫১ টি কবিতা দিয়ে নির্মিত এই বইএর চমৎকার এক কথামুখ লিখেছেন স্বপন রঞ্জন হালদার।

 

পাপড়ি, মুগ্ধতা জানালাম আপনার কবিতার প্রতি।


 

নেক্রপলিসঃপাপড়ি গুহ নিয়োগী

প্রকাশকঃবৈভাষিক

মূল্যঃ১২০ টাকা











দেশকালসময়ের অদ্ভুত এক ভাসানযাত্রা
সুবীর সরকার

উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা কবিতায় এক প্রখর তারুণ্যের নাম। উত্তরাঞ্চলের কোচবিহারে বসেই সে কাজ করে চলেছে বাংলা কবিতা নিয়েই।অর্জন করেছে নিজস্ব স্বর। নিজস্ব উচ্চারণ।সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নাম ধরে ডাকা বারণ’। তার প্রথম কবিতার বই ‘মৃত্যুর পর যে ঘোড়ায় চড়ে তুমি দেশ পেরোবে(২০১৬)’-টিতেই উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায় তার মেজাজ ও জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। নূতন করে আবার পাঠ করলাম চড়ে তুমি দেশ পেরোবে’। খুব সচেতন পাঠকের জন্যই তার কবিতা। অত্যন্ত সময় ও সমাজসচেতন এই কবি চারপাশের সবকিছু, সমস্ত অন্ধকার ও আলোর দিকে সজাগ নজর রেখে চলেন। মানুষের বিষাদ ও বিপন্নতাগুলিকে তীব্রভাবে ছুঁয়ে যান তিনি। তার কবিতা আমাদেরকে ভাবায়।গভীর এক প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়। কবি বলেন_
‘আমি চিৎকার করছিলাম শান্ত ধ্বংসস্তূপের কাছে
যে আমাকে আরো গভীরে শুইয়ে দিতে চেয়েছিল’।
কি ঝরঝরে অমোঘ উচ্চারণ! প্রখর মেধার বিচ্ছুরণ তার কবিতায়। মজা, ম্যাজিক ও হিউমার দিয়ে দেশকালসময়ের অন্তর্দেশ চিনিয়ে দিতে থাকেন উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘তার স্বচ্ছ চোখের ভেতর উপচে পড়ছে দুস্তর মরুভূমি। সে
একবার আকাশের দিকে তাকালো এবং মাটির দিকে। গোটা
বিশ্ব যখন জ্বলন্ত খ্যাদ্যের উদাহরণ, সে ঠুকরে ঠুকরে
প্রথমে খেতে শুরু করলো নিজের পরিবার’।
জায়মান এক সুর খেলে বেড়াতে থাকে তার কবিতায়।কত কত দেখা তার। দেখা সমূহ থেকেই নূতন এক জার্নি শুরু করেন কবি। আর আমাদের শোনাতে থাকেন—
‘তোমার স্বপ্ন ঘিরে সারি সারি সাজানো চিতা।
তবুও তুমি ভরসা রাখ তোমার দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর’।
এই শক্তিশালী কবি বাংলা কবিতাকে তীব্র করে তুলতে তুলতে এক প্রবল বাঁকের দিকে নিয়ে যায়।কবিতার পরতে পরতে তীব্র টান ও টানাপোড়েন গুঁজে দিতে দিতে বাংলা কবিতাকে আবহসঙ্গীতের ভেতর ছেড়ে দিচ্ছেন কবি। আর বলছেন_
‘তুমি যখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠো
আমি বন্ধুত্বের হাত খুঁজি
#
আর সবাই ভয়ংকর ডাকাত হয়ে গেলে
আমার অন্ধকার লোভ হয়’।
মারী ও মড়কের এই দেশ, এই বিশ্ব, প্রতিপল যেখানে ধর্ষিত হয় মানুষ আর মানবতা। পুঁজির দাপটে বিপন্ন হয়ে পড়েন ভূমিলগ্ন জনমানুষ। সেই প্রতারিত ও বিপন্ন মানুষের কথা, তাদের যাপন, তাদের ভাঙা জীবন আর তুমুল স্বপ্ন দেখবার চিরকালীন আকাঙ্খা উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কবিতায় উঠে আসে আন্তরিকভাবেই—
‘এই জায়গাটা আমি চিনি। এই দেশটার নাম
বাবা বলে গেছেন। বাবা বলে গেছেন, এই দেশটা
আমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, এবং এখানকার
মানুষজন’...
১২ টি কবিতা দিয়ে জমিয়ে তোলা এই বইটির সবচেয়ে বড় দিক হলো উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায় তার কবিতায় প্রতিবাদের এক দীর্ঘ সংগীত শুনিয়ে গেছেন, কিন্তু কোন কবিতাই কিন্তু স্লোগান হয়ে যায়নি। তার শব্দের ভেতর সুর ও সুরেলা প্রপাতের ধ্বনি তুমুল আচ্ছন্ন করে তোলে। উদয়ার্ণব লেখেন—
‘এখন গোটা দেশ জুড়ে তুমুল হইচই
আর আমার শহর জুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর
নারকীয় খেলা
আমাদের ঘুম
আমাদের স্বপ্ন
আমাদের লড়াই
শুধুমাত্র একটি পরিচয় বহন করে চলেছে
আমরা ভারতীয় নই
এদেশ আমাদের কখনো হতে পারে না’...
এই সততা, এই সাহস আর মানুষের বিপন্নতাকে ছুঁইয়ে যাবার তাগিদ—এটাই তো একজন কবির বর্ম ও ধর্ম হওয়া উচিত। প্রতীকি প্রচ্ছদ এই বইটির অনবদ্যতা বাড়িয়েছে। কুর্নিশ, কবি উদয়ার্ণব; আপনাকে...

আলোচিত কাব্য: মৃত্যুর পর যে ঘোড়ায় চড়ে তুমি দেশ পেরোবে



কবি: উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: কবিস্টেশন, মালদা
প্রচ্ছদ: বাবাই ২
মূল্য: ২৫ টাকা
যোগাযোগ: ৯৮০০৮৭৭০৯৬/৭৯০৮৭৮৯৭৭


 



সেতু বন্ধন সুব্রত সাহা

বিধিসন্মত সতর্কীকরণ - লেখাটির মতামতের দায় শুধুমাত্র এই অধমের। বই এর আলোচনার একটা নতুন রূপ বা বলতে পারেন নতুনের নতুনায়নের প্রচেষ্টা... পাঠক সহায় হবেন আশা করি। ভালো যা কিছু তা সবার জন্য তোলা রইলো। ভালো না লাগাটুকুর দায় শুধুমাত্র আমার জন্যই তোলা থাকুক। বিষন্ন বিবশ সময়ে সব্বাই  ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সাবধানে থাকুন। ভালোবাসায় থাকুন। এবং অবশ্যই  ভালো ভাষায় থাকুন।

শূণ্য কিন্তু শূন্য নয়। শূণ্য ও প্রথম দশকের তিন লেখক ও কবির যাপনকে তাদের কাব্য গ্রন্থ ও গল্প গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় সেতু বন্ধন। আলোচনায় - "সরীসৃপ সঙ্গ", "কাচ পোকাদের প্রেম", "যারা যাপনে নেই"।

টিং টং টিং টং! - ও তোরা চলে এসেছিস? আয় আয়। মামুকে ডাক তো দিদি। - ঋষি ওই ঋষি মামু ডাকছে তোকে। তোরা কিন্তু এক্কেবারে ঠিক সময় এসেছিস। সময় এর মূল্য দেওয়া উচিৎ। ঠিক কিনা অম্বরীশ? - ঠিক ঠিক একদম ঠিক বলেছো। কিগো মামু কেমন আছো? এই নাও তোমার চকোলেট। - থ্যাংকু মামু। কেমন আছো তুমি? দিদা আর দাদু কেমন আছে? আর পুচকু ভাইটা? আরে আড়াই বছর হয়ে গেছে। বড় হয়ে গেল তো আমার মামাইটা। তা মামু তোমার পড়াশুনো কেমন চলছে? - ভালো। মামু তুমি মাকে বলে দাওতো আজকে কিন্তু আমি তোমাদের সাথে আড্ডা দেব। বাহ্, বেশ তো। তা তুমি কি কবিতা লেখ? - না পড়ি তো। মার লেখা তোমার লেখাও পড়েছি আমি। এক কাজ করি আমরা কবিতা নিয়ে আড্ডা দেব। আর তুমি ছবি আঁকবে। কি ঠিক আছে তো? - মামু দারুন আইডিয়া। তা ঠিক। পড়াশুনোটাও মন দিয়ে করবে আড্ডার পর। - অম্বরীশ বোস তোমরা। তা চা না কফি? সুব্রত কি বলে? কোনটা? - এখন কফি হোক। পরে না হয় চা হবে। বাহ্, ভালো বলেছো। - আরিব্বাস মাশরুম পকোড়া। দিদি জমে যাবে আড্ডা। আরে ওই তো দীপান্বিতাও এসে পড়েছে। আয় আয় দীপু। - যাহ্, আমার জন্য আছে তো? আছে দীপু তোমার জন্যও আছে। - চলো তবে আড্ডা শুরু করা যাক্।

 অম্বরীশ, তোমার সহেলীপনা


মাদকতা দিচ্ছে। দাদা ভাই সহেলীপনাটা কিন্তু ঠিক মাথায় ঢুকলোনা। - আরে দীপু আমি লেখার সাথে সহেলীপনার... আত্মীয়তার কথা বলছি। বুঝলে এবার। হুম, বুঝেছি। অম্বরীশ আমাদের সব্বার প্রিয় আলিপুরদুয়ার কবির শহরের অন্যতম গর্ব। - একদম ঠিক বলেছো দিদি। ও কিন্তু শুধু কবি নয় "এক পশলা বৃষ্টি" পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি এক হাজারেরও বেশী অনুষ্ঠান সন্চালনাও করেছে। আর ভীষণ ভালো সংগঠকও বটে। ভাই একদম ঠিক বলেছিস। অম্বরীশ আমাদের গর্ব। - আরে হয়েছেতো। এত কিছু হজম হবেনা কিন্তু। দাদা, তোমায় দেখে অনেক কিছু শেখার আছে। আচ্ছা, তোমার কয়েকটা গল্প শুনবো আজ। - একদম। আচ্ছা আমার দ্বিতীয় বই "সরীসৃপ সঙ্গ" থেকে কয়েকটা লেখা পড়ছি। প্রথম গল্প লাঠি, ভালো ছেলে, গলদা চিংড়ি, সোয়েটার এই কটা আপাতত পড়ছি। পড়ো পড়ো বন্ধু। তোমার পড়ার মধ্যে একটা আমেজ আছে গো। পড়ো পড়ো। - অম্বরীশ পড়া শুরু করে। একটা কথা বলতেই হয়, ১৩টি লাইনের গল্প লাঠিতে চমৎকারভাবে গ্রামজীবনের চালচিত্র উঠে এসেছে। জটেশ্বর দাসের একটা ফ্রেমে বাঁধা নিপাট ছবি পেলাম আমরা। - যতই শুনছি উথলে উঠছি। ভাষার বাঁধুনি চমৎকার। তোমার ভালো ছেলে শুনে দ্যাখো কেমন আমাদের চোখ ছলছল করে উঠেছে। - সত্যিই ভালো ছেলের সংজ্ঞা বদলে গেছে। পেছনের সারির ছেলেরাই এগিয়ে আসছে। ভালো ছেলে আর ভালো কাজের কথা অম্বরীশের কলম তুলে এনেছে। - গলদা চিংড়ি গল্পে ধরা পড়েছে সমাপন বাবুর পরিবার, মেয়ে, মিত্র বাবু, স্ত্রীর কথা ধরা পড়েছে। বাস্তব। দেখতে পাচ্ছি। ঠিক বলেছিস ভাই,  সোয়েটার গল্প জুড়ে শীতাতুরতা লেগে আছে। নস্টালজিক তেমনি পাশাপাশি দহনেরও। আবার বদল এ দুই বিপরীত চিত্রের ছবি পাই।

আচ্ছা এবার বাবলি দির কবিতা শুনবো। তোমার "কাচ পোকাদের প্রেম" থেকে কিছু কবিতা পড়ো। আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি। কি বলো? - একদম। একদম। কবিতা পড়ছি। নাম কাচ পোকাদের প্রেম। "গাঢ় সন্ধ্যার কাচ পোকারা/ গোপন প্রেম হয়ে/ আমার শরীরে বৃষ্টি নামায়।" আরেকটা পড়ছি, "ভগ্নাংশ" - "গভীর দহ জুড়ে তখন/ শারীরিক সংলাপের বসবাস;/ আর ভেঙে ফেলার বৃত্তের সমীকরণ"... সত্যি কবিতা আমাদের মনে বৃষ্টি নামায়। ভেজায়। আপন করে। - একটা ভালোলাগা কবিতা পড়ি। " নাভি পদ্ম"... "জীবনের বারমাস্যাতে উঁকি দেয় ভারাক্রান্ত উপোসী অতীত,/ নির্জলা রাত গুটিপায়ে চলা/ সরীসৃপের মতো!/ একাদশীর চাঁদ দেখে/ রঙীন স্বপ্নে ভাসে ষোড়শী মেয়ে,/ সময়ের গর্ভে টলমল করে/ নিভন্ত আলোর বদবুদ!/ জীবনের বারমাস্যাতে বয়ে যায়/ একমুঠো ছাই।" - বাবলি দি অবশ্যম্ভাবী কথাকে জীবনের ছবি তুলে ধরলে তুমি। আহা! এবার আমি একটা দিদির কবিতা পড়ে আমার ভাবনা শেয়ার করার চেষ্টা করছি। "স্বরহীন প্রতিচ্ছবি" তে তুমি স্বরহীন হয়ে কাটাতে চাও জীবন। কোনও নির্বাক কষ্ট তোমায় ছুঁতে পারেনা। হাওয়ার সাথে ডুবে গিয়ে তুমি চলে যাও অনন্ত শয্যায়... তোমার স্বরে জীবনের নির্মেদ দৃশ্যপট ধরা পড়েছে। এবার দীপান্বিতার কবিতা শোনা যাক্। - ঠিক আছে কবিতা পড়ছি। আমার বই "যারা যাপনে নেই " তে "বাবা"কে নিয়ে লেখা আছে। ওটা পড়ি। " সব মেয়েরাই মায়ের কাজল চোখ,/ আমি হবো তোমার মত ছায়া/ সামলে লক্ষী পূজার ঘট/ আমি তোমার হোম যজ্ঞ 'বাবা'।" - দীপান্বিতা উঠোন হতে চায়। বাবার মত হতে চায়। লক্ষী সোনা মেয়ে হয়ে থাকতে চূয়। বাবা তো আসলে বট বৃক্ষ। আমরা সন্তানেরা তো বাবার আঙুল ধরে হেঁটে যাই। আবার দেখ, প্রিয় শীতে কবিতায় মিঠে রোদ মরশুমি মাতোয়াল হয়। গীত রাগেরা বন্দিশে জাগে অজানার খেয়ালে। কুয়াশার দেয়ালে ছুঁয়ে থাকে সব। "মিঠে মিঠে ওম নিতে, পার্বনী পৈাষ পিঠে" রা যেমন এসেছে। তেমনি এসেছে পিকনিকের কথাও। ভালো লাগলো। - দীপুকে একটা কথা বলার ছিল। বলবো? দাদা ভাই বলো। - রাগ করবেনাতো? না না করবেনা। তুমি তো আমার ভালোর জন্যই বলছো। - ছেদ, যতি চিহ্নের ব্যাবহারে একটু মনোযোগী হও তুমি। আর বর্তমান দশকের লেখা কিন্তু পাল্টাচ্ছে। দশককে ধরতে হবে। যুগকে ধরতে হবে। ওরা কথা বলবে কবিতায়। নতুনের ডাক শুনতে হবে। ছন্দ মিলের কবিতা সবাই লিখতে পারেনা। এটা একটা মস্ত বড় গুণ। এটা আমার কেন অনেকরই নেই। কিছুটা ছন্দ মিল ছেড়ে লেখার চেষ্টা করো। তোমার লেখায় এনেকটা বিস্তৃতির জায়গা আছে। সে জায়গাটা ধরতে হবে। - দীপা, সুব্রত কিন্তু ঠিক বলেছে। আমিও কথাটা অনুভব করি।

যাক্, আমাদের আড্ডা কিন্তু জমে গেছে কি বলো সবাই? - এধরণের আড্ডা খুব দরকার। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে লেখায় গতি আসে বলেই  আমার মনে হয়। আমি কিন্তু একমত সুব্রতর সাথে। - একটা কথা না বললেই নয়, অম্বরীশ ঘোষ আমাদের কাছে এক প্রীত নাম। গল্প লেখকদের কমতিটা কিন্তু অম্বরীশ পূরণ করবে বলেই  আমার বিশ্বাস। ওর "সরীসৃপ সঙ্গ" এক মলাটে ৫৫ টি গল্পকে ধরে তার পথ দেখাচ্ছে। আর হ্যাঁ,  শূণ্য  ও পরবর্তী দশকে লিখতে এসে আমাদের বন্ধু কবি ও সম্পাদক শুভঙ্কর পাল ও কিছু কিছু গদ্যে ও গল্পে অভাব পূরণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। - অম্বরীশের গল্প শুনি আবার। অনেক ধন্যবাদ সুব্রত ও বাবলি দি, দীপান্বিতা। পড়ছি তাহলে। - "এ্যাই খুশবু, তোর লোক এসেছে"- প্রতিদান গল্পে ভালোবেসেফেলা মেয়ের নিষিদ্ধপল্লীতে বিক্রি হয়ে যাওয়াটা সময়কে তুলে ধরছে। এটা ফ্যাক্টর  হিসেবে কাজ করছে। আবার, " উচ্চতা"য় বন্ধুর বার্গারের দাম মেটানোর মধ্যে দিয়ে সোকলড শ্রেণীর হেয় করার মানসিকতার যোগ্য জবাব খোঁচা খোঁচা দাড়ির বিমলের সরকারী আধিকারীক হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে অম্বরীশের কলম তুলে ধরেছে। - "ভাত" গল্পে বর্তমান সময়ের ফেলে আসা দিনের চিত্রপট অকপটভাবে তুলে এনেছো তুমি। সখ্যতা'য় গাছ ও আনোয়ার এক হয়ে গেছে। ভাবায় আমাদের। গাছ কাটার সাথে সাথে পাগল আনোয়ারের মৃত্যু আমাদের মানসিক বোধকে নাড়িয়ে দেয়। - অম্বরীশ দা তোমার জিন্স গল্পটা তো বোধোদয়ের আরেক ছবি। তেমনই, ইলেকট্রিক বাল্ব গল্পে জ্বলে ওঠে মহাদেব বর্মনের ঘরের দৃশ্যায়ন। অস্বস্তিতে বাল্ব নিভিয়ে লন্ঠন জ্বালিয়ে দেয় মহাদেবের বউ। আলো'র কষ্টা ফুটে তুলেছে তুমি। আর আর আর, "দেনা পাওনা" বিশ্বাস কর অম্বরীশ, পড়ছি আর কেঁদেছি। কেঁদেছি আর পড়েছি। এত অল্প পরিসরে এতটা সার্থকভাবে তুলে ধরা তোমার পক্ষেই সম্ভব অম্বরীশ। হ্যাটস অফ জানাই তোমায়। - সত্যিই অসাধারণ। নিপুণভাবে কথকতা আর ছবিগুলোকে অসাধারণভাবে ফুটওয়ে তুলেছো। শূণ্য দশকের কবিদের গদ্যে ফেরাটা কেবল সময়ের অপেক্ষা  এটুকু বলতে পারি।

এইযে গরম গরম বাটার টোস্ট, ওমলেট আর চা চলে এসেছে। - আরে মামু, কে বানালো তুই? ভেরী গুড। খিদে পেয়ে গেছে রে। নাগো মামু, শুধু চা টা আমি বানিয়েছি। টোস্ট আর ওমলেট বাবা বানিয়েছে। আসলে আমারও খুব খিদে পেয়েছিল তাই বাবাকে বললাম। আর বাবা বানিয়ে বললো নিয়ে আসতে। - হুম, দুই পেটুক একসাথে জুটেছে। যেমন মামু তেমনি তার ভাগ্নে। আরে আগে খেয়ে তো নিই। তারপর কথা হবে। আপাতত ব্রেক নেওয়া যাক্ একটু। কি বলো সবাই? - ব্রেক হোক। টোস্টগুলো খুব মুচমুচে হয়েছে। আর ওমলেটটাও টেস্টি। আর চা টা অসাধারণ হয়েছে। - কে বানিয়েছে দেখতে হবেতো... খাওয়াদাওয়া  তো হলো। আড্ডায় ফেরা যাক্। - একদম। যে কথা হচ্ছিল। ফিরি। আচ্ছা আমরা তো সবাই কবিতা, গল্প পড়ছি সুব্রতর কবিতার কথা কি ভুলে গেলাম সবাই।  সুব্রত  কবিতা শোনাও। - সে শোনাব নিশ্চয়ই।  সবার শেষে। এখন অম্বরীশের গল্প নিয়ে বাকী কথাটুকু হোক। যেটা বলছিলাম, "কর্তব্য"এ এক জটিল অবস্থান। দুটো মেয়েকে নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ও নীল হয়ে আকাশে মিশে যাওয়া... আবার " গাছ" এর কথা লিখেছে গল্পকার অম্বরীশ অনায়াস দক্ষতায়। বাবা তো প্রতিটি মানুষের জীবনে গাছের মতোই। বলতে পারি জীবন গাছ। তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। আর "নীতিকথা" য় ছোট্ট মেয়ের কাছে বাবার শেখাটা ধরা পড়েছে। যা আমাদের অন্যরকম ভালোলাগায় ভরিয়ে তোলে। আমরা তন্ময় হয়ে পড়ি... রেশ থেকে যায়...

- বাবলি দি, এবার পড় তুমি। "অনাচার"- স্বরবর্ণের পথে হেঁটে গিয়ে/ লিখেই ফেললাম বিন্যস্ত ব্যাকরণ,/ আর খুব গোপন অনাচারের আখ্যান!/ যা আড়াল করেছিলাম নিতান্তই / তোমার চোখের কথা ভেবে,/ যে চোখের দহনে দাহ হয়/ একটা নদী আর ক্ষতবিক্ষত অনাচার"। - বেশ ভালো লাগলো দিদি। " স্ব-অন্বেষণ" এ তুমি অবয়বহীন ডাইমেনশনে লজ্জাকে ফ্রেমবন্দী করে রাখো তুমি। আবার প্রত্যাশিত ভুল চাহনি’র অবসান ঘটিয়ে টিস্যু পেপারে মুছে দাও বিষাদ। অবধারিত যন্ত্রণা, অবগাহনে ডুবে যাওয়ার মধ্যে বেআব্রু জীবনের স্ব-অন্বেষণ ঘটাও তুমি। - ঠিক তেমনি করে তোমার কলমে তুলে এনেছো - "শস্যদেবতা"য় সময়ের পালা বদল, স্বপ্নেদের নেমে আসা গোপন টানেল বেয়ে। শস্যদেবতার বীজ বপনে ও সশব্দ রাত জেগে থাকে"। একটা কথা বলতেই হবে, " তন্দ্রা, স্বপ্ন এবং মুখোশ" কবিতা আগে লেখা হলেও বর্তমানের সময়কে তুলে ধরলো অনেকটাই। "ফসিলের মতো সম্পৃক্ত মুহুর্তোগুলো/ অপ্রকাশ বিষাদ মেখে হেঁটে যাই/ শূণ্যতার দিকে।/ এতসব তন্দ্রা, স্বপ্ন অথবা আত্ম নিষেকের উর্বরতা যাপন করি/ স্বজনহীন যান্ত্রিক খেয়ালে।/ মোমের মত রাত গলে যায় দুর্বোধ্য আগুনে।/ আর সাদা মেঘ নেমে আসে/ আমাদের সাজঘরে/ এবং অবিরত চলতেই থাকে/ মুখোশের কার্নিভাল।" - নিজের শহর নিয়ে বাবলি দি শোকাতুর। এভাবেই তার চিহ্ন "অন্তর্জলি যাত্রা" য় দেখতে পাই আমরা। "যেদিন শহর ডুবল জলে/ একবুক আগুন নিভিয়ে এলে/... যেদিন/ শহর পুড়ল বারুদে.../ দুচোখ ভরা বৃষ্টি  নিয়ে এলে/ সে বৃষ্টিতে/ আকাশও ভিজে গিয়ে/ তোমাতেই বানভাসি হল"- এভাবেই  বলে ওঠো তুমি। আর আমরা দেখে নিই একটুরো ছবি।







দীপান্বিতার "বাঁধনে" পিছুটান, ক্ষয় কিসে রাখবে সেই প্রশ্ন করেছে। তেমনি রোজকার অভিযোগ ও অভিমানেরা মাখামাখি হয়ে গেছে। অনেক কিছু সরালেও বড়াই এর তীর বুকের ভেতর বিঁধছে। হারানোর সুর বিষন্ন সানাইয়ে বেজে ওঠে। মায়ার বাঁধনে জড়ায়। খুব সামান্য অক্ষরের জাদুতে ছবি আঁকা হয়ে গেছে। - "পশমিনা চাঁদ" কবিতায় "ভিনদেশী এক পশমিনা চাঁদ জলোচ্ছাসের পর জেগে উঠেছে। কাজল চোখের কোণে জমিয়েছে কোন গোপন আতাত। মেঘের সাথে আড়ি যেন বাড়িয়ে রেখেছে তফাৎ।  শেষ লাইন চমৎকার। " খুব গোপনে ভিজলো এ মন.../ ছুইতে চেয়ে ব্যর্থ বিফল/ জোস্নার ক্ষত।" "নিয়ে যাবি" তে দীপান্বিতার খুব ইচ্ছে করে পাশাপাশি হাত ধরে সুমুদ্দুরে যেতে। কবি হারিয়ে যেতে চায় অচিনপুরে। বলে ওঠে, "নিয়ে যাবি?/ আমার তো খুব ইচ্ছে করে,/ সঙ্গে তোর রাত্রি দিনের সাতকাহনে।" গহন থাকার ইচ্ছেগুলোই নদী হয়ে বয়ে যায় ভেতর বাইরের খরস্রোতে। তারপর ইতিবৃত্ত লেখা হয় শেষ পেরেকে। - পুরোনো ও নতুনের মিশেলে কবির যাপন ধরা পড়ে এভাবে, "অথচ এই ঘনীভূত রূপকথায়,/ আহ্নিক ঘিরে বৈরাগী বনবাস।/ পদ্যে লেখা সে ডুবে যাওয়া নদী,/ যাপনে রাখা উলম্ব অবসাদ।" এভাবেই কবিতার কাছাকাছি চলে আসে পাঠক।

আবার কবি বাবলি সূত্রধর সাহার কলম বলে ওঠে, "অযুত বছর চলে যায় প্রত্যাশিত/ ডার্ক রুমে"। " অযুত" শব্দের প্রয়োগে কবি তুমি এনে দিলে এক বহুমাত্রিক রূপটান। বাবলি দির বইটিও মুদ্রণ প্রমাদে পড়েছে। অম্বরীশের বইতে থাকলেও তুলনামূলক তা কম। এই  ত্রুটিটুকু বাদ দিলে কবি ও গল্পকারের যাপনের স্বাক্ষর বহন করছে আমাদের আজকের আলোচ্য বইগুলো। বাবলি দি'র মায়াজড়ানো কবিতা "পয়লা জুলাই" পড়ছি। একমাত্র বোনকে হারানোর যন্ত্রণাবোধের সঙ্গী হই আসুন পাঠক। "পয়লা জুলাই ফিরলাম শহরে,/ সেই যে নদী উৎসব, নুড়ি পাথরের/ ফেলে আসা জল রং আর/ তোমার ল্যাভেন্ডারের শিশি,/ সবই গোছানো ছিল;/ অথচ গতকালই চলে গেলে তুমি.../ ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেল শুধু ইনজেকশনের চ্যানেল!/ আর বেঁচে থাকার মিথ, জন্মান্তরের সনেট।/ এবং কিছু ব্যথার হাইফেন।/ সবটাই গুছিয়ে রাখি বিষন্নতার নোনাজলে!" - এর পর আর কথা থাকতে নেই।

……………………………………………………………………………………………………….





১. আলোচ্য গল্পের বই- সরীসৃপ সঙ্গ, লেখক- অম্বরীশ ঘোষ প্রকাশক - দি সী বুক এজেন্সী, কলকাতা প্রথম প্রকাশ - মহালয়া ১৪২৬, সেপ্টেম্বর ২০১৯ মূল্য- ১২০/- টাকা


২. আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ - "কাচ পোকাদের প্রেম"। কবি- বাবলি সূত্রধর সাহা প্রকাশক- দৃশ্যমুখ প্রকাশন,

প্রচ্ছদ- উত্তম চৌধুরী, 

প্রকাশকাল- জানুয়ারী ২০২০

মূল্য- ৩০/- টাকা




৩. আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ- "যারা যাপনে নেই" কবি- দীপান্বিতা রায় সরকার প্রকাশক- মামমাম বুকস্, কলকাতা প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারী  ২০১৯, মূল্য- ১৫০/- টাকা ……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

সুব্রত সাহা, চা বাগান ঘেরা ছোট্ট জনপদ শামুকতলা, আলিপুরদুয়ার জেলায় থাকেন। ৭ই জুলাই ১৯৮১তে জন্ম। বাংলার পাশাপাশি সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতার সাথে যুক্ত। "ক্রিয়েটিভ আইডিয়াস ফোরাম" এর কর্ণধার। ভালোবাসাবাসি কবিতা, গদ্য লেখা ও সমাজ সচেতনতায় অংশ নেওয়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আড্ডা। লিখেছেন সচেতনতামূলক কয়েকটি ছোট্ট নাটক। করেছেন কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনাও। সবুজের চিঠি, অথবা এবং নীল পাখি সম্পাদনা ও প্রকাশনাতে যুক্ত ছিলো। কবিতা লেখার শুরু শূন্য দশকে, দু'হাজার সালে। একমাত্র কবিতার বই - "যে গানে বৃষ্টি নামে"। "এখন বাংলা কবিতার কাগজ" জলপাইগুড়ি থেকে প্রকাশিত হয় ২o১১ এর কলকাতা বইমেলায়।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………




 


কবিতা ও যাপনে শূন্যদশক এবং প্রথম দশকের চার কবি
বাবলি সূত্রধর সাহা

জন্মদিন- ২৪.১০.১৯৭৯, ধূপগুড়ির মেয়ে বিবাহ সূত্রে আলিপুরদুয়ারে থাকেন।
কাব্যগ্রন্থ - সময়, মহাকালের স্রোত, অনেক আগুনের শিখা, কাচপোকাদের প্রেম।
সম্মান বলতে সকলের অনেক ভালোবাসা পেয়েছেন। লেখা পড়ে কারোর মননে যদি ছুঁয়ে
যায় সেটাই প্রকৃত সম্মান। বই পড়া নেশা। যা পেয়েছেন জেনেটিক্যালি বাবার
থেকে। আর গান শোনা, আবৃত্তি করতে ভালোবাসেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কবি বিকাশ দাস (বিল্টু)

একটি কবিতার নির্মাণ করেন কবি। কবিতার সাম্রাজ্যে তিনিই একমার অধিপতি।
এখানে পুরোপুরি স্বাধীন তিনি। এই মুক্তির নেশায় কবি সৃষ্টি করেন অসংখ্য
শব্দছক। একটা ধোঁয়াশার মতো অবয়বহীন আদল মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। কখনও
বিচ্ছিন্ন থাকে, আবার কোন একটা সময় সেটাই কবিতা হয়ে ওঠে। জীবনে সেতু
বন্ধনের কাজ করে কবিতা। এই কবিতার জন্যই আজ আমার দূর - দূরান্তরের অজানা
মানুষগুলো হয়ে উঠেছে একান্তই প্রিয় আত্মজন। সেই রকমই কবিতা মিলিয়ে দিল
কবি বিকাশ দাস (বিল্টু) কে। মাথাভাঙ্গার শিবপুরে বিকাশের জন্ম ও বেড়ে
ওঠা।প্রথম দশকের কবি বিকাশ দাসের লিখতে আসা ২০১৬ সালে। কবিতা লেখার সাথে
তিনি "আল্পনার কবিতা" পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। গৃহশিক্ষকতার পাশাপাশি তার
নেশা লেখা, প্রকৃতির রুপ, রস, গন্ধে মজে থাকা। একান্তই যা নিজের তাকে
হারিয়ে মানুষের বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর সমতুল্য। সেই না থাকার স্রোতে বিকাশ
তার প্রেম, স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলেও লেখেন - "একবার না হয় কাছে ঘেঁষো/
ঘ্রাণ নাও কাদা মাটি,সোঁদা মাটি কিংবা পিঠের ঘামে লেপটে থাকা পারিজাত
সুগন্ধির"।
অসাধারন নিজস্বতা আছে বিকাশের কবিতায়। কবিতায় কেন আসা?  আদৌ কি এর কোন
উত্তর হয়! কিছুটা হয়তো কারণ থাকে। কবি বিকাশ তাঁর প্রিয় সঙ্গীকে হারিয়েও
কবিতার মাঝে খুঁজে পেয়েছেন তাকেই। তাই তো তিনি "আল্পনার কবিতায়” নিজেকে
ঢেলে সাজিয়েছেন। মেধাবী ছাত্র এবং উজ্জ্বল জীবন হতেই পারত!  তা না হয়ে
কবি অসহায় ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা ছাড়াও "
বিরহী প্রেমের ঝংকার"" নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আছে।

গভীর বোধ থাকলেই এমনটা লেখা যায় - "তাই তো এখন রোদে হাঁটলেও / ছায়ার সাথে
পাপকে হাঁটতে দেখিনা আর!"  খুব অল্প সময়ের তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে
উঠেছেন সকলের কাছে। "মা" আমাদের বটবৃক্ষ সম। সেই মা কেই তিনি কবিতায়
এঁকেছেন। " কান্নাকে কোঁচায় ভরে / ফুল হাতে মা ক্যামন বিলিয়েই চলছেন আলো
উঠোন জুড়ে।" মায়াময় নস্টালজিয়ায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কবি বিকাশের
কবিতা পাঠকদের এক আলাদা ভুবনে নিয়ে যাবে। এই আশা নিয়েই বলছি আপনার লেখা
চিরকালীন হয়ে উঠুক বিকাশ দাস।

কবি খুরশিদ আলম

কবির মন খারাপ খুব ক্ষনস্থায়ী। বিষাদের মেঘ কেটে গেলেই কবি বেরিয়ে পড়েন
রসিকবিল অথবা চিলাপাতার গভীর জঙ্গলে। সবুজে ডুব দিয়েই কবি খুরশিদ আলম
লিখে ফেলেন ঈশ্বরের পরিধি। "যে জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসে সংখ্যা অথবা সরণি/
তাকে ছুঁতে চাওয়ার আগে / আমরা নাম দিই ঈশ্বর"। অনবদ্য খুরশিদের
চিন্তাধারা। প্রথম দশকের কবি খুরশিদের জন্মস্থান আলিপুরদুয়ার জেলার
দক্ষিণ পারোকাটা। লেখাতে আত্মপ্রকাশ ডিঙি পত্রিকার মাধ্যমে। ২০১৪ সাল
থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে চলেছেন তিনি। স্বভাবে লাজুক এই কবি ভ্রমণ
প্রিয়। অত্যন্ত বিপন্ন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলছি। মানবিকবোধগুলো আজ
হারিয়ে যেতে বসেছে সবার। কবির মননে দাগ কেটে যায় এই ভাবনাগুলো। তাই
খুরশিদ লিখতে পারেন "প্রতিটি স্বপ্ন ভঙ্গের ভেতরেও থাকে / এক একটি
স্বপ্নের বসবাস।" কতটা বোধ আর জহুরীর চোখ থাকলে এতটা গভীরে ডুব দিয়ে
কবিতার মণিমানিক্য তুলে আনা যায় অতল সাগর থেকে।

কবির মননে বারবার আঘাত হেনেছে স্বপ্ন। খুরশিদের পরিনত লেখা পাঠকের দৃষ্টি
আকর্ষণ করে আর আগামীতেও করবে। সামনের দিনগুলোতে খুরশিদের আরও সম্ভাবনাময়
জীবন আশা রাখছি। কবি এগিয়ে চলুক তাঁর স্বপ্ন নিয়ে। সূর্যাস্তের সময় যে
সারা দিনের আশা আকাঙ্খা ডুবে যায়না, তারই প্রতিফলন ফুটে উঠেছে খুরশিদের
লেখায়। " সংখ্যা অথবা সংখ্যার অনুপাত/ সূর্যাস্ত বলতে ডুবে যাওয়া নয়। "

কবি মিহির দে


কবিতা আমাদের অক্সিজেন যোগায়। কবিতার আকাশে কবি মুক্তির আনন্দ খুঁজে পায়।
দিন শেষে মনের জানালা খুলে দিয়ে কবিতাতেই সমর্পিত হই আমরা। এমনই এক
সমর্পিত কবি হলো আলিপুরদুয়ারের প্রথম দশকের কবি মিহির দে। ২০০৮ এর
পরবর্তী সময়ে লিখতে আসা মিহিরের ভালো লাগা ঘুরে বেড়ানো। অজানা অচেনা ছবি
তোলা, ছিপ দিয়ে মাছ শিকার করা তার ভীষন ভালো লাগার বিষয়। ২০১১ সাল থেকে
কবি মিহির দে "কবিকুঞ্জ" নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এ ছাড়াও "
হিরণ্যগর্ভ " নামে অনলাইন পত্রিকার চরৈবেতির সম্পাদক।
কবিতা যাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নতুন পথ দেখায় তিনিই লিখতে পারেন  -"
শ্মশান ছুঁয়ে যে নদী / তারও একটা নীরবতা আছে।" কি কঠিন বাস্তব অথচ করুন
আর্তি ফুটে উঠেছে তার লেখায়। অথবা " ছড়ানো কড়ির ভেতর / জেগে ওঠে আমাদের
সংসার।"  সামাজিক এবং একান্তই ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন এই লেখাতে পাওয়া
যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন কবি। অত্যন্ত হৃদয় দিয়ে তিনি
লেখেন।একটা নিস্তব্ধ পুকুরে ঢিল পড়লে যেমন চক্রাকারে একটি আলোড়ন ওঠে
তেমনই  আলোড়ন ওঠে মিহিরের কবিতা পড়ে।

কবির বেঁচে থাকার রসদ থাকে কবিতার মাঝেই।প্রকৃতির আলো, হাওয়ার টানে
বেরিয়ে পড়েন ডুয়ার্সের সবুজ বনাঞ্চলে।খুঁজে পান পানবাড়ির কাঠবাড়ি।" কতদিন
যাইনি পানবাড়ির কাঠবাড়িতে/ যেখানে রোদ্দুর হেলান দিয়ে থাকে বাঁশের
মাচায়"। কবির দেখার চোখ অসাধারণ!  রোদ্দুরকে তিনি হেলান দিয়ে থাকতে
দেখেছেন। অত্যন্ত গভীরে ডুব দিয়ে তিনি শব্দকে মিশ্রিত করেন কবিতার
সমীকরণে। নীরবে কবিতার সাধনা করে চলেছেন মিহির। স্বভাবে বিনয়ী এই তরুন
কবির লেখাতে একটা স্বচ্ছতা, স্বাতন্ত্রতা আছে।কবিতার মিছিলে তাঁর লেখাটি
নজর কাড়ার মতোই। "বুনো মহিষের পালে নিজেকে জড়াতে পারিনা/ মিশে যাই হরিণের
দলে।"
অসম্ভব দক্ষতায় নিজের মননকে মিশিয়ে দিতে পারে প্রকৃতির ফুল, ঘুঘুর ডাক,
পিঁপড়ের  অস্তিত্বে।কবির ভাবনায় কারো অভিযোগ নেই জেনেও বৃষ্টি নামে।"
বেলে মাছ ধরা ছেলেটির কোন অভিযোগ নেই/ এ কথা জেনেও বিকেলের হাটে বৃষ্টি
নেমে আসে।"  দুর্দান্ত এক পারদে নিয়ে গেছেন কবির কবিতা। বাংলা সাহিত্যে
কবি মিহির দে নিজের দক্ষতা প্রমান করে চলেছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে। আমরা
পাঠকেরা তাঁর লেখা কবিতার সফলতা আশা করছি  প্রতি মুহূর্তে।

কবি জাকির হোসেন স্মৃতিজিৎ

ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকে কবির ওপরে। "যার দুঃখ সইবার ক্ষমতা থাকে তাকেই
ঈশ্বর দুঃখ দেন। আর যিনি কবি বা লেখক তাঁর দুঃখ, হতাশা থাকবেনা এমনটা
কখনই নয়। তাহলে যন্ত্রনা, কষ্ট কি ঈশ্বরের আশীর্বাদ কবির কাছে!"  না এর
কোন ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। যেমনটা জানা নেই কবি কখন ঠিক কি ভেবে
কবিতা লেখেন। কিন্তু জাকির হোসেন স্মৃতিজিৎ মনে করেন "সকলের মাঝে গিয়ে
বহু হতে চেয়েই কবিতা লেখা।"  শূন্য দশকের কবি জাকির হোসেন স্মৃতিজিৎ
ইদানীং প্রায় সব পত্রিকায় লিখছেন " স্মৃতিজিৎ" নামে। কোচবিহার জেলার
খোচাবাড়ি গ্রামে কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছাত্র জীবন থেকে লেখার প্রতি
অনুরক্ত ছিলেন। লেখার পাশাপাশি তিনি ছবি আঁকতে এবং গান গাইতে ভালোবাসেন।
এ ছাড়াও কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন এবং তাতে অভিনয়
করেছেন। শব্দের নৈবেদ্য সাজাতে তিনি ভালোবাসেন।
সত্যিই কবিতা আমাদের কাছে ঈশ্বর। অক্ষরের উপাচারে নিজস্ব অনুভূতির
উদযাপনেই তিনি লিখে  যান একান্ত চেতনা। "এখনও দূরত্ব বেঁচে আছে বলে
দিলখোলা আকাশটা / নীল খামে পাঠায় সন্দেশ"। জাকিরের কবিতায় আলাদা একটা
মাত্রা আছে। কবি তাঁর বাঁচার স্বার্থকতা খুঁজে পায় কবিতার নির্মাণ করে।
স্বার্থকতা, ব্যর্থতা, হতাশা সবকিছুরই বোধ ও ক্ষরণ আছে। সেই প্রকাশেই কবি
বুঁদ হয়ে থেকে সৃষ্টি করেন কবিতার অন্তরীপ।" চলো মেখে নিই ঘাসের আদর,
অন্তরীপ ঢেউ/ নীলকণ্ঠ পাখির ঠোঁটের উদার আকাশের গান"।
এরই মাঝে কবির প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে তিনটি কাব্যগ্রন্থ- "নাম রেখেছি
অন্বেষা", " আমার ঈশ্বর ও মাকড়শা", "যে আকাশ আঁকতে চেয়ে"। আরো দুটি
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। শব্দের মিছিলে কবি হেঁটে চলেছেন তার
নিজস্ব কষ্ট আর আনন্দ নিয়ে। কবি লিখে যান, "একদিন কলম ধরা হয়নি/ মন
মস্তিস্ক আর কলম... / তিনটেকেই কেমন যেন ভোঁতা মনে হয় আজকাল।" কবির জীবনে
মাঝে মধ্যেই হতাশার মেঘ এসে ভীড় করে। নিজের অস্তিত্বকে তখন দুর্বল মনে
হয়। তবে ক্ষণিকের  এই মেঘ বাদলে আবার নতুন সূর্য এসে আলোয় ভরিয়ে দেয় এক
কবির জীবন।

জাকির হোসেন অসম্ভব উষ্ণতার মোড়কে কবিতাকে সাজিয়েছেন। "ঘরের লীনতাপ শুষে
বিহ্বল জর্জর / হৃদয় বোঝে তাই বন্ধুত্বের উষ্ণখোলা হাত।" এই উষ্ণ হাতেই
কবি পেয়েছেন  "নীতীশ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার" আল্পনার স্মৃতি পুরস্কার" এবং
একলব্য স্মারক"। কবি লিখতে থাকুন তাঁর শব্দাবলী। দীর্ঘ এই কবিতার ভ্রমণে
স্মৃতিজিৎ তার লক্ষ্যে পৌঁছাক। তার একনিষ্ঠ পাঠকেরা অপেক্ষা করে থাকবে
আগামী সৃষ্টির জন্য।

মানিক সাহা

 কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলার শূন্য দশকের কবিরা

মানিক সাহা



 আমরা যখন লিখতে এসেছি, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রভূমি তখন নব্বইয়ের দামালদের দখলে। নব্বইয়ের কবিদের অনেকেই প্রতিষ্ঠানকে অবলম্বন করে খ্যাতি ও যশ লাভ করার দৌড়ে মেতেছে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধি যারা তারাও  নিজেদের মধ্যে সংঘ গড়ে তুলেছে। কবিতার চর্চা  আর শহরকেন্দ্রিক নয়। বরং সুদূর মফঃসলের আপাত নির্ভার বাতাসে বাংলা কবিতার শিল্পীত অক্ষরগুলো  প্রতিধ্বনি   হতে শুরু করেছে। যদিও আশির দশক থেকেই কবিতা নন্দন তত্ত্বের প্রচলিত বিধি ডিঙোনোর সাহস দেখিয়েছে 'নতুন কবিতা'য়। কিন্তু তা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করছে শূন্যে এসে। কিংবা অন্যভাবে বললে এও বলা যায় আশির দশকের নতুন কবিতার ধারা যখন নব্বইয়ে এসে কিছুটা শিথিল হয়ে গেছে, শূন্য দশকের কবিতা সেই নতুন কবিতার ধারাকে এগিয়ে নিয়েছে  নিজেদের মতো করে। 

বাংলা কবিতার মূল ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায় তা মূলত শহরকেন্দ্রিক। যদি কেউ গ্রাম বা মফস্বলের শক্তিশালী কবির কথা বলে শহরকেন্দ্রিক ধারনার নশ্বরতা ও অর্থহীনতাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন, তবুও দেখা যাবে সেই গ্রাম বা মফস্বল আসলে মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া কিংবা হুগলী'র কোন গ্রাম বা ছোট শহর। অর্থাৎ বাংলা কবিতার তথাকথিত প্রবক্তাগণ অন্তত বর্ধমানের উপরের অংশ থেকে যেতে পারছেন না। অথচ আশি বা নব্বই দশকের কবিতা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কবিতা ক্রমশঃ এই সীমারেখা অতিক্রম করতে শুরু করেছে। এবং শূন্যে এসে অনেকটাই বদলাতে শুরু করেছে।

শূন্য দশকের কবিরা মূলত ১৯৮০ বা তার সামান্য আগে পরে জন্মানো মানুষ। ফলে আমরা যারা এই সময়কালে জন্মেছি আমাদের চোখের সামনে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সর্বোপরি তথ্য প্রযুক্তির   বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা তার প্রত্যক্ষদর্শী ও তাতে সামিল হয়েছি। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনকে গ্রহণ করার মানসিকতা ও পদ্ধতিও কিছুটা বদলে গেছে। নব্বইয়ের প্রতিষ্ঠিত কবি ছন্দ মিল করতে গিয়ে প্রেমের সাথে এটিএম বসিয়ে দিয়েছেন নির্দ্বিধায়। বাংলা কবিতায় উঠে এসেছে নতুন নতুন শব্দ ও শব্দ ভাবনা। যে জগৎ মানুষের ভাবনার অতীত ছিল তা বাস্তবে দেখা দিয়েছে। ফলে কবিতাও তার গতিপথ নজের মতো করে বদলে নিয়েছে এটা বলাই যায়। 

কবিতার ভাব নির্ভর জগৎ থেকে কবিতা মুক্তি পেয়েছে শূন্য দশকের কবিদের হাতে। প্রথা বিরোধী, ধারাবিরোধী, নতুন কবিতা - যা-ই লেখা হোক না কেন, শূন্যের কবিরা এসে সেই সব কবিতাকে আরো নতুন ভাবে নিজেদের মতো করে প্রকাশ করতে শুরু করে৷ একদিকে যখন অনিমিখ, সংঘমিত্রা, নীলাব্জ, দেবাঞ্জন, অর্ঘ, ইন্দ্রনীল, রিপন,  পলাশ, অস্তনির্জন, দোলনচাঁপারা লিখছে সেই সময় অর্থাৎ ২০০০ পরবর্তী সময়ে কোচবিহারে বসে কবিতা লিখছি আমি, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় , ওয়াহিদা খন্দকার । উদয়ার্ণব ও সুকান্তও লিখছে কিছুদিন পর থেকে। ওদিকে আলিপুরদুয়ার থেকে লিখছে মূলত সুব্রত সাহা, শুভঙ্কর পাল। তবে এই সময় এদিকটায় শূন্য'র মুখপত্র হিসেবে কোন পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। ফলে আমরা লিখছি কলকাতা তথা দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলিতে। অবশ্য নব্বই ও নব্বই পূর্ববর্তী পত্রিকাগুলি আমাদের লেখা প্রচুর ছেপেছে।

জলপাইগুড়ি থেকে প্রকাশিত 'এখন বাংলা কবিতার কাগজ' নতুন বাংলা কবিতা প্রকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এখন এর সম্পাদকের নাম অতনু বন্দ্যোপাধ্যা।  ওঁর এক বন্ধু নীলাদ্রি বাগচি তখন কোচবিহারের জেলা পুলিশের প্রধাণ হিসেবে চাকরি করছে৷ অতনুদা কোচবিহারে এসেছে। অর্জুন ফোন করে আমাকে ডাকলো। আমিও বিকেলের দিকে চলে গেলাম কোচবিহারে। প্রথম দেখা ও কথাতেই আপন করে নেবার স্বভাব অতনুদার।  এখন বাংকা কবিতার কাগজে লিখতে লিখতে পরিচয় হচ্ছিল শূন্যের অন্য সব কবিদের সাথে। অর্ঘ, দেবাঞ্জন, অস্তনির্জনের সাথে সাক্ষাৎ হল। বাংলা কবিতা নতুন গতিপথে বইতে শুরু করেছে তখন।

২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে শূন্য দশক হিসেবে ধরা হল। এই সময় প্রচুর বই বের হচ্ছিল বললে মিথ্যে বলা হবে৷ শূন্য দশকের কবিরা লিখতে এসেই টপ করে বই করে ফেলেনি। বরং বই প্রকাশের থেকে বই পড়া ও লেখার প্রতি অভিনিবেশ মূখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে ২০০০ এর মধ্যভাগ অতিক্রম করার পর থেকে শূন্য দশকের অনেকেই নিজেদের বই প্রকাশ করতে শুরু করলো৷ তবে দুঃখের বিষয়টিহল এই যে আমাদের কোচবিহার বা আলিপুরদুয়ার জেলার কবিরা বই প্রকাশের ব্যাপারে অতটা আগ্রহ দেখায়নি। সকলেই একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছে। পরিসর বিস্তৃত হচ্ছে। শূন্যের কবিরা বাংলা কবিতার মূল ক্ষেত্রটি অধিকার করে ফেলছে ধিরে ধিরে৷ আমরা তখন নিয়মিত লিখে চলেছি কৌরব, নতুন কবিতা, কবিতা ক্যাম্পাস, এখন,  বৈখরীভাষ্য,  কবিসম্মেলন, কবিতা পাক্ষিক ইত্যাদি পত্রিকায়। এসময়ে লক্ষ্য করার মতো বিষয় ছিল এই যে, পূর্ববর্তী পত্রিকাগুলি যা মূলতঃ আশি বা নব্বইয়ের কবিরা প্রকাশ করছিল, তার দায়িত্ব চলে আসে শূন্য দশকের কবিদের হাতে।  ফলে শূন্যের কবিরা নিজেদের পত্রিকা প্রকাশের বিষয়টি তেমনভাবে ভাবার অবকাশ পায়নি। 

কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার থেকে যে কবিরা শূন্য দশকের প্রতিনিধিত্ব করেছে তাদের মধ্যে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় সম্ভবতঃ  অর্জুনের।  '২০ মিনিটের জন্য সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়' প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তারপর দীর্ঘ বিরতি। এইসময় আমরা বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি  বিদেশী সাহিত্যের  দিকে ঝুঁকে গেছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এই সময় আমরা কবিতাকে বাংলা কবিতার ভাব- সর্বস্বতা ও এর  লিরিক নেচার থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি। কবিতাকে আরো স্মার্ট কী করে করা যায় সেই কথা ভাবছে শূন্যের কবিরা। প্রথাগত কাহিনি নির্ভরতাকে পুরোপুরি ত্যাগ করা হয়েছে। ছন্দবদ্ধ লেখাও খুব কম লেখা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে না বললেই চলে। কবিতা হয়ে গেছে ওপেন এন্ডেড। চিত্রকল্প ব্যবহার কমছে। যেটুকু ব্যবহৃত হচ্ছে তাও নতুনতর। কেননা,  আগেই লিখেছি, তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটছে সারা পৃথিবী জুড়ে।   ফলে নতুন শব্দ, নতুন ভাবনা,  নতুন চিত্রকল্প জন্ম নেবে এটাই স্বাভাবিক। অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় চলতি হাওয়ায় গা ভাসায়নি। তাই ওর লেখা হয়ে উঠেছে ওর নিজস্ব। শূন্য দশকে প্রচুর কবিতা লেখা হলেও গদ্যের সম্ভার অপ্রতুল বলা যায়। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র গদ্য সাহিত্য রচনায় বিশেষ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে৷ অর্জুন তাদের অন্যতম। ওর উপন্যাস 'বঙ্কিমচন্দ্র', আমার মতে,  বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকবে। 'বঙ্কিমচন্দ্র'  ছাড়াও অর্জুনের আরো বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।  উল্লেখযোগ্য হল - 'ডি মেজর', 'ডাক্তারকে যা বলেছিলাম', 'উন্নয়ন বিরোধী যেসব কার্যকলাপ এখন শহরে হচ্ছে',' মরণ অন্তরালে' ইত্যাদি।

আলিপুরদুয়ার জেলার শামুকতলায় থাকে সুব্রত সাহা। প্রান্তিক গ্রাম বললে খুব একটা ভুল বলা হয়না। সুব্রত একদিন ফোন করে জানালো সে একটা পত্রিকা করছে। ওর পরিকল্পনা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। এই ছোট্ট জনপদে বাস করা একটি সাধারণ  ছেলে তার স্বপ্নকে কতটা বিস্তৃত করতে পারে সেটা ভেবেই অবাক হয়েছিলাম। 'নীলপাখি' নামে পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা রাজকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছিল। প্রচুর অর্থব্যয় করেছিল নিজের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাস্তব বড়ই নির্মম। পত্রিকাটি আর চালানো সম্ভব হয়নি। 

অন্যদিকে কোচবিহারে কলেজে পড়া ছেলে সুকান্ত দাস পত্রিকা প্রকাশের সম্ভাবনাকে প্রায় বাস্তব রূপ দিয়ে ফেলেছে৷ সুকান্ত বয়সে অনেকটা ছোট এবং লেখালেখির ক্ষেত্রে শূন্য দশকের প্রায় শেষের দিকে তার  আবির্ভাব। ফলে সুকান্তকে শূন্য পরবর্তী তথা প্রথম দশকের  কবিদের মধ্যেও ধরা যেতে পারে৷ আমার মনে হয় সুকান্ত নিজেকে প্রথম দশিকের কবি হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। সে যা-ই হোক, সুকান্ত প্রকাশ করলো 'শাঙ্ক্ষিক'।  আনন্দের বিষয় হল পত্রিকাটি মাঝখানে কিছুদিন বন্ধ এবং অনিয়মিত প্রকাশিত হলেও আবার নতুন করে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। সুকান্ত দাসের সঙ্গে যার নাম মনে আসে সে হল উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়। শূন্য দশকের শেষের দিকে লিখতে আসা শক্তিশালী কবিদের অন্যতম উদয়ার্ণব। তার প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করত্র ইচ্ছে করছে - যদিও তা ২০১০ এর পরে প্রকাশিত- তা হল ' মৃত্যুর পর যে ঘড়ায় চড়ে তুমি দেশ পেরোবে'। 

আলিপুরদুয়ার জেলা থেকে যে কবিরা শূন্য দশকের প্রতিনিধিত্ব করেছে শুভঙ্কর পাল তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শুভঙ্কর বারোবিশার ছেলে। লেখালেখির পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে শুভঙ্কর আমাদের কাছে উদাহরণ স্থাপন করেছে। বারোবিশার মতো প্রান্তিক জনপদে বাস করে নতুন কবিতা লেখার সাহস দেখিয়েছে সে। আর দুঃসাহস দেখিয়েছে 'কবিতা করিডোর' প্রকাশ করে। এবং আমি মনে করি শুভঙ্কর সত্যিই এই দুঃসাহস দেখানোর স্পর্ধা রাখে৷ কেননা 'কবিতা করিডোর' উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্লগজিন। এই মুহূর্তে বঙ্গ, বহির্বঙ্গের প্রচুর কবি সাহিত্যিক লিখে চলেছেন এই ব্লগজিনে।  শুভঙ্কর নিজের লেখার পাশাপাশি অনুবাদের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে ও আজও সিদ্ধান্ত নেয়নি। আশা করি খুব শিগগির ওর কবিতার সংকলন পড়ার সুযোগ করে দেবে শুভঙ্কর। 

ওয়াদিহা খন্দকার দিনহাটার মেয়ে। আমার সহপাঠী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে কবিতা লিখছে৷ যদিও তখন কবিতা লেখার স্রোত ছিল একটু মন্থর। পরবর্তীতে অনেক লিখেছে। লিখে চলেছে। প্রকাশিত হয়েছে দু'টি কাব্যগ্রন্থ - 'নীরব দশমিকের ভিড়' এবং ' বিবর্ণ শ্লেটের সমীকরণ'। এখানে বলে রাখা ভালো ওয়াহিদা শূন্য দশকে লেখা শুরু করলেও তার বইদুটিই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে৷ 

দশক বিভাজন খুব জটিল এক প্রক্রিয়া। কবি ও সমালোচক নিজেরা নিজেদের মতো করে দশকের ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন। যদিও এই দশক বিভাজন বিষয়টি একটি ভ্রান্ত ব্যাপার বলে মনে করেন, তথাপি আলোচনার সুবিধার্থে একে উদ্ভাবন করা হয়েছে। কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে এক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও দেখা যায়। যেমন বয়সের দিক থেকে অনেক কবি হয়তো নব্বই দশকের কবি হিসেবে স্থান পাবে কিন্তু লেখার সময়কাল ধরে তিনি প্রথম দশকে স্থান পেয়েছেন। আবার অনেকে শূন্য দশিকে প্রচুর লিখেছেন, পরিচিত হয়েছে, অথচ তার কাব্যগ্রন্থ প্রথম দশকে প্রকাশিত হওয়ায় তিনি নিজেকে প্রথম দশকের কবি হিসেবেই পরিচয় দিতে চেয়েছেন। যদিও কবিতার বই প্রকাশের বিষয়টির চেয়ে, কবির লেখার মূল সময়কে ধরে দশক বিভাজন করলে ভালো হয় বলেই আমার মনে হয়। 

শূন্য দশকে কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারের কবিদের নিয়ে আলোচনা পরবর্তী সময়ে আরো বিস্তৃত হবে আশা করি। অনবধানতাজনিত কারণে যারা অনুল্লেখিত হয়েছে তাদের নিয়ে পরবর্তী পরিসরে আবার লেখা হবে৷ 

    

পরিচিতিঃ মানিক সাহা

কবি ও গদ্যকার শূন্য দশক 

দিনহাটা

কোচবিহার

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ 

ছায়ারোদের ব্রেইল (২০১৩)

'জলজ্যোৎস্নার মেয়ে' (২০১৭)

অশ্বমেধের ঘোড়া (২০১৯)

প্রবন্ধের শিরোনাম : দর্শক- দর্শন - সুজিত রেজ

 প্রবন্ধের শিরোনাম :  দর্শক- দর্শন 

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ 

সুজিত রেজ




বছরে শতখানেক নাটক দেখার সুযোগ অতি সৌভাগ্যের। নিশ্চিতরূপে  অধমের মস্তকে ভরত-অ্যারিস্টটলের আশীর্বাদ। গুচ্ছেন নাটক দেখার নেপথ্য কারণ---- " বাড়ির পাশে আরশিনগর " (রবীন্দ্রভবন)। কাঁকতালেই বলা যায়। ইচ্ছে হলে নাট্যবিরতিতে বৌয়ের হাতের চা-পানও সম্ভব। তাছাড়াও , নাটক দেখায় আমার কোনও বাছবিচার নেই। বড়-মেজো- সেজো-ন' সব দলেরই প্রযোজনায় হাজির হই।

আর নাটকের প্রতি প্যাশন যে তীব্র ; সেই ছোটবেলাথেকেই------ যেদিন ফুলকাকার রূপান্তর ও  পরিচালনায় বঙ্কিমের " কপালকুণ্ডলা "-য় মা কালীর ভূমিকায় মঞ্চে উঠেছিলাম। তখন আমি ক্লাস টুয়ের ছাত্র। মেক্আপ করার পর আয়নায় রক্তাক্ত লোলজিহ্বা ( দন্ত পিষ্ট টিনের পাত ) ও

কালিবরণ দেখে কাপড়ে-চোপড়ে হয়েছিল। সেইদিন থেকেই-------


মন মোর নাটকের সঙ্গী 

উড়ে চলে দিগ্‌দিগন্তের পানে

নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে

রিমিঝিম   রিমিঝিম   রিমিঝিম॥


মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে

ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে।

ঝঞ্জনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে।

কলকল কলমন্দ্রে নির্ঝরিণী

ডাক দেয় প্রলয়-আহ্বানে॥


বায়ু বহে পূর্বসমুদ্র হতে

উচ্ছল ছলো-ছলো তটিনীতরঙ্গে।

মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে

তাল-তমাল-অরণ্যে

ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে॥



নাটক দেখতে গিয়ে কখনও চমকাই , কখনও দুঃখ পাই। নাট্যদলগুলির প্রযোজনার মান শেয়ার বাজারের সেনসেক্স-এর মতো ওঠানামা করে। শিল্পের স্বভাব বোধহয় তাই-ই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি হতাশ হই দর্শকের মান ও নগণ্য উপস্থিতি দেখে। কোনো কোনো দলের কল-শো দেখতে ভিড় উপচে পড়ে  ;  আবার , পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত নাট্যোৎসবে ওই দলেরই , একই নাটক দেখার জন্য দর্শকদের মধ্যে কোনও উৎসাহ থাকে না , প্রবেশ অবাধ থাকলেও। হয়ত কল-শোর আয়োজন করে স্থানীয় কোনও সংস্থা বা সংগঠন ; তাদের প্রচার ও কানাকানি প্রভাব ফেলে। 



চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় দর্শকদের একাধিক শ্রেণি চিহ্নিত করা যায। প্রথমত , জাম্বু-দর্শক।   নতুন বিয়ের পর , শালা-শালি-মাসশাশুড়ি- পিসশ্বশুর সহ সদলবলে নাটক দেখা। বিরতিতে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও , দু'হাতের মুঠোয় মোবাইলের সঙ্গে পাঁচ-ছ প্যাকেট ঘটি ভাজা নিয়ে , গলদঘর্ম দেহে জামাইবাবুর এন্ট্রি। দশ মিনিটের মধ্যে এক্সিটের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বধূটির বিরহিনী হয়ে ওঠার মহড়াও চলে এই অবকাশেই।  সিনেমার বদলে নাটক বেছে নিয়ে  নিজের রুচিবোধের প্রমাণ রাখার তাগিদও থাকে  জামাইবাবুর  ষোলো আনা। 



দ্বিতীয়ত , হুজুগে- দর্শক। নাটক হচ্ছে , যাওয়া যাক। এঁদের অনেকেই , নাট্যবিরতিতে হিসি করতে গিয়ে আর ফিল্ডিং করতে পছন্দ করেন না। এঁদের সংলাপপ্রীতি তারিফ-যোগ্য। তবে শোনার চেয়ে বলার দিকে অতিমাত্রিক ঝোঁক। গম্ভীর ট্র্যাজেডিকে এঁরা অনায়াসে কমেডিতে রূপান্তরিত করে নেয়। ফলে, নিয়তির তাড়নায় ট্র্যাজিক নায়কের পৌরুষ যখন ভুলুণ্ঠিত , পাশের সিটের দর্শকের চোখ ছলছল , এঁরা তখন ' হেসে খলখল ' । তালি দেওয়ার জন্য এঁদের হস্তযুগল সদাই উচাটন। 



তৃতীয়ত , মোবাইল-দর্শক।  আমৃত্যু মোবাইলে চোখ রাখার ধনুক ভাঙা পণ এঁদের। নাটক শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত  এঁরা বন্ধুদের হাঁড়ির খবর নিতে ব্যস্ত।  ওল খেয়ে গলা কত ডিগ্রিতে কুটকুট করেছিল , বৌয়ের সর্দিতে বেলাডোনা কেন কাজ করছে না---- নাটক তো শুরু হয়নি বলে নেওয়া যেতেই পারে। থার্ড বেল বাজার পর , ঘোষক যখন বলেন , অনুগ্রহ করে আপনার মোবাইল নিষ্ক্রিয় করে রাখুন ,  এঁরা শুধু ' বয়েই গেছে ' বলে না , কাঁচা খিস্তিও মারে। অভিনয়ের মাঝপথে এঁদের মোবাইল বেজে ওঠে  : ' যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে '। প্রসঙ্গক্রমে , দুটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নেওয়া যেতে পারে।দুটিই চাঁটি মারার ঘটনা। চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে নান্দীকারের         ' অজ্ঞাতবাস '-এর অভিনয় চলাকালীন , এক দর্শকের মোবাইল বেজে উঠলে , রুদ্রপ্রসাদবাবু বিরক্ত হয়ে সাময়িক অভিনয় বন্ধ করে দেন। নাট্যবিরতির পরের অভিনয়ে ওই দর্শকেরই মোবাইল আবার জেগে ওঠে : ' মার ঝাড়ু মার ঝাড়ূ মেরে ঝেঁটিয়ে বিদায় কর '। পাশের দর্শক চার অক্ষরের কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলে ওঠেন  :       ' ঝাড়ু মেরে তোকেই হল থেকে বিদেয় করে দেব '। ঠিক তৎক্ষণাৎ , তাঁর বুকপকেটে আলো জ্বলে ওঠে। গান বেজে ওঠে : ' তোমার হল শুরু আমার হল সারা '। এরপর শুধু  চাঁটি - চাঁটি-চড়চাপাটি। দ্বিতীয় চাঁটির ঘটনার সাক্ষীা হলুম এই জানুয়ারিতেই। প্রথামাফিক থার্ড বেল বাজল। দর্শকদের উদ্দেশে মোবাইল নিষ্ক্রিয় করার অনুরোধ জানানো হল। ড্রপ সিন নড়ছে--- সরবে-সরবে করছে। মোবাইল  বেজে উঠল। না কোনও গান নয় , বিএসএনএল মার্কা রিং টোন। ক্রি-ক্রি-ক্রি-----ং। একজন  বয়স্কার গলা পাওয়া গেল :   " যা বাবাঃ ! কোথায় রাখলাম রে ফোনটা "। একজন সহদর্শক বেশ জোরে চেঁচিয়ে বললেন : " বন্ধ করুন। অভদ্র "। ততক্ষণ বেশ কয়েকবার রিং হয়ে সুকণ্ঠী জানিয়ে দিলেন : দ্য পারসন য়ু আর কলিং , ইজ্ নট আনসারিং। আবার রিং ----- ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। পাশের দর্শককে বললেন :" দেখুন তো , ডিসপ্লেতে কার নাম ---- আমি চোখে ভালো দেখি না "। ততক্ষণে তাঁর মাথায় চাঁটি পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বুঝে যাই নাটকও শুরু হয়ে গেছে।


চতুর্থত ,  সহৃদয়-দর্শক। এঁরা চান আগের তিন শ্রেণির দর্শকের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশাধিকার বন্ধ হোক। ভিড়ের সংসর্গে উপভোগ-বিব্রত হতে চান না তাই । এঁরা  কিউবদ্ধ হয়ে হলে প্রবেশে সঙ্কোচ বোধ করেন।। এঁরা যে নাট্যপরিধিতে স্বতন্ত্র গ্রহের জীব , তা তাঁদের চলন-ধরণ-করণ-গড়ন থেকে বোঝা যায়।  এঁরা নগদ বিদায়ে প্রবেশপত্র গ্রহণে গড়িমসি করেন। নাট্যদলগুলির আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার প্রত্যাশায় তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন। নাট্য আকাদেমির সদস্য তো হলে কেল্লা ফতে ! নাটক শুরুর আগে ও সমাপ্তির পর সাজঘরে ঢুঁ মারেন। নাট্যবিরতিতে সিগরেটের ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে নাট্যার্ধ নিয়ে কচুকাটা করেন। পরার্ধে পরিণতির সম্ভাবনা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন। এঁরা মনে করে থাকেন , শিশির-শম্ভু-অজিতেশের পরে বাংলা নাট্য কলাবৌ। ঘোমটা তুলবে কে---- কবে--- জানার জন্য গণেশের দ্বারস্থ হয়ে লাভ নেই।  এঁদের চলভাষ রুদ্ধ ,  কটাক্ষ শুদ্ধ , কথন দুর্বোধ্য।


এবার ছুঁচো গেলার পালা। পাশে বিসলারি রাখতেই হল। আমার আবার গলায় লকগেট। কখনও খাদ্যনালি , কখনও শ্বাসনালি খোলে  আবার অচানক বন্ধও হয়। তখন পিঠে -পেটে প্রেসার দিতে হয়। " পিঠে খেলে পেটে সয় '----    প্রবচন উদ্ভবের  কারণ বুঝি এখন। ছুঁচো কেত্তন করতে - করতে কেমন পারা ভারত-নাট্যম দেখাবে ভগাই জানে। কেন না , প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক  আমি  কোন শ্রেণির দর্শক । তার উত্তর না- দিয়ে শঙ্খ বাজানোই বুদ্ধিমানের কাজ  : 


তোমার কোনো ভিত্তি নেই 

তোমার কোনো শীর্ষ নেই                        

             কেবল তক্ষক

তোমার কোনো উৎস নেই

তোমার কোনো ক্ষান্তি নেই

               কেবল ছন্দ 

তোমার কোনো মিথ্যা  নেই

তোমার কোনো সত্য নেই

               কেবল দংশন

তোমার কোনো দৃষ্টি নেই

তোমার কোনো শ্রুতি নেই

                 কেবল সত্তা


       


          

নীলাদ্রি দেব

 পরিবারের তরুণতম স্বর... আগামী ও অক্সিজেন.

নীলাদ্রি দেব



বাংলা কবিতা একটা আস্ত পরিবার. একটা অনন্ত জার্নি. সীমাহীন কোন পথ. পথের ধারে পেভার্স ব্লকের উপর দাঁড়িয়ে প্রায় সামনে থেকে পথটিকে ছুঁয়ে দেখলে যা কিছু অনুভব হয়, তার ওপর কতটাই বা মন্তব্য করা যায়. শুধু জড়িয়ে ধরাই এক ও একমাত্র পথ বলে মনে হয়. তাই কবিতার কাছে বারবার নত হই. যে সমৃদ্ধ ইতিহাস আমাদের বাংলা কবিতার, সেখানে নতুন কী আসছে বা এল, সে নিয়ে ভাবা যেতে পারে. যদিও নতুন সংযোজন বলেও কি কিছু হয়? যা বলা হয়েছে, তাই খানিকটা নতুন মোড়কে উঠে আসে সময়ের স্রোতে. সৃষ্টি যদিও এক রহস্যময় কুয়াশার নাম. এই সৃষ্টি চলছে. কবিতার পথ প্রশস্ত হচ্ছে. বদল ঘটছে চারপাশের, কবিতা যাপন ও উদযাপনের. আলোর তীব্রতা জোরালো হচ্ছে. এর মধ্যেও সাধক সাধনা করছেন. স্পটলাইটের নিচে মাছ বিক্রি হচ্ছে. হাই মাস্ট বাতির নিচে কলাপাতায় বিতরণ চলছে শিন্নি. এত এত শ্বাস, বিশ্বাসের পরও ভূগোলের বেড়া ভেঙে তরুণ প্রজন্ম সিরিয়াস কবিতার সাথে পরিচিত হচ্ছেন, জড়িয়ে যাচ্ছেন. প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম এই ভূগোলের বেড়া ভাঙতে এতটা কার্যকর হতে পারে, বছর পনেরো বা কুড়ি আগেও তা ভাবা সম্ভব হয়নি. যা হোক, সময়ের সাথে সাথে এগুলো আমাদেরই প্রাপ্তি. যদিও ভূগোল ভেঙেছে, তবু পুরোনো অভ্যেস ভাঙা শক্ত ও সময়সাপেক্ষ. এখনও, কেন্দ্র বা প্রান্ত না থাকলেও, কোথাও একটা থেকেই গেছে এর ছাপ ও ছায়া. কলাগাছের শেকড়েরই মতো. 

না. স্বীকৃতি একটি কঠিন অঙ্ক. এ বিষয়টি তোলা থাক. কাজ নিয়ে কিছু কথা হোক. প্রান্তিক অঞ্চলে বসে কাজ করা তরুণ প্রজন্ম নিয়ে কথা হোক. যারা শুধুই পাঠক চান, পোডিয়াম নয়. এমনই কয়েকজন নন, বেশ কয়েকজন ছড়িয়ে আছেন উত্তরের বিভিন্ন জেলায়, জনপদে. কোচবিহারেও. তাঁদের থেকে চার কবির কবিতা যাপনের খানিকটা অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি. একটি কবিতা, বা তা প্রসঙ্গে সামান্য কথায় কবিকে চেনা যাবে না, তবে খানিকটা আগ্রহ তৈরি হলেই ওঁদের কবিতার পাঠক হিসেবে আমার ভাল লাগবে. 


•• 

ঝুমঝুমি


তোমার আমার মধ্যে মাঝে মাঝে তুমুল ঝগড়া হোক। মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকো। বালিশের ঘন অন্ধকারে বেজে উঠুক দীর্ঘপ্রেমের ঝুমঝুমি। অপেক্ষার একটা শব্দ আছে । যাক না ভেস্তে বাইরে ডিনার করার পুরোনো প্ল্যান। আমার মনের কথা বলেই ফেললে। চলো শান্তিপুর ঘুরে আসি। সম্পর্ক খতিয়ে দেখলে বুঝতে পারি প্রেমে কোনো প্রশ্নচিহ্ন থাকতে পারে না। কোনো ভলান্টিয়ার বাতাসে শান্ত হয় না প্রেমের মন্দাক্রান্তা ছন্দ।


খোকন বর্মন. ওপরের এমন উচ্চারণ খোকনের. সদ্য কুড়ির এই যুবকের. কোচবিহারের এক প্রান্তিক অঞ্চলে বসেও খোকন বাংলা কবিতার মায়াভুবনে এমন অক্ষরের চাষ করছেন. কবিতার কাছে সবসময় সৎ এই কবিতাপাগল শুধু সম্ভাবনাময় নয়, পরিশ্রমীও. লেখা ও পড়ার ভেতরে ডুবে থেকে খোকন দীর্ঘ এক আশাবাদ লিখে রাখছেন. আমরা তাকিয়ে থাকব ওঁর সুন্দর আগামীর দিকে. 


•• 

অস্ত ও জন্মের কথা


আপাতকালীন বৃষ্টির পর রোদ উঠলে জীবনের গন্ধ পাই

অনিশ্চিত পথে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরি 

অনেকটা পিছিয়ে এসে গুনতে শুরু করি ভুল-মেদ-ক্ষমা-কান্না 

মিথ্যে মুহুর্তের কাছে যেদিন আত্মসমর্পণের গল্প-বিচ্ছেদ... 

গন্ডি কেটে রাখি মননের চারদিকে; ভবিষ্যতের কথা বলা বারন। 


প্রতিটি মুহুর্তেই আমরা এগিয়ে যাই অনিয়ন্ত্রিত 

কাটাকুটির দিকে 

দাগ কেটে কেটে এগিয়ে যেতে গেলে হিসেবে ভুল হয়, 

গাছেদের মতো মা হতে চাই না আপাতত, এখন আমায় সন্তান হতে দাও; 

অনিশ্চয়তা আসলে একধরনের অসুখ... যা মৃত্যুর পরেও ঘুরপাক খায়। 


প্রতি মুহূর্ত একেকটি জন্মদিন... প্রতিটি সূর্যোদয়েই লেখা থাকে সূর্যাস্তের কথা...


নাদিরা আহমেদ মুক্তি লিখেছেন ওপরের এই কবিতাটি. দিনহাটায় বসে লিখছেন নাদিরা. বাংলা কবিতার সাম্প্রতিকতম এই সংযোজন লিখে রাখছেন সহজ জীবনের কথা. এই কথার ভেতর থেকে যাচ্ছে সংকেত, মায়াময়তা. অকারণে জটিল না করে তুলে এমন এক উচ্চারণ করছেন, যেখানে স্মার্টনেস থেকে অনেক বড় আন্তরিক স্পর্শ. ওঁর সুন্দর আগামীর পথে আমরাও পথিক বন্ধু হয়ে ওঁর পাশে থাকব. 


••

সম্পর্ক

তিন


দ্রুত সরে যাচ্ছে চাঁদ

রাত থেকে নামিয়ে আনছি স্বপ্ন

তারাদের দেশে ঘুমিয়ে আছে 

নাম না দেওয়া সম্পর্ক।


উনুন ধরাও, কারফিউতে বিলি করো খিচুড়ি

ভিখারীকে দাও দু ফোটা জল

মদ ঢেলে দাও বড়বাবুর গ্লাসে


উন্নতি লুকিয়ে রাখো 

তোমার দুটো অসম স্তনের মাঝে।


সম্পর্কে জল দাও

মিথ্যে থেকে বেরিয়ে এসে...


সপ্তর্ষি বনিক কোচবিহারে বসে বাংলা কবিতা লিখছেন. সময়ের কথা সময়ের ভাষ্যে বলছেন সপ্তর্ষি. স্মার্ট অথচ সজীব, প্রাণবন্ত কথোপকথনের ছলে পাঠকের সাথে কথা বলছেন তিনি. কী এক ঘোর বিছিয়ে ধরেন এই যুবক কবিতার অক্ষরে অক্ষরে. আসলে তরুণতমরাই পারেন গতিপথ তৈরি করতে. সপ্তর্ষির আগামী সুন্দর থেকে আরও সুন্দর হয়ে উঠুক. 


••

কবিতা 


রাত্রি গভীর হলে পাখিদের কান্না পায়

গভীর ঘুম থেকে স্ত্রী কে তুলে দিয়ে তার নরম পালকের নীচে সে ঘুমায় 

গোপনে সে কাঁদে


একটু একটু করে ক্ষয়ে আসছে জীবন

ঘর, বাড়ি, আঙিনা জুড়ে গভীর বিষাদেরা নোঙর ফেলেছে

গোপনে তার কান্না পায়...


প্রতিটি মানুষের ভিতর কেউ কেউ অসহায় বাস করে

তোমার ভিতর আমি

কিংবা আমার ভেতর পাখি

যারা গাছ-পাতা-জল না পেয়ে পেয়ে অজান্তে 

একটু 

একটু 

করে

ক্ষয়ে যায়, ঝড়ে যায় রোজ...


অভ্রদীপ বসু. সে অর্থে কনিষ্ঠতম অভ্র. ওঁর লেখার আলপথ সবে তৈরি হচ্ছে. আর এর মধ্যেই স্বতন্ত্র এক ভাষা. উচ্চারণ. যেন বাস্তব, কল্পনা মিলে মিশে এক হয়ে উঠছে. ভনিতা নেই, মাছ ঢেকে রাখবার শাক নেই. স্পষ্ট. আনকাট. দিনহাটায় বসে অদ্ভুত এক কবিতাভুবন গড়ে তুলছেন নিজেরই অক্ষরে. আসলে ওঁরাই আমাদের প্রাপ্তি. 


মূলত 2015 পরবর্তী সময়ে এসেও ধারাবাহিকতা, সংযম, আগ্রহ ও ইচ্ছেশক্তি দিয়ে ওঁরা বাংলা কবিতা পরিবারকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন. এসব অক্ষর, উচ্চারণ সমসাময়িক তরুণ কবিদের থেকে পেয়ে সাধারণ পাঠক হিসেবে আমি, আমরাও শিখছি. যদিও এ চারজনই নয়. আরও অসংখ্য কলম উঠে এসেছে. আসছে. 


স্বাগত নতুন. 


বিকাশ দাস বিল্টু, রাজিব পাল, মানিক রায়, সুলগ্না বাগচী, আরণ্যক চক্রবর্তী, তুলী চক্রবর্তী, সৌরদীপ বর্ধন, দুর্গেশ বর্মন, রাহুল ঘোষ, নিশীথ কুমার সেন, মাসুদ হাসান, অমিত বিশ্বাস থেকে হিমাদ্রী শেখর... এমন সম্ভাবনাময় অনেক কবিই সেই জার্নির অক্সিজেন. 


তাই আরও একবার বলতে ইচ্ছে হয়, জয় হোক. জয় হোক কবিতার. বন্ধুতার. বৃহত্তর কবিতা পরিবারের.

 


‘মদীয় ফ্যান্টাসি’: তিলেক ডিকোডিং - মহঃ রাফিউল আলম

 

রাহেবুলদার মদীয় ফ্যান্টাসি’ পড়তে পড়তে কোথায় যেন একটা পাঠ প্রতিক্রিয়া দেবার ফ্যান্টাসি চলে এল। যদিও এত উচ্চমানের লেখায় পাঠ প্রতিক্রিয়া দেবার সাহস বা সামর্থ্য কোনোটাই নেই এই অধম পাঠকের। তবু দুস্পর্ধা দেখাবার সাহস করেই ফেললাম। আমি খুব সামান্য একজন পাঠক। পাঠক বললে অবশ্য ভুল হবে নিজেকে কবিতাবিলাসি বলা ভালো। সবার লেখা ভালো লাগেনাসবার লেখা— সবসময় পড়ে ওঠার সময় হয়ে ওঠে না বলেই হয়তো অনেক মুক্তসম লেখা আমার পরিধির বাইরে থেকে যায়। আগেই বলেছি আমি নিয়মিত পাঠক নই। কিন্তু ফেসবুক সূত্রে রাহেবুলদার লেখাগুলো চোখে পড়লেই না পড়ে থাকতে পারিনা। লেখাগুলো আমা প্রচণ্ডভাবে টানে। রাহেবুলদার শব্দ কিংবা কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাংলা সাহিত্যের বাঁক যে পরিবর্তন হচ্ছে তার পূর্বাভাস। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে শব্দগুলো ভাঙতে ভাঙতে হারিয়ে যেতে হয় কবিতার মধ্যে। তবু দুর্ভেদ্য। রাহেবুলদার কবিতা ভেদ করে ওঠার সামর্থ্য আমার মতো সাধারণ পাঠকের সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে লেখার মধ্যে আছে এমন এক মাদকতা যা সহজেই একজন পাঠককে গ্রাস করে। আর পাঁচজন কবিতার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। চলার পথটাও তাই হয়তো আলাদা। আমি যত দূর তাকে বুঝেছি সেখানে কোনো কবিতা গোষ্ঠীতন্ত্র নেই, নেই কোনো মিথ্যে আত্মবঞ্চনা। এখানেই কবি স্বতন্ত্র। উত্তর আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা সেই নক্ষত্র যাকে অস্বীকার করার জায়গা নেই। আমার বিশ্বাস একদিন এই নক্ষত্রও একটা আলাদা নাম পাবে। কবি কবিতার জন্য কবিতা লেখেন না। যা লেখেন তাই কবিতা হয়ে ওঠে। ভাষার মধ্যে মেক আপ কম। কবিতা অক্ষরে দরদের থেকে সত্যতা অনেক বেশি। তবে অবশ্যই সাংকেতিকতা। অনেকটা চর্যাপদের মতোই আলো-আঁধারি বলেই হয়তো পাঠকের কাছে পুরোটা ধরা হয়ে ওঠে না। অনেকটাই অধরা থেকে যায়।

 

তার মদীয় ফ্যান্টাসির প্রথম কবিতা মরাভরাচান্দ্‌’ কবিতার প্রথম লাইন

"কথা ছিল ভাঙার। কীরূপ কথাকাহার লগেতাহা ছিল অনুল্লেখ"

পড়েই বোঝা যায় কবির কলম থামবার নয়। যেমন ভাষাতেমন শৈলীও স্বতন্ত্র। এখানেই কবিকে আলাদাভাবে হাজার ভিড়ের মাঝেও চিনিয়ে দেয়। বইটা হাতে নিয়ে একঝলক কবিতার নামগুলো দেখলেই বুঝতে পারা যায় কবির মতোই স্বতন্ত্র তার কবিতার নামগুলো—'রিভিজিটেড: পানি, ‘অথবা কচুকাটা রাই, ‘N কোড, ‘বগা ও শর্টসার্কিট, ‘বাউলা, ‘হে, ‘পানিপট্টি, ‘লুকোছুপো লিওনি, ‘গুঁড়ো কবিতা’, ‘ডটে কম প্রভৃতি। বিষয়-আঙ্গিকও একক। বোঝাই যায় কলম যথেষ্ট শক্তিশালী। এ যেন কবিগুরুর অচলায়তন এর পঞ্চক বা শুভদ্র।

 

তার কবিতায় এসেছে যেমন আত্মবিশ্লেষণ, আবার বর্তমান অস্থিরতা সব মিলিয়ে একটা যুগযন্ত্রণা। তাই তিনিই বলতে পারেন "একটা ঘুমের কিন্তু ব্যাপক চাহিদা দ্যাশ জুড়িয়া" (রিভিজেটেড: পানি)আবার অথবা কচুকাটা রাই-এ "ভেন্টিলেটরে পুঁজ সংরক্ষণ হতে হতেই পুঁজিপতি আমি।"

তার এই কাব্যের শেষ কবিতা কুহেলি-র একটা লাইন "ফুটেজ খায় কানের দেয়াল...." সম্পর্কে আর কিছুই বলার থাকে না। অন্যদিকে ঈশ্বর-অস্তিত্ব নিয়ে তিনি বরাবরই সন্দিহান "মানুষ নির্মিত সর্ব উৎকৃষ্ট মিথ: ঈশ্বর" (ঈশ্বরের পাঠ)। কখনো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন পাঠকের কাছে কাহার লগেতা অবশ্য অনুল্লেখ—"ঘাস কাটতে ব্যস্ত ঘোড়া কী মনে করে তোমার গুঁড়ো ঘুমে?"(গুঁড়ো কবিতা)কখনো অল্পতেই খুশি থাকার প্রয়াস "মাইরি এতটুকুন লয়েই আমি তবু খুশ।" ভালো লেগেছে তাঁর আখা কবিতায়

"কতগুলি মরমিয়া আগুন পুড়ছিল একা একা।

দুই বেড়াল আর আমিতে মিলে আখার পাড়ে বসে।"

অবশ্য কতটুকু পোড়ার পর নিজেকে বিদগ্ধ বলা যায় আমি জানিনা।

তার পানিপট্টি কবিতায় "আম্মা আব্বা আমার পাশে শুয়ে— আমার কবরের পাশে শোবে তেমন?" সত্যিই অসাধারণ! যদিও তিনি বলেন "এ আবদার আদায় করেনিএ মতন ভাবছুলুম।"

 

আবার বর্তমান অস্থিরতা ধরা পড়েছে তার কবিতায় খুব সুন্দরভাবে "কেউ কোনোদিন হোঁচট খায় না দড়িতে যা সে প্রত্যহ খায় সাধের জনতন্ত্রের সদর দরজায়"(গোরুগোঁসাইজি)। "আগুন পুড়ছে" সত্যিই আগুন পুড়ছে। "সাদাসুন্দর কোয়ি আগুন" (সম্বাদ)।

"ইঁদুর দৌড় দিতে দিতে ইঁদুরকে ভুলে যায় কি একদিন?"(‘পার্থিব) জানা নেই। হয়তো বা যায়। "কোনোদিন স্টাডি করে দেখ মাংসাশী পিঁপড়ে..../বা মাংসাশী মানুষ....." (বাউলা)। "তোমার কর্পোরেট করমর্দন আজ আমায় বাউলা বানায়...." (বাউলা) এরপর আর কী বলার থাকেএক কথায় সত্যিই মদীয় ফ্যান্টাসি

 

খারাপ লাগার কোনো জায়গা নেই। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এই মদীয় ফ্যান্টাসি। আর প্রথম কাব্যগ্রন্থই প্রথম বলে বাউন্ডারি। তবে সেটা চার না ছয় আগামী সময়ই বলবে। এ তো শুধু ভালোলাগার কথাই বললাম।

এবার আসি কিছু মন্দলাগার কথায়, ভাষা-বিষয় অনেক বেশি গভীরউচ্চমানের কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় সাধারণ পাঠক কতটা নিতে পারবে! যদিও কবি কখন পাঠকের কথা ভেবে লেখেন না। লেখেন নিজের কথা ভেবে। আর পাঠকের কথা ভেবে লিখলে সেটা আর কবিতা হয়ে ওঠে না। অনেকটা তোষণ হয়ে যায়। এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তবু পাঠক বলে কিছুর অস্তিত্ব থেকেই যায়। যাকে অস্বীকার করার সাধ্য আমাদের কারোর নেই। কবিতার বিষয় ছুঁতে হয় অনেক কষ্ট করে, তাই আমার মতো একজন সাধারণ পাঠকের কাছে কবিতাগুলো কিছুটা আলো-আঁধারি মনে হয়। সবশেষে এটাই বলব কবির প্রত্যেকটা কবিতার মশাল-অক্ষর একদিন আলোকিত করবে এই বাংলা সাহিত্যকে। আর আশা রাখবো এভাবেই কবি এগিয়ে যাবেন আপন খেয়ালে এক ভিন্ন পথের দিশারী হয়ে। জানি সিসিফাস (কবির ছদ্মনাম) একদিন সেই পাথরটা উপরে তুলবেই। আর সেদিন হয়তো বেশি দেরি নেই। কবির সাফল্য কামনা করি।

আর সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অনুরাগীদের জানাই কবির মদীয় ফ্যান্টাসি হাতে তুলে নিয়ে দেখুন। নতুন স্বাদের সদ্য আবিষ্কৃত খনি। ভালোবেসে পড়ুন। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।

 

 

আলোচিত বই- মদীয় ফ্যান্টাসি

প্রকাশক- সৃষ্টিসুখ, কলকাতা

যোগাযোগ- 9051200437

 

****



 

আলোচকের পরিচিতি:

প্রথম দশক থেকে মূলত ফেসবুকেই টুকটাক কবিতা, গল্প লেখা। এখনও অব্দি কোনও বই নেই। কিছু গল্প প্রকাশিত হয় মানভূম দৈনিক সংবাদপত্রে’। একটি উপন্যাস রচনার কাজ চলছে।

 

যোগাযোগ:

মহঃ রাফিউল আলম

গ্রাম- খড়িকাডাঙ্গাডাকঘর- পাঁচগ্রামথানা- নবগ্রামজেলা- মুর্শিদাবাদডাকসূচক সংখ্যা- ৭৪২১৮৪

মোবাইল- 9732302307