Tuesday, March 31, 2020

কবিতা করিডোর , বসন্ত সংখ্যা , 2020






প্রচ্ছদ : শুভঙ্কর পাল 
চিত্রঋণ : ইন্টারনেট 
মেইল আইডি : subhabrb@gmail.com
মুঠোফোন : 9933770541
সম্পাদক : শুভঙ্কর পাল 
সহ সম্পাদক : সব্যসাচী ঘোষ 
উত্তর পূর্বাঞ্চল বিভাগের  সম্পাদক : রাজেশচন্দ্র দেবনাথ 
বাংলাদেশ বিভাগীয় সম্পাদক : ফারহানা রহমান 

সম্পাদকীয় 
এ এক গভীর সংকটের সময় বসে কবিতা করিডোর বসন্ত সংখ্যা আপলোড করা হচ্ছে । ফুলের মাস , রঙের মাস , কোকিলের কুহুডাক সব যেনো কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে । সময় যেনো থমকে দাঁড়িয়ে আছে । অথচ পৃথিবী ঘুরছে । সারা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আজ করোনার ত্রাসে ত্রস্ত । প্রতিটি মানুষ আজ ঘুমের ভিতর মৃত্যুর হাতছানি শুনতে পাচ্ছে । সে চিন্তিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে । তবুও এক অনন্তবিশ্বাস নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে । আবারো এক নতুন পৃথিবীর গান নিয়ে তারা জেগে উঠতে চায় ।  পৃথিবীর প্রতিটি শিল্প -সংস্কৃতি ও সাহিত্য আবারো মুখরিত হবে । এই বিশ্বাস নিয়েই হোম স্টেতে থাকা কিছু মানুষের কাছে কিছুটা বেঁচে থাকার রসদ এনে দিতেই কবিতা করিডোর এর বসন্ত সংখ্যার প্রকাশ । যদি কারো লেখা বাদ গিয়ে থাকে তা অনিচ্ছাকৃত । প্রকাশিত কোন লেখার দায় সম্পাদকের নয় । 
ধন্যবাদান্তে 
শুভঙ্কর পাল 
সম্পাদক (কবিতা করিডোর )
উত্তর পূর্বাঞ্চলের কবিতা 

গাছেদের রাতকথা

বিজয় ঘোষ 

আমার গাছেরা রাত জাগে।
শিশির পড়ে পাতায় পাতায়।
নগ্নগাছের পোশাক হারিয়ে গেছে উদাসীবিকেলে।

গাছের বাকলে লেখা আছে প্রিয় নাম।

গাছেদের কোনও ধর্ম নেই জেনে পাখিরাও
পারাপারে বাসা বাঁধে গাছের ডালে।

তখন নদীর দুই পারে দুটি নৌকো ভিন্ন ভিন্ন
নিশান উড়িয়ে ধর্মযাজকের পোশাক পরে নেয়।

গাছেদের পোশাক নেই।
কোনও ধর্মে দীক্ষিত নয় প্রাচীন বটগাছ।


ছায়াশরীর

কমলিকা মজুমদার

ঘুম হারা রাতে যে ছায়াশরীর
জড়ো করেছে জোছনা ফুল,
নরম আলোয় জ্বলতে দেখেছি
ঘাড়ের পাশে এক মিশকালো তিল।
অথচ এ রাত শুধু আমার ছিল,
ছিল ওই তিল আঁকা মায়াবী শরীর,
ছিল মুঠোয় ভরা ফুল পরশ।
এত আলো দূরে ফেলে রেখে আজ
বলতে পারো কেন দাঁড়িয়ে আছি
ওয়ালর‍্যাকে রাখা বাহারি মুহূর্ত হয়ে?


জনগণ

দেবলীনা সেনগুপ্ত

ওরা খাদ্য চেয়েছিল
শীত গরমে শ্রান্তি রাখার ছাউনি
জন্মের সুখ মৃত্যুর শোক
সংগমের পৌনঃপুণিকতায় ভেসে যাওয়া
গতানুগতিক সমে বাঁধা দিনকাল
এটুকু চাহিদা নিয়েই
প্রথম ও প্রধান খবর শুনতে শুনতে
আশঙ্কা এবংআশায়
দাঁত মেজে ঘুমোতে গিয়েছিল সব
ওদের দেওয়া হল
রক্ত ও মাংসের গোলক
অগ্নিময়, বরফশীতল বর্তুল
লোফালুফি খেলতে খেলতে
ওরা ভুলেই গিয়েছিল
ওরা ঠিক কি চেয়েছিল
বৃষ্টি
জীবন
অথবা রক্ত?

কিছু না বুঝেই
নয়ানজুলির ধুলোয়
মরিয়া হয়ে খুঁজেছিল আত্মচিহ্ন
এবং তারপর
ধুলো হয়ে গিয়েছিল নিজেই

ধুলোর নাম কোন তালিকায় থাকে না
যদিও, নামহীন ধুলোই শেষ পরিণতি



তৃষ্ণা 

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

সমস্ত মেঘশৈলী ভেঙ্গে যায়                 
যুগযুগান্তরের রোদ্দুর পাহারায়

অলৌকিক তৃষ্ণা গুছিয়ে         
                     শ্মশান তাপে
বৃক্ষ সন্ধি প্রথায় বুনছে স্বরধর্ম


মার্চের চিঠি 
শুভঙ্কর পাল


মার্চের শরীর , একজোড়া জুতো , একটা পুরোনো গাছের সমস্ত পাতা
এই শহরেই একটু একটু মেঘ চেঁচাতে থাকে আলোর জন্য
রাত নামার পর সুপুরি গাছের মাথায় চাঁদ ও স্বপ্ন
আর পাহাড়ে পাইনের নীচে আমাদের ক্যাম্প ফায়ার
বাদামি আগুনে পুড়তে থাকে রাতের খাবার
প্লেটের কানায় কানায় ক্ষুধার স্যালাড  শশা গাঁজার কুঁচি
আলগোছে নিজেকে সমর্পণ করি আলগা শরীরের ভিতরকার
বিভাজন একান্তই ব্যক্তিগত
প্রেমিকার চিঠি আমাকে সীমান্তের গান শোনায়
নরম চাঁদেলা ছায়ার ভিতর বুনো হাঁস ভিড় করে
রাত্রি আরো দৃঢ় হলে বরফের স্ফটিক একটু একটু জিভ দিয়ে শুষে নিই
বয়সের সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে যাই চাঁদের হা -মুখের ভিতর
এখন নদীরা নেমে যাবে , বয়ে নিয়ে যাবে যেটুকু সঞ্চয়
গোলাপের দিন , ঘুমের বালিশ সিনেমার নায়কের  দৃষ্টিভ্রম
ঘুম পাড়ানি লাল নীল দেবতাদের উৎসর্গ করে
কিছু উপহার নৈবেদ্য সাজিয়ে নিশ্চুপ ভুট্টার ক্ষেতে দেবীরা মুখ লুকায়

আঁধার লিপি


রঙ্গন রায়


টোটো গুলো এতো তাড়াতাড়ি চলে আসে 
আমাদের অপেক্ষা ফুরিয়ে যায় , 
এই যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রতিটি মানুষ 
কত দুঃখকে বুকের ভেতর কবর দিয়ে 
মুখে সাদা কাফনের মত হাসি টেনেছে ... 
আসলে ইদানীং আনন্দের সাথে সম্পর্ক 
ঝিমিয়ে এসেছে প্রতিটি মানুষের - 
রাস্তার গর্তে জমে থাকা জলে যেভাবে 
চাঁদের আলোটুকু বেঁচে ...
তুমিও তো একটার পর একটা টোটো ছেড়ে দিতে পারো 
আরোও কিছু সময় আমরা রাস্তায় থাকতে পারি ... 
আমাদের শহর ভ্রমণ শেষ হয়নি এখনো । 
এসো , আরোও কিছুটা পথ অন্তত রাস্তার মত বাঁচি 

রাহুল গাঙ্গুলী



বৃত্ত থেকে প্যারাবোলা

-----------------------------------------------------------------
কয়েকটা বিন্দু ~ ক্রমাগত সরলরেখা বুনছে
কয়েকটা সরলরেখা
                     ক্রমশ চোখের ব্যাসার্ধ 
                     ক্রমশ কয়েকটা ঘুড়ি
                     যেন _______
চোখের ভিতর পুড়ছে সাজানো আগুন
আগুনের স্পর্শে ~ পোড়া ঘুড়িটার কোষ

আবহমান সময়ের প্রস্তুতি
                             প্রসূতি এলোমেলো 






১টা গ্রহণ মুহূর্তের ছবি
-----------------------------------------------------------------
মুখোমুখি হলেই @ ঝড়
জানি না।কতোটা অসুখ হলে
                   মাংসল ক্রিয়াপদ সন্ন্যাসী হয়ে ওঠে
অনভ্যস্ত ঝড়ো পূর্বাভাষ
শূন্যতা ভেদ করে চিঠির চলাচল

অযথা চুপিচুপি ______
ঘোর কাটলে ~ তলাতল চুষছে মিথোজীবী ব্রহ্মাণ্ড

তপোব্রত মুখোপাধ্যায়ের কবিতা 


।।দোর।।

কিছু চাওয়া একাত্ম হলে
আমরা ঘরে ফিরে আসি;
দুয়ারে দিই খিল।
তিলমাত্র চাওয়াখানি -- তবু
সেটুকুই কাছে রাখিবার বলো কি উপায় হে,
হে প্রাণসখা :

পিছন ফিরে দেখি কেউ নেই। একলা মাদুর
কেউ যেন আসবে ভেবে ক্রমে ধুলোটে

এযাবৎ খুলে রাখা বুক,
সযতন, ঢাকবার এই কি সময়?
নিতান্ত কাঙালী ঘরে দোরটুকু, হে সখা
লক্ষ্মীসাঁঝের আলপনা -- হোক সে জলের...


।।একটা মানুষ।।

ঈশ্বরের মতো
একটা মানুষ
হেঁটে রাস্তা পার করছে।

রাস্তায় জমা পিচ
উপরে কুয়াশাস্তর।

ঈশ্বরের মতো নিঃশব্দ একটা মানুষ --

...পেরিয়ে আসতে আসতে নিজের ছায়াটুকু
রাখলাম মানুষের গায়ে...
ঈশ্বরের মতো

একটা মানুষ
ঠিক কতদূর
পিছিয়ে পড়ে থাকে
রাস্তায়, কেউ
অভ্যস্ত, ফিরে দেখে না।


।। যতদূর কথা থাকে ।।

যতদূর কথা থাকে, ততখানি অপেক্ষা থাক

রসনায় জড়িত শব্দ। আগুন হয়ে উঠলে
এখনি খাক হয়ে যেত সব।

অথচ দূরত্বসীমা কাঁটাতার দেখায়,
বিকেল, কিংবা ঝরাপাতার সমার্থক --
.
গন্ধ ছড়ালে ধূপের আগুনটুকু নিভিয়ে ফেলা যাবে

শ্রদ্ধাবনতঃ,



অমিতাভ প্রহরাজের লেখা পাঠ প্রতিক্রিয়া 

জুনিয়রকে লেখা চিরজুনিয়রের খোলা চিঠি-১৭

যাক আমার লেখার ক্লাস তোরা দেখছি একেবারে বৈধ ও পাকাপোক্ত সীলমোহর মেরে দিলি। এ এক অভাবনীয়। বিশ্বরূপ (বিশ্বরূপ বিশ্বাস) কে লেখা নিয়ে ক্রিটিসাইজ করতে গিয়ে খোলা চিঠিগুলি লেখা শুরু করি। আমি ভাবিওনি তার এমন প্রবল রেসপন্স আসবে ইনবক্সে। আমি "লেখা শেখাই" এই দুর্নাম তো আজকের না, বহু বছরের। টু বি ভেরি প্রিসাইজ ২০০৫ থেকে। তা এইরকম প্রকাশ্যে লেখা সম্পর্কিত এইসব ছুপি ছুপি কাজগুলি আনবো, এ স্বপ্নেও ভাবিনি। স্যালুট আমাদের পরের ও পরের পরের প্রজন্মদের যারা এক অলৌকিক খোলার মন নিয়ে এসেছে, প্রি কনসিভড নোশান কমিয়ে রাখার প্রবণতা সহ দার্শনিক পড়াশুনো, তত্ত্ব তর্জা এইসব সরিয়ে লেখার মূল ধুকপুকিটি মুঠোয় নিতে চেয়েছে। লিখে তারা আনন্দের ধ্বকধ্বকখানি বোধ করতে চায়, আর কিছু না। যাক, এই চিঠিতে আমি আমার দশকের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ একজন কবি ও তার লেখা নিয়ে কিছু কথা লিখছি। পড়ে দেখ তোদের কেমন লাগে জানাস। কবির কবিতা আর কবিতা নিয়ে কথাগুলি, দুটোই জানাস। 

কাব্যসব্য-

শূন্যের কবিদের মধ্যে সব্য আক্ষরিক অর্থে ডিসটিঙ্কট এবং আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় শূন্যের একমাত্র সব্য যার নিজের লেখকী খুব স্পষ্ট ভাবে ডিফাইন্ড আছে। লেখকী আমি গায়কীর কনসেপ্ট থেকে বললাম। নিজস্ব স্টাইল বহু কবিরই আছে, ইন ফ্যাক্ট থাকাটা জরুরীও আর স্টাইলাইজড হতে গিয়ে ম্যানারিজমের প্রকোপ আমরা আদিকাল হতে দেখে এসেছি। ঘরানা বা আন্দাজ, এও সংখ্যায় অল্প হলেও অনেক কবির লেখায় পাওয়া যায়, যেমন বহরমপুরের জয়দীপ মৈত্র, বা অত্রি বা শূন্যে এলে অরূপরতন ঘোষ, অরূপ ঘোষ, অতনু, সংঘমিত্রা এরকম কিছু উজ্জ্বল নাম। কিন্ত স্টাইল, আন্দাজ, ঘরানা, ফ্লেভার এই সবের থেকে আলাদা একটা জিনিস হলো লেখকী। 
লেখকী গড়ে ওঠে একের বেশী ঘরানার স্কুলিং এ থেকেও যখন কেউ নিয়মিত রেওয়াজের মধ্য দিয়ে এক নিজস্ব নিরাকার সিগনেচার গড়ে তোলে। এ যেন অনেকটা লেখার গন্ধের মতো। একটা সিমিলি বললে বুঝতে সুবিধে হবে। গন্ধরাজ লেবু লেবু ভাষার মায়া ছড়ানো, এটি হচ্ছে স্টাইল। লেবুফুলের মতো শব্দ যখন তখন ঝরে পড়ছে এ হচ্ছে আন্দাজ বা আদাহ বা পেশকশ। আর লেবুর গন্ধ ভেসে আসছে যে লেখা থেকে সেটা হলো সেই লেখকীর গুণ। লেখকী গড়ে ওঠে মূলতঃ একক বা খুব বেশী হলে একজন কি সঙ্গী নিয়ে এক বিস্তীর্ণ রিওয়াজের পদ্ধতি অবলম্বনে। তার আগে স্কুলিং এর যা যা নেওয়ার জানার সমস্ত সম্পূর্ণ করে নিয়ে, দুটো কি তিনটে ভিন্ন ঘরানার স্কুলিং এর নির্যাসগুলোর নানান এ্যামালগামেশান থেকে শুরু করে। এই পদ্ধতিতে অতি অতি পরিমানে লেখার ক্ষমতা থাকা বাধ্যতামূলক, আর এটা তো বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না যে লেখার দীর্ঘমেয়াদী রেওয়াজে ঢুকতে হলে লেখা "প্রকাশ" সংক্রান্ত সমস্ত মোহ ধ্যান ধারণা ঝেড়ে ফেলতে হয়। সব্যর জার্নি, সব্যর রেওয়াজ আমি শুরুর থেকে দেখে আসছি যখন ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা মস্করা হতো রীতিমতো। ভালোপাহাড়ে এক মহুয়ার আসরে ওকে বলেছিলাম, শোন তুই এই যে শব্দকে ধ্বনিত করতে চাইছিস ডিরেক্টলি, ছবিকে বাজাতে চাইছিস শব্দে, এটা থামাস না। আমি কোনো হনু নই এজাতীয় উপদেশ দেওয়ার তবে আমার তখন মনে হয়েছিলো হাল্কা হলেও সব্য লেখাগুলির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে স্লাইট হলেও চিন্তায় আছে। এই চিন্তা পরে কেটে গিয়ে এক অনবদ্য কনফিডেন্সের জন্ম দেয় প্লাস এক আদ্যন্ত সায়েন্টিফিক এ্যাপ্রোচ নিয়ে ফেলে লেখার। যার সাথে ভ্রমণকে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে রাখে। নীচের লেখাটি সব্যর কবিতার সাথে ট্রেকের ফসল। এই লেখাটিতে আমি সব্যর কবিতার প্রত্যক্ষ্য কোনো অংশ না কোট করে বা বলে, চেষ্টা করেছি সব্যর লেখা পাঠের অভিজ্ঞতাটি ক্রিয়েট করার।

একটি লেখা শুরু হচ্ছে-

সব্য- বেবীদা, পেয়েছো?
আমি- হ্যাঁ রে পেয়েছি, আর গতকাল থেকে লিখছি... তোর সবগুলো বইই একসাথে রেখে একটা দুরন্ত অবজার্ভেশান এসেছে, ওটাই লিখছিলাম... মানে চেঞ্জগুলোর প্যাটার্নে.. আর এমন একটা জোনে কাজ করেছিস আর মুভ করেছি যেটা পুরো ওই ম্যাজিক দোলনার মতো লাগে... মানে বিস্তার তোর যেকোনো বিবর্তন-বন্ধ-নাকরা-লেখক মাত্রেই করে... জোন বাড়ায়, আলোকিত অঞ্চল বাড়ায়.... সেটা করার দু রকম টেকনিকের মধ্যে কোনো একটা ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে ব্যবহৃত টেকনিকটি হলো
১) আলোর উৎস যেটা সেটা একটু একটু করে পেছনে নিয়ে গেলাম। তাতে আলোকিত জোন টা বড় হতে হতে যায়। পেছনে বলতে আমি বলছি উঁচুর দিকে পেছনে... নীচে বৃত্তটা বাড়তে বাড়তে থাকে। এট একটা টেকনিক। সহজ কথায় বললে পেছনে সরতে সরতে আসাটা হচ্ছে নিজের লেখার সমস্ত অভিজ্ঞতা দক্ষতাকে ব্যাকট্র্যাক করে নিয়ে যাওয়া। 
এক্সাম্পল হচ্ছে, আমি গাছ দেখলাম। গাছটি আলোকিত করলাম। আরেকটু ওপরে উঠলাম, দেখলাম জঙ্গল। আরেকটু ওপরে উঠলাম, দেখলাম রাজ্য ও রাজ্যের জঙ্গলমহল। আরেকটু ওপরে উঠে দেখলাম দেশ। তারপর পৃথিবীর সবুজ। এভাবেই বিস্তার বাড়িয়ে জগৎ এর সাথে সংসার করা।

২) এছাড়া আরেকটি যে টেকনিক, সেটির জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হয় সাহস আর কৌতূহলের। সেখানে আমি নিজেই একটি আলোর উৎস হয়ে ভ্রমণ শুরু করলাম। এখানে কোনো উচ্চতার ব্যাপার নেই। আছে ভ্রমণ, আমি যতো জানা জায়গা বাড়াচ্ছি, তার সাপেক্ষে অজানা জায়গা বেড়ে যাচ্ছে ততো। অজানা বাড়াচ্ছি আমি জেনে জেনে। এবং এক্কেবারে নিপাট অজানার মধ্যে লাফ দিচ্ছি আলোর উৎস হয়ে। ফলে প্রত্যেকটা সময়ে প্রত্যেকটা নতুন অঞ্চল আলোকিত হচ্ছে। ক্রমাগত মুভ করছি আমি কোনো সেন্টার না রেখে। স্থা এর বিপরীতে আমি চলমান রয়েছি কেন্দ্র অস্বীকার করে। তোর লেখাগুলোর মধ্যের এই অসম্ভব মুভমেন্ট যা এক প্রবল সাহসী এ্যাডভেঞ্চার স্বরূপ যেন বোধ হয়। 

এতক্ষন সব্য বা সব্যসাচী হাজরাকে বলছিলাম কথাগুলো, এখন আমি সরে এসে আপনাকে বলছি। আপনার সাথে কথা বলি এবারে। সব্যসাচী এভাবেই আক্রমণ করে যেভাবে আমি আপনাকে এই লেখাতে করলাম। আর আপনি হঠাৎ জানতে পারলেন আমি আপনার অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল থেকেই কথাগুলো বলছিলাম প্রথম থেকে। আপনি ভাবছিলেন আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছিনা, বা স্বীকার করছি না। বরং উলটো, আমি আপনাকে আমার আর সব্যর দুজনেরই চোখ দিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। সব্যর কবিতায় এমন এক ইল্যুশান তৈরী হয় যে ও হয়তো পাঠক বা উল্টোদিকের লোকের কথা চিন্তাই করছে না। যাঁরা সহজ পাঠ বা দ্রুত পঠনে অভ্যস্ত তাঁরা এই ছাপ্পা মেরে দেন, এখানে পাঠকের কথা মাথাতেই রাখছেন না কবি। সব্যর কবিতা এই মজার ইল্যুশানে আপনার ডেপথ বা গভীরতাকে চ্যালেঞ্জ করে। আপনি গভীর বা গহীন কিভাবে বোঝেন একটি লেখায়? স্বাভাবিক পদ্ধতি হলো আপনার সামনে দুটো মেলে রাখেন, অগভীর আর গভীর। তুলনামূলক বোধ বা তফাৎবোধ থেকে পান গভীরতার সংজ্ঞা বা দর্শন। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন একটি পাথর চূড়ায় আর দেখছেন একদিকে সমুদ্রের জল জমে আছে, আর একদিকে সমুদ্র আর বুঝছেন সমুদ্রের গভীর কেমন বিস্তৃত। এবার চোখ বন্ধ করে ধরে নিন আপনি পাথরচূড়ায় নেই। আপনাকে একজন অলৌকিক স্কুবা ডাইভার সমুদ্রে নামিয়ে এনেছে। আর আপনাকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে। আপনি দেখছেন প্রথম স্তরে কেমন সূর্যের আলো ঝাপসা হয়ে ঢুকছে। আরো গভীরে মাছের ঝাঁক পার করে যাচ্ছে আপনাকে। আরো আরো গভীরে আলোর খুব অল্প রশ্মিফোঁটা ছুঁয়ে থাকছে। তারপরে দেখছেন ইল মাছের সর্পিল। সামনে আছে কোরাল প্রবাল দু ভাই। 
“সামনে” আছে বললাম খেয়াল করলেন? নীচে আছে বলিনি কিন্তু। আপনি যখন গভীরতার জার্নির সঙ্গী হচ্ছেন তখন আর “উপর” “নীচ”, “অগভীর”, “গভীর”, “গভীরতর” র অস্তিত্ব থাকে না। থাকে না শুরু আর শেষ। থাকে শুধু জার্নি বা ভ্রমণ। বাংলাভাষায় এরকম ভ্রামক লেখার এক ও অদ্বিতীয় শিল্পী সব্য। সব্যর কবিতা আপনাকে কোনো তুলনামূলক আচার আচরণ মাপকাঠি এসবের থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে প্রথমেই। আপনার চোখ কান কে পা পরিয়ে দেবে বেড়ানোর। তারপর আপনি যাত্রা শুরু করবেন ওর সাথেই। আর এটা ও করবে অচানক। আপনি ওর কবিতা পড়তে থাকবেন, ভাববেন ও বোধহয় আপনাকেই গ্রাহ্যই করছে না, লক্ষ্যই করছে না। আসলে সম্পূর্ণ উলটো, ও আপনাকে লেখা ও লেখকের দুজনের চোখ দিয়ে জড়িয়ে নিচ্ছে বুকে, আপনার অজান্তে আপনাকে ঢুকিয়ে নিচ্ছে এক জগৎমাঝারে। এবং এই লেখার মতোই, এক জায়গায় আপনি যখন ভাবছেন যে এখানে বোধহয় দুটো আলাদা লোকের মধ্যে কথোপকথন চলছে কবিতা স্বরূপে, আপনি এক দর্শক মাত্র, আপনাকে আক্রমণ করবে দৃশ্যধ্বনি একসাথে আর আপনি বুঝবেন আসলে আপনি এতক্ষণ অংশ “গ্রহণ” করে চলেছিলেন অজান্তেই। আর তারপর শুরু হবে ওর ট্রেক। ঠিক যেমন এই লেখাটার শুরুতে কোনো নাম নেই, কোনো ভূমিকা নেই, দুই ভিন্ন মানুষের কথপকথন থেকে শুরু আর এখন আপনি এতে গ্রস্ত হয়ে গেছেন। সব্যর কবিতা এভাবেই গ্রস্ত করে পাঠককে। শুরুর বিন্দু থেকেই জড়িয়ে নেয় কিন্তু প্রকাশ্য বোধে আক্রমণ করে একদম অচানক। কবিতা যে ডেপথ থেকে আসে, সেই ডেপথ ও আপনাকে সঙ্গী করে নিয়ে “ঘটাবে”। “বোঝাবে” বা “দেখাবে” না। সব্যর কবিতা চলমান, সর্বদা। তাই সব্যর কবিতায় কোনো দৃশ্যকল্প নেই, দৃশ্য রয়েছে। অদ্ভুত লাগছে কথাটা। এই মুহূর্তে কি আপনার সামনে দৃশ্য নেই? শব্দগুলো, অক্ষরগুলো কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? এখানে কি ছবি নেই, সাদা প্রেক্ষাপটে কালোয় আঁকা? যদি নেই তো আপনি কার দিকে তাকিয়ে আছেন এখন? এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন দৃশ্য আর দৃশ্যকল্প, ধ্বনি ধ্বনিকল্পের তফাৎ। সব্যর কবিতায় কোনো কল্প নেই, দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন সোজা, ধ্বনি আপনি বাজছে শুনবে। যেমন ঢং লিখলে আপনি ধ্বনি শোনেন, আর “ঘন্টার গম্ভীর ধ্বনি” বললে নিজেকে একটা ধ্বনি শোনান। যেমন “ব” লিখলে একটি  ত্রিভুজ দেখতে পান আর “ব-দ্বীপ” লিখলে নিজেকে ত্রিভুজ দেখান। সব্য এই আপনাকে দেখানো, আপনাকে শোনানোর জগৎ এর নয়। ও শুনবে সাথে আপনাকে নিয়ে, আপনিও শুনবেন সেই ধ্বনি যা ও শুনছে। আপনিও দেখবেন সেই দৃশ্য যা ও দেখছে। এ এক অসীম লেভেলের চ্যালেঞ্জ যাতে মাথার গভীরতমতে জন্মানো যে মূল নিরাকার বোধ নির্মিত কবিতা, তাকে ইন্ট্যাক্ট আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার। 
আমরা যখন কোনো কিছু প্রকাশ করি (লেখা কবিতা ইংকু পিংকু মিংকু যাইই হোক) তখন প্রথমে প্রকাশভাবনা, তারপর প্রকাশভাষা হয়ে প্রকাশিত এই রুটে আসে। মানে ভাবনায় প্রথম প্রকাশিত হয়, তারপর ভাষায় প্রকাশিত হয়, এবং সবশেষে ভাবনা, ভাষা এইসবের ওপর নির্ভরতা ছেড়ে, আমার ওপর নির্ভরতা ছেড়ে একা স্বয়ং শ্রী প্রকাশিত আসেন যাকে আপনারা চর্মচক্ষুতে দেখতে পান। বাকি সমস্ত কবি ও লেখকের কাছে আপনি প্রবেশ করেন ওই স্বয়ং শ্রী প্রকাশিতর জন্ম মুহূর্তে। আর সব্য, একমাত্র আই রিপিট এই মুহূর্তে একমাত্র কবি যে ওই আগের বাক্যটার শুরু থেকেই আপনাকে সঙ্গে নিয়ে চলে। খুব সোজাসুজি বলতে গেলে এই সময়ের সবচেয়ে অসমসাহসী ও ডিসটিঙ্কট কবি বলতে আমার সব্যর নাম প্রথম মাথায় আসে। সাহস আর ভ্রমণ একসাথে মিলিয়ে যে এক অপরূপ সৃষ্টি জগৎ নির্মাণ করে আপনাকে বোধ করানোর জন্য। পড়ানো বা শোনানো বা বোঝানো বা ভাবানোর জন্য নয়। 

-অমিতাভ প্রহরাজ

সব্যসাচী হাজরার এযাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- তৃতীয় ফ্লাওয়ার শো, ওভ্যানোর ওভেনে, পসিবিলিটি ও টিলিবিসিপ, উটবিকার(প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকাশ), ৯ আঁকা ০(প্রদীপ চক্রবর্তীর সাথে যৌথ), আনুপাহাড়ের জলছবি, ঝরাপাখিদের চেকমেট, নির্বাচিত শূন্য।

দশক: শূন্যদশক।

ঠিকানা: ৪৯ আলিপুর রোড কলকাতা ২৭

যোগাযোগ : ৯৮৩০৫০৩১৩৬
দাঁড়াবার জায়গা 
পৃথা চট্টোপাধ্যায় 


কোথাও একটু দাঁড়াবার জায়গা নেই 
অথচ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তোমার গা
গনগনে রোদ মেখে  সেই  থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোমার পাশেই
তোমাকে শীতলতা দিতে পারি না 
দিতে পারি না দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও

সাধ আর সাধ্যের টানাপোড়েনে ভর করে 
স্বপ্নে এগিয়ে  আসছে ঘরদোর 

কেমন যেন ভয় করে
হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে উড়ছে তোমার রেশমি চুল
আশরীর আমি লুকোতে চাই 

কারণ আমারও দাঁড়াবার জায়গা নেই 
আমারই দেশের মাটিতে 
                 



প্রজাপতির দুঃখ আঁকতে চাই নি 


শস্যচাষের গভীরে কোনো বিশ্বাস খুঁজি না
কারণ ,বিশ্বাস সবসময় বিশ্বাসী হয় না।
একটা জলছবি আঁকা মেঘ 
পুষে রেখেছি বুকের খাঁচায় 
মেঘ তো একদিন বৃষ্টি হয়ে করবেই

জানো এই অসময়ে হিমেল হাওয়ায় 
উড়িয়ে দিয়েছি অজস্র প্রজাপতি 
শব্দের মিছিলে তারপর ছাড়িয়েছি সীমানা
মধুমাস রঙের আবীরে ফিরিয়ে দিয়েছে 
জমাট প্রজাপতির দুঃখ 
অথচ আমি তো প্রজাপতির দুঃখ আঁকতে চাই নি 
শুধু চেয়েছি ঘাসের গালিচায় আসুক আমাদের নবজাতক ।
দূরত্ব (অণুগল্প)   
জয়ন্ত দত্ত


আজকাল বিতান একটুতেই মাথা গরম করে ফেলে।একটা প্রশ্ন করলে চিৎকার করে দশ টা উত্তর দেয়।রমা দেবী বেশ কদিন ধরেই লক্ষ্য করছেন ছেলের এমন আচরণ।বিশেষত যবে থেকে কলেজ যাওয়া শুরু করেছে।একটু অগোছালো ভাব।বই পত্তর ,ল্যাপটপ, সিডি সব এদিক ওদিক ছড়ানো।এরমধ্যে একদিন রমাদেবী স্থির করলেন ছেলের জিনিসপত্তর সব কিছু গোছগাছ করে রাখবেন।ছেলেও হয়তো এতে খুশি হবে।সেইমত পড়ার টেবিলের ওপর সব গুছিয়ে রাখলেন।সন্ধ্যেবেলা বিতান কলেজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে একদম চুপচাপ।রমা দেবী ভাবলেন, যাক ছেলে বোধহয় খুশিই হয়েছে।

কিছুক্ষন পর হঠাৎ বিতান রুদ্র মূর্তিতে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসে --'মা -মা --কতবার বলেছি আমার জিনিসপত্র ঘাঁটবে না।একটা গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পাচ্ছি না।তুমি কি আজকাল আমার কথা বুঝতে পারো না!'
রমা দেবী বিষণ্ণ মুখে বলে ওঠেন --'নারে,সত্যিই বুঝতে পারিনা।তুই যখন ছোট ছিলিস,কথা বলতে পারতিস না,তখনই বেশি বুঝতাম তোকে।তুই যত বড় হয়ে উঠছিস,  ততই সব কেমন  অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যেন আজকাল।যতদিন মা ছিলাম বেশ বুঝতাম।যবে থেকে তোর বাবা হওয়ার চেষ্টা করছি ,সেদিন থেকে সব বুঝে উঠতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।'

বিতান কি বলবে ভেবে পায় না।কাছে এসে মা-কে জড়িয়ে ধরে।দুজনের চোখেই জলের ধারা।সাক্ষী থাকে কেবল সামনের দেওয়ালে টাঙানো মালা দেওয়া একটি অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি...

ভাতের থালা

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়



ভাতের থালায়
একটা ছেঁড়া ভারতের ম্যাপ


ভাতের থালা নিয়ে ভাবি
এটা কার ?
আমার না আমার মায়ের ?


ভাতের থালা ধুচ্ছি
অথচ খিদেটা সেই আগের মতোই 


ভাতের থালায় রোদ পড়তে দেখি
গিজগিজ করছে মানুষ


ভাতের থালা হাতে নিলেই
আমার দেশ ভারতবর্ষ ।


ভাতের থালা কথা বললে
পাঁচমাথার মোড়ে ট্রাফিক জ্যাম ।




অপেক্ষার রঙ লাল




ঠোঁটে ঠোঁট রেখে যে সন্ধে এলো
আমি তার দুয়ার খুলে বসে থাকি থাকি

ছাই রঙের আকাশ বলে গল্পের একঘেয়ে সুর
হাওয়ায় অস্থির পাতার মতো দুলতে থাকে পা
সাতসকালে বড় বিশ্বাসে ডাক পেয়েছিল যারা
তারা অনেকেই চাঁদোয়ার নিচ থেকে সরে গেছে

আকাশের ক্যানভাসে যা কিছু সাজানো
তারা সবাই প্লাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায়
সময় হলেই গাছতলা থেকে সরে যাবে শুকনো পাতা
কানে আসবে কচিপাতাদের গান

খোলা দুয়ারে সাজানো আল্পনার গল্প শুরু হলেই 
কোথা থেকে উড়ে আসা পাখি বলে যাবে 
অপেক্ষার রঙ লাল ।


ফারহানা রহমানের গল্প 

সোলমেট 


ঘুমের ঘোরেই বাঁহাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ‘কয়টা বাজে? উরে বাস! ১১টা বেজে গেছে?’ পাশ ফিরে ইমরানকে দিনের ফার্স্টহাগ দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু বিছানায় ওকে পেলাম না। হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। আরেকটু চোখ বুজতেই আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। এবার ফাইনালি উঠতেই হলো। দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে। ওয়াশরুমে যেতে হবে। অবাক হলাম। ওয়াশরুম খালি, বিছানায়ও সে নেই। তো গেলোটা কোথায়? বাইরে গেছে? এই সাতদিনে তো একবারও আমাকে ছাড়া কোথাও এক মুহূর্তের জন্যও যায়নি। কী জানি আজ হয়তো খুব জরুরি কোনো প্রয়োজন পড়েছে, তাই বের হয়েছে।
আজকে ১৩ অগাস্ট! আমার জন্মদিন। মাত্র সাতদিন আগে আমি ও ইমরান একই ফ্লাইটে সিডনি থেকে বাংলাদেশে এসেছি। নান্নুর মুমূর্ষু অবস্থার খবর পেয়ে মাম্মি তিনমাস হয়েছে ঢাকায় এসেছে। আমিও গত ৩৬ বছরে দেশে আসিনি বলে আত্মীয়স্বজনরা চাইছিল দেশে আসি। মাম্মিও বারবার রিকোয়েস্ট করলো। ভাবলাম, যাই একবার নিজের দেশটাকে দেখে আসি। পাপাকে বললাম আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য।  কিন্তু পাপার সময় হলো না। অগত্যা একাই রওয়ানা হলাম।
পোর্টহোল উইন্ডো সিটটা আমি নেটে আগেই বুকিং দিয়েছিলাম। ভারী মেঘের ভেতর দিয়ে দ্রুত প্লেনটা সিডনির আকাশ ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। অভ্যাসবশত উইন্ডোর দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নিচের দিকে তাকাই। অবাক হয়ে দেখতে থাকি চোখের সামনে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে বিস্তীর্ণ পশ্চিম মালভূমি ও গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জের উঁচুনিচু সবুজ পর্বতমালা। শাপের মতো একেবেঁকে ছোট হতে হতে হারিয়ে গেলো মারি ও ডার্লিং নদী। এভাবে অনেক অনেক উঁচুতে উঠে গেলো প্লেনটি। এবার নিচে শুধু উঁচু উঁচু পাহাড়ের মতো মেঘের স্তূপ। চেনা পৃথিবী ছেড়ে চলে এসেছি যেন কোনো এক অচেনা মেঘের রাজ্যে। সিটবেল্ট খুলে রিল্যাক্স হয়ে বসলাম। আমার পাশের সিটটাতেই ইমরান বসেছিল। ওকে দেখেই আমার প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের ভেতর কেমন এক অচেনা অনুভূতি বোধ করলাম। ওর চোস্ত ইংলিশ প্রোনাউন্সেশন। গমগমে ভয়েজ। এমন গভীর ব্লু আইস আগে কখনো এভাবে খেয়াল করেছি বলে মনে পড়ে না। এমন হালকা টেনড স্কিনের গ্রিক দেবতার মতো পেটানো শরীর! আহা! যখন-তখন প্রেমে পড়ার মতো নারী আমি নই, অথচ ইমরানকে দেখে মনে হলো যেন প্রেমে পড়ার জন্যই মুখিয়ে ছিলাম।
পরিচয় পর্বের ধার না ধেরেই শুরু থেকেই ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা বলতে লাগলো ও। বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি খেয়াল করলাম আমাদের দুজনেই প্রিয় বিষয় স্পোর্টস, সিনামা ও ট্রাভেলিং। প্রিয় লেখক মপাসাঁ, হুগো, মিলান কুন্ডেরা, সালমান রুশদি, গ্যাব্রিয়াল গারসিয়া মার্কেস, বোর্হেস, কোর্তেজসহ অনেকেই। ল্যাটিন অ্যামেরিকার কোথায় কোথায় ট্র্যাভেল করে ইমরানের কেমন লেগেছে, কলাম্বিয়ায় মার্কেসের ‘কাসা ডি গ্যাব্রিয়াল গারসিয়া মার্কেস’ বাড়িটিতে বেড়াতে গিয়ে ওর অনুভূতি! চিলিতে ব্ল্যাক আইল্যান্ডে নেরুদার প্রিয় বাড়ি ইস্লা নেগ্রা দেখতে গিয়ে নীল সাগরের অজস্র ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যাওয়ার তীব্র আকুতি। পেরুতে লস্ট সিটি অব ইনকাস বা ইনকা সভ্যতার  মাচ্চুপিচ্চু দেখতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা আর পুরনো শহরের গন্ধ মাখা শহর মেক্সিকোর রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। এই সবই ছিল আমাদের সিমিলার অনুভূতির জায়গা। আমাদের সিংক্রোনাইজেশন এক কথায় দারুণ ছিল! ওর নাম যে ইমরান খান আর ও যে পাকিস্তানি সেটা ও সরাসরি না বলে আমাকে বেশ কিছু পাজল দিয়েছিল এবং আমি একসময় আবিষ্কার করি ওর নাম ও পরিচয়। ও পাকিস্তানি শুনে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আমি বাংলাদেশি শুনে ইমরান খান রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়েছে মনে হলো। মনে হলো ওর চোখের কোণায় এক মুহূর্তের জন্য তীব্র ঘৃণা আর বিষাদের এক তীক্ষ্ণ হিংস্র ছায়া দেখলাম। যদিও পর মুহূর্তেই সেটা উচ্ছ্বাসে পরিণত হলো। আমি নিজেকে একটু গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমরা দুজনই বিজনেস ক্লাসে ট্র্যাভেল করছিলাম। ওর কথা শেষ হয়ে গিয়েছে মনে করে এবারের দ্য ম্যান বুকার পাওয়া উপন্যাস ‘মিল্কম্যান’ খুলে পাতা উলটাচ্ছিলাম। বইটি পড়া শুরু করবো এমন সময় ইমরান দাঁড়িয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে অফিসিয়ালি হ্যান্ডশেক করে বললো, আমি ইমরান খান, আই এম রানিং ৩৮ ইয়ার্স ওল্ড। অ্যান্ড আই ফিল সো লাকি টু ইন্ট্রডিউস মাইসেলফ উইথ ইউ।
—সেইম হেয়ার, আই এম এফ্রোদিতি।
—দ্য গডেস অব বিউটি, ডেসায়ার, অ্যান্ড লাভ? ওয়াও, নাইস টু গেট ইউ বিসাইড মি, গডেস।
এইসব ছোট ছোট্ট ব্যাপারকে কী করে এতটা আর্টিস্টিক করা যায়, সেটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আর এ কারণেই বোধহয় আমি ইমরানের প্রতি টেম্পটেড ফিল করি।
আমি যে কখনো আমার সোলমেট খুঁজে পাবো ভাবতেই পারিনি। ধরেই নিয়েছিলাম আমাকে সারাজীবন একাই থাকতে হবে। শুধু জৈবিক প্রয়োজনে বিয়ে করা বা কারও সঙ্গে থাকার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আসলে বিয়ে নামক এই বাতিল কনস্টিটিউশনের প্রতি আমার প্রবল আপত্তি আছে। আমার মাম্মি-পাপা ব্যারিস্টারি পড়তে যখন প্রথম মেলবোর্নে যান, আমার বয়স মাত্র একবছর। পরে আমরা সিডনিতে স্যাটলড করি। এখন আমি ৩৭। আমি নিজেও একজন ক্রিমিনাল লয়্যার। ২০ বছর বয়সে প্রথম আমি বাসা থেকে বের হয়ে স্টিভের সঙ্গে শিফট করি। কিন্তু সেটা মাত্র ছয় মাসের জন্য। এরপর একদিন এপ্রিলের এক বিকেলে, শরতের অপরূপা আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল সেদিন। মিষ্টি রোদে ছেয়ে গেছে প্রকৃতি। হাল্কা শীতের ছোঁয়া বাতাসে। আমরা দুজন ব্লু মাউন্টে ট্র্যাকিং করতে বের হলাম। মনে আছে দুজনেই ম্যাচ করে ব্লু পোলো ভেস্ট আর জিন্স পরেছিলাম। আসলে আমরা সবসময় একই কালারের ড্রেস পরতাম। আমাদের সবাই মেইড ফর ইচ আদার মনে করতো। আমরাও নিজেদের তাই ভাবতাম। গত ছয় মাসে আমরা কখনো কোনো ব্যাপার নিয়ে ফাইট করিনি। আমরা দুজন দুজনকে গভীরভাবে বুঝতে পারতাম। আমি স্টিভকে নিয়ে ভীষণ হ্যাপি ছিলাম।
অপরূপ এক অপরাহ্ণে ব্লু মাউন্টেন পাহাড়ের ওপর মাখনের মতো গলে পড়ছে রোদ। ওপর থেকে নিচের লেক দেখা যায়, এমন একটি জায়গায় আমরা হাত ধরে বসে থাকি। চারদিকের অলৌকিক সৌন্দর্য ও প্রকৃতি কেমন যেন আমাদের বিষণ্ন করে তোলে। আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে উদাস হয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকি। জানি না কী হয়েছিল, তবে হঠাৎ আমি স্টিভের চোখে চোখ রেখে জানতে চাই, ‘ডু ইউ রিয়েলি থিংক উই আর মেইড ফর ইচ আদার?’ স্টিভ কোনো সময় না নিয়েই সরাসরি বলে, ‘নো’।
পর দিন আমি বাসা থেকে আমার জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে আসি। এরপরের কয়েক বছর বার এট ল’ শেষ করে নতুন ল’ ফার্মে কাজ শুরু করি। পাপা বলেছিল তার সঙ্গে জয়েন করতে কিন্তু আমি একাই কিছু করতে চেয়েছিলাম। আসলে একার লাইফ আমি এনজয় করছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে রোড ট্রিপে যেতাম, ট্র্যাকিংয়ে যেতাম। ডিস্কো, আড্ডা, মুভি দেখা, লং ড্রাইভ এসব নিয়ে ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই ব্যালে ডান্স আর বই পড়ার নেশা আমাকে ঘিরে আছে। ব্যালে ড্যান্সের প্রোগ্রাম তো আছেই। এছাড়া মাঝে-মাঝে নাইট ক্লাবে গিয়ে ক্যাজুয়ালি ডেটিং করতাম। খুব বিজি স্ক্যাজুয়েলের মধ্যে সময় কাটছিল। এদিকে প্রফেশনালিও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। নতুন নতুন সব ক্লায়েন্ট ডিল করতে শুরু করলাম। তাদের নানা বিচিত্র সমস্যা আর সমাধান করা নিয়েও প্রফেশনালি ইনভল্‌ভড হয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু ডেভের (ডেভিট) সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সবকিছু চেঞ্জ হয়ে গেলো। আমার সঙ্গে ডেট করে ডেভ এতই পাগল হলো যে দুদিনের মধ্যেই নিজের বাসা ছেড়ে আমার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠলো। স্টিভকে ভোলা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। ওকে আমি মিস করতাম। কতবার মনে হয়েছে ওর কাছেই ফিরে যাবো। কিন্তু জানতাম না ও কোথায় আছে। আসলে জানতেও চাইনি। আর ও নিজে থেকে আমার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করেনি। তবে ডেভ আমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলেছিল বলেই আমরা চার বছর একসঙ্গে থাকতে পেরেছিলাম হয়তো। প্রায়ই ফাইট হতো ওর সঙ্গে। তবে এরইমাঝে আমরা সারা ইউরোপ, অ্যামেরিকা, ল্যাটিন অ্যামেরিকা একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমরা ভালোই ছিলাম কিন্তু একসময় ডেভ আমাকে বিয়ে করার জন্য প্রেসার করতে থাকে। এরপর আমার পক্ষে কোনোভাবেই আর ডেভের সঙ্গে একই ছাদের নিচে, সেম বেড শেয়ার সম্ভব হচ্ছিল না। ডেভ আসলে ঠিক আমার সোলমেট না। আমি আমার সোলমেট খুঁজছিলাম। ডেভ চলে যাওয়ার পর আমি ডিসিশন নেই একা থাকার।
ইনফেক্ট, আই ওয়াজ এক্সেলেন্ট বিইয়িং অ্যালোন। কাজ, জিম, জগিং, হ্যাংগিং আউট, ওয়াচিং মুভিস, রোম এরাউন্ড। আরও কত কী নিয়ে যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার কোনো সময় ছিল না কারও জন্য। ভাবছিলাম বাংলাদেশ থেকে ফিরে লাইফের পারপাস খুঁজতে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হবো। আর ঠিক এ সময়ই দেখা হয়ে গেলো ইমরানের সঙ্গে।
ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেই আমরা ডিসিশন নিলাম কক্সবাজার যাওয়ার। আগস্টের ছয় তারিখ সন্ধ্যা ৭.১০ মিনিটে ঢাকায় ল্যান্ড করলাম কিন্তু সেদিনের শেষ ফ্লাইট কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে বিকেল ৫.৩০মিনিটে। এদিকে ফ্লাইট টাইম জেনে আমাকে রিসিভ করতে মাম্মি লোক পাঠিয়েছে। ওরা বারবার ফোন দিচ্ছে বলে ফোনটা সুইচ অফ করে দিলাম। একজনকে রিকোয়েস্ট করে মাম্মিকে ফোন দিয়ে বললাম আমি জরুরি কাজে কক্সবাজার যাচ্ছি। কবে ফিরবো এখনো জানি না। মাম্মির গলা শুনেই বুঝলাম সে খুব মাইন্ড করেছে। নানা ঝামেলার মধ্যে সেই রাতটা উত্তরার কাছাকাছি একটি হোটেলে কাটিয়েই সকাল ১১টার  ফ্লাইটে কক্সবাজার পৌঁছলাম। ইমরান রয়েল টিউলিপ কক্সবাজার নামের যে হোটেলে হানিমুন স্যুইট বুক করেছিল, তাদেরই একটি প্রাইভেট কারে করে আমরা যখন হোটেলে পৌঁছলাম, তখন দুপুর দেড়টা বেজে গেছে।
রুমে ঢুকে ইমরান বাইরের দরজার হাতলে ডু নট ডিস্টার্ব ট্যাগ ঝুলিয়ে দিলো। এরপর এই মহাবিশ্ব থেকে কী করে সাতটা দিন, (ঘণ্টা বা সেকেন্ডের হিসাব আর করতে চাই না) কেটে গেছে, বলা ভালো উধাও হয়ে গেছে, সেটা কেউ জানে না। রাতে হয়তো কালেভদ্রে আমরা দুই-এক ঘণ্টা ঘুমাতাম। মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও এক আধটু ঘুমিয়ে নিয়েছি। ব্যস এটুকুই। এরমাঝে দুই চার বার যে  ব্যালকনিতে যাইনি, তা নয়। বিকেল হলে যখন ওই আদিম সূর্যটা ক্রিমসন আভা নিয়ে অস্ত যেতো, আমরা দুজন বারোতলার ওপরের বারান্দায় হাতের ওপর হাত দিয়ে ইজি চেয়ারে বসে বসে ইনানি বিচ দেখতাম। পৃথিবীর প্রায় সব বিচ ঘুরে এসেও এই ছোট্ট বিচটা আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে উঠলো। আমরা এমনভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, যেন ডোভার বিচের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ইমরান তার ভরাট গলায় আবৃত্তি করতো—
Ah, love, let us be true
To one another! for the world, which seems
To lie before us like a land of dreams,
So various, so beautiful, so new,
Hath really neither joy, nor love, nor light,
Nor certitude, nor peace, nor help for pain;
And we are here as on a darkling plain
Swept with confused alarms of struggle and flight,
Where ignorant armies clash by night.
( Dover Beach BY MATTHEW ARNOLD)

আমাদের জীবনের আদি-অন্ত আমরা জেনে গেছি এরইমাঝে—প্রথম স্মৃতি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে, যতটুকু মনে আছে, আমার বা ওর, সবকিছু। আমাদের পছন্দ অপছন্দ, জীবনবোধ, কল্পনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শিল্পসাহিত্য, সিনেমা, স্পোরস, ওয়ার্ল্ড পলেটিক্স—সব আলোচনা শেষ হয়ে গেলো। ওর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর স্মৃতির কথা ও জানালো। ওর বাবা-মার ডিভোর্সের কথা! বহুবছর আগে এক বাঙালি নারী সেলিনা হোসেন দুচোখভরা স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে ইকোনমিক্স পড়তে গিয়েছিলেন। ওখানেই পাকিস্তানি সুদর্শন যুবক নাদিম খানের সঙ্গে পরিচয়। ইকোনমিক্সের ফার্স্ট ইয়ারের সেলিনার সঙ্গে ফাইনাল ইয়ারের নাদিম খানের দেখা হওয়া মাত্রই ক্যামেস্ট্রি গড়ে উঠলো। যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট। পরিচয়,  প্রণয়, বিয়ে পরপর হয়ে গেলো। শুধু একটাই সমস্যা দেখা দিলো—তা হলো মুক্তিযুদ্ধে নিজের দুই পুত্রসন্তান হারানো সেলিনার  বাবার পক্ষে কিছুতেই একজন পাকিস্তানি ছেলেকে নিজের মেয়েজামাই হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব হলো না। ফলে জীবিত দুই মেয়ের মধ্যে ছোটমেয়ে সেলিনার সঙ্গে বাবা-মা ও পরিবারের সবার যোগাযোগ চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এর প্রভাব এসে পড়লো সেলিনা-নাদিমের সংসারেও। নাদিম কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি থেকে মেনে না নেওয়ার এই অপমান ভুলতে পারলো না। এসব নিয়ে অশান্তির চূড়ায় অবস্থানকালে দম্পতিটি জানতে পারলো যে তারা বাবা-মা হতে যাচ্ছে। শিশু ইমরানকে কোলে নিয়েই সেলিনা মাস্টার্স শেষ করলো। এরপর পিএইচডি করার কথা স্বামীকে বলামাত্র নাদিম ঘোর আপত্তি জানালো। এভাবেই কয়েক বছর কেটে গেলো। ইমরানের বয়স যখন আড়াই বছর, একদিন সেলিনা ঘোষণা করলো, সে অ্যামেরিকার  ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-তে পিএইচডি করতে যাচ্ছে। নাদিম এই ব্যাপারে বিন্ধুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে জানিয়ে দিলো, ইমরানকে নিজের কাছে রাখবে, সেলিনাকে যেতে হলে একা এবং একেবারেই যেতে হবে। এরপর সেলিনা হোসেনের শারীরিক ও মানষিক পরিস্থিতি তখন বা পরবর্তী সময়ে কী হয়েছিল, তার কোনো খবরই ইমরান জানে না। তার মা জীবিত না মৃত, সেই খবরটিও ইমরানের জানার কোনো আগ্রহ কখনো হয়নি। সেলিনা হোসেন অ্যামেরিকায় চলে গেলো, আর নাদিম খান পাকিস্তানে গিয়ে আবারও বিয়ে করে শিশু ইমরানকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বসবাস শুরু করলো। ইমরানের সেই বাঙালি মা সম্পর্কে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আমার হলো না। কারণ এরইমাঝে আমি বুঝে গেছি, ইমারান তার নিজের সেই বাঙালি মাকে ভীষণ ঘৃণা করে। ওর বারবার ‘আই হেইট হার, আই হেইট হার ফ্রম বোটম অব মাই হার্ট! শুনেই আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বাংলাদেশি শুনে ও কেন প্রথম পরিচয়ের সময় এত বিস্মিত হয়েছিল, সেটা আমি বুঝতে পারলাম।
যাহোক, এসব পারিবারিক কোনো ব্যাপারেই আমাদের দুজনের কোনোরকম কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। আমরা নিজেদের জগতে হারিয়ে গেলাম। আমরা নাচলাম, গান গাইলাম, খেলাম, একসঙ্গে গোসল করলাম, ভেসে গেলাম সুখের বন্যায়। পৃথিবীতে কেউ কখনো এর আগে বা পরে এত সুখী ছিল কি না, কে জানে! নো ডাউট উই আর সোলমেট।
কালকে গভীর রাত পর্যন্ত আমরা তিনতলার বলরুমে কাটালাম। ফাইভ স্টার হোটেলের ব্যুফেতে থরে থরে খাবার সাজানো। আমরা  দুজনই রাতে বলতে গেলে কিছুই খাই না। তবু অল্পকিছু এপিটাইজার, স্যুপ খেয়ে রুমে যাওয়ার জন্য রওনা হতেই এই প্রথমবারের মতো ইমরান আমাকে রাতের বেলায় বিচে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। বিচের কাছে এসে আমরা নিজেদের বয়স ভুলে গেলাম। একেবারেই যেন কিশোরকিশোরী হয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে, একজন আরেকজনকে পানি ছিটিয়ে, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে আমরা গিয়ে জুটলাম আমাদেরই মতো কিছু ট্যুরিস্টের সঙ্গে। ওরা সবাই মিলে ফুটবল খেলছিল। আমরা ওদের সঙ্গে ফুটবল খেললাম। খেয়াল করলাম, ইমরান বারবার রিস্ট ওয়াচে সময় দেখছে। রাত পৌনে বারোটার দিকে হোটেলে ব্যাক করে ও আমাকে রুমে যেতে না দিয়ে বলরুমে নিয়ে গেলো। কী বিশাল সারপ্রাইজ আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো ভাবতেই পারিনি। রুমে ঢুকতেই এক দঙ্গল ওয়েল ড্রেসড লোক হ্যাপি বার্থডে বলে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। এদিকে আমরা তো একেবারেই ক্যাজুয়েল ড্রেসে তখন। বিচ থেকে ঘেমে নেয়ে এসেছি। ইমরানের সেসব দিকে খেয়াল নেই। প্রথমেই সে শ্যাম্পেইন সেব্রেইজ করলো তারপর আমরা সবাই গ্লাস টোস্ট করার পর সে তার ডান পকেট থেকে ডাইমন্ড রিং বের করে সিনেমার নায়কদের মতো হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে,  ‘উইল ইউ মেরি মি’ বলে প্রপোজ করলো! ওহ ফাইনালি উই হ্যাভ ফাইন্ড আওয়ার সোলমেট! এরপর কেক কেটে, অনেক রাত পর্যন্ত ড্যান্স করে মাঝরাতে রুমে এসেছিলাম। আদরে আদরে কেটে গেলো বাকি রাতটুকু। সকাল হতেই ক্লান্ত হয়ে দুজন কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
বেলা এগারোটায় ঘুম ভেঙেছিল একবার। কিন্তু ক্লান্তিতে দুচোখ ভেঙে পড়তেই আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুপুর আড়াইটায় উঠে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এলাম পানি খেতে। টেবিলের ওপর দেখি ফ্লাওয়ার ভাসের নিচে চাপা দেওয়া একটি চিরকুট সঙ্গে ৭০০০ টাকা। মাত্র কয়েকটি লাইন লেখা ছিল তাতে। যার বাংলা করলে অনেকটা এমন হয়, পৃথিবীর বহু দেশে ঘুরেছি। সেরা সেরা ডাকসাইটে সুন্দরীদের সঙ্গে শুয়েছি কিন্তু সেটা কখনোই এক/দুদিনের বেশি নয়। অথচ একজন বাংলাদেশি নারীর সঙ্গে একনাগাড়ে সাতদিন এক ছাদের নিচে কাটালাম। বিছানায় যার অসাধারণ পারফর্মেন্সের কথা কখনো ভুলবো না। জানি, হয়তো তোমার রেট এর চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু বিশ্বাস করো এই মুহূর্তে আমার এরচেয়ে বেশি সামর্থ্য নেই। তাই ৭০০০ টাকা রেখে গেলাম। তুমি বাংলাদেশি না হলে তোমার সঙ্গে হয়তো একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতাম। কিন্তু আমি বাংলাদেশিদের ঘৃণা করি। আদিওস।

সীমান্ত সংঘর্ষ  
 স্বপন রায়


আমরা বলি, বারিষ
তোমরা?

শাম
আমরা সুর করে বলি, হুই শাম উনকা খয়াল আ গয়া
কি সুর, তোমাদের?

রাস্তা বেঁকে গেছে, বৃষ্টিবিকেলে মাটির পাংচার দিকে দিকে
বিকেল খাম হ’লে তার ভেতরে চিঠি
অনেক আগে
বাইকের নাম ইয়েজদি, নায়কের নাম
থাক
একটু খালি খালি ভাব থাক

খালিপন, তোমরা বল
আর আমরা কিভাবে যেন জড়িয়ে যাই
ফুটোফাটা সেলাই করে বৃষ্টি যখন
মনে পড়ে
কে যেন ঝুঁকে আছে সেলাইমেশিনের ওপরে
দীপাণ্বিতা রায় সরকারের কবিতা 

বাগদত্তা

যে পুরুষেরা ছিলা টান করে,
সামনে এসে দাঁড়ায়।
শরীরে বৃষ্টির মতো মোহ,
কর্তুজে ধার।
অমন পুরুষের বাগদত্তা হবো না।

শিকারির মতো সংযম পুষে রেখেছে,
খুব শক্ত ম্যজিকের মতো  বশ।
নল ঘোরালেই যার অমন লক্ষ্য ভেদ।
সে  অনুতপ্ত শিল্প রাখে কেন?

অমন পুরুষের  বাগদত্তা হবো না।
অভিষেক নন্দী



১। সাপলুডো

জেলখানার চাঁদ,
তোমাকে প্রণাম করে তারা ঘুমোতে যাবে, কথা ছিল...

জানলা খসে খসে ফোকলা গুহা
রোদ নয়, বেরিয়ে এসেছে আদিম পিশাচের লালা
চালাও লুটপাট, লুটপাট চালাও...
এখানে আমার বলতে একটা মিনিবাসের টিকিট
কয়েকটা প্রাণী যারা অপচয় করেছে হাসি,
আমার ঠাকুরঘরে এসে যখন কাঁদছে,

ঠিক যেন—রুদ্রাক্ষ হতে খসে পড়া কয়েকটা উট




২। ফাঁকি

শেষ রাতজাগা ফুলশয্যায়। তারপর,
তোমার মাথার দিকে পা, আর, পায়ের দিক
আমার মাথা রেখে উল্লুকের মত ঘুমিয়েছি
তোমার বালিশের তলায় লুকোনো
ঠান্ডা জলের নদীটাতে আমি কখনও স্নান করিনি
ওতে, মন্দিরাদির বাবা এসে গরু চড়ান
বছর বছর সরস্বতী পুজোর ভাসান পড়ে

দূর থেকে আশ্রয় নিই জামাকাপড় মেলার দড়িতে

অথচ, গোটা তোমাকে সমাধান করবই করব
মাধ্যমিকের আগে থেকেই কনফিডেন্ট ছিলাম

হাত ধুতে ধুতে পুরনো বন্ধুর ফোন আসে;
গল্প গালাগালি চলতে চলতে জানতে পারি
আমাদের অংকের স্যার, আসলে বাংলা পড়াতেন!

 ছন্দ পতন
 তিসা মন্ডল 


একা থাকা রাত্রি গুলোর সাথে এখন তেমন যোগাযোগ নেই
কাফনের জলবায়ু বায়ুহীন-এ নেশার ছোঁয়ায়
তোমার গতিপথ,
আমার অন্তিমকালের সাথে মিলে যাবে।
পিছিয়ে চলা অশান্তি কখন
একদম শান্ত হবে,
তুমি স্পষ্ট স্পর্শ করতে পারবে না।
ঘাসের ঠোঁটে খসে পড়া ঝুমকো
চুমে যাওয়া তীব্র দুপুরেও, 
কলমের বাহিনীরা দাঁড়ির অবস্থান না দেখেই চলে একগুচ্ছ রোদ্দুরের রোগে
প্রেমিকা নুপুর সৈনিক ছন্দ পতনের ভোগে।
লৌকিক 

অমিত দে 



ঘোরলাগা অন্ধকারে ঘটেছিল বিস্মরণ
একমুঠো ফুটফুটে ভাত আর দু’আঁজলা সুখে
দিনান্ত জেগেছে... বহুপ্রজ...
এসবের কোনও প্রিলিউড হয় না
লৌকিক লতাপাতা বনকুলের পথে
কিছু লিপির অবসর।
বৃষ্টি এসে কতদিন ধুয়েছে
ওপিঠে জমে থাকা ঘামের
নির্লিপ্ত গোপন অভিমান

আমি তো একফালি আহ্লাদকে
জানালার দৃশ্যে সঞ্জাত করেছি 

বর্ণান্ধ চোখের পরাজয় ছিল
শুধু দূরে সরে যাওয়া  

নেই উপাখ্যান 
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

১.
গাছ আর গাছ নেই । মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ি আর জানালা ।
হাওয়া খুঁজছে । আকাশে উঠে যাওয়া কারখানা বিষাক্ত হাসি হাসলে তুমি 
নীলকন্ঠ । ইদানিং এভাবেই বুদ্ধ 

২.
পাখিপাঠ উঠে গেছে উঠোনে । নেই ক্ষুদ নেই কেনা চালে । অলস বিড়াল 
তোমার রাত্রি বাসে । অপেক্ষায় আদরের । হাঁসটি ফেরে নি । চিন্তা নেই ডাল কেটে নিয়ে যাওয়া সুখেনের । সকালের জমাট ঘুম 
ঘুলঘুলি ছাড়া বাসায় । সায় দিচ্ছে 
যন্ত্র পাখি কলিংবেলের মমতায় 

৩.
তুমি তুমিতে নেই । যন্ত্রের মহিমায় । ঘেঁটে তুলছো অতীত । তারপর ওয়াশিং মেশিনে সাফ । ফল চমৎকারা । গরম হচ্ছো মাইক্রোওয়েভে । আর ঠান্ডা শীতাতপে । আপেল আর আপেল থাকছে না । ফেস ওয়াশ আর বডি লোশনেও । মেগা হিংসা 
ধারাবাহিক । ইনবক্সের অংক আর 
ঝড় এলোমেলোকে মেলোডি
শতানীক রায়ের কবিতা

তথাকথিত  

ঘাস পাতার ভেতর কী একটা খুঁজছি
কেউ জানে না পরাধীন অর্থে 
আমাকে কোন কথা বলতে হবে
কোন দিকে যেতে হবে মধুর।
কারো কাছে বিনম্র মুগ্ধতা
তারপর লঘু জ্ঞান 
পরিত্রাতার আশ্বাস 
সামনে দিয়ে দরজা খুলবে
কোন মানুষগুলো খুলে যাবে
খুলে গিয়ে দূরে এক নদী
কারাগার আর প্রাণী 
কেউ অপরাধ করেনি কর্নেল,
কারো মাটির জোর নেই
কী পরিহাস কী পরিহাস
এমনভাবে কর্নেলকে 
দুই বার হাসতে হয়। 

সব রং ধুয়ে যাবার আগে
শুভদীপ ঘোষ



সব রং ধুয়ে যাবার আগে
ঘুমের সংলাপ জানে ডাকঘরের বারান্দায়
             তবুও লেগে থাকে পুরোনো রোদের দাগ
                                   ঠোঁটের অবশিষ্ট উচ্চারণ

মেহগনি গাছের নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে 
               বসন্তের মায়াবী চাঁদের ছায়া
               মধ্যবিত্ত রমণীর ঘামের মত সৎ 
                    কান্নাজাত খয়েরি পাতাদের অসুখ

সব রং ধুয়ে যাবার আগে
   ঘুমের সংলাপ জানে ইদারার গভীরে
   তবুও লুকিয়ে থাকে ফকিরের বর্ণমালা 

জ‍্যো তি র্ম য়  মু খো পা ধ্যা য়




আচ্ছা, তোমার কবিতা

এত বিক্রি হয় কী করে ! এত বই !
কে কেনে ? কে পড়ে ? এত ! এত !

আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে

একটু শেখাবে?
সেই কৌশল?

আমি তো একটা পাঠক পেলেই বর্তে যাই
অন্তত একটা পাঠক, যে

পড়তে পড়তে কবিতা হয়ে যাবে



শু ভ ম য়  স র কা র-এর তিনটি কবিতা
_-------------------------------------------------
শব্দ সিরিজ-৩
--------------------
ছুঁয়ে ফেলি নির্বাক শব্দ কিংবা
                          মোহহীন রাত
                                  তারপর
             শব্দ ছুঁয়ে দেয় নষ্ট চাঁদ
                       অবাধ্য ধানক্ষেত
                        সন্ধ্যের হাইওয়ে 
                                          তাই
সময় বলেছিলো সাক্ষী থাকুক এরা। 

গতি ছুঁয়েছিলো শব্দ
                           শব্দ ছুঁয়েছিলো নীরবতা
যেভাবে ছুটে যায় অলৌকিক সময়
যেভাবে পড়ন্ত নরম আলোয়
                            স্নান সারে গাছ
                             অলস হয় ছায়া
সেভাবেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর শব্দহীনতায়
 ছুঁয়ে ফেলি ব্যক্তিগত বিবর্ণ অক্ষরমালা। 

শব্দসিরিজ-৪
--------------------
আরও এক শব্দসকাল
            আরও এক কথাযাপনের ভোর
আরও কোনো মূক ও বধির রাত্রিযাপন
              শেষে গড়ে ওঠে যাপন ধারাপাত। 

তুমিও মেরুবাসী হবে জানলে
               হিসেবি হতাম বর্ণমালা নিয়ে
যাপনচিত্রের ছবি গুছিয়ে সেদিন
                 আরও কোনো কুরুক্ষেত্রের পথে। 

সব কথা বলা হয়নি অন্ধকারকে
                    সব যাপন শেষ হয়নি আজও
তবু কোনো শব্দভোরে অন্ধকার ফিকে হলে
                      শুরু হয় আমাদের কথাসকাল। 




প্রেমপদাবলী
------------------
জলপ্রপাতের মতো   অথচ শব্দহীন উচ্ছ্বাসহীন
আমাদের কথোপকথনগুলো
গূঢ় কিংবা সরল কোনো বাউলগানের মতো
খুলে দিয়েছিলো যত গোপন ভাঁড়ার। 

সেইসব কথামালা   ইতিহাস হয়ে
                              ছেঁড়া পাতা হয়ে
                                পত্রাবলী হয়ে
পদাবলী হয়ে ধারাপাতের মতো 
ঝরে পড়েছিলো অনুগত জীবনে
অতিকথনের প্রলাপে   বিপন্ন বিস্ময়ে
আর নির্ভরতায়। 





         




উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা 

অসুখ



পাথরের ঘরের নিচে শুয়ে আছে যে পুরুষ
তার হৃদয় জুড়ে অগণিত ব্যালকনি উৎসব

তুবুও সে কান্না বোঝে না কিংবা গান
স্তব্ধতার ভাষায় হাসি লিখে রাখে ক্ষত কিংবা অসুখ।

ভাঙার গান মানুষ বোঝেনা কিংবা মন 




     অকবিতা



আমি তাদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না 

সব বিবাদের মূলে রয়েছে এক গভীর ষড়যন্ত্র
যে রাস্তায় তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে
সেই নিরুত্তর ঠিকানার কাছে 
আজও আমরা ঠিক পৌঁছতে পারলাম না

শুধুমাত্র কয়েকটিশব্দ প্রয়োগে  জানান দেওয়া হলো,
দেশ বলতে আসলে একটা ভৌোলিক সীমারেখা


রিপন হালদারের বুক রিভিউ 

এখানে অমল নামে কেউ থাকে না’ গল্পগ্রন্থের পাঠ প্রতিক্রিয়া।
লিখেছেন শাক্য দে চৌধুরী

এর আগে দুটো কবিতার বই লিখেছেন। লেখকের এটাই প্রথম গল্পের বই। যদি কেউ ধরে নেয় যে, গল্পের বইয়ে তাঁর কবিসত্তার প্রভাব পড়বে, বলা বাহুল্য যে সে ঠিকই ভাববে। কিন্তু আরো যা যা সে ভাবতে পারবে না, বা ভাবা যাবে না তেমনই কিছু অভাবনীয় উপাদান ও প্রয়োগ এই বইটাকে অকল্পনীয় করে তোলে। 
বইটাতে মোট সাতটি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পেই লেখক তাঁর বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং উপস্থাপনায় অপরিচিত মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। প্রতিটি গল্পের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে সেই প্রথাভাঙা যাদু পাঠককে অন্যরকম ব্যাখ্যা করতে শেখায়, অনিবার্যভাবেই।
যেমন, ‘দ্য বয় উইথ দ্য বাই-সাইকেল’ গল্পটিতে এক কিশোর তার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর দিন সকালবেলা দুশ্চিন্তায় আনমনে তার সাধের সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। রেললাইন, বসতি, দীর্ঘ সরু রাস্তা পেড়িয়ে সে কোথাও একটা যায়। অথবা কোথাওই যায় না। এই যাওয়া না যাওয়ার মূল্যায়ন অর্থাৎ যার নিরিখে দাঁড়িয়ে আমরা কানের পাশে – জামার কলারে দুরন্ত হাওয়া আর পায়ের নিচে অমোঘ প্যাডেল অনুভব করি, সেটাও কি আসলে স্থির অস্থিরতা নয়! যা জনৈক পেন্ডুলামের মতো দুলতে দুলতে ক্রমশ নিচে নেমে এসে সম্ভাবনাময় বাস্তব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখছে।
আবার ‘এসো, বিষণ্ণতা এসো’ গল্পে এক নিটোল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কেউ আবিষ্কার করে জুটমিলের বড়ো নাৎসি একটা পাঁচিল কতো উচুতে উঠে গেছে! কদিন আগেই ওখানেই একটা নদী ছিল, যার তীরে মহালয়ার ভোরে একটা দোদুল্যমান শূন্য নৌকার পাশেই সূর্যোদয় হয় আর সেখানেই নিহিত ছিল দুঃখবোধের বীজ। ওঝা বলেছিল পরীতে পেয়েছে। হাজার ধূপকাঠির গন্ধেও সেই পরী চলে যায়নি। বরং বহু বছর পরে কোনো এক মহালয়ার ভোরেই গুলকয়লার ধোঁয়া আর ড্রেনের ধারে পয়াখানায় মগ্ন বাচ্চাদের সারি পেড়িয়ে পরী সন্ধান দেয় সেই পুরনো নদীর। 
নীত্‌সের দর্শনের এক দুর্দান্ত প্রভাব প্রায় অধিকাংশ গল্পে পাওয়া যায়। জাগতিক ও মহাজাগতিক পুনরাবৃত্তির যে অবাস্তব বাস্তবতা নির্ধারিত হয় লেখক তার অন্য রূপ দিয়েছেন। একদেশ থেকে আরেক দেশে অনুপ্রবেশের যে ক্লান্তিকর ইতিহাস চলে আসছে, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্বিসহ ঐতিহ্যের স্রোতে সপরিবারে ভাসতে ভাসতে মাঝনদীতে জনৈক বৃদ্ধের আবদার তার বৌমার উদ্দেশ্যে, “অরে একটু জাগাও বৌমা, শ্যাশবারের মতো দ্যাশটারে দেইখ্যা লউক!”
সাইকেল বা হেলিকপ্টার, নৈহাটির ভাড়াবাড়ি, পাটকল, যন্ত্রে (যন্ত্রণায়) উত্‌সর্গীকৃত আঙুলের দাম, ইঁটের বোঝা নিয়ে কন্ট্রাকশন বিল্ডিঙের উঁচু আড়ালে চলে যাওয়া রিফিউজি মা ইত্যাদি পেড়িয়ে বহু বছর পরও ক্যানিং বর্ডারে (তৎসহ পৃথিবীর সমস্ত বর্ডারে) পুরনো গন্ধটাই ফিরে ফিরে আসে। নদীর পারে ঘোর কুয়াশায় ভোরবেলা পাঁচ-সাতজনের একটা দল, পালাচ্ছে। কে যেন তার বাচ্চাকে জাগাচ্ছে, “শ্যাশবারের মতো জন্মভূমিরে একবার দেইখ্যা লও! একবার চোখ খোলো বাবা আমার!”
আবার ‘যে চরিত্রটি লেখক হতে চেয়েছিল’ গল্পে, সেখানেও একটা ফিরে আসা আছে বা আদৌ  ফিরে আসা নাকি নিছকই একটা জন্মগত ভ্রম, সেবিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এই জাদুবাস্তবতা ক্রমে প্রানান্তকর হয়ে ওঠে সেই লেখকের কাছে যে প্রচন্ড চেষ্টা করেও বিগত একবছর যাবত্‌ একটা ছোট গল্প শেষ করতে পারছে না। কেননা গল্প লিখতে বসলেই বড়ো বড়ো লাল ডাঁসা পিঁপড়ের মিছিল এসে শব্দগুলো খেয়ে চলে যায়। আবার লেখকও চরিত্রকে বিশ্বাস করাতে পারে না, “আমি লেখক আর তুমি আমার সৃষ্ট চরিত্র”। চরিত্রও তার সৃষ্টিকর্তাকে বাড়িওয়ালা বলে ভুল করে। চরিত্রের মাথার উপর দিয়ে ‘যোগচিহ্নের মতো বিষণ্ণ পাখি” উড়ে চলে যায়। আর লেখকের পথ আগলে বসে থাকে অগণিত পিঁপড়ের সমাবেশ।
সম্পূর্ণ অন্য এক সুর প্রতিধ্বনিত হয় ‘এডিটর’ গল্পেও। ল্যাপটপের স্ক্রিনে হঠাত্‌ দেখা দেওয়া একটা কালো স্পট ল্যাপটপের চতুঃসীমা পেড়িয়ে ঢুকে পড়ে এডিটরের জীবনে। শহর, রাস্তা, ব্রীজ, রেললাইন দুমড়েমুচড়ে এক সর্বগ্রাসী অতলতার স্মৃতিভ্রম, এডিটর নাকি তার শর্টফিল্মের চরিত্র, শেষমেশ কাকে পেয়ে বসে আমরা বুঝতেই পারি না।
‘আমি আর আমার হারিয়ে যাওয়া প্রতিবিম্ব’ গল্পটিতে ইতিহাস নিয়ে পড়তে পড়তে জনৈক ছাত্র মুন্ডুহীন কনিষ্কের মূর্তির সাথে নিজেকে মিশিয়ে স্মৃতি, দৃশ্য, স্পর্শ নির্বিশেষে এক মায়াময় অস্তিত্বহীনতায় ভোগে। হারিয়ে যায় তার প্রতিবিম্ব।
আরেকটি গল্পে হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য, ইচ্ছা বা কাঙ্ক্ষিত সম্ভাব্যের অবাস্তব বিমূর্ত শব্দগুলো আঁকড়ে ধরে মা-বাবা পরিত্যক্ত একটা ছেলে ভালবাসতে শেখে তার আবর্জনাময় তার জীবনটাকে। শব্দেরা পরী হয়ে ভুলিয়ে দেয় অসহ্য গরম আর লোডশেডিং। ভুলিয়ে দেয় দুশ্চিন্তা।
বিষয় নির্বাচনে, স্টাইলের অভিনবত্বে, অপ্রতিম আঙ্গিকে, শব্দ দৃশ্য আর ভাবগত ব্যঞ্জনাময় প্রতিটি গল্পই পরস্পরের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। JUSTAPOSITION -এর মতো একটা জিনিসকে যদি কেউ গল্পে ঢুকিয়ে দেয় তবে কী যে হয়! চরিত্র, প্রেক্ষাপট, স্থান, কাল, পাত্র ইত্যাদি কোলাজ যদি ব্যাকরণ না মানে তবেই বা কী হয়! অবচেতনের যুক্তিহীন প্রলাপ যদি সমান্তরাল অন্য এক দুনিয়ার খোঁজ দেয়, তবেই বা কী হয়! আর এগুলো পেড়িয়ে কিছু অস্পষ্টতা ও ধাঁধা নিয়ে পাঠক যদি পরের গল্পে না গিয়ে এই গল্পটাই পড়তে চায়, তখনই বা কী হবে! লেখক তার স্পর্ধা পেরিয়েছেন। পরিচিত বোধগম্য যা কিছু, সেখান থেকে বেরিয়ে এক অজানা ফসলের চাষ করেছেন তিনি। পণ্য সাহিত্যে বিকিয়ে যাওয়া এই বাজারে এই ফসল আজ গভীর ভাবে প্রাসঙ্গিক। 

এখানে অমল নামে কেউ থাকে না
রিপন হালদার
প্রকাশক- তবুও প্রয়াস 
বিনিময়- ১২৫/

সুব্রত মণ্ডলের কবিতা 


আঙুলের_কথা_১২

আকাশ ঘনিয়ে আসছে___
অন্ধকারে ভাসমান মেঘ যেন এক একটি লন্ঠন
মনে হচ্ছে দূরে কেউ নেই
সমস্ত প্রায়শ্চিত্ত নিয়ে আমার বিছানা মরে পড়ে আছে
সস্তার বিড়ির মতো আমি পুড়ে যাচ্ছি তারই এক কোনে
সমস্ত মানুষ, একদিন এভাবে পুড়ে যায়___
পুড়ে গিয়ে ছাই হয়
অনন্ত দরজার ভেতরে হাওয়া আসে
কেঁপে উঠি, ভয়ে
বুঝি ভোর হয়___
মানুষের লাশের উপর হেঁটে যায় সহস্র মানুষের পরিচয়



আঙুলের_কথা_১৪

সমস্ত প্রশংসা থেকে আঘাত খুঁজে বেড়াই
হে ধানক্ষেত, লাড়াদের বিচরণ নিয়ে আজ কিছু অন্তত বলো তুমি
লাঙ্গল বৃদ্ধ হলে সেওতো বেঁচে থাকে গর্ভবতী মাটিকে ছুঁয়ে
এসব খারিপ দিনে তোমাকেই
চিঠিতে লিখে যাচ্ছি প্রান্তিক মানুষের শোক 
আমাকে ভুল বুঝে কিংবা ভালোবেসে যারা দূরে চলে গেছে
যারা ঘর বেঁধে সুখে আছে পবিত্রতার ওমে
                                                       সকলের চৈতন্য হোক


শোভন মণ্ডলের অনুগল্প 
ভাই- বোন
                       
        

মায়াবী পাহাড়,  নীল টলটলে দিঘি। উড়ে বেড়াচ্ছে অলৌকিক মেঘ। ছেলেটি একটা টিলার ওপর বসেছিল। আনমনা। হঠাৎ একটা ফ্রক-পরা মেয়ে পিছন থেকে তার চোখ টিপে ধরে বললো, 
বলতো আমি কে?

কে আবার!  আমার বনু।
কি করে বুঝলি?
বা রে!  এরকম তুই ছাড়া আর কে করবে? কিন্তু তুই কী করে এলি?
চলে এলাম।
মা , বাবা কেমন আছে রে ?
ভালো নেই। তুই চলে আসার পর খুব কষ্টে আছে। সারাদিন শুধু কাঁদে।
দীর্ঘশ্বাস পড়ে দাদার।
বোন বলে,  তুই এভাবে চলে এলি কেন ?
না এসে কী করতাম বল্!  সবাই আমাকেই দোষ দিচ্ছে।
তোর দোষ ছিল না। আমি জানি।
কী করে জানলি? 
তোর বন্ধু অরূপ স্বীকার করেছে,  ও-ই চুরি করেছে ক্লাবের টাকা। সবাই তোকে দোষ দিল। তুইও অমনি এভাবে চলে এলি। একবার মা, বাবার কথা ভাবলি না?  আমার কথা?
কী করবো বল্,  এই অপমান আর সহ্য হচ্ছিল না।
যে দিন অরূপদা সব স্বীকার করলো,  সেদিন থেকে আমি ছটপট করছিলাম,  কী করে তোকে জানাবো।  ঘুমতে পারতাম না। শুধু মনে হতো ছুটে গিয়ে তোকে জানাই,  দাদা তুই নির্দোষ । কিন্তু তোকে কোথায় পাব বল্। তুই তো তখন...
এই বলে থেমে যায় বোন।
দাদা বলে এই কারণে তুই চলে এলি এখানে?
হ্যাঁ, সন্ধেবেলা বাবা তখনো কাজ থেকে ফেরেনি। মা মন্দিরে পুজো দিতে গেছিল। সেই সুযোগে আমি পড়ার ঘরের ফ্যানে গামছা বেঁধে ঝুলে পড়লাম। একদম তোর মতো!  ভালো করিনি বল্?
বোকা মেয়ে! 
এই বলে বোনকে জড়িয়ে ধরলো দাদা।
ঝুরোগল্প 

কাজল সেন 

প্রস্তাব 
চিত্রঋণ : দালি 


মেনীমুখো ছেলেদের একেবারেই পছন্দ নয় আরাধ্যার। যেসব ছেলেরা ভালোমানুষের মতো মুখ করে ঘুরে বেড়ায়, আড়চোখে মেয়েদের মুখ ও শরীরের দিকে তাকায়, চোখ নামিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে, কথা বলতে বলতে ঘামে আর বারবার সিনট্যাক্স ভুল করে, আরাধ্যা তাদের সহ্যই করতে পারে না। এইসব ফালতু ছেলেগুলো তার দু’চোখের বিষ। কাছাকাছি এলেই আরাধ্যার কেমন যেন অ্যালার্জি শুরু হয়। গা-হাত-পা চুলকোতে থাকে, নাক থেকে জল গড়ায়। আরাধ্যার মনে হয়, এখুনি দূরে ছুটে না পালালে তার নিস্তার নেই। অ্যালার্জির ট্যাবলেট খেয়ে একটানা চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে তবেই আবার তরতাজা  হয়ে উঠবে।

আর এভাবেই স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির বছরগুলিতে একটাও মনোমতো লাভার, নিদেনপক্ষে একটাও বয়ফ্রেন্ড জোটাতে না পেরে, একটা বিখ্যাত রিফ্যাক্ট্রিজ কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে চাকরিতে জয়েন করল আরাধ্যা। জুনিয়র সিরামিস্ট-কেমিস্টের চাকরি। বেশ ভালোই চলছিল চাকরিজীবন। কোনো ঝুটঝামেলা নেই। সহকর্মীরা প্রায় সবাই তার বড়কাকা বা বড়দাদার বয়সী এবং বিবাহিত। তার সিডিউল্ড জব ছিল, প্রতিদিন কোম্পানির স্টকইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন উৎপাদিত রিফ্যাক্ট্রিজ ব্রিকসের নমুনা সংগ্রহ করে এনে ল্যাবরেটরিতে তার ফিজিক্যাল ও কেমিক্যাল টেস্ট করে তার রিপোর্ট সিনিয়র সিরামিস্ট-কেমিস্টের কাছে জমা দেওয়া।

কিন্তু আরাধ্যা একথা ভাবতেও পারেনি যে, কোনো মেনীনুখো নরম সরম নিরামিষ ছেলে নয়, বরং রীতিমতো আমিষ, তার থেকে বছর বারো বড়, বিবাহিত পুরুষ, কোম্পানির সিনিয়র কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার ড. সুখবিন্দর খান্না ডাকাতের মতো শুধুমাত্র প্রেম নিবেদন নয়, বরং সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব করবে। নিতান্ত যৌনাবস্থা থেকে আরাধ্যা হয়তো এইরকমই এক পুরুষের পৌরুষ কামনা করে এসেছে তার জীবনে, কিন্তু সুখবিন্দরের এই বেপরোয়া প্রস্তাব শুনে সে হতভম্ব হয়ে গেল। বলে কী লোকটা! এ তো দুঃসাহসিক ডাকাতির প্রয়াস! ঘরে একটা জলজ্যান্ত বউ থাকা সত্ত্বেও সে আরাধ্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে! আরাধ্যা রীতিমতো হকচকিয়ে সুখবিন্দরের চোখ থেকে চোখ না সরিয়েও ভেবে পাচ্ছিল না, যোগ্য জবাব সে কী দেবে!

সুখবিন্দরের অবশ্য কোনো তাড়া ছিল না। সময় নিয়ে ভেবে দেখতে বলেছিল আরাধ্যাকে। আরও জানিয়েছিল, তার স্ত্রী সীমা দীর্ঘদিন অসুস্থ। প্রায় বিছানাতেই  থাকে। সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো আশ্বাস দেয়নি ডাক্তার। যে কোনো সময়েই শরীর আরও বিপর্যস্ত হয়ে এমনকি মৃত্যুরও মুখোমুখি হতে পারে। মৃত্যুর আগে তাই  সীমার একান্ত সাধ, সুখবিন্দরের জীবন যেন শূন্যতার শিকার না হয়, দ্বিতীয় স্ত্রী এসে যেন শূন্যতা ভরাট করে, এবং সে তা দেখে বিদায় নিতে চায়।

সুখবিন্দর সরাসরি আরাধ্যার কাছে প্রস্তাব রেখেছিল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি, তুমি সম্মত হলে আমাকে বিয়ে করতে পার। আমার স্ত্রী  সীমার আগ্রহেই তোমার কাছে এই প্রস্তাব রাখলাম। আমি আমার সীমাকে বিগত আট বছর প্রচন্ড ভালোবেসেছি, দৈহিক সুখ দিয়েছি, কিন্তু সন্তান দিতে পারিনি। আসলে আমার ক্ষমতা থাকলেও সীমার ধারণ করার ক্ষমতা ছিল না। আমি জানি, সীমা চলে গেলে আমি খুবই কষ্ট পাব। তবুও কথা দিতে পারি, তোমাকে সুখী করার জন্য দায়বদ্ধ থাকব।