Tuesday, February 27, 2018

টংঘরে রাজা প্রথম মনীন্দ্র গুপ্ত
রমিত দে 


 ...” জন্ম থেকে এই জগৎকে পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছি, আর তাঁর বিচিত্র অর্থ মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। নিজে নিজে একা একা এইসব নিয়ে কথা বলি। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই কথা বলাটাই আমার কবিতা । জগৎকে আমি দেখি কালস্রোতের মধ্যে-  কখনো উদাসীনভাবে বহমান, কখনো অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের আলাদা আলাদা ঘরে স্থানু। যতদিন বাঁচি, তাঁর সঙ্গে আমার সংযোগ, সংগম, সম্পর্কের আশ্চর্য কথা বলে যাই। মনে হয়, আমার জীবনের সম্পূর্ন অসার্থকতার মধ্যে, শেষ পর্যন্ত, এইটুকুই সার্থকতা”.... এভাবেই পেরোতে পেরোতে প্রসন্নতার সন্ধানে মনীন্দ্র গুপ্ত তাঁর সব চলাকে সংক্রামিত করে গেছেন ষড়রিপুময় ভ্রমনে। যেখানে একটা যাওয়া অপূর্ব। একটা ফিরে আসা অপূর্ব। কখনও কোনো এক শব্দের পেছনে ছোটা, কাটা ঘুড়ির পেছনে ছেলেরা যেমন ছোটে, আবার হয়ত কখনোবা এমন একটা থামা, যা থেমে থেমে কবিকে ডাকে, জুড়ে দেয় মাটির সাথে মস্করা। যেন এই অনন্ত কুঞ্জবনেই তাঁর নীল পাথরের আকাশ তাঁর নিকষ ম্যানিফেস্টো।
মনীন্দ্র গুপ্ত বলতেন বয়সটা একটা মায়া; তাঁর কবিতার বয়সের ক্ষেত্রেও যেন ঠিক এটাই প্রযোজ্য; জীবনের প্রান্তে এসে তাঁকে বলতে শুনি- ‘জীবনের শেষ লেখায় কোনো তারিখ থাকে না,কোনো ঠিকানা থাকে না, এ জায়গাটা এক কল্পিত নদীর পারে,অজ্ঞাত বনের ধারে। এখানে আমার আসার কারন কী? নিজে আসিনি, এইটুকু জানি।কেউ আমাকে নিয়ে এসেছে, তাও নয় ।এসে পড়েছি-ব্যস, এই মাত্র।‘-  আঙ্গিক থেকে স্বরায়ন, প্রবেশ্যতা থেকে অপ্রবেশ্যতা, বিষয় থেকে বিষয়হীন হয়ে ওঠা কিংবা বিম্ব থেকে প্রতিবিম্বের বহুস্বরিক তাত্ত্বিকতায় তিনি যেন নিজেই এক গতিময় রেখা, এক রহস্যময় রং । দশকচিহ্নহীন কবিতার পিঠে চেপে শিবপিথেকাস, রামপিথেকাস, পিকিং মানুষের ফেলে দেওয়া ভাঙা হাঁড়ি সরার খেলাঘর গুছিয়ে বহুমাত্রিক চেতনায় মেতেছে যাঁর অনতিক্রম স্বতন্ত্র । প্রকৃত অর্থে পরিব্রাজক। সীমার মধ্যেও শতশরতের আয়ু নেওয়া অক্ষর পুরুষ। তাঁকে কিভাবে ভাবব! চল্লিশের কবি? পঞ্চাশের কবি? ষাটের কবি? নাকি দু হাজার পরবর্তী সময়েও তাঁর কাব্যপ্রত্যয়টি রয়ে গেল ঋজুরেখ! পরিব্যপ্ত ও বিস্তৃত এক অনুভূতির জগতে দাঁড় করিয়ে রেখে গেলেন মনীদ্র গুপ্ত। তাঁর কোলাহলহীন অবিশ্রাম স্থিতিবিন্যাসের পাশে, পাহাড়প্রমান মনঃসংকলনের পাশে এসে দাঁড়ালে মনে হয় অসংখ্য সাদা ফুল, অসংখ্য ভিজ়ে মাটি , অনন্ত ফেরিওয়ালার ক্ষীণ গলিপথ ধরে ফেরা আর ফিরে দেখার অসমীকরন নিয়ে চিরসত্যের দিকে চলেছেন, চলেছেন নির্বিকার সম্ভারের দিকে। খড়কুটো মরা পাতা অতীন্দ্রীয় ঋতুচক্রের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন নিজের পথ নিজের অনুভাবিত ভাঁটফুলগুলি। তাঁর সারাজীনের পংক্তিতে অসংখ্য প্রতিফলনের ভীড়,যা এক কথায় জীবনকে দেখার ফসল, কখনও কখনও যে গল্প বলা হয়নি, স্মৃতি যাকে পুনরুদ্ধার করতে পারেনি জীবনের সেসব টুকরোকেও তিনি তুলে এনেছেন তাঁর শব্দভুবনে,আশ্চর্য্য কবিতা ,গদ্যে। নিজেকে ঠাট্টা করে বলতেন –“ আমি এক পিদ্রু সাহেব, তেড়াবেঁকা সোলা-হ্যাট মাথায় দেশে দেশে গোল্ড প্রসপেক্ট করে বেড়াই”। প্রকৃত অর্থেই তিনি কুড়ানি, পৃথিবীব্যাপী মানবনাট্য কুড়িয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন ধরে; মনের চোখ দিয়ে কখনো উতরোল সমুদ্র জীবনে আবার কখনো বা গোলাপি পায়ের পাতা হাঁসের মতই বট পাকুড়ের ব্যাপারী হয়ে শূন্য থেকে লাফিয়ে নেমেছেন শ্রমনে আবার কখনও শূন্যের উন্মুক্তিই হয়ে উঠেছে তাঁর একমাত্র অলখ অনুগত যাত্রা। স্মৃতির একান্ত থেকে সংসারী সংকলনের উপাদান-মানুষের “হাসি কান্না মুগ্ধতা প্রেম চপলতা বিষাদ ভয় অস্থিরতা” থেকে শুরু করে   ঢেঁকিশাক গাবগাছ আর বেতফলের প্রাগৌতিহাসিক স্থাপত্য- সবনিয়ে মনীন্দ্র গুপ্ত। সব কিছু থেকেই একজন শিল্পী একজন কবি কুড়িয়ে নিয়েছেন শব্দের বিমোহন কুড়িয়ে নিয়েছেন রঙের রাঙতা আর এই প্রতিবিম্বিত পৃথিবীর ভাষাই উত্তরাধিকার হিসেবে দান করে গেছেন পরম্পরার পাঠককে। মহাসময়ের মাঝে জেগে থাকা মনীন্দ্র গুপ্তের চেতনামহল, যেখানে ‘বিকেল-সন্ধ্যার রঙীন মেঘ আকাশ থেকে সিঁড়ি নামিয়ে দিয়েছে মাটির বাড়ির বারান্দায়”। যেখানে শিউলি ফুলের ফুটো দিয়ে বেরোলেই পাওয়া যাবে সাদা মেঘের দেশ আর স্বর্নচাঁপার ফুটো দিয়ে বেরোলেই মুনশীবাড়ি। আবার জ্যোৎস্নায় ফোটা হাস্নুহানা ফুলের সুক্ষ পথটূকু পেরোলেই ঝাড়লন্ঠন নিবে আসা এক চাঁদনী জলসার দেশ। হাটখোলা পৃথিবীর দ্বন্ধ নিরাময় খন্ড খন্ড ধ্যাননিবিড় ডায়ভারসিটির মধ্যেই যেন মনীন্দ্রগুপ্তের কল্পকলোনী। তাঁর কবিতাকে , তাঁর অনির্দেশ চিত্তবৃত্তিকে জানতে হলে আমাদের ফিরে আসতে হবে নৈসর্গিক গুটিপোকাদের কাছে, আঁকড়ে ধরতে হবে মাটি, পাহাড়ের পরিচর্যাকে।তুবড়ে টোল খেয়ে যাওয়া জীবনমিতির মাঝেই আঁকড়ে ধরতে হবে প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতাগুলোকে, পরবাসী কুড়ানীর মতো লেগে থাকা মধ্যবর্তী বৈভবগুলোকে সামিল করে নিতে হবে তাদেরই গন্ধসলিলে।
আপনার কবিতা লেখার সূচনা সম্পর্কে বলুন!- শিলীন্দ্র ৯৪ সংখ্যায় কমল মুখোপাধ্যায়ের এমনই প্রশ্নের উত্তরে মনীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন- “ একজন দোয়েল কবে গান গাইতে শুরু করেছিল? একজন উদবেরাল কবে সাঁতাঁর কাটতে শুরু করল? একজন মৌমাছি কবে কেমন করে চাক বাঁধতে শিখল?এসব প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবে?  মনে পড়ে চেতনা জাগার পর থেকেই নির্সগ আমাকে দারুন মুগ্ধ করত। নির্সগের সৌন্দর্য আমি অনুভব করতে পারতাম- মন কেমন করত- মন আঁকুবাঁকু করত। সেই পলায়মান সৌন্দর্যকে আমি মন দিয়ে ধরে রাখতে চাইতাম। অপরিচিত অর্ধপরিচিত যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মুখ ও আকৃতি আমি বিস্ময়ের সঙ্গে নিরীক্ষন করতাম। তাদের ঐ বাইরের খোলস, নড়াচড়ার ভঙ্গি দেখে দেখে ক্রমশ আভাস পেতাম  তাদের জীবনের, রহস্যের। ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম, মৃত্যু, সময়, মহাকাশ নিয়ে নানা দার্শনিক চিন্তা মাথায় ঢুকল। এই সময় আমার মনে হত , আমি হয়ত চিত্রকর এবং ভাবুক। একসময় আর পাঁচটা ছেলের মতো লিবিডো আমার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল। হতে পারে, তাঁরই তাডনায় আমার কবিতায় মনোনিবেশ। অন্তত আমার প্রথম বই ‘ আমরা তিনজন’ সেই কথাই বলে। তাঁরপর একদিন লিবিডো আমাকে দংশন করল। বিষ টেনে নেবার জন্য এই সময় কবিতাই বিষপাথরের কাজ করেছিল। ক্রমে কবিতাই আমার পরম আশ্রয় হল।“.....
মনীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে লেখার প্রাথমিক সংকটই হল ঠিক কোন দশকীয় ফ্রেমে তাঁকে ন্যারেট করা যাবে? তিনি যেন এক বয়সহারা চিরদিনের শিশু যে চেতনার অলীক তাঁতযন্ত্রটি খুলে রেখেছে সময়হীনভাবে। ১৯২৬ এ মনীন্দ্র গুপ্তের জন্ম। আর মোটামুটি চল্লিশের কবিদের মধ্যেই প্রাথমিক প্রজ্ঞার জন্মমূর্হুত। কিন্তু মনীন্দ্র গুপ্ত  জীবনের অজস্র প্রতিরূপে, অনন্য অভিজ্ঞতায় নিজেকে গড়েছেন, বেজে উঠেছেন নিরবে নিবিড়ে। বিশ্বনিয়মের বাইরে গিয়ে নয় বরং শেকড় যেমন আঁকড়ে ধরে মাটিকে, মাটি যেমন পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে শেকড়কে , তেমনি চিররহস্যের মালবেরীকে ঘিরে মনীন্দ্র গুপ্তের সম্প্রসারিত কুড়ানীজীবন পৌঁছে গেছে সামান্য থেকে অসামান্যে, নির্মান থেকে বিনির্মানে। হাইব্রিডেশন নয়, তাঁর কবিতা-ভাষা তাঁর নিজস্ব, গ্রীষ্ম বর্ষায় কুড়িয়ে নেওয়া,ফুলের গর্তে কু দেওয়া আনফ্রেমড আনন্দ বিষাদ। একদিকে তা আমাদের সবার ভাষা অপরদিকে সে যেন এক অন্যমহাদেশ।  আসলে যেটুকু সত্য কেবল সেটুকু ভাসাতে গেলে যে  অকূল জলে ভাসতে হয় দশকের পর দশক পেরিয়ে তাই আমাদের নিয়ে চলে দূরনির্দিষ্ট অন্য এক দ্বিতীয়তায়। তিনি বলতেন তাঁর লেখা আসে জীবন থেকে, কিন্তু তার চাষ হয় মনের মধ্যে, ফসল যেটুকু ওঠে সবই মনের মাঠের, কিন্তু মন কেউ দেখতে পায়না। হয়ত এ জন্যই মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতারা বুড়ো হয়েও বুড়ো হয়না, চৈত্রের বুক ফেটে বেরোয় পলাশ, ডাকতে ডাকতে পাখির বুক ফাঁকা হয়ে যায়। তবু শূন্য শূন্য সব শূন্যের মাঝে পড়ে থাকা ফোঁটা ফোঁটা স্মৃতির ভ্রূনদল বেয়ে প্রকৃতিলীন কবির সাথে দেখা হয়ে যায় কীভাবে কোথায় যেন কোনো স্মৃতিজাগর এগজিটে.....
“বসে থাকতে থাকতে একা হঠাৎ ভিতর ভিজে ওঠে
চারদিক খুব শুকিয়ে রেখেছিলাম; ছাতা, ধুতি, ধান,
কচি আম এবং হৃদয়। কিন্তু
হৃদয় একটি জলাধার। জ্ঞানী জানে, জল ঢলাঢলি করে কিংবা
উবে যায়। এক গাঁজাখোর শুধু দেখেছিল,
নল থেকে লাঠিজল নিষ্কম্প দাঁড়ানো শক্ত শানে।
আমি সেই গেঁজেলের মতো আগাগোড়া ভুল দেখে গেছি।–
                           আজ তাঁর শোধঃ
এই সন্ধ্যেবেলা গভীর ঘনায়মান মেঘমালা চেপে আসছে
সম্পূর্ন বিচ্ছেদ টেনে। দূরে মিজোগ্রাম কিংবা মেঘেরই ভিতরে
হয়তো বৃষ্টি পড়ছে- অন্ধকারে সমস্ত সম্ভব।
নিভু আঁচে অস্পষ্ট রান্নায় কারো সম্পর্কের ছল
কালো স্লেটে ইটলালে শিশুর আঁকার মতো ভেঙে আছে........”
                                ...........(জল/লাল স্কুলবাড়ি)
এই অক্ষর তো অভেদের, ব্যপকতার, দৃশ্যের সারফেসিয়াল বিজ্ঞাপন থেকে বেরিয়ে আন্তর্দৃশ্যের অনিবার্য দর্শন। দশকের মালিকানা ছাড়াই যা সংযোজিত হয়ে চলেছে পাঠকের অন্তরঙ্গ ঘনত্বে । মাঝে মাঝে মনে হয় একজন পাঠকের হাড়ের ভেতর কতদূর গড়িয়ে নামে এই সংবেদনময় জল? এই একা হঠাৎ ভিতর ভিজে ওঠা কতদূর দখল নেয় আত্মচৈতন্যে? মনীন্দ্র গুপ্তের এক একটা কবিতার জন্মকাহিনীর পাশে পাঠক বোধহয় প্রাথমিক ভাবে নির্বাক। চিরাচরিত কাব্যপাঠের অভ্যেসকে তা পঙ্গু করে নতুন মনোপথ তৈরি করে দেয়। যিনি লেখেন তিনি ফিকে সুগন্ধের মত নতুন এক জল ঘেঁটে নৌকোপথ ঘেঁটে কালোনীল জলতন্তুর নিঃশব্দ মৌলটি তুলে দেন সহজের বিমূর্ততায়। তাঁর কবিতার বিস্ময়কর বাঁকগুলো গড়ে উঠেছে লৌকিক শব্দের অলৌকিকতায়, আর এভাবেই পার্থিব জগতের সমান্তরালে অপার্থিব একটি জগত গড়ে ওঠে পাঠকের সামনে । কবিতার মধ্যে এভাবে একই সাথে একধরনের নির্জনতা আবার অন্যদিকে অনন্ত ফেলিসিটি বিস্ময়াবিষ্ট করে রাখে আমাদের । একটি কবিতার সম্ভাব্য ব্যাখা-বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসে অনির্দিষ্ট অর্বুদ সংখ্যক নতুনকে।
মনীন্দ্র গুপ্ত নিজেই মনে করতেন কবিতা কোনো নিরেট বস্তু নয়। কিন্তু কবিতার শতরঞ্জে কথামালাকে হাঁটাতে গেলে বোধের ঠিক কতখানি সেলিব্রেশন দরকার? অক্ষরের ভরকেন্দ্রে শব্দের যে একতাল কাদা তাকে নৈঃশব্দে পরিনত করতে গেলেই বা কতটা বৃত্ত ভাঙার খেলা! বুদ্ধিবাদ? ঝুঁকি? স্ট্রাকচার টেক্সচারের বর্হিগৃহ নির্ধারণ? শিল্পশেকড়ের ভাঁজে ভাঁজে জারিত করে নেওয়া জিওপোয়িট্রিক্স এ্যাম্বিয়ান্স? মনীন্দ্র গুপ্তের কাছে এসবের ঠিকানা ছিল নিজের সত্যের কাছে পৌঁছোনো। তিনি যেন নিজেকেই তাঁর কবিতায় বিশ্বাস করতে চেয়েছেন, বিশ্বাস করতে চেয়েছেন শব্দের বাইরে শব্দের আরও একটা মূর্তি আছে এবং তাই শেষমেশ বিশোধিত কবিতাপথ। আসলে স্রেফ চোখ দিয়ে নয় চোখের পাতার ভেতর দিয়ে অনুভব করলেই হয়ত তাঁর অনুভূতিলোকের কিছুটা এরিয়েল ভিউ পাওয়া যাবে; মনীন্দ্র গুপ্ত মানেই যে কালনিরপেক্ষ বিশাল ভাবনারাশি তার নির্ভুল স্বরস্থান হয়ত একজন পাঠকের পক্ষে কোনওদিনই সম্পূর্ণ অনুধাবন করা সম্ভব না তবু তাঁর কিছু কবিতাংশের কাছে একজন সময়প্রতিনিধি মাত্র হয়েই ফিরে ফিরে আসতেই পারি আমরা। যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় এ কবির সাথে একসাথে কি বাস করিনা আমরা? যেমন-
“এই ভাবে ঘুমোতে ঘুমোতে, স্বপ্ন দেখতে দেখতে, জেগে থাকতে থাকতে
একদিন মরে যাব।
ব্রম্ভসূত্র বলছেন, মৃত্যু হল আত্মার ঐ তিন অবস্থার বাইরে
আর এক অন্য অবস্থা।
আমি দেখছি , অ্যানিসথিসিয়া প্রয়োগে আত্মা
আরও এক পঞ্চম অবস্থায় পৌঁছয়।
সে অবস্থা, কি বলব, সিনথেটিক সুষুপ্তির
যাতে মৃত্যুর ঈষৎ স্বাদ আছে।“..........................(ব্রম্ভসূত্র-২/ নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ)
কোথাও মনে পড়ে এজরা পাউণ্ডের ‘এ্যাণ্ড দ্য ডেইস আর নট ফুল এনফ’ এর সেই সনাতন পূর্ননির্মান- ‘And the days are not full enough/ And the nights are not full enough/ And life slips by like a field mouse/ Not shaking the grass’। বোধ এখানে বহুমাত্রিক। দৃশ্যমান যাপনের মধ্যে কোথাও সেই ডিভাইন কসমেটিক নিয়ে গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসেন কবি। অগন্য ছায়াদের মুখোমুখি এক আত্ম অবলুপ্তির দিকেই তাঁর প্রার্থনা। তাঁর সংস্কার। তাঁর নিখুঁত হয়ে ওঠা। থাকা আর না থাকার ভেতর অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্যই যেন তাঁর সচেতন অনুরনন। আসক্তিময় গোলকধাঁধা আর ছায়ামিছিলের মাঝে এ যেন দ্বিতীয় জাগরন। ছায়ার হাত ধরে বিম্ব থেকে প্রতিবিম্বের পরিকল্পিত দখলদারীতেই মনীন্দ্র গুপ্তের নিজস্বতা। জীবনের অভাব থেকেই অদ্ভুত আলো আসে মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতায়। বোঝা যায় নিরেট সময়ের তাল থেকে সমস্ত স্মৃতিময় দৃশ্যাবলী থেকে তিনি যেন ক্রমাগত একধরনের সংকেত গ্রহণ করে চলেছেন যার কারণ খুঁজতে বসেও হয়ত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না কারণ যে শব্দকে তিনি আঁকড়ে ধরেছেন নখ বিঁধিয়ে কবিতার কাছে টেনে এনেছেন তা পাঁচ ইন্দ্রিয়ের কাছে শেষমেশ আবেদন জানিয়েছে ধ্বনি বর্ণ আর স্পর্শের অতীত আকুতিকেই।
টুনুনান্টাং এ ( পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান) তিনি লিখলেন-“বিশালতার মধ্যে পুনরাবৃত্তি আর একঘেয়েমি লীন হয়ে যায়- যেমন সমুদ্র, যেমন তারাভরা আকাশ, কালস্রোতের মধ্যে যেমন দিনের পর দিন। শিল্পেও এই ব্যাপারটাই তফাত করে দেয় চণ্ডিগড়ের নেকচাঁদের বাগানে আর যামিনী রায়ের ছবির গ্যালারীতে”....মনীন্দ্র গুপ্তের অনলময় কাব্যিক অরন্যেও যেন এমনই লীন সচেতন অনুভূতির বিহঙ্গ। তাঁর প্রাথমিক অপটু কাজগুলোকে বাদ দিলে ১৯৭৮এ প্রকাশিত ‘লাল স্কুলবাড়ি’ ( যার প্রায় সব কবিতাগুলিই বন্ধুর উঠে যাওয়া ব্যবসা থেকে পাওয়া হলদে গোলাপি আর সাদা ডেলিভারি চালানে লেখা) থেকে ২০০৯ এ ,বনে আজ কনচের্টো’ অবধি প্রায় সমস্ত রচনাতেই লক্ষ্য করা যায় নিজেকে ভাঙার কাজ , সীমার কাছে এসে পুনরায়  স্বসমীক্ষা। নিজেরই ভেতর নিজেকে পেরিয়ে এক দ্বিতীয় পৃথিবী গড়ার সারল্যই হয়ত মনীন্দ্র গুপ্তের বিশাল আয়ুর মত সৃষ্টির বিপুল প্রাপ্তি-আধারের অন্যতম কারণ। তিনি থামেননি, আশি পেরিয়ে নব্বই-এ পড়েছেন অথচ জীবনের শেষ লেখাটি নিয়ে মজার ছলে লিখতে বসেও মাঝখানে এসে পড়েছে লাল রং, একটা বিয়ের মেয়ের কল্পচিত্র আর ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাঁর মনকে নিয়ে চলে গেছে নবনির্মাণের পথে। পরিণততম রচনাটির দিকে আকল্পন ট্রেকিংই যেন তাঁর লেখার ঠিকানা। প্রতীক আর প্রবাহিত জীবনের মাঝে কি ইংগিতময় তাঁর কবিতা ! তাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কখনও কখনও বিষাদযাত্রা পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যায় অন্য এক বিশ্বাসভূমিতে, যেখানে শব্দের মধ্যে জীবন্ত নাড়াচাড়া, জানিনা কি পাওয়া যাবে একটূখানি খোঁজা ছাড়া, কিন্তু জীবনের আঁশ খুলে খুলে তার আমাদের নিয়ে চলে নতুন জলছবিতে-
“একটু টিপে,বার কয়েক গন্ধ শুঁকে
বুনো টুকটুকে আমটিকে
যেমন দোকানির ডালায় আবার নামিয়ে রেখে
চলে যায় খদ্দের, তেমনি করে ওরা
আমার মেয়েকে বার বার অপছন্দ করে গেছে।
তাঁরপর থেকে, দুপুরে, নিঃঝুম এক ঝাঁকড়া বট গাছের নিচে
মেয়েটা স্বপ্নাচ্ছন্ন উন্মাদিনীর মতো
চুল এলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
গভীরে রাত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে
সেই গাছের গায়ের সঙ্গে লেপটে অন্ধকারে মিলিয়ে থাকে।
বলে ঐ গাছ তাঁর বর।
আর সেই থেকে আমাদের বংশটাই অদ্ভুতভাবে বদলে গেল।
মারা যাবার পর আমি ঐ মেয়ের গর্ভে জন্মালাম।
মেয়ে আমার মা, বট গাছ আমার বাবা।“..........( পরিব্যক্তি-শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু)

একে কি প্রতিকবিতা বলা যেতে পারে? গাঢ উন্মুখর কল্পের সন্মোহন! অস্পষ্ট মানুষের হেঁটে যাওয়া থেকে অস্পষ্ট মানুষের থেমে যাওয়া এবং তারপর সে থেমে যাওয়ার ভেতর এক অমর আলো যে আলো চুরি করার কেউ নেই আর ! এমনই হয়ত মনীন্দ্রকবিতার বহুমাত্রিক সুক্ষতা। প্রবীন কবির পথনির্দেশিকায় বিমূর্ততাকে কেন্দ্র করে যা পিছলে নামছে অভিব্যতির এক অনন্য সংগ্রহশালার দিকে, সেখানে প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা অথচ বয়নের গোপনে গোপনে বিমূর্ততার অনির্বাণ লেখমালা। আসলে মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় ,গদ্যে তাঁর প্রতিটি ঘন নিবদ্ধ দার্শনিকতার আড়ালে রয়ে গেছে তাঁর ব্যক্তি জীবনের অপার গূঢাচার , অন্তর্লীন পরিসর আর জীবনের প্রতি তাঁর সরলীকৃত মাধুকরী। বাইরের পৃথিবী থেকে ভেতরের পৃথিবীতে ঢুকে পড়ার মত এক অলক্ষ্য ট্রান্সসেনডাল এক্সট্যাসিতে দাঁড়িয়ে মনীন্দ্র গুপ্তের একাধিক কবিতাতেই তাই হয়ত মানুষ মন আর মিথের কোথাও না কোথাও একটা যোগাযোগ আছে।
তারপর? গোয়ালঘরের গন্ধ, ভাত রান্নার গন্ধ, বাঁশঝাড়ের গন্ধ এইসব সাবেকি গন্ধকে নিয়ে কোথায় চললেন মনীন্দ্র গুপ্ত?কুয়াশালীন স্যানিটোরিয়ামে ঢুকতে ঢুকতে যেন অনিবার্য প্রবহমানতার ফ্রেস্কো। মনে পড়ে যায় বৃক্ষনাথ কমল চক্রবর্ত্তীর সহজেই বলে দেওয়া শব্দসংক্রমণ-“মানুষ যখন থামে, কবিতা তখন শুরু করে জারিজুরি। খুব ক্লান্ত মানুষ বারো ঘন্টা আঠারো ঘন্টা নাগাড়ে খেটে হঠাত ঝিম, কবিতা পাচ্ছে। কবিতা মন্ত্র দিচ্ছে। কবিতা জীবনী শক্তি। কবিতা পরদিনের তাগত। আবার সূর্য ওঠার ব্যবস্থা। রাতের জোনাকী, আঁধারের ঝিমঝিম, রক্তে জ্যোৎস্না। ঐ যা ছুঁতে পারি না , বুঝতে পারি না, দেখতে পাই না, ধরতে পাই না, তবু আছে মনে হয়। এমনকি একটা সিঁধেল ঐ যে গা ছমছম বুনো পথে, ঐ আলোহীন পৃথিবীর চোরাপথে সাপ , ব্যাঙ, জোঁক ডিঙিয়ে, কাঁটা, কাঁকড় এড়িয়ে, সে তো কবি। পেটকাপড়ে লুকোনো তাঁর সিঁদিকাঠি না ঝর্ণাকলম, মাটিতে সাক্ষর রাখতে চলেছে। কবির এই পথচলা ভাল লাগে। কবির এই আঁধার ভূবন অপূর্ব। কবিকে ডেকে বলি, চোরা এই পথে আমাকে নিবি? কবি কথা শোনে না, ঝোপঝাড়ে সুডুৎ, কোথায় হারিয়ে যায়। পৃথিবী আরও রহস্যময় সুন্দর হয়।“.......এমনই নির্লিপ্তে গল্প বলতে বসার মতই জীবন যেন মনীন্দ্র গুপ্তের কাছে এক খোল সার্কিট। যেখানে স্নেহাকুল ঘুলঘুলির রৌদ্র নিয়ে, অজয়পাড়ের বাউল নিয়ে অ্যাম্বারগ্রিসের কটূ গন্ধ নিয়ে ব্যক্তিগত নিভৃতেই কবি কনসিভড হয়ে যান অব্যক্ত যাতায়াতে, কবিতার অন্তমার্গের সাথে, ভেতরবাড়ির আবর্তগুলোর সাথে অ্যাবসার্ডিটিগুলোর সাথে।  আঁকর বাঁকর পেরিয়ে , বর্ণ ফাটল পেরিয়ে কোএ্যাগুলেট করে ইশারা গুলি, দীক্ষিত অন্তর্ঘাতগুলি। জলের গায়ে বিপদের গন্ধ রেখে নৌকো চলে যায়। গাছের কথা ছায়ার কথা চলে যায় মধুর মতো গাঢ সময়ের দিকে আর পৃথিবীর ভাষা নিয়ে ঘাসফড়িং এর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে কবি বিশ্বজনস্রোতে মনীন্দ্র গুপ্ত বসে থাকেনীক অকূলবিস্তীর্ণ নিমন্ত্রনপত্র নিয়ে -
“কলেজ হস্টেলের এল এস ডি খাওয়া প্রিয়ঙ্গুফুলের মতো মেয়েরা,
জাগো! ভোরের স্রোত গাছের মধ্যে ঘুরে ঘুরে
অক্সিজেন মেখে আসছে
জাগো!
গড়িয়ার আন্টূনি কবিয়াল, আর শ্যামবাজারের ভোলা ময়রা,
আজ সন্ধ্যায় আপনারা ধর্মতলার মোড়ে হাজির থাকবেন।
ঢাউস একখানা চাঁদ উঠবে আজ।
চাঁদ উঠলেই যানবাহন বন্ধ। তখন
তরজার একখানা দারুন আসর বসবে-
আমরা পুরো শহরটাকে নিয়ে আসছি।
জাগো!”..................চন্দ্রহাস/ লাল স্কুলবাড়ি
নিরবিচ্ছিন্ন শব্দ নিয়ে তাঁর খেলা, সেখানে নেই সাময়িক উল্লাস। আবহমানে ফিরে আসার নিটোল বৃত্ত, নিস্কম্প সিদ্ধি, আকাশ ভোলানো রক্তরং আর ঠ্যাঙারে সন্ধ্যার দেশে গমগম করে বেজে ওঠে গতিময়তার প্রতিটা ইন্টারফেস। অলীক রূপকারের মত মনীন্দ্র গুপ্ত কোলাহল থেকে আনন্দ থেকে ফিরে ফিরে চলেন অনুধ্যানের দেশে আর তাঁর প্রতিটা সম্ভাব্য পরিভ্রমনে নিয়ে চলেন আলো অন্ধকারের শৃঙ্খলাযুক্ত রণন। মানুষের  মত দেখতে একজন কবি তার নিজস্ব জগত পেরিয়ে যদি অন্য এক সমাহিত জগতের দিকে তার প্রস্তাবনাটিকে বিছিয়ে দেন তখনই আমাদের মত সামান্য পরিত্রাণহীন পাঠকের কাছে তা হয়ে ওঠে প্রাণপণে জড়িয়ে থাকার এক আশ্রয়, পালানো যাবেনা কিছুতেই যার থেকে। থিমস , মেটা থিমসের ডিফর্মেশনের মধ্য দিয়ে রিডার্স ইমাজিনেশনকে মিশিয়ে দিয়েছেন রাইটার্স ভিসনে। আর এখানেই তাঁর কবিতায় ঘুরে বেড়ায় চোরের হাতের তেলচিটে ছায়া, ডাকাতের হাতের ক্ষারস্পর্শ কিম্বা মুর্হুতের আরশিচোখ যে মাছ হয়ে লাফিয়ে চলে গেল জলে। কেমিক্যাল ফ্যান্টাসি নয় কেবল এক দর্শন এক উপলব্ধ চৈতন্য যা বস্তু আর বস্তুবাদের আকরিক থেকে তুলে এনেছে বিপ্রতীপ্রের সৌম্য গহনতা। প্রেরনা বনাম নির্মানের প্রেক্ষিতে মনীন্দ্র গুপ্তের দীর্ঘ যাপন এবং খননের মনোহারিকে খানিকটা প্রাচীন অ্যালকেমীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে,  প্রাথমিক পেতলের থেকে সেই সোনা খোদাইয়ের নিমগ্ন বিস্ময়, ব্যক্তিগত বিন্যাস, যেন জীবনের খুঁটিনাটির মুখোমুখি কবি, স্বগত কথনের মুখোমুখি আর এই বিস্মিত তথ্যের শিরাস্ফুট জাদুই তাঁর জীবনকে নিয়ে চলে কেন্দ্রাভীগ কোন এক ক্যাম্পফায়ারের দিকে, স্বতন্ত্র্য রঙের ওয়ার্কশপে। লাইফ বিওন্ড দ্য বর্ডার লাইফ , বিওণ্ড দ্য আর্ট লাইফ , বিওণ্ড দ্য সিরিয়াসনেস...দৃষ্টগ্রাহ্য থেকে কনভেনশান থেকে ফিরে যান অনুনভাবিত এক পরিচ্ছদে যেখানে যাপিত জীবনের বাইরে প্রতীক্ষা অবাধ, যেখানে কবি বান্ধবীহীন সহপাঠিনীহীন অন্ধকার ঘরের মধ্যে ন্যাপথালিনের মেয়ের সাথে লুকিয়ে দেখেন...

“একটু ছত্রাকের মতো আলোয়
আধপাতা বিমর্ষ অক্ষর পড়ার বদলে
ঘিরে এল তারায় ভরা বিরাট অন্ধকার আকাশ;
যেন রাতের খাজুরাহোর মন্দিরচত্বরে এই নাচের উৎসব।

ভোরের ক্ষান্তবর্ষণ আকাশের নিচে
জোঁক ঘাসের পাতা থেকে পাতায় চলেছে,
সন্ধেবেলা কেয়াফুল ফুটেছিল,
পেছন থেকে সাপ এসে
তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে
শেষে সুগন্ধে ঘুমিয়ে পড়ল।

এবারের জন্ম এইরকমই সফল,
এবারের মৃত্যু এইরকমই রোমাঞ্চকর।“.............( সে যখন এল/ নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ)

একটা দেশের পর অন্য একটা দেশ , একটা ফুলের পর অন্য এক পারিজাত। হঠাৎ পাতা নড়ে ওঠার শব্দ, মৈথুন শস্য নারী পার্বণ মানুষ মানুষীর বিচিত্র জীবনায়নে তিনি যেন এক অনন্য আরন্যক। প্রাকৃতিক পেন্টহাউসের সরেজমিনে কখনো তাঁর প্রকৃতি স্বাভাবিক তো কখনও এই নিত্যছবিতে রং দিতে দিতেই আনকনসাস কালেক্টিভনেসের এক অপার জগতে ঢুকে পড়েছেন কবি, পড়ে গেছেন লাবন্য আর ভুতের খপ্পরে। নির্মিত ইকোলজির ভেতর সোচ্চার হয়ে থাকা , আবর্তসংকুল হয়ে থাকা তাঁর দুলর্ভ মনোজিন, যেমন পাতাঁর নিচে লুকিয়ে থাকা ফুল কিম্বা আঁশ উনুনের পাশে শুয়ে থাকা বেড়ালবউটি। টেকনিক থেকে বেরিয়ে এসে মিথভাঙা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর কবিতা সুশীল পথের পাশে ঝরে থাকা রোদ্দুরের সাথে কখনো একা একা চলে গেছে,আবার কখনো ছায়া ধরে ধরে ফির এসেছে হলুদ রঙের বাড়ির অসুখ জানতে, এক ঝাঁক কলহাসি নুড়ির মতো বাজতে বাজতে খাদে খাঁদলে গড়িয়ে গেছে সেই মুনলাইট সোনাটার বন থেকে কুয়াশা পাতানো মানুষের নিঃশব্দ ফরেন্সিকে। তাঁর চেতনাধর্মের কাছে প্রকৃতির সংজ্ঞা অনেকটা প্রাকনির্দেশক, অন্তর্লীন..যার দ্বিতীয় নেই তৃতীয় নেই কেবল প্রথম আছে কেবল প্রাকৃতিক আছে আর তারই খোঁজে কবির মহড়া, সেই প্রথম চলাচলের ছায়াশরীর নিয়েই এক পথিকের অনুধ্যাননা...

‘মনে করোঃ
প্রলয়ের পর নতুন পৃথিবী জাগছে- অন্ধ শূন্যের মেঘের মত সাদা মাটি।
এইবার কি কি চাই বলো।‘

‘সূর্য, হাওয়া, জলাশয়,
গাছ অবশ্যই...
আর তুমি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ- স্বতঃসিদ্ধ আমি তো আছিই।‘.... ( ঈশ্বর/ লাল স্কুলবাড়ি )

এক অনন্ত প্যারাডক্সে দাঁড়িয়ে এঁকে চলেছেন সাড়হীন গাছপালা, ঘোলা রঙের চতুর্থীর চাঁদ কিম্বা আহীর গ্রামের ভরা যুবতীদের ঘড়া ভরে দুধ নিয়ে মিশে যাওয়া দিগন্তরেখায়। মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় টোকা দিলেই নিসর্গডাকের এমনই সব মাস্টারপিস।অবসরের ভেতরেও জেগে থাকে সেই ক্রমজায়মান সিঁড়িঘর, যা নিয়ে চলে বর্হিগৃহের দিকে, সুনিশ্চয় সাড়ের দিকে, শ্বাশত প্রথম থেকে প্রকৃতির প্রতিনিধি হয়ে ইউটোপিক সমতান হয়েও মনীন্দ্র গুপ্ত বারবার  ফিরে এসেছেন শস্য নারী সন্তানের টানে, পার্বন গোষ্ঠীর সুখ যুদ্ধ ঘৃনা জয়ের দোসর হয়ে। মনীন্দ্র গুপ্তের পরিব্যাপ্তিতে এভাবেই একীভূত মানুষ, একীভূত প্রকৃতি।  প্রাণ আর প্রকৃতির অস্থায়ী সেক্টরগুলির সাহচর্যেই গড়ে উঠেছে তাঁর পথিকসত্তার দূরাধিগম্য বর্ণমালা। জনমানুষ ও বনমানুষের উৎসর্গেও দেখা গেল স্বপ্নগাহন সন্মোহনের ভেতরেই জন্মের রহস্য খুঁজে চলেছেন কবি। তাঁর কাব্যজগত তাঁর আকাশী নীল আত্মজৈবনিক উপাদানগুলিকে উৎসর্গ করলেন-
            কুকুর বেড়াল ফড়িং গিরগিটি
  পুকুর নুড়ি ফিঙে ভাঁটফুল
  গাঁয়ের বাইরের বাঁশবন আর
  সন্ধ্যামেঘ ও রাতের ছায়াবনকে

আবার, পরবাসী কুড়ানী ও দারুমা সনের ঈশ্বর, কবিতা, সন্ন্যাসী পর্যায়ে মাধ্যাকর্ষনের কাছেই তিনি কাব্যনিষ্ঠ। জীবনের খেলাধূলো নিয়ে, অনিবার্য পর্যটন নিয়েই তাঁর আনন্দময় বাড়ি , তাঁর অর্কিডঘরের বারান্দা। পাতলা কালির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে নিজস্ব অনুগত যোগ বিয়োগ, অনুচ্চারিত সমীকরন। যেখানে তিনি অক্লেশে বলেন- “এই জগতের অতিরিক্ত, বহিভূর্ত ঈশ্বর আমার বুদ্ধির অতীত। আমি দশদিকে তাকিয়ে শুধু জগতকে দেখতে পাই। সেই জগত সৌন্দর্যে, রহস্যে, শক্তিতে হয়তো ঈশ্বরেরও অধিক ঐশ্বরিক। কিন্তু আমি কি তাঁর ঈশিত্ব টের পাই? অদৃশ্য ঈশ্বর আমার কাছে বরং দৃশ্যমান হয়ে ওঠেন ঈশ্বরভাবিত মানুষদের মুখমন্ডলে, তাঁদের জীবনযাপনে, তাঁদের কুটির ভিক্ষাপাত্র ঝুলি কম্বল কৌপীনে, সামান্য তৈজসপত্রে। এই আধারগুলি এত পলকা এত স্বচ্ছ এত নিরহংকার যে সেই প্রতিবিম্বগুলির মধ্যে মূল বস্তু জ্বলজ্বল করে ওঠে দেখতে পাই।”....... তাঁর ছেড়ে যাওয়া সম্ভবের ভেতর রয়ে গেল অসীম সম্ভব্যতার মহড়া।  দীর্ঘ সত্তর বছরের মনীন্দ্রীয় কবিতার কিছু নমুনা এবং তাদের অন্তর্গত যুক্তিগঠনের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কেবল এক ভবিষ্যতদ্রষ্টার ভূমিকায় নয় বরং বিষয় ও বিস্ময়ের ভেতর শেকড়গভীর জীবনবোধ নিয়ে চিরউদাসীন সন্তের মত ঘুরে বেড়ানো এক কবিকে –যিনি জল আর স্থলের মাঝখানের মানুষ, ঘন ক্ষীর ভরা জামবাটির মত জীবনের প্রতি ভালবাসায় বুঁদ হয়ে আছেন , যেকোনো মহত্বে পৌঁছোনোর চেয়েও স্রেফ জীবনের অন্তঃস্থল অবধি দেখতে চাওয়ার জন্যই কালো মেঘের কানাউঁচু গায়ে লেগে আছেন পাঁচশো বছরের পিঁপড়ের মত। সেখানে চরাচরের আরকে জারিত হয়ে যায় মানবজীবন, অনুবীক্ষনে ধরা পড়ে দূরাগত নদী, অস্তসুর্যের ভাটিয়ালি  -
১।।
     আমি পারি না। কিন্তু তোমরা প্রত্যেকটি পরিবার বাড়ি তৈরী করো-
আনন্দময় বাড়ি।
আমি প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা প্ল্যান করে দেব,
নিজে দেখাশোনা করে বানিয়ে দেব।
গোনাগুনতি খোলা সিঁড়ি ছাদে উঠে গেছে এমনভাবে যেন শিশুরা
মনে করবে তারা আকাশে উঠছে। বাজপাখি দুপুর-মৌতাতে
পাহাড়চূড়া ভেবে জলের ট্যাংকে বসবে।       
       ( বাড়ি/ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ)

২।।
একদিন উদর ভাসিয়ে, ফুলে, নিজের জলেই ডুবে
ভেসে ওঠে শব।
ঘুরে ঘুরে এতদিন পরে
কনে ফিরে এল বরের বাড়িতে।
কেউ নেই।
ভাঙা কলসি, ছেঁড়া চাল, চকমকিহীন সন্ধ্যা।
ভস্ম হেঁটে হেঁটে যায়-সামনে জল- দুকুলপ্লাবিনী গঙ্গা।
( হরমোন প্রোল্যাক্টিনের শয়তানি/ ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ)
৩।।

রোজ রাত্রে স্বপ্নে আমাদের আনা হয়
ভিজে ঠান্ডা নদীর চোরাবালিতে-
ডুবতে ডুবতে বালিতে আমার দাঁত ঝলসায়
দাঁতে-বালি-মানুষের গলা হাসে-
ঝটকা দিয়ে তোমার পায়ের হাড় টেনে ধরে শিকলের মতো ডুবি
( পিশাচ/ ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ)

৪।।
ঘুমিয়েছিস?
এবার আমি তোর স্বপ্নের উপর হাত বুলিয়ে দিই-
তুই গভীর সুষুপ্তিতে তলিয়ে যা। দ্বাপর, ত্রেতা, সত্য পর্যন্ত তলিয়ে থাক।
যতদিন না তোকে চাপা দিয়ে বড় বড় গাছে অরন্য আবার সূর্যহীন হয়ে ওঠে,
যতদিন না দীর্ঘদংষ্ট্রা বাঘ, বিশাল গনেশ হাতি জন্ম নেয়,
যতদিন না কোনো ডাঙার জীব জলকেলি করতে করতে
সমুদ্রের তিমিতে রুপান্তরিত হয়।
তুই ঘুমো।।
কল্প কল্পান্ত ধরে ঘুমোলে যদি এই দুঃখদাহের শান্তি হয়।

                                  ( শান্তি-শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু)

৫।।
নুলিয়ার যদি পেট না থাকত, পেটে খিদে না থাকত, ঝোপড়িতে
বাচ্চাকাচ্চা না থাকত তবে সে সৈকত ধরে ধরে
শ্মশান পেরিয়ে, গঞ্জাম পেরিয়ে, কন্যাকুমারী পর্যন্ত চলে যেতে পারত
যেখানে তাঁর তিন দিকেই সমুদ্র।
..........
.........
সমুদ্রের তলায় নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না, না হলে সে
সেখানেই থাকত।
কখনোসখনো ভেসে উঠে পৃথিবীটাকে দেখত;
কী সুন্দর!
মেঘ
বালির ঢাল
দূরে ঝাউয়ের রেখা।
(নুলিয়া/ নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ )
বুড়ো এস্কিমোর মত মনীন্দ্র গুপ্তের দীর্ঘ কবিতাযাপনের দিকে তাকালে আমরা দেখব নিজের শরীর থেকে আলো নিয়ে একজন স্রষ্টা পাশাপাশি পেরিয়ে যেতে চান বরফের মধ্যে সমাধিস্থ ঘুমন্ত গাছকে, আবার বরফের বাইরের সেই অমিয় মোক্ষকে । অনুভবই যার জীবনদর্শন, নিজেকে যিনি আকাশ উপাসক ভাবতেই অভ্যস্ত সেই দীক্ষিত কবির কাছে জগতরহস্য বোধহয় পুরোপুরি কোনোদিনও উদ্ধার হওয়ার নয় আর তাই  জল বয়ে যাওয়া ঝোরায় গা ডুবিয়ে থাকা নুড়ির মত পড়ে থাকেন নির্বিকার আত্মঅন্বেষনে; কিছুতেই দ্রব্য হতে চান না। ভেসে যাওয়ার প্রশ্ন সেখানে অবান্তর। বায়োগ্রাফিয়া লিটারেরিয়াতে স্যামুয়েল টেলর কোলরিডজ যে লিরিক্যাল ব্যালাডের প্রস্থাবনা করেছিলেন, যেখানে তিনি বলছেন-.......“my endeavors should be directed to persons and characters supernatural, or at least romantic, yet so as to transfer from our inward nature a human interest and a semblance of truth sufficient to procure for these shadows of imagination that willing suspension of disbelief for the moment, which constitutes poetic faith”, .......এই সাময়িক মন্ত্রমুক্তি থেকে আরও কিছুটা পেরিয়ে এসে মনীন্দ্র গুপ্ত প্রস্তাবনা করলেন তাঁর নিরীশ্বর প্রতীতির, যেখানে প্রতিবিম্বগুলোর মধ্যেই ইনস্টল করলেন একটা ধ্যান, একটা জাগতিক আত্মমগ্নতা, ‘ আলোয় অতিরঞ্জিত কোনো সূদূর মেঘে, পাহাড়-পাথরের কোনো আলোছায়াময় নিস্পন্দ অংশে, রুক্ষ আকাশে মুয়াজ্জিনের চিৎকারের মতো কোনো উঁচু মিনারেটে, হাজার বছরের ছায়া-বৃষ্টি-হিমের ছোপ ধরা অতি নির্জন কোনো দেউড়িতে’ নিয়ে চললেন আড়ম্বরের যাপনকে , বিহ্বল পাঠককে। হয়ত বসবাসের মাঝে লুকিয়ে থাকা বিশালতাকে পেতে হলে কখনো কখনো এভাবেই দাঁড়িয়ে পড়তে হয় কবিকে-অপরিমেয়তার প্রান্তিক দিব্যতায়। এই যাত্রায় তাঁকে খানিক অপ্রাকৃত মনে হবে, যেখানে ঐশী ফাঁকটুকু ঘিরে সাজানো থাকে তাঁর মন্ত্র তাঁর ঘর না চেনা চারটে স্বর্নচাঁপা যা কিনা পেড়ে চারজনকে উপহার দেবার কথা ছিল! পথিকতার ভেতরই হেমন্তের একটি ঝরাপাতা আর ঝোপবাসী একটি ইটরঙের পাখিকে নিয়ে লিখতে বসেন নিরম্বু মহাসাগরের গর্ভে ডুবে থাকা সৃজনের অনুরনন। অবহেলার ঘন জঙ্গল, কুঁড়েঘর, ডোবা পুকুর পেরিয়ে বনের মধ্যে নিঃসঙ্গ হাতির বাচ্ছা পালিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পরে সন্ধ্যামেঘের কবির কাছে, শ্রবনফেরত সন্ন্যাসীর কাছে। কোন অতিরিক্তের ভেতর তাদের গভীরভাবে চাইলেন মনীন্দ্র গুপ্ত? লিখলেন-

   “মরা মাহুতকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে হাতি চলেছে সূর্যের কাছে
     রক্তকমলের মতো উতসর্গ করতে।
    গাছের ছায়া এখন পূবদিকে শুয়েছে-
    শুকনো ঘাসের গন্ধ-শীতের বনের অর্ধেক পাতা এখন হলদে-
    মৃত্যুকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে সে চলেছে সূর্যাস্তের কাছে।
    গৃহবাসী যেমন সন্ন্যাসী হবার আগে সব ছাড়ে।“........( খুনে হাতি/বনে আজ কনচের্টো)

সমকালীন কবিতাচর্চার আবহ প্রসঙ্গে রুপম চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্নোত্তরে নির্জন বইমেলা সংখ্যা ১৯৯৫ তে মনীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন-“ আমার সমসময়ের এক প্রান্তে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অন্য প্রান্তে আছে আজকে লিখতে শুরু করা অখ্যাত কিশোরটি।রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সার্বভৌম রাজার মতো শক্তিমান ও অভিজাত, যদিও সেই রাজা গনতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিতেন। সাহিত্য তখনও মিডিয়ার কবলে পড়ে নি, তবুও এক্ষেত্রে যা হয়, একটা সাহিত্যিক বাজার, সমাজ এবং একটা ভ্রান্ত শাসন ও অনিশ্চিত বিচার ব্যবস্থা তো ছিল। ফলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় উসকানি পেয়ে রবীন্দ্রনাথকে আক্রমন করতে পারতেন। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ভীতি প্রদর্শনে বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মৃদু আপত্তিতে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথকে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’কে বাজার থেকে তুলে নিতে হয়েছিল। অন্য দিকে বুদ্ধদেব বসুকে সপরিবারে সবান্ধবে শান্তিনিকেতনে নিমন্ত্রন করেন যে রবীন্দ্রনাথ তিনিই আবার জীবনানন্দকে একটি শুষ্ক কৃপন চিঠি লিখে ম্রিয়মান করে দেন।কিন্তু এসব সাময়িক প্রশ্রয় বা প্রত্যাখান কবিসমাজে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলেও পাঠকসমাজ ছিল দূরত্বে, তাদের শান্ত মুখে কোনো বৈলক্ষন্য দেখা যেত না। কবিতাচর্চাতেও এর ফলে কোনো জোয়ার ভাঁটা দেখা যায় নি। কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, জসীমউদ্দিন প্রভৃতি শান্ত তৃপ্ত পল্লীজীবনের কবিদের একটা প্রসন্ন জীবনের আর্দশ ছিল। সব মিলিয়ে অবস্থাটা যার যেমন ইচ্ছে লেখার অনুকুল ছিল।“......ষাটের দশকের আসা যাওয়ায় প্রায় সর্বোতো ভাবে ধরা থাকে দুটি দিক। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে প্রতিষেধক খোঁজার তাগিদে জীবনানন্দ ও সূধীন্দ্রনাথের অনুকরন কিম্বা নিকট পঞ্চাশের শরৎ-শক্তি-সুনীল প্রমুখের প্রভাব। স্বভাবতই ষাটের কবিদের ছিল না একত্রিত হওয়ার কোনো স্পষ্ট সীমারেখা যা ষাটের দশকের বাংলা কবিতার আউটলাইনকে মধ্যপন্থী পরিমিতির অবয়বে পরিনত করে। ষাটের কবিতা ও কবিদের নিয়ে উত্তর দ্বাদশেও তিনি বলেছেন “ষাটের কবিদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা,  পেশা , নেশা,  ডেরাডান্ডা সবই খুব অনিশ্চিত  ধরনের ছিল। হয়তো সেই সময়কার কৃশ ও রুক্ষ বসন্তের আক্ষেপে এত রকমের মানুষ কবিতা লিখতে এসেছিলেন। ফল= প্রথম শ্রেনীহীন কবিতা”। ষাটের দশকে মনীন্দ্র গুপ্তের তথাকথিত প্রথমদিককার আনকোরা অপটু কবিতাগুলিতেও এই ইতস্তত ছড়ানো মনভূমির পরিচয় পাওয়া যায়, যা তাঁর “নীল পাথরের আকাশ” কাব্যগ্রন্থে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয়। এ সময়ে তাঁর ভাব ভাষা গঠনে পূর্বজ কবিদের শিল্পস্বত্ত্বার কিছুটা হলেও প্রচ্ছন্ন আবছায়া এবং নিজেকে সেলফ সিম্বলিস্ট করে তোলার কিছুটা সমান্তরাল প্রচেষ্টাও দেখা যায়। ষাটের শেষ দিক থেকেই দেখা গেল সারা দেশ জুড়ে ভূমিহীন কৃষক আন্দোলন।নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া বুর্জোয়া আর আধাবুর্জোয়া শ্রেনীর হাত ধরে যে প্রতিবাদী কৃষক আন্দোলন যা মূলত আসাম অন্ধপ্রদেশ বিহার কেরালা হয়ে বাংলাতেও রাজনৈতিক নবফ্রন্টের স্রোত তুলেছিল তা আসলে শিল্পের প্রচ্ছায়াতেও সত্তর দশকে নিয়ে এল এক নতুন মূল্যবোধ নতুন মুক্তসমাজের প্রাসঙ্গিকতা। পার্থ বন্দোপাধ্যায়, দেবদাস আর্চায অভীক গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নবারুন ভট্টাচার্য নমিতা চৌধুরী পঞ্চাশ ষাটের অনেকেই তাই সামাজিক পটপরিবর্তনের এই নব্যসামাজিক অনিশ্চিত স্বরায়নে মনোনিবেশ করেছিলেন। এমনকি এই গনমঞ্চে এগিয়ে এসেছিলেন চল্লিশের সমাজ সচেতন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। চল্লিশের সমাজসচেতন ধারারই যেন নতুন নতুন রূপে কবির দায় আর কবিতার দায়বদ্ধতার প্রশ্ন নিয়ে , উত্তরাধিকার নিয়ে বহন করে চলছিলেন কমল চক্রবর্ত্তী অনন্য রায় বা অন্যান্য সত্তরের কবিরাও। এই প্রসঙ্গে সত্তর দশকের কবিতার ধারা নিয়ে ১৯৭২ এ ভূমিকা তে মনীন্দ্র গুপ্তের বয়ান বিশেষ উল্লেখযোগ্য-“আলাদা কোনো চরিত্র? সময়ের নিজস্ব ছাপ? না , স্পষ্টত তেমন কোনো বিশেষের সীলমোহরে এই এক বছরের ফসলকে দেখে দেওয়া যায় না। সময়ের ছাপ অবশ্যই থাকতে বাধ্য;-তবু তা বড্ড বিবিক্ত ও অস্পষ্ট। বাহাত্তরের প্রথম অংশটা ভ্রাতৃরক্তে নিমজ্জিত সেই একাত্তরেরই ভাঁটার কাল। একাত্তরের আগুন জ্বলেছিল। আগুন যজ্ঞের হোক, গৃহদাহের হোক, তাঁর জ্বলন্ত রূপের একটা নিজস্ব মহিমা আছে।বাহাত্তরের প্রথমে সেই আগুন নিভে এল; পড়ে রইল শুধু পোড়া কাঠ; হাহাকার, অঙ্গারবর্ণ ক্ষতি। এই ক্ষতির ভার সমস্তটাই বহন করতে হল নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালিকে। বাহাত্তর ধীরে ধীরে গড়িয়ে গেল অসীম কালের দিকে। কাটা নলী, ফাটা খুলি, ও বুলেট-ফুটো বুক নিয়ে যুবকেরা রইল মাটির তলায়- গতানুগতিক সবুজ ঘাস এসে ঢেকে দিল তাদের রক্ত”.......  ।সত্তর দশকের এই দায়বদ্ধ অতিবিপ্লবী আবহের ভেতরই নিরুত্তাপের নৈঃশব্দের প্রতুল ভাণ্ডার নিয়ে শুরু হল মনীন্দ্র গুপ্তের পূনঃনির্মান, অভিজ্ঞতা আর সামগ্রিক পরিবর্তনের তাগিদ থেকেই যেন ভাব ও চেতনায় নিজেকেই নিজে ধর্মান্তরিত করলেন। উঠে এল তাঁর মৌলিক স্বর ‘ইউলিসিস’এর মত কবিতায়-
“ দূরে, ঐ নীল পাহাড়ের মধ্যে পৃথিবীর রক্তপাথরের ভাঁজে ভাঁজে
  উন্মুখ উড্ডীন গাছ, গাঢ বাঘনখ গুল্ম, ধ্যান, অনুভূতি ; ঐখানে
  সন্ন্যাসী, শিকারী, দৈত্য- তিন বন্ধু একসঙ্গে থাকে;
  বাতাসে চিন্তার ধ্বনি, দগ্ধমাংসগন্ধ আর ভয়ংকর স্বাধীনতা
  ভেসে আসে- উঠে যায় নীল মন্ত্র,স্বপ্ন,অট্টহাসি”.......

বৈপ্লবিক হৈচৈ-এর বাইরে ,সমসাময়িক ইন্টেলেকচুয়াল আলো হাওয়ার বাইরে  তিনি শব্দমায়ায় অনুসরন করালেন তাঁর উপস্থিতিকে, তাঁর অতলস্পর্শ যোগাযোগের নির্মানকে। প্রসেস অফ অ্যালুয়েশনের ভেতর দিয়েই যেন মনীন্দ্র গুপ্তের এই দ্বিতীয় নির্দেশনা; তাঁর আয়োজন তাঁর এই নতুন সাজসজ্জার দিকে তাকালেই মনে পড়ে যায় rosa alchemica তে যে প্রার্থিত প্রস্তুতির মধ্যে অপ্রার্থিত পরিব্যাপ্তির কথা বলেছিলেন ইয়েটস-‘I did not speak as we drove through the deserted streets, for my mind was curiously empty of familiar thoughts and experiences; it seemed to have been plucked out of the definite world and cast naked upon a shore less sea. There were moments when the vision appeared on the point of returning, and I would half− remember, with an ecstasy of joy or sorrow, crimes and heroisms, fortunes and misfortunes; or begin to contemplate, with a sudden leaping of the heart, hopes and terrors, desires and ambitions, alien to my orderly and careful life; and then I would awake shuddering at the thought that some great imponderable being had swept through my mind.’ ইউলিসিস কবিতা থেকে আরও একটু এগোলেই দেখা যাবে সত্তরের দশকেই ‘লাল স্কুলবাড়ি’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে মনীন্দ্র গুপ্ত যেন এই পয়েন্ট অফ রিটার্নিং এর কাছেই ফিরে যেতে চাইছেন । ফিরে যেতে চাইছেন অবঅতীতের দিকে। এই অবঅতীত বাক্যবন্ধটি বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন মনীন্দ্র গুপ্ত। অতীত অথচ অর্থহীন নয়। যেন নির্মক্ষিক দূর অতীতকে তিনি দেখতে চান সম্ভাবনাময় আরও দূর জিজ্ঞাসা দিয়ে। সত্তর দশকে আত্মরূপান্তরের এমন ডিকশন বাংলা কবিতায় এক নতুন অন্বেষনের দিকে আকর্ষন করল পাঠককে। লাল স্কুলবাড়ির কিছু কবিতার দিকে ফিরে তাকাব আমরা, হয়ত অজ্ঞাতে ইয়েটস বা ব্লেকের কবিতার কিছু চলমানতা লক্ষ্য করা যেতে পারে সেখানে, কিন্তু বাস্তব আর অববাস্তবের মাঝে দাঁড়িয়ে দ্বন্ধিত দুর্বোধ্য কিছু মূহূর্ত রচনা করে তারা-
“সন্ধ্যেবেলায় তালা খুলি। ঘর নয়, বোবা কালা মা-মরা সন্তান
ঢলে আছে। থাক!- ক্লান্ত লাগে...
ক্কচিৎ বিকেলে ফিরে দেখি ; ঘুলঘুলির রৌদ্র নিয়ে
খুব খেলছে। সমবয়সীর মত মেতে উঠে হঠাৎ চমকাই;
আমি ছায়া ধরে আছি , ও রোদ্দুরের সঙ্গে চলে গেছে।“......( রাত্রিতরঙ্গ/ লাল স্কুল বাড়ি)

আবার পাশাপাশি ইয়েটস এর দ্য সঙ অফ ওয়ান্ডারিং এ্যনজাসের কবিতাংশের সাথে, দর্শনের সাথে তাঁর যাত্রার তাঁর চতুরাঙ্গিক ভেতরমহলের কিছু অদ্ভুত সাদৃশ্য পাওয়া যায় লাল স্কুলবাড়ির কবিতাগুলির সাথে-

“I dropped the berry in a stream//
And caught a little silver trout. //
When I had laid it on the floor//
I went to blow the fire aflame, //
But something rustled on the floor, //
And some one called me by my name: //
It had become a glimmering girl//
With apple blossom in her hair//
Who called me by my name and ran”

                                    ........ইয়েটসের সাথে তাঁর কাব্যধারার বা ভাষা গঠনের কোন সাযুজ্য না থাকলেও কোথাও কোথাও আত্মজৈবনিক স্তরে শিল্পীর  একে অপরের অজ্ঞাত সংস্পর্শের একটা ছায়া গুঁড়ি মেরে স্পর্শ করে থাকে। এখানে বোধই একমাত্র কারণ যা কখনই শিল্পীর বিশুদ্ধতাকে খন্ডন করেনা। সজ্ঞা ও উপাদান বিষয়ে ইয়েটসের কাছে ঋনী হওয়ার প্রসঙ্গে অবশ্য ১৯৯৪ এর নৌকো পত্রিকায় সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্নের উত্তরে মনীন্দ্র গুপ্ত বলেন-“ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও ইন্দ্রিয়াতীত স্তরের সংস্পর্শের কথা কোনো কবির কাছে পেয়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। বরং, হয়তো কোনো সাধকের অতীন্দ্রিয় কিংবা তুরীয় জগত সম্পর্কে নানা কথাবার্তা ঐ আশ্চর্য স্তরের দিকে আমার চিন্তাকে আকর্ষন করেছিল। এখানে বলে রাখা দরকার- এ বিষয়ে আমার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, সমস্তটাই চিন্তা, কল্পনা ও বিশ্বাস নির্ভর।”....

আধুনিকতার সংজ্ঞায় মনীন্দ্র গুপ্ত জেন গুরু রিকোয়ানের তুলনা টেনেছেন। যেখানে বিমূঢ চোরকে তাঁর একমাত্র পোশাকটিও উপহার দিয়ে উলঙ্গ রিকোয়ান চাঁদের তলায় বসে ভাবছেন যদি এই অপূর্ব চাঁদ উপহার দেওয়া যেত চোরকে তবে কেমন আনন্দময় হত! আসলে আধুনিকতাকে তিনি দেখেছেন নিরাবয়ব প্রার্থনা হিসেবে যা চিরকালীন রূপরঙের দিকে আবহমানকে করে তুলবে সংকল্পরিক্ত সংস্কারবর্জিত। দিকচিহ্নহীনতার কথাই বার বার উঠে এসেছে তাঁর আঙ্গিকভাবনায় তাঁর কম্যুউনিকেশনে।‘চির-জীবনবোধের তন্মাত্র, আর তাঁর আভা’। বাসনাহীন প্রত্যাশাহীন নির্লিপ্ত এক শিল্পের হয়ে ওঠা। মনীন্দ্রগুপ্তের সামগ্রিক কাজের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দুটো আলাদা স্তর ভিন্ন সাজপোশাকে অবস্থিত অথচ দুইস্তরের ভেতর এক অলীক ডিফিউশন কাজ করে গেছে ক্রমাগত। একদিকে শূককীট, পিউপা, ধনেশ পাখি,চালতার ফুল, সবুজ কিরিচের মতো হোগল গুঁড়ি থেকে শুরু করে যোগমায়া দেবী কলেজের সকালের করিডর, কলাভবনের ছাত্রী জয়া আপ্পাস্বামী,  শান্তিপুরের রাইরাজার মিছিল , চোর ডাকাত সংসারী ভিখিরি কিম্বা অ্যারোড্রামের মাঠ থেকে হালকা খডকুটো নিয়ে ফিরে যাওয়া পাখি –মাথায় হাত বুলিয়ে যায় এমনই সব ম্যাজিক রিয়েলিজম, আবার পাশাপাশি মায়া নির্মায়া ধ্যান ধ্যাননা অকাল্ট কিম্বা রূপকথার স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পচেতনা তাঁর সম্যক উপলব্ধিতে অলংকারবহুল হয়ে আছে। সেখানে সুসঙ্গের রাজবংশ এবং হাজংদের পূর্বকথা ,যবন, দৈত্য, অতীত-ভবিষ্যতের দিকে উড়ে যাওয়া টেরোডাকটিল, অবসিডিয়ান ছুরির সামনে শিখার মতো বসে থাকা অথবা অরোরা বোরিআলিসের ছিন্ন মায়া নিয়ে না ফেরা ভেলায় ভেসে যাওয়া সেই বুড়ো এসকিমো। সত্য এবং সত্যের বিপরীতে সত্যের গূঢার্থকে নির্মানের তাগিদ থেকেই যেন এই স্ববিরোধ। নিত্য ও অনিত্য –তাঁর কবিতায় দুটোই দূরকম আস্তিত্বি অবস্থান থেকে উঠে এসেছে এবং চেতন অচেতন নির্বিশেষে তারা শেষমেশ হয়ে উঠেছে একই সত্তা। বিচিত্র রহস্যের মাঝে সে যেন নিরুদ্বেগ নির্জন সাঁতার। “আলো যেমন মেঘের উপর রঙের ছায়া ফেলে, মেঘ যেমন ভেসে যেতে যেতে বনের উপর ছায়া ফেলতে ভালোবাসে, বন যেমন নিজের ছায়া দিয়ে মেঘকে টেনে আনে, বৃষ্টিকে নিজের উপর ঝরিয়ে দেয়-সেই রকম সূদূর, অনাসক্ত, অথচ ছায়াঘন কোন টান ও ছেড়ে দেবার সম্পর্কের “ সাথেই সাধক কবি তাঁর কবিতার শরীর দিয়ে চিনতে চেয়েছেন সিদ্ধির অন্তঃতরঙ্গ।

‘সত্যের সঙ্গে ভুলভ্রান্তি’, ‘বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা অলীক’, ‘জ্ঞানের সঙ্গে অবচেতন কুহেলী’, ‘আলোর সঙ্গে ছায়া আচ্ছন্নতা’ আর ‘যা ঘটছে তাঁর সঙ্গে যা ঘটলে খুশী হওয়া যায়’- সেই প্রকৃত কবির স্বতঃসিদ্ধ, এই সেই আলোর রঙের ফুল্ল যা সংগ্রহ করতেই অনন্তহীন সময়ের দিকে ছুটে চলে তাঁর আয়ু। আবহমান বাংলা কবিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে মনীন্দ্র গুপ্ত সেই হাতেগোনা কয়েকজ়ন কবির মধ্যে পড়বেন যার শিকড় ও সংকল্প এক, যিনি পতন ও পাপ, ন্যায় ও অন্যায় বিষয়ে সম্যক অবগত এবং তাঁর কবিতা তাঁর ব্যক্তিসত্তারই অংশ।চিরকালের নির্যাস থেকেই তিনি ‘আমি’কে শোধন করে নিয়ে চলেছেন কোলাহলহীন পলকা গৃহস্থের নাগালের বাইরে , যেখানে কেউ নেই এমনকি ‘আমি’ ও নেই। ব্যক্তিসত্তা আর কবিতাসত্তার মাঝে উত্তরীয়ের কাজ করেছে সেই আদিম রহস্য সেই মিস্টিক হুইলউইণ্ড যা কোথাও স্থির হতে শেখেনি, যে দাবী করে কম্যুইনিকেশনের অতলতা আর জীবন্ত পাশাখেলার থেকে ক্ষনজাগরিত হয়ে উদাসীন আনন্দের দিকে বিলীন হয়ে যায়। পূর্বজদের ফেলে যাওয়া সলিটারি থেকেই শুরু হয় তাঁর সোনালী ধানক্ষেত, দরজা ঠেলে ঢোকে এক নুটি পেঁজা তুলো আর গোলাপি রঙের বুড়ীর চুল। আসলে মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতা পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পাওয়া গুপ্তধনের মত, যেখানে কিউবিস্ট আলোর ভেতর ফুটে উঠেছে আদি অন্তহীন রাজ্যপাট। কবিতার দেহ কবিতার সংগঠন নিয়ে তিনি সেই শব্দব্রম্ভের কাছে পৌঁছেছেন যা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত যা মূলত লৌকিক যা জন্মচক্রে অর্জিত। তাঁর নিজের কথাতেই-“ ভূমিজ, অণ্ডজ ও জরায়ুজ যে কোন সপ্রাণ বস্তুর মতো কবিতার জন্মও শূন্য থেকে সম্ভব নয়। কবিতাচরও জন্মবীজ আছে, উপ্ত হবার ক্ষেত্র আছে। ....এই বীজ, প্রত্যক্ষ ও প্রাথমিক অবস্থায়, আমাদেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু পরমূহুর্তেই সে স্মৃতি-অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতাজাত অনুভূতির স্মৃতি। এবং কবিতা যেহুতু অভিজ্ঞতার সংগে সংলগ্ন থেকে লেখা যায় না, অর্থাত প্রত্যক্ষ লৌকিক অভিজ্ঞতা যতক্ষন না দ্বিতীয় ভুবনের অলৌকিকতায় প্রবেশ করছে ততক্ষন কবিতার জন্মচক্র সঠিকভাবে আরম্ভ হয় না। অতএব বলতে পারি স্মৃতিই সেই বীজ।।..........এই বীজ বা অভিজ্ঞতা আসে কোথা থেকে? অভিজ্ঞতা আসে না , জীবন ও জগতের মধ্যে বাস করে অভিজ্ঞতা ঘটে। জীবন, জগৎ ও অহমের পারস্পরিক আঘাতে প্রতিঘাতে অভিজ্ঞতা উদ্ভুত হয়। এক অভিজ্ঞতা অন্য বা পরবর্তী অভিজ্ঞতার জন্মকারন হয়। এইভাবে আমাদের অভিজ্ঞতার শৃঙ্খল দীর্ঘ হতে থাকে। শৃঙ্খলের একটি বন্ধনী ধরে নাড়া দিলে অন্যগুলো ঝনঝন করে ওঠে। এই শৃঙ্খলসূত্রেই কবির সমস্ত কবিতার মধ্য দিয়ে একটা সংলগ্নতা ফুটে ওঠে, আপাত স্ববিরোধ বা বৈপরীত্য থাকলেও নিহিত একটা বিশেষ চারিত্র্য অননুভূত থাকে না। অনুস্যূত এই শৃঙ্খলের সূত্রেই কবির সমগ্রতাকে বুঝতে সুবিধে হয়।“..........এভাবেই ঘুরে ঘুরে অতীত স্বরূপের সাথে তাঁর নিজেকে আবিস্কারের চিত্রমর্মর মোহবীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর কবিতায়। প্রাত্যহিক শব্দের সাথে মিথিকাল পাস্টকে নিয়ে গড়েছেন শাব্দিক ক্যানভাস। ‘স্টুডিওতে দিনে ল্যাবরেটারিতে রাত্রে’ পরীক্ষা করেছেন প্রতিটা শব্দের ওর্য়াডস্কেপ, ‘পংক্তির দৈর্ঘ্য, ছেদ, সংস্থান’। স্ট্রীম অফ কনশাসনেস থেকে যেন তাঁর অন্বেষন অ্যালাইমেন্ট অফ আনকনশাসে। অনুভুতিময় জীবনভাষার ভেতর ,জল স্থল আকাশ মহাকাশ কাল মহাকাল প্রতিটা অনির্বায থাকার ভেতর তাঁর খোঁজ একটিই শব্দ একটিই বাক্য যা শরীরের সীমানা পেরিয়ে মস্তিস্কের সীমানা পেরিয়ে কবিতার ওয়্যারহাউসে কবির দ্যোতক হিসেবে হয়ে উঠবে চিহ্নিত নতুন। আর জমাট তুষারের ওপর পায়চারি করতে করতে এই বীজ শব্দেরই সাধনা করে গেছেন মনীন্দ্র গুপ্ত। আক্ষরিক অর্থেই তিনি সংগ্রাহক, নিরঞ্জন পৃথিবী থেকে, মুকুল গন্ধ থেকে, অবোধ সংসারপথ থেকে ব্রম্ভচারীর মতো খুঁজে বেরিয়েছেন কাঙ্খিত একটিই শব্দ একটিই আয়োজন।–“ধূলিমাটি আমার হাতে সোনা হয় না। অকিঞ্চন পিঁপড়ের মতো ক্ষুদ্র আধার হয়েও জমাট মধুর স্ফটিক কনা খুঁজে খুঁজে খুঁটে খুঁটে আনি। পরিশ্রম করি, পরীক্ষা করি-একটি বীজ-শব্দ খুঁজে আনতে আমার পূর্ন রাত্রি যায়, তমসাময় অন্বয় থেকে একটি বাক্যকে জাগাতে কাটে সপ্তাহ। দিকচিহ্নহীন এই জগৎ থেকে নিজেকেই সংগ্রহ করতে কেটে যায় যুগ। আমি প্রসূতি নই, সংগ্রাহক।”.....(মনীন্দ্র গুপ্ত/ চাঁদের ওপিঠে)

মনীন্দ্র গুপ্তের জন্ম বরিশালে। গৈলা গ্রামে। কৈশোরে আসামে শিলচরে কাটানো কৈশোরকাল সাদা কালো ডোরায় ধরা পড়েছে ‘শিলচরের গল্পে’- চাঁদপুরের স্টীমার, বদরপুর স্টেশনের এক আনার শিঙারা কিম্বা সন্ধ্যায় বরাকের তীরে বসে সাধু হয়ে যাওয়ার কুপ্রস্তাব সব মিলিয়ে এক নস্ট্যালজিক ন্যারেট যা প্রয়াসহীন , ছড়িয়ে গেছে বিওণ্ড দ্য লিটেরালে -“ট্রেন থেকে নেমে চাঁদপুরে স্টিমারে উঠে বসার পর থেকে/ ঘাটে ঘাটে পাতক্ষীর, কাঁচাগোল্লা, কচুপাতাঁর ঠোঙায় কালোজাম/ নামমাত্র মূল্যে- মনে হত একটা টোকেন দামের পরিবর্তে/ গাঁয়ের লোকেরা বুঝি অতিথিসৎকারে নেমেছে।/.....ষাট বছর আগের এসব কথা শুনে কি লোভ হচ্ছে, ভাই?/চলে যেতে ইচ্ছে করছে সেই যুগে?”......তাঁর প্রারম্ভিক শিক্ষা কারিগরীবিদ্যাতে অথচ পেশায় যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। আবার জীবনের অনেকটা সময় উনিশশো ছেচল্লিশ থেকে বাষট্টি অবধি কাটিয়ে দিলেন ছবি এঁকে। ঘর আকাশ স্মৃতি আর চিন্তনের এত অজস্র একাত্মীভূত অংশই যেন দিনরাত্রিমাসবছর ধরে গড়ে তুলেছে তাঁর ইনস্যাটিয়েবল থিয়েটর। যাত্রার থেকে মুক্তি চাননি মনীন্দ্র গুপ্ত। যেখানে এসে থেমেছেন সেখান থেকেই চলতে শুরু করেছেন অন্য পৃথিবীর উপাসনা নিয়ে। মাটিতে চিবুক লাগিয়ে দেখেছেন অতিবাহিত আয়ুষ্কালটুকু যা ক্রমশ পৃথিবীর মঙ্গলকাব্য নিয়ে সীমাবদ্ধ নিশ্চিতকে পেরিয়ে হয়ে উঠেছে পূর্ণজ্ঞানী। জীবনের সাথে সাথে শস্যের মাঠ থেকে সুক্ষ গুঁড়োর মত তিনি তুলে নিয়েছেন কবিতার বীজ বৃদ্ধি বিভাজন বিক্রিয়া,তাঁর বিচ্ছুরণের আকাশ আর রচনার আকর। কবিতার সাথে সংক্রামিত হতে হতে সংশ্লেষিত হতে হতেই যেন রিভ্যাইভাল হয়েছেন সৃজনশীল মনীন্দ্র গুপ্ত। ‘ঘর যদি মাটির হয় তো তাঁর তৈজসও হবে মাটির। কুটির যদি তৃনের হয় তো সেখানে ঘাসের দ্রব্যই মানাবে’-এই যেন তাঁর জন্মান্তরের রহস্যাচার , রসায়ন। জীবনকে নিয়ে তাঁর অনবরত নির্বাচন, কথামৃতের শিবুর মতো বারবার তিনি সেই অনাদি উৎসের দিকে ছুটে গেছেন লাল ফড়িং-এর খোঁজে, গৃহস্থের আঙিনায় ঢুকে পড়েছেন বিনীত হয়ে আদিম অতীতের সাথে যেন আরও দূর অতীত দেখবেন বলে। তীর্থযাত্রীর মত পৃথিবীকে দেখেছেন কৌতুহলী বালকের মত, যেখানে প্রত্যাখাত বলে কোন উপকরন নেই, তাঁর সংহত বুননে তিনি এক ভবঘুরের মধ্যে খুঁজেছেন স্থিতিশীলতার সেই আত্যন্তিক যোগ, যেখানে অস্তিত্ব অনস্তিত্ব এই উভয় সত্তার সহাবস্থানে সংযুক্ত রেখেছেন আশ্চর্য অভিযাত্রিকের শরীরময় গল্প আর কাঁটা ঝোপে আটকে থাকা ছায়া ধরা গেরুয়া। আত্মার গৌণ দরজা হাট খুলে কখন যেন বেরিয়ে গেছেন নিরাভরণ অনাদির দিকে। কতো সহজেই না বলে উঠেছেন........“সব দেখেশুনে মনে হয়,মাটিতে জন্মে, শুধু মাটিটুকুই অবলম্বন করে আমাদের খুশি থাকা উচিত। সেই শ্রেয় পথ। একটা নতুন সভ্যতা কি গড়া যায় না যেখানে মাটির তৈজসপত্র, কর্দমস্থাপত্য, মেটে রাস্তা- যেখানে মানুষ, চাইলে কুড়ানী হয়েও বেঁচে থাকতে পারে। সে দেশে অন্ন বাজারে থাকবে না, গোলায় থাকবে না, আড়তে থাকবে না, থাকবে মাঠে, জলাশয়ের কিনারায়, বনে, পাহাড়ে, যেখানে তার জন্মস্থান সেইখানে। নিতে হলে সেইখান থেকেই তাকে নিতে হবে।” আবার সাথে সাথে বিকার ফাঁদ শূন্যতা থেকে বহুমাত্রিক ফাঁকে এসে দাঁড়িয়েছেন মনীন্দ্র গুপ্ত, যেখানে ‘মূল্যহীনকে না জমানো এবং মূল্যবানকে ছেড়ে চলে যাওয়া- ’ ঘর উঠোনের মাঝে এই তাঁর অভিলাষ এই মুক্তির পথ। ‘মৌচুষি যায় ছাদনাতলায়’ বইয়ের ‘বজরংবলী’ কবিতার প্রথম লাইন পড়া যাক-‘একটা ঘরই আমার পক্ষে যথেষ্ট’ অথবা ওই একই বইয়ের ‘ভেন্টিলেশনের লোকটা’ র প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন-‘অন্তকালে আমাকে যে হাসপাতালে রেখে আসবে/ তাঁর মাথায় বজ্রাঘাত হউক’। আবার ‘দুর্বোধ’ কবিতাটির প্রথম দু লাইন দেখা যাক-‘অনিশ্চিত একটা সুগন্ধ আসছে- ফুল না, অগুরু না, শিশিরও না- বনের কোনো/ পাতার গন্ধ।/ তাকাতে গিয়ে দেখি, লোকটা রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে লম্বা লম্বা পায়ে।’....কিছু কিছু পংক্তিকে ঘিরে বাক্যবন্ধকে ঘিরে এ যেন ছবির উৎসব, দিগন্ত অবধি জীবনের গুনপনা, তাঁর বোধ ইল্যুউমিনেটেড অর্থের বাঁধন থেকে ক্রমাগত শব্দ ব্রম্ভের সেই মিস্টিক পাসগুলোতে প্রবেশ করতে চাইছে। এই বহুমাত্রিক গূঢ গভীর প্রতীকতাদর কাছে এসে মনে পড়ে  ইয়েটসের  ‘দ্য ফেসেস অফ দ্য মুন’ এর সেই নিরীশ্বর বোধি-“All thought becomes an image and the soul/Becomes a body: that body and that soul/Too perfect at the full to lie in a cradle,/Too lonely for the traffic of the world:/Body and soul cast out and cast away/Beyond the visible world.” পেঁচিয়ে ওঠা লতার মতো কবিতার কর্মশালা থেকে কবি বেরিয়ে পড়ছেন বনবাসী জগতের মধ্যে, বৈকালিক বিষন্নতার মধ্যে। এক একটি শব্দের এক একটি পংক্তির মধ্যে উঁকি দিলে দেখা যাবে যে জীবনছকের অনুসন্ধান করে চলেছেন জীবনভর ধরে তারই অন্তিম অনুচ্ছেদে এসে মেটে হলুদ রোদ্দুরে গুবরে পোকার মত ফিরে যেতে চেয়েছেন কেবল একটা অপস্রিয়মানের মধ্যে। চল্লিশের দশকের হয়েও মনীন্দ্র গুপ্তকে কোথাও তাঁর স্বতন্ত্র সৃজনশীলতাই দশকের প্রতীক্ষিত গণ্ডী পেরিয়ে দশক বিভাজন পেরিয়ে করে তুলেছে আধুনিক। তাঁর কবিতা ছন্দমুখর নয়, কেবলমাত্র সুন্দরের সংগ্রহ নয়। সফরসঙ্গী প্রতিটা ভগ্নাংশের ভিতর দিয়ে তাঁর আসা, জীবিতের মতো জৈব অবয়বে ভরপুর তাঁর কবিতা। মনোজগতের জৈব সম্পূর্নতার কোলাজই কবিতার এলিমেন্টারি ওয়ার্কশপগুলো থেকে তাঁকে গড়ে তুলেছে মেটাফিজিকাল পোয়েট হিসেবে যেখানে বাস্তব থেকে তিনি ছেঁকে তুলেছেন সম্ভাব্যতা আর সম্ভাব্যতা থেকে এক সুদৃঢ রিলিজ , একটা হেটেরোজেনিয়াস স্পেস , যেখানে জিপসির মতো অন্তিম ভবঘুরে কবি, আর তাঁর শব্দ আর বরফ একসঙ্গে জমাট বেঁধে স্তব্ধ হয়ে আছে। মেঘের মধ্যে কেবল হারিয়ে যাওয়া উটেরা দৈববানীর মতো কথা বলছে।
কবির ডায়েরীটা খুঁজে হলুদ পাতার স্তুপে হারিয়ে যাওয়া তাঁর সাজপোশাক তাঁর অদৃশ্য পর্দার ওপর অবঅতীতের আলো ফেলে মনীন্দ্র গুপ্তের মতো এত আধুনিক কবিই বলতে পারেন-“মনের দিক দিয়ে আমি তো বনের চেয়ে কিছু বেশি। বিষয়ের সংসর্গে আমার ভাষা সেইভাবেই পালটে পালটে যায়। কিন্তু আমরা গাছের মতো স্তব্ধতাও জানি না , মর্মরও পারি না। অতএব যেখানে বেদ্য জগৎ অনির্বচনীয়ে লীন হয় সেখানে আমার বাক্যও চেষ্টা করে সেই অব্যক্তের পিছু পিছু তলিয়ে যেতে। এইভাবেই আমি বন, মরুভূমি, আদি প্রস্তর যুগের শিকারীদের সন্ধ্যায় ফিরে আসা গুহা, ককটেল পার্টির ড্যান্স ফ্লোরের উৎসুক গাঢ গন্ধ নিঃশ্বাস – অর্থাৎ যাবতীয় কিছুর অস্তিত্ব, নিজস্ব কম্পন, প্রতিক্রিয়া, সুদূরতা ধরবার চেষ্টা করি। ”
তাঁর মতে কবির অচেতনের মধ্যে যে চিররহস্য তাঁর তিনটে চূড়া। প্রকৃতি, নারী ও মৃত্যু। তিনটে চূড়া তিন শীর্ষ নিজস্ব সমবাহু ত্রিভুজের। কবির নিজস্ব সমবাহু ত্রিভুজের দিকে তাকালেই দেখা যাবে প্রকৃতি থেকে দুটি বাহু বেরিয়েছে , নারী ও মৃত্যুর দিকে তাঁর গতি। নারীর দুটি হাত গেছে প্রকৃতি ও মৃত্যুর দিকে আর মৃত্যুর দুই বাহু চলেছে নারী ও প্রকৃতিকে আলিঙ্গনে বাঁধতে। তিন বাহুতে ঘেরা এই জমিই হল কবিতার দেশ আর এক এক কবির এক এক ত্রিভুজ। মনীন্দ্র গুপ্তের সামগ্রিক স্বরায়নে খোঁজা যাক এমনই বীজপ্রত্যয়গুলিঃ-


প্রকৃতিঃ-
তাঁর জীবনকৃতির সাথে অন্তসর্ত্যের সাথে কোষ তন্তুর সাথে জীবাশ্মের মত জড়িয়ে আছে ল্যাণ্ডস্কেপিক কার্পেট।প্রকৃতি তাঁর কাছে সেই আনকোরা আঁতুর ঘর- হোগলাপাতা সবুজ রঙের বাঁশ আর বাদামী রঙের বেত জড়িয়ে পৌরানিক আদরের মত যেখানে তিনি টের পেলেন মুগ্ধতা সন্তাপ উল্লাস দ্রবন! তাঁর আত্মজৈবনিক গদ্য অক্ষয় মালবেরী যেন এক বাল্যপুরান, যেখানে দালানগুলোর কোন মালিক নেই, দেশের কোন সীমানা নেই। পথটুকু শুধু এক জাদুপথ। কাঁচের গুঁড়োর মতো ঝাপসা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মুসাফির আর একা একা সেই নিস্তব্ধ দেশে ঘুরে বেড়ায় নির্সগের কবি। নরম একখানা মেঘ আর বনঝিঙের ফুলের ভেতর ঘুরে বেড়ায় ছেলেবেলা। শূন্যের কয়েকশো লাল ফড়িং এসে যাচাই করে যায় মাটির সাথে পৃথিবীর সাথে লেগে থাকা ডিসএ্যাপিয়েরিং ডিপ। প্রকৃতি অন্বিত সর্মপন। ‘পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান’ এ লিখলেন অনন্ত কুড়ানীর সমায়ত পাঁচশালা-“মাটির উপরে গাছপালার স্বত্বস্বামিত্ব আমাদের চেয়ে আরো কত কত জোরালো- শিকড় কি রকম নাছোড হয়ে আঁকড়ে ধরেছে মাটিকে, আর মাটি কিভাবে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে শিকড়কে। এইসব জায়গায় যে কুডানীরা অন্ন কুড়িয়ে প্রাণধারন করে তাদের কুড়ানীবৃত্তিই একসময় তাদের অন্য এক জীবনবোধ দেয়। নিজের অজান্তে তারা ঢেঁকির শাক তুলতে গিয়ে স্পর্শ করে রজঃস্বলা মাটির সবুজ ভাঁজ, তেলাকুচো লতাঁর সঙ্গে তারা কুড়োয় কিছুটা আগের রাতের শিশির, মেটে আলুর সঙ্গে পৃথিবীর খানিকটা জঙ্ঘা অস্থি তুলে আনে, বনধুঁদুলের সঙ্গে কুড়োয় একটু অস্তসূর্যের রশ্মি, স্কোয়াশের সঙ্গে কুড়োয় হঠাৎ ঘনিয়ে আসা দ্বিপ্রাহরিক মেঘ-মেদুরতা, পাকা আম, পাকা তালের সঙ্গে তারা কুড়োয় পুরো গ্রীষ্ম-বর্ষার সৌগন্ধ। পৃথিবী, আকাশ, বায়ুমণ্ডল, ঋতুচক্রের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত নির্ভরশীল এই কুড়ানীজীবন হয়তো মহা জীবনেরই এক দীন এবং আলগা রূপ। নির্ভরশীল এই জীবন জমির মালিকানা ছাডাও চলে কিন্তু পরিস্কার সীমানা ঘেরা দেশ ছাড়া একেবারেই চলে না।”......  ‘প্রকৃতি’ এই ধীর নিশ্চিত প্রকরণটি তাঁর কবিতা গদ্যের ভাষাকে করে তুলেছে অনন্য।মানুষজন জীবজন্তু গাছপালা নির্সগের মধ্যেই খুঁজেছেন জীবনের সহজ প্রসন্নতা। প্রাকৃতিক দৃশ্যসংবেদের এত বিপুল ব্যবহার জীবনানন্দ পরর্বতী কবিদের মধ্যে মনীন্দ্র গুপ্তকে আলাদা ভাবে চিনিয়ে দেয় বিপুলাজীবনের ধারক বাহক হিসেবে। তাঁর মতে জীবনান্দের আদিতেও মানুষ অন্তেও মানুষ অর্থাৎ এ যুগের মুখ ধূসর হয়ে আছে অতীতের মধ্যে আর তাঁর মানবিক রূপান্তরগুলি খুঁজেছে পরিকল্পিত জন্মান্তর। মৃত্যু কে পেরিয়ে আসার পথে মৌলিককে পেরিয়ে আসার পথে প্রকৃতি তাই ঈশ্বর আর পথিকের মাঝে সেই প্রবেশপথ সেই প্রাচীন টেস্টামেন্ট যেখানে বনমধু খেয়ে আলাদিনের কলসিতে লুকিয়ে রাখা পার্থিব সম্পদ, লম্বা লম্বা পার্চমেন্ট স্কোলের এক অমূল্য লাইব্রেরী। ....মনীন্দ্রগুপ্তের ছাপাখানার কিছু কালচে সবুজ কোলাজের দিকে চোখ রাখা যাক—

১।।  আকাশের দলবাঁধা ক্রোংকার, ঝংকার, শিস, কাকলির এই পারে
স্তব্ধতায় ধূলোর রাস্তায় পড়ে আছে কত যুগ
মরা পাখিদের
হর্তুকির মতন শুকনো মাথা.... (প্রকৃতিলীন)

২।। শীত ও তুষার, বরফ গলানো জল-
তাঁর মধ্যে বন মাঠ ভরে এই উজ্জ্বল ক্রোকাস।
একদিন পূর্বপুরুষেরা সোনার ডিমের হাঁস
ধরে নিতে দূর ভূখন্ডের দিকে গেছে....(প্রকৃতিলীন)

৩।। ছোট্ট পাখির মতো রোদ সারা দিন গাছগাছালি ঠুকরে ঠুকরে
পাখা মেলে শূন্যে ওডে শেষ বেলায়
শিখরগুলো হঠাত ডেকে ওঠে –ট্রি ট্রি ট্রি ট্রি ট্রি-ই
তাঁরপরই
উপত্যকা থেকে মাথা তোলে ছায়া
ছায়া ছায়া ছায়া
আমি শিস দিয়ে বাজাই এই সব
পাহাড়ি হাওয়া........................(আমি শিস দিয়ে বাজাই)

৪।। গোলঞ্চ তাঁর মাথায় ঝরে পড়ে,
বকুল ঝরে ঝরে উডে আসে পায়ে।
নীরব গাছজগতের এই অপাপ যোনিগুলি তাঁর বড় প্রিয়।
সে নীল অপরাজিতা আর লাল জবার কাছে গিয়ে
ফুলের গর্তে কু দেয়।
কাকলির মতো সেই মিষ্টি ধ্বনি নীরব বনের মধ্যে দিয়ে চলে যায়
তিমিমাছ সিন্ধুসিংহের হিম জল, স্বর্ণ ঈগলদের ধূ ধূ আকাশ পেরিয়ে
নীহারিকাদের কানে,
তাদের জাগিয়ে দিতে................( মা )

৫।। বেলা পড়ে আসছিল। পাখিরা গাছে ফিরে এসে একটু প্রানখোলা চ্যাঁচামেচি
করে নিচ্ছিল ভাটির আলোর সঙ্গে। একসময়
তাদের গোল চোখ দেখেঃ জগৎ ধীরে ধীরে ছায়ার মধ্যে ঢুকছে।
.................
................
ছায়া, শুঁয়োপোকার মতো চলেছে, ধীরে, উচুঁনিচু পথে;
ছায়া, মথের ডানা ছড়িয়ে, বসছে পাতাঁর নিচে;
তুলোর আঁশের মতো, ছায়া, উড়ছে বাতাসে।।....................(অদৃশ্য জগৎ)

মনীন্দ্র গুপ্তের কাব্যভাণ্ডারেরর পার্থিব ডাইসটাকে ঘোরালেই দেখা যাবে তাঁর নিভৃতলোকে এক অপার্থিব অভাবনীয় জীবন। অথচ তা প্রকৃতিকে ঘিরে , সলজ্জ অথচ নির্ভয় হয়ে অনন্ত সময়ের প্রার্থণা চেয়ে এই প্রকৃতির কাছেই। বিকার, ফাঁদ, শূন্যতা থেকে বেরোতে তিনি সেই অভিযাত্রারই কথা বলেছেন যা নিসর্গের কাছে প্রত্যাবর্তন। সম্পূর্ন হৃদয়-মন আর জীবনধারনের চাহিদা নিয়ে আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া। অক্ষয় মালবেরীতে ব্যধি ও ব্যধিমুক্তির নিশ্চয়তা হয়েও এসেছে মেদহীন প্রকৃতি, জন্মান্তরের পুরুষ বাতাস। ....”মাটির উপর শুয়ে পড়লে সবুজ ফুরফুরে মটর লতা আমাদের ঢেকে দিত, কেউ আমাদের অস্তিত্ব টের পেত না। আমরা মটরশুঁটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে প্রান ভরে তাদের কচি দানা খেতাম। টনটনে এবড়োখেবড়ো মাটির ওপর শুয়ে সবুজ মটর লতার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত শীতের নীল আকাশ। মটর লতার শষ্পগন্ধ আর নরম রোদ আমাদের গায়ে জড়িয়ে যেত। হঠাত হঠাত কুবোপাখির কুব কুব কুব কুব আর শঙ্খচিলের ট্রি ট্রি ট্রি ট্রি-ই ডাক সেই ফুরফুরে জালের গায়ে অন্য সুতোর ফোঁড় দিয়ে যেন রহস্যজগতের ফুল এঁকে দিত।“........প্রকৃতি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। তাঁর মেটামরফসিসে টুপটাপ খসে পড়েছে কালোজাম কিম্বা চাঁদ একটু একটু করে মসলিন কাপড় ভাঁজ করে রেখেছে বাদামের কৌটোর ভেতর। মনীন্দ্র গুপ্তের বন বাগানে ঘুরতে ঘুরতে, নির্সগনির্ভরতার ফুলরেনুগুলির কাঁচা রঙে নিদ্ধির্ধায় অবগাহন করতে করতে মনে পড়ে বার্গমানের ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’ কিম্বা গার্সিয়া মার্কেজের ‘হান্ডেড ইয়ারস অফ সলিটিউড’ এর সেই ম্যাজিক রিয়েলিজম। তাঁর আত্মকথন যেন সমীকরনহীন চেতনায় প্রকৃতির নিপুন ইন্ট্রোস্পেকশন। অক্ষয় মালবেরীর আলোচনায় কবি দেবাঞ্জলী মুখোপাধ্যায় মনীন্দ্র গুপ্তের জীবন ইতিহাসের সাদৃশ্য খুঁজেছেন ম্যাক্সিম গোর্কির জীবনের সাথে, তাঁর শৈল্পিক উচ্চগ্রামের সাথে। ‘উত্তরাধিকার অগ্রহায়ন ১৪০৫’ সংখ্যায় তিনি বলেছেন-“রুশ ভাষায় ম্যাক্সিম গোর্কি মানে অতিরিক্ত তিক্ত-এই ছদ্মনামের আড়ালে তাঁর ‘ছেলেবেলা’, ‘আমার শিক্ষানিবাসী’, এবং ’আমার বিশ্ববিদ্যালয়’ ট্রিলজিতে পিষ্ট, প্রতিকূল এক করুন জীবনের কথা শুনতে শুনতে যেমন আমরা রুক্ষ পৃথিবীর পথে নেমে পড়ি তেমনি সাশ্রু মুক্তো দিয়ে গাঁথা ‘অক্ষয় মালবেরী’ তে আমরা প্রবেশ করি কষ্টের ও আনন্দের এক অনুভূতিময় বাল্যজীবনে”..ভিন্ন সময়ের এসব ভিন্ন ভিন্ন কবি লেখক চিত্রনির্মাতাদের কথকথার স্তরগুলিতে এই সাযুজ্য স্বভাব কবির ক্রমউত্তরনই প্রমান করে , ক্রমউত্তরন সেই আত্মচিহিত সংজ্ঞার কাছে। পারস্পরিক প্রভাবের থেকেও আরও খানিকটা পূর্নায়তের দিকে এগিয়ে এসে আসলে প্রমান করে পরিনত সৃষ্টিকর্মীর ভেতরের ভিজে পতঙ্গটা, আটপৌরে শব্দটা প্রকৃতির ব্রতগান কুড়িয়ে নিয়ে একটি সম্পূর্ন বৃত্ত পরিক্রমা করে শেষমেশ অবগাহনের একক দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে সামান্যকে নিয়ে সহজ অসামান্যের মত।

নারী-
‘তাহারা অদ্ভুত লোক’ কবিতার আলোচনায় মনীন্দ্র গুপ্ত বলেছেন-‘প্রেম বা নারীসম্পর্ক কবিতায় সবচেয়ে বেশী জায়গা জুড়ে আছে। মেয়েরা পুরুষের ত্রিভুজকে সবচেয়ে বেশি উথালপাতাল করে, সেই আলোড়ন চুঁইয়ে চুঁইয়ে জমে সুধা-বিষের সরোবর হয়ে আছে কবিতায়। যৌনবাসনা বুনো কুকুরের মতো আমৃত্যু আমাদের টুঁটি কামড়ে থাকে-এ সবই সত্য। তবু সুকুমার প্রেম ভঙ্গুর, আর তামসিক প্রেম যেন শুকনো রক্তের দাগ, যাকে প্রেমিক যুগল অভ্যাসবশত চেটে চেটে ভিজিয়ে রোজ স্বাদু করতে চায়’।.....কিন্তু মনীন্দ্র গুপ্তের সার্বিক আধারে তথাকথিত বোরডম ধারনা পেরিয়ে এসে কোনো এক অভেদের সন্ধান নিয়ে এসেছে নারী ; সেখানে কবি স্বেচ্ছায় নিমর্জিত, নির্বাসিত, টলতে টলতে মানুষের পেছনে ঘুরে তিনি সেই অমিয় আশ্রয়ের খোঁজে। হিম অন্ধকারের মধ্যে এ যেন শূন্য ভরাটের খেলা। আর ঠিক এমনই ফিকে জ্যোৎস্নায় , আচ্ছন্নে, প্রতীকি ব্যঞ্জনা হয়ে কখনো ঠাকুমা কখনও নতুন মা আবার কখনও নিজের স্ত্রী লুকোণো চাবি নিয়ে এসেছে তাঁর কুড়ানী জীবনের বৃত্ত সম্পন্ন করতে, মনসিজের তুলো ওড়াতে । অশ্বত্থের মতো প্রাচীন হতে হতে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে স্পর্শের অতীতে নারী তাঁর কবিতায় সংরক্ত কোলাহলের মতো মাল্টিফেসেট। ইন্টেরিয়ওর ন্যারেটিভে পাংকচুয়েট করেছে স্নেহ, মমতা, মঙ্গলময়তা আবার কখনো বা সন্তর্পনে প্রেম, অভিমান, আদিসৌন্দর্যের আশ্চর্য উচ্চারনে বিশ্বসংসারের গল্প শুনিয়েছে। জীবনানন্দের কবিতার মত তাঁর কবিতায় বা গদ্যে নারী অর্ধস্বগত বা অবস্কিয়র নয়, আলাদা আলাদা ভাবে বিষয়বস্তুর মধ্যে তাঁদের অভিনব অবস্থান। মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতা সংগ্রহের উৎসর্গ বড়মা কুসুমকুমারী, মা সুপ্রভা-শান্তি, অন্য মা মলিনা, এবং অভিভাবিকা দেবারতিকে। ছোট্ট পাখির মত তিনি সায়াহ্নের অবোধ গাছপালার মধ্যেই, নীরব একান্তের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক অবলোকন, তাঁর বোধের অর্জিত মুচলেকা। আড়াই বছর বয়সে বাবা নতুন মাকে নিয়ে এলে কনসাসনেস ড্রিফটে নতুন মা হয়ে উঠেছে কখনো এ ফুল তো কখনো ও ফুল, কখনো মনে হয়েছে হিজল কখনো বড়পুকুরের জলে ভেসে যাওয়া আগের দিনের পূজোর গন্ধরাজ। আবাল্যের মাতৃবিয়োগ মনীন্দ্র গুপ্তকে মলিন অভেদের মাঝে হস্তান্তরিত করেছিল সেই শৈশবেই, যা আসলে তাঁকে তাঁর দীর্ঘ যাপনেও স্তম্ভিত করে রেখেছে। বারে বারে এই অনুপস্থিতিকে পেরোতেই অবলম্বন হয়ে উঠেছে ভাস্বর নারীরা। উত্তরাধিকার ২৮ সংখ্যায় দেবারতি মিত্র মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতা ও জীবন প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন কিছু অশ্রুত ঘোষনা-“মনীন্দ্র গুপ্তের জীবনে কতগুলো মৌল অভাববোধ রয়ে গেছে। যা তাঁর স্বভাবেও বর্তেছে। যখন আমার স্বামীর বয়স ১০ মাস, তখন আমার শাশুড়ী মারা যান। তারপর থেকে ভাগ্যের হাতের নানারকম উলটোপালটা তাস দেখে তিন ক্লান্ত ও বিপন্ন। আমরা নিজের জীবন দিয়ে জানি মার ক্ষতিপূরন বোধ হয় ঈশ্বরকে দিয়েও হয় না। তাই মনীন্দ্র গুপ্ত অত্যন্ত অভিমানী, স্পর্শকাতর, আত্মবিশ্বাসহীন, আপাত-ক্রোধী চরিত্রের একজন মানুষ। কারুর প্রতি কোনো জোর ফলাবার সবলতা তাঁর নেই, কারুর কাছ থেকে ন্যায্য কিছু চাইবার প্রবৃত্তিও তাঁর নেই, নিজের অসুবিধা বা কষ্টের কথা স্পষ্ট করে জানাবার মতো উদ্যম নেই, যে জন্য তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা নিয়ন্ত্রনহীন, নিস্ফলতায় পর্যবসিত। তাঁর কাছাকাছি থাকি বলে বাধ্য হয়ে আমাকেই তাঁর প্রতি শিশুর মতো আচরন করতে হয় এবং অনেক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়।”.......এই আকুলতা , আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বভাবআশ্রিত থেকেই পাল্লাহীন দরজা ঠেলে তাঁর অরন্তুদ অন্বেষন, যেখানে নারীর ভেতর খুঁজে বেরিয়েছেন বিশুদ্ধ মনন, ইন্টারসাবজেকটিভিটি, সেই অজানা আধোজাগতিক অসহয়তা। নিজেরই স্বামীর দ্বারা সিফিলিসে জারিত কার্তিক কাকার বউ যখন একটু ছায়ার খোঁজে গভীর বনে ঢুকে খসখসে উরু চুলকোয়, অভিজ্ঞতার দূরত্বে বসে মনীন্দ্র গুপ্ত টুকে রাখেন শূন্য হতে থাকা জীবনের পাঠ, অনুবাদ করতে থাকেন সামান্য নারীর অসামান্য কুহেলির। আবার কখনও মেয়েদের মধ্যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে টের পান নৌকার দুলুনি, জলের কলকল, দুই পাড় থেকে ঝুঁকে পড়া ডালপালায় লেগে নৌকোর ছইয়ের ছরছর শব্দ, মেয়েদের উদ্ভাসিত কথাবার্তার মধ্যে ঘুম ভাঙে তাঁর। ভাঙা দালানের থেকে লক্ষ্য করেন ‘আহীর গ্রামের ভরা যুবতীরা ঘড়া ভরে দুধ নিয়ে মিশে যাচ্ছে দিগন্তরেখায়’। তাঁর কবিতায় নারী এসেছে মেটাফর হিসেবে, গ্রহনযোগ্যতাকে এক বিশেষ মাত্রা দিয়ে তথাকথিত নিষ্কলুষ প্রেমের একক থেকে , ক্লাসিক বা ধ্রুপদী রোমান্টিসিজম থেকে নারীকে বের করে এনেছেন মনীন্দ্র গুপ্ত, প্যারালাইসিস স্বাদকোরক থেকে বির্নিজনের দিকে নিয়ে গিয়েছেন নারীর প্রস্তাব, নারীর বহুস্তরীয় খসড়া যা দীক্ষিত পাঠকের চেতনাকে ভরে দিয়েছে নতুন তত্ত্বে ,গড়িয়ে দিয়েছে নতুন ভ্রমনে। রবীন্দ্রনাথ সুধীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে  সত্তরের কবিদের মধ্যেও প্রেম বিষয়ক যে হাওয়াবাতাস , স্বপ্নফেরির সাঁকো হিসেবে নারীর যে অবস্থান তা থেকে সরে এসে মনীন্দ্র গুপ্ত নারীকে সরাসরি জীবনবিন্যাসের সাথে যুক্ত করেছেন, তাই তাঁর কবিতার স্মৃতিবীজে প্যারাসাইকোলজিক্যালি তীব্র হয়ে উঠেছে গর্ভের আড়ালের কিছু অলিখিত অগম্য  উপলব্ধির কথা।শস্যের মত তাঁর নিউরনে ঘুরে বেড়িয়েছে প্রাণমনজীবনের ছোট ছোট সরল সুগন্ধি। অক্ষয় মালবেরিতে ‘ঠাকুমার ওষুধ’ অংশে দেখতে পাই কি অসাধারন জীবনদর্শন কবিকে নিয়ে চলেছে বিস্মিত বার্তার দিকে, ওভারল্যাপ করে চলেছে প্রতিটা প্যারালেল প্লট। -“যখন ব্যথা উঠত তখন সে ডাক ছেড়ে কাঁদত। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে একদিন সে ঠিক করল, এ প্রাণ আর রাখবে না। মরবার জন্য বাড়ি ছেড়ে এক ঘোর জঙ্গলে ঢুকে হারাউদ্দেশ্যে চলতে লাগল- বাঘ, সাপ যে কেউ তাকে খেয়ে নিক, এই কষ্টের জীবনের শেষ হোক। অথচ বাড়ির দিকে তাঁর কত মায়া- সেখানে তাঁর বুড়ো আছে; ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি আছে। এইসব মনে করে সে কাঁদছে আর পথ চলছে।” – এসব তাঁর অভিজ্ঞতাজাত সত্য, নিজেরই উঠোন থেকে তুলে নেওয়া ছড়ানো ছিটানো অভিক্ষেপ। রিডারস রেসপন্স এমনই ন্যারেটিভে এসে খুঁজে নেয় লেখক পাঠককের আত্মমগ্ন সংযোগসূত্রটি। অবয়বহীনতা থেকে সরে এসে , ফেব্রিকশন থেকে সরে এসে সরাসরি মর্ম থেকে তুলে এনেছেন মাংসের নারীকে, মেদহীন মগ্নতাকে। যোগাযোগের মাঝে শুয়ে তিনি হাতড়ান নারীর নশ্বর শরীর, তাঁর আন্তরিক অক্ষয়,  স্মৃতি-বিস্মৃত অনুশীলনে, অবয়বে আণ্ডারলাইন করে রাখেন নারীর প্রহেলিকা-“এসো, শুতে এসো।/ একা বিছানায় ভয় করে।/ অন্ধকারে পাশে থাকো।/পায়ে সায়েটিকার ব্যথা।/ পায়ের উপর তোমার ভারী জানু চাপিয়ে রাখো।/ ঘুম আসে না...”অতীতের গতানুগতিক রোমান্টিসিজম থেকে বেরিয়ে ট্রাডিশন এ্যান্ড ইণ্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্টে টি এস এলিয়ট বলেছিলেন-  “If you compare several representative passages of the greatest poetry you see how great is the variety of types of combination, and also how completely any semi-ethical criterion of “sublimity” misses the mark. For it is not the “greatness,” the intensity, of the emotions, the components, but the intensity of the artistic process, the pressure, so to speak, under which the fusion takes place, that counts “ একই প্রবন্ধে তিনি আরও বললেন- “Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality.” মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতার নন্দনতত্ত্বে ব্যক্তি মনীন্দ্রগুপ্তের বাইরে আমরা যেন এই ইমেজিস্ট অস্তিবাদী মনীন্দ্র গুপ্তকে দেখতে পাই। দিদিমার দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয় মায়োপিক চোখে সব দিকে তাঁর দৃষ্টি, সংসার তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র, আত্মম্ভরিতার বিচরনভূমি। আবার বালক মনীন্দ্রের মনে হয় বালুচরী শাড়ি পরা কোজাগরী লক্ষী হয়তো কোনোদিনই আসবে না তাদের বাড়িতে, আর যদি বা আসেন তেঁতুলতলা দিয়ে আসতে আসতে তাঁর পায়ে ধূলো লেগে যাবে, গয়না হারিয়ে যাবে পশ্চিমপুকুরপাড়ের রাস্তায় অন্ধকারে। তাঁর শাড়ি তখন যেন ছোটমায়ের শাড়ির মতই ময়লা। ডিম্ববতী মরালীর মতো দীর্ঘঅবয়ব লাবপিসির গ্রামে রেখে আসেন ঘুমন্ত প্রাণের অবোধ পিপাসা কিম্বা পাছাপেড়ে শাড়ী আর ভারী ভারী গেটে মল পরিহিতা ঋতুমতী মেয়েদের প্রথম ঋতু নিয়ে ফল দেখার মত সারল্যের নিরীক্ষণ করেন অপরিমেয় দর্শনে। কালেক্টিভ পসিবিলিটিস থেকে ইনটেন্স এ্যালাইভনেস থেকে বনবাদাড়ে ঘুরতে  ঘুরতে প্রাণের মৌতাত থেকে তিনি এঁকেছেন তাঁর কবিতার বিছেহার, যাপনের চরৈবতিকে। প্রেমও তাঁর কাছে তথাকথিত কূলভাঙা প্রাপ্তি নয়, বরং দূরত্বরেখায় হেঁটে যাওয়া পিছল যা বারবার তাঁর হ্যান্ডনোটে হাজিরা দেয় আত্মশুদ্ধির দোলা নিয়ে-

 “এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কিনা।
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে
                   চলো খেয়ে আসি
লাল রুখু চুল
    সূর্যাস্তের মধ্যে
       অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
             - দেখি দেখি, তোমার তামাটে মুখখানা দেখি!

সূর্য এখনি অস্ত যাবে। পশুর মতো ক্ষীন শরীরে
আমরা হাঁটু পর্যন্ত জলস্রোত পেরিয়ে চলেছি-
              জলস্রোত ক্রমশ তীব্র...... কনকনে......” (এখন ওসব কথা থাক )

মনীন্দ্রীয় কাব্যবীক্ষায় নারী এমনই প্রকৃত প্রস্তাব। ইহলোকের ব্যাপ্তিতেই ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে এসেছেন আনন্দ অনুভব পরিত্রানের সিগনেচারার । চেতনাকে তুলে এনেছেন প্রতিনিয়ত থেকে, আর তাকে অসংলগ্ন বালির মতো উড়িয়ে দিয়েছেন অসীম শূণ্য চিররহস্যে। হোমোস্যাপিয়েন্সের বিন্যাসেই তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক নির্মাণ। স্বামী পরিত্যক্তা কুঞ্জদিদির চিঠি লিখে দেওয়ার মনঃসমীক্ষনের ভেতর দিয়েই চিনে নেওয়া যায় জীবনসত্যের দিকে মনীন্দ্র গুপ্তের প্রসন্নদীপ্ত দৃষ্টিটুকু। দরিদ্র অশিক্ষিত কুঞ্জলতার চিঠি বারবার লেখা হয়, ঋতু পেরিয়ে তাঁর একটিই জরুরী কথা, ফেরার কথা, আর এই অব্যক্ত কথাবার্তার ভেতরই সারসীর মতো কুতসিৎ পা, উঁচু কপাল আর রোগা লম্বা গলা নিয়ে কি যেন খুঁজে বেড়ায় কুঞ্জলতা! মানুষের চোখে পড়ে না এত সামান্য এত সহজ আর ঠিক এখানেই এই সহজতাতেই তিনি সাজিয়ে রাখেন তাঁর কমপোজিশনের সবুজ ঘুঁটিগুলি। নিরাবয়ত্বের থেকে পাঠককে টেনে নিয়ে আসেন অবজেক্টিভ কোরিলেটিভে।নাগালের বাইরে গিয়ে নয়, কোনো শৈল্পিক ক্যামোফ্লাজের আশ্রয়ে নয়, বরং তাঁর নৌকা ভেসে যায় অন্যভাষী রমনীর জন্ম-অজন্মের দিকে।

১।। প্যান্টের পাশপকেটে মেয়েটাকে রাখতেই
    সে তামার পয়সার মতো গড়িয়ে তলায় চলে গেল।
    তাঁর পর মাঝে মাঝে টের পাই
    সে আমার জানু ধরে ইয়ার্কি মারছে।
    ......
    .......
    আমি মধ্যরাত্রে জিজ্ঞাসা করি-
    তুই কেমন মেয়ে রে, জীবনভর বন্দী থাকতে চাস!
    সে দুর্গের নিচে ভূগর্ভঘরে
    তাঁর পায়ের শিকলের আংটা টুংটাং বাজিয়ে
    গানে উত্তর দেয়...........................(বন্দিনী)

২।।  তুমি সহজ পথে ভেতরে ঢুকতে দাও নি
     তাই কর্কস্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ভেতরে সেঁধুচ্ছি।
     কার বেশী লাগছে?
     তোমার না আমার?
     মাঝে মাঝে জল খাই,
     পিঠের শিঁরদাঁড়ার ওপর হাত রেখে দেখি, দারুন ঘেমেছ।......(বলাৎকার)

৩।।  “বিকেল হয়ে আসে। ফুরফুরে হাওয়া দেয়। আমি রাবেয়ার বাড়ির রাস্তাটা, সদর
      দরজা,বসবার ঘর,নীল গদি আঁটা কৌচগুলো আঁকি। তাদের বাড়ির হাওয়ায় ওড়া
      পর্দা আঁকি, তাঁর বিকেলের স্নানের জলঝরা শাওয়ার আঁকি। সারাদিন খাওয়া হয়
      না। শেষে সন্ধ্যের তারা আঁকি-সাঁঝের বাতি আঁকি-নিশীথরাত্রির নক্ষত্র আঁকি-নক্ষত্রের
      নিচে কালোয় মিশে গেছে রাবেয়া। রাত শেষ। প্যাড শেষ, কালির বোতলও প্রায়
       শেষ” .............(প্রথম কদমফুল )

 ৪।।   নদীর খাত অন্ধের চোখের মতো হয়ে আছে-
       অগভীর জলে আকাশ বা পাখি
       কিছুই আর ওড়ে না
       ......
       ......
       মঞ্জুশ্রীর সঙ্গে তাঁর বাবার এইখানে এসে দেখা হল।
       পৃথিবীতে এতদিন একলা থাকতে থাকতে মেয়েটা
       পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিল।
       আজ বাবা কবিতা পড়ে শোনাবেন,
       কাশবনের উপরে বাবা মেঘের মতো ঘনিয়ে আসবে। .......(মঞ্জুশ্রী)

৫।।    ক্রমে অন্ধকারে জ্বলে রানীর টায়রা, তীব্র চেলী।
       কিন্তু সে, বালিকা মহারানী-আজন্ম লালিত ছদ্মবেশে;-
       নিজেকে জানে না, তাই অগাধ সন্ধ্যায় বসে কাঁদে-
       আঙুলে হীরের আংটি তবু কাঁদে সমস্ত জীবন
       দাসীর ছেলের সাথে একহাত কড়ি খেলবে বলে।..........(মহারানী)


মৃত্যুঃ-

কবিতার দেহ জন্ম জৈব সম্পূর্নতা কি নিছক একটি প্রত্যয়? যে অবয়বকে মান্যতা দিয়ে অভিব্যক্তির ভারচুয়াল হতে চাওয়া, সে ঠিক কতটা স্পষ্ট? কতটা নিটোল? শব্দের মীমাংসা সূত্র ঠিক কোনখানে! শব্দ ও ভাষার বহুস্তরীয় স্তরগুলিতে বেড়াতে গিয়ে মনে পড়ে আর্চিব্যাল্ড ম্যাকলেয়িশের সেই ইঙ্গিতময় ফাঁক নিয়ে খেলা। .....”A poem should be palpable and mute/ As a globed fruit, /Dumb/As old medallions to the thumb,/ Silent as the sleeve-worn stone/Of casement ledges where the moss has grown -- /A poem should be wordless/As the flight of birds.”.......সুলভ চাতুরী নিয়ে নৈঃশব্দ্য, মৃত্যু মনীন্দ্রীয় আয়নায় জমাট বাঁধেনি কখনই। জগৎপর্দাথের ঘোর থেকে প্রত্যয় তুলে এনেই তাঁর এই পর্যটন। অনুশীলিত কবির এই জীবনোত্তর অভ্যেস কেবল একটি অনুচ্ছেদ মাত্র নয়।শুরুর দিনগুলো থেকে সম্ভাবনার দিনগুলো থেকে, মার্জিনের দিকে টুকে রাখা বীজ ও ক্ষেত্রের এক অলীক ভগ্নাংশও বলা যেতে পারে মৃত্যুকে। সীমান্তে দাঁড়িয়েই তিনি যেন উত্তরাধিকারের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছেন ‘ যাও জন্ম, গাছ ও ধর্মের নিচে বসে আছে অক্ষর পুরুষ/ দুর্লভ চকচমি জ্বেলে একসঙ্গে হরিন পোড়াও- সারা রাত/ আড্ডা দিতে যাও, ধরো, সুক্ষের আনীল শিখা”।... স্থিতপ্রজ্ঞের মতো আলো নিভিয়ে তিনি দেখতে চেয়েছেন কোথায় কার মুখে লেগে রয়েছে জন্মমৃত্যুরহিত নির্জন! তাঁর নীরবতার মিথরেখা শৈশবের সুস্বর সবুজেই প্রোথিত। জন্মের শুরুতেই মাতৃবিয়োগ আর পরজীবি শিশু অ্যানিমোনের মতো ঠাকুমাকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠা তাঁকে নিঃসঙ্গ হতে শিখিয়েছিল সূদূর বাল্যেই।ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরোর মত মাটিতে গেঁথে থাকা দুঃখকে খুঁজেছেন কাঁচা শরীরে, নির্বোধ নিরীক্ষনে। পরিনত মনীন্দ্র গুপ্তের রচনায় রূপকল্পে বারবার এই মৃত্যু গাঢ হয়ে উঠেছে বিনীত ধৈর্য নিয়ে, যাত্রারম্ভের সেই নিবিষ্ট প্রথমতা নিয়ে। সীমার ধারনাকে পেরিয়ে ধ্বনিহীন শুদ্ধতার সন্ধানে কখনো কখনো একেবারে একা হয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। দ্বন্ধের ভেতর দিয়ে নয়, শস্তার প্রসাধনে নয়্‌ বরং শোককে তুলে ধরেছেন উপকরনহীন শরীরের নিজস্ব সংগ্রহে। মৃত্যুকে নিয়ে তাঁর স্বতন্ত্র্য কাব্যগুনে উচ্চারন করেছেন সেই যাত্রাপথ সেই অনিবার্যতা-“যখন শেষবস্থায়, অতি দীন অস্তিত্ব নিয়ে কোনোক্রমে টিকে আছি, গলা দিয়ে স্খলিত শব্দ ছাড়া কোনো সার্থক শব্দ প্রকাশিত হয় না, ঠিক তখনই জীবনের সবচেয়ে সাহসী সবচেয়ে বেপরোয়া অ্যাডভেঞ্চারটি আমরা করে ফেলি- আমরা মরে যাই। মৃত্যুচিন্তা আমার মধ্যে আজকাল এইভাবেই আসেঃ মৃত্যু!- আমার সবচেয়ে দুরূহ, সবচেয়ে চমৎকারী, অচিন্ত্যপূর্ব কাজটিই তো এখনো বাকি আছে। আমার ভরসা হয়, মুখে অজান্তেই হাসির রেখা ফোটে। সেই মিরাক্যালটি কেমন হবে ভাবতে থাকি”.......জন্ম ভর ওজিবওয়ে ইন্ডিয়ানের মত এই তাঁর অন্বেষণ, তাঁর  আবিস্কার। ক্ষণজীবনের ওঁ-কারে নিঃসঙ্গতার সাথে বন্ধুতা পাতিয়েছেন তিনি, কোনোরকম হাহাকার ছাড়াই জীবনগ্রস্থ মুখের ভেতরও মেপে রেখেছেন মৃত্যুর প্রয়োজনীয় তরঙ্গ। মানুষ কোথায় যায়? আকাশ বাতাস নিঃঝুম পৃথিবীর ওপর দাঁড়িয়ে এই তাঁর নির্লিপ্ত জিজ্ঞাসা। জীবনের মত মৃত্যুও সেখানে নতুন এক প্রতিবেশীর তালিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে। when the fight begins within himself/ the soul wakes/And grows. Prolong that battle through his life! বিশ্বপ্রবাহে তিনি পেছন ফিরে দেখেছেন মৃত্যুকে বার বার আর বার বার মৃত্যু হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল ক্রোকাস,তাঁর ধ্যানের সামগ্রী। যাত্রাপথে ফেরার এই দুর্বোধ্যতাকে অনুগত পথনির্দেশিকা করে তাঁর চলা কেবল চলা।সেখানে মৃতদের ছায়া হাঁটে, মন শিমুলফলের মত ফাটে। মানুষের শূন্যতাকে ছোঁ মেরে দেখায় উদাত্ত অপরিসীম মহাকাশ। মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর দোহাকোষ দুর্গম, দুষ্প্রবেশ্য সংস্কার পেরিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করার মতই সরল; আসলে মৃত্যুর মেটাপরে মনীন্দ্র গুপ্ত কেবল বিয়োগ বা শূন্যতার কথা পাড়েননি বরং তাঁর প্রাজ্ঞতার সীমাকেই যতদূর সম্ভব রূপদক্ষ করে তুলেছেন। লাল মেঘের মধ্যে যে দুজন মাঝি গুন টেনে চলেছে, সরসর করে চলেছে নৌকো, মনীন্দ্র গুপ্ত সেই জলের বহর মেপেছেন, মেপেছেন নির্বাক খোলা আনন্দের মাঝে পড়ে থাকা শরীরের লঘুতা। আর তাই পথে দাঁড়িয়ে নিকট প্রানের মৃত্যদৃশ্যকে  ব্যাখা করেছেন অনেকটা এভাবে-“মুখ ফিরিয়ে দেখলাম পুকুরের ওপারে এসে ছোটমারা দাঁড়িয়ে আছে- হঠাৎ যেন সমস্ত পটভূমি উলটে গেল-মনে হল, পুড়তে থাকা দাদু সমেত আমরাই জীবিতের দল- ওরা, ঐ ওপারে সারি বেঁধে দাঁড়ানো মেয়েরা পরলোকের মানুষ, দুঃখময় তাদের ময়লা চেহারা- এপারে কত আগুন, ঐপারে, অন্ধকার, ছায়া”....প্রকৃত দ্রষ্টার মতো এই দেখা। কেবল নিঃসঙ্গ রেইন ট্রির তলায় শুয়ে শুয়ে দেখা পিঁপড়েদের যাওয়া আসা আর একটি দ্রুত সংক্ষিপ্ত দিন সে যে কত দূরের কত বিষন্নের কেবল তারই প্রস্তুতি অর্জন করা। শোককে আলোবাতাস দিয়ে কুয়াশা দিয়ে হিমল রঞ্জন দিয়ে প্রশ্যয় দিয়েছেন মনীন্দ্র গুপ্ত, আর শোক, মৃত্যু , ভাঙাচোরা নির্জন তাঁর কাছে বোধের অমোঘ লগ্নতায় লেগে থাকা এক স্বপ্নাতুর পারমুটেশন হয়ে উঠেছে। চাঁদের আলোয় লক্ষ্য করেছেন অকৃত্রিম যোগাযোগের সরোবরটিকে, যেখানে তাঁর সাক্ষাৎ তাঁর নিজেরই সাথে , প্রতিপক্ষহীন মনীন্দ্রের সাথে। সমাধিস্থ স্বয়ের ভেতর সযত্নে লালিত এই অবসর, নিজেরই ছেড়ে যাওয়া পোশাক। শোকগাথা আর মৃত্যুচেতনার মাঝে তিনি তফাত খুঁজেছেন যেন ‘জলের থালায় রোদ্দুর ধরা আর কাচের আয়নায় সূর্য ধরা। আয়না যখন সূর্যকে ধরে তখন আয়না যেন জ্বলে ওঠে। নিজের মৃত্যু যখন খুব নিকটবর্তী হয় তখন মনে একেবারে অন্য রকমের রং আর সুর লাগে।‘ যেন আলোর অলস জলাশয়ে হালকা ফতনার মতো ভেসে থাকে হাওয়া-ছায়া-রোদ, আর অমসৃন অতীত-বর্তমানে পিছলে যাওয়া...
পলকাটা শ্বেতসার নিয়ে তীব্র হয়ে ওঠে মৃত্যুর মানচিত্রহীন দেশের ঠিকানা। সাতজন্ম পেরিয়ে নির্মম সঙ্গীতের মত তাকিয়ে দেখেন জন্ম, উৎস ঠিক কত দূরে! স্বপ্ন সুযুপ্তির এক অন্যপারে আমরা সেই পুরুষশরীরের মনীন্দ্র গুপ্তকে দেখতে পাই, যেখানে তিনি প্রজ্ঞাময় , যেখানে তিনি বেজে উঠবেন স্তব্ধতায়। তাঁর ব্রম্ভজ্ঞান তাঁর যাপনে তাঁর ব্রম্ভজ্ঞান শব্দের চিৎসমুদ্রে। নিত্য থেকে যা কিছু পাওয়া তাই নিয়েই কেবল নেমে যাওয়া অ্যানেস্থেসিক ল্যাণ্ডস্কেপে। যেখানে শেষরাতের সপ্তমীর চাঁদ বুক খুলে শালুকপাতার মতো ভাসে আর শালুকপাতা গুলো সবুজ কচ্ছপের মত তাতর চারদিকে ডুবসাঁতার কাটে। নিগূঢ মহাপ্রস্থানের দিকে এ যেন তাঁর নিজের সাথেই নিজের আত্মমগ্ন সাক্ষাৎকার।গর্ভের থেকে তিনি আশ্চর্যভাবে খুলে দিতে থাকেন অন্তর্ধারনের দরজাটা, যা দিয়ে লক্ষ্য করা যায় যাপনের অনিকেত ট্রাফিকের মাঝে আলগা মাটি ধরে ফেরার ধ্রুপদী ঈশারা। ফেরার স্বরূপকে উপলব্ধি করেও যেখানে কেউ জানবে না ফেরার ঠিকানা।....”মরনের সময় আমাদের দেশের মানুষ ঘরে থাকে না...এখন সে আশ্চর্য এক দরজার সামনে – সেই দরজা দিয়ে বেরিয়েই আর কোনো ছোট বাড়ি নয়, যেন আকাশের মধ্যে তাঁর গতি হয়। যাদের চেতনা থাকে তারা নিজেরাই বলে,’ওরে আমারে বাইর কর।” পূর্নতার এই গহনের কাছে এসেই মনে পড়ে এলিয়টের সৃষ্টি-There is one who remembers the way to your door:/ Life you may evade, but Death you shall not। দূর পরলোকের দূরত্বে ঠিক এমনই শোধিত হয়েছে মনীন্দ্র গুপ্তের আনন্দময় অর্জন। নিজেরই ছায়ার কাছে আস্তিন গুটিয়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে মনোসীজের ধ্রুব অনুধ্যানটি। যন্ত্রনাদীর্ন শৈশবের পরাবাস্তবিক অকাল্ট বৈপরীত্যে বার বার খুঁজেছেন অন্তঃলোকনের মহাদ্রুম। অনিকেত ফসলের সুতো দিয়ে,কসমিক চেতনা দিয়ে বুনেছেন মৃত্যুর মত একটি একাঙ্ক নাটকের অতীন্দ্রিয় স্বীকারোক্তি।--

১।। মৃত্যু হল কি না জানব কি করে?
    হাতুড়েরা বলল, নাক মুখ চোখ দিয়ে তখন প্রানের বাতাস বেরিয়ে যাবে।
    ডাক্তার বলল, যখন রাইগার মর্টিস শুরু হবে।
    এ যেন এত সোজা-‘বাড়িতে আছ না কি, থাকলে সাড়া দাও।’
    সাড়া না দিলে বুঝব, নেই।।.............( কোকিল )

২।।  বেড়ালটা সকাল থেকে কাঁদছে
    কাল থেকে ওর বাচ্চাটা নিঁখোজ।
    আমি রাতের বেলা রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ করছিলাম,
    সে শান্তির আশায় এসে দুই থাবা জড়ো করে বসল।
    কিন্তু হল না।
    একটু পরেই সে মিউমিউ করে আবার কাঁদতে লাগল,
    পাগলের মতো প্রদক্ষিন করে ঘুরতে লাগল।
    আর পুত্রশোক আগুনের মতো ঘিরে ধরল
    রামকৃষ্ণদেবকে...........................(বিড়ালী )

৩।। জলে নামার আগে, যে চুল খোঁপায় বাঁধা ছিল
    তা এখন খুলে গেছে।
    কে খুলে দিল!- দুজলেরা? মাছেরা? না কি মৃত্যু নিজে?
    অবন্ধনা চুল এখন ঘুমিয়ে পড়বে।
    জল,মাছ, মৃত্যু-যে-ই হও, নাক মুখের মধ্য দিয়ে
    ওর ভিতরে ঢোকো।
    ভিতরে কুলকুল করে জলতরঙ্গ বাজাও, খেলা করো,
    যতক্ষন ও জেগে আছে ওকে হাসাও, আদর করো।.........(জলের নিচে তরঙ্গ)

৪।।  তাঁর মৃতদেহের সৎকার করতে গিয়ে আমার মন
     দুই বিপরীত পথে চলে।
     সুগন্ধী জলে তাঁর লম্বা কালো চুল, বাদামি রং শরীর
     তিন বার ধোয়া হল।
     প্রিয় লাইলাক রঙের সিল্ক পরানো হল।
     যেন সে এখনো বেঁচে, তাই এত পরিচ্ছন্নতা, সাজগোজ।
     মরা শরীর ভাবলে কি তাকে এমন সাজাতে পারতাম!
     সে মৃত বলেই এই যত্ন। ........................(দু হাজার বছর আগে)

৫।।  মনে পড়ল, মাধোজী লং, সেই খোঁড়া যোদ্ধার কথা।
     মরনাহত, মৃত্যুকে বাঁ পাশে দেখতে পেয়ে হঠাত শান্ত স্বর, বলেছিলেনঃ
     জন্ম থেকে পিছু নিয়েছ। এখন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াও। আমাকে ছোঁবার আগে
     দেখে নাও আমার শেষ খেলা।
     তাঁরপরই প্রচণ্ড বেগে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি শিখরে। সবাই দেখেছিল, যেন
     ঘোডাসুদ্ধ উড়ে গেলেন অস্তসূর্যের মধ্যে...............( দুই যোদ্ধার মৃত্যু)

৬।।  সেই অবঅতীত আবার ফিরে আসছে আমার মধ্যে।
     কাউকে চিনতে পারি না, নাম মনে পড়ে না।
     দুর্ভাবনাগুলো যেন সাপের মতো মাথা নিচু করে
     সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে-
     বালির উপর পড়ে থাকছে তাদের চলার
     চিত্রবিচিত্র ঢেউ........................(ফিরে যাবার পথে)

বিশ্বনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে কথা প্রসঙ্গে আচার্য রমেন্দ্রকুমার চৌধুরী বলেছিলেন- ফ্রি ভার্সের কবিতা – সাম্প্রতিক কালে যার নিরন্তর সক্ষম পূজারী মনীন্দ্র গুপ্ত।যেখানে তাঁর লেখায় শিল্পে সাহিত্যে লক্ষ্য করা যায় ট্রাডিশনাল ইমিটেশন, জার্নি উইথইন ইন সার্চ অফ ট্রুথ এ্যান্ড স্যালভেশন। যেখানে তিনি অকপটে বলতে পারেন-‘ রাস্তায় চেনে না কেউ,/ পথে মরলে বলবে, জনৈক অজ্ঞাতনামা লাশ,/কিন্তু এই দশনামী টং ঘরে, আমি রাজা,/প্রথম মনীন্দ্রগুপ্ত।‘-অথবা-‘আমি প্রাগৌতিহাসিক নই, দৈত্য নই, কবি নই-কীট।/ নিষ্ঠুরতা, স্বাধীনতা, উদাসীনতার ঐ পুরুষ পাহাড়চূড়া থেকে/আমি স্বেচ্ছানির্বাসিত, নত, নেমে আসি বুকে হেঁটে;/ আর, যত নিচে নামি- গায়ে লাগে ফুলের পরাগ,/জলস্রোত,উপত্যকা, মৌপোকাদের গ্রাম,সংসারপৃথিবী, ভালোবাসা।/স্বাগত হাওয়ায় যেন বাড়ি ফিরছি---‘। ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্বের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তাঁর কবিতা বদলের বা ভাঙচুরের নয়, আর্ন্তবৈষয়িক, যেখানে ডিকনস্ট্রাকশনকে দ্বিতীয় গোলার্ধে রেখে বহুধা পথের ভেতর তিনি গড়ে তুলেছেন সাবডিউড রিনানশিয়েশন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন প্রতিটা জৈবিক প্লট, ঘুরিয়ে নিয়েছেন তাঁর গুঢ়র্ধমী রিল, পৃথিবীর নির্মাণিক বয়া, মিউচুয়াল ল্যান্ডস্কেপে দেখতে চেয়েছেন সামাজিক মানুষকে সামাজিক সৌন্দর্যকে। এলিয়টের নৈর্ব্যক্তিকতা বা গোর্কির আত্মজৈবনিক জাড্যের সাথে কেউ কেউ তুলনা করলেও তাঁর সাহিত্য স্বতন্ত্র্য, তাঁর ভুগোল অবস্থানকে পেরিয়ে কালনিরপেক্ষ।তিনি ফর্মাল অথচ ক্রমাগত উপলব্ধি হয় বিশেষের দিকেই তাঁর হাত বাড়ানো। সর্বতোভাবেই মনীন্দ্র গুপ্ত আধুনিক,আধুনিক তাঁর অভিজ্ঞতায়,আধুনিক তাঁর স্মৃতিচিত্রে। নির্মোহ দৃষ্টিতে কবিতার কারুকলাতে প্রত্যক্ষ করেছেন শৈল্পিক বাইনারী। কবিতায় মেপে রেখেছেন ব্যক্তিক ডায়মেনশন, বিস্তৃত চরিত্রের নির্যাস। তাঁর শাব্দিক সংসার স্পৃহা থেকে কখনো পৌঁছে গেছে প্রেরনা অবধি। কখনো প্রেতলোক অবধি। অর্ধজাগ্রত সুযুপ্তির পাশে বসে তিনি সাধনা করেছেন কখনো পরাপ্রকৃতির, কখনো অবসার্ভ করেছেন আনডিফারেনশিয়েটেড ইল্যুশন। সন্ন্যাসী,শিকারী, দৈত্য, মন্ত্র, স্বপ্ন, অট্টহাসি-আদিম অশ্বারোহীর মত দ্রবীভূত এমনই সব ঘোর নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন প্রকৃত ইউলিসিস। নির্বাচিত আবহাওয়ার মধ্যে সেই সমাজবীক্ষ কবি যিনি বলতে পারেন-‘নেবো, সব নেবো।/ সুনীল আকাশে তুমি হেসে উঠলে, আমি /ধারাপতনের বনে ভিজতে ভিজতে/ সমস্ত কুড়োব’।.... আসলে কেবল একজন কবি বা গদ্যকার নন, তিনি চিত্রকরও। স্বরচিত ‘লাল স্কুলবাড়ি’,’নীল পাথরের আকাশ’, ‘ছত্রপলাশ চৈত্র্যে দিনশেষ’, রঞ্জিত সিংহের কাব্যগ্রন্থ ‘মনিপুরে নীল পদ্ম’ কিংবা সংযুক্তা বন্দোপাধ্যায়ের ‘বসন্ত প্রকৃতি’র প্রচ্ছদ চিত্রকর হিসেবে তাঁর সুক্ষতার পরিচায়ক। অনুকৃত শব্দদের প্রতিরূপায়িত করেছেন রঙের স্বাক্ষরে।মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতাভাবনার ভ্যারাইটি এবং ভারসিলিটির অনন্যতায় চিত্রশিল্পি মনীন্দ্র গুপ্তের মৌলিকত্ব অনেকটা নেপথ্যচারী ক্যানভাসের মত। শব্দের অদর্শিত ফাঁকগুলোকে যেন অফুরান রম্যতায় আশ্চর্য রঙে ভরিয়ে দিয়েছে। মনকে মানসভ্রমণে নিয়ে যেতে মনীন্দ্র গুপ্ত আশ্রয় নিয়েছিলেন জীবনের, আশ্রয় নিয়েছিলেন বিপুলা প্রবাহমনতায়, ছত্রাকের মতো আলোয়, বর্ষাকালের সোমলতায়, আর বিস্ময়কর অতীতের বুকে লুকিয়ে থাকা চলমান ন্যাপথালিনের মেয়ে হয়ে । গোডোতের মতই তিনি জানেন কেউ আসবে না ,অথচ চলেছেন নিরুদ্ধেশ যাত্রায়, এ যাত্রা একটা অপেক্ষার, একটা ডাকের যেখানে কেবল তিন সত্য ফুটে আছে সাগর, বাতাস আর শূন্য, সেই স্থিরচিত্র, সেই বিকল্প জীবন, মানুষ মানুষীর ছেড়ে যাওয়া স্ববিরোধ আর সবশেষে প্রসন্ন শূন্যতা-‘Nothing happens. Nobody comes. Nobody goes. It is awful’।‘বৌদ্ধ শ্রমনের মত তিনখানা কাপড়, একটি ভিক্ষাপাত্র, একটি ছোটো কুড়ুল, একটি ছুঁচ, একটি কটিবন্ধ ও একটুকরো জল ছাঁকার ন্যাকড়া’ নিয়ে জীবনকে কবিতায় মিশিয়ে সংখ্যাতত্ত্বের থেকে মনীন্দ্রগুপ্ত পাড়ি দিতে চেয়েছেন সহজিয়ার দিকে। যে জীবন তাঁর তাকে তিনি কবিতার গদ্যের হাতে রেখে এগিয়ে গেছেন নিঃশব্দে, নিঃস্রোত, নিস্তরঙ্গ, যেন এই তৃষ্ণার বাইরে নির্মোহ করে তোলার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।
মনীন্দ্র গুপ্তের মত বিশালাকার এক স্রষ্টার বহুদর্শী আনন্দ বিস্ময় যাপন নিয়ে কিছু বলতে গেলেই মনে হয় কোথা থেকে শুরু করি! কোথায় সুস্বাগত ডেকে নেবে লাউবুড়ো হয়ে! একদিক থেকে তাঁকে ছুঁতে চাই তো দলছুট হয়ে অন্য রাস্তা ধরেন তিনি, অন্য পথ, পোষাক খুলে সত্যিকারের মাছেরা এসে তাকে নিয়ে চলে স্নোফলের অনন্ত সাদায়।‘নেশাডু বুড়োর কাঁধে আচাভুয়া পাখি নেমে বলেঃ গপ্পো বলো-’। মনীন্দ্রীয় গপ্পো। গুল্মের মত, জিনের মত, স্ফিংকসের মতো, তিনি সেই প্রথম জাতক, যে বালকের স্বপ্ন দ্যাখে- স্বপ্ন দেখে জল, নৌকো, ভেসে চলে যাওয়া। রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতায় জীবনানন্দীয় কোকুনকে পাঠক ওরশিপ করেছিল বহুকাল কিন্তু তাঁর পরবর্তী পথিকস্বত্তা নিয়ে আত্মনির্ভর যোগাযোগ নিয়ে মৌলিকতা নিয়ে মনীন্দ্রগুপ্তের আবাহন আজও সেভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি বাংলা সাহিত্য। তাঁর মৃত্যুর পরেও সেভাবে সামান্যতম স্মৃতিচারণেও দরাজ হতে পারলাম না আমরা। তবে মনীন্দ্র গুপ্ত তো প্রাসাদ বা প্লট বানিয়ে কবিতা লিখতে চাননি কখনও, চেয়েছিলেন মালিকানাহীন বিনিপয়সার জমির সৌন্দর্য নিতে। তাঁর মত একজন বিশুদ্ধ লেখক স্বতশ্চল স্রোতে গা ভাসাতে চাননি কোনোদিনই, বরং মোহনায় গিয়ে সমুদ্রে না মেশা পর্যন্ত ছিলনা তাঁর শান্তি। প্রশান্ত মল্লের কথায়-‘জীবনানন্দের পর এক নতুন কবি, যাঁকে আমরা কোনো অভ্যর্থনা জানাইনি’। আত্মপ্রচারহীন মনীন্দ্র গুপ্তের প্রান্তিক দিব্যতায় সত্যিই কি আমরা পৌঁছতে পেরেছি- এ প্রশ্ন হয়ত থেকেই যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে, তবে এসবে মনীন্দ্র গুপ্তের থোড়াই কেয়ার, কারণ মৃত্যুর আগেই যে তিনি দুঃখসুখহীন জন্মমৃত্যুহীন চিরজীবিতার তাজা হাওয়ার সন্ধান পেয়ে গেছিলেন, যেখানে এতটুকুও দুঃখ বা ভিজে ভাব নেই, যেখানে ফেরার পথে কবেই তিনি উপসর্গপত্রে লিখে গেলেন মৃত্যু সম্বন্ধীয় মহাপয়ার-
        “এতদিন যা ভাবি নি, মরনের কিনারায় দাঁড়িয়ে এখন তাই ভাবছি।–মৃত্যুর পরে হয়তো আমি চিরজীবী হতে চলেছি। কবিতা, বন্ধ হবার বদলে, নতুন একটা পথে যাবার চেষ্টা করছে। এখন মাঝে মাঝে আমার মধ্যে একটা বিদেহচেতনা কাজ করে। কামক্রোধলোভমোহ ছয় রিপু মন থেকে যেমন খসে পড়ছে তেমনি কবিতাতেও আর তারা জায়গা পাচ্ছে না। জীবিতের এক রকম চাহিদা, মৃতের অন্য রকম চাহিদাহীনতা । পথের এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে আমি বেশি বাস্তব বলে স্বীকার করি- অতিবাহিত জীবন যত ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসা মৃত্যু ততই সত্য হয়ে উঠছে। আমার নতুন কবিতা সেই চাহিদাহীনতা, বাস্তবতা ও সত্যতা নিয়ে চিন্তা করতে চাইছে”.......
********************

No comments:

Post a Comment