Wednesday, February 28, 2018

বিষয় নির্ভর গদ্য : গৌতম গুহ রায়

দ্রোহের অবিনশ্বর ঝান্ডা, আমাদের  লিটল ম্যাগাজিন,
                                       গৌতম গুহ রায়

    আসল প্রশ্ন হচ্ছে ভিড়ের হৃদয়ের পরিবর্তন হওয়া দরকার,
      বিষয়টা যখন লিটল ম্যাগাজিন তখন এক ভিন্নধারার সৃজনের বেগবান স্রোতের কথাই  উঠে আসবে । তাই জীবনান্দকে উদ্ধৃত করে আলোচনার সূচনা করা যেতে পারে । , কবিতার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন ঃ “কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে ভিড়ের হৃদয়ের পরিবর্তন হওয়া দরকার, কিন্তু সেই পরিবর্তন হবে কি কোনো দিন? ... যখন দেখি তথাকথিত সভ্যতা কোনো এক দারুণ হস্তীজননীর মতো যেন বুদ্ধিস্খলিত দাতাল সন্তানদের প্রসবে পৃথিবীর ফুটপাথ ও ময়দা ভরে ফেলেছে তখন মনে হয় যে কোনো সুক্ষ্ণতা , পুরোনো মেদ ও ইন্দ্রলুপ্তির বিরুদ্ধে যা, পুরোনো প্রদীপকে যে অদৃশ্য হাত নতুন সংস্থানের ভিতর নিয়ে গিয়ে প্রদীপকেই যেন পরিবর্তন করে ফেলে; তার এই স্ময়িকতা ও সময়হীন্তার গভীর ব্যবহার যেন মুষ্টিমেয় দীক্ষিতের জন্য শুধু, সকলের জন্য নয়- অনেকের জন্য নয়” স্রষ্টার এই আর্তি শুধু কবিতার ভূবনের নয় সমস্থ সাহিত্য ভুবনের ।এরই প্রতিক্রিয়াজাত আলোড়ন থেকেই জন্ম নেয় স্বতন্ত্র ও আপোষহীন এক শতজল ঝর্না, লিটল ম্যাগাজিন সেই শতজল ঝর্নার ধ্বনি । ব্যক্তিসত্তার সময়-মন্থিত উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয় শিল্প, এই উপলব্ধির অনুরণন  থেকেই উঠে আসে সাহিত্যপত্র । সাময়িকী বা periodical  যেখানে সময়কে বহন করে তথ্যগুচ্ছের মাধ্যম, সাহিত্যপত্র সেখানে সময়ের চিহ্নবাহী অনুভূতিকেও ধারণ করে রাখে । এক্ষেত্রে তাই ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তার আয়ূষ্কাল, যতটা তার স্বকীয়তা, তাতে ধরে রখা অনূভুতি ও সময়ের চিহ্নাবলি । আজ সময়ের ধর্মেই “লিটল ম্যাগাজিন” বা ছোটো ছোট বারুদ প্রকোষ্ঠ সমকালীন জঞ্জীবন, সমাজের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, তার আলোড়ন, অনুরণন। চিন্তনের প্রতিফলন বা  প্রকাশ বহন করে চলছে । “ম্যাগাজিন” শুধু বারুদ প্রকোষ্ঠই নয় a portabole teceptacle for articles of Value-ও বটে । শুধু সময়কে ধারণ করাই লিটল ম্যাগাজিনের ধর্ম নয়, সমাজের ঋণাত্মক প্রবণতাস্মূহের চিহ্নিতকরণ, সমাজকে সচেতন রাখে সে তার নিজের ভঙ্গিমায় । শুধু গল্প কবি তার প্রকাশের মাধ্যম নয়, গোটা সৃজন মাধ্যমকেই আলোডিত করে দায়বোধ থেকে ।
“শিল্প হচ্ছে সৃষ্ঠি,বিবর্তন আর সীমাহীনতার মুখপত্র” ।
 
 ১৮র গুটিকয়েক স্কুল ছাত্রের স্পর্ধিত প্রচেষ্ঠায় ১৯৭৮এর বর্ষ সূচনায় যে “দ্যোতনা”র অঙ্কুদ্গমন আজ তা প্রায় চার দশকের মুখে দারানো এক মহীরূহ ।  হাততালির যান্ত্রিক শব্দ নয়, বাড়িয়ে দেওয়ার হাতের ভেতর যে উষ্ণতা রয়েছে সেটাই আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন । এই তাপ মুঠোভরে এগিয়ে দিতে চাই বাংলা ভাষার সমস্ত ভাষা কর্মীর প্রতি, যারা বাংলাভাষার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে থেকে সহস্র প্রতিবন্ধকতাকে উড়িয়ে দিয়ে জারী রেখেছেন সৃজন সংগ্রাম । দ্যোতনা আত্মপ্রকাশের লগ্ন থেকেই যৌথ প্রয়াসে চলার বিশ্বাসী । লেখক, পাঠক, মুদ্রণ কর্মী, দপ্তরি প্রত্যেকে মিলে এই যৌথ বাহীনি । শুধু মাত্র নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ নয়, সৃজনশীলতার অভিমুখ নির্দিষ্ঠ রেখেই তার এগিয়ে চলা, অবশ্যই চলার চালিকা শক্তি তার স্বপ্ন, সুস্থ ও সুন্দর এক দমন্মুক্ত সমাজ, যেখানে প্রবলের বুটের ভাড়ী আশব্দ শাসনের অশ্লীল ভাষা হয়ে উঠবে না, শতফুল বিকশিত হবে সৃষ্টি সুখের আনন্দে । আমরা বিশ্বাস করি “শিল্প হচ্ছে সৃষ্ঠি,বিবর্তন আর সীমাহীনতার মুখপত্র” ।
     আমরা যে বিশ্বাসের উপর আজো আস্থা রাখি  সেটা  লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠান বিরোধি চরিত্রে । লিটল ম্যাগাজিনের আন্যতম বৈশিষ্ঠ তার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, পুরোনোকে সে ডিঙিয়ে যায় নতুনের অন্বেষণে । সেই পারে আত্মসম্মাঙ্কে আয়ূধ করে গতানুগতিক্তাকে আক্রমণ করতে । ওইতিহাসিক ও অনতিক্রম্য কারণোই উওত্তরের আমরা স্বতন্ত্র , তিস্তা বাংলার এই ভিন্নতা নগর কলকাতা থেকে বোধ ও ভাষা, জীবন অভিজ্ঞতার কারনে । এই ভিন্নস্বরের জন্যই আজ মফস্বল শহরগুলো, জনপদ গুলো থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার দিকে মননশীল লেখাপত্রের অনুসন্ধানী পাঠক ঘুড়ে তাকিয়েছেন । ভালো লেখার জন্য ভালো কাগজের জন্য এই প্রান্তিক শহরের দিকে তাকাতে বাধ্য হছেন নাগরিক পাঠক । বিপনন মূখ্য নাগরিক সাহিত্যে পাঠক আজ ক্লান্ত ও হতাশ ।
    এই তিস্তা বংলার এক সম্পাদক তার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন,” স্বাধীনতার সুরই প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের সুর । প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের স্বরের সে আত্মীয়”, এভাবেই এক সটান ও ঋজু বাঁশের মাথায় উড়িয়ে দেওয়া হয় লিটিল ম্যাগাজিনের অবিনশ্বর ঝান্ডা । কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির, তিস্তাবংগের দুই জনপদেরই স্বাধীন মত প্রকাশের হাতিয়ার হিসাবে  সামোয়ীক পত্রিকার বিশেষ ভূমিকা পরবর্তিতে প্রতিষ্টিত হয় যার সূচনা ১৮৯৫-৯৬,  প্রায় একই সময়ে দুই শহর থেকে দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো, কোচবিহার থেকে “কাঙ্গাল” আর জলপাইগুড়ি থেকে ‘ভিক্ষুক” । দুটোই অচিরে বন্ধ হয়ে যায় ক্ষমতার রোষে ।
“আমরা এ যুগের দূরন্ত ঘোড়সওয়ার”
১৯৫২তে আমার শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো “জলার্ক”, আমাদের সাহিত্য পত্রের দিশা নির্দেশ করেদিলো এই প্রকাশ । এর পর এই শহর থেকে বেরহয় সত্তরের দশকে “পাগলঘোড়া” “ক্রুশেড” ,তার আগে “উত্তর দেশ” । এই স্বতন্ত্র স্বরের উত্তরাধিকার নিয়েই ১৯৭৮এ দ্যোতনার প্রকাশ । সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকার তখন শ্লোগান ছিলো “আমরা এ যুগের দূরন্ত ঘোড়সওয়ার” । ইতিপূর্বে দ্যোতন নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিলো, তাই এই নামটিই পত্রিকা প্রকাশের সময় বাছা হয় ।  ১৯৮২ নাগাদ আসে এর প্রকাশ ভাবনায় ও চেহারায় বিপুল বিবর্তন । অগ্রজ দুই লিটল ম্যাগাজিন “পাগলাঘোড়া” ও “ক্রুশেড”এর সঙ্গে নিয়মিত সাহিত্য আড্ডায় গড়ে উঠলো  নিজস্ব সাহিত্য পরিমণ্ডল, লেখক গোষ্ঠি । সঙ্গে সঙ্গে চলে সাম্প্রতিক সাহিত্য ও সমাজভাবনার চর্চা, এই চর্চার আবহে সেতু বন্ধন হয় উত্তরের  অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে, “তমসুক” জিরাফ, দ্রোহ, ধৃতরাষ্ট্র, পাহাড়তলি, এবং এই সময়। বক্সবাজার, মল্লার প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে কাধে কাধ দিয়ে উত্তরে জমাট বাধে এক স্বতন্ত্র  সাহিত্য আন্দোলন, যার বীজ ছিলো এই সব লিটল ম্যাগাজিন, দ্যোতনা যার শরীক ।
“দ্যোতনা” সমাদৃত হয়েছে তার বিশেষ সংখ্যা গুলোর জন্য, বিহারের আরোয়াল গণহত্যা বা গুজরাট গণসংহারের সময় বিশেষ সংখ্যা প্রাকশ করে, বাবরি মসজিদ  ধংসের সময়ের গনহিস্টিরিয়ার বিরুদ্ধে সংখ্যা প্রকাশ করা হয় ।
    র‍্যাবোবো মৃত্যু শতবর্ষে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, লিকানর পারা, প্রভৃতি সাহিত্য ব্যক্তিত্বদের নিয়েও এই মফস্বল শহর থেকে “দ্যোতনা”র  বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়, মূল্যবান ক্রোড়পত্র করা হয় চারুচন্দ্র স্যান্যাল, শামশের আনোয়ার, হুমায়ুন আজাদ,ফাল্গুনী রায় , গুন্টার গ্রাস প্রমুখকে নিয়ে ।
আমরা ভারতীয় ভাষা চর্চার ও ভাষা তথ্য চর্চার স্থপতি জন আব্রাহাম গীয়ার্সন এর জন্মের ১৬০ বর্ষ পূর্তিতে বিষেষ সংখ্যা করেছি, মধুসূদনের ১৫০বছরে  গুরুত্বপূর্র কাজ করা হয়েছে দ্যোতনার পক্ষ থেকে । ভিন্নধারার কথা সাহিত্যিক শহীদুল জহীর বা কবি অনন্য রায়ের মত লেখকদের নিয়ে কাজ করা হয়েছে ।
     কাঁটাতারের বিভাজন রেখার উর্ধে বাংলার যে অখন্ড সৃজন বিশ্ব, দ্যোতনা তার প্রকাশ ক্ষেত্র,  দ্যোতনার মুখবন্ধ আজ “অবিভক্ত বাঙ্গালী সত্তার প্রতিবেদন” ।
      দ্যোতনার ভাষা বিষয়ক সংখ্যা পাঠকের মনোযোগ কেরেছিলো । “ভাষাঃ সংবেদন ও সৃজন” এর প্রতি পাঠকের আগ্রহ আমাদের উতসাহিত করেছিলো, আমরা ভাষা বিষয়ক চর্চা ও বিতর্কগুলোর মুখোমুখি থাকার তাগিদ অনুভব করি, তাই প্রতি সংখ্যাতেই ভাষা নিয়ে এই আলোচনা চালু রেখেছি ।
শেকড়ের কাছাকাছি থাকে চাই আমরা, আমাদের অস্থিত্বের তাগিদ এটা । প্রতি সংখ্যায় তাই স্থানীয় সংস্কৃতির শেকড়ের অনুসন্ধান থাকে আমাদের ।
 আগামীতে তিস্তা নদীকে নিয়ে একটি সমৃদ্ধ সংখ্যা করায় উদ্যোগ নেও্য়া হয়েছে ।
       আমরা জানি, প্রায় আধা বন্য, আধা সামন্ত, আধা পুঁজিবাদী এই সমাজ কোনো বিকশিত মূর্ত সমাজ নয় । আর এই অগোছাল সমাজে ছোট কাগজের ক্ষেত্র থাকে আরও দূর্বল । বিদ্যমান পুজিতান্ত্রিক সমাজ  কাঠামোতে শোষকের অন্তর্দন্দ্ব প্রকট হলেও এই দ্বন্দ্ব মৌলিক দ্বন্দ্ব নয় ।  যখন আসে কাঠামো ভাঙ্গার কথা, প্রতিষ্ঠিত জীর্ণ মূল্যবোধ উৎখাতের কথা, যখন আসে সচেতন দৃষ্ঠিভংগির কথা, যখন আসে সৃজনশীল পরিবর্তনের কথা, উন্নত জমিকর্ষনের প্রসংগ ।  নৈতিক অনুসন্ধিৎসায় দ্বায়বদ্ধ থাকার কথা, তখন এসব বোধ, মনন, জিজ্ঞাসা, চিৎকার  রাজনীতি নিরপেক্ষ থাকে না, দলীয় গোষ্ঠিবদ্ধতার থেকেও বৃহত্তর এই রাজনীতির সেনা দ্যোতনা, সে দলদাস নয়্‌  চেতনার চর্চার, স্বাধীনতার প্রকাশের দাস ।
     
আমাদের বাঁচা ও বেঁচে থাকার  আয়ুধ ।
 চলতে চলতে অনেকটা পথ চলে এলাম আমরা, এই প্রায় অর্দ্ধশতকের পথ, একটা অর্ধবিকশিত, এবড়ো খেবড় জনপদের আধো অন্ধকারের আলোছায়ায় আমরা একটা একটা করে পা ফেলে এগিয়ে এসেছি , এই সময় সবকিছুই বিপনন মুখী, মুনাফার মানদন্ডে মাপা হয় কার জল কত গভীর । পূজির এই ক্রমপ্রসারমান দিনে বিশ্ব ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, টুকরো টুকরো , খন্ডিত মানুষ মানুষের দিকে ধেয়ে আসছে ভীষণ আত্মঘাতী সংঘাতে । এই ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে আমরা যাবতীয় সংকোচন , খন্ডিকরণের, গন্ডিকরণের বিরুদ্ধে , লিটল ম্যাগাজিন আমাদের বাঁচা ও বেঁচে থাকার  আয়ুধ ।
এক দগ্ধ প্রান্তরের ভেতর দিয়ে ছুটছি আমরা, এই সময় চারদিকে উড়ছে ভষ্ম ছাই, দৃষ্টিপথের প্রতিবন্ধক সেই ধুসর ছাই । এর মধ্য দিয়েই আমাদের আলোর পথ যাত্রা, আসুন আপনি , হাতে হাত ধরে এই যাত্রায় সামিল হই ।

No comments:

Post a Comment