Tuesday, February 27, 2018

ব্যক্তিগত গদ্য : প্রবীর রায় 
লেখালিখি

লেখকজীবনের শুরুতে একজন লিখিয়ে যখন কলম ধরেন , তখন তিনি জানেন না এই লেখাই পরবর্তীকালে তার নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে কিনা।তিনি ভবিষ্যতে লেখক পরিচিতি পাবেন ,নাকি লেখা লেখা খেলাতেই শেষ হবে এই আঁচড় কাটা। এ নিয়ে ভাবনাও তার আসেনা।বেশীর ভাগেরই শুরু কবিতা দিয়ে।সেখানেও অন্ত্যমিল কিংবা মুখস্ত করা ছড়ার মত করে মকশো করা। এভাবেই একদিন কেউ কবিতা লিখিয়ে হয়ে যায়। কেউ শুরুতে কবিতায় থাকলেও পরে গদ্যে চলে যায়।অনেকে দুদিকেই সমান রচনাকাজে ব্যাস্ত থাকেন। কেউ খ্যাতি, কেউ অখ্যাতি, কেউবা কোনও দিকেই নয়, নেহাতই নগণ্য। তবুও লেখা হয়।গদ্যের পাঠক বেশী হলেও কবিতা লেখকের সংখ্যাই এখন বেশী,এ অভিযোগ পাঠক কুলের।

কবিতা কোথায় কবিতা হয়ে ওঠে,এ সম্পর্কে বহু কবি নিজস্ব অনুভুতির কথা বলেছেন। জ্ঞানী ও পন্ডিত ব্যাক্তিরা এ বিষয়ে দীর্ঘ ভাষণও দিতে পারবেন।কিন্তু কবিতার গ্রহন বর্জন, পাঠকের নিজস্ব রুচি কবিতাভাবনা সংস্কার মনোজগত অনুভূতিপ্রবনতা এমন সূক্ষ্ম বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।এজন্যই একটি কবিতার পাঠপ্রতিক্রিয়া একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম।এই একবিংশ শতাব্দীতেও অনেকে কবিতা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাত্রা গুনতে থাকেন। অনেকে শোনা মাত্রই কবিতার ব্যাখ্যা চান।কবিতায় অন্য ভাষা ব্যবহারে আপত্তি জানান অনেকে।অভিধান বহির্ভূত শব্দ ব্যবহারে অনেকের আপত্তি।অপ্রচলিত শব্দবন্ধ কিংবা নতুন শব্দ সৃষ্টির মত পুরনো কাজ এখনও মেনে নিতে পারেননা অনেকেই।এখনও আবৃত্তিযোগ্যতা কারও কারও কবিতা হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত, কবিতার সহস্র মাইল পার হয়ে আসার পরেও।

একজন কবি কবিতা লেখে কেন?তার মধ্যে কি খ্যাতির সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থাকে? না কি নিজের ভাবনা কে নিজের মত করে প্রকাশ করার তীব্র তাড়না তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় কয়েকটি লাইন।লেখালিখির সমস্ত বিভাগের মধ্যে কবিতাকে বলা হয় সবচেয়ে অনুভূতিপ্রবণ মাধ্যম। কবির মনের ভিতর ও বাহিরের এই অদ্ভুত রসায়নটি কিভাবে ঘটে কবি নিজেও জানেননা। তারই খোঁজে কবিরা নিজেরাই নানা তত্ত্ব রচনায় আগ্রহী হন। কবির কাজ কবিতা রচনা করা ।তত্ত্ব রচনা পন্ডিতের কাজ। ঠিক যেমন কবিতা রচনা পন্ডিতের কাজ নয়। তবু কবিরা তাদের রচিত গদ্যে কবিতা ভাবনার কথা বলেন।সমর্থন ও বিরোধিতায় কবিতা চর্চার পরিবেশ মাঝেমাঝেই সরগরম হয়ে ওঠে।



কবিতা আন্দোলনও তো কম হলনা দেশে বিদেশে। এখনও তরুন কবিদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে নতুন অন্যরকম লেখার প্রবনতা।স্বাভাবিক ভাবেই গতানুগতিক জনপ্রিয় কবিতাধারার বাইরে গিয়ে তারা  নিন্দিত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কবিতা ভাবনার বাহকদের কাছে।

সতর দশকে প্রতিষ্ঠান নিয়ে খুব হইচই ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতা অনেকের মুখেই শোনা যেত। প্রাতিষ্ঠানিক কবিতাধারনা প্রচারিত হত সংবাদপত্র পরিচালিত পত্রিকাগুলি বেতার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। এই সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে  সিদ্ধান্তের একটা মিল ছিল। এরপরে এসেছে দূরদর্শন।সরকারও এখন সাহিত্য প্রসারে আগ্রহী। কবিতা একাডেমী তৈরী হয়েছে।একসময়  যারা এই এই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনার বাইরে ছিল,তারাই লিটল ম্যাগাজিন করত। আজ পটভূমি পাল্টেছে।এখন সবাই লিটল ম্যাগাজিন করে। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার কথা এখন আর কেউ বলেনা।

ষাট দশকের পরে বাংলা কবিতায় বিচ্ছিন্ন ভাবে চেষ্টা হলেও নাড়া দেওয়ার মত ইস্তেহার সহ কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।এখন একটা প্রবনতা দেখা যাচ্ছে,নতুন লিখতে আসা কবি কিছুদিন লিখেই একটি বিশেষ শিরোনামে একটি তত্ত্ব রচনা করলেন। তারপর ফেসবুক ইত্যাদির সহায়তায় ছড়িয়ে দিলেন চারিদিকে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তিনি যা বলছেন তা নতুন কিছু নয়।এই কথাগুলি আগেই নানা ভাবে বলা হয়েছিল।মনে হয় নিজের ভাবনা কে পরিস্কার করে নেওয়া এবং অন্যরকম লেখার বাসনায় এরকম হচ্ছে।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজ রাজনীতি সম্পর্ক বদলাচ্ছে। মানুষের অবস্থান বদলাচ্ছে মানবিক অনুভূতি বদলের সাথে সাথে। ভাষার পরিবর্তনও আমরা লক্ষ করি আমাদের কথাবার্তায় প্রকাশেও। মাঝে মাঝে এই বিতর্কও শুনি এই পরিবর্তন কতটা কাম্য। না চাইলেও এই বদলটা নতুন লিখতে আসা  কবির মানস জগতে যে আবহ তৈরী করে, তার প্রকাশ তো অন্যরকম না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। নতুন কবিরা নতুন ভাবে লিখছে। নিন্দিত হলেও হাল ছাড়ছেনা।নিজেদের মত করে পত্রিকা করছে। মনে হলে লেখার সাথে সাথে ফেসবুকে পোস্ট করছে। বাংলা কবিতায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে বলে মনে হয়।  নতুন সময়ের কবিকে বরণ করে নিতে পাঠককুলের কোনও দ্বিধা থাকবেনা আশা করি।
 

1 comment:

  1. কবি নিজেই যখন প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে আর সমস্ত প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে চাওয়াকে মনে প্রাণে প্রশ্রয় দেয় তখন যারা লিটল ম্যাগাজিন করতে চায় বা করছে তাদের কাছে যে সংকট তৈরী হয় তা মূলত কবি আর কবিদের দ্বারাই সৃষ্ট। একে হয়তো ধারা মুক্তি বলে দাবী করা হবে বা হচ্ছেও। গুনগান আর সংকীর্তনে ভরে থাকা এই আবহে সত্যিই কঠিন লিটল ম্যাগাজিন করা। কারণ সবটাই ভাল দিয়ে আর যাই হোক কোন পত্রিকার চরিত্র তৈরী হয় না। বিগত দিনের সাথে ভাষা আর ভাবনার কত ফারাক। যদিও মানুষ সবচাইতে বেশি পরিবর্তনশীল।কিন্তু কবিতা আর কবিতা করার যে নতুন আঙ্গিকের পক্ষে বলা হচ্ছে তা কতটা নতুন হয়ে উঠতে পারলো বা নতুন ভাবে বা কতটা নতুনের জন্য ভাবছি সেটাও পাশাপাশি ভেবে দেখা দরকার।একটা ওয়েব ই হোক আর ছাপার পত্রিকা হোক তার চরিত্রটাই আসল শুভঙ্কর। কার কার লেখা ছাপলে কতজনের লেখা ছাপলে সেটা কিন্রু মোটেও কোন উল্লেখযোগ্য অংশ না । যাক এই ভাবনার জয় হোক। কবি না কবিরর কবিতাই প্রতিষ্ঠা পাক। পাঠকই শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর হয়ে উঠুক।

    ReplyDelete