Wednesday, February 28, 2018

কমল সরকার



বিশ্ববিদ্যালয়কালীন কিছু অসেচনক মুহূর্ত

(১)

ল'মোড় থেকে সরে গেছে সুদর্শনদার চায়ের দোকান ,
... তার সাথে আরো কিছু ছোটখাটো স্টল ---
কেক-বিস্কুট , বিড়ি-সিগারেট , আলুকাবলি ও ফুচকার ।
এখন সন্ধের পর
মৃত হ্যালোজেন আলোয় দিনের চাকচিক্য ঢেকে
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ পড়ে থাকে ল'মোড় ।
...
অথচ এখানে একদিন
উৎসব লেগে যেত প্রতি সন্ধ্যায় ---
সুদর্শনদার চায়ের কাপের চুমুকে চুমুকে
দর্শনের ছেলেদের অন্তহীন অর্থহীন তর্কের ঝড় ,
'রানী ভবানী' ও 'পূর্ণেশ্বরী'র মাঝখান দিয়ে
হাইওয়ে উঠে গেছে যে গলিপথ
অমোঘ আনন্দধারা বিছিয়ে দিত সে পথে
বাংলা বিভাগের নবাগত ছেলেমেয়েদের
হাততালি ও গানের আসর ।

আর এইসব আপাতমুখর উৎসবমুহূর্ত হেলায় তুচ্ছ ক'রে
আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে হেঁটে যেতেন
রসায়নের দীর্ঘদেহী গুরুগম্ভীর প্রফেসর ।

এখন সান্ধ্যভ্রমণকালে দেখি
নির্জন গলিপথে পড়ে থাকা হলুদ পাতারা শুধু
আবছায়া আলো গায়ে মেখে নিয়ে
মৃদু হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠে অনুঃস্বর ।

আমি হেঁটে এসে দাঁড়াই মাগুরমাড়ির ব্রীজে,
বিদ্যাসাগর মঞ্চের পাশের মন্দির থেকে
কীর্তনিয়া সুর ভেসে আসে ,
আসে অদূরের শালবনের পাতার মর্মর ।
আর তখনই কানের কাছে কে যেন হঠাৎ বলে ওঠে ---
"এই যে ! কেমন আছো ? কী খবর ? "


বিশ্ববিদ্যালয়কালীন কিছু অসেচনক মুহূর্ত
(২)
বস্তুত ওভাবে কেউ ডাকে না আমায় ।
কেউ ডাকেওনি কোনদিন ।
আমি শিবমন্দির থেকে ল'মোড় ভায়া
... আপাত-উদ্‌ভ্রান্ত একলা হেঁটে যাই
'সি পি এম' মোড় হয়ে রসায়ন বিভাগের পথ ।

এখানে এসে স্থানীয় নিরাপত্তার খাতিরে
জোড়া জুটিয়ে নিয়েছে যারা
তারা তো চক্ষুহীন তখন !
আর সদ্য খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে
যেসব প্রজাপতি-তরুণীর দল
ওরা আচমকা-পেয়ে-যাওয়া ফুরফুরে ডানায়
নির্ভার স্বপ্নের উড়ানে বিভোর ।

আমি একা একা হাঁটি ।
হাঁটি আর দেখি
এইসব শিশুসুলভ তরল তরুণীরা
চিরাচরিত ঘরোয়া শাসন বেমালুম ভুলে গিয়ে
কী অনাবিল পুলকে
নিজেদের চোখেমুখে মেখে নিচ্ছে অযুত আকাশ ,
বহু ...... বহু দিনের পর ।।


বিশ্ববিদ্যালয়কালীন কিছু অসেচনক মুহূর্ত
(৩)
আর.কে. হোস্টেলের ছাদে উঠে উত্তরে তাকাতেই
দু’চোখে অপার বিস্ময় ---
আলোর দীপমালা জ্বেলে শুয়ে আছে
... দূরবর্তী পাহাড় ।
অতি নীরস যে ছেলেও চাঁদ দেখেনি কোনদিন ,
কখনো ঘাসের শিশিরে ডোবায়নি পা
কিংবা ঝড়ের দিকে বুক চিতিয়ে
দাঁড়ায়নি একপল ,
এমন অবর্ণনীয় নিসর্গ দেখে সেও
চিৎকার ক’রে ওঠে , ‘স্বাগতা ! আই লাভ্‌ ...’
ইউ-টার্ন নিয়ে রুমে চলে আসে আমাদের কালীচরণ ।
দেয়ালে টাঙানো স্বাগতার ছবি ,
তাতে বাসি ফুলের মালা ,
সামনে জ্বলে ধুপকাটি ক’টা
আর আমাদের এক মিনিটের নীরবতা পালন :
অমর রহে কালীচরণের প্রেম ।
অতঃপর সব ভুলে শুধুই অধ্যয়ন ।

দৃশ্যতঃ অসম্ভভ অধরা
বিজ্ঞান বিভাগের মেয়েরা সব ---
ওদের জীবনে গান নেই , কবিতা নেই ,
প্রেম নেই , আনন্দ নেই ,
ফলতঃ নেই জীবনের প্রতিফলন ।
শুধু মাটির ব্যবধানে পা ফেলে চলা
এক অদ্ভুৎ জীবনচেতনা
যেন তারা উদ্‌জান-বেলুনে চড়ে
দেখে ফেলেছে দূরবর্তী আকাশে
কাঙ্ক্ষিত স্বর্গের ঠিকানা ।


বিশ্ববিদ্যালয়কালীন কিছু অসেচনক মুহূর্ত

(৪)
অ্যানুয়াল সোসালে রঙিন প্রজাপতি-ডানা মেলে ধরত
কলা বিভাগের মেয়েরা ।
... গান , কবিতা ও নাচের অনুষ্ঠানের বিচারক শুধু
অর্থনীতির অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ।
ফলতঃ সব পুরস্কার চলে যায়
একটিই বিভাগের নামে
ঈর্ষনীয় পক্ষপাতিত্বে ।

অনুপম সুললিত কন্ঠে কবিতা শুনিয়েও
বিজয়িনী নয়
দর্শনের সোমা দত্ত ।
তবু দেখি তার চোখের কোণে
অদ্ভুৎ খুশির ঝিলিক ,
অবাধ্য ওড়নায় সে বেঁধে নেয়
দর্শকাসন থেকে ছুঁড়ে দেওয়া তার প্রেমিকের
একান্ত করতালি ।

খুব জানতে ইচ্ছে করে
আজ এতগুলো বছর পরে
কেমন আছে সোমা দত্তরা সব !
ওদের কন্ঠে এখনো কি কবিতা আসে
সময়ে বা অসময়ে ?
এখনো কি হাতে পেন্সিল নিয়ে বসে থাকে
কোন জাজ-দিদিমণি
ইচ্ছাকৃত ওদের হারিয়ে দেবে বলে ?
থাকে কি কোন দর্শকাসন
আর সেখানে বসে ওদের অনিন্দ্য প্রেমিকপ্রবর
একান্ত করতালি দিয়ে
ওদের স্বীকৃতি দেবে বলে ?

খুব জানতে ইচ্ছে করে
আজ এতগুলো বছর পরে
সোমা দত্তরা কোথায় কী করে ।।


বিশ্ববিদ্যালয়কালীন কিছু অসেচনক মুহূর্ত

(৫)     ( সমাপ্তক )
সন্ধে নামতেই ভ’রে উঠতো
পি.জি. ক্যান্টিনের গাছতলা ,
... গেস্ট হাউসের কাছের বিশ্রামাগার ,
সংসদ কক্ষের পেছনের বারান্দা
এবং আরো যেসব অলিগলি কোণাকাণার থেকে
মুখ ফিরিয়ে রাখতো
সোডিয়াম ভেপারের হলুদ আলো ।
পরস্পর ছুঁয়ে থাকা সেই সব যুগল
আবছা আলোয় আবছা অন্ধকারে
অনন্ত দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাক
যেন কোন স্বর্গীয় ভাস্কর
অনুপম শৈলীতে গড়ে তুলেছে
এ যুগের পরিশীলিত খাজুরাহো ।

এখন সন্ধে নামলে
সেইসব স্বর্গীয় উদ্যানে
ঘুরে বেড়ায় পুলিশের পেট্রল ভ্যান ।
তবু , প্রেম কি ঠেকানো যায় কোনভাবে ?
নাকি গেছে কোনকালে ?
সেইসব উদ্বাস্তু যুগল খুঁজে নেয় ঠিক
নিজেদের নতুন ঠিকানা ,
গড়ে তোলে নিজেদের স্বর্গ
অন্য কোনখানে
যেমন এখন দেখি
স্ট্যাট ব্যাঙ্কের আলোহীন নির্জন গলি
ভরে ওঠে অন্ধকারে , জোনাকিতে
আর সারি সারি দাঁড়ানো যুগলবন্দীতে ।

...............................................................................

No comments:

Post a Comment