Monday, February 26, 2018

আত্মস্বর কিছুতেই চাপা থাকছে না / প্রদীপ চক্রবর্তী
.....................................................................



প্রথম পর্ব

................
শব্দমালা / এক
..................
কবিতার বই - এম এন নাইনটিন
কবি - প্রীতি আচার্য
প্রকাশক - পাখিরা
মূল্য - 25 টাকা
প্রথম প্রকাশ - পৌষ , 1424
...................................................................

প্রথমাংশ /
প্রচ্ছদ প্রকরণে নামটা দেখে প্রথমে একটু সংশয় হয় |ভাবতে থাকি এই কবিতা বইয়ের ভেতরে কি আধুনিক কোনো মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্রের 
প্রচ্ছন্ন স্বরলিপি আছে ? ..., কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙে | বোঝা যায় , সভ্যতার অনন্ত আকাশের নিচে মানুষের ডেস্টিনেশন অর্থাৎ , ঠিকানা লেখা একটা ঘরের মেটাফোর ..., একটা ঠিকানা লেখা নি্তরঙ্গ অথচ গভীরে ঢেউ ওঠা আপতিক ঔদাস্যের আড়াল ,জীবন আসক্ত সম্পর্কের ,রূপান্তরগুলো ,কি ভাবে কখন যেন ব্যক্তিকে অতিক্রম করে যায় | অনেকের ' আমি '
গুলো হয়ে ওঠে দিনানুপাতের সংঘাতে , কখনো বা ৈব দুর্বিপাকের প্রারব্ধ অতিক্রম করা , সমূহ শক্তি বা নারীর আজ কাল পরশুর গল্প |, কিন্তু সেটা নিছক নয় কখনোই |বৈরাগ্য আর আসক্তি র যুগ্ম বিপরীতে দাঁড়িয়ে সৌদর্যের একটা অক্ষয় বিকাশ টেনে নিয়ে যায় , মনের শেষ সীমা পর্যন্ত | আমরা অনুভব করে থাকি , আমাদের ছোট ছোট বেঁচে থাকার মুহূর্ত , ক্ষণ, আমাদের বিষাদ , আমাদের মৃত্যু বোধ ও চরম নিঃসঙ্গ অবস্থায় যখন আমরা অনিশ্চিত আর আলোকিত অন্ধকারের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে ভাবি , আপন মুদ্রাদোষে আমরা কেবল হতেছি একেলা .... তখনো যেন আমাদের নাড়া দিয়ে যায় , এই এক জীবনের সমূহ সম্পর্ক গুলো কি আসলে নিছক মিথ ? না কেবল চলাচলের পথে , এক একটা অভিজ্ঞতা , এক জীবনে অনেক জন্মান্তর ?...কি এবং কেন ,র প্রশ্ন নিয়েই মানুষ ছুটে চলেছে , সভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক আদিম পৃথিবীর প্রথম ভোর থেকে ,আজ পর্যন্ত .....সেই চর্যাপদের ,আপনা মাংসে হরিণা বৈরী ,সেই রূপলুব্ধ শিকারের ব্যবহৃত অংশবিশেষ হয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ,সমাজ ও রাষ্ট্রকে , নারী কি কেবল ই , পণ্য ? সে কি কারোর প্রত্যাশায় পৃথিবীতে বেঁচে থাকে ? সে কি আসলে মানুষ হয়েও , মানুষের তৈরী সোনার খাঁচার ফাঁদে আটকানো পাখির সমস্তটা ? সামাজিক ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রশ্নে , একসময় ভোলগা থেকে গঙ্গার বিস্তৃত ক্ষেত্রে , নারীগঠিত ,মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কি ভাবে পুরুষের নিয়ন্ত্রিত সমাজে কুক্ষিগত হয়ে গেলো , এবং তার ব্যথিতপ্রতিবাদ , যে বাল্যে পিতার , যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের সম্পদ ...সেই প্রথা কি আজ ও অধুনান্তিক বা উত্তরাধুনিক বাস্তবতায় , এই উপমহাদেশে বারংবার প্রমাণিত নয় ,অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রে .... ? এই অনেক প্রশ্ন উঠে আসে , যখন আমরা  প্রীতি আচার্যের এই নতুন বই টি পড়তে থাকি .....



দ্বিতীয় ভাগ /

শূন্যদশকের কবি প্রীতি | তার প্রথম কবিতার বই , ইউরেনাসের  মেয়ে | যদিও ছড়ার বই , ছড়ায় ছড়ায় আকাশ ভরা , বইটির মাধ্যমে তার আত্মপ্রকাশ |কিন্তু , নিছক ছন্দ মকশো করা তার ছড়ার প্রতীতি বদলে গেলো অচিরেই | তার প্রস্তুতি ভেতরে ভেতরে চলছিল অনেক দিন ধরেই | ' আরোহণ ', নামক ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে তার প্রথম কবিতার প্রকাশ |
আমাদের পশ্চিম বঙ্গে আত্মশ্লাঘায় ভরপুর বাঙালি কবিরা তাদের কাব্যচর্চায় এমন ই মগ্ন থাকেন , যে তার প্রতিবেশী রাজ্য বা রাষ্ট্রের কবিতা বা সাহিত্যচর্চা নিয়ে তাদের উদাসীনতা বা উপেক্ষার চিত্র সর্বজনবিদিত | অথচ , ত্রিপুরার বা বাংলাদেশের যে কোনো  তরুণ কবিকে জিজ্ঞাসা করুন , দেখবেন , এই বাংলার সাম্প্রতিক কবিতা চর্চার পরম্পরা থেকে হালহকিকত পর্যন্ত তাদের জানা |আর আমরা ...! থাক...., প্রীতি,র কাব্যচর্চার সূত্রপাত ও বিস্তার ত্রিপুরায় হলেও ,সম্প্রতি তিনি কলকাতাবাসী |
ওপরের এই নিছক তথ্য গুলো দেবার পর , আমরা দেখে নেবো প্রীতির সম্প্রতি বইটি ,কেন পাঠকের ভাবনাকে নাড়া দিয়ে যাবে ,তার কারণ গুলো .....
এক/, প্রীতির কাব্য দর্শনের মূলে আছে সহজিয়া ভাব ও ভাবনার প্রকাশ |, তার ভাষার আপতিক গঠন প্রণালী , বর্তমানে বহুরৈখিক নিরীক্ষামূলক শাব্দিক উপাচারে সজ্জিত নয় | নয় কখনোই , কৃত্রিম ভাষাচলে ,রুদ্ধ | তার ভাবনা , ভাবের শৈলীতে হয়ে উঠেছে গভীর |, সে চর্চা করছে যতদিন ,তার তুলনায় তার প্রচার ও প্রকাশের ব্যাকুলতা অনেক কম | কিন্তু তার প্রকাশিত মুষ্টিমেয় কবিতা ,ও কয়েকটি মাত্র বইতেই পেয়েযাই আমরা ,এমন একজন ভাবুক কে , যিনি অনায়াসে জীবন কেন্দ্রিক আধুনিক নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে , সম্পর্কের সমস্ত সত্য , মিথ্যা , আলো অন্ধকার ভালোবাসা ঘৃণা রৌদ্র বৃষ্টি যাবতীয় নারীর গভীর যন্ত্রণা চাওয়া পাওয়া এবং ক্ষণ ভঙ্গুর অথচ গহন ঠুনকো মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্ব , উৎস , এবং সচল সক্রিয় বাস্তবতাকে এক ঝটকায় দেখিয়ে দেন , সাবলীল কিছু শব্দের সাহায্যে | ছোট ছোট চিত্র কখনো ,দূর সুদূর নীহারিকার  মতো পরাবাস্তবতার ক্ষণ চিত্র এঁকে...|
দ্বিতীয় /
প্রীতি ,অনায়াসে লিখে ফেলে এরম কিছু পংক্তি , তার নতুন কবিতার বই , এম এন নাইনটিন ,এ ...
1) রেলিং নেই তিনতলার এইছাদে / মাঝে মাঝে ছাদে র কিনারে গিয়ে দাঁড়াই আমরা / চাঁদ ওঠে ছাদ আলো করে |/ এক হিম হাওয়া এসে বলে , চলে এসো| / আমাদের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে / আমরা এগিয়ে যেতে থাকি ...(সম্পর্ক )
2/  ওরা আসে / দরজা খোলে / আলো নেভায় / গোলাপ কঁকিয়ে ওঠে / বাতাসে লালার গন্ধ / ওরা একে একে চলে যায় ( দরজা )
3/ এই শহর / যেখানে ঘুরে বেড়ায় / মৃত মানুষেরা / তাদের হাড় দিয়ে / কারা আজ সাজিয়েছে / নগরের নাভিকুন্ড  / এখানে কোনো বোধিবৃক্ষ নেই / নেই প্যাপিরাসে সাজানো সবুজ অক্ষর / আছে ঘুঘুজন / যাদের মৃত্যু মহান , বেঁচে থাকাও মহান
4/ তোমার পায়ে হেঁটে যাওয়া / লোকটা তুমি নও / সে তোমার সন্দেহ কিংবা / সন্দেহাতীত এক গমন / যে নিজেও তার গন্তব্য জানে না ( পুরুষ)
5/ সেদিন আমার সকল ইন্দ্রিয়কে / আফিম দিয়ে আচ্ছন্ন করা হয়েছিলো / পায়ের আলতায় ছিলো শেষ গমনের ছাপ / কপালে লেপ্টানো সিঁদুর / আমাকে মহা সতীর উপমায় ডেকে আগুন চেনালো / আগুন আমার পা স্পর্শ করার আগে / শরীর থেকে / পুরুষ মন্ত্র গুলো মুছে দিয়ে বললো , / এবার তুমি মুক্ত হও নারী .... ( মুক্তি যজ্ঞ )

তৃতীয়/
প্রীতির কবিতা কি তথা কথিত নারী বাদী কবিতা ? নিছক নারী বাদী ?... মনে হয় না | কখনো ,বিপ্রতীপ সাজের মুখোশ আর মুখের মুখর দ্বন্দ্বে , নারীতে নারীতে যে আত্মীয়তা তাতেই তার নিস্পৃহ উদাসীন রূপ বা বাস্তবের অতীত প্রতিবিম্বন ও ভবিষ্যের এক প্রবাহিত আভাস আমাদের ভাবিয়ে তোলে |
 বিপন্ন ক্ষয়ের অন্তর্জলী যাত্রায় একাকার হয়ে যায় | প্রীতি ,কখনোই পুরুষ বিদ্বেষী নয় | তার কাছে পুরুষ ও প্রকৃতি বিপরীতের মিলন বিন্দু তে স্থির ও বিস্তৃত কনীনিকা .... যা নিছক নগ্নতাকে নিরঞ্জনতা দেয় , ক্লেদাক্তকেও ঋজুতা দেয় , কিন্তু সে কখনোই , ঠুনকো পুরুষ নির্দেশিত নিয়মের নিগড় কে তোয়াক্কা করে না |,
 সে বোঝে আপন অন্তরের স্ফূর্ত আবাহন , কখনো যা আরোপিত নয় |, যা বাধ্য করে ,জোর করে , তাই সংস্কার .... প্রীতির আপত্তি ,তাতেই | তার কবিতা তাই নিছক বিলাসিতা নয় , তা সম্পর্কের গভীর অতলে গিয়ে প্রশ্ন করে , আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় সত্য ও আপতিক সত্যের মুখ ও মুখোশের দ্বন্দ্বে ....|, আর সেখানেই তার সহজ ভাষায় গভীরে প্রবেশের ছাড় পত্র ....|
উৎকৃষ্ট কবিতা অভিজ্ঞতা ও মনের পরিণতির 
অপেক্ষা রাখে |, তার জন্য চাই , মননে নির্জন পথের সাধনা | আর যার লেখার সঙ্গে তার অস্মিতা , মুক্তি , ও অস্ত্বিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে , তাকে দুনিয়াদারির প্যাঁচে ফেলা যায় না | তার খোলা চোখের দেখায় তুচ্ছ ও সম্পন্ন ,ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ভেদাভেদ শূন্য হয়ে একটি অখণ্ড অবিভাজ্য রূপ নেয় | প্রীতি, সম্পর্ক ও চলাচল 
কে , জীবনের সাদা কালোর দ্বন্দ্ব- পারমিতাকে দেখেছে তার ভাবনা ও অভিজ্ঞতার গভীরে গিয়ে |, তার ভাষা পেয়েছে , তার ভাবনা শৈলীর নিজস্ব রূপ |
প্রীতি, আরো লিখুক | আরো বিস্তৃত পথের যাত্রায় , তার প্রজ্ঞা তার জগতের স্বরূপদীপ্তিতে অলংকৃত আগুনের তীর হয়ে উঠুক ,লক্ষ্যভেদে...
এটুকুই......

কবির কয়েকটি কবিতা :





1 comment:

  1. সুন্দর ও নিখুঁৎ আলোচনায় শূন্যদশকের কবি প্রীতি আচার্য কে তুলে ধরেছ পাঠকের চোখে ও মনে।
    খুব পরিপাটি লেখাটি। ভালো লাগলো প্রদীপ।
    নীতা বিশ্বাস।

    ReplyDelete