Tuesday, February 27, 2018

ব য়া তি বৃ ত্তা ন্ত
সুবীর সরকার


‘আরো দিয়া যায় পীরীতির বায়না’...
১।
হাটের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে ফাগুন চোতের রোদ হাওয়া অতিক্রম করতে করতে রতিকান্তকে কখন কিভাবে যেন মহামহিম এক হাটখন্ডই হয়ে উঠতে হয়! হাট থেকে হাটের দিকে যেতে যেতে সে তার ঢোল,ঢোলের কাঠি সমেত কত কত খেতপাথারবাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে। অনুপ্রবেশের হালহকিকত থেকে নতুন ধানের চিড়া খইএর সুঘ্রাণ তাকে আমোদিত করলে রতিকান্ত ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে কিন্তু মগজের কোষে কোষে গান ঘুম আর স্বপ্ন নিয়ে সে অনুপ্রবেশের চিরকালীনতাকে হাটগঞ্জের বাতাসেই যেন উড়িয়ে দিতে চায়।
২।
জীবনের উজানে কি যাওয়া হয় মানুষের!জন্ম জন্ম ধরে জন্মান্তরের পাকে পাকে ভাটির দিকে এগিয়ে যাওয়াই যেন গাঁথা হয়ে যায়।রতিকান্ত বয়াতি ঢোল বাজাতে বাজাতে মাথাভরতি বাবড়ি চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কখন বুঝি চলেই যায় হাওড় বাওড় বাওকুমটা বাতাসের নৈরাজ্যের ভিতর। তার কাঠিঢোল নিয়ে সে জীবনভর যেতেই থাকে সোনাপুর মথুরা নিমতি তপসিখাতা বঞ্চুকুমারী দেওডাঙ্গা শালকুমারের হাটে হাটে। ধুলোর ঘূর্ণী তাকে ঢেকে ফেললেও সে কবেকার যেন বংশপরম্পরাসূত্রেই ভীষণভাবে ঢোল দোতরা আর নাচগান নিয়ে হাটের ভিতর চলে আসে;চলেই আসতে হয় তাকে। বুঝি রতিকান্ত বয়াতি ছাড়া,বয়াতির ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি বিনা হাট শেষাবধি কিছুতেই হাট হয়ে উঠতেই পারে না! রতিকান্তের গান,নাচের বিবিধ মুদ্রা,কাঠি ঢোল দীনদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে নদীজঙ্গলজনপদের ফাঁকে ফাঁকে অনবরত হাটখন্ডগুলি পাশ ফিরতেই থাকে।
৩।
ভাঙা হাটের হাটফিরতি মানুষের চোখেমুখে চলন বিচলনের ভিতর আকুলতা বিকুলতা থাকে বুঝি! তেমনভাবে রতিকান্তের কথা কেউ না জানলেও রতিকান্তের বয়াতি হয়ে ওঠার গল্পগাথাটুকরোগুলি হাটের পরতে পরতে আঠার মত আটকে থাকে। রতিকান্তর গুরু ঝাম্পুরা, কিংবা তারও গুরু নালচান সব যেন আইলে আইলে হাটতে থাকে। হোঁচট খায় আইল কাশিয়ার থোপে থোপে। সবজিহাটার পথে কুঁপির আলোয় চতুর শেয়ালের চোখের ভিতর আগিলা দিনের গান বাজে। বাজতেই থাকে। যেভাবে ঢোলের লোকজতা নিয়ে সর্বশরীরে বিষাদ মেখে নেয় রতিকান্ত বয়াতি। বাতাসের খুব নিকটে কান পাতলেই পাখিদের ডাক,পাতা খসে পড়া; আর সব ছাপিয়ে হু হু হাহাকার হয়ে বেজে ওঠা গান,
     ‘ও মুই কং তোমার আগে
     ও মোর কইতে শরম নাগে
     সগায় যাছে মেলা দেখিবার
     মোক না নিগান কেনে’


৪।
গান বলি নাচ বলি কালখণ্ড বলি সবেরই ভিতর যাপিত জীবনের প্রবহমানতা গল্পের পর গল্প জুড়ে যেন ঘাসের স্তূপ বেরিয়ে আসা বাঘেরা বুঝি জল খেতে চলে আসে দিনকাল ভুলতে বসা হাটবাজারের ভিতর! এতসব ঘটে,ঘটেই চলে; রতিকান্ত বয়াতির বিশ্বাসযোগ্য কোন বৃত্তান্ত রচিত হয় না। গান শুরু হয় নাচ শুরু হয়। বাদল মেঘের নিচে রতিকান্ত দাঁড়িয়ে থাকে। রতিকান্তর কোন বৃত্তান্ত রচিত হয় না। বরং রতিকান্তই নতুন নতুন সব বৃত্তান্তের জন্ম দিতে থাকে জলহাওয়াজনপদের ভিতর।
৫।

সে তো ৫০/৭০ বছর আগেকার কোন পৃথিবী। কালখণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা টুকরোগুলিকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই বুঝি গায়ত্রী সিং জলঢাকার চর পেরোতে পেরোতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে মধ্য শীতের রোদমায়ায় অসম্ভব এক পুলক জাগে। মাথায় শোলার টুপি। হাতে দোনলা বন্দুক। গোঁসাইহাট ফরেস্ট থেকে শিকারফেরত গায়ত্রী, হীরা সিং-এর কাঁধে হাত রাখলেই বিশাল প্রান্তর যেন ডেকে নিতে থাকে গিলাডাঙ্গা এস্টেটের ভিতর। গায়ত্রী তার অন্যমনস্কতাকেও অগ্রাহ্য করে;গভীর কোনো গান ভেসে আসতে থাকে,

‘হামার দেশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়

ফান্দত পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে রে রূপা রায়’

গানের ভিতর কেমন এক যাদু থাকে।মায়া থাকে। গান ছড়িয়ে পড়ে গানে গানে ভরে ওঠে টাড়িবাড়িখেতখামারবৃক্ষনদী। অন্যমনস্কতা থেকে ফিরে আসবার মরীয়া প্রয়াস গায়ত্রীর। পৃথিবীর ভিতর পুরাণসকল ঢুকে পড়তে থাকলে পুরাতন পৃথিবীর পটভূমির ভিতর এসে জড়ো হতে থাকে রাজার হাতি,শিকারজুলুস কিম্বা গায়ত্রী সিংএর জোতজমি।
৬।

গায়ত্রীর চোখের তারায় তারায় আন্ধার আতির জোনাই জ্বলে ওঠে। অতীতময়তায় দিন কাটে তার। কোথাও চলে যাওয়া ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি আর ফিরিয়ে আনতে পারে না সে। চলমানতা দিয়েই তো তার দীর্ঘ যাপন,যা তাকে স্মৃতিকাতরতার দিকে ঠেলে দিলে তার কিছুই করার থাকে না আর। জলঢাকার তরমুজবাগিচায় কুয়াশাশিশিরের কুহকে শেয়ালেরা ডেকে ওঠে। বিভ্রমে ঢুকে পড়তে পড়তে গায়ত্রী আবার বুঝি জাগিয়ে তোলে,পুনরুদ্ধার করে গিলাডাঙ্গা এস্টেট। হেমন্তের ফসলবোঝাই মহিষের গাড়ি। বিষাদু মইষালের বাওকুমটা বাতাসের গান। কোথাও বুঝি চলে যেতে হয় মানুষকে! পুরাতন পৃথিবীর ভিতর দীর্ঘনিঃশ্বাসেরা ঘনবদ্ধ হয়। জিপগাড়ির ভাঙা পাদানীতে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে হীরা সিং। সময় অতিক্রম করতে গিয়ে বুঝি একপর্বে গায়ত্রী সময়াতীতের ধারাবাহিকতাতেই আটকে পড়ে!

৭।

আঞ্চলত মুছিনুং হয় তোর

সোনা মুখের ঘাম...


নয়ারহাটের জমজমাটির ভিতর দাঁড়িয়ে আমাকে শুনতে হয়েছিল গায়ত্রী সিং-এর গল্প। ২৫ বর্গমাইল বিস্তৃতির পূর্বতন গিলাডাঙ্গা এস্টেটের পুরনো নতুন সব মানুষের কাছেই যিনি মিথের মত। মিথ ভেঙে দিয়ে তৈরী হওয়া নতুনতর মিথের জালকে আটকে গিয়েও নিজেকে স্মরণযোগ্য করে রাখবার প্রয়াসটুকুন তাকে চলমানতা দিতে না পারলেও;সে কিন্তু মাথায় শোলার টুপি হাতে বন্দুক সহ আদ্যন্ত এক গায়ত্রী সিং হয়েই যেন উঠে আসছেন জলঢাকার পুরাতন চরের খুব খুব গভীর থেকেই।

No comments:

Post a Comment