Tuesday, February 27, 2018

অপরাহ্ণ সুসমিতো’র দুটো কবিতা

ক. শুরু বলে কিছু নেই

কাল সারা সন্ধ্যা আপনার অপেক্ষায় ছিলাম আমি চাতক তৃষ্ণার ঠোঁটে । আপনি এলেন না,ফোন করলেন না । আমি ফোনে ট্যাঙ্গোর দিকে লাল হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ।

অপেক্ষার রাজকন্যা হয়ে একাকী গান গাইছিলাম তোমার বাস কোথা যে পথিক..

আপনি ভালো লেখেন জানি । বৃষ্টি নিয়ে আপনার লেখা পড়লে মনে হয় কাগজের পাতায়,চোখের পাতায় বৃষ্টির নূপুর নামছে । সেদিন আপনার লেখায় সকালের নাস্তার বর্ণনা পড়ছিলাম,আশ্চর্য এতো সুনিপুণ করে বর্ণনা যে প্রতিটা লাইন যেন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম মুচমুচে পরোটা,সামনের বাটিতে সদ্য রান্না ভুনা মাংস,ধোঁয়া উড়ছে পতাকার মতো,আরেক পাশের পিরিচে দুটো লাজ লজ্জাহীন গুলটু টুবলু রসগোল্লা ।

রান্না ঘরে চায়ের কাপে পিয়ানোর শব্দের মতো টুংটাং আওয়াজ । চা হচ্ছে...

আপনি এতো নিখুঁত বর্ণনা করেন যে আপনার লেখা পড়লেই আমার খিদে পায় । এমনিতে আমার খাবার দাবার রুচিতে চৈত্র খরা,খিদে পায় না । মা বাবা যেমন ছোট বাচ্চাদের খাবার সময় কতো কি বাহানা করে,টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দেয়,বাবাগো,মাগো,সোনারে,যাদুরে কতো কি বলে । আমারও তেমনি । খাবার সময় আপনার সেই যাদুকরী লেখাটা পড়তে শুরু করি । সামন্ত প্রভুর মতো খিদে এসে হানা দেয়,খেতে শুরু করি ।

একবার আপনার লেখায় নায়িকাটা ডলসি গাবানা চশমা পরে উবু হয়ে সম্পাদককে টেক্সট করে । আমি কতো দিন টিভির একদম সামনে চোখ বড় বড় করে বসে থেকেছি যাতে আমার চোখ খারাপ হয়,যেন আমি ওরকম ঝকঝকে চশমা পরি । ঘোড়াড্ডিম আমার চোখ একদম ৬/৬....

এই কথার যাদুকর,লেখার যাদুকর শোনেন না,সেদিন এক সম্পাদককে আপনার লেখার প্রশংসা করাতে সম্পাদক সাহারা খাতুন ম্যাডামের মতো মুখ গোমড়া করে রইলেন । আশ্চর্য ব্যাটা ছেলেরা এরকম ঈর্ষাক্রান্ত হয় !

এবারে কোথায় কোথায় আপনি লিখছেন বলুন তো ? আমি সবগুলো সংখ্যা কিনব উথাল ।

গত মাসে অফিসের কাজে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলাম । তীব্র গরম । একটা পুরোনো চায়ের স্টল দেখে চা খেতে ইচ্ছা করল । চায়ের স্টলে আচানক চোখ পড়ে একটা কিশোর ছেলের দিকে,গভীর যত্নে চায়ে পাউরুটি ডুবিয়ে খাচ্ছে । আমার চট করে আপনার ‘শালিক যখন হলুদ ঠোঁটে সুষমা খায়’ গল্পটার কথা মনে পড়ল । আমিও চা পাউরুটি অর্ডার করলাম । এতো গরমে,ভিড়ে সেই কাজল কিশোরের মতো আমিও চায়ে পাউরুটি ডুবিয়ে খেতে শুরু করলাম ।

পাউরুটিতে চা ভিজে গেলে কী যে নরম আর পেলব হয়,টুপ করে গিলে ফেললেই হয় । আহ অমৃত । মুখে চায়ের ঘন দুধের স্বাদ লেগে রইল ।

কাল খবরের কাগজে পড়লাম,আপনার স্ত্রী দিনাজপুরে বেড়াতে যেয়ে একটা হোটেলে উঠে আত্মহত্যা করেছে । পুলিশ চিরকুট থেকে সব জানতে পেরেছে । আপনার স্ত্রী নামী অভিনেত্রী ছিলেন । কী চমৎকার তার ক্যারিয়ার ! সমস্ত বাংলাদেশ আপনাদের জুটির কতো প্রশংসা করত,মানিকজোড় আপনারা ।

এক সময় আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করত,লেখার সময় আপনার মুখ,আপনার চোখ কেমন হয়,জানতে ইচ্ছা করত খুব । এখন আর দেখতে ইচ্ছা করছে না । অদেখাই থাক সব । কতো কী অদেখা থাকে এক জীবনে !

নিয়ম করেই হয়তো আবার রোদ পড়বে হাঁসের ডানায়,নদী ঘাটে একাকী মাঝি বিমর্ষ বসে থাকবে আসন্ন ঝড় উপেক্ষা করে । ধারালো শাবলের মতো বিক্রম ঢেউ হানা দেবে অভয়মিত্রের ঘাটে । ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা আমার মালবিকা বোন গান করবে চোখের জলে

তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়...

চোখের জল আড়াল করব আমিও ভেসে আসা গানের মুকুলে,টেবিলের উপর ধুলো পড়বে আপনার বইয়ের ধূসর মলাটে । আমার না-দেখা আপনি হয়তো শূন্য ছবির হাট ঘুরে আসবেন চোখের কোণায় ঈগলের পায়ের ছাপের মতো বেড়ে যাওয়া একেকটি বয়সী দিনের মতো,নিশির মতো ।

হয়তো মানিকগঞ্জে আবারও যাব রোদ রঙ শাড়ি পরে । সেই কাজল কিশোর বা আপনাকে আর দেখব না ।


খ. সমাপ্তি বলেও কিছু নেই

আমার মৃত্যু সংবাদ লিখছি । খটাখট টাইপ করছি । নামের বানান লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় অপরাহ্ন লিখে ফেলছি যেমন অধিকাংশ বন্ধুজন লেখেন । আবার টাইপ করতে গিয়ে নিজের কাছেই দ্বন্দ্ব হচ্ছে । কম্পিউটারে বানান ভুলে সমস্যা নেই,মুহূর্তে ঠিক করতে পারছি ।

অগ্রিম দেখতে পাচ্ছি নূরজাহান চক্রবর্তী লাইক দিচ্ছেন । জাহ্নবী মাসী সংক্ষেপে আরআইপি লিখছেন । যে সূচালু আহমেদের কাছে ১৪৩০০ টাকা পেতাম,তিনি সবচেয়ে বড় কমেন্ট লিখছেন বিনিয়ে ইনিয়ে । মধু ভাই এখনো জানেন না । উনি প্রতি মাসের ২৮ তারিখ বেতন পান,সেদিন ফেসবুকে লগইন করেন । উনি খুব কষ্ট পাবেন ভাবতেই একটা কষ্ট কাবেরী নদীর মতো তিরতির করল বুকের হিমালয় পাদদেশে ।

আমি যে মন্ত্রণালয়ে কাজ করি,সেখানে বেশুমার ঘুষ । সহকর্মীরা চটজলদি চাঁদা দিতে শুরু করেন স্মরণ সভার । ঘুষখোর লোকজন খুব উদার হয় এরকম দান খয়রাতে । বেতনের টাকায় গয়া কাশী যায়,হজ্ব করে আর ঘুষের টাকায় বউকে বাদামী ব্রা কিনে দেয় । ফেসিয়াল করে,এবেনটি বায়স্কোপ করে ।

আমার ড: যে হাসপাতালে কাজ করেন সেখানে ৮০% কর্মকর্তা কর্মচারী পরষ্পর প্রেম করেন । ড: আমার ডেথ সার্টিফিকেট খসখস লিখতে লিখতে খিকখিক হাসেন ;

: প্রেমের আবার প্রথম শেষ কি?

সামরান হুদা মাথা নিচু করে গল্প লিখছেন পাতার পর পাতা । মনটা রাজশাহী আমের মতো টুপলু হয়ে আছে; আহা সামরানের লেখা আর পড়বো না । মৃত্যুর পরেও আমার ইমেইল একই পাসওয়ার্ড থাকবে । খনাকে কি পাসওয়ার্ড দিয়ে যাব ? সে আমার হয়ে জবাব দিবে ।

খনা ছলছল কাঁদতে কাঁদতে বলবে;
: এই আমি মানস কন্যা,কতো মানুষ স্বপ্নে নদীর ছবি আঁকে । তুমি এঁকেছিলে ছায়ায় ছায়ায় আমাকে । দাও রক্ত দাও এক প্রভু জীবন ।

হাঁটতে হাঁটতে পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম,বাসার চাবির রিং,ফোনে অণু টেক্সট । তুমি ঘরে ফিরছো । কচুর লতি দিয়ে হাপুস হুপুস ভাত খাচ্ছো । খাবার সময় কাউকে সুন্দর লাগে না কেবল ছোট দুধের শিশু ছাড়া ।

মৃত্তিকা নতুন ছবি পোস্ট করেছে । এতো মুটিয়েছে তবুও শরণার্থী ভক্তের থকথকে দল কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে । এতো কবি আমাদের বাংলা ভাষায় । টেলিভিশনে কবিতা,গুলিস্তানে কবিতা,রিক্সায় জড়াজড়ি কবিতা,আওয়ামী বিএনপি কবিতা,ফালতু কবিতা,নমোশুদ্র কবিতা,সৈয়দ কবিতা...

এইসব পাঠ করে করেই নিজস্ব মৃত্যুর নোট লিখছি...
আহা..

No comments:

Post a Comment