Monday, February 26, 2018

অনিন্দ্য রায়

  কবিতা,যখন ক্রিয়াপদহীন 


‘যুদ্ধের আগে’ । একটি কবিতার বই । কবি গোপাল কুম্ভকার । প্রথম প্রকাশ ঃ ২০১৪ । রূপালী প্রকাশন । ৬০ পৃষ্ঠা । ৪৬ টি কবিতা । একেক পৃষ্ঠায় একটি ক’রে কবিতা। বাকিগুলিতে টাইটেল, উৎসর্গ, সূচিপত্র, কিছু কথা কবির ।অমিয়কুমার সেনগুপ্তের বইটি সম্পর্কে পূর্বকথা । বিশেষত্ব বইটিতে, পুরো বইটিতে ক্রিয়াপদ অব্যবহৃত।
  হ্যাঁ, একটিও ক্রিয়াপদ নেই বইটিতে, কবি লেখেন নি ।
 যেন যুদ্ধের আগে সমস্ত থমকে আছে; কেউ কিছু করছে না, নড়ছে না,নিষ্ক্রিয় সব কিছু, কোনো ক্রিয়া নেই, ক্রিয়াপদ নেই।
“ নদীর দু’হাতে চর
      জনপদ
   পাখির আস্তানা
   মাঝখানে অস্তিরতা
    ধ্বংস ও গঠন ।
#
  নদীর হৃদয়ে বেদ
মুক্তো গান
     জলের মগ্নতা
  সন্নিহিত প্রাণভাষা
   মেঘ ও বিদ্যুৎ ।
#
  নদীর দু’পায়ে ক্ষুর
শিল্পবাধ
   বেহুলা ভাসান
  স্রোতপথে ঘুর্ণি ঢেউ
  আবেগ ও ভ্রমণ ।
   ( নদী/গোপাল কুম্ভকার  )
এরকমই, এই কবিতগুলি থেকে, বাক্য থেকে ক্রিয়াপদকে সরিয়ে রেখেছেন তিনি।
বাক্যের অন্তর্গত যে পদ দিয়ে কোনো কিছু ‘করা’কে বোঝায় তাকে ক্রিয়াপদ বলে, আমরা জানি। করা মানে অ্যাকশন, ক্রিয়াশীলতা, ভার্ব ।  কোনো কোনো ভাষায় ভার্ব ছাড়া শুদ্ধ, সম্পূর্ণ বাক্য হয় না। 
 বাংলায় হয়, কবিতায় হয়। হ্যাঁ, ক্রিয়াপদ বাদ দিয়ে এমন বাক্য লেখা সম্ভব বাংলাভাষায় যা বাক্যটির অর্থ পুরোপুরি প্রকাশ করতে সক্ষম । ভার্ব সেখানে উহ্য থাকে, নিজে উপস্থিত না থেকেও সে কথক ও শ্রোতার মধ্যে, লেখক ও পাঠকের মধ্যে কমিউনিকেশন সম্পূর্ণ করে। সে কবিতার শরীর থেকে নিজে সরে যায়, কিন্তু কবিতাকে অঙ্গহীন করে তোলে না, স্থবির করে তোলে না।
আর অ্যাকশন না থাকা মানে কি স্থবিরতা? অন্য পার্টস অফ স্পিচের ব্যবহার, গোপন ভার্বের ক্রিয়াশীলতা বাক্যে গতিময়তার সেন্স তৈরি করতে পারে। ‘ছুটন্ত ট্রেন’ এই বাক্যাংশটিতে একটি বিশেষণ ও একটি বিশেষ্য ভার্ব ছাড়াই চলমান দৃশ্যের ধারণা  দিতে পারে।
 ক্রিয়াপদহীন কবিতা তাই নিষ্ক্রিয় নয়, অচল নয়, স্বতন্ত্র প্রকরণে সে সৃজনশীল।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার কবিরা বিভিন্ন সময়ে তাঁদের কবিতা থেকে ভার্বকে নির্বাসন দিয়েছেন। 
  রাশিয়ার কবি Afansii Fet-এর লেখা দুটি গীতিকবিতা “সন্ধ্যার আকাশে ঝড়...”( ১৮৪২) ও  “ ফিসফিস, ভীরু শ্বাস...”( ১৮৫০)-এ আমরা ক্রিয়াপদের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করি।ইতালির কবি Filippo Tommaso  Marinetti ( ১৮৭৬- ১৯৪৪) কবিতা থেকে ভার্বকে বাদ দেন টেলিগ্রাফিক যোগাযোগের আবহ তৈরি করতে।  Ezra Pound ১৯১২ সালে লেখেন ১৪ শব্দে এই বিখ্যাত কবিতাটি যা ইমেজিস্ট কবিতার সার্থক উদাহরণ আর যাতে কোনো ভার্ব নেই।
The apparation of these faces in the crowd;
Petals on a wet, black bough.
                  (In A Station of the Metro )
 ১৯১৮ থেকে ১৯২৫-এর মধ্যে রাশিয়ায় গড়ে ওঠা ইমাজিনিস্ট আন্দোলনে কবিদের মধ্যে কবিতাকে ক্রিয়াপদহীন অথচ ডায়নামিক রাখার প্রয়াস দেখা যায়।
 বাংলাভাষায় মৌখিক বা লিখিত কোনো ক্ষেত্রেই বাক্যে ক্রিয়াপদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। এবং অনেকক্ষেত্রই ক্রিয়াপদ অতিরিক্ত হয়ে দাঁড়ায়, কথার স্বাভাবিক গতি রোধ করে, শ্রুতিমাধুর্য নষ্ট করে। ‘আমার নাম অনিন্দ্য” না ব’লে যদি “ আমার নাম হয় অনিন্দ্য” বলি, ‘হয়’ ক্রিয়াপদটি যুক্ত করি, তা আস্বাভাবিক ও হাস্যকর। কিন্তু কবিতা? একের পর এক বাক্য যেখানে ভার্ব নেই, লেখা হয় নি। এমন প্রকরণের ব্যবহার আমরা দেখেছি বারবার আমাদের ভাষায়।

 গভীর রাত
তীব্র গতি
খড়ের গাড়ি
গরুর চোখ
গাছের গুঁড়ি
খড়ির দাগ ।।
(দ্রুতি / সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
এই বারোটি শব্দে একটি কবিতা, সম্পূর্ণ কবিতা, একটিও ক্রিয়াপদ নেই। কিন্তু রচনাশৈলীতে, ভাবনায় এক আশর্য গতিময়তা লক্ষ্য করি আমরা।
এবং

কতবার কফিপট থেকে দূরে সেই এশিরীয় মত
ইন্দ্রধনু নয়
শৃঙ্গারে পঞ্চপ্রদীপের তেল এই গাঢ় ভিড়ে
  শার্ঙ্গপাত্রে মধু
এ জাতীয় বন্দনা শিলীভূত
    যার পাশে হংকংযের তৃণ
( হিম : প্রতি জীবনানন্দ, ৩০ / অরুণাংশু ভট্টাচার্য )
 এই কবিতাটিতে ভার্বহীন উচ্চারণে কবি একটি আবহ তৈরি করেন, যা ভাবনার স্বরকে আরও স্পষ্ট করে।
 বাংলা কবিতায় ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং চিরাচরিত কাব্যকাঠামোকে বদলে বিভিন্ন বিকল্প আঙ্গিক প্রস্তাবনা করেন তাঁরা। পুষ্কর দাশগুপ্তর লেখা সেই সব প্রকল্পের অন্যতম। তাঁর এই লেখাটি শুধুমাত্র বিশেষ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। আর কোনো পার্টস অফ স্পিচ নেই, ক্রিয়াপদও নেই। 

রাস্তা
বাস
ট্রাম
গাড়ী
        #
রাস্তা
ফুটপাত
দোকান
আলো
চিৎকার
#
রাস্তা
ফেরিঅলা
মানুষ
#
  রাস্তা
রাস্তা
রাস্তা
     (রাস্তা)
এই আন্দোলনের অন্য কবিদের কবিতাও কখনো কখনো ক্রিয়াপদ বর্জন করেছে। 
এখানে নদীর স্মৃতি
       সীমানা
হৃদয়
অ ক্ষ রে খা ব রা ব র
ছায়া
        মন্দির
এবং
রাত্রি
( মানচিত্র / পরেশ মণ্ডল )

তখন সূর্যের ...
না
মেঘ ছায়া
এবং শিশুরা
তখন লজ্জায়
না
বাঁশপাতা
শব্দ
ধ্বনিময় কারুকার্যে
শিশুরা সূর্যের
কিম্বা
 হাতে
তেলরঙা অন্তিম রেখায়
( অন্তিম রেখায়/ মৃনাল বসুচৌধুরী )
 ছোট কবিতা, কম শব্দে ,কম স্পেসে লেখা অনুকবিতা আমাদের সাহিত্যে বিশিষ্ট। নানা সময়ে বহু কবিই লিখেছেন মিত কথায় ন্যূন দৈর্ঘ্যের কবিতা। অনেকেই সেই সব রচনা থেকে ক্রিয়াপদকে বাদ দিয়েছেন, বাতিল করেছেন।

  চোখ
নীচে ক্লান্তি
 ভেতরে ভয়
 পাতায় ভালোবাসা।
( ঋক্‌ অথবা শায়েরী, ১ / ঈশ্বর ত্রিপাঠী)

চোখে নয়
চোখের কোলের দাগে আমি
সারাদিন ঘুমে অভিভূত...
( কয়েকটি নিমেষ, ৩/ জয় গোস্বামী )
                               


সমস্ত জীবন ধরে মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা আমার
                                                              (মুক্তি/ পরেশ মণ্ডল )
সাদা
আমি অন্যকারও কাছে      আমি অন্যকোনওদিন    আমি অন্যকোনওখানে    আমি অন্যকোনওবিষয়ে

কালো
আমি সবার কাছে        আমি প্রতিদিন          আমি সবখানে                আমি সব বিষয়ে   
  (কবিতাফিল্ম/ প্রবীর রায়)
বাংলাভাষায় ক্রিয়াপদ বাদ দিয়ে কবিতা লেখার প্রকৌশল তৈরি হয়েছে নানা ভাবে। এবং সেইসব কবিতায় নান্দনিকতার  কোনো শর্তই বিঘ্নিত হয় নি।
প্রস্তুতিপর্ব এই, যুদ্ধের আগে। একটি বই। একটাও ভার্ব লেখা নেই তাতে।
শিল্পাকর কুলাল চক্র কামারের শাল
তাঁতির তন্তুজালে নক্সীকাঁথা ছবি ।
#
শিল্পের সত্বা এক চরিত্র আলাদা
চারিত্রিক রূপভেদে আর্থিক হাডু-ডু ।
#
শিল্পের ধারক হাত মন আর মেধা
নিপুণ রাজ্যপাটই শিল্পের গরিমা ।
( শিল্পের গরিমা / গোপাল কুম্ভকার)
ভার্ব যদি হয় কথার শ্বাস তাকেই বাদ দিয়ে কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখা।  এমন টেকস্ট যা ক্রিয়াক্ষম,কিন্তু কোনো ক্রিয়াপদ নেই তাতে।
পাঠকের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কবিতা, যখন ক্রিয়াপদহীন।

( ‘বর্ণমালার বায়স’ পত্রিকায় মুদ্রিত )





No comments:

Post a Comment