Friday, March 30, 2018

কবিতা 

 মঈনুস সুলতান 

১. হৃদয়ে বাঞ্চা ব্যাকুল

যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়ে আমি ভ্রমণের রিদমে ভারাক্রান্ত হতেই
মনে হয়েছে বাড়ি ফেরাটা আজ অক্তে-জরুরি
অনাহারের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছে মনন
গমের স্থাপত্যকলায় দেখেছি রঙধনু ট্রাউটের গনগনে তন্দুরি।
গৃহহীনদের সাথে সহবতে মেতে ঘুরেছি স্কাই স্ক্যাপার্সের বাগানবিলাসে
সরণীর দুপাশে ইমারতের কনসার্টে জমেছে আবাসিক স্বপ্নের সমারোহ
আমিও খুঁজেছি ঘর, সরাইখানায় একটি খাটিয়াও খুঁজে পাইনি
পাঁজরে লালন করেছি না পাওয়ার দ্রোহ।

মানমন্দিরের কাঁচে দেখেছি একটি নক্ষত্র
দিনের ভাটিতে ভেসে গেছে তা
ফেরেনি সে জ্যোতিষ্ক সায়াহ্ণের শিয়রে কখনো
আমি উদ্যোগ নেইনি বলে উজাড় হয়েছে বৃষ্টিবন
চড়া পড়ে শ্লথ হয়েছে বহতা অ্যামাজনও।

হেঁটে গেছি আইসল্যান্ডিক পাহাড়ের পাদদেশে
রেনডিয়ারের খুরধ্বনিতে ম্লান হয়েছে অরোরার দ্যুতি
তোমাকেও কাছে চেয়েছি হে নিসর্গ অন্তরঙ্গ আবহে
কিন্তু রাখতে পারিনি প্রতিশ্রুতি।

আকিয়াব থেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে ডাঙ্গায় উঠেছে রোহিঙ্গা মানুষ
বেতের ঝাঁপিতে বৃদ্ধা জননী আহাজারে উপদ্রুত  হয়েছে আমার উপকূল
খেয়াঘাটের নিরালায় বসে আমি তোমার কথা ভেবেছি হে বালুচর
হৃদয়ে হয়েছি বাঞ্চা ব্যাকুল।


২. কদমতলির হাট 


আমাকে পাড়ে নামিয়ে দিয়ে ফিরে চলে নদী। বিমান বন্দরে ভিআইপি পুরুষের পদচারণার পর যে রকম রোল করে ফেলা হয় লোহিত ফরাশ, ঠিক এমনি ধারায় বহতা জলের রূপালি চিত্রপট গুটিয়ে সুরমা নদীটি ফিরে যায়  তার পাহাড় বনানীতে নিবিড় ভিটেমাটিতে। ডাঙ্গার ভিজে বালুকায় পড়ে থাকে আমাকে নিয়ে আসা নৌকাটি। আমি ধানখেতের ভেতর দিয়ে পায়ে চলার সংকীর্ণ পথ ধরে হাঁটি। ধুমকেতুর সর্পিল অবয়বে উড়ছে কুয়াশা। তার জলময় ধূসর জাফরিতে ময়নাশাইলের ফসলি মাঠ হয়ে পড়ে ঘঁষাকাচের ভেতর দিয়ে দৃশ্যমান জলরঙের রূপবন্ধ।

গঞ্জ থেকে বেশ দূরে কদমতলির হাটটি জমে ওঠেছে বেশ। দাঁড়িয়ে পড়ে আমি বেতের চাঙ্গারিতে রাখা মুড়ি-মুকড়ি দেখি। মোয়া,গুড় মাখানো নাড়– ও ভেটে চিনির শিরা মেশানো খই এর দিকে নজর যেতেই ফ্রাইপ্যানে বালুকা মিশিয়ে ভাঁজা মুচমুচে শস্যদানা বিবর্তিত হয়ে দোলায় শিশির মাখা ধানের সোনালি শীস।

হাট থেকে বেরিয়ে আসার মুখে দেখি কদমগাছের তলায় লাঙ্গল, জোয়াল, পিঁড়ি ও কুটি-চৌকি সাজিয়ে বসেছেন গাঁয়ের বুড়ো ছুতার। কানে গোঁজা পেন্সিলে থুতনি চুলকিয়ে তিনি ফোঁকলা দাঁতে হাসেন। আর রান্দা দিয়ে ঘষামাজা করা কাঠের জিনিস কখানি বদলে গিয়ে ছড়িয়ে দেয় নওল তরুবরের সবুজ পত্রালি।

Thursday, March 29, 2018

কবিতা করিডোর 
উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিভাগ :


মুখবন্ধ 
বোতল সংস্কারে জলীয় ভাষা...

জলীয় ভাষা ভেঙ্গে তরতরে এগিয়ে চলছে জ্যোৎস্নামাখা পরমায়ু। পূর্বোত্তরের টংঘর থেকে মেঘের বারান্দায় শব্দের ঝংকারে ভেসে উঠে জীবন্ত স্নায়ু। বোতল সংস্কারে লিপিবদ্ধ কণাধর্ম ছেড়ে এগিয়ে চলছে সাংবিধানিক সংকেত। সাহিত্য পাড়ায় আনাচেকানাচে মেঘের শিরায় উপশিরায় উদয় হচ্ছে রঙিন ভাবনা। ভুরি ভুরি কাব্য দাহনে প্রতিদিন ঢেউতোলা চেতনায় করিডোর ভিত পাকাপোক্তে সরগরম...

         ----রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ
              আগরতলা, ত্রিপুরা

কবিতা বিভাগ :

জ্যামিতিক
দেবলীনা সেনগুপ্ত 

চিলেকোঠা ছুঁয়ে থাকে
একফালি রৌদ্রবিলাস
আপেল খেতের বৈভবী বাতাস
তাকে শেখায় জ্যামিতিক নকশাসব
জীবন মানে বৃত্ত , উপবৃত্ত
প্রেম ত্রিকোণ , পরিবার চতুর্ভুজ
কে কাকে লালন করে
কার ভেতরে রাখে কাকে
তা নিয়েই গড়ে ওঠে যাপন কথা, জীবনের।
সময় তা শোনেনা
রোদের ফালিটুকু গুটিয়ে নিয়ে
 রাখে দরজার ধারে
প্রতি ঋতুর ক্ষরণে
রোদের গালিচায় সে আনে
অসময়ের গ্রীষ্ম , অকারণ বসন্ত
ত্রিভুজ ও বৃত্তের পাশে  খেলে
অকাজের কাটাকুটি  খেলা
 লেখা হয়,মৌলিক বর্ণমালা

রাত্রি
বিজয় ঘোষ

রাত্রি দ্রুত রং বদল করছে। ধূসর।কালো।আবছায়া ।এক আধভাঙা চাঁদের মিহি রুপোলি রঙ।রাত্রির কথকতা কোনও এক  রাতচড়া পাখির মতো।বরাকের জলে।নৌকার পাটাতনে যামিনী একা জেগে আছে।মাছেদের প্রেমে রাত্রির কারুকাজ ঝিলিমিলি করে।রাত্রি রঙ পালটায় ব্রহ্মপুত্রে।কুশিয়ারা হাত বাড়িয়ে দেয়। অথচ বাংলা-রঙে মিশে যায় লাল।'আয় তবে ভানুমতীর খেল দেখাই'।ক্ষপা ,রাত্রিকে বলে। রাত্রি হেসে কুটিপাটি।যামিনীর গালটিপে বলে,'আর কুয়ারা করতে লাগবো না।'

এতক্ষণ মিসকল মিসকল খেলছিল।যতসব পাড়াগেয়ে সেক্সি মেয়েরা।

গুলাল
সুমিতা ধর বসুঠাকুর

 তোর গলি দিয়ে হেঁটে গেলে যে ঝিঁঝিট সুরের রেশ
কবিতাকে ঘুমাতে বলেছি একটু শীত মেখে তার গায়ে
খোসা ছাড়ানো বসন্তের রঙ মাটির সিঁদুর
টইটুম্বুর মুকুলে এখন মা মা গন্ধ,
অপেক্ষার সুতো বাঁধা রয়েছে-
কবিতা,চোখ খুলিস না এই করবী বসন্তে
তার ফলে ভরা আছে ঘুম নির্যাস।

দর্পণে হাজার মুখ।।
আবু আশফাক্ব চৌধুরী।।


একটা মুখ
না চাইলেও বারবার ফিরে আসে
প্রেমকামুক উচ্ছল কোন সুনয়না যুবতী নয়
নয় কিশোর কালের পার্কে বসা ছেঁড়াছিঁড়ি
এক বটবৃক্ষ তার সুশীতল প্রশাখা অমৃত ছায়া

সে আমার জন্মদাতা পিতা-তথাগত
যার আঙ্গুলে ধরে হাঁটা শেখা
পথ চেনে নেওয়া...
স্মৃতি ভুল হতে পারে দর্পণে
হাজার মুখ
ভাসে-ডুবে হারায়- কিন্তু
আমার বাবা ধ্রুবতারার মতো অস্খলিত
যখন যেমন চাই দেখি সে
সটান দাঁড়িয়ে আছে বাহুপাশে
অফুরন্ত স্নেহ ভালবাসা

জিও
রাজীব ভট্টাচার্য

অক্ষত রাখছি খেলা
লাল নীল স্বপের বল
কমলস্বরের ক্যাকটাস
কি নিপুণ বিধে আছে
হিলহিলে নগ্নতার নৃত্যে।
বিভঙ্গে কাঁটাচামচ
খাদ্য আর খাদকের
ছুরি দিয়ে কাটছে গণতান্ত্রিক পিজা ।
লাল নীল বল গড়াচ্ছে
চকমকে বিক্ষত রাজপথ
রেম্প আজ রাতে


মিতালি 
নীলদীপ চক্রবর্তী 

যে লোকটা গুইজান ঘাট থেকে রোজ আসে
যে লোকটার মাথায় মাছেদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে
তাঁর জলে ছুড়ে ফেলা
চাঁদনী রাতে জোছনায় সঁপে দেওয়া –
যে লোকটা মাছেদের ঝাকা নিয়ে বসে বাজারে
মাছেদের কেটে কুটে যার হাত রক্ত হয়
জলে ছুঁড়ে ফেলা তাঁর মেয়েটির
আগামী – মাছেরা প্রতিপালন করে !
জুলে ছুঁড়ে ফেলা মেয়েটিকে গোপনে
মাছেরাই সই পেতে নেয় !



প্রকৃত-ক্যামেরা
অপাংশু দেবনাথ

ব্রহ্মতালু বরাবর ক্রমাগত নীলাভ কুন্ডলী,
ওই নীল ছুঁয়ে জেগে ওঠা চাঁদের যৌবন।
ক্ষুধার্ত রাত্রির সাথে ছবি তোলা বারণ এমন।

এই দৃশ্যে ছায়া মজে যায় শরীরে শরীরে,
ছায়াহীন চিত্র কোনো জীবন্ত মানুষের তো নয়।

পৃথিবীর শিশুরা জন্মের আগে মরে যায়,
পরেও আমাদেরই হাত মৃত্যুর দিকে যায় নিয়ে ।
এতো পাপ নিয়ে আয়নায় তাকাতে নেই কখনো,
কাচও ভাঙে চন্দ্রাহত রাত্রির ছায়ায়।

প্রকৃত-ক্যামেরা মানুষের মুখের দিকেই থাক।

চুয়াক
হারাধন বৈরাগী 

ফিরে যাচ্ছি- নিঝুমপরী-
বেঘোরে--ফিরে যাচ্ছি

জঙ্গল আকাশ করেছি-আকাশ জঙ্গল

চুয়াকের ঘোরে তোমাকে বিলি কেটেছি
মাটি জড়িয়ে তোমাকেই শুঁকেছি
বনপারূকদম্পতি-উড়িয়েছো তুমি

ভালবাসা-ভালবাসা-রাত্রিগুলি ফাটিয়েছি
শরীরে গ্রহন ও বর্জনের কোন দাগ দেখিনি

কামনার আগুনে চুয়াকের ঘোর দিয়ে
হাসমতি-পরকিয়ায় মেতেছিলে তুমি

*বনপারূক-কপোত সদৃশ জঙ্গলের মায়াপাখি

*চুয়াক-জঙ্গলের নেশাপানীয় বিশেষ

বসন্তসৈনিক
চিরশ্রী দেবনাথ

চারদিকে শুধু ক্ষয় দেখি
দেখি ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে মানুষ
গাছেরা দেখছে, ঘাসেরা দেখছে
ডালপালা মেলে গাছ হাত পেতে নিচ্ছে মানুষের শরীর
ফুল হয়ে ফুটছে তারা, রুগ্ন বসন্তসৈনিক
কথা নেই, সুর নেই, আলোহীন অঙ্কুরিত ফিসফিস
সমাগত দিনে কি সব পথ দ্রবীভূত
একাকী কোন মানুষের মতো একখানা ছায়া

ফিরে দেখে না
সামনে  অনুচ্চারিত, মৃদু পৃথিবী
ভালোলাগা জমা দিতে দিতে চলে যাচ্ছে
সে বুঝি, পৃথিবীর শেষ মানুষ


জীবন এক কবিতানদী
অভীক কুমার দে

শব্দরঙ বিভাজিত হলে জীবন এক কবিতানদী...

জল মাটি আলো বাতাস আর শূন্যে যখন প্রেম
কেউ কবি শব্দ শোনে কবিতার,
মনের ভাষা একা হাঁটে সৃজনের পথে।

হাতেগোনা দিনরাত পথ দেখাতে এলে
একেকটা পঙক্তি বার্ধক্যের চিত্র আঁকে,
বদলে যাওয়া অবয়বে নদীর বর্ণহীন সারাংশ।

সারাংশ থেকে উঠে আসে জীবনের পরিভাষা,
যেখানে দলবদ্ধ বর্ণনার নীলে বাস করে শূন্যতা।

হয়তো শূন্যতাও কোন গোপনীয়তা জানে,
তাই বুঝি আকাশের সব শব্দ নীল...

বৃষ্টি
প্রীতম ভট্টাচার্য

বৃষ্টির মধ্যে যখন সমুদ্র কে দেখেছি ,
ঢেউ ছাড়া সব কিছু গোপন ছিল তার ।
দ্বিধাহীন এক সত্যের সামনে ছিল
বহু সম্পর্ক এর অসমাপ্ত গল্প।
কক্ষ পথ হারিয়ে -
অচেনা গন্তব্য এর দিকে
স্থির হয়ে বসে থাকে আকাশগঙ্গা ।
পেন্সিল এ আঁকা নদী পাহাড়ের
স্কেচ থাকতেই পারে-
তবে বেঁচে থাকার জন্য
একবার হলেও নাটুকে বিদায় দরকার।

মেঘের কাছে প্রার্থনা করি 
 অমলকান্তি চন্দ

টুকরো টুকরো কথা গুলো সাজিয়ে রাখ তোমার স্বর যন্ত্রে
খেয়ালি সময়ে আবর্তনে গূঢ় পিপাসা বুকে
মেঘের কাছে প্রার্থনা করি
নতজানু হয় আরক্ত গোধূলি
উপাসনা গৃহে অভীষ্ট জড়তা কাটিয়ে উঠার ভান করি।

আল জিহ্বার নিপুণ সঞ্চালনে কথা গুলো কখনোবা পাখি হয়
ডানা মেলে দিতে চায় -তোমার ভোর আকাশে
সরল দুপুরে কিংবা একান্ত আপন ক্ষণে
আমি দু-হাত বাড়িয়ে দেই, আমাকে জড়িয়ে ধরো বুকে।

সময়ের ষড়যন্ত্র
সৌরভ গোস্বামী

বিশ্বাসের মোহভঙ্গ হয়েছে
বালিশের কোন বেয়ে জমাট হচ্ছে নোনাজল।
পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে কংক্রিট এর উঁকি,
প্রতিদিন।।
গতকালের লেখা খাতার শেষ পাতায়
সুরা পড়েছে,কিছুটা ঝাপসা তাই।
কিছু গোছানো স্বপ্ন আজ মমি,
তাই আলমারি তে রেখেছি যত্নে।।

দেওয়াল ঘড়ির সময়ানুপাতিক ষড়যন্ত্রে
অতীত একে একে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট পেজে রুপান্তরিত।
কান পেতে মাঝে মাঝে শুনি নি:শব্দের কোলাহল,
নেশার অভ্যাসে মস্তিষ্কজাত চেতনা আজ প্রত্নতাত্ত্বিক সৌধ।।

শব্দছায়া
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য 

এখনও স্টেশনে হলুদ গন্ধের পলাতক উষ্ণতা
মাথার কাছে দড়িপাকানো  সন্ধ্যার শান্ত ত্বক।
দুবেলা হাতভরা নরম বাতাস পকেটে তুলে
আমার ছায়া মাটির ঘরে ফিরে।
চিরবধির মানুষ্যজন্মের টানাপোড়ন
সন্তর্পণে  বোধের রক্ত চতুষ্কোণ
নিয়মিত নষ্ট কাগজে মহাকাশ খোঁজে
আমার ছায়া একান্তে  ঘরে ফিরে।


কোকিল বেলা
অনুরাগ ভৌমিক

ঐ নাভিমূলে আমার সমাধি হোক...
মুহূর্তে প্রেমিক হতে পারি,হতে পারি কবি।
বসন্ত ছুটে কোকিলের পিছে,

সম্রাট হওয়ার ইচ্ছে নেই,
তবু ভালোবাসার মুকুট পরতে চাই ।

এইভাবে একটু আশ্রয় সময়ের বৃহত বুকে,
সূর্যের সাথে পশ্চিমে চলে কোকিল বেলা...

স্মৃতি
ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার

বেশ থেমে আছে সময়টা
অথচ বদলায় ক্যালেন্ডার
ইতিউতি ঘোরাফেরা করে প্রেম
কবিতার জামা গায়ে ।
এক একটি মিনিটের হৃদয়ে
শুধু ষাটটি সেকেন্ড নয়,
কল্পযুগ
সৃষ্টি স্থিতি,
তবে লয় বিহীন ।

সব মিলিয়ে আমার জাগতিক দশটি মিনিট
অপরিমেয় অনন্ত ,
হাজারো লাখো জীবনমৃত্যু চক্র শেষেও
অসমাপ্য সেই ক্ষণ।
যে ক্ষণের চারপাশে
ধ্বনিত হচ্ছে ঐশী বৈদিক তান
সদগুরু বন্দনার ঊজ্জীবনী তরঙ্গ
লোকে লোকারণ্য উৎসব মুখর
একটি গ্রামীণ পাহাড়ি জনপদ।

মনে পড়ে কুরুক্ষেত্র
সেই মাঠেও একবার থেমেছিলো কাল
অর্জুন দেখেছিল পরম সত্য ,
আমার সত্যের গায়ে অন্য জামা
এক শুভ্রবসনা মূর্তি
চোখেমুখে অফুরান অনুসন্ধানী আলো
নেহাত সাদামাটা চিত্রপট।
অথচ যেনো -
জন্মান্তরের প্রতীক্ষার অবসান
অনাবিল তৃপ্ততা নিয়ে আসা
কয়েক সেকেন্ডর দৃষ্টি বিনিময়,
লৌকিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের শেষে
মুহূর্তেই বিদায়ের পালা।

ক্ষণিকের সেই স্বর্গীয় অনুভুতির--
অপ্রকাশ্য ইন্দ্রজালে মোহাবিষ্ট ঘন্টা মিনিটেরা,
স্থুল সময় গড়িয়েছে বহুদূরে।
ধ্যানস্থ জীবন আবর্তিত হচ্ছে; হোক্
মূহুর্তকে কেন্দ্র করে।।

গল্প বিভাগ :

রিডাকশন 
বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য 



দুপুর একটা । চৈত্র ২০১১ । ক্যাপিটাল সিনেমা হলের ঠিক পাশটায় ছোট্ট পানের দোকানটা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পম্পা ।মুখে লাগানো প্রসাধনগুলো চৈত্রের গরমে , অবাঞ্ছিত ঘামে ক্রমশ মিলেমিশে একাকার ।রুমালদিয়ে মুখটা মুছল পম্পা ।তবে সাবধানে । এখনও খদ্দের জোটেনি ।সকাল এগারোটা থেকেই এখানটায় ঠায় দাঁড়িয়ে । চৈত্র সেলের ভিড়টা বাড়ছে । সঙ্গে ‘দুটো পঞ্চাশ’ , ‘পাঁচটা একশো’ টাইপ কথাগুলোও । না, খিদেটা বড্ড জ্বালাচ্ছে । সকাল দশটায় বেগুন আর শুঁটকি মাছ দিয়ে খেয়ে আসা গত রাতের সামান্য পরিমাণ ভাত প্রায় হজমই হয়ে গেছে। বয়স তিরিশের দেহ, আর মোটে পাঁচ মুঠো ভাত ।খিদে তো লাগবেই ।তবে পম্পা পাঁচ গ্রাস থেকে বেশি খায় না , খেতে পারে না । কারণ , আরও পাঁচ গ্রাসতো তুলে দিতে হয় বছর পাঁচেকের সুবলের মুখে ।
সুবল পম্পার রক্তের সম্পর্কে কেউ নয় , তবে তাঁর কাছে পেটের ছেলের মতোই ।সুবল গান্ধীমেলায় ভিক্ষে করছিল । তখন আর বয়স কত ?মাত্র তিন ।দেখেই মনটা কেমন করে উঠল ।খদ্দের সামলে ঘরে ফেরার পথে ছেলেটাকে প্রায় চুরি করেই নিয়ে  এসেছিল পম্পা । তারপর থেকেই সন্তানসম আদর পেয়ে বড় হচ্ছে সুবল ।তবে এই সন্তান প্রেমের জন্য প্রায়শই গালি গালাজ খেতে হয় পম্পাকে । পাড়া পড়শিরা কটাক্ষ করতেও ছাড়ে না । ‘মাগির আবার মা হবার শখ’ এমনতর বিশেষণগুলি পম্পার নিত্যদিনের সঙ্গী ।তবে সে অনঢ় ।সুবলকে ভালো রাখতে যা যা প্রয়োজনীয় তা সবকিছুই পম্পা যোগান দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ।মাঝে মধ্যে নিজে না খেয়েও সবটূকু সে সুবলের মুখেই তুলে দেয় ।ছেলেটা খিদে একদম সহ্য করতে পারে না ।আর পারবেই বা কীভাবে ? বয়সটাই আর কত ?তাই পম্পা সুবলের খাবার-দাবারে কোন ত্রুটি রাখে না , রাখতে চায় না । কখনও কখনও পম্পার খুব দুঃখ হয় । সুবলকে সে নিজের ছেলেই ভাবে কিন্তু মা-র চূড়ান্ত আদরটুকুতো আর সে দিতে পারে না । আর তা দেবার ক্ষমতা বা সম্মান দুটোই পম্পার নেই । শরীর তো আবেগ বুঝে না ,সে বুঝে নিয়ম । তাই খিদেয় কাঁদতে থাকা সুবলকে সে কখনও বুকে টেনে নেয় না ।কারণ , এ জায়গাটা তো খদ্দেরের , সুবলের নয়। আর এই মাংসপিন্ড দুটো দিয়ে সুবলের খিদে মেটানোর ক্ষমতাটাও তো ওর নেই । তাই এ অক্ষমতা বারবারই পম্পার মনের কোনে এক নাছোড়বান্দা যন্ত্রণার জন্ম দেয় ।আর সেই যন্ত্রণারই ধুকপুকানি সবসময় হতে থাকে তাঁর পাঁজরের ভিতর ।
সংসারের স্বপ্ন পম্পার আজকের নয় । স্কুলে যে কটা দিন সে পড়াশোনা নামক বিষয়টার সংস্পর্শে ছিল তখন থেকেই ।স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে লাল-নীল স্বপ্নের কথাই সে গল্প করত ।তবে স্বপ্ন উৎপাদন ক্লাশ সেভেন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল ।পাড় মাতাল বাপটাকে একদিন একটা লরি রাস্তায় চাপা দেয় । তারপরই সব খতম । পড়াশুনার পাট চুকে যায় ।মা চেয়েছিল মেয়েটা পড়াশোনা করুক । তবে যক্ষাক্রান্ত মাকে বাঁচানো , দুটো পেটের যোগাড় করার মতো ব্যাপারগুলোর সঙ্গে পড়াশোনাটাকে বড্ড বেমানান ঠেকতে লাগলো পম্পার ।তাই পড়াশোনার বইগুলো ক্রমশ কোনঠাসা হতে হতে একদিন পম্পার হাতে বানানো ঠোঙ্গা হয়ে চলে যায় পাড়ার মুদির দোকানে ।সামান্য কটা পয়সা আসে , তবে মাকে বাচানো যায় না ।বাধ্য হয়েই ধাপ্পাবাজ ছোটো মামার সঙ্গে সে গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহর শিলচরে।
শিলচরে এসে আর স্বপ্ন দেখার সুযোগ মেলেনি পম্পার ।ততদিনে দেহে যৌবন এসে গেছে ।মামির গালি-গালাজ , মামার অবাঞ্ছিত কামনা মেশানো আদরকেই সঙ্গী করে , পম্পার বয়স তখন ষোলো । হটাত  একদিন মামা এসে জানায় কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধেবেলা পম্পাকে যেতে হবে । ওর জন্য নাকি একটা চাকরি আছে । পম্পা কী চাকরি জিজ্ঞেস করলে মামা খুব একটা কোঠা বাড়ায় না । শুধু বলে , ‘ছোটোদের বেশি প্রশ্ন করতে নেই।’  সন্ধ্যা হয় ।মামাই পম্পাকে বন্ধুটির বাড়িতে নিয়ে যায় । তবে পম্পাকে একা রেখে মামা কখন কেটে পড়ে তা পম্পা বুঝতে পারে না । চাকরি করার বদলে পম্পার ব্যবসার হাতেখড়িটাই হয় সেদিন । যন্ত্রণায়, দুঃখে কষ্টে টলতে টলতে রাত দশটায় বাড়ি ফেরে পম্পা । হাতে চারটে জাতির জনকের মাথাওয়ালা একশ টাকার নোট । মামা পম্পার অবস্থাটা না জেনেই সর্বাগ্রে  টাকাগুলোই ছিনিয়ে নেয় ।পম্পা কিছু বলে না ।শুধু চোখ ঝাপসা করে দেওয়া জলের ফাঁকে মামার চকচক করা মুখটা দেখে ।তারপর ? তারপর থেকে কোনো কথাই আর জিজ্ঞেস করেনি পম্পা ।মামা-মামি তাকে ফেলে বাংলাদেশ চলে যায় ।কিন্তু পম্পা টু শব্দও করেনি ।পম্পার জীবনে তারপর অবেক কিছুই ঘটে যায় ।তবে এতো সবের পরেও পম্পা আজও মনেপ্রাণে পণ্যাঙ্গনা । 
৩ 
‘না, আজ ভাগ্যটাই খারাপ ’- চোখে চোখে ইঙ্গিত করা সত্বেও খদ্দেরটা ফস্কে যাওয়ায় এ কথাটাই মনে মনে বলে পম্পা ।সারাদিনে একটা টাকাও উপার্জন হয়নি । সিনেমা হলের উলটো দিকে বাচ্চাদের কাপড় বিক্রি করা ফেরিওয়ালাটা বার দুয়েক অবশ্য তাকিয়েছে ।না, সুযোগটা হাতছাড়া করা যায় না । ফেরিওয়ালার দিকেই ধীরে ধীরে পা বাড়ায় পম্পা তবে খিদেটা এখন আর সহ্য করা যাচ্ছেনা ।তাই বাধ্য হয়েই পাশের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট কিনে নেয় পম্পা ।চা-পর্ব শেষ হয়। একটা খিলি পান মুখে চালান করেই ফেরিওয়ালার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে ।তবে ফেরিওয়ালাটাকে বড় ভীতু মনে হর ওর ।চোখ মিলিয়েও যেন মেলাতে চাইছেনা ।ফেরিওয়ালার সঙ্গে চোখাচোখি খেলা চালাতে চালাতেই ফাঁকতালে পম্পা সুবলের জন্য একটা কাপড় পছন্দ করে নেয় ।সামনেই পয়লা বৈশাখ । নতুন কাপড়তো সবাই পরে । তাই সুবল বাদ যাবে কেন ? কিন্তু ফেরিওয়ালাটা যে দাম হাঁকাচ্ছে সে অনুযায়ী আজ রোজগার হয়নি । অজান্তেই চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে পম্পার মুখে ।তবে সময় এখনও আছে ।এ কথাটাই মনে মনে বলে নিজেকে চাঙ্গা করে নেয় পম্পা ।
নান ফন্দিফিকির ভাবতে ভাবতেই পম্পা রাস্তা পার করে ।ফেরিওয়ালাটা তাকাচ্ছে ।ওর চোখে চোখ রেখেই পম্পা জিজ্ঞেস করে, এই শার্টটার দাম কত ?জীবিকার স্বার্থেই পম্পার ব্যবহার করা শরীরের অংশগুলোতে চোখ বুলোতে বুলোতে ফেরিওয়ালাটা জবাব দেয় – ‘একশ’।
কম ? পম্পা চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করে ।
না, একশোই ।রিডাকশন লাগিয়েই তো বললাম। ফেরিওয়ালার চোখ পম্পার শরীরে । 
না, একশো তো বড় বেশি ।এই কথাটা বলেই পম্পা বুকের আঁচলটা ঠিক করার ভান করে। ফেরিওয়ালার ভেতর ক্রমশ জেগে ওঠা খিদেটা টের পায় পম্পা। তবে ফেরিওয়ালাটা তাঁর দামে অনড় ।উপায় না দেখে পম্পা শেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করে ।ইচ্ছে করেই গায়ের শাড়িটা নাড়াচাড়া করে ফেরিওয়ালার চোখে চোখ রাখে । তবে রিডাকশনের গন্ধে হটাত অন্য ক্রেতাদের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় চেষ্টাটা ব্যর্থ হয় ।  ফেরিওয়ালাও ভিড় সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
না , হবে না , একশোর এক টাকাও কম হবে না । পম্পার দিকে এ কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই ফেরিওয়ালা মুনাফা সন্ধানে মন দেয়। ব্যর্থতা নিয়ে পম্পা রাস্তা পেরোয় । কিন্তু হতোদ্যম হয়না । কারণ ফেরিওয়ালার ভিতর জন্মানো খিদেটা পম্পার অজানা নয় ।তবে খিদেটাকে পুরোপুরি জাগাতে সময় লাগবে ।লাগুক। পম্পা হাল ছাড়তে নারাজ ।
ক্রমশ বিকেল হচ্ছে । রিডাকশনের লোভে লোভে আসা মানুষগুলোর মধ্যে ক্লান্ত মুখ নিয়ে ঘরে ফেরা মানুষগুলোকে চেনার চেষ্টা করছে পম্পা ।পানের দোকানটা ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে আছে সে। সুবলের মুখটা চোখে ভাসছে । নতুন একটা সিনেমা এসেছে । তা দেখতে অবশ্য আজ খুব একটা ভিড় হয়নি । ফেরিওয়ালাটার চক্করে পড়ে আজ আর অন্য খদ্দেরও ধরা হলো আন আ।দু একটা ইঙ্গিত এলেও সাফ না বলে দিয়েছে পম্পা। তবে এতে যে একদম আপশোষ হয়নি তাও নয় ।ফেরিওয়ালাটার ব্যবসা প্রায় শেষের দিকে । পম্পার পছন্দ করা শার্টটা এখনও বিক্রি হয়নি। তা দেখে অবশ্য সে খানিকটা আশ্বস্ত হয় । ফেরিওয়ালাটার মাল পত্তরও গোছানো প্রায় শেষ ।এখনই সময় ।রাস্তা পার করেই চেনা ভঙ্গিতে ফেরিওয়ালার সামনে দাড়ায় ।বাধ্য হয়েই সে পম্পাকে দেখে ।ফেরিওয়ালার ক্রমশ বাড়তে থাকা হৃদযন্ত্রের শব্দটা স্পষ্ট টের পাচ্ছিল পম্পা । তাই সময় বুঝেই সে ভুরুর ধনুক দিয়ে চূড়ান্ত বাণটা ছুঁড়ে ।ফেরিওয়ালা ধপাস ।পম্পার পেছন পেছন সে এগিয়ে যায় ।
রেট টা কত ? মাথার ঘামটা মুছতে মুছতেই ফেরিওয়ালা প্রশ্ন করে ।
একশো । তবে ব্যালকনির টীকিট দুটো তুমিই কিনবে । মুখের ঘামটা মুছতে মুছতে পম্পা জবাব দেয় ।
ব্যালকনির কত ? মানিব্যাগটা বের করতে করতেই ফেরিওয়ালাটা জিজ্ঞেস করে ।
দুজনের আশি ।পম্পা টিকিট কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে বলে।
আশি ? অবাক ফেরিওয়ালা অর্ধেক বের করা মানিব্যাগটা পুনরায় পকেটে ঢোকায় ।
কী হল ? টাকা দাও , টিকিট আমি নিচ্ছি ।তোমায় আসতে হবে না ।ও, আর যা  দরকার সেটা আমার কাছে আছে ।পম্পা স্মার্টলিই কথাগুলো বলে ।
তোমার একশো , ব্যালকনির দুজনের আশি... ফেরিওয়ালা স্বভাব মাফিক হিসেব করতে লেগে পড়ে।
ওটা কিছুনা । ব্যালকনির টিকিটে কম হবে না ।তবে আমি যদি রিডাকশন দেই... পম্পা ব্যবসায়িক ভঙ্গিতেই কথাটা ছুঁড়ে দেয় ফেরিওয়ালার দিকে ।
মানে ? ফেরিওয়ালার চোখ চকচক করে ওঠে ।
তুমি আমায় বিশ টাকা কম দিও । বিশটাকা রিডাকশন দিলাম ।আর কম হবে না ।টাকাটা দাও ।
ফেরিওয়ালার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে পম্পা টিকিট কিনে আনে ।দুজনে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায় ।তবে পম্পা মনে মনে আরেকটা হিসেব করে নেয় । নিয়ম মাফিক খেলা শুরু হয় ।জীবিকার দৌলতেই অভ্যস্ত পম্পা খেলার নেশায় ডুবতে থাকা ফেরিওয়ালার সঙ্গে আরেকটা সওদা করে নেয় ।
আগে যে শার্টটার দাম কিরেছিলাম সেটা আছে তো ?ফিসফিস করে পম্পা জিজ্ঞেস করে ।
আছে। কোনো মতে কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দেয় ফেরিওয়ালা ।
আমিতো রিডাকশন দিলাম , তুমিও দাও ।পম্পা ফেরিওয়ালার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে ।
আচ্ছা। খেলায় মগ্ন ফেরিওয়ালা জবাব দেয়।
আশি টাকায় তাহলে দিচ্ছো শার্টটা ।পম্পা নিশ্চিত করার ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে ।শরীরের চরাই উৎরাইয়ে হারিয়ে যাওয়া ফেরিওয়ালা কথা নাবাড়িয়ে উত্তর দেয় –হ্যাঁ ।
অন্ধকারেও পম্পার মুখে তৈরি হওয়া আলো ব্যালকনিতে ছড়িয়ে পড়ে । এ যেন এক বিজয়িনীর হাসি ।পম্পা ইচ্ছে করেই ফেরিওয়ালার মুখটা সযত্নে বুকে টেনে নেয় ।



কিছু অসংলগ্ন দৃশ্য
 মেঘমালা দে মহন্ত 

দৃশ্যঃ ১

উৎসবে মেতেছে গোটা কাশীপুর গ্রাম । অনেক পূজা-পার্বণ-ব্রত-হুজুগের একঘেয়ে জীবনে নতুন কিছুর আয়োজন । গ্রামের শিক্ষিত ছেলেরা মিলে গড়েছে গো-রক্ষা সেবা সঙ্ঘ । জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে স্বদেশ ।সেই ছেলেরাই এবার করবে গো-সেবা উৎসব কাশীপুর গ্রামে ।একঘর মুসলমানের হিন্দু-গ্রাম কাশীপুরে সাজো সাজো রব । বাদ যায়নি সেই ‘একঘর’ও।গফুরের মহেশকে বাছা হয়েছে গো-সেবা সম্প্রিতীর প্রতীক করে ।

দৃশ্যঃ ২

তিনদিন বিছানায় পড়ে আছে গফুর ।খিদে পেটে জ্বরের ঘোরে কখনও প্রলাপ বকছে জোর – কখনও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে প্রায় ভেঙ্গে পড়া ঘরের বাঁশের বেড়াগুলোর দিকে –আবার কখনও মড়ার মতো পড়ে রয়েছে বেহুশ।ভাগ্যিস বৃষ্টি হয়নি এই ক’দিন । তাই বেহুঁশ হয়ে অন্তত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা নসীব হয়েছে নয়তো বাপ-বেটিকে ঘরের কোনে গুটিসুটি বসেই সহ্য করতে হত বৃষ্টির দাপট । আমিনা গত দু’দিন ঠায় বসে আছে গফুরের কাছে ।প্রথম দিন মেয়েটা এদিক ওদিক সারা গ্রাম ঘুরেছে বাপের জন্য সামান্য ঔষধ-পথ্যি জোগাড়ের চেষ্টায় ।সুবিধে করতে পারেনি কোথাও ।গোটা গ্রাম ব্যস্ত জীব-প্রেম উৎসব আয়োজনে । শুদ্ধতা রক্ষার রক্তচক্ষুতে দিশেহারা হতাশ আমিনা ঘরে ফিরে এসেছে লোলুপ কিছু দৃষ্টি গায়ে মেখে ।মেয়েটার দিকে তাকাতে পারেনা গফুর – বুকের যন্ত্রনা বেড়ে যায় ।কী হবে তার এই মা-মরা মেয়েটার !চালে খড়ের অভাবে ফুটে ওঠা টুকরো টুকরো অনেক আকাশ যে কোন সময় মিশে যাবে এক আকাশে –নড়বড়ে বেড়াগুলো যে কোন সময় ঘরটাকে মিশিয়ে দেবে খোলা দিগন্তে – যে কোন সময় গফুরও মিশে যাবে – কোথায়, গফুর জানে না ।শুধু জানে , একা এই ঘরে ঝড়-জল-বৃষ্টি-জ্যোৎস্না-অন্ধকার-রোদে-ক্ষুধায় খাদ্য হয়ে পড়ে থাকবে একা আমিনা ।হাড় সর্বস্ব বুকের খাঁচাটার ওঠানামা অস্বাভাবিক রকমের বাড়তে বাড়তে থেমে যায় এক সময় । পাশে বসে থাকে নিশ্চুপ হতবাক গফুরের ‘একা আমিনা’।

দৃশ্যঃ ৩

তিনদিন বিছানায় পড়ে আছে গফুরের ‘একা আমিনা’ ।তবে বাপ মারা যাওয়ার পর এই তিনদিন রোদ-জল-আলো-অন্ধকারে একা থাকেনি আমিনা ।গফুরের মৃত্যুর পরদিনই সশব্দে তাকে তুলে এনে গ্রামের শেষ প্রান্তে পাহাড় ঘেরা জঙ্গলের শুরু যেখানে সেখানে এই ঘরটাতে রেখেছে ছেলেগুলো ।তারা কারা আমিনা জানে না । শুধু জানে বাপ হারানোর একাকীত্ব ধারেকাছেও আসতে দেয়নি ছেলেগুলো ।অত্যচার-যন্ত্রনায় নীল আমিনা চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে ।তাকে ঘিরে চারপাশে চলে পাশবিক উল্লাস।
এভাবেই তিনদিন শেষে ভোরবেলা গ্রামের পরিত্যক্ত ভাগাড়ের ধার ঘেষে নদীর বাঁকে ভেসে চলে গফুরের ‘একা আমিনা’।

দৃশ্যঃ ৪

তিনদিন ধরে মহেশ সহ্য করে চলে স্বদেশ তথা জীব-সেবার ধকল । প্রহরে প্রহরে মাখানো তেল সিঁদুর চন্দনে একাকার গোটা শরীর । চাল-কলা-ফলের জমানো স্তুপের গন্ধে গা গুলিয়ে আসে –কাঁসর ঘন্টা আর মাইকের বিকট আওয়াজে হতবাক মহেশের ভয়ার্ত চোখ তিন দিন গোটা গ্রামের ভিড়ে খোঁজে শুধু গফুর আমিনাকে ।ইচ্ছে করে ছুটে পালিয়ে যায় কিন্তু মাথায় লালফেট্টি বাঁধা লাঠি হাতে ছেলেগুলোকে দেখে ভরসা পায় না। নিস্তেজ পড়ে থাকে ।
তিনদিন তিনরাত উৎসব শেষে খুলে দেয়া হয়েছে জরি জড়ানো মহেশের বেঁধে রাখা দড়ি ।গলায় ফুলের মালা, সিঁদুরের টিপ কপালে দিগন্তে মিশে যাওয়া বাড়িটা খুঁজে চলে গফুর-আমিনার ‘একা মহেশ’।




৩ টি অনুগল্প 

বই

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ 

দুপুরের ভাত খেয়ে বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিলেন অমরেশ বাবু।

সাত পাঁচ ভেবে টেবিল থেকে  গল্পের বইটা আবারো হাতে নিলেন। বইটি কি করে তার বইয়ের তাকে আসলো সেটাই দুদিন ধরে মনে করতে পারছেন না। অথচ গল্পগুলির জন্য লেখককে কুর্নিশ জানানোর প্রবল ইচ্ছে...

ফোনের রিংটোন বাজতেই থতমত হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন অমরেশ বাবু। বুকের ওপর থেকে গল্পের বইটি টেবিলে রেখে জলপান করতে করতে রাস্তায় চেঁচামিচি শুনতে পেলেন।

চশমাটা চোখে দিয়ে চেঁচামিচি উৎস খুঁজতে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলেন। কিছু মানুষ জটলা হয়ে রয়েছে।তাদের ঠেলে সামনে যেতেই চমকে উঠলেন। রাস্তায় পড়ে রয়েছে তার থেথলানো দেহ।হাতে সেই গল্পের বই...



অভিমান



রতন টাকাটা চুরি করলো । তুমি কিছু বলবে না ।
-কি বলবো ? নিয়েছে তো তর ভাই । ভাইয়ের টাকা ভাই নিয়েছে । এতে বলার কী আছে ।
-বা । জিজ্ঞেস না করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেল । মদ গাঁজা খেয়ে অতগুলো টাকা উড়িয়ে দেবে । টাকাগুলো যে রান্নাঘরটা মেরামত করবার জন্য বেশি সুদে এনেছি । সে দিকে খেয়াল আছে ।
-আ বেশি বকবক করিস না । এখান থেকে সরে পর ।
সুশীল আর কথা বাড়াল না । বুঝল এ সব কথা মাকে বলে লাভ নেই । সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ।
ঘড়ির কাটায় তখন ১০ টা । সুশীলের ছোট বোন রত্না বললো , মা তুমি বীনা দোষে দাদাকে বকলে । রতনের দোষ । অতগুলো টাকা চুরি করলো ।তুমি কিছু বললে না ।
-কি বলবো বল । সুশীল শান্ত ছেলে ।মা বকলে কিছু বলবে না । চুপ করে থাকবে । আর রতন জানোয়ারটা কে কিছু বললে তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাড়বে ।
-তাই বলে সবসময় ...
ভোরের আলো চারধারে ছড়িয়ে পড়েছে ।সুশীল রাতে বাড়ি ফিরেনি । সুশীলের অপেক্ষায় মা সারারাত উঠোনে পায়চারি করে কাটিয়ে দেয় ।সারা মুখে চিন্তার ছাপ । ছেলেটা না খেয়ে সারারাত কোথায় ছিল এসব চিন্তা তাকে জর্জরিত করছিল । এমন সময় সুশীলের বন্ধু শৈলেন দ্রুত দৌড়ে বাড়িতে ডুকলো । হাফাতে হাফাতে বললো । মাসিমা দ্রুত আমবাগানে চলুন ।
কেন,হঠাৎ আমবাগানে । কি হল ।
সুশীল আমবাগানে ফাঁসি দিয়েছে


কবি


রৌদ্রদগ্ধ আয়নায় ক্যালেন্ডারের শনির চিত্র ফুটে উঠতেই কবি তৃপ্ত কন্ঠে ঢেকুর তুললো।কবির জংশন নাকি ইদানীং খুব সরগরম চলছে। পুরোনো স্নেহগুলি মাড়িয়ে সদ্য প্রেম করতে শিখেছে।
বিকেলের হাওয়ায় কলার উঁচিয়ে বাইকের তুমুল গতি তুলে দীপ্ত কন্ঠে কবি বলতে লাগলো 'এবারের সংখ্যাটা প্রকাশের আগে ফেইসবুকে ঝাক্কাস একটা বিতর্ক বাধাতে হবে।যেন তরতর করে ছড়িয়ে পড়ে ম্যাগাজিনের নাম।'

নির্মল পেছনে বসে নিশ্চুপ হয়ে কথাগুলি শুনছিল। বন্ধুর লেখালেখি নিয়ে তার ততটা মোহ নেই। কবিতা কবিতা করে ভবঘুরে হয়ে বন্ধুর জীবনটা নষ্ট হচ্ছে এমন একটা বদ্ধ ধারনা তার। নির্মল আলতো করে বললো 'কবিতা না বাল।এই সব নিয়ে কতদিন জীবন চালাবি। নিষ্কর্মা দের কাজ হল কবিতা নিয়ে পড়ে থাকা। কতদিন বললাম মিছিল মিটিংয়ে আয়। এতদিনে ঠিক কিছু একটা হয়ে যেত'
কবি এক মিলিয়ন হাসি উড়িয়ে বললো 'তা যা বলেছিস।আরতো ছয় মাস।এরপর তোর কি হবে। মিছিল মিটিং করে তোর কি হল।'
নির্মল আর কথা বাড়াবার সাহস পেল না। এক কথায় সে যেন জব্দ হয়ে গেল।

২)

বাইক থেকে নেমে প্রেসে ঢুকতেই কানে আসলো '১৮ তে বামফ্রন্ট সরকার আইতাছে ফিরিয়া' গানটা।ভোটের বাজারে এইসব গান এখন মুড়িমুড়কি মত অলিতেগলিতে ভেসে বেড়ায়।গানটা গুনগুন করেই কবি ভেতরে ঢুকলো। প্রেসে ডুকতেই দেখতে পেলেন গৌতম বাবুকে। গৌতম বাবু একটি অনলাইন ম্যাগাজিনের  সম্পাদক।
গৌতম বাবু কবিকে দেখেই বলে উঠলেন  'এই যে ইয়ং বয়েজ। লেখাজোঁকা কেমন চলছে। '
কবি গৌতম বাবুকে দেখে বললেন ' আপনি এখানে। আমিতো এলাম এই দশক ম্যাগাজিনের নতুন সংখ্যা কপি গুলি নেবার জন্য।কাল প্রকাশ হবে।'
গৌতম বাবু বললো 'বাহ!দারুণ খবর। শুনে ভালো লাগলো।চালিয়ে যা। কোন দরকার লাগলে অবশ্যই বলবি।'
কবি হেসে উঠে। গৌতম বাবুকে পুরোনো একটা কথা মনে করিয়ে বেশ লজ্জায় ফেলে দিল। সে বললো ' গত সংখ্যায় লেখা চেয়েছিলাম। অনেক ঘুরিয়ে দেবেন দেবেন বলেতো দিলেন না।এরপরে কি আশা করা যায় বলুন'
কবির কথা শুনে বেশ ইতস্তত হয়ে গৌতম বাবু বললো ' সেবার এত ঝামেলায় ছিলাম সত্যি সময় করে উঠতে পারিনি। '
'তা যা বলেছেন। কলকাতা পত্রিকা গুলিতে তখন আপনার ডজন ডজন লেখা প্রকাশ পেল।আর আমরা চাইলেই বাহানা করছেন।'
কবির মুখে এমন কর্কশ কথা  শুনবে বলে আশা করেনি গৌতম বাবু।তিনি আর কথা বাড়ালেন না।দু এক কথা বলে সেখান থেকে সটকে পড়েন।

৩)

ম্যাগাজিনের কপি গুলি ঠিকঠাক বুঝে নিয়ে কবি বাইরে এসে দেখতে পেলেন নির্মল দিব্যি ফোনে কথা বলতে বলতে সিগেরেট টানছে।
' এই তাড়াতাড়ি চল।মিছিল আসছে এপথে।দ্রুত বেরিয়ে  যেতে হবে।মিছিলে আটকা পড়লে কত সময় লাগবে কে জানে' কবি কথা গুলি আওড়াতে আওড়াতে দ্রুত বাইক স্টার্ট করলো। মুহুত্তে পেছন থেকে ভেসে এল একটি কর্কশ শব্দ।

৪)

চোখ খুলে কবি দেখতে পেলেন গৌতম ট্রাকের চাকার নিচ থেকে তার দুটুকরো দেহটা টেনে বের করছে।




রাহুল গাঙ্গুলী



মাঝামাঝি অবস্থান ~ ১টি দৃশ্যবার্তা কোলাজ
(১ম অংশের পর)
------------------------------------------------------------------
আপাতত ~ ঝুরঝুরে কাচ/বালি/রোদ/অভ্র/ঝিনুক
স্থান ~ ওডালারেভু সমুদ্রতট
অক্ষাংশ : (৮১.৯৫৭১৫ - x)
দ্রাঘিমাংশ : (১৬.৪৪২৯১ - y)
উচ্চাংশ মাত্রা : (z - উচ্চতায় সমুদ্র পিঠ)

অগোছালো ১২টা।দুপুর উপচানো কাঁধ।রিংটোন ~ অবিলম্বে ঘটিয়ে ফেলা সমান্তরাল ডায়ালগেজ্ ∞ যেখানে x=y=z=অস্থির 0 মান।চোখের কালো অংশে ডুবোজাহাজ ~ ডোবে না : কেবল ভুটভুটি ঘামজলে ভেজে।জল ~ ভারী জল ~ ঘনো ভারীজল ~ তেজস্ক্রিয় ঘনভারীজল : (ভারহীনতা > ০)।আরো একটু এগিয়ে ~ ক্রমাগত : সরন/ঘূর্ণন/নিক্ষেপন/ত্বরণ ~ ঘুমভাঙানি চুম্বক শেখায় ৩য় সূত্র ~ 'শুদ্ধ হও।শুদ্ধ করো' ~ ভাসমান [সময়✡] যতোটা আয়তনগত অবয়বহীনতায়।


সমুদ্র : বরফ গলছে।ইদানীং রোদকম্পাঙ্ক ছাড়িয়ে ~ যেনো খোলা উঠোনের কোল।কোল গড়িয়ে সংরক্ষিত আলো : মাঠের ফসল থেকে কোষীয় ক্রোমোজোম

রাহুল : বুকের উষ্ণতা পুড়িয়ে কৃষ্ণগহ্বর।চলমান ~ তুমি কে : আমিই চলমানতা।বহমান ~ তুমি কোথায় ~ বহমানতা [© আবহমান] মুখোমুখি।দ্রাব্য '?' শেখায় নক্ষত্র সন্ধানের শিকড়

সমুদ্র : অথচো দেখো ~ যাবতীয় শিকড়েই কিন্তু উত্তাপের খোঁজ।আজ কতোটা শীতল হলে ~ পরিমাপ করো।কাল কতোটা ঝুরোঝুরো বরফ ~ এগিয়ে আসলে বালিজ অভিমান

বালি : পরিচয় চিরে ফেলা ব্যস ~ ভাবো এখানেই মিশে গেছি আমি।(জল ভাসে ~ জলের ওপর জল ~ জল ভাসে ~ বহুজলীয় স্তর : সমুদ্র আঘাত ~ ভাসমতি জল)

রাহুল : দেখছি ~ এখানেও কতো উপোষ / কতো কুয়াশা ~ বালিরা টুপটুপ ~ বহুগামিতায় স্পন্দন

শিকড় : তাহলে কেনো মানো না ~ তোমার পেটেও থাকছে আদিম মাটি।মিশে যাচ্ছে দেহ ~ যেখানে আমরা সবাই আগামী-র মাটিদেহ

রাহুল : বুদবুদ ওড়ে।ফাঁকা পথ বুড়ো হয়।বুড়োটে নখ ~ নখ ভাঙে : সেতু ফিরে যায় মেঘকালো বাড়ি

সমুদ্র : ফাঁকা হলেও বা কি অথবা না হলেও।বলা কি যায় না ~ ০-ভর্তি অস্থায়ী অসীম।যাযাবর রাহুল বৃষ্টি খোঁজে ~ বৃষ্টি-জায়মান : নগ্ন অপেক্ষা

শিকড় : যদিও ~ এই নাম / সংখ্যা / আকার / তল ~ সবই আণবিক দাবী : নিখোঁজ রাহুল ~ রাহুল-কে খোঁজে

রাহুল : খনিজ পোষাক ~ শাদাসাদা বালি জমাই।বালিকথার ক্যানভাস : এই মেঘ/দুপুর ~ জড়ানো ফুসফুস থেকে মিউট্যান্ট জাদুকর

সমুদ্র : ভুলে যাচ্ছো ~ জাদুঘরের সর্বনাশ : বাগান ভর্তি ~ বালি/মাটি/খনিজ।আফসোস : এতোটা এগিয়ে গেলে শিকড়ের নগ্নতা ভুলে

বালি : ঝমঝম ~ ঝমঝমিয়ে : ক্রমাগত খোলাছাদ।উপত্যকা-শিরা এখনো বর্ষা ছেটায়।উল্লাস ভেসে পড়ে ~ তুমুল সর্বনাশ ~ সর্বনাশে ভাসমান নাবিক : ২পশলা চিহ্নহীন দেহ

শিকড় : ঝিনুক কোথায় ~ রূপকথামালা : বন্ধকী সীমান্ত [ছায়ারূপ ~ অছায়া তছনছ]

ঝিনুক : আছি হে বাউল।উলু দাও ~ হাঁটু মুড়ে তুলে ফেলি বোধিফুল।এখনো পাড়ি দেওয়া বাকি।পাড়ি দেবো।বাদবাকি কালরাতে ~ নিঃসঙ্কোচ অভ্রঘুম

রাহুল : অদৃশ্য রূপক ~ খোঁপা ঝরা কুসুম-শিশির।নুনের পরিমাপ বাড়ে : কমে গেলে টিক্-টপ্-টপ্।ভেলা নিয়ে তুমুল অজগর ~ আসমানি মাঝে দরিয়ারেখা।দেখা হবে।আবারো শুদ্ধতা ~ ঘি-চন্দন প্রলেপ্ : আবারো শুদ্ধতা

সমুদ্র : এসো এবার।সকলেরই পরিচিত জরায়ু ~ এসো এবার।ঘড়িতে পারদ-লেখ : শিলালিপি।গুহাকথা।লাজুক সঙ্গম


শব্দরূপ : রাহুল

(দৃশ্যবার্তা নিয়ে কাজগুলোর আরেকটু এগিয়ে যাওয়া।এবারে দিন, সময়, অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশের সাথে যোগ হলো উচ্চতার মাপ।এই কাজটির মূল উদ্দেশ্য হলো ~ মহাব্রহ্মান্ডের অন্তর্নিহিত প্রকৃতির ভিতর প্রবেশ এবং তার উপাদানগুলির সাথে আত্ম-উপলব্ধির সংযোগ স্থাপন ~ বার্তা বিনিময় মাধ্যমে।প্রকৃতির এমন কোনো উপাদান নেই, যা প্রাণস্পন্দনহীন এবং যা আমাদের উপকার করতে চায় না, আর এখানেই যাবতীয় জীবনের সূূত্র)
ফিচার বা একটি লেখা 
হাত বাড়াই
সত্যম ভট্টাচার্য

শীতকালের পেছনদিকটাকে দেখি।যখন সকালের রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা ডানা মেলে দিয়ে বসে আছে পানকৌড়ি,তাকে দেখি।দেখি কিরকম সবুজ কচুরিপানার সাথে বন্ধুত্ব তার।বহুক্ষণ একইভাবে বসে সেও কি এসবই ভাবে?ভাবে একটা শহর।তার ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট।গাড়ির পেছনে দৌড়চ্ছে ঝরে পড়া পাতারা।কার কথা ভেবে যে ঝরে পড়া তাদের?ফুটপাথে বসে পড়লে কোলের ওপরেই এসে পড়ে।যেন প্রেমিকার ফেলে যাওয়া ওড়না।তার গন্ধ।তার নরম।তার থেকে যাওয়া।মনে হয় কোন প্রেমিকাই যেন রয়ে গেল তার খানিকটুকু নিয়ে।প্রেমিকা চলে গেছে বহুদিন।প্রেমও চলে গেছে।আমিই দায়ী।শুধু ঘুরে ঘুরে মরে স্মৃতি মনের হাজারদুয়ারিতে।আর আমি হাত বাড়াই।হাওয়া হয়।দমকা হাওয়া।কাউ কি আমাকে টেনে তুলবে এখান থেকে?খয়েরবাড়ি বনে আমরা বসতাম একটা বিশাল গাছের শিকড়ে মাঝখানে।গ্রাম পেরিয়ে ছোট নদী পেরিয়ে সেখানে বসতাম।এখোনো স্টিলের গ্লাসে জল খেতে গিয়ে মাঝেমধ্যে সেসব কথা মনে পড়ে।অনেকদিন সে পথে যাই নি।অনেকদিন হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গিয়ে গ্রামের কোন ঘর থেকে জল চেয়ে খাই নি।মনে পড়ে জল খেতে দাঁড়ালে গ্রামের বাচ্চাগুলো ঘিরে ধরতো আমাদের।এখন ভাবি ওদের জন্য চকোলেট নিয়ে গেলে বেশ হোতো।ওয়াচটাওয়ারে বসে আমার প্রেমিকা আমাকে শিখিয়েছিলো কিভাবে আসল চুমু খেতে হয়।আর আমি দেখছিলাম দূরে নীল আকাশে একটা জেটপ্লেন তার সাদা দাগ রেখে চলে যাচ্ছে অনন্তের দিকে।সেদিন বুঝিনি সে সাদা দাগ আসলে নীল আকাশে নয়।থেকে গেছে আমারই বুকে।এ বসন্তকালে একা একা বসে এসব কথা ভাবি।আর হলুদ পাতা ঝরে ঝরে পড়ে।বাতাসে এসময় একটা কেমন জানি মন কেমন করা গন্ধ পাওয়া যায়।প্রেমিকার বুকে মুখ রেখে কি একদিন এই গন্ধই পেয়েছিলাম?দোল চলে গেছে কিছুদিন হোল।বড় চাঁদও চলে গেছে কোথায়।শুধু মনে পড়ে ফাঁকা একটা রাস্তায় হাঁটছি।হাঁটছি ঠিক নয়।দৌড়চ্ছি।তুমুল বাতাসে ধুলো উড়ছে চারদিকে।আকাশ ফেটে পড়ছে মাঝেমধ্যে আলোতে আর গর্জনে।দূরে হাইওয়েতে সার সার ট্রাকের আলো।আমি পালাচ্ছি।পালাচ্ছি নিজের থেকে।নিজের মফস্বল থেকে।নিজের ভালোলাগার জায়গা থেকে।এমন অবস্থা যে কাউকে বলতে পারছিনা ভালো থেকো।বলতে পারছিনা দেখা হবে আবার...

হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাক্ষণ 

সব্যসাচী ঘোষ


১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ । আনন্দজ্যোতি মজুমদারের দেওয়া তথ্য   অনুযায়ী অমিয়ভূষণ মজুমদারের পেশাগত ডাককর্মী জীবনের সময়কাল । সকালে উঠে লিখতে যাওয়া , বাজার করা শিব পুজো দিয়ে তারপর অফিস । বাড়ি ফিরে বিদেশি সাহিত্য । শৃঙ্খলিত জীবন যেন হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাক্ষণ জমিদারের মেজাজকে কিছুটা বুঝতে সাহায্য করে । সাহিত্য করতেই হবে তাই নাম কে ওয়াস্তে অফিস , অফিসের অন্দরে সাহিত্যিক জ্ঞানে বীরপূজা আদায়ের চেষ্টা। এই সংস্কৃতি সর্বকালে ছিল আছে থাকবেও। কিন্তু অমিয়ভূষণ মজুমদার নিয়ম রক্ষার দফতর করেন নি। শুধু ডাককর্মীর জীবন নয় । অরাজনৈতিক ভাবে গড়ে তোলা ডাক সংগঠনের দক্ষ সংগঠক অমিয়ভূষণ তাঁর সংগঠনের মাস্তুল ধরে তাঁকে কোন প্রকার রাজনীতির ছোঁয়াচ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন । সেই কাজে ঠোক্কর খাচ্ছেন , বেদনা আসছে । সমর্থন , অসমর্থন দুইই রয়েছে । আবার প্রতিদিন সকালে নিবিষ্ট হচ্ছেন সাহিত্যের কাজে । বিকালে জেমস জয়েস , টমাস মান । যেখানে কোনভাবেই এই বিরাট পেশাগত জীবন ও কর্মী সংগঠন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না । সমান্তরাল রেলপথ । অর্থাৎ কোথাও কোন ফাঁক নেই । ফাঁকিবাজি নেই । সবটাই নিখাদ । গঙ্গা থেকে দূরে যেখানে হিমালয়ের সানুতট । সেখানের জীবন যাত্রাতেও আড়াল আবডাল আর খাদ অনেকটাই কম । সেকারণেই কোন ভনিতা ছাড়াই অমিয়ভূষণের গল্পের চরিত্র পুরসভার ময়লা ফেলার মদ্যপ গাড়ির চালক নিজের মেয়েকেই ভোগ করে । মেয়ের গর্ভে বাবার সন্তান গর্ভস্থ হয়। কোন আড়াল ছাড়াই বাবা মেয়ে এই বিষয়ে কথা বলে । মেয়ে সন্তানের জন্ম দিতে চায় । পৃথিবীর বড় অমোঘ প্রিয়তম সন্তানটি আগুনের মত ফুটে উঠবে ওর নাম রাখবে অনল । গল্পের রেশ ধরে আলোচকেরা কোচবিহার থেকে গ্রিক পুরাণ অবধি যোগসূত্র খুঁজে পেতে থাকেন।
             আনন্দজ্যোতি জানালেন বাবা অমিয়ভূষণ ইন্দিরা গান্ধী কে শ্রদ্ধা করতেন । যারা অমিয়ভূষণ চর্চা করেন তাদের কাছে এসব তথ্য হোঁচট খাওয়ায় না, কিন্তু ভাবায় । বাম আন্দোলনের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের যে স্বাভাবিক চলন বরাবর রয়েছে তা তো তখন আরও বেশি মাত্রায় ছিল । বাংলার শিল্পী সাহিত্যিক কবি হয় নিরেপক্ষ হবে , নতুবা বামপন্থী এটাই একপ্রকারের স্বাভাবিকতা । সেখানে জরুরী অবস্থার ইন্দিরাকে সমর্থন , শ্রদ্ধা ! কেন ?  বিরুদ্ধমত তো থাকতেই পারে , ১৮০ ডিগ্রীর ওপারে অবস্থিত অমিয়ভূষণের থেকে আগে এবং পরে ডুয়ার্সের তরাই এর কোল , রাভা , মুন্ডারি , রাজবংশীদের নিয়ে যে সাহিত্য সৃষ্টি যাকে তিনি উপন্যাস বা গল্প লেখা নয় কাজ বলতেন তা তো আর কেউ সেই অর্থে করতে পারলেন না। এই কাজগুলো সাধনের জন্যে তাঁকে কখনই যে বামপন্থার চাদর পরতে হয় নি এবং তাঁর জন্যে বাংলা সাহিত্যই যে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর একটা যুক্তির ব্যাখ্যাও রয়েছে । এই যে উত্তরের লোকজীবন তাদের প্রতি অমিয়ভূষণের নিবিষ্টতা সেখানে জীবনচর্যার সঙ্গে অমিয়ভূষণের  অধিদৈবতের মিশেল একটা অদ্ভুত ইমেজারি নিয়ে আসে । বামপন্থার চেনা ফরম্যাটে থাকলে এই অধিদৈবতকে আমরা এভাবে পেতাম কি ? ২০০০ সালে অমিয়ভূষণকে শিলিগুড়ি জারনালিস্ট ক্লাবের উদ্যোগে কাঞ্চনজঙ্ঘা সম্মান প্রদান করা হয় । রাজ্যের ততকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আসেন সেখানে । মহিষকুড়ার স্রষ্টাকে তাঁর হাত দিয়েই সম্মান প্রদান করা হয় । সম্মান গ্রহণের পর বক্তৃতা করতে গিয়ে অমিয়ভূষণ জানান প্রিয় কবির ভ্রাতুষ্পুত্রের থেকে সম্মান গ্রহণ করে তাঁর ভাল লাগছে। অনুষ্ঠানের পর পরই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এনিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। বামপন্থী সুকান্ত কি সত্যিই অমিয়ভূষণের প্রিয় কবি ? নাকি শুধুই মন্ত্রীকে খুশি করার জন্যে নেহাত কথার কথা বলেছিলেন । অমিয়ভূষণ কিন্তু এমন প্রশ্নের জন্যে তৈরিই ছিলেন তাই সুকান্তের মতাদর্শ নয় তাঁর নির্মাণকে ভাষার সম্পদ বলেই দীর্ঘকাল ধরে মানতেন তিনি । অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বামপন্থা অমিয়ভূষণের কাছে কোনই প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।
সুতরাং এই মানুষটিকে নিয়ে সমস্যা সত্যিই অনেক । ছক নেই তাই ছকে ফেলা যাচ্ছে না  , লেখক কি বলতে চেয়েছেন জাতীয় দিগদর্শন মিলছে না । তাই সমস্যা বিষম , “ কে এই অমিয়ভুষণ পত্র-পত্রিকায় অদীক্ষিত পাঠককুল সঙ্গতভাবেই এই কলমচিকে প্রশ্ন করতে পারেন – কে এই অমিয়ভুষণ  ? তাঁকে খেতে হয় বা মাথায় দিয়ে শুতে হয় ? এই লোকটিকে নিয়ে ঝামেলা বিস্তর । ইনি তারাশংকর – বিভূতিভূষণ – মানিক – সতীনাথের মতো তর্কাতীত স্থায়িত্বের অধিকারী নন । কমলকুমার মজুমদারের মতো লেখকদের লেখক নন । নন সমরেশ বসু – বিমল কর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মারকাটারি লিখিয়ে। ”  (প্রবন্ধ – অমিয়ভুষণ , অমিতাভ দাশগুপ্ত , বৈতানিক )
তাঁর উপন্যাস বিন্যাস তাই নিজস্ব খেয়ালে চলে , সকলের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে এগিয়ে যায় , , “আমি তাড়িত হ’য়ে লিখি না । আষাঢ় এসে পৌছলে ধূলিকণা থেকে পর্বতচূড়া তৃণদল থেকে মহীরুহে পরিবর্তন এসে এক নতুন পৃথিবী হয়। আবার ফাল্গুন চৈত্রে অনায়াসে যেন অদৃশ্যভাবে বিনাশ্রমে অন্য পৃথিবী । কারো তাগিদ নেই কারো চেষ্টা নেই । ঘটে যাচ্ছে । আমার এক উপন্যাসের পরে অন্য উপন্যাস এমনি ব্যাপার । ” দলবিচ্ছিন্ন কমরুনের সঙ্গে জুটে যাওয়া কিছু বছরের ছোট আসফাকের জঙ্গলে জঙ্গলে ভ্রমণ । শিকার , ডাহুক পুড়িয়ে খাওয়া । কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে ম্যারিনেট করা মাছ । মহিষকুড়ার উপকথার এসব বেঁচে থাকা আমাদের কাছে ডিসকভারি চ্যানেলের বেয়ার গ্রিল থেকে কোন অংশে কম কি ?                        
খনন করিডোর  

স্টিভ ও  এবং আমাদের নব্বই দশক কে যারা ভালোবাসেন তাঁরা জানেন । ওঁর আত্মজীবনীর নাম “আউট অফ মাই কমফোর্ট জোন”। স্বস্তিকে আমরাও সীমানার বাইরে রেখে মুখোমুখি বসছি । কবি , সম্পাদক , সাহিত্যিক সকলকেই একে একে মুখোমুখিতে আসবেন , শুধু গতের কথা আর ছাঁচের কথা নয়, বলা হবে কিছু মনের কথাও । নিছক সাক্ষাৎকার নয় বরং একে খনন বলা যেতে পারে, যেভাবে এই চৈত্রের দুপুরে জলের সন্ধানে মাটির অতল থেকে আরও অতলে খনন চলে , সেই ভাবে আমরা মানুষটিকে খনন করে যাব ।


ডুয়ার্সের মুজনাই চা বাগানের যে মেয়েটি চা বাগানের সবটা সবুজ নিয়ে আলিপুরদুয়ার জংশনে স্কুলের পড়াশুনো করতে আসত সেকি জানত তাঁর জীবন পাখির মত হবে । তাঁর অবিরল উড়ান প্রতিটা ডানা ঝাপটানোর শব্দ কি কঠিন অথচ কতই সহজ সাবলীল । তিনি কতটা নগরের কতটা চা বাগানের মেপে দেখেন নি এখনো । সবকিছুর মধ্যে থেকেও আবার কেমন যেন উদাসীন বাউল বাউল মন । নব্বই দশকের উল্লেখযোগ্য এই কবি শূন্য দশক থেকে যখন “পদ্য” করতে আসলেন তখন যেন বিচ্ছুরণ আরও বাড়ল । এখন শিলিগুড়ির লেকটাউন বাড়িতেই কত অজস্র পত্রিকার ঠিকানা,  শিলিগুড়ি ম্যাগ !  আমরা খনন করব এই রিমি দেকেই যার পয়সার দুটো পিঠেই কবিতা আঁকা ...
করিডোর - দশম শ্রেণিতেই নাকি আপনার বিয়ে হয়ে যায় , কিশোরী বউ থেকে আজকের রিমি কি করে পাড়ি দিলেন এই দীর্ঘপথ ?

 রিমি -   বিয়ের পর পড়াশুনো থামিয়ে দিই নি , নিজের চেষ্টায় পড়াশুনো করেছি , বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হয়েছি , তারপর বাংলা। অঙ্কুশ ভট্টের মত শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি। নাটক , রেডিওতে উপস্থাপনা সংস্কৃতি জগতে জড়িয়ে থাকার প্রবল ইচ্ছাটাই শক্তি জুগিয়েছে , আমি দুধের সন্তানকে নিয়েও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েছি শিলিগুড়ির অনেকেরই স্মৃতিতে তা আছে । তবে কবিতায় অবশ্যই আমি একটু বেশি বয়সে এসেছি ।


করিডোর - শিলিগুড়ি , কিরকম একটা গদ্যময় শহর । প্রধান অঞ্চলগুলোতে আবাঙ্গালি প্রাধান্য । ব্যবসা , টাকা , রুখাশুখা । এরমধ্যে কবিতার খোঁজ পেলেন কি করে ? এই শহর থেকে এতগুলো বছর কাগজ করার স্পর্ধা এল কোথা থেকে ?  

 রিমি -শুরুতেই খুব সুন্দর একটা প্রসঙ্গের অবতারনা করে অন্তরমহলের প্রদীপের
সলতেটা উসকে দিলে সব্য। যা তুমি বললে তা ১০০ভাগ সত্যি। তবে প্রথমে বলি 
আমি যখন নয়ের দশকের শেষার্ধে লেখালেখি শুরু করি তখন অতশত ভাবার মন ও
চোখ তৈরি হয়নি।একপ্রকার শাদা সারল্য নিয়েই লিখতে আসা।আর পাশাপাশি আমার মনে হয় যে পারিপার্শ্বিক ইট কাঠ পাথর  কোন লিখিয়ের 
কবিতায় শুরুর দিকে তত প্রভাব ফেলে না।লেখার তাগিদটাই আসল।যা বুকের ভিতরে চিনচিন বেদনা তৈরি করে।ওই তাগিদই ক্ষত,যা লেখায়। চারপাশ পরে আসে।
অনুসঙ্গ হিসেবে। যদিও এক এক জনের কবিতা একেক
রকম ভাবে নির্মিত হয়।তবু সামান্য অভিজ্ঞতায় আমি বিশ্বাস করি,একজন লেখক হৃদয়ের গভীর থেকে তাড়িত না হলে কবিতা লিখতে আসেন না।জীবনের অভিজ্ঞতা অনুভবের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির চোরা স্রোতধারায় সিক্ত হয়ে ভিতরে দোলা না জাগালে
কবিতা জাগে না। সে দোলায় হর্ষ বিষাদ হাহাকার আনন্দ জীবনের যা কিছুই লেগে থাকুক না কেন! এই নাড়িয়ে দেওয়া রক্ত শিকড়ের। এ সুধা প্রাণের।এ সুধা সত্যের।
   সৃজন কখনো বানিজ্যের তোয়াক্কা করে না। তুড়ি মেরে সে উড়িয়ে দিতে পারে  
মোহ, উল্লাস আর কম্প্রোমাইজ। পদ্যের জন্মের আগে প্রচুর কাগজ এ শহরে হয়েছে।পরেও হবে। এবিষয়ে
আমি আশাবাদী। সবচেয়ে বড় কথা কোনো লালসা নিয়ে পদ্য আসেনি। প্রচুর বিঘ্ন
সত্বেও পদ্য বিরতীবিহীন। কাজেই আর্থিক প্রাচুর্যের শহরে থেকেও অর্থকে অর্থহীন  ভেবে  পদ্য আঠেরোতে পা রেখেছে।এত লড়াই করার মনের জোর কত কতদিন থাকবে জানিনা!ইচ্ছাশক্তির কাছে স্বপ্ন কতটা পৌঁছবে তাও জানিনা।তবু চলছি! আমাদের ডারুইন বলে গেছেন না, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম!ঐ আর কী! 

করিডোর - শিলিগুড়িতে আমরা দেখি সকলে (সাহিত্যপ্রেমী , কবিতাপ্রেমী রা) বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত । পদ্য ও তার সহযোগীদের এই দ্বীপ সংস্কৃতি কতটা দগ্ধ করে ?

রিমি -গল্পটা ঠিক ধরেছ। ঐতিহ্যের শহর কলকাতাতেও এই দ্বীপ সংস্কৃতির 
প্রকাশ্য সমাবেশ এত নেই।অথচ শিলিগুড়ি পাহাড়, নদী, জঙ্গল,চাবাগান,উড়ো মেঘ সঙ্গী করেও এমন অসুখের শিকার। 
 শুরুর দিকে পদ্য এসব বোধের ঊরধে ছিল। খোলামেলা
ও মিশেল মন নিয়েই পদ্য শুরু হয়েছিল। কিন্তু চলতে চলতে দেখলাম এটা কষ্টকল্পনা !!কারণ বাস্তব অন্য কথা বলে। এক সুরে কথা বললে ধোঁয়া ওড়ে অন্য সুরে।সেই ওড়ায় প্রকৃত আমি অন্য হয়ে যাই।অথচ সেই অন্য আমি কিছুতেই নই!চলার পথের দুধারের মুখ ও মুখোশের সাজ  মৃদু টের পাই, কিন্তু বিশ্বাস
করতে চাই না! তোমার ভাষায় বলি, দগ্ধ হই দগ্ধ হই! তারপর নিজেই নিজের
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। জর্জরিত হই নিজেরই প্রশ্ন বাণে! 
ঠিকই বলেছ, শিলিগুড়ি অন্যরকম। থাক না! দ্বীপ হয়ে! নিজের কাজটাতো
চার দেওয়ালের মধ্যেই করতে হয়। এটাও একটা পথ। যত মত,তত পথ।কী বলো
তুমি!কাজেই অসুখ না বলে একে সুখ ভেবে নিয়েছি।   

করিডোর - ৯০ দশকে যখন কবিতায় এলেন তখনকার সঙ্গে আজকের কবিতায় যারা এসেছে মানসিকতায় কতটা মিল পান ?

রিমি - দেখো, আমি প্রকাশ্যে একটু বেশী বয়সেই ্লিখতে এসেছি। ভৌগোলিকভাবে
আমি উত্তরবঙ্গ তথা শিলিগুড়িতে বসবাস করি একথা ঠিক।কিন্তু আমি মনে করি
আমি বাংলার। তবে সবার সাথে মেশার তেমন সুযোগ যেমন সবার ঘটে না,আমারও ঘটেনি।আর আমরা যখন লিখতে এসেছি তখন আমাদের মুঠোয় না ছিল আন্তরজাল,না ছিল ভার্চুয়াল পরিমন্ডলের জরিবুটি। পাতিরাম ছিল শুধু।চিনতামও না কাউকে।আর মফস্বলে থাকা
লিখিয়েদের পথ বাধার পাথরে ভর্তি থাকে একথা কম বেশী সবার জানা। ।শুধু লেখা পাঠানো ছাড়া আর কোন কাজ শিখিনি।লিখেছি আর পাঠিয়েছি।  এখন কিছু কম লিখলেও
একসময়  বাংলার প্রতি জেলার গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলোতে লিখেছি।মূলত আমি ছোট কাগজেই লিখি।সমসময়ের লেখখদের সাথে আমার লেখার মাধ্যমেই পরিচয়। আর ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা যদি বলো, তবে বলব বন্ধুরা বন্ধুই থেকে যায়। সাময়িক দূরত্ব তৈরি হলেও জগতে কিছুই হারিয়ে যায় না। সব থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে
হয়তো সামান্য রূপান্তর ঘটে।আজ যারা লিখতে এসেছেন তাদের লেখালেখির
সংগ্রাম আগের তুলনায় আমার কম বলে মনে হয়,ভুলও হতে পারি! তবে বিতর্কে না গিয়ে বলি, বিশ্ব যখন হাতের মুঠোয়, তখন যোগাযোগ কে আটকায়! শুধু সৃষ্টি সম্পদ
যথাযথ হলেই হল।আমরা যা করতে পারিনি, পারিনা,এই সময়ের তরুণ তা সাফল্যের সাথে করে। পিছিয়ে পড়ি,তবু নিজের বিশ্বাস আঁকড়ে থাকি।থাকবো।শুধু একটাই প্রার্থনা,যেন লিখে যেতে পারি!! বাকিটা আমার হাতে নয়।    

করিডোর - পদ্য আর রিমি দে সমার্থক । কবি কি কোথাও তার পত্রিকায় হারিয়ে যান , অন্তত সম্ভাবনা তৈরি হয় কি ?

রিমি -২০০১ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী পদ্য র পথ চলা শুরু। আমি লিখতে শুরু করেছি নয়ের 
দশকে। আর এটাও বলি এবং অনেক জায়গায় বলেছি যে, নিজের লেখার জন্য
পদ্য নয়। আমি পদ্য তে কম লিখি।লিখলেও কম জায়গা নেই। আসলে সবাইকে নিয়ে কাজ করার মধ্যে
আনন্দ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই রয়েছে।জল যেমন সমস্ত বাধা অতিক্রম করে নিজস্ব গতির
ডানা মেলে কুলুকুলু বয়ে যায়, মনে হয় পদ্য শুধু কেন, স্বাধীনভাবে চলতে চাওয়া
কাগজগুলো এমন মানসিকতাই বহন করে।এর সাথে ব্যক্তিলেখার কোন সম্পর্ক আছে
বলে আমি মনে করি না।লেখকসত্বা আর সম্পাদক সত্বার বিরোধ কোথায়!আমি বিশ্বাস করি এবং নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি, আমার নিজের লেখার ও লেখার জায়গার এ পর্যন্ত সংকট তৈরি হয়নি। কাল কি হবে জানিনা।নিজের লেখা ও পদ্য থাকতেও পারে ,নাও পারে।বরং সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।

করিডোর - ফেসবুক বিস্ফোরণ সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি । পিছিয়ে পরার ভয়ে আমরা সদা সতর্ক । কতটা উৎপাদনশীল এই চর্চা ?

রিমি -এ বড়ো কঠিন প্রশ্ন! সময় আমাদের ফেসবুক দিয়েছে। সময় কতটা ফেসবুক নেবে
তার জন্য সময়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাতে হবে বলে আমার মনে হয়।আবার চর্চাকে অস্বীকারই বা  করি কী করে? প্রযুক্তির উন্নতি কে না চায়! তবে ফেসবুক চর্চার চাইতে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ব্লগ চর্চা ও ই ম্যাগাজিনকেই বেশি গুরুত্ব দেই।
আগামী আসলে কী নেবে জানিনা আমরা। তবু বলতে ইচ্ছে হয়, ভার্চুয়াল আর  রিয়াল দুটো যে ভিন্ন তা আমরাই আবার বিস্মৃত হই। স্ফট আর হার্ড দুটো কপিই
সমান্তরাল ভাবে চলুকনা! অসুবিধে কোথায়?তবে বইয়ের ঘ্রাণ,মেলার হুল্লোড়,  ধুলো,ভীড়,আড্ডা, ঘামের গন্ধ, রক্ত,চামড়ার  ছোঁয়া হারিয়ে যাক তা চাই না। কিছুতেই চাইনা।

করিডোর - কোনও অপ্রাপ্তি , কিছু না পাওয়া যা হতাশা জাগায় , আছে কি এমন ?

রিমি -যদি এক কথায় বলতে বলো, আমি বলব, না। বিস্তারে অনেক বলতে হয়। যদি
বলি তাতে আমার শ্ত্রু তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে  যা এখন চাই না আর!তার চেয়ে বরং কাজে হাত দেই মহানন্দে!আরো বলি যে,  
 পদ্যর প্রতি সংখ্যা প্রকাশ পাবার পর আমি ভীষণ অসন্তুষ্টিতে ভুগি।
নিজের কাজকে নির্ভুল করতে না পারার ক্ষত যন্ত্রণা দেয় বড্ড আমায়।   

করিডোর - নারীর সম্পাদিত কাগজ তার কি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন আছে , নাকি এভাবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকেমাত্র ?    

রিমি -সৃষ্টিসূত্রে আমরা নারী পুরুষ বন্ধনে আবদ্ধ।দুই লিঙ্গের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট যা বিজ্ঞান নির্ভর।এর বাইরেও যা ঘটছে তাও ইতিমধ্যে সমাজ ও আইন স্বীকৃত। নারীর সব খুঁটিনাটি কি
পুরুষ অনুভব করেন কিংবা পুরুষেরটা নারী! আমি বিশ্বাস করি এরা একে অপরের
প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে মানুষ সভ্যজগতে পদার্পণ করতে পারত না।আদি থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজে যা কিছু ইতি নেতির মধ্য দিয়ে মানুষ হেঁটেছে তা সম্পূর্ণ সভ্যতার অগ্রগতির প্রয়োজনে! নর নারী্র নীরব পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকলে আজ এই পর্যায়ে আমরা আসতে পারতাম কি? নিজ নিজ বৈশিষ্ট নিয়েও আজ নারী পুরুষ  সমাজ সংসারে সমান গুরুত্বপূর্ণ ।কাজেই ভেদাভেদের কোন প্রশ্নই আসেনা! নারী বলে শুধু নারীর কথাই বলব এমন ধারণা আমি পোষণ করি না।এই সময়েই কিছু কাগজের পুরুষ সম্পাদক আছেন যারা শুধু নারী লেখক নিয়েই কাজ করেন নিষ্ঠা নিয়ে।আবার
মহিলা সম্পাদক হয়ে যদি তিনি নারীর কথাই বলবেন বলে স্থির করেন, তাতে
সমস্যা  কোথায়? প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে নিজস্বতা নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন।
এখানে বিন্দুমাত্র চাপিয়ে দেওয়াকে মেনে নেব না।     


# কবিতা করিডোর এর পক্ষে রিমি দের সঙ্গে কথা বলেছেন সব্যসাচী ঘোষ 

কবিতা ১:

আলাপ 
শুভঙ্কর পাল 

"সাইয়া গায়ে পরদেশ গায়ে পরদেশ রে "
এভাবেই বছর কেটে যায় রোদ ও নরম নামতায়
বসন্ত কেবিনে পাতা খসে পরার দিনে গজলী আলাপ
বিন তেরে চেইন না আবে
পেয়ালার উষ্ণ চুমুকে মুমতাজ বেহিসেবী
কতটা মুহব্বত কতটা তাজমহল


জঙ্গলমহল, ঈশ্বর ও কলকাতা 
           বিশ্বজিৎ লায়েক

                 উৎসর্গ :  জঙ্গলমহলের বন্ধুদের


খেজুরপাতার চাটাইয়ে বসে চুটি ধরাই
পাশে কাঁসাইনদী, ওপারে অবসন্ন শাল জঙ্গলমহল
নডি দিয়েছে ঘর, গেরস্থালি, ছেলেপুলান
সহায় মিলনের পরাগ
সন্ধ্যার আদর নিয়ে ঘুমোতে চলল পৃথিবী
মাটিতে তার সবুজ শস্য
নদী, নারী, ঘর
জীবনে আগুন দিতে দিতে
আকাশে ফুটছে অবশিষ্ট তারা


মিছিমিছি রাগ কর
গরীব ছোকরার বুকে টিলহা-পাহাড় জ্বলে
বটতলায় সিঁদুর লেপা পাথর
শিবঠাকুরের দেশ নয় গো – গরাম্থান
মুরগা বলি দিয়েছিল
তোর আমার গাঁইয়ের লোক
এর মাটি, পৃথিবী, মানুষের এক রা

আমাদের অভাবী সংসার যেমন ভাদ্রমাস
কুলহিমুড়ায় গেরামঠাকুর
ভক্তিভরে গড় কর বউ
দেখবি আকাশে উড়ছে জোড়া শালিক
ক্ষেত ভর্তি ধান, আলু, কুথ্‌থির ডাল
বাটা ভরা পান
পেটেও ফলেছে সোনা



আদিবাসী গাঁয়ের মতো মা
শালিধানের চিড়া কুটছে কালা পিসিমনি
বিরিক্ষেতে চাঁদ উঠেছে
লাউমাচায় পূর্ণিমার আলো
তুলসিথানে মেয়েদের উলু
চাঁদের শব্দ পৃথিবী শোনে না
পৃথিবীর শব্দ চাঁদ


গোবর দিয়ে ছঁচ দেওয়া মাটিতে বসে
এক একটা সফল মুড়ি
অসফল হাতে কুড়িয়ে মুখে পুরছি
তেত্রিশ বছর আগে
খামারে কাঠের চুলায়
ভোরবেলা তুষের আগুনে মা
ধানসেদ্ধ করত মাটির হাঁড়িতে

মা এখনও ভোরবেলা ওঠে মাড়ুলি দেয়
আমি ঘুম থেকে উঠে চা খাই
আজ রোববার মা বলছে –
শুভকে দেখতে যাবি না!

Wednesday, March 28, 2018

সুমন মল্লিকের কবিতা




।।রবীন্দ্রসংগীত। ১টি লেখোনী।। 

বিশ্বরূপ বিশ্বাস 

কুকুরকে যা-ই ভাবো। ব্লেড বানাতে পারবে না।
আমার পুকুরে জল নেই কোনো। হলুদ বাসি হ'য়ে প'চে
আছে মাছ। আমি মাছের দুঃখ কারে জানাবো।
আমার গাঁয়ের মেয়েগুলো বড়ো ছেনাল। রবীন্দ্রসংগীত
শোনাতে গেলে। পর্ণগ্রাফির ডায়লগ মারে। ওহো্ বেবি,,,,ওহো্ বেবি,,,,,,,,
আমি বুঝতে পারি না। গাঁয়ের মেয়েরা এখনো ক্যানো। রবীন্দ্রসংগীত শোনে না।।


ডোরবেল....
কোজাগরী


সেদিন এমন ভাবেই বসন্ত এসেছিলো ভোর বেলা--
চায়ের কাপ হাতে নিতেই ঠকঠক করে বাবার হাত কেঁপে উঠেছিলো। মা এসে বলেছিলো!......

 বেহুঁশ ঘুমিয়েছিলাম ক্লান্তিহীন।
আমার নিরুদ্দেশ অভিসারের গল্প লিখে রেখেছিলো একটি বিবর্ণ শিমূল। 

ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সাড়ে তেত্রিশ বছরের একটি নৌকো জীবনের ঝাঁপতালে বসন্ত পুষে পুষে স্বপ্ন এঁকে চলতো...

লম্ফঝম্প টুনটুনি জীবন
 সালোকসংশ্লেষ পত্রিকা দেখতে দেখতে বহুদূর উড়ে যেত..

 বেহুঁশ ঘুমোলে কোনো হাত এখন কেঁপে ওঠবে না বা  মা এসেও বলবে না....

হৃদয়ের ভেতর থেকে হৃদপিন্ড ডেকে যাবার অপেক্ষায় ডোরবেল জেগে থাকে

এখন......
প্রবীর রায়ের কবিতা

অপসারণ

নিজনিজ বিষয়বিভ্রম থেকে ওই যে ঝিঁঝিঁ ডাক ডেকেই চলেছে
অথবা খনিজ চেহারায় সোনামুখী কয়লার এক শীৎকার ধ্বনি
নতুন মূর্তি গড়ে পুরনো নামিয়ে রেখে
কালোর মধ্যে ছায়া পড়ে আলো হচ্ছেনা
এও এক রাত্রিলক্ষণ

মূর্তি


কী বিশেষ পরিচিত হলে মূর্তিমান একক হয়ে গণনায় ব্যবহৃত হবে গণকের কাছে
ভেঙ্গে ফেলার আগে পর্যন্ত মহিমায় প্রতীক তার পাথুরে কিংবা ধাতব নির্দেশ ঠিকরে পড়া কুড়িয়ে নিয়ে মিছিল মানুষের জিন্দাবাদধ্বনি নির্ভরতা পাবে এই কঠিন সময়ে







■  ভালোবাসা-গাছ ■

   উজান উপাধ্যায়


জলের ওমে ডুবিয়ে রেখেছি স্নেহ।
ভিতরে ভিতরে আধখানা চাঁদ 
আদরে আদরে বুড়ো গাছ ....

ভালোবাসা ভাড়া করা ছায়ায় ছায়ায়,
ওষ্ঠভাঁজে চারখণ্ড অধরা বিভূতি
 মূখোমুখি পেয়ালায় নভোচারী ধোঁয়া..।

বুকের ভিতরে অর্ধনগ্ন নারী,
তালা ভেঙে কাজলের সূক্ষ্ম রেখায়...।

গাছটির ভিতরের শাঁস --
পায়ে পায়ে নেচে চলা মোহনীয় নদী।

সব খসে... আলো খসে ..ঋণ পরিশোধ,
ভালোবাসা গাছ একা --
অধরা নিরোধ ...।

চুম্বন প্রকল্প তার অনন্ত প্রজ্ঞায়....
গেছো প্রেম...
জ্যোতিষ্কের অনাবিল দ্যুতি....
ঋতুস্রাব নাভিগর্ভ পরজন্মে পায়--
চাঁদ -ফুল -নদী -মেয়ে....
আকাশগঙ্গায়----।।



◆ সেই মেয়েদের গপ্পো ◆
     
      


মেয়েদের হাত ও পায়ের শেকল খুলে গেছে।
খবরে প্রকাশ।
এখন রাস্তায় ওরা পুরুষের পাশে পাশে।
এমনকি টপকে টপকে গেছে কখনও কখনও।
খবরে প্রকাশ।
রাষ্ট্রের স্টিয়ারিং ওদের হাতে।
মহাশূন্যে ভেসে গেছে।
ওদের মুক্ত মুখে চোখে বিজয়ের উল্লাস অহরহ।
ওরা রাত করে বাড়ি ফেরে ।আড়চোখে দেখে নিয়ে  ফিসফাস করে হয়তো আধুনিক প্রতিবেশী, কিন্তু সামনে পড়লে কুশল বিনিময় চলে।
এমনকি প্রসংশা সূচক বাক্যও জুটে যায় কিছু।
আদিবাসী, সা‍ঁওতাল মেয়েদের মত আধুনিক মেয়েরাও ধূমপান করে।কফিহাউসে মুখ ঢেকে যায় উদ্ধত ধোঁয়ায়।
ছেলেদের টিস্ করে।টোন কাটে।অনেকটা খোলামেলা পোশাকের উদগ্র মেজাজে মেয়েরা জনপদে,মফস্বলী রাস্তায় এমনকি গ্রামের আনাচে কানাচে স্লিভলেস পড়ে।ওড়নায় বুকের চড়াই উৎড়াই ঢেকে নিতে বয়ে গেছে তার।সতীত্বের ন্যাকামি পোশায় না আর।
মেয়েরা আকাশে এখন ।উড়োজাহাজের সেবিকাই নয় , হাওয়ার গতির সাথে কাটাকুটি খেলে।কলেজে কারখানায় খোলামেলা গালিগালাজ তার বাঁহাতের খেল।কলমবাজি তে মেয়ে আকছার অ্যাকাডেমি পায়।মঞ্চের মাঝখানে দা়ঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কন্ঠে আইটেম গায়।
শুধু অন্ধকার নেমে এলে বাতাসের কানে কানে  সংহত শুদ্ধ ভঙ্গিমায় কারা যেন বলে যায়, ছিছি এরা কি আদপে নারী! মেয়েদের জাত। টেলিভিশনের জনপ্রিয় রিয়ালিটি শো এ শ্বাশুড়িরা  আন্তরিক প্রেমে বৌমার মা হয়ে যান,শ্বশুরেরা বাবা।
বাড়িতে  ফেরার পথে অন্তরঙ্গ স্বরে বলে দেন ...রাতের খাবার রেডি করে ডাক দিও।বড্ড ক্লান্ত আজ।কাল তো বাবুর অফিস , নাতনির স্কুল ।টিফিনটা ভালো কিছু দিও। দেখো বাইরে খেতে না হয়।

গাড়ির জানলা দিয়ে বসন্তের জ্যোৎস্না খচিত আলো হাওয়া বৌমার খোলা চুলে ঘোমটা টেনে দেয়।

মিউজিক সিস্টেমে তখনও একটি মেয়ে নাটুকে কায়দায় গলা ফুলিয়ে চীৎকার করে ...আমি সেই মেয়ে।আমি দশপ্রহরণধারিনী....

একটা শেকলের লকলকে জিভে কলেজ পড়ুয়া মেয়ের সাইকেলের চাকা শহুরে রাস্তায় হঠাৎ ই আটকে যায়।

শপিং মলের  ইলেকট্রনিক্স শোরুমে চলতি টিভিতে নিউস অ্যাঙ্কর সাহসী কন্যার বীরত্বের কাহিনী বলে চলে আবেগঋব্ধ কন্ঠের তীক্ষ্ণ উচ্চারণে।





রক্তবর্ষণ

নবকুমার পোদ্দার

সাবধান হয়ে যাও
সাবধানের রাজকার্য নেই।
বাইরে বেরিয়ে রংচঙ দেখো না।
বিশ্রাম ভুলে যাও
দীর্ঘশ্বাস জুড়ে নির্জণ কিছু দেখলে
শ্বাস বন্ধ করে রাখো।
যে কোনো মন্ত্রে
সাবধান বেরিয়ে আসবে।





এখানে ধারাবাহিকতা কাব্য বলে গণ্য হয়




কিভাবে নখের চারপাশে পরকীয়া?

স্থানীয় সংবাদ বি.বি.সি নিউজে

খোরপোষ পেতে একটা আঠালো

                              ফলন দরকার

তাহলেই চারপাশে মৌমাছি -

                         থাকবে

থাকবে

নিজস্ব বিকেলের

              বিক্রিবাটা...


উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবিতা

অপারেশন মার্চ কিংবা আলোর বিতর্কে
----------------------------------------------------


রোগীটিকে যখন হাসপাতালে আনা হয়েছে তার মুখ অ্যাসিডে ক্ষয়ে গেছে ।পুরো মুখ দলা পাকিয়ে আসতো মাংসপিণ্ড । রোগীটি বারবার করে ইশারা করছিল যেন সকলেই আরেকবার আত্মহত্যার প্রস্তুতিতে উৎসাহিত করে।

নার্সটি কমন রুমের ভেতর দৌড়ে চলে আসে। হঠাৎই ভেতর থেকে উগড়ে ফেলে বমি বেসিনের তলপেটে। জলের ঘন শব্দে চাপা পড়তে থাকে নিঃশব্দ কান্নার আওয়াজ।টাওয়ালটা জড়িয়ে পাশ ফিরতেই সে লক্ষ্য করে আয়নার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুমূর্ষু সেই রোগীটিকে, যে ইশারায় কাছে আসতে বলে নার্সটি চিৎকার করে ওঠে ভয়ে কঁকিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় খানিকটা পরাজিত সৈনিকের মতো। হঠাৎ আয়নার ভেতর থেকে উত্তর আসে
"এখানে আমরা অনেকেই... তোমরা আমাদেরকে এখানে কেন নিয়ে এলে... তোমরা যা খুঁজতে চাইছ আমাদের শরীর ঘেঁটে তা কখনোই খুঁজে পাবেনা"।




দহন
-------


আদতে সে আমাকে চিঠি লিখে পাঠালো যেটা সে লুকিয়ে রাখতে চাই কতগুলো প্রশ্নের চাপায়। আমি অনেকদিন হয়েছে এমন জিজ্ঞেস করতে পারিনি,- তুমি কোত্থেকে এসেছ এখানে, - কিংবা তোমার পরিবার...

" সে এক ভয়ংকর নিবিড় তার মাঝে রাত্রিযাপন কি করে মানুষ হতে হয় চিনিয়ে দিয়েছিল ওরা, ট্রেঞ্চের ভেতর একটি বাচ্চা মেয়েকে আনা হয়েছে, পায়ের আসক্ত বেড়ি মাংস ছিঁড়ে খাবার অহেতুক প্রলোভন, স্বপ্নে ছাই যাওয়া নিঃশ্বাসে তবুও দীর্ঘ ছিল তাদের কথাবার্তা

কাঁটাতার পেরিয়ে এসে কেউ জল দিয়ে যায়, মেয়েটি চোখের পাতা খোলে অন্য হাতে খুঁজতে থাকে একটা পাথর কিংবা ইটের টুকরো, যেখানে তাকে কবর দেয়া হবে কিংবা যেখানে এসে সবাই পেচ্ছাপ করতে করতে একটা বিড়ি ধরাবে তারপর তারা এগিয়ে যাবে গ্রামের দিকে " ।

পথে
রৈবতী ব্যানার্জী


দুঃস্বপ্নের রাত কেটে গেছে,
এখন ভোরের আলো,
রাস্তায় আলুথালু বেশে
মাধবী বোস,শহরের কৃতিছাত্রী,
সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে আসতে
পারতে আমার জীবনে,
এখন ধ্যান,জ্ঞান বলতে এই তপোবন।
পথশিশুদের জ্ঞানের আলো দেখাতে
হবে,সব হারিয়ে আমি এক জীবন
পথিক
টুকরো কবিতা 
                                 উমাপদ কর

১৭
কার মুখ আলতো চুমোয় ভরিয়ে এই সকাল সূ্র্য কি জানে?
   অনেক দিনের সঙ্গী, তোকে মানাচ্ছে না এই বেশে
   হেসে ওঠা মুখে পলেস্তরা কেন যে কুয়াশার ময়েশ্চারাইজে
কোথায় হারিয়ে যাস ফের উঁকি মারিস ঠোঁটে
     আমার মুখে গত রাতের আলো নিভিয়ে দিয়ে কোথায় উঠে এলি আজ

১৮
যে-সব হারিয়ে যাওয়া নিয়ে দিনটা শুরু হয়েছিল
     তাদের বিনতি করে বলি ফিরে এসো
   একে একে সবই যদি হারিয়ে যাওয়ার দলে জুটে যায়
তবে কার সঙ্গে খেলা ভেঙে যাওয়ার পরেও এক প্রস্থ খেলা বাকি রয়ে গেছে ভেবে
        মনস্তাপে ভুগব না, সন্ধে হয়ে এলেও

১৯
এক বিঘত দুপুরের ঘুম যখন আমাকে নাকাল প্রায়
       তখনই তোমার বজ্রমাখা চুলে বিদ্যুৎ খেলে যায়
    আর আমাদের দুজনের মাঝে যে লেপ তা আরও চওড়া হয়ে ওঠে
তুমি কেন শুধু শুধু জেগে থাকো জাগিয়ে রাখতে না পেরে
       একটু লেপ নাও, অনেকটা তুলোয় গুঁজে রাখো মনখারাপের ফিতেটা

২০
আবার একটা কুসুম ফুটে ওঠার সময় তোমার ব্যস্ততা
       ভালো লাগে না মাইরি, ওদের একটু একা থাকতে দাও
    আর শেখো কেমন করে ব্রীড়া মেখেও ফুটিয়ে তোলা যায়
শুধু সময়টা ঠিকঠাক দিতে হবে জায়মানতার
       তোমাকে ফুল বললে তখন আর কারো মুখেই চটুল হাসি জুটবে না



তবুও অরণ্যে চন্দন বৃক্ষ আছে
       তৈমুর খান

কোথাও কোনও গৌরব নেই
তবু অরণ্যে চন্দন বৃক্ষ আছে

আমরা রোজ হাওয়া খাই
হাওয়া খেতে ভালোবাসি
আর স্বপ্নকে বলি, ডালে গিয়ে বসো...
কত পাখি আছে
সেসব পাখির নাম জানি নাকো
দিন শেষ হলে তারা ফিরে আসে

এইঅরণ্যে শুধু মধু বিক্রেতার সঙ্গে দেখা হয়
মৌমাছি উড়িয়ে দেয় ওরা
তারপর চাক ভেঙে মধু আনে
আমাদের মধুমেহ বলে
সেসব মধুর দিন ডাকি নাকো ঘরে
শুধু কথা হয় রাস্তার মাঝে
যে সরু রাস্তাটি অরণ্য পার হয়ে লোকালয়ে গেছে

যাওয়া আসা করে লোক অরণ্য সমাজে
মাঝে মাঝে শিকার হয় অথবা শিকারি
তাদের কাহিনি ঘোরেফেরে আলোকে নিরালোকে
সেসব কাহিনির কোনও গৌরব নেই
অন্ধকার হয়ে এলে স্বপ্নরা ঘুমিয়ে পড়ে একে একে
আমরা স্মৃতির পাখি উড়িয়ে দিই
          যাক তারা কোথাও উড়ে উড়ে যাক
অনুগল্প 
আলোয় আলো
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল সুমনার । গলিতে দাঁড়িয়ে আধপাগলিটা হাঁ করে ওকে দেখছে । পাড়ার সবাই আবার ওকে আদিখ্যেতা করে কালী বলে ডাকে ।  আর বলবে না-ই বা কেন, গায়ের রঙ তো অমাবস্যার রাতকেও হার মানিয়ে দেয় । এদিকে সুমনার আবার রূপ নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার আছে । ফলে . . .
এই মাস তিন চার হল পাগলিটা এ পাড়ায় এসে জুটেছে । আর সুমনা লক্ষ্য করে দেখেছে, পাগলিটা অন্য সবার কাছে খাবার চায়, ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে । কিন্তু সুমনার কাছে কোনদিন কিছু চায় না । শুধুই নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে । আর এটাতেই সুমনার অস্বস্তি ।
কিন্তু এই মুহূর্তে অস্বস্তিটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না সুমনা । আজ তার ঋকের জন্মদিন । সন্ধেবেলা পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছে সে । যেতেই হবে । কিন্তু এই দু তিনটে দিন, মানে কালীপুজো আর তার আগে-পরের দিনগুলোতে সুমনা বাইরে বেরোতে চায় না । ওর বাজিতে আবার বেশ আতঙ্ক । ছোটবেলায় এক কালীপুজোর দিনে রংমশাল ধরিয়ে ওর বাপি হাতে দেওয়ার আগেই বার্স্ট করেছিল । আর তাতে ওর বাপির হাত পুড়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । সেই ভয়টা এতগুলো বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ।
ঋকের মুখটা ভেসে উঠতেই মনটা ভাল হয়ে যায় সুমনার । মাত্র ছমাস আগে পরিচয় । অথচ আজ সুমনার বুকের ভেতর একটাই নাম সবসময় রিনরিন করে বাজে । ঋক, ঋক, ঋক . . .
‘ঋক, বড্ড রাত হয়ে গেল । প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে । আর তুমি একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে ফেলেছ । ঠিক করে গাড়িটা চালাও । আর আমি তো তোমাকে বললাম, ক্যাব নিয়ে আমি চলে যেতে পারব ।’
‘আরে তুমি তো পারবে । কিন্তু আমার বার্থডে গিফ্‌টটা যে এখনও আমি পেলাম না । সেটা তো এখনই আমার চাই ডিয়ার ।’ জড়ানো গলায় হেসে ওঠে ঋক ।
‘এই, একদম কোন দুষ্টুমির মতলব না । বাড়ি এসেই গেছি । বাঁদিক করে সাইড করো । নামব ।’ গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলে সুমনা ।
সজোরে ব্রেক কষে গাড়িটার ঋক । তারপর বিশ্রীভাবে খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে । বলে, ‘দুষ্টুমির মতলব হতে যাবে কেন ? আমি দুষ্টুমি, গুন্ডামি সবই করব ।’
চোখে অন্ধকার দেখে সুমনা । পামেলার কথাগুলো মনে পড়ে যায় । ঋকের সঙ্গে মিশিস না । লেখাপড়া, রূপ, বড়লোক বাবা সব থাকলেও ওর মনের একটা গোপন অন্ধকার দিক আছে । যেখানে ও মেয়েদের এতটুকু সম্মান দেয় না । তাদের তছনছ করাই মূল উদ্দেশ্য । তখন ভেবেছিল ঋক রিজেক্ট করেছে পামেলাকে তাই ও হিংসে করে বলছে ।
ভাবনা কেটে যায় । দেখে ওর ওড়নায় টান পড়েছে । ঋক কুটিল দৃষ্টি নিয়ে হাত দিয়েছে ওর ওড়নাতে । আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে সুমনা । সজোরে ঠেলা মারে ঋককে । তারপরই গাড়ির দরজা খুলে সোজা দৌড় দেয় বাড়ির গলির দিকে । ঋকও ছাড়ার ছেলে নয় । মদ্যপ অবস্থাতেও ছুটে সুমনাকে ধরে ফেলে । সুমনা একবারই শুধু সুযোগ পায় চেঁচিয়ে ওঠার । পরক্ষণেই ঋকের ঠোঁটদুটো সুমনার চিৎকার বন্ধ করে দেয় ।
দমবন্ধ কয়েক মুহূর্ত । তারপরই সুমনার কানে আসে এক অমানুষিক গলার চিৎকার ।
‘অ্যাইইইই . . . শিগগির ছাড় আমার মেয়েকে । নাহলে তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব ।’
হতচকিত হয়ে ঋক ছেড়ে দেয় সুমনাকে । দুজনেই তাকিয়ে দেখে সেই আধপাগলিটা হাতে একটা কাটারি নিয়ে দাঁড়িয়ে । তার চোখদুটো যেন জ্বলছে । সুমনা যেন তার পরিত্রাতাকে দেখতে পায় । দৌড়ে আধপাগলি কালীর পিছনে লুকিয়ে পড়ে । আর ঋক নিজের বিপদ বুঝে তিলার্ধও দাঁড়ায় না ।
সুমনা অবাক হয়ে দেখে কখন যেন নিশ্চিন্তে সে ওই পাগলিটার বুকে মাথা রেখে দিয়েছে । তার মনের অন্ধকার ছায়া দীপাবলির আলোকেও ছাপিয়ে আলোকিত করে তুলেছে সেই মানুষটা ।

অনুবাদ কবিতা : মানিক সাহা 

বিজয় নাম্বিয়ানের কবিতা
(First Infinites)
অনুবাদঃ মানিক সাহা

"Hell, or a state very much llike it, does feature in Nambisan's poetic underworld, which is deep, intricate and enticing. But its attendant horrors are never indulged in for their own sake and are kept well in check by a certain wit, aa muscularity of mind,  which remind mme of a similar grace in poets as far distant in time from each oother as Robert Graves ans John Donne.
- From the Preface  by Adil Jussawall of 'First Infinities'

 বিজয়  নাম্বিয়ান  (1963   -   10 August 2017  ) ছিলেন একজন সাংবাদিক ও লেখক।  তিনি ভারতের অনেক অঞ্চলে কাজ করেছেন এবং পত্রিকায় লিখেছেন। কবি, গদ্যকার  ও কলামিস্ট হিসেবে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। কবিতার পাশাপাশি তাঁর ননফিকশনগুলিও ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় ও আলোচিত। 'Bihar is in the Eye of the Beholder' বিহারের বাস্তব ছবি তুলে ধরে। বইটি তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে স্থাপন করে।
বিজয় নাম্বিয়ান, জিত থেয়িল এবং ডম মোরেসের (সম্পাদক) সাথে 'জেমিনি'র সহ-লেখক ছিলেন। 'জেমিনি' ছিল থেয়িল এর সঙ্গে করা তাঁর প্রথম কবিতা বই। নাম্বিয়ান পুন্ঠনম ও মেলপথুর নারায়ণ ভট্টতীরীর ভক্তিমূলক কবিতাও অনুবাদ করেছেন।
তাঁর বিখ্যাত বই 'ল্যাংগুয়েজ এ এথিক' এ, নাম্বিয়ান ভাষাগতভাবে নৈতিক ব্যবহারের জন্য সাহিত্যের লেখকদের এবং পাঠকদের উভয়ের কাছে আন্তরিকভাবে আবেদন করেছেন।

নাম্বিয়ান তাঁর প্রথম কবিতা 'মাদ্রাজ সেন্ট্রাল'র জন্য  1988 সালে সর্বকালের সর্বভারতীয় কাব্য চ্যাম্পিয়ন হন। এই কবিতাটি সমালোচকদের কাছে প্রশংসা লাভ করে এবং পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিজয় নাম্বিয়ান মাত্র 54 বছর বয়সে মারা যান।

অনুদিত কবিতাগুলি ২০১৫ সালে প্রকাশিত 'First Infinities' কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। এই বইটিই কবির শেষ প্রকাশিত বই। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বইটি সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবির বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে এই অনুবাদগুলি তাঁকেই সমর্পণ করলাম।


মৃতপ্রায় শহর থেকে ভেসে আসা শব্দ
(সাগরির জন্য)

তৃষ্ণার্ত মানুষের জল চাওয়ার মতো
মৃতপ্রায় শহর থেকে শব্দ ভেসে আসে
আর হত্যালীলার বহু দূরে থাকা
সাদাবাড়ির দেয়াল বেয়ে উঠতে থাকে বেগলভেলিয়া।

উঁচু আলোকিত জানলার পাশে একজন বসে থাকে যেখানে
সাদা ঘুঘুপাখিগুলি তাদের অস্থির পালক আরো এলোমেলো করে নেয়।
আর মনোরম মার্চের বাতাসে বেগোনভেলিয়ায় ভ্রমরের শব্দের মতো
সে পরিস্কার শুনতে পায় মৃতপ্রায় শহর থেকে ভেসে আসা শব্দ।

গত গ্রীষ্মের এই অভিশপ্ত শহরটির কথা
জানলার পাশে থাকা লোকটি ভাবতে থাকে। সে দেখে
আকাশ জুড়ে কৃষ্ণচূড়ার লেলিহান শিখা ছড়িয়ে রয়েছে।
আর সে ভালোভাবেই জানে, যে শহরের মৃত্যু হবে তার কথা ভাবা
নিতান্তই অনর্থক।







ডায়াজেনেস
(ডায়োজেনস, ডায়োজেনস দ্য সনিক নামেও পরিচিত,  ছিলেন একজন গ্রিক দার্শনিক এবং সাইনিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা।)

পাহাড়াদার তার আলো জ্বালিয়ে নিয়েছে।
সুরক্ষিত বাড়িগুলির বাইরে বিস্তৃত ও পরিপূর্ণ রাত।

তার লাঠির ঠক ঠক শব্দ শোনা যায়। মৃদু আঘাতের শব্দ।
অনেক পায়ে চলার পথকে সে সোজা করে চলেছে।

দিনের আলোয় তারা নিজেকে ভুলে থাকে। অন্ধকারে
তারা নিরব হতে চায়, পরাস্ত করতে চায় নিজেকে

প্রকৃত জীবন বহু দূরের এই উপলব্ধি দিয়ে।
এই প্রচেষ্টায় তারা পরিণত হয়

গুপ্তচর এবং অপরিচিত ব্যক্তিতে, ইচ্ছে না করেও প্রতারিত করে
মনকে যেন কোন কারণে সে কোথাও যাচ্ছে।

পাহাড়াদার তাকে অনুসরণ করে। খোলা রাতে
যে অভিসন্ধিগুলি খোলা পড়ে আছে তাদের ঢেকে দিয়ে
সে তার নিরপেক্ষ লাঠির ছায়ায় তাদের আড়াল করে রাখে।




এলিজাবেথ ওমানচেরি

এলিজাবেথ ওমানচেরি
বিখ্যাত কবি
রুটি কেনার জন্য
এক দোকানে গেলেন।
দোকানদার বলল, 'আচ্ছা,
আপনি এলিজাবেথ ওমানচেরি না?
বিখ্যাত কবি।"
তাই এলিজাবেথ ওমানচেরি বাড়ি ফিরে গেলেন।

এলিজাবেথ ওমানচেরি
এক সন্ধ্যায় কবিতা লিখবেন বলে
তাঁর লেখার টেবিলে বসলেন।
কবিতা জিজ্ঞেস করলো, 'আচ্ছা,
আপনি এলিজাবেথ ওমানচেরি না?
বিখ্যাত কবি।"
এলিজাবেথ ওমানচেরি
বলল, 'হ্যাঁ,'
তাই কবিতা বাড়ি ফিরে গেল।



শূন্য দেবালয়

ভগবান চলে গেছেন। তাঁর গর্ভগৃহ শূন্য হয়ে আছে।
রোদের গোপনে থাকা ছায়ায়
দলাপাকানো বাদুরগুলি ছাদ থেকে ঝুলে থাকে।
নীচে, বিছেগুলি ছোটাছুটি করে
এবং যদি কোন অশুভ কিছু হয় এই ভয়ে
ধর্মপ্রাণা মানুষেরা আর এখানে আসেনা।

মেঝের উপর পরে থাকা ফুলের ধ্বংসাবশেষে
তাঁর পায়ের ছাপ লেগে আছে।
সেগুলি দরজা দিয়ে চলে গেছে
মরীচিকাময় তপ্ত বালির দিকে।
অথচ তাঁর কন্ঠস্বর শোনা যেত। তাঁর সৌরভ একসময়
এই বদ্ধ বাতাসকে সুরভিত করে তুলতো।

তাঁর কন্ঠস্বর শোনা যেতঃ সূর্যের শাপিত এই পাহাড় ছেড়ে
প্রাচীন বাসিন্দাদের তিনি চলে যেতে বলতেন।
পুরোন বাসা ছেড়ে অবশেষে তারা  চলে গেল।
তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তারা চলে গিয়েছিল।
যে এই পাথরগুলিকে স্তুপ করেছিল সে-ই কেবল জানে
ভগবান কখন আসেন এবং শেষমেশ কোথায় থাকেন।




অরণ্যে ভীম

ষাঁড়ের মাংস আর পাখির মাংস
আর নীলগাইয়ের মাংস
আমি খেয়েছি।

খরগোশের রক্ত, আর ভেড়ার রক্ত
আর ময়ূরের রক্ত
আমি পান করেছি।

আমাকে বলো, সেই সাপ কোথায়
যে আমাকে নষ্ট করে দেবে, সেই বাঘ কোথায়
যে আমাকে ছিঁড়ে খাবে, আমার শরীরে
সব জানোয়ার মিশে আছে, আমি তাদের জাতভাই।




কবিতা :২
সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা

চিত্রনাট্য

ঘন নীল জমি....অভিমান অভিমান....
কুন্দ হাসির ফুলকারি....শুভ্র....মুক্তো জমাট
প্রতি সম্পর্কই তো জামদানি বোনে পূর্বরাগে ,
বিসমিল্লা সানাই তুলে রাখলে সব মণিকর্ণিকা ।

এখন মোরা সাইয়া বহুশ্রুত দাবিতে উপাস্য উইন্ডোয় ফরোয়ার্ড ,
গ্লেনের কান্নায় অমীমাংসিত পূর্ব সূত্ররা সরল সমীকরণে উজ্জ্বল ,
' ও রোয়ে হামাসে লিপট কর কিসি অওর কে লিয়ে
অওর হাম উনহে মানা ভি না কর পায়ে '

সফল নাটকের চিত্রনাট্য প্রয়োজন
অগত্যা ভনিতা রেখে আত্মকথন ।