Thursday, March 29, 2018

কবিতা করিডোর 
উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিভাগ :


মুখবন্ধ 
বোতল সংস্কারে জলীয় ভাষা...

জলীয় ভাষা ভেঙ্গে তরতরে এগিয়ে চলছে জ্যোৎস্নামাখা পরমায়ু। পূর্বোত্তরের টংঘর থেকে মেঘের বারান্দায় শব্দের ঝংকারে ভেসে উঠে জীবন্ত স্নায়ু। বোতল সংস্কারে লিপিবদ্ধ কণাধর্ম ছেড়ে এগিয়ে চলছে সাংবিধানিক সংকেত। সাহিত্য পাড়ায় আনাচেকানাচে মেঘের শিরায় উপশিরায় উদয় হচ্ছে রঙিন ভাবনা। ভুরি ভুরি কাব্য দাহনে প্রতিদিন ঢেউতোলা চেতনায় করিডোর ভিত পাকাপোক্তে সরগরম...

         ----রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ
              আগরতলা, ত্রিপুরা

কবিতা বিভাগ :

জ্যামিতিক
দেবলীনা সেনগুপ্ত 

চিলেকোঠা ছুঁয়ে থাকে
একফালি রৌদ্রবিলাস
আপেল খেতের বৈভবী বাতাস
তাকে শেখায় জ্যামিতিক নকশাসব
জীবন মানে বৃত্ত , উপবৃত্ত
প্রেম ত্রিকোণ , পরিবার চতুর্ভুজ
কে কাকে লালন করে
কার ভেতরে রাখে কাকে
তা নিয়েই গড়ে ওঠে যাপন কথা, জীবনের।
সময় তা শোনেনা
রোদের ফালিটুকু গুটিয়ে নিয়ে
 রাখে দরজার ধারে
প্রতি ঋতুর ক্ষরণে
রোদের গালিচায় সে আনে
অসময়ের গ্রীষ্ম , অকারণ বসন্ত
ত্রিভুজ ও বৃত্তের পাশে  খেলে
অকাজের কাটাকুটি  খেলা
 লেখা হয়,মৌলিক বর্ণমালা

রাত্রি
বিজয় ঘোষ

রাত্রি দ্রুত রং বদল করছে। ধূসর।কালো।আবছায়া ।এক আধভাঙা চাঁদের মিহি রুপোলি রঙ।রাত্রির কথকতা কোনও এক  রাতচড়া পাখির মতো।বরাকের জলে।নৌকার পাটাতনে যামিনী একা জেগে আছে।মাছেদের প্রেমে রাত্রির কারুকাজ ঝিলিমিলি করে।রাত্রি রঙ পালটায় ব্রহ্মপুত্রে।কুশিয়ারা হাত বাড়িয়ে দেয়। অথচ বাংলা-রঙে মিশে যায় লাল।'আয় তবে ভানুমতীর খেল দেখাই'।ক্ষপা ,রাত্রিকে বলে। রাত্রি হেসে কুটিপাটি।যামিনীর গালটিপে বলে,'আর কুয়ারা করতে লাগবো না।'

এতক্ষণ মিসকল মিসকল খেলছিল।যতসব পাড়াগেয়ে সেক্সি মেয়েরা।

গুলাল
সুমিতা ধর বসুঠাকুর

 তোর গলি দিয়ে হেঁটে গেলে যে ঝিঁঝিট সুরের রেশ
কবিতাকে ঘুমাতে বলেছি একটু শীত মেখে তার গায়ে
খোসা ছাড়ানো বসন্তের রঙ মাটির সিঁদুর
টইটুম্বুর মুকুলে এখন মা মা গন্ধ,
অপেক্ষার সুতো বাঁধা রয়েছে-
কবিতা,চোখ খুলিস না এই করবী বসন্তে
তার ফলে ভরা আছে ঘুম নির্যাস।

দর্পণে হাজার মুখ।।
আবু আশফাক্ব চৌধুরী।।


একটা মুখ
না চাইলেও বারবার ফিরে আসে
প্রেমকামুক উচ্ছল কোন সুনয়না যুবতী নয়
নয় কিশোর কালের পার্কে বসা ছেঁড়াছিঁড়ি
এক বটবৃক্ষ তার সুশীতল প্রশাখা অমৃত ছায়া

সে আমার জন্মদাতা পিতা-তথাগত
যার আঙ্গুলে ধরে হাঁটা শেখা
পথ চেনে নেওয়া...
স্মৃতি ভুল হতে পারে দর্পণে
হাজার মুখ
ভাসে-ডুবে হারায়- কিন্তু
আমার বাবা ধ্রুবতারার মতো অস্খলিত
যখন যেমন চাই দেখি সে
সটান দাঁড়িয়ে আছে বাহুপাশে
অফুরন্ত স্নেহ ভালবাসা

জিও
রাজীব ভট্টাচার্য

অক্ষত রাখছি খেলা
লাল নীল স্বপের বল
কমলস্বরের ক্যাকটাস
কি নিপুণ বিধে আছে
হিলহিলে নগ্নতার নৃত্যে।
বিভঙ্গে কাঁটাচামচ
খাদ্য আর খাদকের
ছুরি দিয়ে কাটছে গণতান্ত্রিক পিজা ।
লাল নীল বল গড়াচ্ছে
চকমকে বিক্ষত রাজপথ
রেম্প আজ রাতে


মিতালি 
নীলদীপ চক্রবর্তী 

যে লোকটা গুইজান ঘাট থেকে রোজ আসে
যে লোকটার মাথায় মাছেদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে
তাঁর জলে ছুড়ে ফেলা
চাঁদনী রাতে জোছনায় সঁপে দেওয়া –
যে লোকটা মাছেদের ঝাকা নিয়ে বসে বাজারে
মাছেদের কেটে কুটে যার হাত রক্ত হয়
জলে ছুঁড়ে ফেলা তাঁর মেয়েটির
আগামী – মাছেরা প্রতিপালন করে !
জুলে ছুঁড়ে ফেলা মেয়েটিকে গোপনে
মাছেরাই সই পেতে নেয় !



প্রকৃত-ক্যামেরা
অপাংশু দেবনাথ

ব্রহ্মতালু বরাবর ক্রমাগত নীলাভ কুন্ডলী,
ওই নীল ছুঁয়ে জেগে ওঠা চাঁদের যৌবন।
ক্ষুধার্ত রাত্রির সাথে ছবি তোলা বারণ এমন।

এই দৃশ্যে ছায়া মজে যায় শরীরে শরীরে,
ছায়াহীন চিত্র কোনো জীবন্ত মানুষের তো নয়।

পৃথিবীর শিশুরা জন্মের আগে মরে যায়,
পরেও আমাদেরই হাত মৃত্যুর দিকে যায় নিয়ে ।
এতো পাপ নিয়ে আয়নায় তাকাতে নেই কখনো,
কাচও ভাঙে চন্দ্রাহত রাত্রির ছায়ায়।

প্রকৃত-ক্যামেরা মানুষের মুখের দিকেই থাক।

চুয়াক
হারাধন বৈরাগী 

ফিরে যাচ্ছি- নিঝুমপরী-
বেঘোরে--ফিরে যাচ্ছি

জঙ্গল আকাশ করেছি-আকাশ জঙ্গল

চুয়াকের ঘোরে তোমাকে বিলি কেটেছি
মাটি জড়িয়ে তোমাকেই শুঁকেছি
বনপারূকদম্পতি-উড়িয়েছো তুমি

ভালবাসা-ভালবাসা-রাত্রিগুলি ফাটিয়েছি
শরীরে গ্রহন ও বর্জনের কোন দাগ দেখিনি

কামনার আগুনে চুয়াকের ঘোর দিয়ে
হাসমতি-পরকিয়ায় মেতেছিলে তুমি

*বনপারূক-কপোত সদৃশ জঙ্গলের মায়াপাখি

*চুয়াক-জঙ্গলের নেশাপানীয় বিশেষ

বসন্তসৈনিক
চিরশ্রী দেবনাথ

চারদিকে শুধু ক্ষয় দেখি
দেখি ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে মানুষ
গাছেরা দেখছে, ঘাসেরা দেখছে
ডালপালা মেলে গাছ হাত পেতে নিচ্ছে মানুষের শরীর
ফুল হয়ে ফুটছে তারা, রুগ্ন বসন্তসৈনিক
কথা নেই, সুর নেই, আলোহীন অঙ্কুরিত ফিসফিস
সমাগত দিনে কি সব পথ দ্রবীভূত
একাকী কোন মানুষের মতো একখানা ছায়া

ফিরে দেখে না
সামনে  অনুচ্চারিত, মৃদু পৃথিবী
ভালোলাগা জমা দিতে দিতে চলে যাচ্ছে
সে বুঝি, পৃথিবীর শেষ মানুষ


জীবন এক কবিতানদী
অভীক কুমার দে

শব্দরঙ বিভাজিত হলে জীবন এক কবিতানদী...

জল মাটি আলো বাতাস আর শূন্যে যখন প্রেম
কেউ কবি শব্দ শোনে কবিতার,
মনের ভাষা একা হাঁটে সৃজনের পথে।

হাতেগোনা দিনরাত পথ দেখাতে এলে
একেকটা পঙক্তি বার্ধক্যের চিত্র আঁকে,
বদলে যাওয়া অবয়বে নদীর বর্ণহীন সারাংশ।

সারাংশ থেকে উঠে আসে জীবনের পরিভাষা,
যেখানে দলবদ্ধ বর্ণনার নীলে বাস করে শূন্যতা।

হয়তো শূন্যতাও কোন গোপনীয়তা জানে,
তাই বুঝি আকাশের সব শব্দ নীল...

বৃষ্টি
প্রীতম ভট্টাচার্য

বৃষ্টির মধ্যে যখন সমুদ্র কে দেখেছি ,
ঢেউ ছাড়া সব কিছু গোপন ছিল তার ।
দ্বিধাহীন এক সত্যের সামনে ছিল
বহু সম্পর্ক এর অসমাপ্ত গল্প।
কক্ষ পথ হারিয়ে -
অচেনা গন্তব্য এর দিকে
স্থির হয়ে বসে থাকে আকাশগঙ্গা ।
পেন্সিল এ আঁকা নদী পাহাড়ের
স্কেচ থাকতেই পারে-
তবে বেঁচে থাকার জন্য
একবার হলেও নাটুকে বিদায় দরকার।

মেঘের কাছে প্রার্থনা করি 
 অমলকান্তি চন্দ

টুকরো টুকরো কথা গুলো সাজিয়ে রাখ তোমার স্বর যন্ত্রে
খেয়ালি সময়ে আবর্তনে গূঢ় পিপাসা বুকে
মেঘের কাছে প্রার্থনা করি
নতজানু হয় আরক্ত গোধূলি
উপাসনা গৃহে অভীষ্ট জড়তা কাটিয়ে উঠার ভান করি।

আল জিহ্বার নিপুণ সঞ্চালনে কথা গুলো কখনোবা পাখি হয়
ডানা মেলে দিতে চায় -তোমার ভোর আকাশে
সরল দুপুরে কিংবা একান্ত আপন ক্ষণে
আমি দু-হাত বাড়িয়ে দেই, আমাকে জড়িয়ে ধরো বুকে।

সময়ের ষড়যন্ত্র
সৌরভ গোস্বামী

বিশ্বাসের মোহভঙ্গ হয়েছে
বালিশের কোন বেয়ে জমাট হচ্ছে নোনাজল।
পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে কংক্রিট এর উঁকি,
প্রতিদিন।।
গতকালের লেখা খাতার শেষ পাতায়
সুরা পড়েছে,কিছুটা ঝাপসা তাই।
কিছু গোছানো স্বপ্ন আজ মমি,
তাই আলমারি তে রেখেছি যত্নে।।

দেওয়াল ঘড়ির সময়ানুপাতিক ষড়যন্ত্রে
অতীত একে একে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট পেজে রুপান্তরিত।
কান পেতে মাঝে মাঝে শুনি নি:শব্দের কোলাহল,
নেশার অভ্যাসে মস্তিষ্কজাত চেতনা আজ প্রত্নতাত্ত্বিক সৌধ।।

শব্দছায়া
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য 

এখনও স্টেশনে হলুদ গন্ধের পলাতক উষ্ণতা
মাথার কাছে দড়িপাকানো  সন্ধ্যার শান্ত ত্বক।
দুবেলা হাতভরা নরম বাতাস পকেটে তুলে
আমার ছায়া মাটির ঘরে ফিরে।
চিরবধির মানুষ্যজন্মের টানাপোড়ন
সন্তর্পণে  বোধের রক্ত চতুষ্কোণ
নিয়মিত নষ্ট কাগজে মহাকাশ খোঁজে
আমার ছায়া একান্তে  ঘরে ফিরে।


কোকিল বেলা
অনুরাগ ভৌমিক

ঐ নাভিমূলে আমার সমাধি হোক...
মুহূর্তে প্রেমিক হতে পারি,হতে পারি কবি।
বসন্ত ছুটে কোকিলের পিছে,

সম্রাট হওয়ার ইচ্ছে নেই,
তবু ভালোবাসার মুকুট পরতে চাই ।

এইভাবে একটু আশ্রয় সময়ের বৃহত বুকে,
সূর্যের সাথে পশ্চিমে চলে কোকিল বেলা...

স্মৃতি
ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার

বেশ থেমে আছে সময়টা
অথচ বদলায় ক্যালেন্ডার
ইতিউতি ঘোরাফেরা করে প্রেম
কবিতার জামা গায়ে ।
এক একটি মিনিটের হৃদয়ে
শুধু ষাটটি সেকেন্ড নয়,
কল্পযুগ
সৃষ্টি স্থিতি,
তবে লয় বিহীন ।

সব মিলিয়ে আমার জাগতিক দশটি মিনিট
অপরিমেয় অনন্ত ,
হাজারো লাখো জীবনমৃত্যু চক্র শেষেও
অসমাপ্য সেই ক্ষণ।
যে ক্ষণের চারপাশে
ধ্বনিত হচ্ছে ঐশী বৈদিক তান
সদগুরু বন্দনার ঊজ্জীবনী তরঙ্গ
লোকে লোকারণ্য উৎসব মুখর
একটি গ্রামীণ পাহাড়ি জনপদ।

মনে পড়ে কুরুক্ষেত্র
সেই মাঠেও একবার থেমেছিলো কাল
অর্জুন দেখেছিল পরম সত্য ,
আমার সত্যের গায়ে অন্য জামা
এক শুভ্রবসনা মূর্তি
চোখেমুখে অফুরান অনুসন্ধানী আলো
নেহাত সাদামাটা চিত্রপট।
অথচ যেনো -
জন্মান্তরের প্রতীক্ষার অবসান
অনাবিল তৃপ্ততা নিয়ে আসা
কয়েক সেকেন্ডর দৃষ্টি বিনিময়,
লৌকিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের শেষে
মুহূর্তেই বিদায়ের পালা।

ক্ষণিকের সেই স্বর্গীয় অনুভুতির--
অপ্রকাশ্য ইন্দ্রজালে মোহাবিষ্ট ঘন্টা মিনিটেরা,
স্থুল সময় গড়িয়েছে বহুদূরে।
ধ্যানস্থ জীবন আবর্তিত হচ্ছে; হোক্
মূহুর্তকে কেন্দ্র করে।।

গল্প বিভাগ :

রিডাকশন 
বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য 



দুপুর একটা । চৈত্র ২০১১ । ক্যাপিটাল সিনেমা হলের ঠিক পাশটায় ছোট্ট পানের দোকানটা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পম্পা ।মুখে লাগানো প্রসাধনগুলো চৈত্রের গরমে , অবাঞ্ছিত ঘামে ক্রমশ মিলেমিশে একাকার ।রুমালদিয়ে মুখটা মুছল পম্পা ।তবে সাবধানে । এখনও খদ্দের জোটেনি ।সকাল এগারোটা থেকেই এখানটায় ঠায় দাঁড়িয়ে । চৈত্র সেলের ভিড়টা বাড়ছে । সঙ্গে ‘দুটো পঞ্চাশ’ , ‘পাঁচটা একশো’ টাইপ কথাগুলোও । না, খিদেটা বড্ড জ্বালাচ্ছে । সকাল দশটায় বেগুন আর শুঁটকি মাছ দিয়ে খেয়ে আসা গত রাতের সামান্য পরিমাণ ভাত প্রায় হজমই হয়ে গেছে। বয়স তিরিশের দেহ, আর মোটে পাঁচ মুঠো ভাত ।খিদে তো লাগবেই ।তবে পম্পা পাঁচ গ্রাস থেকে বেশি খায় না , খেতে পারে না । কারণ , আরও পাঁচ গ্রাসতো তুলে দিতে হয় বছর পাঁচেকের সুবলের মুখে ।
সুবল পম্পার রক্তের সম্পর্কে কেউ নয় , তবে তাঁর কাছে পেটের ছেলের মতোই ।সুবল গান্ধীমেলায় ভিক্ষে করছিল । তখন আর বয়স কত ?মাত্র তিন ।দেখেই মনটা কেমন করে উঠল ।খদ্দের সামলে ঘরে ফেরার পথে ছেলেটাকে প্রায় চুরি করেই নিয়ে  এসেছিল পম্পা । তারপর থেকেই সন্তানসম আদর পেয়ে বড় হচ্ছে সুবল ।তবে এই সন্তান প্রেমের জন্য প্রায়শই গালি গালাজ খেতে হয় পম্পাকে । পাড়া পড়শিরা কটাক্ষ করতেও ছাড়ে না । ‘মাগির আবার মা হবার শখ’ এমনতর বিশেষণগুলি পম্পার নিত্যদিনের সঙ্গী ।তবে সে অনঢ় ।সুবলকে ভালো রাখতে যা যা প্রয়োজনীয় তা সবকিছুই পম্পা যোগান দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ।মাঝে মধ্যে নিজে না খেয়েও সবটূকু সে সুবলের মুখেই তুলে দেয় ।ছেলেটা খিদে একদম সহ্য করতে পারে না ।আর পারবেই বা কীভাবে ? বয়সটাই আর কত ?তাই পম্পা সুবলের খাবার-দাবারে কোন ত্রুটি রাখে না , রাখতে চায় না । কখনও কখনও পম্পার খুব দুঃখ হয় । সুবলকে সে নিজের ছেলেই ভাবে কিন্তু মা-র চূড়ান্ত আদরটুকুতো আর সে দিতে পারে না । আর তা দেবার ক্ষমতা বা সম্মান দুটোই পম্পার নেই । শরীর তো আবেগ বুঝে না ,সে বুঝে নিয়ম । তাই খিদেয় কাঁদতে থাকা সুবলকে সে কখনও বুকে টেনে নেয় না ।কারণ , এ জায়গাটা তো খদ্দেরের , সুবলের নয়। আর এই মাংসপিন্ড দুটো দিয়ে সুবলের খিদে মেটানোর ক্ষমতাটাও তো ওর নেই । তাই এ অক্ষমতা বারবারই পম্পার মনের কোনে এক নাছোড়বান্দা যন্ত্রণার জন্ম দেয় ।আর সেই যন্ত্রণারই ধুকপুকানি সবসময় হতে থাকে তাঁর পাঁজরের ভিতর ।
সংসারের স্বপ্ন পম্পার আজকের নয় । স্কুলে যে কটা দিন সে পড়াশোনা নামক বিষয়টার সংস্পর্শে ছিল তখন থেকেই ।স্কুলের বান্ধবীদের সঙ্গে লাল-নীল স্বপ্নের কথাই সে গল্প করত ।তবে স্বপ্ন উৎপাদন ক্লাশ সেভেন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল ।পাড় মাতাল বাপটাকে একদিন একটা লরি রাস্তায় চাপা দেয় । তারপরই সব খতম । পড়াশুনার পাট চুকে যায় ।মা চেয়েছিল মেয়েটা পড়াশোনা করুক । তবে যক্ষাক্রান্ত মাকে বাঁচানো , দুটো পেটের যোগাড় করার মতো ব্যাপারগুলোর সঙ্গে পড়াশোনাটাকে বড্ড বেমানান ঠেকতে লাগলো পম্পার ।তাই পড়াশোনার বইগুলো ক্রমশ কোনঠাসা হতে হতে একদিন পম্পার হাতে বানানো ঠোঙ্গা হয়ে চলে যায় পাড়ার মুদির দোকানে ।সামান্য কটা পয়সা আসে , তবে মাকে বাচানো যায় না ।বাধ্য হয়েই ধাপ্পাবাজ ছোটো মামার সঙ্গে সে গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহর শিলচরে।
শিলচরে এসে আর স্বপ্ন দেখার সুযোগ মেলেনি পম্পার ।ততদিনে দেহে যৌবন এসে গেছে ।মামির গালি-গালাজ , মামার অবাঞ্ছিত কামনা মেশানো আদরকেই সঙ্গী করে , পম্পার বয়স তখন ষোলো । হটাত  একদিন মামা এসে জানায় কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধেবেলা পম্পাকে যেতে হবে । ওর জন্য নাকি একটা চাকরি আছে । পম্পা কী চাকরি জিজ্ঞেস করলে মামা খুব একটা কোঠা বাড়ায় না । শুধু বলে , ‘ছোটোদের বেশি প্রশ্ন করতে নেই।’  সন্ধ্যা হয় ।মামাই পম্পাকে বন্ধুটির বাড়িতে নিয়ে যায় । তবে পম্পাকে একা রেখে মামা কখন কেটে পড়ে তা পম্পা বুঝতে পারে না । চাকরি করার বদলে পম্পার ব্যবসার হাতেখড়িটাই হয় সেদিন । যন্ত্রণায়, দুঃখে কষ্টে টলতে টলতে রাত দশটায় বাড়ি ফেরে পম্পা । হাতে চারটে জাতির জনকের মাথাওয়ালা একশ টাকার নোট । মামা পম্পার অবস্থাটা না জেনেই সর্বাগ্রে  টাকাগুলোই ছিনিয়ে নেয় ।পম্পা কিছু বলে না ।শুধু চোখ ঝাপসা করে দেওয়া জলের ফাঁকে মামার চকচক করা মুখটা দেখে ।তারপর ? তারপর থেকে কোনো কথাই আর জিজ্ঞেস করেনি পম্পা ।মামা-মামি তাকে ফেলে বাংলাদেশ চলে যায় ।কিন্তু পম্পা টু শব্দও করেনি ।পম্পার জীবনে তারপর অবেক কিছুই ঘটে যায় ।তবে এতো সবের পরেও পম্পা আজও মনেপ্রাণে পণ্যাঙ্গনা । 
৩ 
‘না, আজ ভাগ্যটাই খারাপ ’- চোখে চোখে ইঙ্গিত করা সত্বেও খদ্দেরটা ফস্কে যাওয়ায় এ কথাটাই মনে মনে বলে পম্পা ।সারাদিনে একটা টাকাও উপার্জন হয়নি । সিনেমা হলের উলটো দিকে বাচ্চাদের কাপড় বিক্রি করা ফেরিওয়ালাটা বার দুয়েক অবশ্য তাকিয়েছে ।না, সুযোগটা হাতছাড়া করা যায় না । ফেরিওয়ালার দিকেই ধীরে ধীরে পা বাড়ায় পম্পা তবে খিদেটা এখন আর সহ্য করা যাচ্ছেনা ।তাই বাধ্য হয়েই পাশের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট কিনে নেয় পম্পা ।চা-পর্ব শেষ হয়। একটা খিলি পান মুখে চালান করেই ফেরিওয়ালার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে ।তবে ফেরিওয়ালাটাকে বড় ভীতু মনে হর ওর ।চোখ মিলিয়েও যেন মেলাতে চাইছেনা ।ফেরিওয়ালার সঙ্গে চোখাচোখি খেলা চালাতে চালাতেই ফাঁকতালে পম্পা সুবলের জন্য একটা কাপড় পছন্দ করে নেয় ।সামনেই পয়লা বৈশাখ । নতুন কাপড়তো সবাই পরে । তাই সুবল বাদ যাবে কেন ? কিন্তু ফেরিওয়ালাটা যে দাম হাঁকাচ্ছে সে অনুযায়ী আজ রোজগার হয়নি । অজান্তেই চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে পম্পার মুখে ।তবে সময় এখনও আছে ।এ কথাটাই মনে মনে বলে নিজেকে চাঙ্গা করে নেয় পম্পা ।
নান ফন্দিফিকির ভাবতে ভাবতেই পম্পা রাস্তা পার করে ।ফেরিওয়ালাটা তাকাচ্ছে ।ওর চোখে চোখ রেখেই পম্পা জিজ্ঞেস করে, এই শার্টটার দাম কত ?জীবিকার স্বার্থেই পম্পার ব্যবহার করা শরীরের অংশগুলোতে চোখ বুলোতে বুলোতে ফেরিওয়ালাটা জবাব দেয় – ‘একশ’।
কম ? পম্পা চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করে ।
না, একশোই ।রিডাকশন লাগিয়েই তো বললাম। ফেরিওয়ালার চোখ পম্পার শরীরে । 
না, একশো তো বড় বেশি ।এই কথাটা বলেই পম্পা বুকের আঁচলটা ঠিক করার ভান করে। ফেরিওয়ালার ভেতর ক্রমশ জেগে ওঠা খিদেটা টের পায় পম্পা। তবে ফেরিওয়ালাটা তাঁর দামে অনড় ।উপায় না দেখে পম্পা শেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করে ।ইচ্ছে করেই গায়ের শাড়িটা নাড়াচাড়া করে ফেরিওয়ালার চোখে চোখ রাখে । তবে রিডাকশনের গন্ধে হটাত অন্য ক্রেতাদের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় চেষ্টাটা ব্যর্থ হয় ।  ফেরিওয়ালাও ভিড় সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
না , হবে না , একশোর এক টাকাও কম হবে না । পম্পার দিকে এ কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই ফেরিওয়ালা মুনাফা সন্ধানে মন দেয়। ব্যর্থতা নিয়ে পম্পা রাস্তা পেরোয় । কিন্তু হতোদ্যম হয়না । কারণ ফেরিওয়ালার ভিতর জন্মানো খিদেটা পম্পার অজানা নয় ।তবে খিদেটাকে পুরোপুরি জাগাতে সময় লাগবে ।লাগুক। পম্পা হাল ছাড়তে নারাজ ।
ক্রমশ বিকেল হচ্ছে । রিডাকশনের লোভে লোভে আসা মানুষগুলোর মধ্যে ক্লান্ত মুখ নিয়ে ঘরে ফেরা মানুষগুলোকে চেনার চেষ্টা করছে পম্পা ।পানের দোকানটা ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে আছে সে। সুবলের মুখটা চোখে ভাসছে । নতুন একটা সিনেমা এসেছে । তা দেখতে অবশ্য আজ খুব একটা ভিড় হয়নি । ফেরিওয়ালাটার চক্করে পড়ে আজ আর অন্য খদ্দেরও ধরা হলো আন আ।দু একটা ইঙ্গিত এলেও সাফ না বলে দিয়েছে পম্পা। তবে এতে যে একদম আপশোষ হয়নি তাও নয় ।ফেরিওয়ালাটার ব্যবসা প্রায় শেষের দিকে । পম্পার পছন্দ করা শার্টটা এখনও বিক্রি হয়নি। তা দেখে অবশ্য সে খানিকটা আশ্বস্ত হয় । ফেরিওয়ালাটার মাল পত্তরও গোছানো প্রায় শেষ ।এখনই সময় ।রাস্তা পার করেই চেনা ভঙ্গিতে ফেরিওয়ালার সামনে দাড়ায় ।বাধ্য হয়েই সে পম্পাকে দেখে ।ফেরিওয়ালার ক্রমশ বাড়তে থাকা হৃদযন্ত্রের শব্দটা স্পষ্ট টের পাচ্ছিল পম্পা । তাই সময় বুঝেই সে ভুরুর ধনুক দিয়ে চূড়ান্ত বাণটা ছুঁড়ে ।ফেরিওয়ালা ধপাস ।পম্পার পেছন পেছন সে এগিয়ে যায় ।
রেট টা কত ? মাথার ঘামটা মুছতে মুছতেই ফেরিওয়ালা প্রশ্ন করে ।
একশো । তবে ব্যালকনির টীকিট দুটো তুমিই কিনবে । মুখের ঘামটা মুছতে মুছতে পম্পা জবাব দেয় ।
ব্যালকনির কত ? মানিব্যাগটা বের করতে করতেই ফেরিওয়ালাটা জিজ্ঞেস করে ।
দুজনের আশি ।পম্পা টিকিট কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে বলে।
আশি ? অবাক ফেরিওয়ালা অর্ধেক বের করা মানিব্যাগটা পুনরায় পকেটে ঢোকায় ।
কী হল ? টাকা দাও , টিকিট আমি নিচ্ছি ।তোমায় আসতে হবে না ।ও, আর যা  দরকার সেটা আমার কাছে আছে ।পম্পা স্মার্টলিই কথাগুলো বলে ।
তোমার একশো , ব্যালকনির দুজনের আশি... ফেরিওয়ালা স্বভাব মাফিক হিসেব করতে লেগে পড়ে।
ওটা কিছুনা । ব্যালকনির টিকিটে কম হবে না ।তবে আমি যদি রিডাকশন দেই... পম্পা ব্যবসায়িক ভঙ্গিতেই কথাটা ছুঁড়ে দেয় ফেরিওয়ালার দিকে ।
মানে ? ফেরিওয়ালার চোখ চকচক করে ওঠে ।
তুমি আমায় বিশ টাকা কম দিও । বিশটাকা রিডাকশন দিলাম ।আর কম হবে না ।টাকাটা দাও ।
ফেরিওয়ালার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে পম্পা টিকিট কিনে আনে ।দুজনে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায় ।তবে পম্পা মনে মনে আরেকটা হিসেব করে নেয় । নিয়ম মাফিক খেলা শুরু হয় ।জীবিকার দৌলতেই অভ্যস্ত পম্পা খেলার নেশায় ডুবতে থাকা ফেরিওয়ালার সঙ্গে আরেকটা সওদা করে নেয় ।
আগে যে শার্টটার দাম কিরেছিলাম সেটা আছে তো ?ফিসফিস করে পম্পা জিজ্ঞেস করে ।
আছে। কোনো মতে কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দেয় ফেরিওয়ালা ।
আমিতো রিডাকশন দিলাম , তুমিও দাও ।পম্পা ফেরিওয়ালার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে ।
আচ্ছা। খেলায় মগ্ন ফেরিওয়ালা জবাব দেয়।
আশি টাকায় তাহলে দিচ্ছো শার্টটা ।পম্পা নিশ্চিত করার ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে ।শরীরের চরাই উৎরাইয়ে হারিয়ে যাওয়া ফেরিওয়ালা কথা নাবাড়িয়ে উত্তর দেয় –হ্যাঁ ।
অন্ধকারেও পম্পার মুখে তৈরি হওয়া আলো ব্যালকনিতে ছড়িয়ে পড়ে । এ যেন এক বিজয়িনীর হাসি ।পম্পা ইচ্ছে করেই ফেরিওয়ালার মুখটা সযত্নে বুকে টেনে নেয় ।



কিছু অসংলগ্ন দৃশ্য
 মেঘমালা দে মহন্ত 

দৃশ্যঃ ১

উৎসবে মেতেছে গোটা কাশীপুর গ্রাম । অনেক পূজা-পার্বণ-ব্রত-হুজুগের একঘেয়ে জীবনে নতুন কিছুর আয়োজন । গ্রামের শিক্ষিত ছেলেরা মিলে গড়েছে গো-রক্ষা সেবা সঙ্ঘ । জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে স্বদেশ ।সেই ছেলেরাই এবার করবে গো-সেবা উৎসব কাশীপুর গ্রামে ।একঘর মুসলমানের হিন্দু-গ্রাম কাশীপুরে সাজো সাজো রব । বাদ যায়নি সেই ‘একঘর’ও।গফুরের মহেশকে বাছা হয়েছে গো-সেবা সম্প্রিতীর প্রতীক করে ।

দৃশ্যঃ ২

তিনদিন বিছানায় পড়ে আছে গফুর ।খিদে পেটে জ্বরের ঘোরে কখনও প্রলাপ বকছে জোর – কখনও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে প্রায় ভেঙ্গে পড়া ঘরের বাঁশের বেড়াগুলোর দিকে –আবার কখনও মড়ার মতো পড়ে রয়েছে বেহুশ।ভাগ্যিস বৃষ্টি হয়নি এই ক’দিন । তাই বেহুঁশ হয়ে অন্তত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা নসীব হয়েছে নয়তো বাপ-বেটিকে ঘরের কোনে গুটিসুটি বসেই সহ্য করতে হত বৃষ্টির দাপট । আমিনা গত দু’দিন ঠায় বসে আছে গফুরের কাছে ।প্রথম দিন মেয়েটা এদিক ওদিক সারা গ্রাম ঘুরেছে বাপের জন্য সামান্য ঔষধ-পথ্যি জোগাড়ের চেষ্টায় ।সুবিধে করতে পারেনি কোথাও ।গোটা গ্রাম ব্যস্ত জীব-প্রেম উৎসব আয়োজনে । শুদ্ধতা রক্ষার রক্তচক্ষুতে দিশেহারা হতাশ আমিনা ঘরে ফিরে এসেছে লোলুপ কিছু দৃষ্টি গায়ে মেখে ।মেয়েটার দিকে তাকাতে পারেনা গফুর – বুকের যন্ত্রনা বেড়ে যায় ।কী হবে তার এই মা-মরা মেয়েটার !চালে খড়ের অভাবে ফুটে ওঠা টুকরো টুকরো অনেক আকাশ যে কোন সময় মিশে যাবে এক আকাশে –নড়বড়ে বেড়াগুলো যে কোন সময় ঘরটাকে মিশিয়ে দেবে খোলা দিগন্তে – যে কোন সময় গফুরও মিশে যাবে – কোথায়, গফুর জানে না ।শুধু জানে , একা এই ঘরে ঝড়-জল-বৃষ্টি-জ্যোৎস্না-অন্ধকার-রোদে-ক্ষুধায় খাদ্য হয়ে পড়ে থাকবে একা আমিনা ।হাড় সর্বস্ব বুকের খাঁচাটার ওঠানামা অস্বাভাবিক রকমের বাড়তে বাড়তে থেমে যায় এক সময় । পাশে বসে থাকে নিশ্চুপ হতবাক গফুরের ‘একা আমিনা’।

দৃশ্যঃ ৩

তিনদিন বিছানায় পড়ে আছে গফুরের ‘একা আমিনা’ ।তবে বাপ মারা যাওয়ার পর এই তিনদিন রোদ-জল-আলো-অন্ধকারে একা থাকেনি আমিনা ।গফুরের মৃত্যুর পরদিনই সশব্দে তাকে তুলে এনে গ্রামের শেষ প্রান্তে পাহাড় ঘেরা জঙ্গলের শুরু যেখানে সেখানে এই ঘরটাতে রেখেছে ছেলেগুলো ।তারা কারা আমিনা জানে না । শুধু জানে বাপ হারানোর একাকীত্ব ধারেকাছেও আসতে দেয়নি ছেলেগুলো ।অত্যচার-যন্ত্রনায় নীল আমিনা চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে ।তাকে ঘিরে চারপাশে চলে পাশবিক উল্লাস।
এভাবেই তিনদিন শেষে ভোরবেলা গ্রামের পরিত্যক্ত ভাগাড়ের ধার ঘেষে নদীর বাঁকে ভেসে চলে গফুরের ‘একা আমিনা’।

দৃশ্যঃ ৪

তিনদিন ধরে মহেশ সহ্য করে চলে স্বদেশ তথা জীব-সেবার ধকল । প্রহরে প্রহরে মাখানো তেল সিঁদুর চন্দনে একাকার গোটা শরীর । চাল-কলা-ফলের জমানো স্তুপের গন্ধে গা গুলিয়ে আসে –কাঁসর ঘন্টা আর মাইকের বিকট আওয়াজে হতবাক মহেশের ভয়ার্ত চোখ তিন দিন গোটা গ্রামের ভিড়ে খোঁজে শুধু গফুর আমিনাকে ।ইচ্ছে করে ছুটে পালিয়ে যায় কিন্তু মাথায় লালফেট্টি বাঁধা লাঠি হাতে ছেলেগুলোকে দেখে ভরসা পায় না। নিস্তেজ পড়ে থাকে ।
তিনদিন তিনরাত উৎসব শেষে খুলে দেয়া হয়েছে জরি জড়ানো মহেশের বেঁধে রাখা দড়ি ।গলায় ফুলের মালা, সিঁদুরের টিপ কপালে দিগন্তে মিশে যাওয়া বাড়িটা খুঁজে চলে গফুর-আমিনার ‘একা মহেশ’।




৩ টি অনুগল্প 

বই

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ 

দুপুরের ভাত খেয়ে বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিলেন অমরেশ বাবু।

সাত পাঁচ ভেবে টেবিল থেকে  গল্পের বইটা আবারো হাতে নিলেন। বইটি কি করে তার বইয়ের তাকে আসলো সেটাই দুদিন ধরে মনে করতে পারছেন না। অথচ গল্পগুলির জন্য লেখককে কুর্নিশ জানানোর প্রবল ইচ্ছে...

ফোনের রিংটোন বাজতেই থতমত হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন অমরেশ বাবু। বুকের ওপর থেকে গল্পের বইটি টেবিলে রেখে জলপান করতে করতে রাস্তায় চেঁচামিচি শুনতে পেলেন।

চশমাটা চোখে দিয়ে চেঁচামিচি উৎস খুঁজতে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলেন। কিছু মানুষ জটলা হয়ে রয়েছে।তাদের ঠেলে সামনে যেতেই চমকে উঠলেন। রাস্তায় পড়ে রয়েছে তার থেথলানো দেহ।হাতে সেই গল্পের বই...



অভিমান



রতন টাকাটা চুরি করলো । তুমি কিছু বলবে না ।
-কি বলবো ? নিয়েছে তো তর ভাই । ভাইয়ের টাকা ভাই নিয়েছে । এতে বলার কী আছে ।
-বা । জিজ্ঞেস না করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেল । মদ গাঁজা খেয়ে অতগুলো টাকা উড়িয়ে দেবে । টাকাগুলো যে রান্নাঘরটা মেরামত করবার জন্য বেশি সুদে এনেছি । সে দিকে খেয়াল আছে ।
-আ বেশি বকবক করিস না । এখান থেকে সরে পর ।
সুশীল আর কথা বাড়াল না । বুঝল এ সব কথা মাকে বলে লাভ নেই । সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ।
ঘড়ির কাটায় তখন ১০ টা । সুশীলের ছোট বোন রত্না বললো , মা তুমি বীনা দোষে দাদাকে বকলে । রতনের দোষ । অতগুলো টাকা চুরি করলো ।তুমি কিছু বললে না ।
-কি বলবো বল । সুশীল শান্ত ছেলে ।মা বকলে কিছু বলবে না । চুপ করে থাকবে । আর রতন জানোয়ারটা কে কিছু বললে তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাড়বে ।
-তাই বলে সবসময় ...
ভোরের আলো চারধারে ছড়িয়ে পড়েছে ।সুশীল রাতে বাড়ি ফিরেনি । সুশীলের অপেক্ষায় মা সারারাত উঠোনে পায়চারি করে কাটিয়ে দেয় ।সারা মুখে চিন্তার ছাপ । ছেলেটা না খেয়ে সারারাত কোথায় ছিল এসব চিন্তা তাকে জর্জরিত করছিল । এমন সময় সুশীলের বন্ধু শৈলেন দ্রুত দৌড়ে বাড়িতে ডুকলো । হাফাতে হাফাতে বললো । মাসিমা দ্রুত আমবাগানে চলুন ।
কেন,হঠাৎ আমবাগানে । কি হল ।
সুশীল আমবাগানে ফাঁসি দিয়েছে


কবি


রৌদ্রদগ্ধ আয়নায় ক্যালেন্ডারের শনির চিত্র ফুটে উঠতেই কবি তৃপ্ত কন্ঠে ঢেকুর তুললো।কবির জংশন নাকি ইদানীং খুব সরগরম চলছে। পুরোনো স্নেহগুলি মাড়িয়ে সদ্য প্রেম করতে শিখেছে।
বিকেলের হাওয়ায় কলার উঁচিয়ে বাইকের তুমুল গতি তুলে দীপ্ত কন্ঠে কবি বলতে লাগলো 'এবারের সংখ্যাটা প্রকাশের আগে ফেইসবুকে ঝাক্কাস একটা বিতর্ক বাধাতে হবে।যেন তরতর করে ছড়িয়ে পড়ে ম্যাগাজিনের নাম।'

নির্মল পেছনে বসে নিশ্চুপ হয়ে কথাগুলি শুনছিল। বন্ধুর লেখালেখি নিয়ে তার ততটা মোহ নেই। কবিতা কবিতা করে ভবঘুরে হয়ে বন্ধুর জীবনটা নষ্ট হচ্ছে এমন একটা বদ্ধ ধারনা তার। নির্মল আলতো করে বললো 'কবিতা না বাল।এই সব নিয়ে কতদিন জীবন চালাবি। নিষ্কর্মা দের কাজ হল কবিতা নিয়ে পড়ে থাকা। কতদিন বললাম মিছিল মিটিংয়ে আয়। এতদিনে ঠিক কিছু একটা হয়ে যেত'
কবি এক মিলিয়ন হাসি উড়িয়ে বললো 'তা যা বলেছিস।আরতো ছয় মাস।এরপর তোর কি হবে। মিছিল মিটিং করে তোর কি হল।'
নির্মল আর কথা বাড়াবার সাহস পেল না। এক কথায় সে যেন জব্দ হয়ে গেল।

২)

বাইক থেকে নেমে প্রেসে ঢুকতেই কানে আসলো '১৮ তে বামফ্রন্ট সরকার আইতাছে ফিরিয়া' গানটা।ভোটের বাজারে এইসব গান এখন মুড়িমুড়কি মত অলিতেগলিতে ভেসে বেড়ায়।গানটা গুনগুন করেই কবি ভেতরে ঢুকলো। প্রেসে ডুকতেই দেখতে পেলেন গৌতম বাবুকে। গৌতম বাবু একটি অনলাইন ম্যাগাজিনের  সম্পাদক।
গৌতম বাবু কবিকে দেখেই বলে উঠলেন  'এই যে ইয়ং বয়েজ। লেখাজোঁকা কেমন চলছে। '
কবি গৌতম বাবুকে দেখে বললেন ' আপনি এখানে। আমিতো এলাম এই দশক ম্যাগাজিনের নতুন সংখ্যা কপি গুলি নেবার জন্য।কাল প্রকাশ হবে।'
গৌতম বাবু বললো 'বাহ!দারুণ খবর। শুনে ভালো লাগলো।চালিয়ে যা। কোন দরকার লাগলে অবশ্যই বলবি।'
কবি হেসে উঠে। গৌতম বাবুকে পুরোনো একটা কথা মনে করিয়ে বেশ লজ্জায় ফেলে দিল। সে বললো ' গত সংখ্যায় লেখা চেয়েছিলাম। অনেক ঘুরিয়ে দেবেন দেবেন বলেতো দিলেন না।এরপরে কি আশা করা যায় বলুন'
কবির কথা শুনে বেশ ইতস্তত হয়ে গৌতম বাবু বললো ' সেবার এত ঝামেলায় ছিলাম সত্যি সময় করে উঠতে পারিনি। '
'তা যা বলেছেন। কলকাতা পত্রিকা গুলিতে তখন আপনার ডজন ডজন লেখা প্রকাশ পেল।আর আমরা চাইলেই বাহানা করছেন।'
কবির মুখে এমন কর্কশ কথা  শুনবে বলে আশা করেনি গৌতম বাবু।তিনি আর কথা বাড়ালেন না।দু এক কথা বলে সেখান থেকে সটকে পড়েন।

৩)

ম্যাগাজিনের কপি গুলি ঠিকঠাক বুঝে নিয়ে কবি বাইরে এসে দেখতে পেলেন নির্মল দিব্যি ফোনে কথা বলতে বলতে সিগেরেট টানছে।
' এই তাড়াতাড়ি চল।মিছিল আসছে এপথে।দ্রুত বেরিয়ে  যেতে হবে।মিছিলে আটকা পড়লে কত সময় লাগবে কে জানে' কবি কথা গুলি আওড়াতে আওড়াতে দ্রুত বাইক স্টার্ট করলো। মুহুত্তে পেছন থেকে ভেসে এল একটি কর্কশ শব্দ।

৪)

চোখ খুলে কবি দেখতে পেলেন গৌতম ট্রাকের চাকার নিচ থেকে তার দুটুকরো দেহটা টেনে বের করছে।




No comments:

Post a Comment