Saturday, March 24, 2018

দুই লেখক দুই দিক শামীম রেজা ও সমীরণ ঘোষ

আলোচনায় : সব্যসাচী হাজরা 


১।“আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে কত পুড়েছি মন
ঘুমের মধ্যে কারা জেব্রারক্ত ঢুকিয়েছে শরীরে
তুমিও জানো না যে, দেশলাই জ্বালিয়েছো কখন;
শুধু ছুটতে ইচ্ছা করে তোর ভূমি থেকে প্রান্তরে।”

হাতে আছে ‘ক্রৌঞ্চ দ্বীপ” সিরিজের এক ফর্মার বইগুলো।সেখান থেকে প্রথমে টেনে নিলাম একটি বই। লেখক:শামীম রেজা। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে সবসময়ই  মনে হয় সমাজ নামক শব্দের গভীর উচ্চারণ তাঁর কলমে। সমাজের প্রতি যেন লেখকের এক দায় আছে। তাঁর লেখায় সেই ছবি বিম্বিত হতে দেখি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখায় এসেছে গণতন্ত্রের উত্থান প্রসঙ্গ, এসেছে অবক্ষয় ও শোষনের কথা, আবার কখনো দেখা গ্যাছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আলো। কবি সময়-দেশ বিচ্ছিন্ন নন। স্থান ও কালের চিহ্ন তাঁর কবিতায় অতিমাত্রায় স্পষ্ট। আবেগমথিত এক কাব্যিক উচ্চারণ তাঁর লেখার এক বিশেষ দিক। বিষয়গত উপস্থাপনায় তিনি হাজির করেন সময়ের রুক্ষতাকে, পেলবতাকে। আঞ্চলিক কথ্যভাষার সাথে ভাষার প্রমিত রীতির ব্যবহার  তাঁর কাব্যভাষার এক বিশেষ দিক। ইতিহাস, সমসাময়িক ঘটনা, নারীদের অবস্থান, দেশ, সমাজের আলো-আঁধার, স্বজন, সম্পর্ক, অত্যাচার ও বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা তাঁর কবিতার প্রধান সম্পদ। অতি কথায় মোড়া এই লেখায় আমরা পাই স্পষ্ট এক মেসেজ। যা তাঁর লেখালিখির অভিপ্রায় বলেই মনে হয়। ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার জন্য মানুষকে তিনি মুখ ও মুখোশের সামনে নিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর।  শামীম রেজার লেখায় সেই যুগ ও সমাজসচেতনতা পরিলক্ষিত হয়।  ছন্দ নিয়ে প্রচলের বাইরে তিনি বেরতে চেয়েছেন বহুবার। ভাঙা ও গড়ায় নিজের মতো করে তাঁর এগোনো।  একবার তাঁর লেখা ‘আমি ও ঈশ্বর’ পড়ে চমকে উঠেছিলাম।যাই হোক এইসব টেকনিকাল কথার বাইরে তাঁর ‘দেশহীন মানুষের দেশ’ থেকে একটি লেখা:

মাগো তোর ষোল/শামীম রেজা



জল পুড়ে যাচ্ছে, মন পুড়ে যাচ্ছে; দেহ?

অথচ আগুন নেই , বস্তুত সন্দেহ

চেরাজিভ লজ্জা দেখে ফেলে হাসে; সাপ!

বাস্তুসাপ ঘর বেঁধেছে মনের ভিতর ঘাসে।



মাগো তোর ষোল, হৃদয় ছিল টলোমলো

নয়মাস আমি তোর পেটে, একটু একটু আমারও মনে আছে

রক্ত-নীল, সেই নদী এখনো দুচোখে ভাসে

ফতোয়া বাজির; ঘৃণাবুকে কাঁটার মালার সাজে

প্রতিবেশিরা গর্ভবতীকে বেত্রাঘাতের পরে

ভাসিয়ে দিয়েছে , বিষখালির অথৈ ধূসর জলে।

আফিম ফুলের থেকে রেণু দিয়েছিল বীরাঙ্গনা তোকে

ভাঙা হারমোনিয়ামের মতো পাঁজর বাজিয়েছে লোকে

মাগো তোর পরনে শাড়ি ছিলনা কোনো

লাশ দেখে ছিল মুক্তিকামীরাও, মনে ছিল সন্দেহ

উদ্বাস্তু নদীটা তুইতো জানিস শঙ্খলাগা মাকে

নাভিমূলে কম্পোমান আমারই দেহ, একলা একলা দোলে

মাগো এখনো লাঞ্ছিত নদীটি গর্জন দিয়ে বোবা কথা বলে

মুখোমুখি আমি তুমি মৃত শয্যা জলে

বেঁচে গেছি এমন পৃথিবীতে চোখ খুলিনি বলে।

২।আমি তাঁর পাঠক অনেকদিনের। সে সুর আমার ভেতরে ভেতরে। এক অন্তহীন অতীতকে তিনি জুড়ে দ্যান তাঁর মগ্ন উচ্চারণে। আদিম উৎস থেকে বহমান  সেই কথা যা সামনে দাঁড়ায়। ঘুরিয়ে দ্যায়। বলে “ঐ দ্যাখো”। “ঐ তোমার হেঁটে আসা।” মুহূর্তের প্রজ্জ্বলন থেকে আবার ছুটে যায় ঘোড়া। আমাকে নিয়ে আমার অতীত দ্যাখাতে। টের পাই  ইতিহাস-চেতনার আলো-ছায়াগুলো। সময় জুড়ে যায় ফেলে আসা সময়ের শেষে।

কখনো কালো পাথরে খোদাই করা নগ্ন দেবীর অবয়ব থেকে অসংখ্য অবয়বের দিকে যেখানে আমার মা, আমার প্রেমিকা, আমার মেয়ে,  অথবা আমার সহবাসের অংশীদার।

আমি দেখি কখনো বনদেবী, কখনো সংহারমূর্তি, কখনো জগৎ-পালিকা, কখনো বা অতি প্রাচীন শিলায় খোদাই করা কোনো মেয়ের প্রত্নমুখ। আবার কখনো স্নানঘরে কেউ চুড়ির আওয়াজে কম্পনের লেখচিত্রকে বদলে দ্যায়।
“চমৎকার মৃতদেহ কোলে কেউ এক পদ্মাসনে বসে”।

কোলাহল ও নির্জনতাকে যিনি জুড়ে দ্যান, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থান থেকে গড়িয়ে নামে পর্যটকের চোখ, প্রাচীনস্বর থেকে যা আজকের সময়ে খুলে দ্যায় আলো থেকে কালোগানগুলো, ঘানির অতলে খুঁজে পাওয়া মহাপ্রাণ। সেই গান কাঠের নয় যেন কালো পাথরের।

যুদ্ধনগর, আপেল-বণিক, কালো জাদুকর, সুদূরকালো মেয়ে…

এক অন্ধকার, প্রাচীন থেকে আজ,  তন্ত্র, মন্ত্র যেন যন্ত্রের গা বেয়ে এক সময়হীন সময়ের যাত্রা। যে ছিলো সে আছে শুধু রূপের বদল ঘটেছে তার।

“কাচের ঘরে পাথরের কালো হারমোনিয়াম।” সেখান থেকে “কালো পাথরের ঘরে কাচের হারমোনিয়াম”।

সত্যি এই ভেসে যাওয়া পরিণামহীন। যা ভাসতে থাকে,  শেষ পর্যন্ত ভাসতেই থাকে।

এই হচ্ছে সমীরণ ঘোষ।
বইটির উৎসর্গের পাতায় দেবকুমার সোম, সজল রায়, সব্যসাচী হাজরা, শঙ্খদীপ কর, জয়দীপ মৈত্র, সজল দাস

এ আমার বড় পাওয়া সমীরণদা। বইটি থেকে একটি কবিতা সবার জন্য-

কালো পাথরের হারমোনিয়াম-পাঁচ/ সমীরণ ঘোষ



কালো শ্লেটের চেয়েও কালো গান গাইতে পারতে অনায়াসে

আমাদের কোটিপুরুষের শীতে পূর্বাপর লিপিবদ্ধ ছিল



থালায় চামচ ঠুকে আমাদের মেয়েরা যা রান্নাঘর থেকে

শুনেছিল। কাচের চুড়ি ঠুকে চানঘরে অস্ফুট মিলিয়ে ছিল গলা



আমাদের প্রেতাত্মারা আরও আরও মগ্ন সুরেলা

আমাদের দশাশ্বমেধ আরও আরও কাহিনিবিহ্বল



কালো গান, একমাত্র কালো গানের সাথে শুয়ে পড়েছিল

বাকি ইতিহাস। তারই চলন্ত এক শিলা অজান্তেই

পুঁতে ছিলে আমাদের ভূপৃষ্ঠার ভেতর



প্রচ্ছদ:সমীরণ ঘোষ
প্রকাশনী: ক্রৌঞ্চদ্বীপ
প্রকাশক:স্নেহাশিস রায়
বিনিময়:৩০টাকা

No comments:

Post a Comment