Thursday, March 29, 2018

খনন করিডোর  

স্টিভ ও  এবং আমাদের নব্বই দশক কে যারা ভালোবাসেন তাঁরা জানেন । ওঁর আত্মজীবনীর নাম “আউট অফ মাই কমফোর্ট জোন”। স্বস্তিকে আমরাও সীমানার বাইরে রেখে মুখোমুখি বসছি । কবি , সম্পাদক , সাহিত্যিক সকলকেই একে একে মুখোমুখিতে আসবেন , শুধু গতের কথা আর ছাঁচের কথা নয়, বলা হবে কিছু মনের কথাও । নিছক সাক্ষাৎকার নয় বরং একে খনন বলা যেতে পারে, যেভাবে এই চৈত্রের দুপুরে জলের সন্ধানে মাটির অতল থেকে আরও অতলে খনন চলে , সেই ভাবে আমরা মানুষটিকে খনন করে যাব ।


ডুয়ার্সের মুজনাই চা বাগানের যে মেয়েটি চা বাগানের সবটা সবুজ নিয়ে আলিপুরদুয়ার জংশনে স্কুলের পড়াশুনো করতে আসত সেকি জানত তাঁর জীবন পাখির মত হবে । তাঁর অবিরল উড়ান প্রতিটা ডানা ঝাপটানোর শব্দ কি কঠিন অথচ কতই সহজ সাবলীল । তিনি কতটা নগরের কতটা চা বাগানের মেপে দেখেন নি এখনো । সবকিছুর মধ্যে থেকেও আবার কেমন যেন উদাসীন বাউল বাউল মন । নব্বই দশকের উল্লেখযোগ্য এই কবি শূন্য দশক থেকে যখন “পদ্য” করতে আসলেন তখন যেন বিচ্ছুরণ আরও বাড়ল । এখন শিলিগুড়ির লেকটাউন বাড়িতেই কত অজস্র পত্রিকার ঠিকানা,  শিলিগুড়ি ম্যাগ !  আমরা খনন করব এই রিমি দেকেই যার পয়সার দুটো পিঠেই কবিতা আঁকা ...
করিডোর - দশম শ্রেণিতেই নাকি আপনার বিয়ে হয়ে যায় , কিশোরী বউ থেকে আজকের রিমি কি করে পাড়ি দিলেন এই দীর্ঘপথ ?

 রিমি -   বিয়ের পর পড়াশুনো থামিয়ে দিই নি , নিজের চেষ্টায় পড়াশুনো করেছি , বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হয়েছি , তারপর বাংলা। অঙ্কুশ ভট্টের মত শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি। নাটক , রেডিওতে উপস্থাপনা সংস্কৃতি জগতে জড়িয়ে থাকার প্রবল ইচ্ছাটাই শক্তি জুগিয়েছে , আমি দুধের সন্তানকে নিয়েও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েছি শিলিগুড়ির অনেকেরই স্মৃতিতে তা আছে । তবে কবিতায় অবশ্যই আমি একটু বেশি বয়সে এসেছি ।


করিডোর - শিলিগুড়ি , কিরকম একটা গদ্যময় শহর । প্রধান অঞ্চলগুলোতে আবাঙ্গালি প্রাধান্য । ব্যবসা , টাকা , রুখাশুখা । এরমধ্যে কবিতার খোঁজ পেলেন কি করে ? এই শহর থেকে এতগুলো বছর কাগজ করার স্পর্ধা এল কোথা থেকে ?  

 রিমি -শুরুতেই খুব সুন্দর একটা প্রসঙ্গের অবতারনা করে অন্তরমহলের প্রদীপের
সলতেটা উসকে দিলে সব্য। যা তুমি বললে তা ১০০ভাগ সত্যি। তবে প্রথমে বলি 
আমি যখন নয়ের দশকের শেষার্ধে লেখালেখি শুরু করি তখন অতশত ভাবার মন ও
চোখ তৈরি হয়নি।একপ্রকার শাদা সারল্য নিয়েই লিখতে আসা।আর পাশাপাশি আমার মনে হয় যে পারিপার্শ্বিক ইট কাঠ পাথর  কোন লিখিয়ের 
কবিতায় শুরুর দিকে তত প্রভাব ফেলে না।লেখার তাগিদটাই আসল।যা বুকের ভিতরে চিনচিন বেদনা তৈরি করে।ওই তাগিদই ক্ষত,যা লেখায়। চারপাশ পরে আসে।
অনুসঙ্গ হিসেবে। যদিও এক এক জনের কবিতা একেক
রকম ভাবে নির্মিত হয়।তবু সামান্য অভিজ্ঞতায় আমি বিশ্বাস করি,একজন লেখক হৃদয়ের গভীর থেকে তাড়িত না হলে কবিতা লিখতে আসেন না।জীবনের অভিজ্ঞতা অনুভবের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির চোরা স্রোতধারায় সিক্ত হয়ে ভিতরে দোলা না জাগালে
কবিতা জাগে না। সে দোলায় হর্ষ বিষাদ হাহাকার আনন্দ জীবনের যা কিছুই লেগে থাকুক না কেন! এই নাড়িয়ে দেওয়া রক্ত শিকড়ের। এ সুধা প্রাণের।এ সুধা সত্যের।
   সৃজন কখনো বানিজ্যের তোয়াক্কা করে না। তুড়ি মেরে সে উড়িয়ে দিতে পারে  
মোহ, উল্লাস আর কম্প্রোমাইজ। পদ্যের জন্মের আগে প্রচুর কাগজ এ শহরে হয়েছে।পরেও হবে। এবিষয়ে
আমি আশাবাদী। সবচেয়ে বড় কথা কোনো লালসা নিয়ে পদ্য আসেনি। প্রচুর বিঘ্ন
সত্বেও পদ্য বিরতীবিহীন। কাজেই আর্থিক প্রাচুর্যের শহরে থেকেও অর্থকে অর্থহীন  ভেবে  পদ্য আঠেরোতে পা রেখেছে।এত লড়াই করার মনের জোর কত কতদিন থাকবে জানিনা!ইচ্ছাশক্তির কাছে স্বপ্ন কতটা পৌঁছবে তাও জানিনা।তবু চলছি! আমাদের ডারুইন বলে গেছেন না, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম!ঐ আর কী! 

করিডোর - শিলিগুড়িতে আমরা দেখি সকলে (সাহিত্যপ্রেমী , কবিতাপ্রেমী রা) বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত । পদ্য ও তার সহযোগীদের এই দ্বীপ সংস্কৃতি কতটা দগ্ধ করে ?

রিমি -গল্পটা ঠিক ধরেছ। ঐতিহ্যের শহর কলকাতাতেও এই দ্বীপ সংস্কৃতির 
প্রকাশ্য সমাবেশ এত নেই।অথচ শিলিগুড়ি পাহাড়, নদী, জঙ্গল,চাবাগান,উড়ো মেঘ সঙ্গী করেও এমন অসুখের শিকার। 
 শুরুর দিকে পদ্য এসব বোধের ঊরধে ছিল। খোলামেলা
ও মিশেল মন নিয়েই পদ্য শুরু হয়েছিল। কিন্তু চলতে চলতে দেখলাম এটা কষ্টকল্পনা !!কারণ বাস্তব অন্য কথা বলে। এক সুরে কথা বললে ধোঁয়া ওড়ে অন্য সুরে।সেই ওড়ায় প্রকৃত আমি অন্য হয়ে যাই।অথচ সেই অন্য আমি কিছুতেই নই!চলার পথের দুধারের মুখ ও মুখোশের সাজ  মৃদু টের পাই, কিন্তু বিশ্বাস
করতে চাই না! তোমার ভাষায় বলি, দগ্ধ হই দগ্ধ হই! তারপর নিজেই নিজের
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। জর্জরিত হই নিজেরই প্রশ্ন বাণে! 
ঠিকই বলেছ, শিলিগুড়ি অন্যরকম। থাক না! দ্বীপ হয়ে! নিজের কাজটাতো
চার দেওয়ালের মধ্যেই করতে হয়। এটাও একটা পথ। যত মত,তত পথ।কী বলো
তুমি!কাজেই অসুখ না বলে একে সুখ ভেবে নিয়েছি।   

করিডোর - ৯০ দশকে যখন কবিতায় এলেন তখনকার সঙ্গে আজকের কবিতায় যারা এসেছে মানসিকতায় কতটা মিল পান ?

রিমি - দেখো, আমি প্রকাশ্যে একটু বেশী বয়সেই ্লিখতে এসেছি। ভৌগোলিকভাবে
আমি উত্তরবঙ্গ তথা শিলিগুড়িতে বসবাস করি একথা ঠিক।কিন্তু আমি মনে করি
আমি বাংলার। তবে সবার সাথে মেশার তেমন সুযোগ যেমন সবার ঘটে না,আমারও ঘটেনি।আর আমরা যখন লিখতে এসেছি তখন আমাদের মুঠোয় না ছিল আন্তরজাল,না ছিল ভার্চুয়াল পরিমন্ডলের জরিবুটি। পাতিরাম ছিল শুধু।চিনতামও না কাউকে।আর মফস্বলে থাকা
লিখিয়েদের পথ বাধার পাথরে ভর্তি থাকে একথা কম বেশী সবার জানা। ।শুধু লেখা পাঠানো ছাড়া আর কোন কাজ শিখিনি।লিখেছি আর পাঠিয়েছি।  এখন কিছু কম লিখলেও
একসময়  বাংলার প্রতি জেলার গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলোতে লিখেছি।মূলত আমি ছোট কাগজেই লিখি।সমসময়ের লেখখদের সাথে আমার লেখার মাধ্যমেই পরিচয়। আর ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা যদি বলো, তবে বলব বন্ধুরা বন্ধুই থেকে যায়। সাময়িক দূরত্ব তৈরি হলেও জগতে কিছুই হারিয়ে যায় না। সব থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে
হয়তো সামান্য রূপান্তর ঘটে।আজ যারা লিখতে এসেছেন তাদের লেখালেখির
সংগ্রাম আগের তুলনায় আমার কম বলে মনে হয়,ভুলও হতে পারি! তবে বিতর্কে না গিয়ে বলি, বিশ্ব যখন হাতের মুঠোয়, তখন যোগাযোগ কে আটকায়! শুধু সৃষ্টি সম্পদ
যথাযথ হলেই হল।আমরা যা করতে পারিনি, পারিনা,এই সময়ের তরুণ তা সাফল্যের সাথে করে। পিছিয়ে পড়ি,তবু নিজের বিশ্বাস আঁকড়ে থাকি।থাকবো।শুধু একটাই প্রার্থনা,যেন লিখে যেতে পারি!! বাকিটা আমার হাতে নয়।    

করিডোর - পদ্য আর রিমি দে সমার্থক । কবি কি কোথাও তার পত্রিকায় হারিয়ে যান , অন্তত সম্ভাবনা তৈরি হয় কি ?

রিমি -২০০১ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী পদ্য র পথ চলা শুরু। আমি লিখতে শুরু করেছি নয়ের 
দশকে। আর এটাও বলি এবং অনেক জায়গায় বলেছি যে, নিজের লেখার জন্য
পদ্য নয়। আমি পদ্য তে কম লিখি।লিখলেও কম জায়গা নেই। আসলে সবাইকে নিয়ে কাজ করার মধ্যে
আনন্দ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই রয়েছে।জল যেমন সমস্ত বাধা অতিক্রম করে নিজস্ব গতির
ডানা মেলে কুলুকুলু বয়ে যায়, মনে হয় পদ্য শুধু কেন, স্বাধীনভাবে চলতে চাওয়া
কাগজগুলো এমন মানসিকতাই বহন করে।এর সাথে ব্যক্তিলেখার কোন সম্পর্ক আছে
বলে আমি মনে করি না।লেখকসত্বা আর সম্পাদক সত্বার বিরোধ কোথায়!আমি বিশ্বাস করি এবং নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি, আমার নিজের লেখার ও লেখার জায়গার এ পর্যন্ত সংকট তৈরি হয়নি। কাল কি হবে জানিনা।নিজের লেখা ও পদ্য থাকতেও পারে ,নাও পারে।বরং সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।

করিডোর - ফেসবুক বিস্ফোরণ সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি । পিছিয়ে পরার ভয়ে আমরা সদা সতর্ক । কতটা উৎপাদনশীল এই চর্চা ?

রিমি -এ বড়ো কঠিন প্রশ্ন! সময় আমাদের ফেসবুক দিয়েছে। সময় কতটা ফেসবুক নেবে
তার জন্য সময়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাতে হবে বলে আমার মনে হয়।আবার চর্চাকে অস্বীকারই বা  করি কী করে? প্রযুক্তির উন্নতি কে না চায়! তবে ফেসবুক চর্চার চাইতে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ব্লগ চর্চা ও ই ম্যাগাজিনকেই বেশি গুরুত্ব দেই।
আগামী আসলে কী নেবে জানিনা আমরা। তবু বলতে ইচ্ছে হয়, ভার্চুয়াল আর  রিয়াল দুটো যে ভিন্ন তা আমরাই আবার বিস্মৃত হই। স্ফট আর হার্ড দুটো কপিই
সমান্তরাল ভাবে চলুকনা! অসুবিধে কোথায়?তবে বইয়ের ঘ্রাণ,মেলার হুল্লোড়,  ধুলো,ভীড়,আড্ডা, ঘামের গন্ধ, রক্ত,চামড়ার  ছোঁয়া হারিয়ে যাক তা চাই না। কিছুতেই চাইনা।

করিডোর - কোনও অপ্রাপ্তি , কিছু না পাওয়া যা হতাশা জাগায় , আছে কি এমন ?

রিমি -যদি এক কথায় বলতে বলো, আমি বলব, না। বিস্তারে অনেক বলতে হয়। যদি
বলি তাতে আমার শ্ত্রু তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে  যা এখন চাই না আর!তার চেয়ে বরং কাজে হাত দেই মহানন্দে!আরো বলি যে,  
 পদ্যর প্রতি সংখ্যা প্রকাশ পাবার পর আমি ভীষণ অসন্তুষ্টিতে ভুগি।
নিজের কাজকে নির্ভুল করতে না পারার ক্ষত যন্ত্রণা দেয় বড্ড আমায়।   

করিডোর - নারীর সম্পাদিত কাগজ তার কি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন আছে , নাকি এভাবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকেমাত্র ?    

রিমি -সৃষ্টিসূত্রে আমরা নারী পুরুষ বন্ধনে আবদ্ধ।দুই লিঙ্গের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট যা বিজ্ঞান নির্ভর।এর বাইরেও যা ঘটছে তাও ইতিমধ্যে সমাজ ও আইন স্বীকৃত। নারীর সব খুঁটিনাটি কি
পুরুষ অনুভব করেন কিংবা পুরুষেরটা নারী! আমি বিশ্বাস করি এরা একে অপরের
প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে মানুষ সভ্যজগতে পদার্পণ করতে পারত না।আদি থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজে যা কিছু ইতি নেতির মধ্য দিয়ে মানুষ হেঁটেছে তা সম্পূর্ণ সভ্যতার অগ্রগতির প্রয়োজনে! নর নারী্র নীরব পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকলে আজ এই পর্যায়ে আমরা আসতে পারতাম কি? নিজ নিজ বৈশিষ্ট নিয়েও আজ নারী পুরুষ  সমাজ সংসারে সমান গুরুত্বপূর্ণ ।কাজেই ভেদাভেদের কোন প্রশ্নই আসেনা! নারী বলে শুধু নারীর কথাই বলব এমন ধারণা আমি পোষণ করি না।এই সময়েই কিছু কাগজের পুরুষ সম্পাদক আছেন যারা শুধু নারী লেখক নিয়েই কাজ করেন নিষ্ঠা নিয়ে।আবার
মহিলা সম্পাদক হয়ে যদি তিনি নারীর কথাই বলবেন বলে স্থির করেন, তাতে
সমস্যা  কোথায়? প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে নিজস্বতা নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন।
এখানে বিন্দুমাত্র চাপিয়ে দেওয়াকে মেনে নেব না।     


# কবিতা করিডোর এর পক্ষে রিমি দের সঙ্গে কথা বলেছেন সব্যসাচী ঘোষ 

No comments:

Post a Comment