Saturday, March 24, 2018

নিবিড় পাঠের আকাশচুম্বন :


১মুসাফির এবং তার আত্মকাহিনী ~ প্রিয় চিন্তাবিদ ও কবি পীযুষকান্তি বিশ্বাস রচিত কাব্যগ্রন্থ 'আকাশ,চুম্বন' পড়ার পর এই শিরোনামটিই দিতে ইচ্ছে করলো।আসলে আমরা সকলেই পথিক || সকলেই মুসাফির ||, তবু কজনই বা পথ চলতে চলতে ~ চলার কথা লিখি? লেখা দিয়ে আকাশ-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারি, চুমু খাওয়ার বাসনা-কে লালন করে যাপনের পরিচর্যা করতে পারি।এখানেই এই কাব্যগ্রন্থের স্বপরিচিত ডিসকোর্স ~ কবি এখানেই স্ব-আলোকে মহিমাময় বৈরাগীও বটে।মোট ৫১টি কবিতা বইটিতে রয়েছে, ৬টি সিরিজ কবিতা নিয়ে।প্রতিটা কবিতাতেই সেই পথ হাঁটার গল্প ~ পরতেপরতে আকাশকে চ্যালেঞ্জ।এখানে আকাশ কোনো বিমূর্ত আকৃতি নয়, সে এখানে সামাজিক - অর্থনৈতিক - রাজনৈতিক কাঠামো এবং তা ভীষনভাবেই।সে এখানে বিশ্বায়নের চৌকাঠে দাঁড়ানো হাইরাইজ বিল্ডিংগুলির মাথায় থাকা দূরত্ব।যার কথা, যার আগ্রাসী আকার-আকৃতি-আয়তন ক্রমাগত ধাক্কা মারে আমাদের বোধ ও অনুভূতির বলয়কে।কবিতাগুলি পড়তে পড়তে কখন যেন নিজের অজান্তেই দেওয়ালে ঝুলতে থাকা ছায়াহীন আয়নাটাকে সরিয়ে দেবার ব্যর্থ প্রয়াস।নিজস্বতার অজান্তেই দেখি প্রকৃত স্বরুপ ~ গুটিগুটি নাঙ্গা পায়ে জড়ো হই সেই মিছিলটার শেষ কানায়।যেখান থেকে শুরু করা যায় প্রাণের আদিমতম প্রকাশের চিৎকার।
যেমন : ১ম কবিতা 'হাইওয়ে' ~ "যেভাবে একের পর একটা মাইলস্টোন আসে / গতিবেগকে পিছনে ফেলে আগে বেড়ে যায় হাইওয়ে, / প্রত্যেকটি পথ তাই আরো পঞ্চাশটি অন্ধকারের গন্তব্যের রকমফের / প্রত্যেকটি অন্ধকারকে আরও ঘন করে তোলে / এক একটি জঙ্গল / হে প্রভু আমার ঘুম আসে"
আবার 'মানচিত্র' কবিতাটিতে ~ "আমাকে চৌমাথায় দাঁড় করিয়ে / মিছিলগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় / ভিড় থেকে আলাদা হাঁটতে হাঁটতে, / জারা হাটকে, / একা হয়ে যাচ্ছি / নিজের থেকে দূর / শহর থেকে দূর ! "
আরেকটি কবিতা 'ইঞ্জিন' ~ "পেটে আগুন নিয়ে যে খেলাটা / স্পোকের অভাব টের পায় না / কোন চাকা আর"
কবি বর্তমানে দিল্লীবাসী।কর্মসূত্রে একজন পেশাগত সফটওয়্যার প্রযুক্তিবিদ।তাই তার কর্মব্যস্ততার অতি-গতিবেগ এবং রাজধানীর রাস্তা পরিক্রমা প্রতিটা কবিতাতে মিশে আছে।শুধু তাই নয়, তার পর্যবেক্ষণ আমাদের দেখায় বর্তমান সময়ের বাস্তবোচিত বলয়-কে।সুতরাং, কবিতাগুলি পড়ার পর এই দৃশ্যের সম্মুখীন না হবার কোনো উপায় আমাদের থাকে না ~ ক্রমশঃ ভারী হতে থাকে মস্তিষ্ক : সমস্ত চেতনা ১টি বৃত্তে রূপান্তরিত হয়ে ভার বাড়ায়।
কবিতাগুলিতে আরেকটি জায়গা খেয়াল করার মতো : তা হলো বাংলা ভাষার প্রয়োগ।হিন্দী বলয়ে থাকার দরুন ভাষার এক অভিনব মিশেলত্বের প্রয়োগ ~ যা বাস্তব এবং অতিমাত্রায় সহজাত।এছাড়া রয়েছে বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞান।যেমন ~ ১টি লাইন কবিতা 'অবতার' থেকে : "ওদের কথাগুলির শূন্য এবং এক-কে আমি দেওয়ালে আটকে আটকে / স্পার্সম্যাটিক্স বানাচ্ছি "
'খাজানা' কবিতায় ~ "কিছু কিছু শিকড় যদিও লবণের স্বাদ পায় না / 
কুকুরটি তবুও মোহনা অবধি / সঙ্গে সঙ্গে আসে।"
সফটওয়্যার থেকে নানান্ শব্দ-প্রতিশব্দ কবিতায় আসে ~ যেমন ল্যুপ বা এইচটিএমএল বা রিসাইকেল বিন।
শেষ করার আগে আরেকটি বোধ ও চেতনায় মিশে যাওয়া কবিতা 'ফির মুসাফির' থেকে কয়েকটি লাইন ~ "তাকিয়ে থাকি, / কী করে ভাতের দলাটা নামতে নামতে, / গলা ধরে আসে, কীভাবে / সেলুলোজগুলো ভেঙে হজম করে নেয় / আন্ত-প্রজাতির অস্তিত্বের সংগ্রাম।"
কবির আরেকটি পরিচয় শেষে না দিলে হয়তো লেখাটি অসম্পূর্ণ থাকবে।তা হলো আরেক প্রিয় কবি এবং চিন্তাবিদ দীপঙ্কর দত্ত শুরু করেছিলেন অনলাইন পত্রিকা শূন্যকাল।অত্যন্ত অকালে দীপঙ্কর দত্ত প্রয়াত হবার পর, পীযূষকান্তি বিশ্বাস বর্তমানে শূন্যকাল সম্পাদনা করছেন।সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ২০তম সংখ্যা।কবির সাহিত্যের প্রতি এই টান এবং সাহিত্যবোধ আগামীদিনে আমাদের অনুভূতিকে আরও বেশী জারিত করবে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।আকাশচুম্বন কাব্যগ্রন্থটি ২০১৬ সালে প্রকাশ করেছে অভিযান পাবলিশার্স।পার্থপ্রতিম দাস কতৃক প্রচ্ছদটিও চোখে পড়ার মতোন।


আলোচনায় : রাহুল গাঙ্গুলী

No comments:

Post a Comment