Wednesday, March 28, 2018

অনুগল্প 
আলোয় আলো
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল সুমনার । গলিতে দাঁড়িয়ে আধপাগলিটা হাঁ করে ওকে দেখছে । পাড়ার সবাই আবার ওকে আদিখ্যেতা করে কালী বলে ডাকে ।  আর বলবে না-ই বা কেন, গায়ের রঙ তো অমাবস্যার রাতকেও হার মানিয়ে দেয় । এদিকে সুমনার আবার রূপ নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার আছে । ফলে . . .
এই মাস তিন চার হল পাগলিটা এ পাড়ায় এসে জুটেছে । আর সুমনা লক্ষ্য করে দেখেছে, পাগলিটা অন্য সবার কাছে খাবার চায়, ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে । কিন্তু সুমনার কাছে কোনদিন কিছু চায় না । শুধুই নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে । আর এটাতেই সুমনার অস্বস্তি ।
কিন্তু এই মুহূর্তে অস্বস্তিটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না সুমনা । আজ তার ঋকের জন্মদিন । সন্ধেবেলা পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছে সে । যেতেই হবে । কিন্তু এই দু তিনটে দিন, মানে কালীপুজো আর তার আগে-পরের দিনগুলোতে সুমনা বাইরে বেরোতে চায় না । ওর বাজিতে আবার বেশ আতঙ্ক । ছোটবেলায় এক কালীপুজোর দিনে রংমশাল ধরিয়ে ওর বাপি হাতে দেওয়ার আগেই বার্স্ট করেছিল । আর তাতে ওর বাপির হাত পুড়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । সেই ভয়টা এতগুলো বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ।
ঋকের মুখটা ভেসে উঠতেই মনটা ভাল হয়ে যায় সুমনার । মাত্র ছমাস আগে পরিচয় । অথচ আজ সুমনার বুকের ভেতর একটাই নাম সবসময় রিনরিন করে বাজে । ঋক, ঋক, ঋক . . .
‘ঋক, বড্ড রাত হয়ে গেল । প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে । আর তুমি একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে ফেলেছ । ঠিক করে গাড়িটা চালাও । আর আমি তো তোমাকে বললাম, ক্যাব নিয়ে আমি চলে যেতে পারব ।’
‘আরে তুমি তো পারবে । কিন্তু আমার বার্থডে গিফ্‌টটা যে এখনও আমি পেলাম না । সেটা তো এখনই আমার চাই ডিয়ার ।’ জড়ানো গলায় হেসে ওঠে ঋক ।
‘এই, একদম কোন দুষ্টুমির মতলব না । বাড়ি এসেই গেছি । বাঁদিক করে সাইড করো । নামব ।’ গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলে সুমনা ।
সজোরে ব্রেক কষে গাড়িটার ঋক । তারপর বিশ্রীভাবে খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে । বলে, ‘দুষ্টুমির মতলব হতে যাবে কেন ? আমি দুষ্টুমি, গুন্ডামি সবই করব ।’
চোখে অন্ধকার দেখে সুমনা । পামেলার কথাগুলো মনে পড়ে যায় । ঋকের সঙ্গে মিশিস না । লেখাপড়া, রূপ, বড়লোক বাবা সব থাকলেও ওর মনের একটা গোপন অন্ধকার দিক আছে । যেখানে ও মেয়েদের এতটুকু সম্মান দেয় না । তাদের তছনছ করাই মূল উদ্দেশ্য । তখন ভেবেছিল ঋক রিজেক্ট করেছে পামেলাকে তাই ও হিংসে করে বলছে ।
ভাবনা কেটে যায় । দেখে ওর ওড়নায় টান পড়েছে । ঋক কুটিল দৃষ্টি নিয়ে হাত দিয়েছে ওর ওড়নাতে । আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে সুমনা । সজোরে ঠেলা মারে ঋককে । তারপরই গাড়ির দরজা খুলে সোজা দৌড় দেয় বাড়ির গলির দিকে । ঋকও ছাড়ার ছেলে নয় । মদ্যপ অবস্থাতেও ছুটে সুমনাকে ধরে ফেলে । সুমনা একবারই শুধু সুযোগ পায় চেঁচিয়ে ওঠার । পরক্ষণেই ঋকের ঠোঁটদুটো সুমনার চিৎকার বন্ধ করে দেয় ।
দমবন্ধ কয়েক মুহূর্ত । তারপরই সুমনার কানে আসে এক অমানুষিক গলার চিৎকার ।
‘অ্যাইইইই . . . শিগগির ছাড় আমার মেয়েকে । নাহলে তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব ।’
হতচকিত হয়ে ঋক ছেড়ে দেয় সুমনাকে । দুজনেই তাকিয়ে দেখে সেই আধপাগলিটা হাতে একটা কাটারি নিয়ে দাঁড়িয়ে । তার চোখদুটো যেন জ্বলছে । সুমনা যেন তার পরিত্রাতাকে দেখতে পায় । দৌড়ে আধপাগলি কালীর পিছনে লুকিয়ে পড়ে । আর ঋক নিজের বিপদ বুঝে তিলার্ধও দাঁড়ায় না ।
সুমনা অবাক হয়ে দেখে কখন যেন নিশ্চিন্তে সে ওই পাগলিটার বুকে মাথা রেখে দিয়েছে । তার মনের অন্ধকার ছায়া দীপাবলির আলোকেও ছাপিয়ে আলোকিত করে তুলেছে সেই মানুষটা ।

1 comment:

  1. চমৎকার লিখেছ মৌ। খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete