Wednesday, March 28, 2018

বিক্রয় 

মহসীন হাবিব


গেস্ট রুমে চারটি সোফাসেট চার রঙের। এক সেট লাল হলুদের মিশেল, একটি গাড়ো খয়েরি, একটি নীল আর  সাদা, অন্যটি সবুজ। চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই ফার্নিচারের দোকান থেকে কিনে এনে বসানো হয়েছে। সবগুলো মোলায়েম চামড়া দিয়ে মোড়ানো। সোফার ফাঁকে ফাঁকে ম্যাচ করা ছোট শ্বেত পাথরের নিচু টেবিল। টেবিল না থাকলেও চলতো। টেবিলের উপর কোন পত্রিকা নেই, চায়ের কাপ নেই। কিন্তু সোফার সাথে টেবিল অনেকটা নববধুর হাতে মেহেদী রাঙানোর মতই জরুরী। এসি রুম, মাথার উপর এসি চলছে। পৌষ   মাসের কাঁথা জড়ানো শীতের মত ঠাণ্ডা ঘর। অথচ বাইরে ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরম চলছে। গেস্ট রুমে দু’ঘন্টার অধিক সময় ধরে বসে আছেন ছয়-সাতজন মানুষ। এরা সবাই এসেছেন আকরাম সাহেবের সাথে দেখা করতে। কিন্তু ডাক আসছে না। র্দীঘক্ষণ অলস বসে থাকার কারণে কেউ কেউ হাই ছাড়ছেন।পনের বিশ মিনিট পরপর কোর্ট-টাই পরা এক যুবক এসে অকারণেই ঘরে ঢুকছে।  সবাই নড়ে চড়ে বসছেন। দু-একজন সাহস করে জ্ঞেস রছেন, ভাই কি খবর? যুবকের নির্লিপ্ত উত্তর, স্যার মিটিংয়ে আছেন ।
উত্তর পাশের সোফার এক প্রান্তে বসে আছেন  কামরুজ্জামান।  গায়ে সাদা ফনিফিনে পাঞ্জাবী। তাঁর শীত শীত লাগছে ।  কাচুমাচু হয়ে বসেছেন। ঘুমে চোখ ঢুলঢুল করছে। ঢাকার এই অফিসটিতে কেউ না চিনলেও ফরিদপুর  তাঁকে অনেকেই জামান মাস্টার হিসাবে চেনে।  পেছন থেকে কেউ কেউ ডাকে চ্যাতা মাস্টার। তিনি কোন স্কুল মাস্টার না। বছর বিশেক আগে ফরদিপুর পুলিশলাইন স্কুলে সংগীত শক্ষিক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের ছেলেমেয়েদের ওই স্কুলে তিনি ছয় মাসও টিকতে পারেননি।  শিক্ষার্থীরা বাদ্যযন্ত্রগুলোর সাথে  রাইফেল বন্দুকের মত আচরণ করতে থাকল। হারমোনিয়ামের চাবি, বিলো নষ্ট হতে থাকল প্রতিসপ্তাহে। তবলা সারিয়ে আনার পরদিনই নষ্ট হতো ক্ষীরণ, তার পরদিন  থাকতো চামড়ার ছাউনি ফেটে। এমনিতেই লঘু সঙ্গীতে মন নেই,  তার উপর কামরুজ্জামান গরম মানুষ। এক বান্দরের বাচ্চার গালে টাস করে চড় বসিয়ে দিয়ে তিনি বাড়ি চলে আসলেন। আর গান শেখাতে যাননি। তখন থেকেই চ্যাতা মাস্টার টাইটেলটি তাঁর নামের সাথে রয়ে গেলো ।
খানিক সময় এদিক-ওদিক তাকিয়ে জামান সাহেব এসির ঠান্ডায় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। মানুষ কখন স্বপ্ন দেখে কে জানে।  চ্যাতা মাস্টার স্বপ্নে দেখলেন বাড়ি ফিরে গেছেন। বাড়িতে টিনের ঘর বাতিল করে নতুন বিল্ডিং তুলছেনে। ফ্রিজ কিনেছেন। বিছানায় শুয়ে স্ত্রীকে তিনি বলছেন, নাহার ঠাণ্ডা লাগছে। এসিটা একটু কমিয়ে দাও।
স্ত্রী নাহার এসি রিমোট হাতে নিয়ে বললেন, আহা জীবনে কী ভুলটাই হয়েছে! আগেই যদি আপনি ঢাকা যেতেন, তাহলে সারাজীবন আমাদের কষ্ট করতে হতো না। আমি আগেই জানতাম, ঢাকা শহরে উচ্চাঙ্গসংগীতের কদর না থেকে পারে না। ওখানে সব ধনী লোকের বাস। যুগে যুগে ধনী লোকরাইতো শাস্ত্রীয় সংগীতরে কদর করেছেন। অথচ কী র্অথকষ্ট, কী শারীরকি কষ্টই না করলেন!
জামান সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমওি কি কম কষ্ট করেছ নাহার? আজ থেকে তিরিশ বছর আগের  সেই সমাজব্যবস্থায় তুমি হিন্দু ঘরের মেয়ে হয়েও আমাকে বিয়ে করে তোমার পরিবার, র্ধম, সমাজ ত্যাগ করলে। সেই থেকে কোনদিন তোমাকে শান্তির মুখ দেখাতে পারি নাই। পরণে ছেড়া কাপড়, ঘরে চাল নেই। সেই অবস্থায় আমি তানপুরা কোলে নিয়ে আলাপ করেছি, তান করেছি । তুমি একবারও সংসারের প্রয়োজন নিয়ে অভিযোগ করনি।
আপনার সংগীত শুনে মুগ্ধ হয়েই ঘর ছড়েছেলিাম । সেই সংগীত আপনি ধরে রেখেছেন। তাই আর অভিযোগ করতে পারি নাই।
এখন অভযিোগ কর হাঃহাঃহাঃ, কী চাই বল! সব দাবী-দাওয়া পূরণ হবে!
নাহার বললেন, আচ্ছা, ঢাকায় গিয়েই আপনি এত টাকা নিয়ে এলেন। কী করলেন বলেন তো?
জামান সাহেব দুষ্টু সুরে বললেন, করেছি একটা কাজ।
কী করেছেন?
তুমি তো শুনলে আবার রাগ করবে।
তবু বলেন, শুনি।
যে ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিলাম তাঁর নাম আরমান সাহবে। এলাহী কারবার! কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। চিন্তা করতে পারো! কয়েক হাজার কোটি টাকা! ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। আমেরিকানরাও এসে তাঁর পেছনে ঘুরঘুর করে ব্যবসার জন্য। যখন তাঁর রুমে ঢুকলাম তখনও তিনি মাথা নীচু করে কাজে ব্যস্ত। আমি উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী শুনে বেচারার চোখ-মুখ একেবারে চেঞ্জ হয়ে গলে।  কফি দিতে বললেন। পিয়নটা দৌড়ে গিয়ে মিনারেল ওয়াটার, কফি এসব নিয়ে আসল। কফি জিনিষটা ঠিক চায়ের মত না বুঝলে। খাওয়া যায়না। কেমন তিতা লাগে।  যাহোক ইনিয়ে-বিনিয়ে শেষ র্পযন্ত আরমান সাহেব বিনয়ের সাথে বললেন, ভাই জগতে টাকা বানানো কোন কঠিন কাজ না। সবচেয়ে সোজা কাজ। কিন্তু আপনি যা করেছেন তা সবার হয় না। বিরল প্রতিভার প্রয়োজন। এখন যদি আপনি আমাকে একটু সাহায্য করেন, তাহলে জীবনের একটা র্স্বাথকতা খুঁজে পাই। আমি বললাম, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি ? তিনি বললেন, আপনার কিছু বিদ্যা আমি কিনে নিতে চাই। আপনি যা শিখেছেন। যত টাকা চান, আমি দেব।
বলেন কী! বলল আর আপনি সব বিক্রি করে দিলেন? 
আমি কি এত বোকা নাকি যে সব বিক্রি করে দেব? ইমনকল্যাণ, আহেরি ভায়রো, ভূপালী, বাগেশ্রী বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু মিয়াকি টোরী কিন্তু চুপ করে রেখে দিয়েছি। শত হলেও গুরুর জিনিষ।
আপনি কেন বিক্রি করতে গেলেন! সারা জীবনতো কাটিয়েই দিয়েছিলাম। আর ক’টা দিনের জন্য আপনার দম্ভটা বিক্রি করে দিলেন? বছরের পর বছর গরম নেই শীত নেই আপনি সকালে উঠে আহেরী ভায়রোতে গলা সেধেছেন, রাতে ইমনকল্যান নিয়ে বসেছেন..
আমি কি বুঝিনা? কিন্তু তোমার চিকিৎসা করতে হবে না? এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল নির্মলা !
সাথে সাথে কামরুজ্জামানরে স্ত্রী মুখ নীচু করে ফেললেন। মনে হল লজ্জা পেয়েছেন। মুচকী হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, আপনি অনেকদিন পর এই নামে ডাকলেন।
কামরুজ্জামান ঝুঁকে পরে স্ত্রীকে একটু আদর করতে গেলেন। আসলে তিনি আরমান সাহেবের গেস্টরুমের সোফায় ঘুমন্ত অবস্থায় নুইয়ে পরেছিলেন। তিনি হকচকিয়ে উঠে স্বাভাবিক হয়ে বসলেন। 
কামরুজ্জামানের ঠিক উল্টো দিকের সোফায় স্থির বসে আছেন এ, এম, শফিকুর রহমান। আজই তিনি বরিশাল থেকে এসেছেন। শরীর ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও আসতে হয়েছে। তাছাড়া উপায় কী? তিনি খেয়ালি মানুষ। এক জায়গায় এভাবে বসে বসে অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত নন। বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসবেন সে উপায় নেই। কখন ডাক পরে তার ঠিক আছে? প্লাস্টিক পেইন্ট করা দেয়ালের দিকে তিনি অলস ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন। অজানা কারণে নতুন ঝকঝকে পেইন্ট করা দেয়ালেও দু-একটা ছোট খাটো দাগ  দেখা যায়। তেমনি একটা দাগ চোখে পড়লো । এসির কাছাকাছি একটা জায়গায় ভারী কোন কিছুর ঘষা লেগেছে। দাগটা এমনভাবে পরেছে যেন ঠিক একটা কিশোরী দোলনায় দোল খাচ্ছে। শফিকুর রহমান তাঁর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে কাগজ বরে করে আঁকতে শুরু করলেন। ফ্যান্টাসি ছবিটার পেন্সিল স্কেচ।
সেই ছয় বছর বয়সের  সময় শফিক জন্মদিনের উপহার পেয়েছেলিনে রঙ পেন্সিল। শফিক সাহেবের ভাষায় র্সবনাশটা তখনই হয়েছিলো । পাখি দেখেন-ছবি এঁকে ফেলেন, খেজুর গাছ দেখেন-ছবি এঁকে ফেলেন। বড়রা দেখলেই বলনে, খুব সুন্দর হয়েছে বাবা! খুব সুন্দর। শেষ র্পযন্ত শফিকুর রহমানের আব্বা মুশফিকুর রহমান বলতে শুরু করলনে, আমার শফিক বড় হলে  ভ্যানগগের মত আর্টিস্ট হবে।
মুশফিকুর রহমান মোটা মোচের নীচ দিয়ে কষ্টের হাসি হাসলেন। তাঁর ধারণা ভ্যানগগের মত শীল্পি তিনি হতে পারেননি, কিন্তু গগের মত কষ্টের জীবন তাঁকে জাপটে ধরেছে।  র্আট কলেজ থেকে যে বছর পাশ করলেন, ঠিক সেই বছর বাবা মারা গেলেন। মায়ের ভাগ্য ভাল। তিনিও দুই মাসের মধ্যেই বাবার পেছনে রওয়ানা দিলেন। শুরু  হল শফিকুরের একা জীবন। এতে তাঁর কোন সমস্যা ছিল না। সমস্যা দেখা দিল আত্মীয় স্বজনদের। তারা চিঃকার করতে থাকল,  মরে যাবি রে! একা মানুষ থাকতে পারে! বিয়ের বয়স পের হয়ে গেলো রে!
তবুও বিয়ে-সাদির ঝামেলায় রাজি না শফিক। কী হয় বিয়ে না করলে? র্আট নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় না! ঘরে বউ থাকতে হবে এটা কোন কথা?
এমন সময় একজন ভক্ত জুটে গেল। সাদা-সালোয়ার কামিজ পরে একটি মেয়ে এসে বসে  থাকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে শফিকের তুলির টান দেখে।শফিক মাঝে মাঝে অস্বস্তি বোধ করে। কী চায় মেয়েটি? একবার তাঁকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বলেছিলেন, কী চান, বলেন তো? 
কই, কিছু চাই নাতো!
ছবি আঁকা দেখতে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে  থাকে, কাজ নেই আপনার? 
অবশ্যই  আছে। ছবি আঁকা যেমন কাজ, দেখাও তেমন কাজ।  বাংলায় ক্রিয়াপদ, ইংরেজিতে র্ভাব।
বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ  কেটে গেল। এবার ইচ্ছে করে মেয়েটিকে অপমান করার জন্য শফিকুর বললেন, দেখেন তো এই ছবিটায় কী আছে?
গভীরভাবে ছবিটা দেখে সে বলল, খুবই করুণ! বুকের ভেতর ভার হয়ে আসে শফিক ভাই। 
মন্ত্রীদের চিত্র প্রর্দশনী উদ্বোধনের মত কী বলছেন! কী বুঝেছেন?
গম্ভীর মুখে মেয়েটি বলল, এমনওতো হতে পারে আপনি এঁকে যা বুঝেছেন, আমি দেখে তারচে ভালো বুঝেছি।
শফিক হেসে বলেছিলেন, আপনি তো ছবি আঁকেন না। আমার ধারণা, অনেক চিত্রশিল্পীই এটি বুঝবে না।
মেয়েটি ছোট করে বলেছিল, ভবিষ্যৎ দেখছে। 
মাত্র দুটি শব্দ শফিকের বুকের ভেতর যেন ভূমিকম্পের মত নাড়িয়ে দিল।। বললনে, কে  ভবিষ্যৎ দেখছে!
বর্তমান সময়কাল। আমি এখন যাই শফিক ভাই।
একটু দাঁড়ান, আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কী দেখছে!
নৈরাশ্য আর অন্ধকার দেখা যাচ্ছে।
শফিক পেছন থেকে চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়েছিল।  চোখ ভিজে উঠেছিল। সেই প্রথম মনে হয়েছিল, শিল্পী জীবন বৃথা যায়নি। তার ছবি সমঝদাররা বুঝতে পারে। তার শিল্পী জীবনের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল মেয়েটির। সেই মেয়েটি তানিয়া। বিমুখ করেনি তানিয়া। অকাতরে সব দুঃখকষ্ট মেনে নিয়ৈ দুর্দশাগ্রস্থ শিল্পীর জীবনসঙ্গী হওয়ার সাহস দেখিয়েছিল। এখন শফিক বোঝে, তানিয়ার এই সাহস ছিল বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেওয়ার মত।
যা হবার তাই হল। রুমকী পেটে আসার প্রায় সাথে সাথে অসুখে পরল তানিয়া । পথ্য নেই, চিকিৎসা নেই।  সরকারি হাসপাতালে শুয়ে জন্ম দিল মেয়েকে। কিন্তু নিজে আর ফিরতে পারল না। শফিক সাহেবের ভেতর থেকে  ব্রয়লার নির্গত ধোঁয়ার মত তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। রুমকী মামণির ছবি তিনি আঁকলেন।  তিনি তো রুমকীর ছবি আঁকতে চাননি। শফিক সাহেবের চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পরল। সেই ছোট্ট খুকি রুমকী এখন ঢাকা মেডিক্যাল এ পড়ে আছে। চিকিৎসা চলছে।
অবশেষে আরমান সাহেবের ঠিকানা পাওয়া গেছে। শোনা  গেছে তিনি চিত্রকলার সমঝদার। শফিক সাথে সাথে চলে এসেছেন । তাঁর সারা জীবনের র্আট আরমান সাহবেকে দিয়ে দেবেন! বিক্রি করবেন। কী হবে র্আট দিয়ে!  রূমকীকে সারিয়ে তুলতে মাত্র হাজার তিরিশ টাকা প্রয়োজন। অবশ্য যা শোনা গেছে তাতে ভদ্রলোক হয়তো একটি র্আটের জন্যই তিরিশ হাজার টাকা মূল্য  ধরবেন। হ্যা তাইতো, যুগে যুগে তো বিত্তবানরাই চিত্রকলার সমাদর  করেছেন। শিল্পীদের দুঃখকষ্টে ঝাপিয়ে পরেছেন। তা না হলে শিল্পীরাই বা আঁকবেন কেন!
ভাই, আপনার হাতে ওটা কী?
প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলনে শফিক। পাশে বসা ভদ্রলোকের বুদ্ধি দীপ্ত চোখ, উন্নত নাক। লম্বা চুল পেছনের দিকে আচড়ানো। শফিকুর রহমান বললেন, একটা স্কেচ।
বাহ! চমৎকার! ছবি আঁকেন বুঝি?
আঁকি আরকি।
একেবারে জীবন্ত আপনার হাতের ছোঁয়া ভাই! মনে হচ্ছে কবিতা। কিছু মনে করবেন না ভাই, কবিতা লিখি তো।   ভাল কিছু দেখলেই মনে হয় কবিতা। এই যেমন গতকাল একটা মেয়েকে দেখে মনে হয়েছে কবিতা হেঁটে যাচ্ছে। আজ সকালে একটা হলদে পাখি দেখে মনে হয়েছে কবিতা উড়ে যায়। একটা কথা জজ্ঞিসে করি?
করেন।
আরমান সাহবেরে সাথে আপনার সর্ম্পক কেমন? একটু কাজ করে দেয়া যায়?
শফিকুর রহমান ফ্যালফ্যাল করে তাকিতে থাকলেন।
শুনেছি আরমান সাহবে কোটি কোটি টাকার মালিক ! আমি একটু সাহায্য চাই। তিনি সাহায্য না করলে অনেকগুলো কবিতা আর সৃষ্টি হবে না...কবিতা বিচ্ছুরিত হয়...কবি হ'ল কবিতার আধার...আমার এক কবি বন্ধু  মৃত্যু শয্যায়!
রাত বারোটার দিকে আরমান সাহবে দাঁড়িয়ে আছেন একটি দামি ড্রেসিং টেবিলের সামনে। হাতে একটি গ্লাস। গ্লাসের তলায় সামান্য জ্যাক ডেনিয়াল। সারাদিন রাতের মধ্যে এই সময়টা তাঁর একার। তিনি আয়নার ভেতরে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন আরমান সাহবে আরেকটা আরমান সাহেবের সাথে কথা বলছনে। আয়নার আরমানের কথা তিনি শুনতে পাচ্ছেন। কীরে আরমান! অনেক টাকা বানিয়েছিস! কয়েক হাজার কোটি টাকা! কী করবি এত টাকা দিয়ে?
আরমান সাহবে নিজেই বিড়বিড় করে উত্তর দিলেন, এইটাকা দিয়ে আরো টাকা বানাবো! যত বেশি বানাবো, তত বেশি টাকা বানানোর আগ্রহ বাড়বে!
তোর কী কাজে লাগবে এত টাকা?
ইন্দ্রীয় সুখ উপভোগ করব একশ ভাগ।
তাতে আর কয় টাকা দরকার, এত টাকা লাগবে কেন?
লাগবে।  এখন আছে চার হাজার কোটি টাকা। এরপর হবে আট হাজার কোটি তারপর ষোল... শুনতইে কেমন আনন্দ লাগে!
শুধু শোনার জন্য?
না, শুধু শোনার জন্য না। টাকা সাথে করে অনেক কিছু নিয়ে আসে। টাকা আনে ক্ষমতা, র্মযাদা। যত টাকা তত  ক্ষমতা, যত টাকা তত র্মযাদা। টাকা আনে মানুষ, এমনকি শুনলে অবাক হবে টাকা আনে মানুষের ভালোবাসাও। সবাই টাকাওয়ালা মানুষকে ভালোবাসতে চায়! এরা জীবন র্পযন্ত দেয়!
এ কি বশ্বিাস করা যায়?
কেন যাবে না? তুমি নিজে তার প্রমাণ  দেখছ না? সেদিন যখন গাড়িতে যাবার পথে সামান্য এক্সডিন্টে করে হাতে ব্যথা পেলাম, কত লোক এসে আহাজারি করল!  কেউ কেউ কান্নকাটি করল! অথচ তাদের অনেককে আমি চিনিই না। শুধু আমার জন্য কেন, আমার ওই লেক্সাস গাড়িটির জন্যও কতজন আহাজারি করল! ওরা আমার গাড়িটি ব্যথা পেয়েছে তা-ও বুঝতে পারল! অথচ নিজের মায়ের কান্নাও ওরা শুনতে পায় না। এসব কৃতিত্ব কার? টাকার!  দেখ, আমার কোন বিদ্যা দরকার হয় না, বুদ্ধি দরকার হয় না। সৃজনশীলতা দরকার হয় না। আমি না চাইতেই   লেখক, বুদ্ধিজীবি, উচ্চ র্পযায়রে সরকারী র্কমর্কতারা তাদের সারা জীবনরে জ্ঞান বুদ্ধিকে জিহ্বা বানিয়ে আমাকে  চাটতে  থাকে। আমি কিছু দেই বা না দেই, আমাকে এমনিতেই সেবা দিতে চায়। সুখ পায়। এসব কৃতত্বি কার? টাকার। আমি যখন নিজের অফিস কক্ষে বসে বসে কফি খাই, তখন আমার জন্য অপক্ষো করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে কতজন। শুধু একটু আমার দখো পেতে চায়! এই কৃতত্বি কার? টাকার!
তাহলে ওরা সবাই আসে টাকার কাছে। ওরা কাঁদে টাকার জন্য। ওরা অপক্ষো করে টাকার জন্য। তুমি আসলে কেউ না। তুমি আসলে ডিমের খোসা। ডিমের কুসুমের জন্যই সবাই খোসাটা আদর করে ধরে যত্ন করে। তুমি আসলে একা।  এই জীবন তোমার র্ব্যথ বললে খুব ভুল হবে না আরমান। তুমি এই জীবনে হতে পার নাই কোন সংগীত শিল্পী, হতে পার নাই কোন চিত্রকর বা কবি।
দরকারটা কী? যা আমি ক্রয় করতে পারি, তা কসরৎ করে কেন উৎপাদন করবো?
এ তুমি বুঝবে না। এ এক পরম জ্বালা।

এবার সত্যিই কোথায় যেন আরমান সাহেব হিংসা অনুভব করলেন সঙ্গীত শিল্পী, কবি, চিত্রশিল্পীগুলোর প্রতি। হাতের গ্লাসটা আবার ভরে নিয়ে তিনি বেল চাপলেন। সঙ্গে সঙ্গে পরিপাটি পোষাকের এক কর্মচারি এসে রোবটের মত দাঁড়ালো। আরমান সাহেব বললেন, আজ যাদের বিদায় করে দিয়েছি, ওই শিল্পী, কবিদের, কাল তাদের আবার আসতে বল।
কর্মচারি লোকটি আমতা আমতা করে বলল,  জ্বি স্যার। স্যার, ফিরে যাওয়ার পথে ওনাদের একজন মারা গেছেন।
আরমান সাহেব ঘাড় বাকা করে তাকিয়ে বললেন, কে মারা গেছেন?
কর্মচারি বলল, সঙ্গীত শিল্পী, কবি অথবা চিত্রশিল্পী... তাদের কোনো একজন স্যার...
আরমান সাহেব আরো একবার তার গ্লাসটি ভরে নিলেন।

No comments:

Post a Comment