Wednesday, March 28, 2018

ভাষায় আজ্ঞা হউক 

 মুরারি সিংহ 

যেসব শব্দকে ব্যবহার করে আমরা কথা বলি, সাধারণত তাদের আমরা নেহাৎ শব্দ হিসেবেই দেখি। কিন্তু হঠাৎ করে যখন কেউ কাউকে বলে তোমার কথায় জাদু আছে। তখন চমক লাগে। তখন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হয় বইকি। ভাবতে গিয়ে বুঝি, এই কথার ম্যাজিক বা ভাষার জাদুকাঠির ছোঁয়ায় রুমাল কখন যেন বেড়াল হয়ে যায়, পর্বত হতে চায় বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ। তখনি কবি বলতে পারেন – “একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে / ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;/একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে /থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;...”
আসলে আমরা চারপাশে যা কিছু দেখি অর্থাৎ আমাদের দৃশ্য-জগৎ, সেটা সকলের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম। আবার সেই দৃশ্যগুলি যখন ফোটো-ফ্রেমে বন্দি করি তখন বুঝি সকলের দেখার চোখ এক নয়, এক এক জনের দেখা ও তার প্রকাশ এক এক মাত্রায় বাঁধা। আমাদের যে অনুভবের জগৎ সেটাও এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। কারণ আমাদের দেখাগুলি আমাদের চেতনায় যে অভিঘাত তৈরি করে তার সঙ্গে যুক্ত হয় আমাদের কল্পনার রং তাই ছবিগুলিও বদলে যায়। তারপরে থাকে ভাবের প্রকাশ। অর্থাৎ কথা বা ভাষার জগৎ। সেটাও কখনো ব্যক্তি নিরপেক্ষ হতে পারে না। ফলে শব্দের খেলা জমে ওঠে। সেখানে ভাষা ও চিন্তা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়। ভাষার সাহায্যে চিন্তা করি আবার চিন্তাকে প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে ভাষা দিয়ে সাজিয়ে নিই। 
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, শব্দ দিয়ে একটা পৃথিবী বদলানো যায়। একটা পৃথিবী বানানোও যায়। একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলে, তার বর্ণনা দেওয়া যায়। তাকে আবিষ্কার করা যায়। শব্দেরা সেতু হয়ে এক পৃথিবীর সঙ্গে অন্য পৃথিবীর মেলবন্ধন ঘটায়। আমাদের চেনা পৃথিবীতে আমরা যে-সব শব্দ আঁকড়ে পড়ে আছি ব্যবহারের হেরেফেরে সেই শব্দরাই তখন আবার আমাদের এক অন্য পৃথিবীতে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে। অচেনা অজানা অবোধ্য অবান্তর সে-এক পৃথিবী।
তার মানে সেক্ষেত্রে শব্দরা এক দিকে যেমন নির্মাতার কাজ করে অন্যদিকে তেমনি বাহকের কাজও করে। এক দিকে পথ নির্মাণ করে। অন্য দিকে সেই পথে আমাদের বহন করে নিয়ে যায়। যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এক জগতের সঙ্গে অন্য জগতের।
মানুষের সমস্ত কাজকর্মের পিছনে থাকে তার চিন্তা-ভাবনা। আবার মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে সংগঠিত করে তার ভাষা-কাঠামো। সুতরাং একথা বলা যায় একটা ভাষাই গড়ে তোলে একজন মানুষের মনোভূমি। এক একটা শব্দ এক একটা বস্তু, বিষয়, ভাবনা সমেত মানুষের নানান গুণ দোষ আবেগ অনুভূতিকে চিহ্নিত করে। সেই চিহ্নায়ন আবার পুরোয়াই আপেক্ষিক, পরস্পর-নির্ভর। অর্থাৎ এটা আম বলেই ওটা জাম, এটা আমি বলেই ওটা তুমি। আবার যে আমি-র মধ্যে দিয়ে আমার আমি কথা বলছি সেই আমিকে যখন তুমি ব্যবহার করো তখন সেই আমি-র মধ্যে দিয়েই তোমার-আমিও কথা বলে। ভাষা এবং চিন্তা, চিন্তা ও ভাষা একে অন্যকে পুষ্ট করে।
মজার কথা হচ্ছে, আদিকাল থেকেই ভাষাকে যেমন আমরা ব্যাকরণের খাঁচায় বন্দি করতে চেয়েছি, তেমনি চিন্তাকেও বাঁধতে চেয়েছি নানান নিয়ম-নীতি ও যুক্তি-তর্ক-দর্শনের জানে। অথচ সমস্ত শব্দের অর্থ চিরকাল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সময়-বদলের সঙ্গে সঙ্গে শব্দার্থেরও বদল হয়, বদলাতে থাকে ভাষা, বদলাতে থাকে মানুষের চিন্তা-ভাবনার গতি-প্রকৃতি, তার কাজ করার ধরণ। শব্দের প্রয়োগে মানুষের চেতনার রং বদলে বদল্র যায়। চিন্তা-জগতে নতুন নতুন ছবি তৈরি হয়। নতুন মানচিত্র। অগত্যা মেনে নিতে হয় ভাষা ও চিন্তা বহতা নদীর মতো। নিজস্ব ছন্দে বয়ে যায়। বাইরে থেকে আরোপিত কোনো বাঁধ তাদের না-পসন্দ।
আসলে অনেক কিছুর মতোই মানুষের কাছে ভাষাও সেই প্রকৃতিরই একটি দান। ভাষাকে আয়ত্ব করা একটি সম্পূর্ণ জৈবিক প্রক্রিয়া। সেখানে যেমন বাগযন্ত্রের ভূমিকা আছে তেমনি নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ করা বা অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার যে সহজাত মানসিক গরজ সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমিক পর্বে একজন মানুষ যখন ভাষা শেখে, ভাষাকে পড়ে বা লেখে, তখন এক অর্থে সেই ভাষার দ্বারা সেও লিখিত হয়। তারপর তার বোধবুদ্ধি যত পরিণত হতে থাকে ততই সে চিন্তা-ভাবনার দিক দিয়ে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করার প্রয়োজন অনুভব করে। এই পর্বে দেখা যায় একই ভাষা-কাঠামোর মধ্যে থেকেও অনেকে নিজস্ব ভাষা-আঙ্গিক তৈরি করতে সচেষ্ট হয়।
আসলে নানা ব্যাপারে আমরা অনেকাংশেই অভ্যাসের দাস। ভাষা বা শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাই। আমাদের চারপাশে দৈনন্দিন গণচেতনার যে জগৎ সেখানে সাধারণ মানুষের কথোপকথনের একটা প্রবাহ আমাদের কানে নিরন্তর ধাক্কা মারছে। আমরা রাজনীতি সমাজ প্রশাসন ব্যাবসা-বাণিজ্য এসব ব্যাপারে প্রতিদিন যে কথাবার্তা বলছি বা শুনছি সেটা আগেভাগেই একটা তৈরি করা ব্যাপার। সেই ভাষা লক্ষ করে দেখুন, দেখুন তা কতখানি ছকে-বাঁধা একঘেয়ে গতানুগতিক ম্যাড়ম্যাড়ে ছেঁদো, সব মিলিয়ে খুবই কলুষিত। থোড়বড়িখাড়া-খাড়াবড়িথোড় বা  ইয়োরস-ওবিডিয়েন্টলি মার্কা সেই সব বাতচিৎ নেহাৎই ব্যাবহারিক বা শুধুই সংবাদ বিনিময়ের কাজে লাগে তার মধ্যে চেতনায় ধাক্কা মারার মতো নতুন কোনো উপাদান থাকে না। কারণ এইসব শব্দ বড়ো একমুখী। ঘ্যানঘ্যানে। বহু-ব্যাবহারে জীর্ন। যেহেতু সেইসব শব্দ সবাই সহজেই বুঝে যায় তাই আমরা সবাই তাদের অন্ধ ভাবে ব্যাবহার করি। কিন্তু তা আমাদের মধ্যে নতুন চিন্তার কোনো উসকানি তো তৈরি করেই না বরং অনুসরণ ও অনুকরণের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কেমন যেন হিংস্র ভাব তৈরি করে। অনেকে সেই গতানুগতিকতা পছন্দ করেন। সেই হিংস্রতায় ডুবে যেতে চান। তারা এই চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে আসতে ভয় পান। কারণ নতুন কিছু ভাবা বা বলার জন্যে যে ঝুঁকি নিতে হয় তা নিতে তারা অপারগ। তারা শব্দের সঙ্গে তাদের পুরোনো সম্পর্কই বজায় রাখতে চান।
যারা ভাবেন বা বলেন সাহিত্য হবে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যম তারা হয়ত ভেবে দেখেন না যে একটা গতানুগতিক বা ছেঁদো ভাষা-কাঠামো দিয়ে কোনো বিপ্লব ঘটানো যায় না। নতুন কিছু করার জন্যে প্রথমেই প্রয়োজন মান্ধাতা আমলের ভাষার শরীরে নতুন রক্ত-সঞ্চালন। অর্থাৎ ভাষা-প্রয়োগের অভিনবত্ব। ভেবে দেখুন উনবিংশ শতকে বাংলায় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল বা একটা জাতি দীর্ঘকালের ঘুম থেকে ঠেলে তুলে তার মন ও মেজাজে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের তুমুল ভাব-তরঙ্গ তুলেছিল তার পিছনে সমসাময়িক বাংলা-মনীষীদের উন্নত ও পরিবর্তিত ভাষার ব্যাবহার কতখানি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।
আবার ভেবে দেখুন, যে জিনিসটা যেমন আমরা কি তাকে তেমনি করেই দেখি, না প্রচলিত বিধি মেনে যেভাবে আমাদের দেখানো হয় সেভাবে দেখি। সেভাবেই আমরা সাদাকে সাদা কালোকে কালো বা ভালো-মন্দ দিন-রাত্রি এইসব চিনি। আমাদের দেখার মধ্যে এইসব ভাষা নানান ভেদাভেদ তৈরি করি। তৈরি করে কারণ পূর্ব-পুরুষদের একটা তৈরি করা পৃথিবীতে একটা তৈরি করা সমাজে একটা তৈরি করা ভাষা-কাঠামোর মধ্যে আমাদের বসবাস করতে হয়। তাই যখন আমাদের চোখ থেকে, চোখের উপর বসিয়ে দেওয়া চশমাটা সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়, তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে যায়, একটা জটিলতা, একটা গোলমাল বা ক্যায়স তৈরি হয়। যা আমাদের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। 
আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার দিকেও একবার নজর দিয়ে দেখুন ছেলেবেলা থেকেই তা আমাদের কেমন নিখুঁত ভাবে সিলেবাসকেন্দ্রিক করে তুলতে চায়। আমাদের মধ্যে পাশ-ফেল বা সাফল্য-ব্যর্থতার এক তীব্র মানসিকতা ঢুকিয়ে দেয়। আর সাফল্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমরা একদিকে বাজারে নোটস সাজেশন এবং ডিমার্কেটেড সহাহিকা এবং অন্যদিকে প্রাইভেট টিউশনির ব্যবসাকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে সাহায্য করছি। ফলে বাল্যকাল থেকেই ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ অবহেলিত থেকে যায়।
নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে বলার ক্ষমতা অধরা থেকে যায়। কোনো কিছু বোঝাতে আমরা সেই সিলেবাসের ভাষাই ব্যবহার করি। স্বকীয়তা গড়ে তুলতে আগ্রহ দেখাই না।
কিন্তু জীবন তো আর সিলেবাস মেনে চলে না। তো সেই জীবন যখন তার নানান টানা-পোড়েন অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অজস্র ওঠাপড়া নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয় তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দিশেহারা হয়ে যাই, ভয়ে কুঁকড়ে থাকি, সাহসের সঙ্গে প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি না হয়ে আমরা দুর্ভাগ্য নিয়তি বা ভবিতব্যের দোহাই দিই। নিজেদের ভেতরের শক্তিকে আবিষ্কারের চেষ্টা না করে, তাকে যথাযথ কাজে না লাগিয়ে কোনো এক ঈশ্বরের শরণ নিই। মাপ করবেন, যাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের কোনো রকম আঘাত করতে চাইছি না, কিন্তু একথাও তো ঠিক যে এক জন মানুষ নিজের চেষ্টায় নিজের বুদ্ধি ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক মিরাকেল ঘটাতে পারে। তার জন্যে দরকার তার ব্যক্তিক্তের পূর্ণাঙ্গ ও সার্বিক বিকাশ। সেটা আবার অনেকটাই নির্ভর করে নিজের ভাষা-কাঠামোটি কতখানি বিকশিত সুগঠিত ও জোরালো তার উপর।  যার ভাষার ব্যবহার যতকানি সংস্কারমুক্ত নমনীয় সহনশীল উদার ও বহুমুখী তার ভাবনার জগৎটিও ততটাই বিস্তৃত এবং তার ভাষার ব্যবহারও ততটা মুক্তমনা।
যারা যুক্তি তর্কের বাইরে নিজেদের দেখাকে নিয়ে যেতে ভয় পান তাদের অনুভূতির প্রকাশও তেমনি হয়। সে প্রকাশে দেহ ও মনে কোনো রোমাঞ্চ জাগে না। কিন্তু একট্য অন্য রকম ভাবছে চেষ্টা করলে দেখা যায় বস্তুর রূপের আড়ালে এক ছায়াময়তা আছে এক অপরূপ আছে । এক রহস্যময় জটিলতা আছে। সেই রহস্য ভেদ করে যত এগোনো যায় ততই এক একটা নতুন জগতের দরাজা খুলে যায়। তার জন্য দরকার হয় একটা সৃষ্টশীল মন। গতানুগতিকতার চাপে যাকে অধিকাংশ সময়েই আমরা হারিয়ে ফেলি।
যারা কবি-শিল্পী-দার্শনিক বা সৃষ্টিশীল মানুষ, যারা নতুন কিছু করতে চান, তারা সব সময় চেষ্টা করেন পূর্ব-আরোপিত সংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে এই প্রচলিত কাঠামো বা মূর্তিকে ভেঙে ফেলতে। নতুন কথার উদবোধন ঘটাতে। ভাষাকে নতুন দিশায় নিয়ে যেতে। এখানেই তৈরি হয় নতুন দ্বন্দ্ব। নতুন সংঘাত। নতুন আলাপচারিতা। কারণ বলপ্তে চাইলেই তো আর সব কথা বলা যায় না। আমরা যতই চেষ্টা করি আমাদের সব ভাব বা ভাবনাকে কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব। নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে তাই কিছু খামতি থেকেই যায়।
আসলে আমাদের মধ্যে মানুষের দুটি সত্তা কাজ করে। এক যিনি ভাষায় ব্যক্ত হচ্ছেন অর্থাৎ এক জন ব্যক্তি-মানুষ। এবং দুই, যাকে ভাষার চৌহদ্দিতে ধরা যাচ্ছে না, অর্থৎ যিনি অব্যক্ত অনুক্ত অনুচ্ছিষ্ট থেকে যাচ্ছেন সেই অধর-চাঁদ। এই অব্যক্ত-মানুষকেই আমাদের সাধক কবিরা বলেছেন মনের মানুষ, প্রাণের মানুষ, সহজ মানুষ। যাকে ধরতে না-পারার বেদনা স্রষ্টাকে সব সময় অতৃপ্ত রাখে, চঞ্চল করে। সেই বেদনা নিয়েই কবি এক সময় বলে ওঠেন –“দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।/তারে ধরি ধরি মনে করি/ধরতে গিয়ে আর পেলাম না।।...” 

No comments:

Post a Comment