Friday, August 30, 2019

কবিতা করিডোর 
আগস্ট সংখ্যা , ২০১৯
সম্পাদক :শুভঙ্কর পাল 
উত্তর পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক : রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ
প্রচ্ছদ ও নামাঙ্কন : সমীরণ ঘোষ 

সম্পাদকীয় :


তুমি না হয় পাতাদের গল্প লিখবে ! গল্পের ভেতর শব্দকে সত্যই কী বাদ দেয়া যায় ।  শব্দ কী হাওয়ার শরীর । ওর ঘামের ভেতর অনেক গন্ধ লুকিয়ে থাকে ।  সেই গন্ধের ভেতর কতো চাপা কান্না আবার হুল্লোর লুকিয়ে রেখেছো সযত্নে ।  এতো সব আবোল তাবোল ভাবলে চলে ।  এ যে গাঁজার সুখ টান । সুখে রাজা সেজে বসে থাকা ।  সত্যি বলছো শব্দ অর্থহীন ।  এতো কাল জেনে এসেছি শব্দ ব্রহ্ম ।  অসীম , অনন্ত এক শক্তির আঁধার ।  অথচ আজ নৈঃশব্দের কথা বলবো বলেই এই আয়োজন ।  এই নৈঃশব্দ শব্দটিই আমার কাছে সোনার পাথর বাটি । শব্দ আছে বলেই তার বিপরীত ভাবার একটা প্রচেষ্টামাত্র ।  তবে এই কথা ঠিক মানুষের সাব কানসাস মনের গভীরে জন্ম নেয়া যে শব্দগুলো জীবনানন্দ বা তেমন কারো নির্জনতা চায় তখন তা শব্দকে অতিক্রম করে শব্দাতীত হয়ে উঠে .....আর এই হয়ে ওঠার মধ্যদিয়েই সাহিত্যে জন্ম নেয় ॥ 
                                ধন্যবাদান্তে 
                               শুভঙ্কর পাল 
যোগাযোগ : subhabrb@gmail.com
মুঠোফোন :9933770541
অতিরিক্ত পাখি
হাসান রোবায়েত 

১.
সে-বার আশ্চর্য গানের ভেতর একদল দর্জি ঢুকে
কেটে নেয় তাসের বাগান
কতখানি বেঁকে যায় জ্বর—মা তাকিয়ে থাকেন
প্রকাণ্ড মাছ কুটনির দিকে

ভাষাও অতিরিক্ত পাখি—ফাটা ফাটা রোদের থেকে
তুলে নিচ্ছে বিশ্রাম-বাতাস

২.

ধুলার নৈঃশব্দ্য ঘিরে যে হিংসা-রেস
এই পাঠযোগ্য হাওয়ায় ঝরে পড়ে রাশি রাশি
বল্লম

কোথাও, হে নিরোদ পাতা—
মৃত্যুকে ভাষার ভালো লাগে

সমস্ত পারাপার ভাবি সাঁকোর ওপার—
উত্তর পূর্বাঞ্চলের কবিতা 

নীরবতা

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

মেঘের পালক ছিঁড়ে নৈঃশব্দ্য যাদুগর
জম্পুই ভাঁজে ভাঁজে হেঁটে চলে
নিশাচর ভোলা মন
অলৌকিক মাদুরতায়
কন্ঠে ঝরে পড়ে টুপটাপ নীরবতা


নিস্তব্ধ 
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য

এক অংশ অপর অংশের
রৌদ্র ভেঙ্গে যায়
হাসি শুকতে জানালায় বিলাপ করে
এক বৃষ্টি সাদা মেঘ।

জলে ভিজে কাঠের গন্ধ
কষ্টের নিদাঘ তুলে 
ত্বকহীন নিস্তব্ধতা  ।





নৈঃশব্দ,সে তো খোলা আকাশের নিচে পাখিদের ডানার ছায়ার ম্যাজিক...
সুবীর সরকার


‘বাউকুমটা বাতাস যেমন ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে
সেই মতন মোর গড়ির চাকা পন্থে পন্থে ঘোরে রে
ও কি গাড়িয়াল মুই চলং রাজপন্থে’
১।
অন্ধকার এক রাত্রীকাল।আকাশ জুড়ে হাড়ির কালির মত ‘হাড়িয়া ম্যাঘ’।বজ্রবিদ্যুতের গম্ভীর গর্জন।কেমন একটা অলৌকিকতা যেন পরিসর জুড়ে।কালাম ব্যাপারী বড় গঞ্জ থেকে হাট সেরে ফিরে আসছেন।তার গরুর গাড়ির গাড়োয়ান হাকিমুদ্দিন গান ধরেছেন,সেই কত কত পুরাতন লোকগান।গানের ওঠানামায় কেমন এক জাদু।রহস্য।গান চলতে থাকে।গান গড়াতে থাকে।নৈঃশব্দ জমাট হতে হতে কালাম ব্যাপারীর তিন কুড়ি সাত বয়সী শরীরের বাঁকে বাঁকে কি এক শিহরণ বুঝি বুলিয়ে দিতে দিতে ব্যাপারীকে তীব্র স্মৃতিকাতরতায় নিমজ্জিত করে দিতে থাকে।ব্যাপারীর দীর্ঘ যাপনের কোন গুপ্ত কোটর থেকে বেরিয়ে আসা স্মৃতি তাকে কুমারসাহেবের সেই বাঘশিকারের ঘটনাক্রমের কথাই মনে করিয়ে দিতে থাকে হয়তো বা!এইসব তো আসলে স্বপ্নের মতন।ম্যাজিক বাক্স থেকে উড়ে আসা রুমালের মতন।আর এভাবেই তো নৈঃশব্দ ঘিরে রাখে মানুষের আবহমানের জীবনকে
২।
আর তিন বুড়ি গোল হয়ে নাচে।মাঠে মাঠে,পাথারবাড়িতে নাচ আর গান সাজাতে সাজাতে নৈঃশব্দ ডিঙিয়ে কেবল ভেসে আসে গান_
‘ও জীবন রে
জীবন ছাড়িয়া না যাইস রে’
তখন মরিচের খেত থেকে কি এক ব্যাকুলতা নিয়েই উড়ে যায় অগনণ লাল টিয়া।রুপসীর জমিদারবাড়িতে নাচতে থাকা ময়নামতি আবো প্রবল নৈঃশব্দ নিয়েই ছুটে যেতে থাকে আসারীকান্দির দিকে।বগরীবাড়ির দিকে।বালাকুঠির দিকে।আর ময়না মতি দেখতে পান টোকন ব্যাপারীর হাতি শুড় তুলে অভিবাদন জানাচ্ছে লালজি রাজাকে।আর সেই হাতির সামনে শরীরে সামান্য নাচের মুদ্রা মেখে গান গেয়েই চলেছে বুচুসুন্দরী।আর সেই গান থেকেই তো নেমে আসতে থাকে দিক ও দিগরের দিকে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দতা_
‘ধওলি মোর মাই
সুন্দরী মোর মাই
দোন জনে যুক্তি করি
চল পালেয়া যাই’
৩।
শব্দ ও নৈঃশব্দ নিয়ে এভাবেই চিরকালীন বেঁচে থাকতে হয় মানুষকেঅথচ মানুষ বেঁচে থাকে কেন!এই দার্শনিক জটের ভিতর ঢুকে পড়তে পড়তে আমাদেরকে দেখে ফেলতে হয় আবহমানের এক চলমানতাকে।সেখানে হাকিমুদ্দিন গাড়িয়ালের গান তখন বাউকুমটা বাতাস থেকে সরে এসেছে নাল টিয়ার দিকে।আর শিকারজুলুস থেকে কালাম ব্যাপারীর স্মৃতি ঝুঁকে পড়ে জমি ও চর দখলের অতিজীবিত আখ্যানের উপরেই।এইভাবে নৈঃশব্দ ঘন ও গহীন হয়।এবং নৈঃশব্দ ডুবে মরতে থাকে সেই চোরাবালিতে হাতি ডোবার এক কালখন্ডেই।এতসবের ফোকড়ে কখন বুঝি প্রবেশাধিকার পেয়েই যায় গান_
‘বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে’
আদতে,নৈঃশব্দ এক তীব্র সবুজ মায়া...

এই নিস্তব্ধতা আমরা কেউই চাইনি কোনো দিন
সুভান


শব্দের জন্য আর কোনো অপেক্ষা থাকবে না একদিন জেনেও, প্রেম হেঁটে আসবে পুরোনো করিডোর ধরে, বিচ্ছেদের রঙ পায়ে যেভাবে এসেছিল বসন্ত শেষবার... তেমন ভাবেই পাতাঝড়াকালও এসেছিল... তখন তুমি একটা আলোর রেখার মত ছিলে,  এখন ঝড় আঁছড়ে পড়ে দেহের ভেতর... অন্ধকার আঁছড়ে পড়ে আরেক অন্ধকারের ভেতর... কেন হত্যা হও আচমকা বাতাস, ভোরের পর ভোর পলাতক হও সময়, এভাবে কথা আসে নিয়মমাফিক, পুরোনো পুরোনো.. শ্যাওলা জমা সেসব আধঢাকা আশ্রয় খুলে যায়... রাতের রুমালে কে যেন নোনাজল রেখে যায় অপেক্ষার, এমন রাতের জন্য তার কাছে শরীর খুলে দেওয়া যায় সহজেই, রাত যদিও ভঙ্গুর, ক্ষীণ হয় আজকাল... কথার জন্য গাছ ফুরিয়ে আসে, কি দেখবে তখন? নিষিদ্ধ ফুল? তুমি বরং ফিরে যাও তীক্ষ্ণবিষাদ... চোখের রঙ ভয় পাও? দেখো, এখন ঘুমিয়ে পড়াটা কত সহজ মনে হয়, যত ঘুম আসে কবিতায় শব্দক্ষয় হয়,  অবধারিত একটা নীলস্রোত নেমে আসে, তোমার ভ্রম পার হয়ে আসাটা তাহলে নিতান্তই সহজ... ক্ষতর ভেতর সূর্যাস্ত দেখা যায়।  ছায়া দীর্ঘ হতে হতে ছিঁড়ে যায় দুই প্রান্তে, তাহলে প্রেমই আজও সবচেয়ে সহজ, সহজেই পাথরের গান শোনা যায়.. শূন্যতার দশক থেকে বের করে আনে কবিকে যে কিশোরী, তার বুকে হাত থাক আজ সারারাত... কিশোরী তো আসলে পুতুল, তার ঠোঁটে ফালাফালা নিয়মের সেলাই, তার হাত জুড়ে ঠান্ডা মাটি... গাছের শেকড়.. তার বুকে পাথর ঘষার দাগ দেখে মনে হয়, চোখের জলের ভাষাটাই তবে একমাত্র সহজ ভীষন... কিন্তু চোখ তো কথা বলে, অনর্গল কথা বলে, চোখে কিছু লুকিয়ে রাখা যায় কই, কিশোরী কাছে আসে, বলে কাছে আসাটাও তো কতটা সহজ দেখো কবি... তুমি সহজ বোঝো না? হাতে হাত রাখা সহজ নয়? ঠোঁটে ঠোঁট? কথার সঙ্গম বোঝো কবি? সহজই তো? ভালো সন্ধে নেমে আসে শহরে,  কিশোরী বলে_ "এবার তবে ফিরি... হাসি দিলাম, ঠোঁটে মেখে রেখো..." জল স্থির হয়ে আসে, ধ্বনি কাঁদে বহুদূর... এতই সহজ? এতই সহজ? ফিরে যাওয়া, এতই সহজ... আমি বলি  ফিরে যাও তুমি সত্যি ফিরে যাও, সহজ যখন, ফিরে যাও, কথা ফুরিয়ে এসেছে, মেঘের দাবিও ফুরিয়ে এসেছে এখন চুপ থাকি তবে, কবি বলে_ চুপ থাকা টাই সহজ ভীষন... তবু... এই নিস্তব্ধতা আমরা কেউই চাইনি কোনো দিন।
নৈঃশব্দের বর্ণমালা
---------------------------
শুভময় সরকার


নৈঃশব্দ মানে কী...? সে কি শুধুই এক শব্দ? নাকি অধিক কিছু!!! প্রশ্নগুলো সহজ নয়,উত্তরও একটু জটিল বটে। তবে এটুকু বলা যায় যে নৈঃশব্দেরও কিছু অনুচ্চারিত বর্ণমালা রয়ে যায়। একটু সহজ করে বলা যাক বরং! বহুদিন আগে একটি ইংরাজি সিনেমায় এক দৃশ্য দেখেছিলাম,অবশ্যই ভৌতিক ছবি। তো দৃশ্যটি ছিলো  এরকম-মাঝরাতে চরম নিস্তব্ধতার মাঝে,মানে যাকে বলে absolute silence-য়ে একটি দরজা সামান্য ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে যায়, সামান্য এই শব্দে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায় সারা শরীর জুড়ে! যে বয়েসে সিনেমাটি দেখেছিলাম,সেই অপরিণত সময়ে নেহাৎই সাদামাটা এক ভয়ের দৃশ্য ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি হয়নি কিন্তু   পরে পরিণত ভাবনায় কিন্ত শুধুই এক ভয়ের দৃশ্য বলে মনে হয়নি।আসলে দরজার ওই শব্দ নৈঃশব্দকেই তীক্ষ্ণ করেছিলো বহুগুণ। 
            কার যেনো একটি উক্তি পড়েছিলাম-Listen to silence. It has so much to say...! সত্যিই তো নৈঃশব্দ বলে কি সত্যিই কিছু হয়? নৈঃশব্দেরও তো একটা ভাষা আছে, কথা আছে, অনুভূতি আছে! কালো রঙ কি কিছুই বলেনা? নিশ্চয়ই বলে,কখনো সে শোকের কথা বলে, কখনো প্রতিবাদের ভাষা কালো, কখনোবা অন্য কোনো আধাঁরের কথা, ভিন্ন এক অনুভূতির কথা! 'তুমি যে আধাঁর তাই বড় ভালোবাসি...'! সব Negation-এর কিন্তু এক Positive বার্তা রয়ে যায়।  একজনের  কাছে যা Negation হয়ে আসে, অপরজনের কাছে সেটাই  Positive এক ভাবনা! নৈঃশব্দও তেমনি এক অনুচ্চারিত বর্ণমালা এবং সেই অনুচ্চারিত অক্ষরমালায় নৈঃশব্দ যা বলতে চায়, তা অনুভবের। নৈঃশব্দের ভাষা পড়বার জন্য ভিন্ন এক প্রস্তুতি জরুরি, সে প্রস্তুতি না থাকলে প্রাচীন প্রস্তরলেখ-র মতোই অপঠিত রয়ে যাবে!!! নৈঃশব্দ নিয়ে এটুকুই আপাতত, পরবর্তী সময়ের জন্য আরও কিছু কথা রয়ে গেলো।
শব্দ কবিতা, নিঃশব্দ কবিতা
   অনিন্দ্য রায়



কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে, হ্যাঁ, শব্দ দিয়েই তো । কিন্তু ‘শব্দ’ কী ?

শব্দ। এর যে অর্থগুলো আমরা পাই বাংলা অভিধানে
১ শব্দকরণ, ধ্বনি, রব, নিঃস্বন, নাদ
২ শ্রোতোগ্রাহ্য আকাশগুন
৩ কণ্ঠস্বর
৪ কলকল
৫ সার্থকবর্ণসমূহ, বাক্‌
৬ (ব্যাকরণে) বিভক্তিহীন পদ; প্রতিপদিক
৭ শব্দশাস্ত্র, ব্যাকরণ
৮ ভাষা
৯ (ন্যায়ে) আপ্তোপদেশ, আপ্তবাক্য
        ১০ উপাধি, নাম, সংজ্ঞা
        ১১ নামমাত্র
        ১২ প্রচার, প্রসার, ঘোষণা
        ১৩ কথা, বিষয়
হ্যাঁ, শব্দের প্রথম অর্থটি – ধ্বনি, Sound; আবার ব্যাকরণে অর্থযুক্ত ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ (Word ) বলে । কিন্তু ধ্বনির কি অর্থ হয় ?
 ভাষাতাত্ত্বিক Ferdinand de Saussure চিহ্নের অযৌক্তিক চরিত্রের ( arbitrary nature of signs ) কথা বলেছেন যেখানে  signifier ও signified-এর মধ্যে যুক্তিসিদ্ধ সম্পর্ক নেই, মানুষের ভাষাতে ধ্বনি ও অর্থের মধ্যের সম্পর্ক, তাঁর মতে arbitrary । অথচ ভাষাকে ভাঙতে ভাঙতে বাক্য, শব্দ পেরিয়ে আমরা পোঁছই আদিতম একক ধ্বনিতে, সে ধ্বনিই তো শব্দই যা দিয়ে কবিতা লেখা হয়, যা কবিতার বুনিয়াদি একক। আমাদের চারপাশে যেসব শব্দ হয়, যেসব আওয়াজ হয় – সবই কি ভাষার যুক্তিকাঠামোয় খাপ খেয়ে যায় ? না কি? 

ঠাস্‌ ঠাস্‌ দ্রুম দ্রাম,শুনে লাগে খটকা–
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্‌কা!
শাঁই শাঁই পন্‌ পন্‌, ভয়ে কান বন্ধ–
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?
হুড়মুড় ধুপধাপ–ওকি শুনি ভাইরে!
দেখ্‌ছনা হিম পড়ে– যেও নাকো বাইরে।
চুপ চুপ ঐ শোন্‌! ঝুপ ঝাপ্‌ ঝপা-স!
চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? গব্‌ গব্‌ গবা-স!
খ্যাঁশ্‌ খ্যাঁশ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ ঘ্যাঁচ্‌, রাত কাটে ঐরে!
দুড়দাড় চুরমার–ঘুম ভাঙে কই রে!
ঘর্ঘর ভন্‌ ভন্‌ ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচ শোন্‌–ধেই ধেই ধিন্‌তা!
ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজেরে–
ফট্‌ ফট্‌ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে!
(শব্দকল্পদ্রুম / সুকুমার রায়)

 শব্দকল্পদ্রুম একটি সংস্কৃত অভিধান। রাধাকান্ত দেব অভিধানটি সংকলন করেন এবং করুণাসিন্ধু বিদ্যানিধি  সম্পাদনা করেন । ১৮০৩ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছরে আটটি খন্ডে এই অভিধানটি প্রকাশিত হয়। শোনা যায় যে, সংস্কৃত ভাষায় এমন কোন শব্দ নেই যার অর্থ এই বইতে নেই ।
 এমন কোনো শব্দ কি আছে যার গায়ে অর্থের জামা নেই? অথচ ঐ জামা খুলে আমরা কি দেখতে চাইব না তার প্রকৃত
শরীর ?
  আমরা তো বলি,’ অর্থই অনর্থের মূল’, শব্দ ও তার অর্থের মধ্যের সম্পর্কের স্বতঃসিদ্ধ কিনা তা নিয়ে আমরা অবিশ্বাসী হয়ে উঠছি । আমাদের কবিতাকেও ভাষার আদিতে, ধ্বনিতে উপনীত করতে চাইছি । 
 প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার বীভৎসতা, ধ্বংসময়তা ও হহাকার নিয়ে সেইসময়ের মানবসভ্যতাকে টুকরো টুকরো করল, টুকরো করল মানুষের চিন্তাচেতনাকে। ধ্রুপদীতত্ত্বের মৃত্যু হল। শিল্প ও সাহিত্যে একের পর এক নতুন ইজম, নতুন আন্দোলন উঠে এল ।
 ১৯১৬ সালে  Hugo Ball তৈরি করলেন  Dada Manifesto, ‘Dada’ ? কোত্থেকে এল শব্দটি ? ফরাসি অভিধানে এর মানে বাচ্চাদের খেলনা ঘোড়া। অনেকে বলেন আস্ট্রিয়ান শিল্পী Richard Huelsenbeck একটি ছুরি অভিধানে একটি শব্দে এলোপাথাড়ি গেঁথে দেন, সেই শব্দটি Dada আর এভাবেই এই অন্দোলনের নামকরণ । কারু কারু মতে এটি মানবশিশুর প্রথম উচারিত শব্দ, আবার কারু মতে এর প্রকৃত কোনো অর্থই নেই যা এই আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য অর্থহীনতারই সমার্থক। 

১৯১৬-তেই Hugo Ball লিখলেন Karawane কবিতাটি 
jolifanto bambla o falli bambla
großiga m’pfa habla horem
egiga goramen
higo bloiko russula huju
hollaka hollala
anlogo bung
blago bung blago bung
bosso fataka
ü üü ü
schampa wulla wussa olobo
hej tatta gorem
eschige zunbada
wulubu ssubudu uluwu ssubudu
–umf
kusa gauma
ba–umf
অর্থহীন, ননসেন্স শব্দ দিয়ে লেখা একটি কবিতা, যার কোনো মানে নেই অথবা মানেহীনতাই এর মানে । তৈরি হল sound poetry, শব্দকবিতা, ধ্বনিকবিতার ধারা ।
যদিও এর ইতিহাস আরেকটু পুরোনো। মৌখিক কবিতাচর্চায়, সঙ্গীতে এরকম আপাত অর্থহীন ধ্বনির ব্যবহার আমরা আগেই পেয়েছি।  জার্মান কবি Christian Morgenstern-এর ১৯০৫-এ  Das Große Lalulá কবিতাটি আমরা এর উদাহরণ পাই।
ইতালির ফিউচারিজম আন্দোলনের অন্যতম কবি Filippo Tommaso Marinetti যুদ্ধক্ষেত্রে নানান আওয়াজের ভেতর উপলব্ধি করেন যে, শুধুমাত্র ধ্বন্যাত্মক শব্দ ব্যবহার করেই যুদ্ধের আবহ কবিতায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব, শুধুমাত্র তা দিয়েই কবিতা লেখা সম্ভব । সেই যুদ্ধকালীন ধ্বনিপ্রবাহেই ১৯৩৪ সালে তিনি লেখেন Zang Tumb Tumb কবিতাটি। 
১৯১৮-তে Tristan Tzaraআরেকটি ইস্তেহার লেখেন দাদাইজমের এবং তা হুগো বলের ইস্তেহারটির থেকে ভিন্ন। ত্রিস্তান জারার কবিতাতেও শব্দের অর্থহীনতার ঝোঁক দেখি আমরা। কংক্রিট কবিতার অন্যতম নাম ফরাসি কবি Henri Chopin( অঁরি শঁপা ), তাঁর কবিতাতেও সাউন্ড কবিতার দেখা পাই আমরা।  বিভিন্ন দেশের লেখম-শিল্পীদের রচনায় এর প্রকাশ নজরে আসে । নিউইয়র্কবাসী জার্মান Elsa von Freytag-Loringhoven, অস্ট্রিয়ান  Raoul Hausmann, জার্মান Kurt Hermann Eduard Karl Julius Schwitter-র নাম উল্লেখযোগ্য।
Bruce Lansky নিয়ে নিবন্ধে এর উদাহরণ দিতে গিয়ে এই কবিতাটি লেখেন রেলপথের পরিমণ্ডলে ।
Choo Choo
Chuga-chuga, chuga-chuga, chuga-chuga, chuga-chuga, chug.
Choo Choo!
When I hear a choo choo train I think of all the many things that I
should do
সাউন্ড পোয়েট্রিরও নানা উপবিভাগ Bruitist poem ঃ Richard Huelsenbeckএর পথ ধরে ধ্বন্যাত্মক কবিতা, Simultaneous poem ঃ   Tristan Tzara-র পথ ধরে এমন কবিতা যা বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ছন্দকাঠামোয় পড়া যাবে। দাদাইস্টের একটা প্রবণতা ছিল শিশুর সারল্যে পৌঁছনোর ।
.
 শিশুর উচ্চারণের শব্দগুলিতে অর্থের প্রলেপ লেগে থাকে না, সেগুলি এলিমেন্টাল ধ্বনি। আর শিশুর সাথে কথা বলতে আমরাও এরকম অনেক শব্দ বলি যেগুলির আওয়াজ নেই।
মহারাজ, আমি তোমার সেই পুরনো বালক ভৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? তোমার বুকে হোঁচট পথে
চাঁদের আলোয় মোট বয়েছি, বেতের মতো গান সয়েছি
দু’হাত নিচে, পা শূন্যে- আমার সেই উদোম নৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ,
চাঁদের আলোয়?

মহারাজ, আমি তোমার চোখের জলে মাছ ধরেছি
মাছ না মাছি কাঁকরগাছি একলা শুয়েও বেঁচে তা আছি
ইষ্টকুটুম টাকডুমাডুম, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!
অমন তোমার ভালোবাসা, আমার বুকে পাখির বাসা
মহারাজ, তোমার গালে আমি গোলাপ গাছ পুঁতেছি-
প্রাণঠনাঠন ঝাড়লন্ঠন, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!

মহারাজ, মা-বাপ তুমি, যত ইচ্ছে বকো মারো
মুঠো ভরা হাওয়ার হাওয়া, তো কেবল তুমিই পারো।
আমি তোমায় চিম্‌টি কাটি, মুখে দিই দুধের বাটি
চোখ থেকে চোখ পড়ে যায়, কোমরে সুড়সুড়ি পায়
তুমি খাও এঁটো থুতু, আমি তোমার রক্ত চাটি
বিলিবিলি খান্ডাগুলু, বুম্‌ চাক ডবাং ডুলু
হুড়মুড় তা ধিন্‌ না উসুখুস সাকিনা খিনা
মহারাজ, মনে পড়ে না?
( মহারাজ, আমি তোমার / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )

পুরনো বালক ভৃত্য ভোলাচ্ছে মহারাজকে, মহারাজ নামের শিশুটিকে। বলছে, ‘মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!’ আর ভোলাতে ভোলাতে,’ইষ্টকুটুম টাকডুমাডুম’ ‘বিলিবিলি খান্ডাগুলু, বুম্‌ চাক ডবাং ডুলু হুড়মুড় তা ধিন্‌ না উসুখুস সাকিনা খিনা’- এই সব শব্দ করছে যা অর্থহীনতার সারল্যে শিশুটির সাথে কমউনিকেশন সরল করছে ।
 আমাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই ধ্বনি দিয়ে তৈরি, শব্দ থেকে প্রচলিত অর্থে না গিয়ে উৎসে, সেই জায়মান ধ্বনি-আয়নে পৌঁছতে পারেন কবি। তাঁর কবিতাও প্রচলের পথ ছেড়ে ‘নতুন’ হয়ে ওঠে। 
গোধূলি কার গোধূলিকার
হাসলে কিছুদিন বরোজ সবুজ কিছুদিন
পান-ই-পান্না
মনে হবে শ্বাস ফেলছে অবন-পাখিরা ।
অস্থানে মনে নেই শোয়ার কুঁজে সারারাত উট ভরা লাই

দুর্গেই ছিল চূড়ান্ত নীপবন
সেও কার দুলকারি কে জানতো কার এত
          লয় ঝাড়া সুর
সেও এম্নি নাশের বুকে এম্নি পাতি
পটে বসলেই রটে যাচ্ছিল আদিগন্ত লিখিত
লু-থর

ভাঙা ভাঙা কাহিনীকত্থকে প্লাশই ডাকছে রাজপুত পলাশকে
...
( ও পলাশ / স্বপন রায় )

ধ্বনির যে সঙ্গীতময়তা, মার্গসঙ্গীতে, তালবাদ্যে, নৃত্যবোলে ধ্বনির যে পরম অবস্থান তাও ছুঁয়ে থাকেন কখনো ।
ভোজালির ভিল্লিতে চাপছে ভাবিনীর ভিন...
দুটো ঢং বালিশে সাজানো
শিশিরের ভোট নিয়ে সাতাশে হারালো
লিনায় পরালে
পারমাণবিক কোকুনে বিভ্রাট তুলে কোকিলা হেঁটে গেল ল্যাম্পের খোঁজে
পুরুষের স্বাভাবিক সুইচ
লটারি পেরোনো
বোতামে ডাম্প দেখ আড়াইশো বছরের...
দোদুম ফেনে ওঠো
    নিঝুম
আফিম
   ক্যাম্পাসে দোলো ঘোমটার আলে...
অলিতে গলিতে
ধা-নি-সা-গা
নি-সা
  নি-সা,
মা-ধা-নি
গ্লাসে গ্লাসে ঐরাবত ঠেলে
আমার নিদ লেগে গেল
‘দাদা আমাকে প্রিয়াতে ঠেলে দিন’...
ঢলে যাক
   মেহেদির লজ
        হিবিস ভোলানো,
        রুণা কপ্‌চানো
পা-নি
  পা-নি
নোনাদের ভ্রূণ
    ফুলমুন সধবারা নিয়ে গেল রূপ থুড়ি কলোনির ঘুম
আমাকে লম্ফ দাও
চিরুনিরা তল্লাশে ভালো...
এইখানে বসে আছে মরুলাল বাংলার জল,
সা-মা
    রে-সা
নি-রে-সা
লক্ষ লক্ষ মীর কোটায় ভূদেশে...
গামলার ঘর
আমাকে তুমি উষ্ণ পড়োনি ?
কী জানি রাম রাম ঝোঁক
   সবিনয় রোগ
      গা-মা
গা-মা
     মনিটর চর্চার দেশ
আমাদের টর্চের খোঁজ নিশায় পোড়েনি,
নিশিও বলেনি
    যমালয়ে হাত পাতো বেশ
    ‘মাগো ! মাগো ! দুটো দাওনা মাগো!’
  [ হিং চার চিল (অংশ ) / সব্যসাচী হাজরা ]
কবিতা সাধারণত অর্থের শৃঙ্খলা ধরে এগোয়, এগোয় কবির ভাবনাপথে। কিন্তু যদি তা ধ্বনিকে নির্ভর করে, সেই পথে লিখিত হতে থাকে ।
চাঁদের নাকি পা আছে
চন্দ্রপা শুনে আটকে গেছি
বিশ্বায়ন শুনেছো
শিল্পায়ন
কবিতায় আঁটে না এমন শব্দজ্যাম

যারা মৃত্যু দেখতে পাওনা
যারা উনুনে চাঁদের পা
চন্দ্রভাগা
অভাগা এই গেলো তো সেই গেলো
ক্রাচ দেখলাম
জয়পুর কাঠের পা
প্রজাপতি
       এবং ওই তারাটা
প্লেনের চলে যাওয়াও দেখো
ছায়া ফুরনো মানুষটার দুচোখ ভরা
( চাঁদের প্রতি-কবিতা / বারীন ঘোষাল )
 এইভাবে ধ্বনির কবিতা লিখিত হতে থাকে, তা শব্দকবিতা ( sound poetry )এবং নিঃশব্দ কবিতা ( non-word poetry)।
কিন্তু শব্দের অর্থ হয় কিনা, সে যে সংস্কারগত, ইতিহাসগত সাংস্কৃতিক অর্থ বহন করে তা খুলে নিজে যে অনর্থ পড়ে থাকে, যোগাযোগ-অসম্ভব যে ভাষার কঙ্কাল পড়ে থাকে তা আমাদের বেঁচে থাকাকেও কি নিষ্প্রাণ করে দেয় না?

তর্ক পেরিয়ে, তত্ত্ব পেরিয়ে সুকুমার রায়ের লেখা দিয়েই বুঝতে চাইব।
তাঁর লেখা নাটক ‘শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম’-এর অন্তিম অংশ ।
গুরুজি ।   শব্দের ঘাড়ে চিন্তাকে চাপাচ্ছ - ? ছিঃ ! অমন ক’রে শব্দশক্তি ম্লান কোরো না – আমার পূর্ব উপদেশ স্মরণ কর –
           শব্দের সঙ্গে    তার অর্থের যে একটা সূক্ষ্ণ ভেদাভেদ আছে সাধারণ লোকে সেটা করতে পারে না ।
সকলে ।  তাদের শব্দজ্ঞান উজ্জ্বল হয়নি –
সকলে ।  তারা শব্দের রূপটিকে ধরতে জানে না –
গুরুজি ।  তারা ধরে তার অর্থকে । তারা শব্দের চক্রের আবর্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায় । যেমন কর্মবন্ধন, যেমন মোহবন্ধন, যেমন সংসারবন্ধন, - তেমনি শব্দবন্ধন !
সকলে ।  শব্দবন্ধনে প’ড়োনা- প’ড়োনা-
গুরুজি ।  শব্দকে যে অর্থ দিয়ে ভোলায় – সে অর্থপিশাচ । শব্দকে আটকাতে গিয়ে সে নিজেই আটকা পড়ে । নিজেকেও ঠকায়
           শব্দকেও  বঞ্চিত করে । সে কেমন জানো ? এই মনে কর, তুমি বললে ‘পৃথিবী’ – তার অর্থ কর দেখ দেখি? – সূর্য
           নয় চন্দ্র নয় আকাশ নয় পাতাল নয়  - সব বাদ – শুধু পৃথিবী ! এরা নয় অরা নয় তারা নয়, এসব কি উচিত ? আবার
           যদি বল ‘পৃথিবী গোল’ – তার সঙ্গে অর্থ জুড়ে দেখ দেখি, কি ভয়ানক সংকীর্ণতা ! – পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে তো
           বলা হোল ণা – পৃথিবীর উত্তরে কি দক্ষিণে কি, তা বলা হল না – তার তিনভাগ জল একভাগ স্থল, তা বলা হল না –
            তবে বলা হল কি ? গোটা পৃথিবীটার সবই ত বাদ গেল ! এটা কি ভালো ?
সকলে ।  আজ্ঞে না – এটা ত ভালো ঠেকছে না – তাহলে কি করা ্যায় ?
গুরুজি । তাই বলেছিলাম – শব্দের বিষদাঁত যে অর্থ, তাকে আগে ভাঙ । শুধু পৃথিবী নয়, শুধু গোল নয়, শুধু এটা নয়, শুধু ওটা
নয় ; আবার এটাই ওটা, ওটাই সেটা – তাও নয় । তবে কী ? না
[ গৌ গবৌ গবঃ –
  হলদে সবুজ ওরাং ওটাং – ইত্যাদি ]
[ বিশ্বকর্মার আবির্ভাব ]
বিশ্বকর্মা । নিঝুম তিমির তীরে শব্দহারা অর্থ আসে ফিরে
কালের বাঁধন টুটে দশদিক কেঁদে উঠে
দশদিকে উড়ে শব্দধূলি উড়ে যায় উড়ে যায় মোক্ষপথ ভুলি –
ভেবেছ কি উদ্ধতের হবে না শাসন ? জাগে নি কি সুপ্ত হুতাশন ?
বিদ্রোহের বাজেনি সানাই ? শব্দ আছে প্রতিশব্দ নাই ?
শব্দমুখে প্রতিলোম শক্তি এসো ফিরে কুণ্ডলীর মুখ যাও ফিরে
শব্দঘন অন্ধকার নিত্যঅর্থভারে  নামে বৃষ্টি ধারে
শব্দ যজ্ঞ হবিকুণ্ড অফুরন্ত ধূম এই মারি শব্দকল্পদ্রুম
    [ ‘দ্রুম’ শব্দে সশিষ্য গুরুজির স্বর্গ হইতে পতন ]
        ।। যবনিকা ।।



নৈঃশব্দ  ছিন্ন করে
শুভঙ্কর পাল 



তারাহীন আকাশে শরীরী উটের গ্রীবা পেড়িয়ে যাচ্ছে জংশান
মুখোশের আড়ালে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর
বিন্দু বিন্দু ফসফরাসের জোনাকি
তলোয়ারের খাপিখুলে  আল দেওয়া ধানক্ষেত
আর চোখে ছাই রং মেখে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে হ্রদ
দৃশ্যত পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছি রেখাচিত্রের নিস্তব্ধতায়
উলঙ্গ পাখিদের লেজে নৈঃশব্দ  ছিন্ন করে
এক ঝাঁক জানালা উঠে এল হাটু জলে
তেষ্টা মেটাচ্ছে চাঁদের কুসুম , খোলসহীন শামুকের দেহে
না , কেউ নেচে উঠেনি মৃতের স্তূপ ঠেলে
অন্যেরা মাতাল ঘুমে কিংবা রাজার আমলের গল্প শুনতে বসেছে-
ভোরের পিরামিডের গল্প
বাগান সাজিয়ে রেখেছে ভোরের প্রতীক্ষায়
বাদামী কিংবা বেগুনি-হলদে নামহীন ফুলে
আর শ্যাওলা ধরা দেয়ালের আড়ালে তাড়াতাড়ি মুখোশ বদল হয়ে গেল ।
মৃত্যুকে, মৃত্যু কে? 
 স্বপন রায়

এ ছাড়া সব ঠিকঠাক। রুমাল বের করে মুখ মুছলো, একধরণের স্মৃতি যা বের করতে হয়, রুমাল

এরকমই এসব, চাঁদ যেরকম নয়। ওই গোল বা বিসর্গ বা হেলমেটের অপেক্ষা। মুখ মুছলো, শব্দ হল চলে যাওয়ার

আজ চলেই গেল
অথচ পর্দার রঙ নিয়ে লেখার কথা যার, সেতো আমিই। মেঘে পর্দা দিলাম, পর্দায় মেঘ বসালাম। মুখ মুছলাম, কারণ রুমাল

কারণ রুমাল তো রুমালই, এত কিছু রাখবে কিভাবে...
চুপকথা

মিতালি চক্রবর্তী


আগে পিছে কথার জঞ্জাল

জলের মাঝে অজস্র আল্পনা,

মাছ আর সাপের খাদ‍্যশৃঙ্খলে

মনের মাঝে স্বজনের আনাগোনা।

প্রতিটা রাত জ‍্যান্ত হয়ে আসে

শরীর চেনার নিদারুন  অভ‍্যাসে,


অথচ, তফাৎ জলে আর মাটিতে

তাবৎ সত‍্য অন্ধকারের সাথে
মেলায় হাতে হাত,,,


বাকি থাকল কলসী উপুড় তত্ত্ব

সাজানো লোকাচারের সিঁদুরে ব্রাত‍্য


বরনডালা ,কুলো,ধানের শিষ


দুই একখানি দূর্বার আশীষ।


ব‍্যস এইটুকুতেই ক্লান্ত নৈর্ব‍্যক্তিক

ভরাপেটে কাপড়চোপড় আনুষঙ্গিক

মন্থনদন্ড থাক বা নাই থাক


অমৃতের যোগান আবশ‍্যিক।
ডায়েরি 
নীলাদ্রি দেব


আমাদের পদক্ষেপে আর কোন শব্দ হয় না এখন
গতি ও শব্দহীনতা নিয়ে বিতর্ক সভার মাঝে বিজ্ঞাপন

তরুণ শিকারির হাতে রং মশাল
                                     ভাবতে পারিনি
ভাবতে পারিনি, দেশে দেশে ধর্মের চাষ
তবুও ভেঙেছে নদী, ভেসে গেছে পাহাড়ের ঢাল

সমস্ত আঙুল আজ মানুষের দিকে
পৃথিবীর অনন্ত বেসুরো গান বেজে যাচ্ছে বুকের ভেতরে
চুপ ও চিৎকারের মাঝে
                    থেকে যাচ্ছে অমীমাংসিত অন্ধকার

নিঃশব্দ প্রেমিকা
অরুণাভ রাহারায়


তোমার উপেক্ষা-রং উড়ন্ত গোধূলি...
চাঁদের অপর পিঠে মুখ ঢেকে আছে।

ঘুমন্ত চোখের পাতা বুজে-আসা-নদী।
সমস্ত নদীর জলে আলো ধুয়ে যায়...

অফিসের গেটে এসে মুহূর্তে দাঁড়াও--
তখন শরীর দিয়ে বিদ্যুৎ গড়ায়...
কথা ছিল
             শোভন মণ্ডল


আলোর উলটো দিকে পথ খুব অচেনা
তবুও এগোতে হচ্ছে
কথা দিয়েছিলাম,  এভাবেই যাবো
যেতে যেতে নেমে আসবে ভারী বর্ষণ
শ্রাবণের ধারা, অলীক স্রোত

তোমার প্রশ্রয়গুলো গুছতে গুছতে এগিয়ে যাচ্ছি
একটা মৃত সুড়ঙ্গ আমাকে ডাকছে
সেখানে যেসব লাশ পড়ে আছে তাদের কাউকে চিনতে পারছিনা
যদিও চেনার কথা নয়

তোমার ইশারাও ছিন্ন করতে হবে
পিছুটান ফেলে এগোতে হবে
এগোতে হবে,  এগোতে হবে

কথা ছিল
এই সব কথা ছিল
ভালো না বাসার কথা ছিল

শব্দ (ভাঙা) কক্ষপথ...

অভিজিৎ দাসকর্মকার 


নগ্ন হয়ে বাজছে নুপুর 
       জলগুচ্ছের তলায়- 
          নিজেকে জলজ বানাই
              অভিশাপমুক্ত চোয়ালে
                     বদলে যাচ্ছি ক্রমশ
            আর-
            প্রবাহমানতায় ক্রমাগত 
  অনুবাদ করছি 
        সংখ্যালঘু স্রোত ভাঙা শব্দস্নান
               এবং
            উত্তাপ বাড়ছে আক্রান্ত শরীরের অনুকুলে
      
 ঘটমান বর্তমানে দাঁড়িয়ে 
      তবু
        আজও
    প্রাচীন নদীস্রোত উপত্যকায় মজেছে
সেই প্রতিফলনে মোহনামূখী জলও 
                                  সহ্য করতে পারেনা  চোখ আর বহমানতার শব্দ (ভাঙা) কক্ষপথ--





হারামি কবিতা
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
৮.
কবরে চোখ রেখে উড়ে যায় বাইকপাখি
এক রক্তাক্ত যীশুকে দেয়ালে বসিয়ে

খসে যায় অসমাপ্ত কদম ফুল বেদনার ঘাসে
হলুদ বর্ণের গান হয় নৈঃশব্দের ভাষায়

পাতলা পর্দাটি কখন লক্ষ্যভেদ করে
অদেখা বাসাটি ঢুকে পড়ে অন্তর্বাসে

কার মর্জি কাকে অমার্জিত করে পাতালের ভিতর জলকথা শোনে

২.
শীতল


মার্চে শীতল অনেক দিন পর
পাতার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে
জারুল নীলনবঘন 
কালরাতের শিলাবৃষ্টির টিকা
লেগে আছে বসন্ত না আসা ডালে
বেদনার্ত আঁতুড়ঘর
মাটিই মাটি দিয়ে চলেছে
গাছেদের পাড়া
ঘিরে আছে নৈঃশব্দ্য
এতটাই শীতল
কেঁপে ওঠে হত্যাকারীর রু

৩.
দৃশ্যকল্প


নৈঃশব্দ্য পাঠ করি আমার ভিতরের
ঝরে পড়া বিষাদসেলুনে জোছনার সৌন্দর্য
কিছুদুরে জীবনবাবুর তবলা লহৱা
মিশে যায় আরেক তারা আশুদার
রাগাশ্রয়ী গানে
প্রতিদিন খোলা পড়ে গোঁসাইবাগান
ছায়াছাড়া হলুদ ঘাসের পদাবলী
এঁকেবেঁকে যে কেউটে তার গা ছোঁয়
তার যৌন ইতিহাস পড়া হয় নি আর
টুকিটাকি লেখার ভিতর চৈত্রের দুপুর
গাছ চাই , গাছ চাই হাঁকে অবাক জলপান
 নাটকের পর- অভাবে 
 ‎ভাবের ঘরে ‎চুরি করে ফেলে
 ‎দৃশ্য নয় দৃশ্যের বাইরে থাকা চোখ
 ‎থম বসিয়ে রাখে তবে এ প্রথমবার নয়



তৈমুর খান

নৈঃশব্দ্যের পাড়ায় মেঘ জমে
_____________________________________________

  
       


নৈঃশব্দ্যের পাড়ায় মেঘ জমে
গার্হস্থ্য বিকেলে ভয় নাচে
আমরা পুতুল হয়ে খোকা ও খুকুর ঘরে
শুয়ে থাকি ।
আমাদের বিবাহ উৎসব
প্রচলিত বাল্যধারণায় প্রবেশ করি
ফুলশয্যায় ।
আনন্দ ব্যঞ্জনে মিষ্টি মুখ
আহা কত কত মিষ্টি শাকপাতা ধুলোমাটি...

যদিও পুতুল , ব্যাকুলতা স্পর্শ করে
ঘুমের আড়ালে অজাগর
কষ্টগুলি নোনতা ফুলের মতো ফোটে

বাতাসের বাজনায় আন্দোলিত কোনো গান
ঘুরেফিরে আসে
মৃত ও জীবিত সমুদ্র উথাল পাথাল...
যখন থেমে যায় সব
 সত্যম ভট্টাচার্য



চরম নৈঃশব্দের সাথে মৃত্যুর একটা কেমন জানি সম্পর্ক রয়েই গেছে।কারণ যে ক্যাকোফোনি আমাদের ঘিরে থাকে সবসময়-দিবারাত্র,স্কুলে শোকসভার সময়ই প্রথম আমরা তার বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।চারিদিক থেমে যাওয়া এক চরম নৈঃশব্দ আমাদের সকলেরই প্রথম অনুভব হয় কন্ডোলেন্সের লাইনে দাঁড়িয়েই।আর কন্ডোলেন্স মানেই তো মৃত্যু-শোকসংবাদ।ঠিক মনে পড়ে না প্রাইমারী না হাইস্কুলে প্রথম শোকসভায় নীরবতা পালন করেছিলাম।কিন্তু এটা খুব মনে পড়ে যে ভেবলে গিয়েছিলাম রীতিমতো।কারণ সব স্কুলে সবসময় একটা শোরগোল লেগেই থাকে।ক্লাস শুরুর আগে বা টিফিনে বাচ্চাদের চিতকার-ক্লাসের সময় স্যারেদের পড়ানো-বা বাচ্চাদের সমবেত পড়ার আওয়াজ-দেখলাম তার থেকে একদম সরে গিয়ে আমার চেনা স্কুল কোন একদিন সকালে কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।একদম নিথর যেন,ঠিক সেই মৃতদেহের মতোনই।সকলে বলেন পিন পড়া নিস্তব্ধতা।সেই প্রথম সেইদিন আমরা একে অপরের নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেলাম।আমার চেনা স্কুল চেনা চারপাশে কেমন যেন এক থমকানো পরিবেশ ধীরে ধীরে নেমে আসতে লাগলো।একটা ভয়ানক দম বন্ধ করা নৈঃশব্দ তখন গ্রাস করছিলো গোটা স্কুলচত্বর।সশব্দ জীবনের লাইনে যে অশ্বমেধের ঘোড়া দিবারাত্র চলতে থাকে প্রথম তা অনুভব করলাম থেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।যে বিচ্ছু ছেলেটা হই হট্টগোল করে সবসময় মাতিয়ে রাখে গোটা স্কুল সেও দেখলাম মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আর আমি ভাবছিলাম যে এটা হতে পারে?হতে পারে এত চুপচাপ চারিদিক।রীতিমতো ভয় ভয়ই লাগছিলো আমার তখন।ভাগ্য ভালো যে স্যার ঘড়ি দেখছিলেন এতক্ষণ মাথা নীচু করে, যখন মাথা তুলে বললেন যে এবারে আমরা কোনরকম হট্টগোল না করে বাড়ি ফিরে যেতে পারি,তখনই আবার ধীরে ধীরে চেনা স্কুলের পরিবেশ বা ছন্দ ফিরে এলো।হ্যাঁ,নিত্যদিনের এই আওয়াজ-এই কোলাহল-সশব্দ পরিবেশের মাঝেই লুকিয়ে তাকে জীবন।তাই তো কোন কোন সময় নৈঃশব্দে ভয়ই লাগে।
অথবা খুব মনে পড়ে সেই সকালটা-খুব সম্ভবত রোববারই ছিলো মনে হয়-যখন সবাই মিলে বাবাকে নিয়ে এলো-আমি বসে ছিলাম আমাদের ছেড়ে আসা পুরোনো বাড়ির বারান্দায়-বাবাকে দেখছিলাম-চরম কর্মক্ষম লোকটা কেমন বছর দুয়েকের মধ্যেই ফুরিয়ে গেলো।চারিদিকে অনেক কথা বলছিলো অনেকে,কিন্তু আমাকে তখন ধীরে ধীরে গ্রাস করছিলো এক প্রগাড় নিস্তব্ধতা-চরম নৈঃশব্দের এক ধূ ধূ বালুচরে বসে আমি শুধু স্বার্থপরের মতো ভাবছিলাম-এরপর কি হবে আমাদের...এখন বাবা চলে গেছে অনেকদিন,অথচ প্রতিটি মুহূর্তে আমি তার নিঃশব্দ পদচারণা অনুভব করি আমার চারপাশে।এই নৈঃশব্দ,এই নিঃশব্দ পদচারণা যেন চিরকাল আমার সাথে থাকে।

নৈঃশব্দ্য কথন
চিরঞ্জীব হালদার 


বিড়ালের সাথে বিড়ালের সম্পর্ক সমান নৈঃশব্দ্য।একটা ছিচকাঁদুনে বিড়াল আর শব্দ না করে অন্ধকারে এক'শ আশি ডিগ্রী অবস্থানে ভেসে থাকা শয়তান বিল্লির  চোখ দুটো নৈঃশব্দ্য আর নৈঃশব্দ্য।সাদা বিছানা জুড়ে অজস্র টগর ফুল ফুটে আছে।কে যে মজা করে এক শিশি ফলিডল ছুঁড়ে দিল ঘোসপুকুরে, সকাল বেলা উঠে  দেখি পুকুরে জল কই,মাছেদের মড়কের ভেতর ওরা যেন উৎসব শুরু করেছে।
খে্সারি ক্ষেতে সাদা থান পড়ে পরমাসুন্দরী পদ্মপিসি মিলিয়ে গেলে তাকে কি নৈঃশব্দ্য বলবো।যে দিন আমার সাইকেল চুরি হল,যেদিন দেরীতে পৌঁছলো বিধবা মায়ের হাতে আমার যন্ত্রণাদগ্ধ বাসি অভিজ্ঞাপত্র,যে দিন আমি মার্কেজ কিনতে পারিনি , ভুন্টি ভুন্টি করতে করতে একরত্তি মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে গেল,পেয়ারা বাগানে ডাঁসা ফলের পাশে একটা লাল টুকটুকে ওড়না একা একা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে ,তাকে কি নামে ডাকবো। নৈঃশব্দ্য প্রকৃত বান্ধবীর মত। ভার্চুয়াল নয়।যারা নিরুদ্দেশ হয়,যার রেল পাতের উপর রক্তাক্ত পড়ে থাকে , যারা দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরে শোনিত বিক্রি করে ,যারা শৃগালের মুখ থেকে পচনশীল মাংসের কাছে গোল হয়ে বসে নৈঃশব্দ্য পান করে তকে কি নামে ডাকবো।
মার্কেজ কাকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘এক’শ বছরের নিঃসঙ্গতা।দুটো শব্দের মধ্যে একটা হাইপেনের থেকে নিঃসঙ্গ কি আর হতে পারে। এরা সারা বছর নিরুদ্দেশ।আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।সেই যুগলও কি ভয়ানক কোন দ্বীপে গা ঢাকা দিয়েছে।কোন যৌন তাড়নায় না আরক্ত জন্মের সা্ধনায়।কে বলবে পাঠক? সে ও তো বড় হেঁয়ালি। আর যদি পাওয়া যেতো তাহলে কি সুবর্তুল যুবতীর স্তন থেকে পচনশীল জন্মের থেকে বিস্ফারিত নৈঃশব্দ্য তারদের ডেকে ডেকে বলতো –এস আজ আমার ঘরে আমার গৃহপ্রবেশ।সেই আমগাছটা ,সেই পারিজাত ফুল,সেই জামরুল গাছে ঝুলিয়ে রাখা মৃত্যুঞ্জয়দাদুর কাতান মাঝে মাঝে এলিয়টের ঊন্মাদিনী প্রেমিকার কাছে বসে গুলতানি করে।এক ঘর বইয়ের মধ্যে একটা বিড়াল, যেন ঠেকা নিয়ে বসে আছে একটা অক্ষরও যেন পালিয়ে যেতে না পারে নৈঃশব্দ্যের তীব্র সাদা থেকে।চন্দ্রগ্রহণের সময় কেন যে ঘুম কেটে গেল।যে পুকুর চিরকাল বাঁজা ,একটা ল্যাঠা মাছের জন্ম দিতে অক্ষম,কিছু বেহিসেবী আলোর গুলতানি দেখি ভরে থাকে সারা সবুজ আগাছায়।চারপাসে এত কলকাকলি, বেলুন ওয়ালার চিৎকার সব ফিরিয়ে দেয় বাঁজা পুকুরটা।
পঞ্চিস্যাকরা কোনও নারী কে গর্ভবতী করতে পারেনি ,অথচ তার দোকানের চারপাশে থরে থরে গর্ভফুলের ছড়াছড়ি।নাম না জানা ডাগর মেয়েটাও দেখি কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে এক গ্লাস জল চাইলো।আমি তাকে দেখতে পাইনি।মাইরি বলছি পাঠক,শুধু তার ছায়া দেখে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি।যেন নৈঃশব্দ্য উগরাতে উগরাতে একটা হেলিকপ্টার দুপুর শাসন করতে করতে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল নাতালিয়াদের মত।যারা আর ফিরে আসেনি মার্কেজের কাছে।
যেঁ আমার আজও বন্ধু, চার কেলাস পাস করার পর স্কুলের গন্ডি আর মাড়ায়নি,উমাচরণ কর্মকার কে সে চিনতে চেয়েও চুড়ান্ত অসফল। একদিন খরদ্বিপ্রহরে কসবার মাঠপুকুরে বাসের অপেক্ষায় দাঁডিয়ে আছি।এক লাজুক মধ্যবয়সী মহিলাকে দেখি হাতে টিফিন কৌট নিয়ে ছায়া ঘেঁসে আমারই অতি কাছে দাঁড়িয়ে আছে। টের ও পাইনি।ইনি কি সেই প্রাচ্যের অশিক্ষিত নাতালিয়া।একটা অটো এসে দাঁড়ালো,উঠতে গিয়েও উঠলাম না। এও কি তার কারসাজি।অসহিষ্ণু আটো চালক।ছেড়ে যাওয়া যাত্রীর প্রতি ঝাঁঝালো স্বর নিক্ষেপ করতে করতে অন্য যাত্রীর তয়াক্কা নয়া করে চলে গেলো।এই যেঁ দাঁড়িয়ে রইলুম আর এই ফাঁকে আমার বহুদিনের স্মৃতি নামোছা  পাঠশালের শ্যামবর্ন সহপাঠী উদিত হলো এক অস্থির নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে । যেন বিসর্গের বিন্দুর মত। একটা সে আর একটা তার সহধর্মিনী।যে মধ্যবয়সী এক নিরাপদ দুরত্ব জুড়ে এতক্ষন সুন্সান স্তব্ধতার মায়া নির্মাণ করছিল না জেনে আমি টের পাইনি।সময়ের কি নিদারুন ব্যাপ্তি।কি রসালাপ।কি ভঙ্গীমা ।তার ডাক নাম বুড়ো।ভালো নাম আসিত।হয় তো সে প্রকৃতার্থে অসিত।ভগ্ন রাত ও মনে হয় তার পোষা বেড়াল।আমাকে হিপ্নোটাইজ করে।জাদুতাড়িত দেহ মাত্র আমি।সে আমাকে ন ন্তে বালির বাগান থেকে পাকা টুকটুকে তেলা্কচু কত এনে দিয়েছে। তুলসি দাদুর বাগানে ডাঁশা বাংলা আমড়া এনে দিয়েছে।হ্যান্ডেল ভাঙা সাইকেলে বসিয়ে দয়ারাম্পুরের মোড়ে শ্যামাপূজোর তুবড়ি প্রতিযোগীতায় নিয়ে গেছে।সে আমার প্রেমিকার উৎকৃষ্ট পত্রবাহক হতে পারতো, হয়নি সেও কি নৈঃশব্দ্যের চক্রান্ত।যার তার সাথে আমার জন্য ঝগড়া করতো। মার খেয়ে নাক দিয়ে লাল নিঃশব্দ গড়াতো।সেই ঝগড়া করনেওয়ালারা আজ আর একজনও বেঁচে নেই।এই ষাট ছুঁই ছুঁই দেহে সে এখন ও শক্তোপোক্ত গতর মজুয়া নাগরিক মাটির কাছে। 
খুব জানতে ইচ্ছে করে যে সব রবীন্দ্ররচনাবলীর পাতায় কো মেদুর চোখের চোঁয়া লাগেনি,বইগুলো  আজ ও অপেক্ষায় আছে কোন উৎসাহী পাঠকের অপেক্ষায়।
ঝকঝকে পূজোবাড়ির থান ,যেখানে ঠাকুর বাসানো হয়।তার চারপাস হালদার মোড়ল
সিমেন্ট ছাইতে দেয়নি ,সিঁদুর খেলার সময় পাড়ার এয়োতিরা খালি পায়ে আলতা মুগ্ধ পায়ে এই মাটিতে অনৈঃশব্দ্য বেঁটে দিয়ে যায় সারা বছরের জন্য।আরতির সময় থেবড়ে বসা গৃহিনীদের স্ফীত মধ্যদেশে এই মাটি থেকে ঊঠে আসা ডাগর মৌনতা গুলো শারদীয়ার মূহুর্ত গুলোকে স্বর্ণমন্ডিত করে।এদের নাতি দূরে স্বামী খোয়ানো ,স্বজন খোয়ানো গৃহীরা এক অলিখিত নিয়মে নির্বাক জড়ো হয়।আরতির মুগ্ধ আলোকরেখা গুলো এক মহাজাগতিক মহানৈঃশব্দ্য ছাড়িয়ে দিচ্ছে চুড়ান্ত ঘন্টা বাদনের মধ্যে।
অর্জুন গাছের ছায়া তখনও গাঢ় হয়নি।পুকুরের জল সারা বছর কোমর সমান ।ছায়া গাঢ় হলে নৈঃশব্দ্য যেন চোদ্দগুষ্টিকে নিয়ে পুকুরের উপর
ঝাঁপিয়ে পড়তো।ওরা তুতো ভাই-ভাগ্নেদের নিয়ে আধা ঘোলাটে পুকুরের উপর জমিয়ে আড্ডা মারতো।এসব অনুভব করতে করতে মা অর্জুন গাছে হেলান দিয়ে একের পর এক লকলকে ছিপে তুলে আনতো সরপুটি -খয়রা- ট্যাংরা।ঠিক যেন নৈঃশব্দ্য এর পিতামহীর সাথে অনর্গল বৈকালিক 
আড্ডা দিতে দিতে ফাতনার উপর সতর্ক  নজর রাখতো।তখন তাকে অতি জাগতিক এক কায়া মনে হতো।অর্জুন গাছ ও যেন তার যুতসই দোসর।তার কাছে যেতেও গা ছম ছম করতো।হায় কালের নিয়মে সেই অনাবিল অশৈল শব্দ শহুরে সংস্করনে
প্রত্যেকের ভেত র তাঁবু খাটিয়ে বসেছে।সংসার স্ফিত হোক বা রাজনৈতিক অচারুময়তা আমাদের
চারপাশে দমবন্ধ একাকিত্ব আর তার বিশ্বস্ত 
অনুচর নৈঃশব্দ্য।মার্কেজের ম ত তুমিও কি আমাদের মহান করবেনা।
কবিতার নির্জনতা
প্রবীর রায়



নীরবতা যখন মুখর তখনই তাকে চেনা যায়,যাকে চিনতে চাওয়া বারবার।
বাগানের কোনের লিচুগাছটা চুপচাপই থাকে,তবু তাকে মুখর হতে দেখা যায়, যখন বাতাস এসে কথা বলতে চায় কিংবা ঝড় এসে শুইয়ে দিতে চায় তাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় অসম লড়াই।
গাছকে পাখিও বলে কথা বলতে,কিন্তু তখন সে শুধু শ্রোতা হয়ে থাকতে চায়।
তবুও ঝির ঝির শব্দে তার আবেগ নির্ভরতা মানুষকে প্রভাবিত করে। অবাক মানুষের নীরবতা তৈরী হতে থাকে ক্রমশ ।

মানুষের এই দোষ।কথা বলতে চায়। দুদন্ড চুপচাপ থাকতে পারেনা। যদিও বা থাকে, তাকে বিষণ্ণতার প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।আনন্দের মুহূর্তে তার নম্র উল্লাস নীরবতা ভঙ্গ করে।
রাত কি শব্দহীন থাকে আদৌ, না , ঠিক তখনই মুখর হয়ে ওঠে চারিপাশ।দিনের আলোয় ঢাকা শব্দেরা জেগে ওঠে। নানা ছবিধ্বনি আছন্নকে স্বপ্ন দেখায়।

অনেকে নীরব কেউ কেউ শান্ত।কিন্তু শব্দহীনতা কখনই গ্রাস করে ফেলতে পারেনা তাকে।
এসময়ে শিল্পীর তুলি মুখর হয়ে ওঠে। রঙের ভাষা আর তুলির টানে ফুটে উঠতে থাকে আঁচড়ের দাগ। কবিকেও ডুবে যেতে হয় মনের গভীরে যেখানে কোলাহল আকৃতি পেয়েছে বর্নমালায়।
এরপর কবিও মুখর হন তাঁর রচনায় যা সে পেয়েছে ভাষাহীনতা আর স্তব্ধতার পৃথিবী থেকে।
কবি কি নির্জনতার হতে পারেন কখনও? মনে হয় না।বিশুদ্ধ কবিতার প্রচারকেরা মনে করেন কবিতার সাথে জীবনযাপনের কোনও সম্পর্ক নেই।আবার সমকালীন কবিতা চর্চায় সমাজ প্রকৃতি আর মানব সম্পর্কের পরিবর্তনের  বাঁকগুলির অনুসন্ধান আছে।

জীবনান্দ দাশকে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন নির্জনতার কবি। জীবনানন্দ নিজে নির্জনতা বিশেষনটি মেনে নিতে পারেন নি।কিন্তু প্রকৃতির কবি, অবচেতনার কবি, নিশ্চেতনার কবি এমন নানান আখ্যায় ভূষিত করা হলেও তিনি নিজে এ সমস্তকেই আংশিক সত্য বলে মনে করেছিলেন।

নৈঃশব্দের ভূমিকা কবিতা কিংবা কবির কাছে কী,এই ভাবনায় মনে হয় কোনও কবির ক্ষেত্রেই নির্জনতা বিশেষনটি খাটেনা। কবিকে তার চারিপাশ যা দেখায়  তাকে যে ভাবে ভাবায় তাকে গভীরে নিতে কবির ধ্যানময়তার প্রয়োজন আছে।তার জন্য কবিকে নিজের মখোমুখি বসতে হয়।এটা কবির একান্ত নিজসব সময়।এজন্য কখনই তিনি নীরবতায় থাকেন না।বরং চেতনে অবচেতনে কিংবা অতিচেতনায় সেখানে শব্দছবির কোলাহল। বাইরের মুখর জগতের থেকে তিনি আপাত বিচ্ছিন্ন থাকেন।

পাঠের সময় সমকালীন কোনও কবিকেই নৈঃশব্দের ছবি আঁকতে দেখিনি। বরং তাঁর জীবনযাপন আশাভঙ্গ মানবিক বিপর্যয়গুলি  কোলাহলের ভিতর এক শান্ত কেন্দ্রবিন্দুতে 
শব্দ ও ধ্বনির নতুন শরীর আবিস্কারে মগ্ন রেখেছে।




মুক্তগদ্য (নৈঃশব্দ্য)



ধূলির সরগমে আঁকা আমার স্বাক্ষর
উদয় সাহা 



এক.

আমাদের ঘুমের কোন রঙ নেই। সীমান্তে সিঁদুর ছড়ালে চিলেরা কান্না জুড়ে দেয়। প্রপিতামহের গল্প নয়নতারা ফুল হয়ে বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকে। আমাদের প্রিয় স্বপ্নদের যদি একটা অরণ্য থাকতো !  তামাটে শরীরে কুয়াশায় ভেসে ভেসে চলে যেতাম একদিন ... 

দুই.

শ্রাবণের শেষে রাস্তার দু'ধারে গড়ে ওঠে পাটকাঠির মিনার। অদূরে জলাভূমির পাশে কিশোরের নতুন গোঁফের মত কাশফুল। কিছু অপাঠ্য ইচ্ছেদের কথা মনে পড়ে। আর ভেবে ভেবে ব্যথা পাই। নক্ষত্রের রাত্রি তবু থাকে। থাকে সজনে গাছের হাওয়ায় রাত্রির অবসান...একটা অনার্ত রাত্রি...

তিন.

যতদূর চোখ যায় ধূধূ প্রান্তর ---আশ্চর্য মাঠ।ছোটবেলায় দেখা সেই চালতাগাছ, ন্যাড়া অশ্বত্থ নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে আছে ছায়াঘরের ঝিমবেলায়। রেশমি আলোর বুফেতে ডাকসাইটে চলে আসে তোমার জন্যে আঁকা তুলোবীজ। আমাদের অভ্যর্থনার আকাশ ধূসর ; নিমপেঁচার কনসার্টময়।

চার.

পুকুর, নদী, সাগর যে মুগ্ধরেখায় একসাথে বসবাস করে তার নাম জলপ্রহর। তোমার বুক কিংবা চোখ সেই প্রহর মাখানো শ্রাবণবেলা।
নয় কি?  ভেবে দেখো। ভেবে দেখো কতটা গভীরে প্রোথিত হয়েছে স্মৃতিবৃষ্টির টুপটাপ ---চুমুর আগে কাঙাল প্রেমিক ; চুমুর পরে গ্রামদেশ...

পাঁচ

চলে যাব একদিন। ঘুম পাড়াব আমার ভেতর জাগতে চাওয়া নদীকে। সেদিন খুব শান্ত হব। হৃদয় পথে থমকে যাবে বাতপতাকা আর রুমালের ভাসমান গান। সেদিন আঙিনায় জ্বলবে না সন্ধ্যাবাতি। গোধূলি বাজাবে না শান্ত শাঁখ। নির্লজ্জ চাঁদটা পিছলে যাবে মেঘ থেকে মেঘমল্লারে। শুধু অনুভূত হবে অন্দরমহলের লবণাক্ত জল। টুপ করে খসে পড়বে মরশুমি ফুল... আমি তখন রোদ্দুর হব। 
কবিতা বিভাগ ২:

একটি মৃত্যু
সঞ্জয় দাশগুপ্ত 


আমার নৈঃশব্দরা স্বপ্নতে আসে
বিদ্রুপে হাসে, ভঙ্গ করে নিয়ম।

আমার কোলাহল একাই আসে
নৈঃশব্দের কবরে ‘বসে একাদশী ব্রত করে পালন। 
নির্ভার
জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি


এই সবকিছু থেকে দূরে
একটা নিমগ্নতা পেতে চাইছি আমি

এই শব্দের অহংকার, এতো বেশি কথা কেন

আমি চাই, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে
নির্বাক করে দিক কেউ আমাকে
হাতে হাত রেখে অক্ষরহীন

এতটাই নিমগ্ন হতে চাইছি আমি
যেখানে শব্দরাও শব্দহীন

আমি নিঃস্ব, নির্ভার







জীবন যেমন
রিয়া রিয়া চক্রবর্তী 


হঠাৎ সেদিন পথের বাঁকে, কি জানি কার ডাকে, পেছনে ফিরে খুঁজে পেলাম নিজেকে। অনেক আলোর দিনেও, সেই বৃষ্টি ভেজা পাতার গন্ধ-ছায়ায় নিজেকেই খুঁজি। সেদিনেও গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টিরা এসে  জল-চোখে চোখ মিলিয়েছে। দৃষ্টির এতটুকু আকাশ, চাইতে গিয়ে গুটিয়ে গিয়েছি নিজের কোলের ভিতরে।রাতের পর রাত নিজের কোলে কোল পেতে ঘুম পাড়াই আমি। অগুন্তি তারার গাঢ় পর্দার ওদিকে আস্তে আস্তে বড় হয় রাত। একটু একটু করে নীল রঙা রাতভোর। আর একটু একটু করে রোদ পেয়ে মুছে যাস তুই। এখন আমি একাই চলি। নিজেই নিজেকে ভালোবাসি। এখনও আমি নদী খুঁজি রোজ। নদী খুঁজি রোজ, চুপি চুপি আনমনে, শহরের পথে পথে, মনে মনে, বিসর্জনের সময় এসেছে বোধে-অবোধে। তোকে কি চেয়েছে কেউ? বা আমি? পাঁজরের খাঁচার একটা একটা করে আগল উপড়ে নিচ্ছি রোজ। আর একটু একটু করে তোকে রোজ ভাসিয়ে দিচ্ছি জলে। জানি তোকে দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে সকলে, জানি তোর অনেকেই আছে। আমার কিন্তু শুধু ছিলিস তুই। 

তবু কেউ জানবেনা, এখন, ঠিক এই সব মূহুর্তেরা বড় বেশি নিঃসঙ্কোচে নিঃসঙ্গ।নিজেকেই বলি “একলা হবি সই?”হাতের মুঠি খুলে গেলো হঠাৎ হাওয়ার টানে। এলোমেলো এক পলকে সব বোঝাবুঝি। আঙুলের আলগা হল ফাঁক। একে একে চলে গেলি তুই, এক পা এক পা করে; তোর শেষ আকার টুকু মিশে গেলো ছায়াপথে।অনেক ক্ষণ তারপর থেকে, হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া। হয়তো কিছুক্ষণ আগলে রেখেছিলি, কিছু মূহুর্ত দিয়ে ছিলিস উপহার। আমি যে মুহুর্তেই বাঁচি।এখন এই চাঁদ-রঙা সন্ধ্যেতে, প্রতিটা কোনে, মনের প্রতিটা আলপথে, ছাদের সেই সব কার্ণিশের আনাচে কানাচে, ছলছলে আর্শীতে, অপলকে চেয়ে থেকেছি, যদি পাই তোকে। তুই নেই। এখন অনেকখানি কাজ জড়ো হয়ে গেছে শুধু। যে শব্দেরা কোথায় উড়ে গেছিলো তোর ডানা হয়ে, আজ তারা হাওয়া পথে ফিরে এসে ঘিরে আছে আমায়।হাঁটু দুটো বুকের কাছে নিয়ে এসে মাথা রেখে জড়িয়ে নিয়েছি নিজেকে, আচমকা নিজের কাছে বড় বেশি বেয়াব্রু আমি। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি রক্ত ক্ষরণ। ফোঁটা ফোঁটা লবণাক্ত হয় যখন সময়, ‘অস্ফুটে বোলে ফেলা স্বীকারক্তি’ কেউ হতে পারে না, তোর মতো। কেউ নেই তোর মতো। তবু জানি, আমি বেঁচে থাকি। এ এক অন্যরকম বাঁচা, অন্য জীবন, তবু আমি বাঁচি। জীবনের প্রতি এ আমার অন্তহীন সন্ন্যাস।

শব্দ দিয়ে নৈঃশব্দের অভিব্যক্তি গড়ি


 রঞ্জন চক্রবর্ত্তী




শহরের পথেঘাটে ইতস্তত খুঁজি সেই হেমন্তের হারানো বিকেল
যদিও থেমে থাকে না সময় - এগোয় নিঃশব্দে নিজের নিয়মে
চারপাশে অসংখ্য মুখ - হয়ত লক্ষ্যচ্যুত হব একাগ্রতার অভাবে
অনির্দেশের দিকে আমার চলার পথ ঝরে যাওয়া পাতায় ঢেকেছে
একের পর এক শব্দ সাজাই – শব্দ দিয়ে নৈঃশব্দের অভিব্যক্তি গড়ি
হাজার লোকের ভিড়ে প্রচ্ছন্ন তুমি আনমনে হেঁটে চলে যাও
এই নীরবতা আসলে বাঙ্ময় – সমাধান খুঁজে নিতে হয় সংকেতে
যেমন কান পাতলে নৈঃশব্দ্যের আড়ালে শোনা যায় সুরের অনুরণন
হেমন্তসন্ধ্যায় শূণ্য মাটির ঘরে একটি প্রদীপ জ্বালা রয়েছে কেবল
জোনাকীরা আলো জ্বেলে নিকষ অন্ধকার কীভাবে ঘোচাবে বল?
ফুলের সুবাস আর শীতল বাতাস শুধু তোমাকে দিয়েছি ভালবেসে
এ কাব্য নিছক কল্পনা নয়, মোমের হলুদ আলোয় বসে লেখা

রিনা রানি দাসের কবিতা 

মুখর আলোর সন্ধান



নির্জীব নির্জন...খুঁজে ফিরি একাই
পান্থ, পথ দাও যেথায় চাই;
ওই দূর জলসায়, জ্বলেছি অবেলায়
পাইনি হরদম মনের ঠাঁই।

বিহ্বল রৌদ্দুর...কেটে-কুটে আঁধার
স্বর্ণ-মন্দির কিছুই নয়;
পিঞ্জর সন্ধ্যায়. তারারা কথা কয়
তাজমহল তাই মুখরময়।

বিভ্রম চিন্তায় কোথা যে তোকে পাই
খুঁজছি বিস্তর মনের ’পর;
চঞ্চল হৃদ-মন, খোদা কি ভগবান
পাইনি আজতক এ উত্তর।

সুনসান চিৎকার...আকাশে ছেঁয়ে যায়
নেই কি উত্তর মানুষজন;
রাত্রির ঘোর-বন, আদরে কোলে নেয়
সৃষ্ট সবটাই আপন-মন।