Tuesday, October 27, 2020

কবিতা করিডোর, সেপ্টেম্বর সংখ্যা ,২০২০ ,ক্ষুধা বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা




 প্রচ্ছদ: শ্রীহরি দত্ত 

সম্পাদক: শুভঙ্কর পাল 

সহ সম্পাদক: সব্যসাচী ঘোষ 

উত্তর পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক: রাজেশচন্দ্র দেবনাথ 


সম্পাদকীয় 

লাটিমের মতো ঘুরছে এই পৃথিবীর যাবতীয়। কার্যকারণ সম্পর্ক একটা সংখ্যা মাত্র নয়। সব মিলিয়ে সবেতেই থাকে সে। এই মুহূর্তে শুধু পুজো নিয়ে হুল্লা নয়, অতিমারীর ভয়ঙ্কর থাবায় কত চেনা মুখ হারিয়ে গেছে ও যাচ্ছে।  তবুও ওই ফাইট অনলি ফাইট। লড়াই চলছে হাসপাতালে,  পাড়ায় পাড়ায়। খেতে না পাওয়া মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়েছে । মানবিকতার অপমৃত্যু এখনো পুরোপুরি হয়নি। এই পরিস্থিতিতে কবিতা করিডোর এর ' ক্ষুধা ' বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হচ্ছে। 

বিশেষ দ্রষ্টব্য,  লেখা সংক্রান্ত সমস্ত দায় সম্পাদকের নয় । যারা লেখা দিয়ে এই সংখ্যা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা রইলো। 

ধন্যবাদান্তে 

শুভঙ্কর পাল 

সম্পাদক,  কবিতা করিডোর 

যোগাযোগ: 9933770541

subhabrb@gmail.com 


বিষয় ভিত্তিক নয় 

নীলাদ্রি দেব 



ক্ষুধা নিয়ে কবিতা লিখতে বসে 

  বারবার হারিয়ে যাচ্ছে বিষয়, যাবতীয় অক্ষর 

আগুনের পাশে শুকোতে দিয়েছ ঘি-এর শিশি 

খই উড়ছে বাতাসে 

হাই তুলতে না তুলতেই 

                            পাল্টে যাচ্ছে ব্রেকিং নিউজ

আর অট্টহাসির ভেতর দিয়ে 

      বাইপাস খুঁজছেন শাসক 

খিদে ওদের কাছে অস্ত্র 

এবং বর্মও 

প্রাইমটাইমের হ্যালুসিনেশন নিয়ে মাথাব্যথা নেই

তবু ব্যালট আর বুলেটের মাঝে 

                  চকচক করছে অপ্রত্যাশিত চিৎকার

মুখোশ জড়িয়ে রাষ্ট্র ভালই ছিলেন 

আরও কিছু চাপিয়ে এখন অনেকটাই নিরাপদ

প্লিজ এবার মেনে নিন, 

                       আপনি মুখ দেখাতে পারছেন না 

শুকোতে শুকোতে ফল প্রকাশের আগেই 

                       উঠে গেছে ভোটের কালি 

অথচ প্রতিটি সেকেণ্ডে বীভৎস শুকিয়ে আসছে

                   বিশ্বাস, স্বপ্ন আর আস্ত একটা দেশ


 "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি"



কবি সুকান্তের হাত ধরে ক্ষুধা কেমন হয় শুনেছি ,অনুভব করেছি আমরা আমাদের পেটের ক্ষুধার অনুপাতের হিসেবেই ।

কিন্তু ক্ষুধাকে বিশ্ববাসী চাক্ষুস করলো আবেদিন সাহেবের মোটা তুলির আঁচরে,যা ছিলো হৃদয় বিদারক মানবতার  অবক্ষযের এক করুন দৃশ্য,যা দেখলে তথাকথিত যারা শিল্পপ্রমী নন তাদের ভরা পেটও ক্ষিদের জ্বালায় কুঁকড়ে উঠে পরে।

হ্যাঁ , শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন১৯৪৩ শে যখন দেশেরই কিছু স্বার্থাণ্বেষী মানুষ ও বৃটিশ সরকারের চক্রান্তে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ শুরু হয় তখন তিনি   কলকাতার ১৪ নম্বর সার্কাস রোডের বাড়ীটিতে আর বসে থাকতে পারেন নি।কলকাতার রাস্তায় ডাস্টবিনে পরে থাকা সামান্য উচ্ছিষ্ট খাবারের জন্য যখন কুকুর মানুষের তীব্র লড়াই চলছে তখন তিনি অতি সাধারন কাগজ ও কালো কালি নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলেন।

রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন,প্রত্যেক্ষ করেছেন অনাহারক্লিষ্ট মানুষের আর্তনাদ,ক্ষুধার তাড়নায় মানুষের  বিবেকহীনতা,খাদ্যহীন,বস্ত্রহীন মানুষের চরম দূর্দশা।

শত শত স্কেচে ভরে উঠেছিলো তার ঝোলা।"স্ত্রীর শবদেহের পাশে আর্তনাদরত স্বামী","মৃত মানুষের চোখ ঠুকরে খাচ্ছে কাক"। এরকম বহু দৃশ্য তিনি আঁকেন।এরকম ১২ টি চিত্র নিয়ে তিনি তৈরি করেন "Darking Days Of Bengal"নামে একটি এলবাম ।

            শিল্পীদের একটি প্রিয় বিষয় "ম্যাডোনা"তাতে আমরা দেখতে পাই মা ও শিশুর অকৃত্তিম ভালোবাসার কথা।ইতালীয় রেনেসাঁর শিল্পী লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চি থেকে শুরু করে ,মাইকেল এঞ্জেলো ,রাফায়েল এরা প্রত্যকেই ম্যাডোনার ছবি  এঁকেছেন ।লিওনার্দো-দা -ভিঞ্চির "Virgin of the rocks" ছবিটিতে ম্যাডোনার সুশ্রী  রূপ তুলে ধরা হয়েছে সুন্দর বর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থাৎ ম্যাডোনা বলতে আমরা সুন্দর মায়ের রূপই কল্পনা করি।

               কিন্তু "ম্যাডোনা ১৯৪৩" নামে জয়নুল আবেদিনের ম্যাডোনা এর ব্যাতিক্রম। তিনি যে ম্যাডোনা কে আঁকলেন তিনি রাস্তায় পরে থাকা না খেতে পেয়ে অস্তি কঙ্কালসার  মৃত  মায়ের  এক করুন দৃশ্য যার বুকের উপর চড়ে জীবিত শিশুসন্তানটি মাতৃদুগ্ধ পান করছে ।যদিও মা মৃত তবুও মানবপ্রেমী আবেদিন সাহেবের তুলিতে প্রাণের স্পন্দন স্পষ্ট দেখা যায় ।


                   এরকমই আরো একজন সংগ্রামী শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য সংগ্রাম করেছেন মানুষের দুঃখ ,দুর্দশা ,ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়ে ।হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন কালো রং।এমন কি শিল্পী প্রত্যক্ষ ভাবে যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দলনে।শিল্পীসত্তা ও প্রতিবাদী সত্তার মিশ্রনে এই সাদা-কালোর সম্রাট ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে ভীষণভাবে আলোড়িত হন।চট্টগ্রামে বিমান আক্রমন ,পূর্ববংগের বিরাট অঞ্চলে খাদ্যশস্যের  হাহাকার চিত্তপ্রসাদের ছবিরর বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।১৯৪৩ সালে মেদিনীপুর জেলায় ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকেন যা হা যা hungary Bengal নামে পরিচিত ।

                চিত্তপ্রসাদের  ভাবাদর্শ ও শিল্পাদর্শে অনু্প্রাণিত হয়ে  সোমনাথ হোর কাজ করেন।

 খিদে যখন বেড়ে উঠে পরিপূর্ণ রূপ পেতে চায়

শ্রীহরি দত্ত 




খিদেই পায় আমাদের, মাতৃগর্ভ থেকে খিদে পায় আমাদের। জন্মের পর প্রথম চিৎকারে মাকে খুঁজে পেতে যে হাত দুটি ছুঁড়ে দিই, খিদের খোঁজ থাকে তাতে। যত বড় হই ততই খিদে পায়, যত ছুটে বেড়াই ততই খিদে বাড়ে, মায়ের কাছ থেকে যতই দূরত্বে থাকি না কেনো, যতই থাকি কোনো না কোনো আড্ডায়, পেটে যখন টান তৈরি হয়, ফিরে আসি মায়ের কাছে... খিদের জন্যে। এই ভাবেই ঘরের ভেতর তৈরি হয় খাবার সংগ্রহের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। ধীরে ধীরে চিৎকার বড় হতে থাকে, একদিন ঘরে বসেই শুনতে পাই খাদ্যের জন্যে আন্দোলনের স্লোগান ... মনটা কেমন করে ওঠে, তার মানে মাথা বুঝে নিতে চায় আমাদের প্রত্যেকের খাবার কি কেউ নিয়ন্ত্রণ করে? ...আর সেটা বুঝতে গিয়ে কখন যে ওদের দলে মিশে গেছি, তা বুঝে উঠতেই... খিদে কখন পেটের থেকে মাথায় উঠে বোধের জন্ম নিয়েছে, বুঝতেই পারিনি। এখন মনের খিদে পায়, মাথার খিদে পায়। তার থেকে মনে জন্ম নেয় ছবি। আঁকিবুকি টানতে টানতেই ছবি আমাকে তলিয়ে দিয়েছে তার খেয়ালে, তা বুঝে গেছে মন... এখন মন কেমন করার পালা... তার থেকে পরিত্রাণ পেতে রোজই এই মন ছবি আঁকে, আঁকলে খিদে মেটে। কিন্তু সেই পেট ভরার মতো খিদেরা একইরকম, আবার পায়। এখানে ছবির চিৎকার আরও গভীর... বুঝতে শিখেছে মন। কিন্তু মাথা বুঝতে শিখেছে যে সাহিত্যে খিদে অনেক আগেই এসেছে তাই তখন মাথা... রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, অরুণেশ, শক্তি, সুনীল পড়ে, সমস্ত শিল্পীর কাজ দেখে, খিদের পরিসর বাড়তে থাকে। একই সাথে জন্ম নিতে থাকে শরীরের খিদে ... সে তো আরেক মোচড়। যেন সব কিছুর উর্দ্ধে উঠে ভাবনার দেশে উন্মুক্ত বাতাস। চোখ বলে ধরে দেখ, জিভ বলে চেখে, হাত বলে উল্টে দেখ নিজ পরিসরে; কিন্তু সব কিছুতেই মানা। চুরি করে খাওয়ার স্বভাব, বাইরে চোখ রাঙায় যে মন, ভেতরে সিদ কাটে। কিন্তু খিদে বাড়তে বাড়তে চোখ তৈরি করে সে খিদে মেটানোর চেষ্টা আজও জারি রেখেছে।


এই খিদেকে বুঝতে গিয়ে কত মানুষ নিজেকে হারিয়েছে। ছুটে গেছে ভাতের কাছে... নদীর কাছে... প্রেমিকের কাছে... প্রকৃতির কাছে। শুধু নিজেকে পরিপূর্ণ করতে। খিদে কী, কেন, কোথায় পায়, মানুষ ভেদে খিদে কেমন, তার কি কোনো পার্থক্য আছে... প্রয়োজন বুঝতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যে ক্ষুধার আন্দোলনের জন্ম হয়ে সাহিত্যে নতুন ভাষা খোঁজার চেস্টা হয়েছে। ছবি আন্দলনের ক্ষেত্রেও বার বার সারা পৃথিবীব্যপী বিভিন্ন রূপ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। ক্ষুধাকে নিয়ে শিল্পীদের বিভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই... বিভিন্ন শিল্পী, তাদেরই নিজস্ব ভাবধারায় যে শিল্প কর্ম করে থাকেন সেখানেও শিল্পী তার দর্শন তৃপ্তির সন্ধান করেন। আজও আমরা প্রতিদিন ছুটি সেই লক্ষ্যে, যেখানে চোখ... পেট... শরীর... মন... সমস্ত খিদের পরিপূর্ণতার জন্যে এই লক্ষ্যই একটি বিলীয়মান বিন্দুর মতো।

 খিদে

 অরুণাভ ভৌমিক



আমি বসে আছি নির্মম
আমি বসে আছি নিশ্চল

আমি নিশ্চল বুঝি না
আমি নির্মম বুঝি না
আমার আছে শুধু একপেট খিদে

আমি বসে আছি নিস্ফল
আমি বসে আছি নিষ্করুণ
আমি নিস্ফল বুঝি না
আমি নিষ্করুণ বুঝি না
আমার আছে অন্তহীন খিদে

খিদের আছে শুশ্রুষার আঙ্গুল
খিদের আছে মায়াবী অঞ্জন
খিদের আছে শব্দের পর শব্দ

আমি কবিতা লিখি না
আমি পদ্যও লিখি না

আমি শুধু শব্দ সাজিয়ে গড়ে তুলি বিহ্বল খিদে!

 আদিতম স্বর

শুভঙ্কর পাল 



যখন ভবিষ্যৎ শব্দের ভিতর হেঁটে যাই 

আদিতম স্বর পেড়িয়ে আসি প্রথম অক্ষরের কাছে 


যখন নীরব শব্দের ক্ষেতে ফসল  ফলাই 

আমি আসলে শব্দের ফসিল পোড়াতে থাকি 


যখন শব্দেরা আমাকে হারাতে থাকে 

আমি দেখি অনুভবের জানালায় আদিতম স্বর জেগে থাকে  ।

Monday, October 26, 2020

 ফুটো থালায় স্তব্ধ  ভাষা

   শিপ্রা পাল। (লাভলী)



নিরন্ন যন্ত্রণার নুখ, ধর্ম মানে না- মানে না দেশ——
পৃথিবীর এখন দারুণ অসুখ, কর্মহীন বুকে আকাশ ভাঙে
হাতকড়ি পেটে, নিয়ম ভাঙার  শেকল পায়ে  আগুন জোছনায় চাঁদ!!

ডানা ঝাপটানো রোদ, আছড়ানো ঢেউয়ে দুর্ভিক্ষ  শ্বাস
বৃষ্টির ধারায় মাটিকে ছুঁয়ে ফসল-শস্য থেকে ওঠে আসা নোনা জল
পথে-প্রান্তরে ছাউনিহীন চোখে শুধু শূন্যতার হাহাকার!!

ক্ষুধার ফুটো থালায় স্তব্ধ ভাষা——
এখানে আবেগ বিলাসিতার মখমলেে মোড়া উদাসীন
সবকিছু পোড়ে, প্রেমহীন কামড়ে সহবাস!!


 স্বপ্নপরাগ 

                    এক

              সোমা সাহা পোদ্দার



পাতার মার্জিন ছুঁয়ে রোদের খেলা ।

স্বপ্নপরাগ মিশিয়ে যোগ হবে নব জন্মের

রঙ বেরঙের মেহেক ঢেলে রেখেছ আশ্রয়ে

শব্দ গুছিয়ে না বলারা এভাবেই থাক। 

অচেনা শব্দে লেখা হয় জেগে থাকার অভ্যেস

সরু রেখায় চাঁদ আরি পাতে ক্ষুধার জানলায়

ঘুমের ভেতর আসা যাওয়া করে আলোখানি

গভীর রাত খুলে এখনও বাকি হাঁটা

উড়ে যায় রাত পাখি দূরের সহজতায়

নরম আলোয় নিঃশব্দ বয়ে নেয়

শুধু দৃশেরা মৃদু কাঁপে আগের মতো করে।

 

                       দুই 

তুমি তো ক্ষুধার সূচক সরিয়ে মুক্ত হতে চেয়েছিলে ?

সীমাহীন ক্ষুধায় মুচড়ে ওঠে কোণ

কোষে কোষে ছড়িয়ে পরে তার বীজ

হাত ধরাধরির ক্লান্ত পথ তবু এগোয় ঝাপসা চলন মেখে

পোশাক বদল হয় ফেরিওয়ালার

ফেরিওয়ালা ক্ষুধা ফেরি করে আর কেউ তা কেনে

উড়াল খুলে রাখি প্রতিদিন বাড়ার জন্যে

না দেখারা আরও তীব্র হয় স্বপ্নক্ষুধায়। 

  

 গুঁড়ো পাকস্থলী 

রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় 



অন্ধকার স্রোতে সারা শরীর ক্রমে দড়ির মত পাকিয়ে যাচ্ছে, ওদের ৷

 প্রতি রাতে উপোসী চাঁদ আর কাঙাল নদীটা মাধুকরী করে৷

 ছাল ওঠা মাটির বুক থেকে সব অমৃত শুকিয়ে গেছে ৷ 

নিভন্ত চুল্লীর ছাই থেকে হাহাকার উঠে আসছে ৷

ভাতের দানাগুলোয় দুঃস্বপ্নরা মাখামাখি হচ্ছে ৷

রক্তের স্রোত ক্রমে জলের মত পাতলা হচ্ছে ৷ 

শ্মশানের শূণ্যতা মেখে জনপথ, ক্ষেত, ঘরবাড়ি ৷

বুভুক্ষু মানুষেরা একে একে সীমানা পেরোচ্ছে ৷ 

ওদের দুদিকের ডানা পুড়ছে, পুড়ছে হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ৷

নিরন্ন পাকস্থলীগুলো ক্রমে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে,

একদল পরজীবী তা চেটেপুটে খাচ্ছে ৷

যুগ যুগ ধরে ওরা এইভাবেই বেঁচে আছে-

উপবাসী মানুষের পাকস্থলী, অস্থি, মজ্জা চিবিয়ে খেয়ে ৷  

ভবিষ্যতেও বাঁচবে, সভ্যতার শেষদিন পর্যন্ত বাঁচবে, এই ভাবেই ৷

আর অনাহারী মানুষগুলো, পেটে গামছা বেঁধে যুগযুগ ধরে ওদের খাদ্য হয়ে উঠবে প্রতিনিয়ত ৷



 অনন্ত এক খিদে

সুমন মল্লিক




এই ভ্রম-সিন্দুকে সযত্নে গুছিয়ে রাখি
ঋণ আর একেকটা ক্ষুধার্ত দিন৷

কতটুকুই বা দূরে যেতে পেরেছি আমি!

প্রতি রাতে স্মৃতির দরজার সামনে থামি–
আত্মাকে প্রবেশ করিয়ে 
চুপচাপ বিছানায় ভস্মের আল্পনা আঁকি৷

সময় আমাকে কিছুই দেয়নি,
ঋতুতে ঋতুতে শুধু দিয়ে গেছে ফাঁকি৷

তবু দ্যাখো, অনন্ত এক খিদের ভেতর
বিগ্রহহীন উপাসনা... শাস্তি ও শান্তি...

কতগুলি দিন কেটে গেল উপস্থিতিহীন,
তবু ক্ষুধার্ত আমি, ক্ষুধাই লিখি রাতদিন৷   

 বাবা ও বাহারি উল

শ্রদ্ধা চক্রবর্তী 




বড় বড় বাহারি বোতাম বসানো খোলাবুকটা,হয়ত দেখবে না কেউ

কেউ আর ডেকে গান শোনাবে না বা বাহারি সাপের গল্প...

সমস্ত ঘাস, সব দৃশ্য যেভাবে সাজানো থেকে গেছে সিনেমায় সেভাবে কখনোই 
সাজানো থাকবে না আমার ঘরটা,
সুপুরি গাছের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একটা রাস্তা...

এই সমস্ত কালো হয়ে আসা রঙে কারো চলে যাওয়া যেন কখনো মনে না পড়ে

আসলে, 
আমাদের ভেতর বিশ্বাসের  সম্পর্কটুকুও নষ্ট হয়ে গেছে 
তুমি, তুমি, তোমার জন্য 

বুকের ভেতর যে গভীর দিঘি টা থাকে
তাতে নিজের মুখের ছায়াটাও অনেক অস্পষ্ট হয়ে এসেছে...

চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে
আর কাটাছেঁড়া বাবার পায়ের ফোঁটা ফোঁটা রক্তে ভিজে আসছে গজ
সাদা কাপড় চোপড়

এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে আমার বাবার মুখ
ভালোবাসা ছড়িয়ে যাচ্ছে বুক থেকে বুকে

গুটিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন 
বিকেলের রোদ্দুর যেরকম আদুরে উলের গোল্লা বুনতে বুনতে ছোট হয়ে আসে...

 সুবাস  

   পার্থ সারথি চক্রবর্তী 



অতল স্মৃতিতে ডুব দিয়েছি-
    ক্ষুধার গন্ধ ভেসে আসে 
                                  সারা শরীরে 
কাদামাখা সাদা ভাতের এক
                                 আশ্চর্য সুবাস
    চাপা দেয় নাড়ি ছেঁড়া'র বেদনা
ভূমিষ্ঠ হবার কান্নায় মুখরিত হয়
                                  চারদিক 
অসহায় আশ্রয় খুঁজি বিষবৃক্ষের
                                   জঠরে

 এইমাত্র

মিতালি চক্রবর্তী


আসলে আমি ভিনজন্ম পালন করি অনভিজ্ঞ আস্কারায়,,,

বৃন্তহীন পলাশ বিক্রেতা গ্রেফতার হয়েছে সমুদ্রসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে;

অস্তিত্ব সংকট সমাধানের কাগজপত্র আগুনে পুড়ে উত্তাপ বিলিয়েছে শিশুখাদ্য প্রস্তুতিতে!

আমরা কাজের জন্য হাত ধরেছি
ভাতের জন্য পা বাড়িয়েছি,
আর বক্তব্য ‌পেশ করেছি।

অবমূল্যায়ন আধখানা রুটি হয়ে
হাতছানি দিয়ে গেল আধপেটা খিদের গল্পের লড়াই আর স্যালুটের যুগল বন্দিশ,,,

তারপর কান্নারা চোখ মুছে বিদায়ী পাখির মত একে একে উড়ে চলে যাবে একদিন।
শোকসভা ভেঙে ঘরেফেরা মানুষেরা গেরস্থালিতে ফিরে নিকানো উনুনে ফের আগুন দেবে ধোঁয়ার গন্ধকে ছাপিয়ে যাবে গরম ভাতের মায়া,,,
এই বিশ্বাসটুকু হাতে রাখি শেষ সম্বলের মত। আর,,,
আলোরগল্পের নীচে একটা অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে থাকে সর্বগ্রাসী ছোবল আগলিয়ে,
চেনা হাতের মুঠোয় ভরাথাকে উপেক্ষার করুনা;
বানভাসি হয়ে যায়  বিশ্বাস,
সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় প্রবঞ্চনা এবং সম্পর্কের জোড়াতালি ‌।
অসম্পূর্ণ তালিকা  হাতে ঘুরে বেড়ায় কিছু হাটুরে ,
ভাঙা হাটের বিকিকিনি জমেওঠে।।

 প্রবীর রায়ের দুটি কবিতা



------------------------------

জবানবন্দী
-------------

এতকাল যা লিখেছি সবই ছিল ভূমিকা
এবার শুরু করব

কিছু বর্ণ তাদের জায়গা বদল করেছে
কিছু শব্দ উঠে আসতে চাইছে সামনে
এইসব তোমরা মেনে নেবে কিনা
না বুঝেই তৈরি হচ্ছে সংলাপ

নীতিবহির্ভূত কথা
---------------------

আমি যা-ই বলি
তোমাদের এরকম মনে হয়
সংসদ যারা ভারী করে রেখেছে
তাদের ওপর দিয়েই পাখিদের নীরবতা
উড়ে এসে বাসা বাঁধল এইখানে
আমার খুব কাছে
আজ নীতিকথা এভাবে বলার মত নয়

 এবং

জোতির্ময় মুুুখোপাধ্যায়



একটা ক্ষুধা আঁকব

তারপর, ক্ষুধার ঢলে গড়িয়ে দেব

ঘরে না ফেরার পথ

তোমরা শাঁখ বাজাও, উলু দাও

কাঁসর, ঘন্টা, হাততালি

এখন অভিষেক হবে

মৃত মানুষদের




 সু দী প্ত  মা জি 


সাপলুডোর ভারতবর্ষ 





নিতান্ত দৈবের বশে সাপের সহজ মুখ থেকে তুমি 

                     একদানে সরে গেছো লেজের ডগায়... 


আঃ, কী নিঃসীম শান্তি — ভেবে তাকিয়েছো ওই  

                                       শীর্ষদেশে, মইয়ের চূড়ায় 

যেখানে দেশের মাত্র তিন শতাংশের মতো 

                                    প্রকৃত মানুষ বাস করে ! 


উচ্ছিষ্ট ফেলে দেয় তারা কৃপাভরে —

লেজের ডগায় বাঁচা খণ্ড খণ্ড মানুষের 

                              প্রতিদিন ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় ! 


লেজের ডগায় বাঁচা লোকজন তারপর ভাবে, আহা,

এখনও সাপের মুখে পড়িনি তো  ভাগ্যধর 

                                                      আমরা কজন ! 


তিন বর্ণে আঁকা, আহা, আমার পতাকা

অন্তত দু'বার তাকে নমস্কার করে ফি বছর 

পুষ্প ও প্রসাদ সহ, গৌরবের গান সহ 

                                           বাতাসে ওড়াই... 


এইভাবে বাঁচি আর এইভাবে মরি প্রতিদিন 


এইভাবে মরে গিয়ে বেঁচে যাই হঠাৎ একদিন ! 


বিজয়গৌরব নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র 

                                                   তূর্যনাদ করে...

 মানসপুর

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়


কালো পাথরের কাছে স্তদ্ধবাক
বিয়োগের পাশে বিয়োগজন্ম লিখে
পেরোই  মায়াসরোবর



পিলসুজ জ্বালিয়ে পাহারা বসিয়ে
অলৌকিক আলোয় মাধবীকুঞ্জে
শ্যাম জেগে ওঠে শ্যামকল্যাণে
অশ্রুলিপি লেখে রাধা আলপনা
সারা উঠোনময় সান্ধ্য অক্ষরে



সবুজ কলাপাতার ছায়া
যেন আশ্চর্য বধূর উন্মোচন
আত্মসঞ্চয়ের সেই জলাশয়
হঠাৎ অন্ধত্ব কেটে
আলোজলে ফুটে ওঠে
আলোচাল  উদ্ভাসে


প্রতি অঙ্গ কানু-ক্ষুধাতুর

২.
হারামি কবিতা


২.
মনুর শরীরে ক্ষুধার্ত কুকুরের জিভ
তীব্র মশালাগন্ধ সারা ভোজসভায়

কয়েদিখানা খুলে গেলে নীরবতা ভাঙে
যেন কত জন্মের অন্ধকার স্রোত ফিরে 

কাঁসরে সানাই এ মাটিগর্তমুখ খুলে
সঙ্গমের আহবান 

শয্যায় তান্ত্রিকের রক্তিম বস্ত্রে
 মৃতজঙ্গল জাগে 
নির্জলা একাদশী শেষে

পথ  এক জেনেও গ্রাস মুদ্রায় সব গিলে
বেপথু পড়ে আছি

৩.
নেগেটিভ


একটা বাঘ দুপুর
ক্ষুধার্ত বসে আছে
আর ডোরাকাটা হয়ে
চেটে যাচ্ছি থাবার রক্ত

ছবিটা স্পষ্ট অথবা নয়
কিন্তু রোদকে অস্বীকার
করতে পারছে না
আলোর একটা গর্জন
চাপা থাকছে না কিছুতেই

৪.
রূপ


সাজ সাজ । দেবী পাল্টে যায় । গরীব মেয়েটি । দু হাতে নতুন জামা ধরে আয়নাকে দেখায় । ঈর্ষা জাগে । ঠোঁটের হাসিতে বেশ মুক্তা মুক্তা ভাব

ভাজা ভাতের গায়ে মাংস আর আলু । দেবীর গভীরে ক্ষুধা । ভূলোকে ও দ্যুলোকে । সেখানে প্রবেশ করে সে ছোঁড়ে তীর । চুর চুর হয়ে ভেঙে পড়ে দিনের খোয়াব

এই যে ক্ষ্যাপা বাতাসের তেজ । সেও প্রার্থনায় ছিল । রূপং দেহি । তার রূপে ঘুরে পড়ে তাহাদের চালা

দেবীর গলায় মালা । মাথায় মুকুট । কিন্তু ঐশ্বর্য ভাবে । মা নেই । গাছ কাটা মাঠে । বন বিবির
পালা

৫.


অক্ষর লিপি 

স্বাধীনতা । তার হাত ফসকে । কে ছিনিয়ে নিলো । লোকটা অবাক
একটা আকাশ হাতড়ায়

সারাবছর । রঙছাড়া জীবন । বনছাড়া ভোজন । জন থেকে সরে
যাচ্ছে  আপন আর নীড়
নীরবতা । তাকে পালন করতে হয় ।

খাঁড়া ঝুলতে থাকে রাষ্ট্রশক্তির । তীর
সমাজের আর সংসারের তর্জনী

পালাতে দেয় না । না কবিতা থেকে ।
নিম বা ক্ষুধার্ত । আঁকড়াতে আঁকড়াতে  সে ক্রমশ অপর

পরজীবি হয়ে বাঁচতে বাঁচতে সে
ভুলে যায় অর্থ বাঁচার

         রাজা-সাজা

              শোভন মণ্ডল



নিতান্তই পাকেচক্রে এভাবে গলিয়েছি মাথা

মাথা নয়, মাথাব্যথা,  মুকুটের ভার

সে তো সহজ নয়,  জানা কথা

তবুও কাঁপাতে হবে স্টেজ, যে ভাবেই হোক

অজস্র রোশনাই,   শত শত চোখ

আমাকেই দেখছে,  না হয় অভিনয়ে মন দি

এ তো কঠিন কাজ, নজরবন্দি


কাহিনী শেষ হয়ে গেলে

গ্রীনরুমে মেকআপ তুলি

রাজা-সাজা সারা, ফিরিয়ে দাও তবে

                                 ভিক্ষের ঝুলি

 শীতের দিনের খিদে


কমল সরকার



শীতের সকাল।
রাতভর মা'র মুখে একঘেয়ে অভাবের গল্প  শুনে শুনে
'চললাম' বলে খুব ভোরে উঠে গিয়ে বাবা 
মিশে গেল দূর কুয়াশায়।

দরজা ঈষৎ খোলা।
হিমেল হাওয়া এসে আমাদের প্রবল কাঁপায়।
ছেঁড়া কাঁথা, উদোম শরীরে শুয়ে আমরা ক'ভাই
খোলামুখ এতটুকু বাবুইয়ের বাসায়
যেমনটি গায়ে গায়ে লেগে থাকে ছানাগুলো 
মায়ের ডানায়।

মা'র চোখে ঘুম নেই।
চালের ভাঁড়ার খালি, আনাজও ফুরিয়েছে কাল।
ক্রমে ক্রমে বেলা বেড়ে গেলে
কী এক ঘুমোনো ব্যথা জেগে ওঠে নাভির তলায়। 


'কই গেলি সব?' 
মেঘের ডাকের মতো স্বর ভেসে আসে যেই উঠোনসীমায়,
মুঠো মুঠো রাঙা-আলু, মটর, মকাই ---
এসব কিছুই নয়, ভুবনভোলানো হাসিখানা দেখে তার
আমাদের আজীবনের খিদে মরে যায়। 


  প্রতিবন্ধী

  নীপবীথি ভৌমিক



প্রতিবার খিদের পাশে পাশেই গজিয়ে ওঠে একটা করে সবুজ গাছ
  যার পাতা নেই, মৃত ডালপালা জুড়ে থাকে
     শকুনের নিজস্ব উল্লাস !

     ভাত বেড়ে দেয় জীবন, 
       অথচ হাত নেই আমার সে ভাত মুখে তোলার

       খিদেরা মৃত হয়ে যায় ক্রমশ এভাবে
           সবুজ গাছ আরো সবুজ হয়
              ঝোপঝাড়, শকুনের সন্ধানে।

 হে ঈশ্বর 

বাপ্পাদিত্য দে



যদি শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নাও 

আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো। 

আমি খোলা আকাশের নীচে 

শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।


বিষণ্ণতা দিয়ে গড়েছি এই ঘর

পাজরের হাঁড় দিয়ে বোনা দেওয়াল

আর সম্ভবনাময় ফসলের ক্ষেত

এ সবই আমার শেষ সম্বল। 

যদি শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নাও 

আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো। 

আমি খোলা আকাশের নীচে 

শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।


আকাশের নীচে কালো মেঘ।

সেখান থেকেই ঝরেছিল 

অভিশাপের পোড়া জল।

ধ্বংসের হাওয়া মেখে কী আশ্বাসে 

লুঠে নিল প্রকৃতির দল

বিষণ্ণতা দিয়ে গড়া 

আমার এই একচালা ঘর।

যদি শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নাও আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো। 

আমি খোলা আকাশের নীচে 

শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।


আমি তো দেখেছি অট্টালিকার অন্ধকার ঘরে নীল জোনাকীর আলো

আকাশ ছোঁয়া প্রাসাদের চূড়া ।

কৈ তাদের চোখে-মুখে তো 

তোমার ধুলো পড়েনি ? 

দেহ-মন দিয়ে সাম্যের গান 

আমিও তো গেয়েছি। 

তবে আমার পথেই কেন এত অন্ধকার ? 

তবু বাঁচার স্বপ্ন দেখি আমি।

তাই বেঁধেছি ঘর তোমাকে আলিঙ্গন করেই। 


আজকাল তুমিও হয়েছ ফন্দিবাজ

কাউকে বিলোচ্ছ মহাভোগ রাজ

কাউকে দিয়েছ ফকিরের সাজ।

থালার ফুটোটা বড় হয়ে উঠলে

জেগে উঠছে ভয়

তোমার দেওয়া এই জন্ম, এই জীবন

থাকবে তো ?


ঐ একরতি মেয়েটি কী জানে,

জীবনের মানে ?

আমি বুঝি ওর উপস্থিতি 

বংশের স্মৃতি... বোঝা হয়ে গেছে

ওর চোখের জল আরও বেশী ভারী 

দুঃখ-কষ্টে, অনাহারে

যদি শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নাও আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো। 

আমি খোলা আকাশের নীচে 

শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।


হে ঈশ্বর ...


 উপেক্ষিত খিদে

বাবলি সূত্রধর 


টিলার আকাশ থেকে গলে পড়ে 

চাঁদ।শাল মহুয়ার বিস্তীর্ন প্রান্তরে

ফুলমণির বন্ধ্যা যাপন। 

জ্যোৎস্না মাখা শিমূল ফুলে

উপচে পড়ে বন্য খিদে....। 

রঙীন রাতের পাতায় লেখা হয় 

ধামসা মাদলের ইতিহাস! 

ফুলমণির পেটে তখন ভাতের 

গন্ধ ব্রাত্যই থেকে যায়।

টিলার আকাশ বেয়ে গলে পড়ে 

খরখরে ভাত আর উপেক্ষিত খিদে।

 অণুগল্প


 সরীসৃপ সঙ্গ (২) 

               অম্বরীশ ঘোষ 




আগে কখনো সুস্নেহ  এভাবে চমকে ওঠেনি । টিভিতে মুভি দেখছিল ও । হঠাৎ দেখল যে কিচেনের জানালা দিয়ে একটা বড়সড় কালো কুচকুচে সাপ মা বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল । সে কি গতি সাপটার !  মা-বাবাকে বাঁচানোর জন্য সুস্নেহ ঢুকলো ওই ঘরে । খাটের নিচ থেকে শুরু করে ঘরের সর্বত্র খুঁজলো ভয়ে ভয়ে । না , কিছুই নেই । কিন্তু নিজের চোখে দেখা ঘটনা ! পরের দিন আবার প্রায় একই সময় । এবং তাজ্জব ব্যাপার , আবার সেই একই ঘটনা । ওই বিশাল বড় কালো কুচকুচে সাপটা কিচেনের জানালা দিয়ে ঢুকলো । বীভৎসভাবে এঁকে বেঁকে গিয়ে ঢুকলো মেয়ের পড়ার রুমে। আঁতকে উঠে সুস্নেহ ঢুকলো মেয়ের ঘরে । পিতৃস্নেহে ভয়-ডর বাদ দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলো  ঘরের সর্বত্র । না কোথাও কিচ্ছু নেই ! আজ বাড়ির সকলে বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে চাইছে না । সকলে বলছে যে সুস্নেহর কোথাও নিশ্চয়ই একটা ভুল হচ্ছে । কিন্তু সুস্নেহ কি করে নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবে ! তৃতীয় দিন বিষয়টার বীভৎসতা একেবারেই আলাদা । একই সময়ে স্ত্রী ইচ্ছে করেই নজর রাখছে  জানালাটায় । সুস্নেহ একটু অস্থির মন নিয়ে টিভিতে খবর শুনছে । আবার জানালা দিয়ে ওই কালো মিশমিশে সাপটা ঢুকে পড়ছে । সুস্নেহ বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে সাপটার দিকে । সাপটা একটু থেমে দাঁত বের করে তাকালো ওর দিকে ।  তারপর অন্যদিনের চাইতেও বেশি গতিতে এসে ঢুকে পড়ল ওর বুকের ভেতর । বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে বসে পড়ল সুস্নেহ । কিন্তু বুকে কোন ক্ষতচিহ্ন না থাকায় কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারল না ।

 যাকে পাবি তাকে খা 

 সোমনাথ বেনিয়া



কালো বিড়াল! হাঁচি! শরীরে আঘাত! অত‌এব দাঁড়িয়ে যাও। এই যে দাঁড়ালে তা কিন্তু পারতপক্ষে পেটের জন‍্য। পেটের ভিতরে দৌড়। পেটের বাইরে দৌড়। রান অ্যান্ড রান অ্যান্ড "ক‍্যাচ মি ইফ ইউ ক‍্যান!" কোথাও মস্তিষ্ক, কোথাও-বা গতর। মস্তিষ্কের কোষে-কোষে শ্রম আর গতরের চামড়ার ভাঁজে ঘর্মাক্ত পরিশ্রম। দু-ক্ষেত্রেই "ওয়ান পাইস ফাদার মাদার!" মাথা ঝিমিয়ে যায় আর ক্লান্তির অকৃত্রিম আক্রমণে শরীর নেতিয়ে পড়ে। অ্যাট দ‍্য এন্ড অব দ‍্য ডে দু-জনার প্রয়োজন বিছানা। এখন তুলতুলে নাকি শুধু তক্তা, তা বিবেচনা করতে গিয়ে পূর্ণিমার সাথে পেঁচার গোপন বৈঠক হয়। পূর্ণিমার আলো নরম, কোমল, স্বপ্নালু, অন‍্যদিকে পেঁচার ঠোঁট কঠিন, কঠোর, বাস্তবিক। তবু স্বপ্ন একটা থাকে যে আসে রক্তকণিকার সমস্ত বাধা পেরিয়ে। স্বপ্নের রঙ বদলে গেলে হৃৎপিণ্ডের ওঠা-নামা হাঁসের ঠোঁটের পর্যায়ক্রম হয়ে ওঠে। যেন একথালা ভুসি মেশানো পানতা ভাতের মধ‍্যে ঠোঁট দুটির কতকত শব্দে অবিরত নড়ে চলা। কী দেখবে? খিদের রাজ‍্যে শিল্পী সত্তার গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো হয়। প্রতি মুহূর্তে চরাচর ডুবে থাকতে চায় ভোগবাদীর চূড়ান্ত অসুখে। সেই অসুখপ্রিয়তা প্রাত‍্যহিকীর আনাচকানাচ থেকে তুলে আনা কদম চালে চলা সারিবদ্ধ মুখের কষ্টকল্পিত নিশ্বাস।
     খিদের জ্বালায় এখানে সম্পর্ক জটিল হয়ে ওঠে। জটিল রসায়ন ফ্লয়েডিয় তত্ত্বের ঘাড়ে বসে থাকে। সম্পর্কের সরু তারে অভিধানের বাছা-বাছা শব্দগুলো ব্রাউনিয়ান মোশানে দৌড়ায়। এই আপেক্ষিক জীবনে কার ভালো, কার মন্দ কিংবা এর উলটো ঘটনা‌ও দোলাচলে থেকে মাঝেমধ‍্যে "জরুরী অবস্থা" জারি করে। ঠোঁটের সাথে ফুঁয়ের মিলবন্ধন ঘটলে মাউথ অর্গান বিপ্লবী হয়ে ওঠে। আশেপাশের যত ছড়ানো-ছিটানো মন আছে, তাদের সবার মধ‍্যে যেন তাদের নিজস্ব প্রিয়সুর অ্যাকসেস খুঁজে পায়। তখন সবাই সবার আইডল। প্রত‍্যেকে প্রত‍্যেকের রূপকথার নায়ক হয়ে যায়। আলোকবর্ষ দূর থেকে ছিটকে আসা কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর অভিকর্ষের টানে গ্রন্থিত হয়ে ছুটে আসে। ফিল্‌মের দৃশ‍্য। নায়িকা ছুটে যাচ্ছে নায়কের কাছে। তারপর একে অপরের বাহুডোরে আবদ্ধ। জেগে ওঠে আদিম খিদে। নলেনগুড়ের মতো চুয়ে পড়ে শরীরী উপাদান। ঘোষণা হয়ে যায় "কোহি মিল গ‍্যায়া!" আনন্দ তখন শব্দের খেলাঘর। প্রেমের শব্দছক। শুধু ঘরের পর ঘর মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। থমকে দাঁড়ালে মনে হয় "অ্যায় মসোম বড়া বেইমান হ‍্যায় বড়া, বেইমান হ‍্যায় অ্যায় মসোম!"

 

কবিতায় কল্পনা, কবিতার মিথ্যে
কুমারেশ তেওয়ারী


‘কবিতা কল্পনালতা’ এই কথাটি তো সুপ্রাচীন। এবং এই কথাটির ভেতরেই ধরা আছে কবিতার আসল জিয়নকাঠিটি। মানব মনের চুড়ান্ত কল্পনার ফসলই তো কবিতা। কবিতার ক্ষেত্রে এই কল্পনার রূপটি এক লতানে গাছের মতো। আকর্ষ বাড়িয়ে বাড়িয়ে যা চতুর্দিকে তার লতা বিস্তার করে শান্ত আধিপত্য গড়ে তোলে। যে আধিপত্যে কোনো ক্ষতি নেই বরঞ্চ হিতৈষীর ভূমিকায় গ্রহণ করে এই আধিপত্য।  শত শত বৎসর ধরে এই কল্পনার ডানায় ভর করেই যত কবিতা। তা সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজকের নবীনতম কবিটির সদ্য লেখা কবিতাটি ওই কল্পনারই ফসল। 
“কা আ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” লুই পা-র এই কবিতায় কবি, শরীর কে এক বৃক্ষ কল্পনা করে সেই বৃক্ষরূপ শরীরের পাঁচটি ডালের কথা ভাবলেন। যদিও এখানে এক চুড়ান্ত দর্শন প্রতিফলিত হয়ে উঠেছে পঙক্তিটির মুকুর শরীরে। আবার একই সঙ্গে শাশ্বত আধ্যাত্মবাদ এবং বিজ্ঞান যেন মিলেমিশে একাকার। সত্যিই তো মানব শরীর এক বৃক্ষের মতো। যার পাঁচটি ডাল হলো ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও বোম। তাহলে কী দেখা গেল? দেখা গেল কবির কল্পনা মুহূর্তে এক শাশ্বত সত্যের পূণর্জন্ম দিল কবিতায়।
 
আবার বিনয় মজুমদারের একটি কবিতার এই পঙক্তিদ্বয় দেখুন,“ তবু কি আশ্চর্য, দ্যাখ, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে/তার উড়ে যাওয়া ইষৎ সঙ্গীতময় হয়”। এখানেও সেই কল্পনার আশ্রিত কবি। যে কল্পনায় মশার উড়ে যাওয়ার মধ্যেও কবি সঙ্গীতময়তার সন্ধান পেলেন। অর্থাৎ কবির কল্পনা জন্ম দিল দুটি প্রবাদপ্রতিম পঙক্তির। এখানেই কবি ও কল্পনার যুগলবন্দি। একজন সাধারণ মানুষের চোখ যেখানে শুধুমাত্র একটি মশার উড়ে যাওয়াকেই দেখতে পেত তার সাধারণ চোখে, সেখানে কবির চোখ মুহূর্তে কল্পনালতা হয়ে উঠে মশার উড়ে যাওয়ার মধ্যে আবিষ্কার করলো সঙ্গীতময়তার। এখন প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র বাস্তব দৃষ্টিতে এই দৃশ্যটি যদি কবি দেখতেন তাহলে কি জন্ম হতো এমন দুটি পঙক্তির? অবশ্যই না। শুধুমাত্র বাস্তব দৃষ্টিতে রচিত একটি কবিতা অনেকটা তেমন ইক্ষু দণ্ডের মতো, যা দেখতে সুদর্শন হলেও ভেতরমহল শুষ্ক কাঠের মতো রসহীন। যা সামান্য এক পিঁপড়েকেও তার নিকটে আকর্ষণ করতে পারে না। সুতরাং কী দেখা যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, চুড়ান্ত কল্পনার আশ্রয় না নিলে এক সার্থক কবিতার জন্ম দেওয়া কখনই সম্ভব নয়। বিশেষ করে কবিতায় মূর্ত ও বিমূর্তের খেলায় এই কল্পনার এক বিশেষ ভূমিকা আছে। ধরা যাক এমন একটি পঙক্তি—“ গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই/ গাছের ভেতর থেকে নৌকাটি গড়িয়ে নেমে/বললো, চলো নদীর দিকে যাই”। কল্পনাশক্তি না থাকলে কোনো কবি জন্ম দিতে পারবেন এমন পঙক্তির? কক্ষনো না কারণ তিনি তো শুধু গাছকেই দেখবেন সেক্ষেত্রে, গাছের ভেতর থাকা নৌকাটির অস্তিত্ব টের পাবেন কীভাবে? 

“এ আকাশ ভাঙে মাঝে মাঝে/ও আকাশ 
মেঘে আত্মহারা/সে আকাশে নৌকা খোলা আছে/মা আমি আকাশভরা ভরা”
এই কবিতাটি দেখুন, মিথ্যের বেসাতি করেছেন কবি। আকাশে কি নৌকা খেলা করে! নৌকা তো জলে ভাসে। আবার কবি কবিতার কথকের মুখ দিয়ে সেই মিথ্যেরই কথা লিখছেন। “মা আমি আকাশভরা তারা”। কারো পক্ষেই কি আকাশের তারা হওয়া সম্ভব? এই হচ্ছে কবির কল্পনাপ্রসূত মিথ্যে, যা মুহূর্ত কবিতাটিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে” ,জীবনানন্দের “বনলতা সেন” কবিতার এই পঙক্তিটির কথা ভাবুন। এ কি কবির চুড়ান্ত মিথ্যের ফসল নয়? অবশ্যই কারণ হাজার বছর কোনো মানুষ তো আর বেঁচে থাকতে পারেনা। অথচ এই মিথ্যেই জন্ম দিল এমন এক কবিতার যা বিশ্ববন্দিত কবিতা হয়ে থাকলো এতদিন। কত আলোচনা কত অনুসন্ধিৎসা এই কবিতাটি নিয়ে। অর্থাৎ মিথ্যের আশ্রয়ে গিয়ে (যে মিথ্যে আবার কবির কল্পনার ফসল) কবিতাটি অমরত্ব প্রাপ্ত হলো।  সুতরাং কল্পনার আশ্রয়ে গিয়েই কবি প্রসব করেন অজস্র মিথ্যার। টুকরো টুকরো মিথ্যা নিয়েই গড়ে ওঠে একটি কবিতা শরীর। তবে এই মিথ্যেই তো কবিতার অলংকার। এই মিথ্যে যত বেশি করে থাকবে কবিতায়, কবিতাও হয়ে উঠবে তত মোহময়ী এবং মিস্টিক। একটি কবিতার শরীর থেকে এই অলংকাররূপী মিথ্যেগুলো খুলে নিলে কবিতাটি হয়ে উঠবে শুধু কিছু শব্দের সমাহার সম্পন্ন এক অসাড় শরীর। যা পাঠকের মনে সামান্যতম অনুরণনেরও জন্ম দিতে পারবে না কখনও। তাহলে কী দেখা গেল? কবি মাত্রই মিথ্যুক এবং কবিতা মানের মিথ্যের ভাণ্ডার। আবার এই মিথ্যে না থাকলে কোনো কবিতা কবিতায় নয়। এই যে দুরকম বিপরীতধর্মী কথা বলছি মনে হতেই পারে, এ তো দ্বিচারিতা! হ্যাঁ, দ্বিচারিতায় তো কারণ এই দ্বিচারিতা না করলে কীভাবে বলতে পারবো, এই মিথ্যের মধ্যেই কবিতার নীল ভ্রমর। এই নীল ভ্রমরটি যেন একাধারে মৃত্যুদূত আবার একইসঙ্গে অনন্ত জীবন দূতের ভূমিকায়। কবিতায় মিথ্যে না থাকলে এই নীল ভ্রমর বিষাক্ত দংশন দেয় কবিতাকে আর কবিতাটি মারা যায়। অন্যদিকে আবার মিথ্যে থাকলে নীল ভ্রমরটি জেগে উঠে দংশন করে কবিতাকে আর কবিতাটিও অনন্ত আয়ু প্রাপ্ত হয়ে বের হয় বিশ্বভ্রমণে। “এখানে এমন একজন শায়িত রয়েছে যার নাম লেখা আছে জলের অক্ষরে“। কবি কীটসের সমাধি ফলকে লিখে রাখা  কল্পনা ও মিথ্যের মেলবন্ধনে রচিত কবিতার এই পঙক্তিটি কি বিশ্বভ্রমণের ফসল রূপেই পৌঁছইনি আমাদের কাছে এবং ওই যে ‘জলের অক্ষরে’ এই মিথ্যেই ( মিথ্যে কারণ জলের কোনো অক্ষর হয়না এবং জলের মধ্যে লেখাও যায়না। আবার জল কোনো কিছু লেখা হলে তার স্থায়িত্বও ক্ষণকালের) জন্যই এই পঙক্তিটির আবেদন এত তীব্র হয়ে ধরা দিল আমাদের কাছে।  ইংরেজীতে একটি শব্দবন্ধ আছে, “হোয়াইট লাই”। এমন মিথ্যে কখনও করো ক্ষতি তো করেই না উলটে মঙ্গলের কজই করে। এই মিথ্যেই কবিতার পাঠকের চোখের দরজা খুলে দেয় এবং পাঠকও তখন আবিষ্কার করেন ওই মিথ্যের ভেতরে সুপ্ত ঘুমে থাকা কোনো চরম সত্যকে।   এই মিথ্যে না থাকলে কবি কীভাবে জন্ম দেবেন হিরণ্ময় কবিতার এবং পাঠকই বা কীভাবে মিথ্যের জারকরসে জারিত হতে হতে মিলেমিশে যাবেন কবিতার অণু পরামাণুতে। সুতরাং এইকল্পনা ও মিথ্যে যা কবিতার প্রাণভোমরা অথবা প্রাণভোমরী, আরও শক্তিশালী হোক আর কবিও এইসব মিথ্যেকেই আশ্রয় করে রচনা করুন কোনো মহৎ কাব্যের। জয় হোক কবিতাকল্পনালতার এবং হিরণ্ময় মিথ্যের যুগলবন্দিতে গাওয়া অনন্ত সঞ্চারির।

 

ক্ষিধে এক সমুদ্র পাখি...
সুবীর সরকার


ক্ষিধে এক সমুদ্র পাখি যে অনেক জলোস্তম্ভ পেরিয়ে যেতে চায়। ক্ষিধে আসলে সার্কাস তাঁবুর আলোর নিচে ঘন হতে থাকা অন্ধকার।
ক্ষিধে গড়াতে থাকে জীবনের নানা বাঁক ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
কত রকমের ক্ষিধে। ভালোবাসার যৌনতার প্রেমের আশ্রয়ের আশ্রয়হীন তার। আপাত সুখী মানুষের ভেতরে পরতে পরতে সাজিয়ে রাখা ক্ষিধে ধারাভাষ্য হারিয়ে ফেলা এক দীর্ঘ পদযাত্রার মত।
সোমনাথ হোড় সালভাদর দালি অরি মিশো কর্পেন্টিয়ার পেরিয়ে যদি ঋত্বিক কিংবা প্রমথেশ বড়ুয়ায় আসি তবে দেখবো ক্ষিধে তো কেবল পেটের নয়!
মানুষের গোটা জীবনই তো নানারকম ক্ষিধে দিয়ে গড়ে তোলা বহুস্বরিক ভাষ্কর্যের মত।
রামকিঙ্কর বেইজের কথা মনে পড়ে যায়।
২.
ক্ষিধে আসলে ভাঙা হাট থেকে ভেসে আসা পদাবলী গানের আখর। গান শুনতে শুনতে এগিয়ে যাওয়া। অপেক্ষায় তো কেউ থাকে না আদতে। একটা ভাঙা লণ্ঠনের আলো খুঁজতে খুঁজতে রাতের জঙ্গলে ক্ষিধে খুঁজতে যাই। জীবনের পাকে পাকে ক্ষিধে এক মহামান্য শব্দবন্ধ হতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত কি আর তা হয়!
নদীর জলে মানুষ ভরা ফেরি নৌকো। একেক মানুষের মুখে একেক রকমের ক্ষিধে না ফুরিয়ে যাওয়া গল্পের মত বুঝি।
৩.
আবহমান যাপন ভূমির প্রস্থান রেখায় বারবার ভোরের আলোর সাথেই জেগে ওঠে আমাদের ক্ষিধে। মুলিবাশের বেড়ার ফাঁকে জলে ভিজিয়ে রাখা ভাত খেতে খেতে মহেশ্বর দাস তার ক্ষিধে জড়ানো আস্ত জীবনের কথা ভাবে। ভেবেই চলে। সে ভাত খেতে খেতে স্বপ্ন দেখে লাল মরিচ, কাসুন্দি আর পেয়াজের ঝাঁঝের।
নুরুদ্দিন ইয়াসিন নুর নবীরা তখন ফেলে আসা সময়ের বৃত্তে প্রবেশ কিংবা অন্তর্ধানের এক জলবিভাজিকা এই মরপৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে থাকে। আর গানের ঢেউয়ের পিঠে ক্ষিধে ও খুদকাতরতা কেবল ভেসেই যেতে থাকে_
" এ পাড় থাকি না যায় দেখা রে
   নদীর ওই পাড়ের কিনার"
৪.
ক্ষিধে নিয়ে অচিন্ত নন্দীর নির্মিত একটি তথ্যছবি দেখতে দেখতে আমি চলে গিয়েছিলাম ইথিওপিয়া আফ্রিকা সোমালিয়া কলাহান্ডিতে। সত্যি, ক্ষিধে কি প্রবল এক বিপণন! হাড্ডিসার শরীর নিয়ে কলো মানুষেরা কিন্তু হারতে চায় না। তারা হারে না।পরাজয় থেকে ঢের দূরে দাঁড়িয়ে তারা লোকসঙ্গীত গায়। ধুঁকতে ধুঁকতে নাচে। জীবনের দিকে তীব্র ব্যঙ্গ ছুড়ে দিয়ে ক্ষিধে তখন আবহমানতার দিকে গড়াতে থাকা কবেকার সেই কাঠের বন্দুক। সিন্ধু সভ্যতার লো ল্যান্ড।
৫.
ক্ষিধে নিয়ে কিছু চিরকালীন সামগান তো টেনে আনা যেতেই পারে! হাংরি অ্যাংরি হিপি বিট থেকে ক্ষিধে ক্রমে সমকাল অতিক্রম করে করে চিরদিনের সম্পদের মত অ্যান্টিক কিছু বুঝি বা!
ক্ষিধে আলাদা করে তেমন কিছুই না।
ক্ষিধে আছে বলেই তো আমাদের সভ্যতা গড়ে ওঠে। সভ্য মানুষেরা ঝুঁকে পড়ে শিল্প সাহিত্য গান প্রেম যৌনতায়।
ক্ষিধে শেষপর্যন্ত আদি ও অন্ত এক কুটিরশিল্প, যা বেসিক্যালি সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়তে চাওয়া প্রবল এক প্রতিরক্ষার মত!

 রাখাল কিংবা ক্ষুধাবিষয়ক রচনা

প্রশান্ত গুহমজুমদার



আমি রাখাল। সীমা আর শংকু-কে নিয়ে আমার ছোট্ট সংসার। কিছুদিন ধরেই ভাবছি আপনাদের একটা গল্প শোনাবো। মানে শোনাতে চাইছিলাম। বিশ্বাস করুন, গল্পটা ছিল একটা বাঁশের সেতু, দুটো ছাগল আর কয়েকটি গাছের গল্প। সেখানে এক অতীব সুন্দরী, সামান্য মেঘ আর ঝরা পাতার শব্দ। 

কিন্তু লেখাটা হয়ে দাঁড়াল এ রকম। সরি। সীমা বা আমার কোন খরিদ্দারকে এসব বলা যায় না। পাগলও ভাবতে পারে। তাই আর সাহস করি নি। আসলে বিষয়টা  সারা পৃথিবী বা মানুষের খিদে নিয়ে বিদ্যালয় কিংবা মহাবিদ্যালয় উপযুক্ত এক সামান্য রচনা।

এটা যে কোন জায়গা থেকেই শুরু করা যাতে পারে। যেমন রমেনের কথা দিয়ে।

রমেন, আমার একদা সহপাঠী, সেই বিরল বাঙ্গালীদের মধ্যে একজন যে কথায় কথায় একদিন আমাকে জানিয়েছিল, কিছু জিনিস নিয়ে ও ভাবার প্রয়োজন বোধ করে না। যেমন, খাবার, মাথা গোঁজার আস্তানা, বিনোদনের বৈচিত্র এবং ভ্রমণের অর্থ। তার বহুজাতিক সংস্থার ৩০ শতাংশ মালিকানা, পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত নিজেদের গুটি কয়েক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা এবং সুবিশাল চমকদার বাড়ি। সে দেশবিদেশ ঘোরে, মহার্ঘ্য মদ্য পান করে, নারী সংসর্গে বড়ই উন্নাসিক এবং পটু। তিনটে মূল্যবান গাড়ির একটা নিয়ে অফিস, ব্যবসা দেখে, একটা গাড়ি বিনোদনের জন্য আর একটি দেশের বিভিন্ন রিসর্টে যাওয়ার জন্য বরাদ্দ। সে খাবার, মাথা গোঁজার আস্তানা এমন কয়েকটি জিনিস বোঝে না বা সে সব দিকে ধ্যান দেওয়া সময়ের অপব্যয় বলেই মনে করে।

ব্যক্তিগতভাবে খিদে নিয়ে আমার কিন্তু খুব মাথাব্যথা নেই। দৈনন্দিন মাথাব্যথার মত। ঘিনঘিনে একটা ব্যথা লেগেই থাকে। খিদে পেলেও ব্যথা, মাথা ধরলেও ব্যথা। সে আমার সহ্য হয়ে গিয়েছে। আমার ছোট একটা শোপিসের দোকান আছে। ঘর থেকে অনেকটা দূর। সকালে ৮টা নাগাদ দুটো ভেজা ভাত খেয়ে বেড়োই। ফিরি রাত্রি ৯টা নাগাদ। দুপুরে টিফিন বক্সে বৌয়ের দেওয়া একটু ভাত, ডাল আর সবজি। কোন কোনদিন এক টুকরো পোনা মাছ। অতএব খিদে আমার আছেই। অন্য কোন খিদের বাতিক আমার নেই। 

রমেন-কে আমার কোন ঈর্ষা নেই। যার যেমন কপাল। কেউ শোষণ করে, কেউ বা কেবল শোষিত হয়েই চলে। আমার মা তো শৈশবেই রওনা দিয়েছিলেন। বাবাও ফটাং করে পাঁচ দিনের জ্বরে গন্‌। ভাগ্যিস ভাই বোন কেউ ছিল না আমার। তখন বয়স কত হবে আমার! সতেরো-আঠারো। সেই থেকে খিদে আমার নিত্য সঙ্গী। এক দূর সম্পর্কের কাকার পরামর্শে লটারির ব্যবসা, অফিসে অফিসে স্টেশনারী মাল সাপ্লাই দেওয়ার কাজ। তবে এর মধ্যেই গ্র্যাজুয়েশনটা করে নিয়েছিলাম। মাথাটা খুব খারাপ ছিল না। ভুগোলে অনার্সটাও ছিল। কিন্তু তাতে কী আর চাকরি জোটে! এই সব করতে করতেই কালেক্টরেটের এক সাহেবের নজরে পড়ে যাই। এই আট বাই আট ঘরটা তাঁরই অবদান। একটা ছোট্ট মার্কেটের মত যায়গায় দোকানটা। সেই শুরু। তা আজ বাইশ বছর হয়ে গেল। তবে দারিদ্র সীমার উপরে ওঠা আমার এখনো হল না। লিস্টে দেখেছি, জ্বলজ্বল করছে আমার আর সীমার নাম। দেশের বাইশ শতাংশ মানুষের মধ্যে আমরাও তা হলে আছি! বেশ একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়। দোকানে বিক্রিবাটা কিছু হয়। তবে সবই চায়না মাল। এর মধ্যেই বিয়েও করলাম। শংকু এলো। ওর এখন চার। আমাদের  গড় ওজন আশি। 

দুটো দোকান পরেই অনিলের বড় মুদিখানা-কাম-স্টেশনারি দোকান। আমারই বয়সী। পড়াশোনাও প্রায় আমারই মত। তবে বি পি এলে নেই। কোন দেখনদারীও নেই। নানান বিষয়ে খোঁজখবর রাখে, পড়াশোনা করে। মাঝে মধ্যে আমার কাছে এসে বসে। আমরা সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে বসি। ওকেই প্রথম কথায় কথায় এই খিদে আর পেটের ব্যথার গল্প করেছিলাম। সেদিন চায়ের সঙ্গে দুপিস্‌ পাঁউরুটি মাখন আর চিনি মাখিয়ে খাইয়েছিল। ব্যথাটাও গায়েব। 

এরকমই এক দুপুরে অনিল আর আমি বসেছি। সামনে দিয়ে একটা বিরাট মিছিল। দু টাকায় চালগম, শাসকদলের বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে মিছিল। 

-এমন মিছিল তো হর সপ্তাহেই দেখছি। কিন্তু আমাদের তো কিছু হচ্ছে না! মানুষের খিদে কী কমছে? মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষের হয়রানি।

-এ ভাবে ভাবছো কেন? মানুষের দাবীদাওয়া অভাব অভিযোগ নিয়ে মানুষই তো কথা বলবে। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, এ ধরনের বেশিরভাগ মিছিলের পিছনে কিছু রাজনৈতিক ফায়দার ব্যাপার থেকেই যায়। ফলে মিছিল হয় ঠিকই, কাজের কাজ কিছু হয় না।   শুদু তুমি নও, সারা পৃথিবী পেটের খিদেয় ভুগছে। 

বোধহয় অনিলের তাড়া ছিল না। পকেট থেকে দামী ফোন বের করে ক্ষুধা নিয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান আর খবর দেখিয়েছিল। আমি তো হতবাক! 

তারপর থেকে সময় পেলেই ওকে খোঁচাই। হাসতে হাসতে ও কত কিছু যে জানিয়েছে আমাকে! অনিলকে রমেনের কথা বলেছিলাম। ও কোন কথা না বলে একটার পর একটা ভয়ংকর অবস্থার কথা বলেছিল। 

বলেছিল, রমেনের মত ওই ২০% বা ৩০% মানুষ অনায়াসে অবহেলায় সারা বছরে যে পরিমান খাদ্য অপচয় করে বা করার স্পর্ধা করতে পারে, তার পরিমাণ বছরে উৎপাদিত  খাদ্যশস্যের ৪০% । অর্থের নিরিখে তার মূল্য ৯২ হাজার কোটি টাকা।  আমাদের দেশে এত প্রগতির আলো চারপাশে বিচ্ছুরিত হলেও সাম্প্রতিক সুমারির হিসেব অনুযায়ী ২২% মানুষ বিপিএল তালিকায় এখনো রয়ে গিয়েছে। ২০১৭-র গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্ট অনুযায়ী ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারত ১০০তম স্থানে অবস্থান করছে। খুব অবাক করে দেওয়ার মত ঘটনা, ইরাক, বাংলাদেশ, নর্থ কোরিয়ার থেকেও ভারত এ ব্যপারে পিছিয়ে রয়েছে। যথেষ্ট পরিমানে খাদ্য মজুত থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ১৯০ মিলিয়ন মানুষ অভুক্ত থেকেই রাত্রে ঘুমোতে যায়। তথ্য অনুযায়ী ৪টি শিশুর মধ্যে একটি শিশু ভুগছে অপুষ্টিতে। ভারতে শিশুদের অবস্থা একবার ভাবতে পারছো? 

সে রাত্রে ঘরে ফিরে ঘুমন্ত অংশুর মাথায় হাতটা ছুঁইয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।  কিছু মুখে তুলতে পারি নি। 

তবু অনিল ক্রমশ আমার একটা নেশা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। দুপুরের চায়ের দোকানে বসে থাকার সময় দিনের পর দিন হচ্ছিল দীর্ঘতর । 

এরকমই একদিন অনিল বলছিল, তার নাকি মনে পড়ে ভ্যান গঘের 'পটেটো ইটারস'-ছবির কথা। ছবির প্রিন্ট আমিও দেখেছি। কিন্তু ডিসটার্ব করলাম না। অনিল বলে যাচ্ছিল। 

-কিশোরকবি সুকান্ত-র সেই বহুল পরিচিত পংক্তি আজ উচ্চারণ না করেও বলা যায়, এই পৃথিবীতে সামান্য কয়েকটি পরিবারের ব্যবসায়িক মূলধন যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ক্ষুধা, অনাহারে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে যেন সেই হারেই। ঝলসানো রুটিও জোটে না মানুষের কপালে আজো। এ এক বিচিত্র ফ্যালাসি! অথবা ধনতন্ত্রের স্বাভাবিক উপহার। সামান্য পুরনো কিছু তথ্য মনে রাখা যাক। সারা পৃথিবীর ৮১০ মিলিয়ন অর্ধভুক্ত অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে আমাদের শস্যশ্যামল ভারতের ১৯৪ মিলিয়ন মানুষ এসে গিয়েছেন এই বিবর্ন চিত্রপটে। অথচ আমাদের দেশ কতকগুলি খাদ্যসামগ্রীতে তো উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করে রেখেছে। যেমন, দুধ, ডাল, বাজরা ইত্যাদি। ভারত চাল, গম, আখ, বাদাম, সব্জি, ফল আর তুলো উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তুমি হয়ত বলবে, তাহলে এমন অবস্থা কেন! দেশের অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল বা যাদের সাধারণ ভাবে যারা গরীব, প্রত্যন্ত গ্রামেরই তো মানুষ তাঁরা, তাঁদের কাছে তো পৌছচ্ছে না নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার অথবা প্রয়োজনীয় খাবারটুকু কেনার ক্ষমতাই থাকছে না। কারণও অনেক। এইসব মানুষের কাছে পৌঁছাতে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন, সেই রাস্তা, পরিবহনের ব্যবস্থা, কৃষক থেকে ক্রেতার কাছে সরাসরি খাদ্যদ্রব্য পৌঁছনোর মত ব্যবস্থা, সবই তো অধরা! এ ছাড়া রয়েছে ফড়েদের দৌরাত্ম। শেষ অবধি চাষীর পকেটে যায় সামান্যই। আর গরীব মানুষের কাছে, মনে রাখতে হবে কিন্তু  ঐ চাষীও একজন ক্রেতা, সেই খাদ্যদ্রব্য হয়ে যায় অগ্নিমূল্য। এদের পকেটে অত পয়সা কোথায়! ফলত ক্ষুধা থেকেই যায় পেটে। খাবারের নিরাপত্তার অভাবে এই শ্রেণীর মানুষ ভোগে আজীবন। অপুষ্টি হয়ে পড়ে এদের আজীবনের সঙ্গী। 

ক্রমশ বির্বাক হয়ে পড়ছিলাম। আর এ ভাবেই অনিল ক্রমশ ভুলিয়ে দিচ্ছিলো আমারই খিদে বোধ। 

একদিন বললো, চলো, কাল তো রোববার। একটা গ্রাম দেখে আসি। প্রশ্ন করি নি কোথায়, কেন। শুধু সময়টা জেনে নিয়েছিলাম। বাড়িতে ব'লে সময়মত দোকানের সামনে। তারপর ঘন্টা দেড়েকের বাসজার্নি, দুটো বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে হাঁটা, তারপরেও কয়েক কিলোমিটার। ক্রমে দেখা গেল ঘরের মত বেশ কিছু আস্তানা। চৈত্রের মাঝামাঝি। ঘন বসন্ত। অন্তত ক্যালেন্ডারমাফিক। এখানে সে সুবাতাস নেই। তীব্র দহন শুধু। কিছু মুরগী চরে বেড়াচ্ছে। একটা ঘরের সামনে তালপাতার চাটাই মতো একটা কিছুর উপর শুয়ে আছেন লোলচর্ম হাড়সার এক বৃদ্ধা। ভয় হয়, আর কোনদিন উঠে বসতেও পারবেন না। চোখদুটো আমাদের দিকে। ভাষা নেই কোনো সে চোখে। কিছু দূরে দুটি বালকবালিকা, দৃশ্যত শিশু। একে অপরকে জড়িয়ে। অদূরে একটি মেয়ে, মনে হয় আসন্নপ্রসবা। কোটরাগত চোখ, প্রবল রক্তাল্পতা। দৃশ্য শুধু তার পেট। বসে আছে দাওয়ায়। অবশ্য ওটাকে যদি দাওয়া বলা যায়। ব্যাগ থেকে নিজেদের জন্য আনা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে ওদের দেওয়ার জন্য এগোতেই অনিল আমার হাত চেপে ধরলো। 

- কক্ষনো এই ভুল কাজ করবে না। ওরা নেবে না। আর এভাবে ওদের না খেয়ে থাকার বহু দিনের, অভ্যাসের কী অবসান তুমি ঘটাতে পারবে? মাঝখান থেকে ওরা ভিখিরি হয়ে যাবে। না খেয়ে মরে যাওয়া নতুন কিছু নয় ওদের কাছে। ওরা জানে, মা বাবা ভিন দেশ থেকে ওদের জন্য নিয়ে আসবে খাওয়া। ঘরে এখনো থেকে যাওয়া খাদ্যের অবশিষ্ট ফুরিয়ে গেলে ওরা অপেক্ষা করবে। ওরা অপেক্ষা করতে শিখে গিয়েছে। 

-পুরুষ বা অন্য সব মেয়েদের দেখছি না তো!

-বললাম তো ওরা সবাই ভিন্‌ দেশে কাম্‌লার কাজ করতে গিয়েছে। ধান কাটা শেষ হলে ফিরে আসবে ঘরে। যে যেটুকু পারে নিয়ে আসবে ক্ষুধা নিবারণের অন্ন।

 - এখানে তো কোন যানবাহনের আসার মত কোন পথও দেখছি না!

-দেখবে না। নিজেই তো দেখলে, বাস থেকে নেমে কতটা হেঁটে এলাম এখানে। আর এই যে জমিটায় ওরা ঘর তুলেছে, সবটাই ব্রম্ভডাঙ্গা। এখানে কোন জলের ব্যবস্থা নেই। ফসল ফলে না। পানীয় জল পাঁচ ছ কিলোমিটার দূরে একটা সরকারী কুয়ো আছে, সেখান থেকে নিয়ে আসে। দু চারটে ফলের গাছ লাগিয়েছিল। বাঁচে নি।

-তুমি এত সব জানলে কী করে!

-যখন ওরা ফিরে আসে, সে সময়ে আসি। ওদের সঙ্গে গল্পগাছা করি। বেশি কিছু বয়ে আনার ক্ষমতা তো নেই আমার। ওদের জন্য বিড়ি সিগারেট আর কিছু গুড় বাতাসা চিনি নুন নিয়ে আসি। জানি, বিড়িটিড়ি আনা, এটাও ঠিক না। তবু আনি। ওদের পুরনো বন্ধু হিসেবেই আনি। ওরা আমাকে খেতে দেয় মোটা চালের ভাত, সবজি। আর হাঁড়িয়া। এ টুকুই তো ওদের বিনোদন।

আর কোন প্রশ্ন করি নি। মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলাম। 

এটুকু হচ্ছে দীর্ঘ এক রচনার সামান্য অংশ। আপনারা পরিত্রাণ চাইছেন, অনুমান করছি। ক্ষমা করবেন। আর সামান্য কয়েকটি কথা। 

দিনের পর দিন অনিলের কথা শুনতে শুনতে মনে হয়,  রমেনের মত মানুষকে হিসেবের বাইরে রাখলে অনিলের মত মানুষেরও হয়ত দেখা পাওয়া যায়, যারা কেবল খিদে বোঝে না, অপরের জন্য অনুভব করে, সাধ্যমত চেষ্টা করে দারিদ্র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, অন্তত শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে। এটুকুই ভরসার কথা। সর্বার্থেই ভারত এগোবেই একদিন, অনিলের মত মানুষের জন্যই উপরে দেওয়া সব খারাপ খারাপ তথ্য পাল্টে যাবে আগামীতে। আমাদের তিনজনের আর ক্ষিধে থাকবে না। ভয়ংকর এক প্যানডেমিকের মধ্যে দিয়ে এগোলেও, আমরা আশা করব, এ সবই সাময়িক। ৫ বছরের নিচে শিশুদের অপুষ্টিতে ভুগতে ভুগতে নানান অসুখে আর ঢলে পড়বে না মৃত্যুর কোলে, প্রতিদিন আমার এই প্রিয় জন্মভূমিতে ৩০০০ শিশু অপুষ্টিজনিত অসুখে হারিয়ে যাবে না চিরতরে মায়ের কোল থেকে, পেটের খিদে নিয়ে মানুষ প্রতি রাত্রে আর ঘুমোতে যাবে না সর্বহারার বিছানায়।


-


 বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা

_________________________

সুজিত রেজ




যে-কোনো চিন্তন-দর্শন-ভাবনা-অনুভাবনার গূঢ় স্বরূপ বিচার করে,তার গৃহীত-সৃজিত অনুষঙ্গের পাঠ-পাঠান্তরের নির্যাসজাত মৌলিকত্ব-স্বাতন্ত্র্য মূল্যায়ণ কূটভিষার নামান্তর ; একইসঙ্গে চাপান-উতোরের অবকাঠামো বিনির্মাণের ক্ষেত্রভূমি কর্ষণের অবকাশ সৃষ্টি করা। এই মায়ালোকে প্রবেশ-বাঞ্ছা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে, রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবাদ-সিঞ্চিত রসসুধা পানে আগ্রহের উজ্জীবন আমার ধারণ-ক্ষমতা-বিচার  :


                                          শোনো বিশ্বজন

           শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ

           দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে

           মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে

          জ্যোতির্ময়। তাঁকে জেনে তাঁর পানে চাহি

          মৃত্যুকে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।


এই বিচার একান্তই আমি-সংশ্লিষ্ট। আমার মধ্যে যে আমি আছে , তাকে আহত করার ঝুঁকি নেওয়া যেতেই পারে। আহত আমির যন্ত্রণার শুশ্রূষা-প্রার্থনা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। আমার আমি কি ব্রহ্ম? জানি না। কেন জানি না, তা জানি না। বলতে পারব না। জানতে চাইনি তা তো নয়। তবে যেভাবে চাইলে জানা যায় , হয়ত সেভাবে জানতে চাইনি কোনদিন। জানার ইচ্ছের মধ্যেই বড় ফাঁকি ছিল। তবে জানা- অজানার মধ্যে 'কেটেছে ' একেলা বহুদিন। 'বিরহের বেলা ' হয়েছে দীর্ঘ।

অভিধানে আত্মাদিবিষয়ক  কিংবা দেহাদিতে অধিকৃত ব্রহ্মবিষয়ক জ্ঞান অধ্যাত্ম অর্থবাচক।আত্মা "আত্মানং রথিনং বিধি" ( কঠোপনিষৎ), অর্থাৎ যা ব্যাপ্ত করে বা সঞ্চরণ করে। আত্মা আপনি, নিজস্বরূপ, স্বীয়রূপ। আত্মা আবার প্রযত্ন, চেষ্টা, ধৃতি, ধৈর্য, ধর্ম, বুদ্ধি, মতি, প্রজ্ঞা, স্বভাব, প্রকৃতি ও শূন্য। আত্মা পরমাত্মা, ব্রহ্ম ও চৈতন্য নির্দেশক। ব্রহ্ম " বস্তু সচ্চিদানন্দমদ্বয়ং "; ওঙ্কার-শব্দ-ধন-বিত্ত-মোক্ষ-অন্ন -সত্য কিংবা তত্ত্বজ্ঞান-আত্মজ্ঞান-প্রকৃতিপুরুষবিবেকজ্ঞান।  উল্লিখিত ওঙ্কার-শব্দাদির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শৈশব-নাড়ির অচ্ছেদ্য বন্ধন।মাতৃজঠরের নাড়িছেদনের অনুষ্ঠানেই মাঙ্গলিক হুলাহুলির পরিবর্তে ধ্বনিত হয় :

" ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।"

( জগতে যাহা কিছু চলমান পরিবর্তনশীল বিকারশীল তাহার সব কিছুই যে এক পরমসত্যের দ্বারা আবৃত অর্থাৎ বিধৃত।)  অথবা " ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবির্তুব রেণ্যং ভর্গো দেবস্যঃ ধীমাহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।"

( যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে 

              পৃথিবী আকাশ তারা

   যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে

              বুদ্ধি চেতনা ধারা-----

    তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি

    ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি। )


জ্ঞান-পরিধির শৈশব-স্মৃতি রচন বাহুল্যদোষেদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ "মানবসত্য" প্রবন্ধে বাল্যস্মৃতি উদ্ধার করে লিখেছেন  :

" আমার জন্ম যে পরিবারে সে পরিবারের ধর্মসাধন একটি বিশেষ ভাবের। উপনিষদ এবং পিতৃদেবের অভিজ্ঞতা , রামমোহন আর আর সাধকদের সাধনাই আমাদের পারিবারিক সাধনা। আমি পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। জাতকর্ম থেকে আরম্ভ করে আমার সব সংস্কারই বৈদিক মন্ত্র দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল , অবশ্যই ব্রাহ্মমতের সঙ্গে মিলিয়ে।.... এমন সময় উপনয়ন হল। উপনয়নের সময় গায়ত্রীমন্ত্র দেওয়া হয়েছিল। কেবল মুখস্থভাবে না ; বারংবার সুস্পষ্ট উচ্চারণ করে আবৃত্তি করেছি এবং পিতার কাছে গায়ত্রীমন্ত্রের ধ্যানের অর্থ পেয়েছি। তখন আমার বয়স বারো বছর হবে। এই মন্ত্র চিন্তা করতে করতে মনে হত, বিশ্বভুবনের অস্তিত্ব আর আমার অস্তিত্ব একাত্মক। ভূর্ভুবঃ স্বঃ---- এই ভূলোক, অন্তরীক্ষ আমি তারই সঙ্গে অখণ্ড।এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি-অন্তে যিনি আছেন, তিনিই আমাদের মনে চৈতন্য প্রেরণ করেছেন। চৈতন্য ও বিশ্ব --- বাহির ও অন্তরে সৃষ্টির এই দুই ধারা এক ধারায় মিলেছে। এমনি করে ধ্যানের দ্বারা যাঁকে উপলব্ধি করছি, তিনি বিশ্বাত্মাতে আমার আত্মাতে চৈতন্যের যোগে যুক্ত। এইরকম চিন্তার আনন্দে আমার মনের মধ্যে একটা জ্যোতি এনে দিলে। এ আমার সুস্পষ্ট মনে আছে।"

ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে পারিবারিক গভীরতার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মলোকে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা নিবিড়তর হয়। ব্রাহ্মসমাজের উন্নতি সাধনের জন্য নির্স্বার্থ-প্রাণ পিতা দেবেন্দ্রনাথ ১৮৬৭-তে ' মহর্ষি ' রূপে কেশবচন্দ্র সেনের কাছে অভিনন্দিত হন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ছয়। ' ব্রাহ্মধর্ম ' ও ' ব্রাহ্মধর্মবীজ ' প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রণেতা ব্রাহ্মমুখ্য দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের ভাঙনে ব্যথিত হয়ে , ১৮৮০ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হন। ১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ ২৭ বছর তিনি এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন।


পিতার মনোবাঞ্ছায় ব্রহ্মসংগীত রচনার মধ্য দিয়েই  ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগের সূত্রপাত। ১৮৭৩ সালে পিতার সঙ্গে অমৃতসর স্বর্ণমন্দির দর্শন করে বিস্মিত বালক গুরু নানকের একটি গানের (গগন মে থাল রবি চান্দ দীপক বনে) কথা ও সুরের বিনির্মাণে রচনা করেন প্রথম ব্রহ্মসংগীত : " গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে "।  দেশ রাগে ঝাঁপতাল তালের এই গানটি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের মাঘোৎসবে প্রথম গীত হয়। গানের সূত্র-ভিত্তি এতটাই দৃঢ় যে গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের ৬২৬ টি গানের মধ্যে ৪৮৪ টি ব্রহ্মসংগীত ; সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মসংগীত গ্রন্থের সর্বশেষ পঞ্চদশ সংস্করণেও

(১৯৯৩) যা অন্তর্ভুক্ত।


" শান্তিনিকেতনে অপর সাধারণের একজন বা অনেকে একত্র হইয়া নিরাকার এক ব্রহ্মের উপাসনা করিতে পারিবেন" এই উদ্দেশ্য নিয়েই মহর্ষি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর উপাসনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে উপাসনা মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মোপনিষদ ভাষণ পাঠ করেন। এটি তাঁর প্রথম ধর্মদেশনা। পরের বছরে পাঠ করেন ব্রহ্মমন্ত্র। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের 'সাত বৎসরের ধর্মোপদেশের সংগ্রহ ' ধর্ম পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত  ' নিত্যপূজার নৈবেদ্য ' 'শান্তিনিকেতন'-গ্রন্থের একাধিক প্রবন্ধে উপনিষদের মন্ত্রগুলির সহজ ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি, যুক্তি ও প্রাচীন ঋষিদের অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য উপস্থাপিত। যার মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের সংকীর্ণ সীমা অতিক্রমণের প্রতিজ্ঞা এবং প্রথাসর্বস্ব সনাতন ধর্মের বিচ্যুতি-বেদনা বিনত মানসিকতায় উৎকীর্ণ। 'আত্মপরিচয়' প্রবন্ধে তার স্পষ্ট পরিচয় আছে  :

" বস্তুত ব্রাহ্মসমাজের আবির্ভাব সমস্ত হিন্দু সমাজেরই ইতিহাসের একটি অঙ্গ। হিন্দু সমাজেরই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে তাহারই বিশেষ একটি মর্মান্তিক প্রয়োজনবোধের ভিতর দিয়া এই সমাজ উদ্বোধিত হইয়াছে। ব্রাহ্মসমাজ আকস্মিক অদ্ভুত একটা খাপছাড়া কাণ্ড নহে। যেখানে তাহার উদ্ভব সেখানকার সমগ্রের সহিত তাহার গভীরতম জীবনের যোগ আছে। বীজকে বিদীর্ণ করিয়া গাছ বাহির হয় বলিয়াই সে গাছ বীজের পক্ষে একটা বিরুদ্ধ উৎপাত নহে। হিন্দুসমাজের বহুস্তরবদ্ধ , কঠিন আবরণ একদা ভেদ করিয়া সতেজে ব্রাহ্মসমাজ মাথা তুলিয়াছিল বলিয়া তাহা হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধ নহে , ভিতর হইতে যে অন্তর্যামী কাজ করিতেছেন , তিনি জানেন তাহা হিন্দু সমাজেরই পরিণাম। "

শৈশবকাল থেকেই রবীন্দ্র-অন্তরে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক আকুতি স্বতঃস্ফৃর্ততায় বিকাশ লাভ করে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক- সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মিলনগ্রন্থিতে মানবিক-ঐশিক এষণা প্রগাঢ়তমমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়। যা সত্য,শাশ্বত ও সুন্দর , যা বৃহৎ , বিপুল ও অবিনশ্বর তারই আস্পৃহায় রবীন্দ্র-অন্তর আকুলিত ও উদ্বেলিত হয়। ধর্ম-সাধনার বিকৃত বিক্ষুব্ধ ক্ষুদ্রতা- সংকীর্ণতা পরিহার করে  ভূমার সঙ্গে যোগসূত্র রচনার তীব্র আকুলতা জাগে। এর প্রাথমিক পাঠ তিনি গ্রহণ করেন বেদ ও উপনিষদের মণিকোঠার নিরুপম ও নান্দনিক শ্লোকমালায়। গভীর নিষ্ঠায় চলে প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাবগত ও মর্মগত রসসন্ধান। অচিরেই আত্মস্থ হয়  :

ক) একঃ দেব সর্বভূতেষু গূঢ় সর্বভূতান্তরাত্মা...


খ) সর্বে সুখেনি সন্তু সর্বে সন্তু নিরামায়া।


গ) সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ           সহচিত্তমেয়াম।


ঘ) স বিশ্বকৃৎ স হি সর্ব্বস্য কর্তা তস্য লোকাঃ স উ লোক এব...


ঙ) আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।


চ) ইয়ং পৃথিবী সর্বেষাং ভূতানাং মধু।


ছ) আত্মবৎ সর্বভূতেষু য পশ্যতি স পশ্যতি।


জ) ভ্রাতারো মানবাঃ সর্ব্ব স্বদেশ ভুবন ত্রয়ম।


ঞ) বিশ্বানি দেব সবিতদূরিতানি পরাসুব।


বৈদিকোত্তর ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, অহিংস প্রেমের প্রবর্তক, অপরিমেয় করুণা ও মৈত্রী বোধের প্রতিভূ বুদ্ধদেবের  ----

" সর্ব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু অবেরা হোন্তু অব্যাপজ্ঝা হোন্তু সুখী অত্তানং পরিহরন্তু " বাণীমন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ  মানবজীবনের পরম লক্ষ্য ও প্রশান্তির জগৎ খুঁজে পেয়েছিলেন। নোবেল প্রাপ্তির পর বিশ্ব-পরিক্রমায় আর এক মানবপুত্র যিশুর পায়ের চিহ্নে দীন মানুষের মিলনসাধনপীঠ অবলোকন করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী কবি -শিল্পী - দার্শনিক - বৈজ্ঞানিকদের স্নিগ্ধ সন্নিধানে , ব্রহ্ম-মানুষ-প্রকৃতি এই উপাদানত্রয়ে " বিশ্বলোকে চিত্তবৃত্তির যে বিচিত্র প্রবর্তনা আছে তাতে সাড়া দিতে হবে সকল দিক থেকে " এই সিদ্ধান্তে রবীন্দ্রনাথ উপনীত হয়েছিলেন।

দীর্ঘজীবনের প্রতিদিবসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর ' হইয়া উঠিয়াছেন '। শেষ জীবনে ' মানুষের ধর্ম ' প্রবন্ধে তিনি সেকথা জানিয়েছেন-- " আমার জীবন তাহার ধর্মকে লাভ করিয়াছে একটা বাড়িয়া উঠিবার প্রবাহের ভিতর দিয়া , কোনো উত্তরাধিকারের ভিতর দিয়া নয়, বাহির হইতে আমদানির দ্বারাও নয়।....

সব কিছুর ভিতর দিয়াই যে একই বিষয়বস্তু প্রকাশ লাভ করিয়াছে , তাহাতেই আমার নিকট প্রমাণিত হইয়াছে যে ' মানুষের ধর্ম ' আমার মনের মধ্যে একটা ধর্মের অনুভূতিরূপেই গড়িয়া উঠিয়াছে , কোনো দার্শনিক বিষয়বস্তুরূপে গড়িয়া ওঠে নাই। " আত্মলব্ধ এই মানসিক শক্তিতেই  ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ  অহং- এর আবরণ মুক্ত করেছেন। এই অহং নিত্যকালের অহং নয় , তা তো শাশ্বত অমৃতরূপ। এই অহং ক্ষুদ্র ; প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয়তা ও ভেদবুদ্ধির দ্বারা আবৃত, ক্লিন্ন ও মলিন। ভেদাত্মক আত্মকেন্দ্রিকতা থেকেই জন্মায় পাপ। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে এই সংকোচনধর্মী অহং - এর খোলস পরিত্যাগ অনিবার্য। কেননা " আত্মার প্রকাশরূপ যে অহং তার সঙ্গে আত্মার একটী বৈপরীত্য আছে। আত্মা ন জায়তে ম্রিয়তে। না জন্মায় না মরে। অহং জন্মমরণের মধ্য দিয়ে চলেছে। আত্মা দান করে , অহং সংগ্রহ করে , আত্মা অন্তরের মধ্যে সঞ্চরণ করতে চায় , অহং বিষয়ের মধ্যে আসক্ত হতে থাকে।" (আত্মার প্রকাশ, শান্তিনিকেতন) 


ছান্দোগ্য উপনিষদে আত্মা ও ব্রহ্ম নিরূপণমূলক উক্তি রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা লব্ধ সমর্থন পেয়েছে - " যিনি সর্বকর্মা , সর্বকাম, সর্বগন্ধ , সর্বরস, যিনি এই সখল পরিব্যাপ্ত করিয়া আছেন, যিনি বাকরহিত উদাসীন---- তিনিই আমার আত্মা, তিনিই আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে--- এই-ই ব্রহ্ম।" বিশ্বপ্রবাহ এক এবং অখণ্ড। এককে জানাই মানুষের লক্ষ্য। এককে জানলেই সমস্ত কিছুই জানা যায়। সব কিছুই করায়ত্ত হয়। সেখানেই মানুষের অমৃতত্ব অমরত্ব। বিশ্বপ্রবাহ একটি অনাদি অনন্ত মহাসঙ্গীত----

              জগৎ জুড়ে উদার সুরে

                          আনন্দগান বাজে,

              সে গান কবে গভীর রবে

                          বাজবে হিয়ামাঝে।(১৫)


      তুমি   কেমন করে গান করো যে, গুণী

                অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি।

                    সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে

                    সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে

                    পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে

                         বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।(২২)


                 

              বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি

                          সে কি সহজ গান।

              সেই সুরেতে জাগব আমি,

                           দাও মোরে সেই কান।

                       ভুলব না আর সহজেতে

                       সেই প্রাণসমন উঠবে মেতে

                       মৃত্যুমাঝে  ঢাকা আছে 

                             যে অন্তহীন প্রাণ।


               সে ঝড় যেন সই আনন্দে

                            চিত্তবীণার তারে

               সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত

                            নাচাও যে ঝংকারে।

                        আরাম হতে ছিন্ন করে

                        সেই গভীরে লও গো মোরে

                        অশান্তির অন্তরে যেথায়

                                  শান্তি সুমহান।(৭৪)

রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্ম মোহ নয় , মোহ থেকে মুক্তি। নিজের গোষ্ঠীর ধর্মমতকেও তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করেননি। দেবালয়ের তথাকথিত পবিত্র আবেষ্টনে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে তাঁর অস্তিত্ব অনুসন্ধান অর্থহীন---

             অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে

             কাহাকে তুই খুঁজিস সংগোপনে

             নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে

                                দেবতা নেই ঘরে।

' বিসর্জন ' নাটকে জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের পর, রঘুপতি গোমতীর জলে ত্রিপুরেশ্বরী কালিকামূর্তি নিক্ষেপ করেছে। রানি গুণবতী স্বামী গোবিন্দমাণিক্যের নিষেধ অগ্রাহ্য করে, মাতৃ-আরাধনার জন্য মন্দিরে উপস্থিত হয়ে লক্ষ করেছে, দেবীমূর্তি নেই। বিস্ময় -কৌতূহলে তিনি রাজপুরোহিতকে প্রশ্ন করেছেন : দেবী কই?

রঘুপতি : দেবী নাই।

গুণবতী :                               ফিরাও দেবীরে

             গুরুদেব, এনে দাও তাঁরে, রোষশান্তি

             করিব তাঁহার। আনিয়াছি মা'র পূজা।

             রাজ্য পতি সব ছেড়ে পালিয়াছি শুধু 

             প্রতিজ্ঞা আমার। দয়া করো, দয়া করে

             দেবীরে ফিরায়ে আনো শুধু, আজি এই

             এক রাত্রি তরে। কোথা দেবী?

রঘুপতি :                                       কোথাও সে 

             নাই। ঊর্ধ্বে নাই, নিম্নে নাই, কোথাও সে

             ছিল না কখনও।

তাই--- কাজ কি আমার মন্দিরেতে আনাগোনায়

         পাতব আসন আপন মনের একটি কোণায়

                                             (গীতিমাল্য/৮১)

কল্পিত, আরোপিত কঠোর নিয়ম-অনুশাসনের নিগড়ে দেবতা সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। " এইজন্যেই মানুষকে সাম্প্রদায়িক খ্রিস্টানের হাত থেকে খ্রিস্টকে, সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবের হাত থেকে বিষ্ণুকে, সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মের হাত থেকে ব্রহ্মকে উদ্ধার করে নেবার জন্য বিশেষভাবে সাধনা করতে হয়। "( খ্রিস্ট / খ্রিস্টধর্ম)

                     


আপন সত্তার অসাড়তার নির্মোক উন্মোচনের জন্যই রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক-মানস বরণ করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল আন্তর-আনন্দের জগতে বিহার। একমাত্র নিজের পূর্ণ প্রকাশেই সেই আনন্দ পাওয়া যায়, তা-ও উপলব্ধি করেছিলেন। এবং " আনন্দের ভোজে বাহিরের চেয়ে অন্তরের অনুষ্ঠানটাই গুরুতর " মনে করেছিলেন। তাই অন্তরতরর কাছে অন্তর বিকশিত করার, জাগ্রত-উদ্যত-নির্ভয়-মঙ্গল করার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন।


রবীন্দ্রনাথের ধর্ম - কর্ম একই পেটিকায় গ্রন্থিবদ্ধ  : " আমার ধর্ম হইল একজন কবির ধর্ম---- এ ধর্ম কোনও নিষ্ঠাবান সদাচারী লোকের ধর্মও নয়, কোনও ধর্মতত্ত্ববিশারদের ধর্মও নয়। আমার গানগুলির প্রেরণা যে অদৃশ্য এবং চিহ্নহীন পথে আমার কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে সেই পথেই আমি আমার ধর্মের সকল স্পর্শ লাভ করিয়াছি। আমার কবিজীবন যে রহস্যময় ধারায় গড়িয়া উঠিয়াছে, আমার ধর্মজীবনও ঠিক সেই একধারাকেই অনুসরণ করিয়াছে। যেমন করিয়াই হোক, তাহারা পরস্পরে পরস্পরের সহিত যেন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়া আছে........"

                                       হিবার্ট লেকচারস্সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় , রবীন্দ্রনাথের কবিত্বের মধ্যেই অধ্যাত্মসুধার নিরন্তর ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়েছে।

          একি কৌতুক নিত্যনূতন

                    ওগো কৌতুকময়ী !

         আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে

                    বলিতে দিতেছ কই ?

         অন্তরমাঝে বসি অহরহ 

         মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,

         মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ

                    মিশায়ে আপন সুরে।

         কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই

         তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,

         সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই----

                    কোথা ভেসে যাই দূরে !


কবি ঋষিতুল্য, মেধাবী, ক্রান্তদর্শী, মনীষী,প্রাজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্বুদ সুর একমাত্র কবির কানেই অনুরণিত হয়। কবিত্বশক্তি তূরীয়, দিব্য, অতিলৌকিক, ঐশ্বরিক, অনিঃশেষ, ইহজন্মীয় ও জন্মান্তরীয়। কবির সৃষ্টি তাই হৃদ্য, সুন্দর, রমণীয়, বিচিত্র, মনোরম, অত্যাশ্চর্য ও অদ্ভুত বিস্ময়কর। " মানুষ বুদ্ধির পরিচয় দেয় জ্ঞানের বিষয়ে , যোগ্যতার পরিচয় দেয় কৃতিত্বে, আপনার পরিচয় দেয় সৃষ্টিতে।" সৃষ্টি করে আনন্দে। সীমার দ্বারা অসীমকে পাওয়াই আনন্দ। " আকাশ খানিকদূর পর্যন্ত আকাশ, ততটা সে সাদা। তারপরে সে অব্যক্ত, সেইখান থেকে হে নীল। " সেই নীলিমাতেই আনন্দের বিস্তার। রবীন্দ্রনাথের চিত্তই সেই আকাশ। যে আকাশ পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের ইচ্ছা দিয়ে পূর্ণ। পূর্ণের উৎসবে দেওয়া আর পাওয়া--- একই কথা। " ঝরনার একপ্রান্তে কেবলই পাওয়া, অভ্রভেদী শিখরের দিক থেকে--- কেবলই পাওয়া। আর এক প্রান্তে কেবলই দেওয়া ---- অতলস্পর্শী সমুদ্রের দিকে।"এই অন্তহীন পাওয়া আর দেওয়ার নিরবচ্ছিন্ন আবর্তনেই আনন্দের উৎসার  :

           এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়

           যে প্রাণ তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়,

           সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্ব দিগবিজয়ে,

           সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দে-তালে-লয়ে

            নাচিছে ভুবনে ; সেই প্রাণ চুপেচুপে 

            বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে

            লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরষে,

            বিকাশে পল্লবে পুষ্পে---- বরষে বরষে

            বিশ্বব্যাপী জন্মমৃত্যু সমুদ্রদোলায়

            দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ারভাঁটায়।

কবি ও গুরু রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই মহাকালের বাণী ও মহাবিশ্বের রূপ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। বেদ ও উপনিষদের সূক্ত ও সংগীত এই ঋষিকণ্ঠকে আধার করে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। কবীর-নানক-মীরাবাঈ-চৈতন্যের ভক্তিসাধনার সহজ উপাচার' গীতাঞ্জলি 'র ভাবতন্ময়তায় সংগতি লাভ করেছে। বিশ্ববিদ্যাতীর্থ প্রাঙ্গনে বিশ্বমানবের মহামিলন রচিত হয়েছে। ভগবান ও বিশ্ব একীভূত হয়ে মানুষের ধর্ম হয়ে উঠেছে---

             বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো

             সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।

                  নয়কো বনে নয় বিজনে

                  নয়কো আমার আপন মনে

             সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়,

                      সেথায় আপন আমারো।