Monday, October 26, 2020

 

কবিতায় কল্পনা, কবিতার মিথ্যে
কুমারেশ তেওয়ারী


‘কবিতা কল্পনালতা’ এই কথাটি তো সুপ্রাচীন। এবং এই কথাটির ভেতরেই ধরা আছে কবিতার আসল জিয়নকাঠিটি। মানব মনের চুড়ান্ত কল্পনার ফসলই তো কবিতা। কবিতার ক্ষেত্রে এই কল্পনার রূপটি এক লতানে গাছের মতো। আকর্ষ বাড়িয়ে বাড়িয়ে যা চতুর্দিকে তার লতা বিস্তার করে শান্ত আধিপত্য গড়ে তোলে। যে আধিপত্যে কোনো ক্ষতি নেই বরঞ্চ হিতৈষীর ভূমিকায় গ্রহণ করে এই আধিপত্য।  শত শত বৎসর ধরে এই কল্পনার ডানায় ভর করেই যত কবিতা। তা সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজকের নবীনতম কবিটির সদ্য লেখা কবিতাটি ওই কল্পনারই ফসল। 
“কা আ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” লুই পা-র এই কবিতায় কবি, শরীর কে এক বৃক্ষ কল্পনা করে সেই বৃক্ষরূপ শরীরের পাঁচটি ডালের কথা ভাবলেন। যদিও এখানে এক চুড়ান্ত দর্শন প্রতিফলিত হয়ে উঠেছে পঙক্তিটির মুকুর শরীরে। আবার একই সঙ্গে শাশ্বত আধ্যাত্মবাদ এবং বিজ্ঞান যেন মিলেমিশে একাকার। সত্যিই তো মানব শরীর এক বৃক্ষের মতো। যার পাঁচটি ডাল হলো ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও বোম। তাহলে কী দেখা গেল? দেখা গেল কবির কল্পনা মুহূর্তে এক শাশ্বত সত্যের পূণর্জন্ম দিল কবিতায়।
 
আবার বিনয় মজুমদারের একটি কবিতার এই পঙক্তিদ্বয় দেখুন,“ তবু কি আশ্চর্য, দ্যাখ, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে/তার উড়ে যাওয়া ইষৎ সঙ্গীতময় হয়”। এখানেও সেই কল্পনার আশ্রিত কবি। যে কল্পনায় মশার উড়ে যাওয়ার মধ্যেও কবি সঙ্গীতময়তার সন্ধান পেলেন। অর্থাৎ কবির কল্পনা জন্ম দিল দুটি প্রবাদপ্রতিম পঙক্তির। এখানেই কবি ও কল্পনার যুগলবন্দি। একজন সাধারণ মানুষের চোখ যেখানে শুধুমাত্র একটি মশার উড়ে যাওয়াকেই দেখতে পেত তার সাধারণ চোখে, সেখানে কবির চোখ মুহূর্তে কল্পনালতা হয়ে উঠে মশার উড়ে যাওয়ার মধ্যে আবিষ্কার করলো সঙ্গীতময়তার। এখন প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র বাস্তব দৃষ্টিতে এই দৃশ্যটি যদি কবি দেখতেন তাহলে কি জন্ম হতো এমন দুটি পঙক্তির? অবশ্যই না। শুধুমাত্র বাস্তব দৃষ্টিতে রচিত একটি কবিতা অনেকটা তেমন ইক্ষু দণ্ডের মতো, যা দেখতে সুদর্শন হলেও ভেতরমহল শুষ্ক কাঠের মতো রসহীন। যা সামান্য এক পিঁপড়েকেও তার নিকটে আকর্ষণ করতে পারে না। সুতরাং কী দেখা যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, চুড়ান্ত কল্পনার আশ্রয় না নিলে এক সার্থক কবিতার জন্ম দেওয়া কখনই সম্ভব নয়। বিশেষ করে কবিতায় মূর্ত ও বিমূর্তের খেলায় এই কল্পনার এক বিশেষ ভূমিকা আছে। ধরা যাক এমন একটি পঙক্তি—“ গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই/ গাছের ভেতর থেকে নৌকাটি গড়িয়ে নেমে/বললো, চলো নদীর দিকে যাই”। কল্পনাশক্তি না থাকলে কোনো কবি জন্ম দিতে পারবেন এমন পঙক্তির? কক্ষনো না কারণ তিনি তো শুধু গাছকেই দেখবেন সেক্ষেত্রে, গাছের ভেতর থাকা নৌকাটির অস্তিত্ব টের পাবেন কীভাবে? 

“এ আকাশ ভাঙে মাঝে মাঝে/ও আকাশ 
মেঘে আত্মহারা/সে আকাশে নৌকা খোলা আছে/মা আমি আকাশভরা ভরা”
এই কবিতাটি দেখুন, মিথ্যের বেসাতি করেছেন কবি। আকাশে কি নৌকা খেলা করে! নৌকা তো জলে ভাসে। আবার কবি কবিতার কথকের মুখ দিয়ে সেই মিথ্যেরই কথা লিখছেন। “মা আমি আকাশভরা তারা”। কারো পক্ষেই কি আকাশের তারা হওয়া সম্ভব? এই হচ্ছে কবির কল্পনাপ্রসূত মিথ্যে, যা মুহূর্ত কবিতাটিকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে” ,জীবনানন্দের “বনলতা সেন” কবিতার এই পঙক্তিটির কথা ভাবুন। এ কি কবির চুড়ান্ত মিথ্যের ফসল নয়? অবশ্যই কারণ হাজার বছর কোনো মানুষ তো আর বেঁচে থাকতে পারেনা। অথচ এই মিথ্যেই জন্ম দিল এমন এক কবিতার যা বিশ্ববন্দিত কবিতা হয়ে থাকলো এতদিন। কত আলোচনা কত অনুসন্ধিৎসা এই কবিতাটি নিয়ে। অর্থাৎ মিথ্যের আশ্রয়ে গিয়ে (যে মিথ্যে আবার কবির কল্পনার ফসল) কবিতাটি অমরত্ব প্রাপ্ত হলো।  সুতরাং কল্পনার আশ্রয়ে গিয়েই কবি প্রসব করেন অজস্র মিথ্যার। টুকরো টুকরো মিথ্যা নিয়েই গড়ে ওঠে একটি কবিতা শরীর। তবে এই মিথ্যেই তো কবিতার অলংকার। এই মিথ্যে যত বেশি করে থাকবে কবিতায়, কবিতাও হয়ে উঠবে তত মোহময়ী এবং মিস্টিক। একটি কবিতার শরীর থেকে এই অলংকাররূপী মিথ্যেগুলো খুলে নিলে কবিতাটি হয়ে উঠবে শুধু কিছু শব্দের সমাহার সম্পন্ন এক অসাড় শরীর। যা পাঠকের মনে সামান্যতম অনুরণনেরও জন্ম দিতে পারবে না কখনও। তাহলে কী দেখা গেল? কবি মাত্রই মিথ্যুক এবং কবিতা মানের মিথ্যের ভাণ্ডার। আবার এই মিথ্যে না থাকলে কোনো কবিতা কবিতায় নয়। এই যে দুরকম বিপরীতধর্মী কথা বলছি মনে হতেই পারে, এ তো দ্বিচারিতা! হ্যাঁ, দ্বিচারিতায় তো কারণ এই দ্বিচারিতা না করলে কীভাবে বলতে পারবো, এই মিথ্যের মধ্যেই কবিতার নীল ভ্রমর। এই নীল ভ্রমরটি যেন একাধারে মৃত্যুদূত আবার একইসঙ্গে অনন্ত জীবন দূতের ভূমিকায়। কবিতায় মিথ্যে না থাকলে এই নীল ভ্রমর বিষাক্ত দংশন দেয় কবিতাকে আর কবিতাটি মারা যায়। অন্যদিকে আবার মিথ্যে থাকলে নীল ভ্রমরটি জেগে উঠে দংশন করে কবিতাকে আর কবিতাটিও অনন্ত আয়ু প্রাপ্ত হয়ে বের হয় বিশ্বভ্রমণে। “এখানে এমন একজন শায়িত রয়েছে যার নাম লেখা আছে জলের অক্ষরে“। কবি কীটসের সমাধি ফলকে লিখে রাখা  কল্পনা ও মিথ্যের মেলবন্ধনে রচিত কবিতার এই পঙক্তিটি কি বিশ্বভ্রমণের ফসল রূপেই পৌঁছইনি আমাদের কাছে এবং ওই যে ‘জলের অক্ষরে’ এই মিথ্যেই ( মিথ্যে কারণ জলের কোনো অক্ষর হয়না এবং জলের মধ্যে লেখাও যায়না। আবার জল কোনো কিছু লেখা হলে তার স্থায়িত্বও ক্ষণকালের) জন্যই এই পঙক্তিটির আবেদন এত তীব্র হয়ে ধরা দিল আমাদের কাছে।  ইংরেজীতে একটি শব্দবন্ধ আছে, “হোয়াইট লাই”। এমন মিথ্যে কখনও করো ক্ষতি তো করেই না উলটে মঙ্গলের কজই করে। এই মিথ্যেই কবিতার পাঠকের চোখের দরজা খুলে দেয় এবং পাঠকও তখন আবিষ্কার করেন ওই মিথ্যের ভেতরে সুপ্ত ঘুমে থাকা কোনো চরম সত্যকে।   এই মিথ্যে না থাকলে কবি কীভাবে জন্ম দেবেন হিরণ্ময় কবিতার এবং পাঠকই বা কীভাবে মিথ্যের জারকরসে জারিত হতে হতে মিলেমিশে যাবেন কবিতার অণু পরামাণুতে। সুতরাং এইকল্পনা ও মিথ্যে যা কবিতার প্রাণভোমরা অথবা প্রাণভোমরী, আরও শক্তিশালী হোক আর কবিও এইসব মিথ্যেকেই আশ্রয় করে রচনা করুন কোনো মহৎ কাব্যের। জয় হোক কবিতাকল্পনালতার এবং হিরণ্ময় মিথ্যের যুগলবন্দিতে গাওয়া অনন্ত সঞ্চারির।

No comments:

Post a Comment