Wednesday, October 7, 2020

 মেডেল

সত্যম ভট্টাচার্য



ধুর ব্যাটা,এই সব মাল নিয়ে আমি কি করবো?


কথাটা শোনার পর খানিকক্ষণ স্থাণুর মতো বসে থাকলো মাইকেল।মাইকেল ওঁরাও যার পুরো নাম।একবার ওর ইচ্ছে হল যে মঙ্গলবাড়ি হাটে বসা এই বানিয়ার পেছনে একটা লাথি কষিয়ে বলে যে কার জিনিস নিয়ে তুই কথা বলছিস জানিস?একদিন তার নামে সম্মানে মাথা নোয়াত এই জায়গার মানুষ।আর আজকে তার জিনিসকেই মাল বলছে এই দুই পয়সার বানিয়া!


কিন্তু নিজের উঠে আসা প্রচন্ড রাগটাকে কোনক্রমে গলার কাছে এখন আটকাতে শিখে নিয়েছে মাইকেল।তাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে ভাবলো এবারে  কি করবে?যে জিনিসটাকে জন্ম হওয়া ইস্তক দেখে এসেছে বাড়ির সবাই প্রণাম করছে আজকে সেই জিনিসটাই নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে তাকে।যতদিন দাদু বেঁচে ছিলো মনে পড়ে বছরের একটা নির্দিস্ট দিনে তাকে নিয়ে বাগানের ফ্যাক্টরীর সামনে বসানো হতো।আর নিয়ে যাওয়াও তো যেমন তেমন ছিলো না।গোটা বাগানের লোক লাইনে তাদের ছোট্ট বাড়িটার সামনে জমা হতে থাকতো সেদিন সকাল থেকেই।তারপর নটা দশটা  নাগাদ মুখিয়া আসতো।ধামসা মাদল বাজতে থাকতো।দাদুও সেদিন সকাল থেকেই স্নানটান করে রেডি।

তারপর শুরু হতো জলুস।বাজনা বাজিয়ে মিছিল করে দাদুকে নিয়ে যেতো সবাই মিলে।কোনবার বাগানের ম্যানেজার,কোনবার অন্য কেউ দাদুর গলায় মেডেল দুটো পরিয়ে দিতো।ফুল দিতো।ভাষণ দিতো।আর রাতে মারা হতো গোটা কয়েক শুয়োর।তা দিয়ে ভোজ খেতো সারা বাগানের লোক।সন্ধ্যে থেকেই সেদিন স্কুলের মাঠে মেলা বসে যেতো।

সেসব দিনের কথা মনে পড়লে কান্না পায় মাইকেলের।আজ সকালে মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে মেডেল দুটো নিয়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে প্রথমে দৌড়তে শুরু করেছিলো সে।কিন্তু কতটুকুই বা দৌড়তে পারবে।কাল সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি।আর দৌড়বেই বা কেন?বাবা তো হাঁটতে চলতেই পারে না।আর মা যখন ঘরে ফিরে দেখবে যে মাইকেল নেই আর মেডেল দুটোও নেই ততক্ষণে সে চালসা পৌছে যাবে পায়ে হেঁটেই।

কি করবো বল?তুই তো একদিন বাগানের গেটে বলেছিলি যে মজদুরের আগে পেট,তারপর সব–গোলাইতে দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপাশে ঘেরা জায়গাটায় দাদুর বুক অব্দি নোংরা মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো মাইকেল।এখন দুপুর।মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ।এবছরও মূর্তিটা পরিষ্কার করা হয়নি।পনেরো কিলোমিটার হেঁটে এসে শরীরটা খুব দুর্বল লাগছিলো প্রথমে ওর।খানিক বসেছিলো তাই।কিন্তু আর তো দেরী করা যায় না।অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মঙ্গলবাড়ির হাট জমে যাবে।সেখানে স্যাকরার দোকানে গিয়ে এ দুটো বেঁচে দিলেই বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে।আঃ,তারপর তো কতদিন পর চাল।অন্ততঃ এক বস্তা তো কিনতে পারবেই,ভেবেছিলো মাইকেল।

রাস্তার পাশ দিয়ে হাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওর মনে পড়ছিলো দাদু যেদিন মারা গিয়েছিলো সেদিন কত লোক এসেছিলো বাড়িতে।কত কথা বলেছিলো।কত কিছু দেবে বলেছিলো।কিন্তু কয়েকমাস আগে যখন বাগান বন্ধ হয়ে গেলো,শহরে গিয়ে তারা এক বাবুর সাথে দেখা করে দাদুর নাম বলেছিলো।বলেছিলো ঐ বাগান থেকে আসছে।শালা চিনতে অব্দি পারেনি।তারপর থেকে তো কত নাটক।আজ এ আসে,কাল সে আসে।কিন্তু বাগান আর খোলে না।বোনটা চলে গেলো কোথায়।আর ফিরলো না।বাবাও সেই যে বিছানা নিলো।

তারপর একদিন বাগানে সবাই মিলে ঠিক করলো যে নিজেরাই পাতা তুলে বিক্রী করে বাগান চালাবে।প্রথম প্রথম ভালোই চলছিলো।নাম ছিলো তাদের বাগানের চায়ের।কিন্তু এখন ভেজালের যুগ।কে আর এতদূর আসবে তাদের বাগানের পাতা নিতে।তাই আস্তে আস্তে সেটাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো।তবু মায়েরা যায় প্রতিদিন সকালে দল বেঁধে।ঐ সবুজ বাগানের পাতার মধ্যে,তার গন্ধের মধ্যে না গিয়ে দাঁড়ালে বলে ওদের ভালো লাগে না।দাদু মারা যাবার পর মা একখানা দাদুর ফটো বাঁধিয়ে নিয়ে এসে তাতে মেডেলদুটো পরিয়ে দিয়ে বলেছিলো-এ আমাদের পরিবারের সম্পদ বুঝলি।একে প্রতিদিন প্রণাম করবি।

দাদুকে নাকি দেশ স্বাধীন হবার পর ঐ মেডেলদুটো দেওয়া হয়েছিলো।ওর একটা না কি রুপোর আর একটা কিসের মাইকেল জানে না।তবে রুপোরটা বেঁচেই ও ভেবেছিলো রেশনের চোরাই চালের একটা প্যাকেট নিয়ে যেতে পারবে আজ বাড়ির জন্য।কিন্তু এ স্যাকরা তো নিতেই চায় না।আবার বলে কি না এ চুরির জিনিসও হতে পারে।

পকেটে শুধু দশটা টাকাই পড়ে আছে।মাইকেল ভেবেছিলো সব কাজ হয়ে গেলে এক গ্লাস খাবে।কিন্তু এখন কি আর কাজটাই করতে পারবে ও?শালা বানিয়া যেভাবে বলছে। মনে তো হয় একই কথা সুদের মহাজনও বলবে।আর তারপর তো একমাত্র বাকি থাকলো হাটের পাশের কাবারীখানা।কিন্তু সেখানে তো ভাঙাচোরা বাতিল জিনিস বিক্রী হয়। এই জিনিসের মূল্য তারা দেবে না।

এসব মাথায় নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হাটের পেছন দিকটায় চলে এসেছিলো মাইকেল।এখন সূর্য অনেকটাই ঢলে পড়েছে।খানিক আগেও বিকেলের হলুদ আলো লম্বা গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আসছিলো ।ওদিকে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে একটা পায়ে চলা রাস্তা।তার ওপাশে চা বাগান।তার ওপরেও হলুদ আলো পড়ে সবুজ ঝলক দিয়েছিলো একসময়।মাইকেলের মনে হলো তার দাদু যেন এই বাগান জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লম্বা গাছপালাগুলো ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে উঠছেন।বলছেন-আমাদের ক্ষিদে নেই রে,ক্ষিদে পেতে নেই,ক্ষিদে থাকতে নেই...                   

No comments:

Post a Comment