Wednesday, October 7, 2020

 ক্ষুধা এক তীব্র অভিজ্ঞতা 

মানিক সাহা





ক্ষুধার চিত্র

The vulture and the little child - ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে যাদের সামান্য খোঁজখবর আছে, তারা এই নামটির সঙ্গে মোটেই অপরিচিত নয়। বিখ্যাত চিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টার এই ছবিটি তোলেন ১৯৯৩ সালে। সুদানে তখন ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। অগুনতি  মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে। চিত্র সাংবাদিক হয়ে ডেভিড কার্টার সুদানে গেছেন এবং তার পোর্টেবল ক্যামেরায় ছবি তুলে চলেছেন। সারাদিন মৃত্যু আর কংকালসার মানুষ দেখে দেখে ক্লান্ত তিনি। ফেরার পথে চোখে পড়ল সেই ভয়ানক দৃশ্যঃ না-খেতে পেয়ে একটি ছোট্ট শিশু, তার বয়স অনুমান করাও কঠিন, জীবন্ত কংকালে পরিণত হয়েছে। বল শক্তিহীন দেহটাকে নিয়ে সে আর চলতে পারছে না। পথেই পড়ে আছে। কার্টার যখন ছবি তুলবে বলে যে মুহূর্তে ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছে, ঠিক তখনই শিশুটির পেছনে সামান্য দূরে এসে বসলো এক মোটাসোটা শকুন। শকুনের নজর শিশুটির দিকে। কার্টার ছবিটি তুলে নিল। সামনে সেই অনাহারে শক্তিহীন অস্থিসার শিশু আর পেছনে শিকারী পাখিটি।

ক্ষুধার এ এক মর্মান্তিক চিত্র। এমনই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ১৯৪৩ সালে কলকাতার রাস্তায়। সে বছর তীব্র খাদ্য সংকটের কারণে না খেতে পেয়ে কেবল বাংলাতেই মারা গিয়েছিল প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ প্রান্তিক মানুষ। যদিও এই খাদ্য সংকট প্রকৃত অর্থে সংকট না কি পরিকল্পিত নরহত্যা সে বিষয়ে গবেষকরা এক মত নয়। যাই হোক,  খিদের কোন ধর্ম হয় না। সেই কারণে এই মৃত্যু তালিকায় বাংলার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে দরিদ্র কৃষক, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা শ্রমিক, দিন মজুর এমনকি গ্রামের ছোট ব্যবসায়ী -সকলেই ছিল। এই অনাহার ও মৃত্যু 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' বা 'তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ' নামে পরিচিত। এর আগে এমন বৃহৎ আকারের মন্বন্তর ঘটেছিল ১১৭৬ এ, যা ছিল 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' । এই সময় বাংলা বিহার মিলিয়ে প্রায় এক কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। 


অন্নে হিমানি সর্বানি ভূতানি বিষ্টানি

ঋকবেদের গল্পে আছে ব্রাহ্মণ বামদেব ঋষি বলছেন ‘অভাবের জন্য আমি কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছি, দেবতাদের মধ্যে কোন সাহায্যকারী পাইনি, (নিজের) স্ত্রীকে অপমানিত হতে দেখেছি, পরে এক শ্যেন আমার জন্য মধু আহরণ করে।’ – লক্ষ্যনীয় এই শাস্ত্রাংশটি ঋকবেদের প্রাচীনতম অংশ ঋষিমণ্ডলগুলির ( দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল ) অন্তর্গত। অর্থাৎ এখানে বামদেবের যে ক্ষুধার তাড়না, তাতে চণ্ডালের আহার করা বস্তু কুকুরের মাংসও তিনি জোগাড় করতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে চণ্ডালও যা অখাদ্য বলে ফেলে দেয়, সেই কুকুরের নাড়িভুঁড়ি তিনি রেঁধে খাচ্ছেন। এটি প্রাচীনতম যুগেরই একটি সমাজচিত্র। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহ ২ গ্রন্থে উপরে বর্ণিত অংশ উল্লেখ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, " বামদেবের দুঃসহ খিদের যন্ত্রণাতে দেবতা বিমুখ, মানুষও। কেউ ডেকে খাওয়ায়নি তাঁকে। এ অবস্থার পেছনে খাদ্যাভাবের ত্রাসও আছে, অর্থাৎ মানুষ হয়তো ইচ্ছে থাকলেও সাহস পায়নি তার খাদ্য ভাগ করে খেতে - যদি তারও ওই অবস্থা হয়? সমাজে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য থাকলে এ-অবস্থা হত না। "


ঋকবেদের দশমমণ্ডলে এক ভক্ত বলেছেন ‘গাভী দিয়ে উত্তীর্ণ হবো দারিদ্রজনিত কষ্ট, সকল ক্ষুধা অতিক্রম করবো যব দিয়ে।’ অর্থাৎ ক্ষুধা ও দারিদ্রতা বেদের যুগে পরিলক্ষিত হয়েছে। “যেন খেতে পাই” এই প্রার্থনা ব্যপ্ত হয়েছে সারা বৈদিক সাহিত্য জুড়ে। বৃহদারন্যক উপনিষদে বলা হয়েছে “ অন্নে হিমানি সর্বানি ভূতানি বিষ্টানি” অর্থাৎ অন্নেই সমস্ত প্রাণ নিহিত আছে। মানুষ অন্ন তথা  খাদ্যের সংস্থানে সদা তৎপর। খাদ্য দিয়েই খিদের সাথে লড়াই কর যায়। অথচ 'এই যে সরাসরি খাদ্য দিয়ে ক্ষুধার মোকাবিলা করা, তা বেদের যুগেও হয়নি, আজও হয়নি'।    


ফ্যান দাও

বেদ উপনিষদের এই মর্মধ্বনি একটু অন্যভাবে হলেও ধ্বনিত হয়েছে  তসলিমা নাসরিন সম্পাদিত 'ফ্যান দাও' কাব্য সংকলনে।  কারণ বইটির বিষয় বস্তু ভুখা অস্থিসারসর্বস্ব মানুষের  ‘ফ্যান দাও’ আর্তচিৎকারের ছবি। বইটির সব কবিতাই বাংলা ১৩৫০ অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি নিয়ে সাজানো। বইটির নিবেদনের এক জায়গায় তসলিমা নাসরিন ইতিহাসের অভব্যতার রাশ টেনে বলেছেন, ‘উনিশশ তেতাল্লিশ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই ভাত চাই, ভাত না হোক ফ্যান চাই, এই ফ্যানও না পেয়ে জুন-জুলাই থেকে মানুষ মরতে শুরু করল, পথে ফুটপাতে হাটে বাজারে ঘাটে মানুষ মরছে। গোটা বাংলায় তখন ভাতের জন্য চিৎকার, আকাশে শকুনের ভিড়, লাশ-পচা দুর্গন্ধে ভেসে উঠছে বাতাস। বাজারে চাল নেই। মুন্সীগঞ্জ, নাটোর, কলকাতা, পটুয়াখালীতে মানুষ মরছে। আগস্টে খবর বেরোল বাংলায় ঘোর মন্বন্তর।’ 

আবার অমর্ত্য সেন হিসাব করে দেখিয়েছেন গোটা দুর্ভিক্ষে মানুষ মরেছে তিরিশ লাখ। তখন খবরের কাগজে বেরোত বাবা তার মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে বারো আনা কী এক টাকায়, স্বামী তার স্ত্রী কন্যাকে পাঁচ দশ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। পেটে ভাত নেই, তার ওপর জাপানি বোমা, বনে আগুন লাগলে বুনো জন্তু যেমন পালায়, তেমন করে মানুষ পালিয়েছে একবার গ্রাম থেকে শহরে, আরেকবার শহর থেকে গ্রামে। 

অনাহারের ষড়যন্ত্র

 জাপান প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার দখল করে নেওয়ার পর তেতাল্লিশের মন্বন্তর শুরু হয়। ওই সময় বার্মা ছিল চাল আমদানির বড় উৎস। ভারতবর্ষের তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক সেনা ও যুদ্ধে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্য মজুদ করতে শুরু করলে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

মজুদ করার কারণে হু হু করে বেড়ে যায় চালের দাম। একই সঙ্গে বাজারে তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। জাপান ভারত দখল করলে খাদ্য যাতে শত্রুর হাতে না পৌঁছায়, এ জন্য ব্রিটিশ সরকার আগাম কিছু ব্যবস্থা নেয়। বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নৌকা ও গরুর গাড়ি হয় বাজেয়াপ্ত—নয় তো ধ্বংস করে ফেলে তারা। এতে চাল বা খাদ্য বিতরণ-ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে।

বাঙালির প্রধান খাবার চালের আকাল দেখা দেওয়ায় ভাতের জন্য সারা বাংলায় হাহাকার পড়ে যায়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষ। পথে-প্রান্তরে লুটিয়ে পড়তে থাকেন না খাওয়া মানুষ। এখানে-ওখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় হাড্ডিসার লাশ। বিভিন্ন গ্রাম থেকে তখন বুভুক্ষু হাজার হাজার মানুষ একমুঠো অন্নের আশায় স্রোতের মতো চলে যাচ্ছেন কলকাতার দিকে। দেখা গেছে, এসব অভাগা দলে দলে পথের ওপর পড়ে ধুঁকছেন আর আবর্জনার পাশে উচ্ছিষ্টে ভাগ বসাতে পরস্পর লড়ছেন। একই সময় ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং তাদের তোষামুদে অবস্থাপন্ন ভারতীয় লোকজন বাড়িতে বসে ভূরিভোজ করছেন।

জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী এই দুর্ভিক্ষের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ খুঁজে পায়নি ভারতীয় ও মার্কিন গবেষকদের একটি দল। অর্থাৎ এই দুর্ভিক্ষের জন্য আবহাওয়া নয় বরং তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের অমানবিক নীতিই দায়ী ছিলো।


সংকটের পর

বাবার জন্ম চল্লিশের গোড়ার দিকে। ফলে তেতাল্লিশের অভিজ্ঞতা তাঁর মনে থাকার কথা নয়। তবে বাবার যখন কিশোর বয়স তখন খিদের জন্য তাঁকেও কষ্ট পেতে হয়েছিল। বাবার যখন ১৩-১৪ বছর বয়স, চালের দাম হঠাৎ খুব বেড়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের ক্রয়  ক্ষমতার বাইরে। ফলে অধিকাংশ মানুষ ভাত ছাড়া অন্য কিছু খেয়ে পেট ভরাতো। কখনো যব, কখনো খুদের জাই, কখনো কোন ধনী বাড়ির ভাতের ফ্যান এইসব। কোনদিন সৌভাগ্যবশত রুটি খাওয়ার সুযোগ হয়ে যেত। এক মহাজনের ঘরে বিশেষ কাজে গিয়ে ভাত দেখতে পেয়ে আশ্চর্য হয়েছিল। যদিও সেই মহাজনের গিন্নী যার হাতে সোনার বালা, গলায় সোনার মালা -    বাবাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাত খাওয়ার ইচ্ছা সেদিন পূর্ণ হয়নি। অনেকে কেবল কঁচু সেদ্ধ খেয়েই দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছিল। 

খিদে এমন তীব্র অনুভূতি যার জন্য মানুষ এমন কোন কাজ নেই যা করতে পারে না। তীব্রতার তারতম্যে মানুষ কখনো পশুতে পরিণত হয়ে যায় তার ঠিক নেই। সেরকমই ঘটেছিল কিছু গ্রাম।  যারা বেশ অর্থের অধিকারী তাদের বাড়িতে ডাকাতি করে খাদ্য ও অর্থ লুঠ করার ঘটনা অস্বাভাবিক ছিল না। এমনও হয়েছিল, যে-মানুষ দিনের বেলা শ্রমিকের কাজ করে গেছে, সে-ই হয়তো রাতে অনাহারী সঙ্গীদের নিয়ে এসে ধনীর বাড়ি লুঠ করে নিয়ে যেত। 

অন্নপূর্ণা জনভোজনালয়

ধীরে ধীরে দিন পালটে গেছে। মানুষের খাদ্য সংকট ও খিদের যন্ত্রণা প্রশমিত হয়েছে। যদিও চা-বাগান,  প্রান্তিক গ্রামাঞ্চল, কিছু বেনামী বস্তি, আদিবাসী পল্লী ইত্যাদি জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে অনাহারের সংবাদ আমাদের বিচলিত করেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দিয়েছে। 

করোনার প্রভাবে অভূতপূর্ব লকডাউন ও কর্মহীনতার কারণে কিছু সময়ের জন্য তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। কাজ হারানো পরিযায়ী মানুষ দলে দলে স্বভূমিতে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। কেউ পায়ে হেঁটে কেউ সাইকেলে করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে চেয়েছে। ফলে অনেকে পথেই লুটিয়ে পড়েছে। অনেকে ঘুমের অবশ করা তীব্রতায়  রেল লাইলে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে পাওয়া গেছে তাদের ছিন্ন ভিন্ন দেহ আর ছড়িয়ে থাকা না-খাওয়া রুটি। 

এসবের মধ্যেও সরকারি ও বেসরকারি  উদ্যোগ গ্রহণ করে  মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকার যেমন রেশনের মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী বন্টনের ব্যবস্থা করেছে, রান্না-করা খাবারের ব্যবস্থা করেছে তেমনি অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। হয়তো তাই এই তীব্র সংকটের সময়েও মানুষ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সাহস দেখাতে পারে।

 

অতঃপর 

তবু দুঃস্বপ্নের মতো জেগে থাকে সেই দৃশ্য যেখানে এক অবোধ শিশু রেল স্টেশনে অনাহার ও অসুস্থায় মৃত মায়ের আঁচল টেনে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে। এই মৃত্যুর দায় কে নেবে? এখানে এসে মিলে যায় তেতাল্লিশের কলকাতা,  যে কলকাতার দালানকোঠা ও পাকা বাড়ির পাশেই রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় অনাহারে মৃত প্রান্তিক মানুষ অস্থিসার দেহ আর পাঁচিল বা ছাদের উপর মৃতদেহের অপেক্ষায় থাকা শকুন আর কাক। কিংবা সুদানের ছোট্ট শিশুটি যার পেছনে অপেক্ষমান এক শকুন। 


আমাদের চারদিকে এখন শকুনের দেখা খুব একটা মেলে না। কিন্তু শকুনের মতোই কিছু অর্থলোভী ব্যবসায়ী, রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা করা অনেক মানুষকে দেখা যায় যারা ক্ষুধার্ত মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে দ্বিধা করে না৷ এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।  সরকার কঠোর অথচ জনদরদী ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এটাই কাম্য।


ঋণস্বীকারঃ ক্ষুধার্ত বাংলা - মধুময় পাল সম্পাদিত (দীপ প্রকাশন) 

নামকরণের জন্য  সুকুমারী ভট্টাচার্যের একটি বাক্যের অংশ ব্যবহার করা হয়েছে। 

No comments:

Post a Comment