Sunday, March 25, 2018

মুক্তগদ্য 


দহনবেলায়
শৌভিক রায়

এই টানের সময়ে আদাড়ে-বাদাড়ে ঘোরাঘুরি দিনভর। গাজনের দিন। ঢাক বাজে পাগলপারা। ক্ষ্যাপা চৈত্রের খা খা রোদে, শুকনো বাতাসে, শিমূলের তুলো ঝিম ধরা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে যায়। 

লাল শালুর ধুতি আর উড়নি পরণে ক্ষ্যাপা তার চ্যালাকে নিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলতে থাকে গাঁয়ের পর গাঁ। পথচলতি হঠাৎ বসে পড়া ধুলো ভরা পথে। লাল থলি থেকে অনায়াসেই বেরিয়ে আসে কল্কে। শুকনো শরীরে শুকনো নেশায় লাল হয়ে ওঠে চোখ অচিরেই চারদিকে ফুটে থাকা শিমূল, পলাশ আর মাদারের মতোই। হলুদ ছাতিমের গন্ধে টৈ টৈ নেশা ছড়িয়ে পড়ে যেন মনময়। নিজেকে মনে হয় রাজা-বাদশা। কেবল ঠোঁট চড়চড়, চড়চড় গলা। টাকরা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। তবু চলা নেশার ঘোরেই। হঠাৎ দেখা হয়ে যায় আলগোখরোর সাথে। বিরাট শরীরটা টেনে টেনে আলের এপার থেকে ওপারে যায় সে। গর্বিত গ্রীবা সামান্য হেলিয়ে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে চলে যায় সে নিজ পথে। অপূর্ব সহাবস্থান যেন! যাও তুমি তোমার মত, আমি চলি আমার পথে। 
কিন্তু কে না জানে সর্বনাশা এই চৈত্রে এই চলা যেন সত্যিই সর্বনাশের দিকে....যদিও সর্বনাশ হয়ে গেছে বহু আগেই।
জল নেই। কেবল ছোট ছোট পাহাড় থেকে নামা স্রোতা আর ঝর্ণাতে হালকা রেখা। শীতের সেই জমাট বরফ এখনো তিরতিরে জলের উৎস। অনায়াসে পেরিয়ে যায় পশুর দল।মাথা উঁচু করে থাকা বড় পাথরগুলোতে শ্যাওলার ছোপ বোধহয় এই জীবনে ছাড়বে না। পা রাখলে পিছলে যায়। ঠান্ডা জলে তবু গা ভেজাতে ভালো লাগে এই চৈত্রের রোদে।

 ক্ষ্যাপা সাধু জলে নামে তাই। আচমন করে। বিড়বিড় জপে মন্ত্র। এ যেন নদীকে বাঁধার কোন এক গুহ্য কথা। অবশেষে অবগাহন। অবগাহনে জেগে ওঠে শরীর। আরে ক্ষেপীকেও তো বাঁধতে হয় মন্ত্রে। তারপর অবগাহনে হতে হয় শুদ্ধ। কে না জানে নারী হল নদী। চিরবহতা। বাঁধা পড়ে না এমনি এমনি। বাঁধতে হয় জীবনের মন্ত্রে, ভালবাসার মন্ত্রে। তবেই না অবগাহনে সায় দেবে সে! আর অবগাহন মানেই তো সৃজন। অবগাহন ব্যতিত সৃজন কোথায়! সৃজন না হলে কে কার! কোথায় থাকবে পাগলপারা এই সে চলা, কোথায় থাকবে নিত্য কুটুম আর মন্ত্রশুদ্ধি। ক্ষ্যাপা সাধু নিজেই খলখল হাসে। বড় রসিক ওহে ওপরওয়ালা তুমি। দেহ দিলে, কাম দিলে, সৃজন দিলে। দিলে, তবে সবটা নয়, সুতো রেখে দিলে নিজের হাতে। যেদিন টান পড়বে সেই সুতোয় চারদিক ঠিক থাকবে ঠিকই, ঠিক থাকবে শরীরটাও, থাকবে না কেবল প্রাণবায়ু। ফুড়ুত উড়ে পালাবে সে। ফিক ফিক হেসে ক্ষ্যাপা তাই গান ধরে- 'কি এক অচিন পাখি পুষলাম আমি খাঁচায়...।'

কচি পাতা আসছে গাছগুলোতে। লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। ক'দিন পরেই নামবে বৃষ্টি। নববারিধারায় পুষ্ট হবে সবুজ পাতার দল।হালকা ধুলোর পরত তাই যায়নি এখনো। নিজের রঙ হারিয়ে ফেলা গাছগুলোতে কচি পাতার উঁকিঝুঁকি  অদ্ভুত রঙ এনেছে গাছে।কিছু গাছের ছাল উঠে গিয়ে নতুন ছালের আবরণ। সেরকম পুরু নয় এখনো, রোদ আর বাতাসের ছোঁওয়ায় এখনো কর্কশ হয়নি তেমন। বড় গাছের কোটরে উঁকি দেয় ছোট ছোট পাখির ছানা, উড়তে শেখেনি। ক'দিন পরই মা-পাখি শেখাবে ওড়া। তারপর ওড়াউড়ি সারাদিন, এ ডাল, সে ডাল। ঠিক তার মত। সেই যে কবে বাপ-মা মুখে অন্ন দিল, পুষ্ট করলো শরীর আর সে হয়ে গেল নিজস্বচারী! তারপর তো এই ডাল সেই ডাল ঠিক পক্ষীশাবকের মত। ক্রমে হৃষ্টপুষ্ট হলে নিজের মত দুনিয়াদারি। কে কার এই দুনিয়ায়! জন্মেই যখন হাত নেই কারো তখন কি আর কর্মে হাত থাকে! তবু কর্ম করতে হয়। কখনো ধরতে হয় ভেক। কখনো ছুটে ফিরতে হয় এক অমোঘ টানে।

উজ্জ্বল দিন। সূর্যের লম্বকিরণ শরীরের ভেতর চলে যায় যেন। শুষে নেয় সবকিছু। নাড়া দেয় অন্তরে। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া রক্ত টগবগ করে। ভাঙতে যায় সবকিছু। ভেঙে চুরমার করে গড়তে চায় আবার নতুন উদ্দ্যমে। ভাঙা যায় না। একজীবনে ভাঙা যায়না কিছুই।
প্রকৃতি ভাঙে, প্রকৃতি গড়ে।কচিপাতায় ভরিয়ে গা গাছেরাও ভাঙচুর করে নিজেদের। নদী ভাঙে নিজেকে আবার গড়তে নতুন করে।

মানুষ ভাঙে। 
ভাঙতেই থাকে। গড়তে পারেনা কিছুই আর। ভাঙা মনের মানুষ অর্থনীতির সোপান বেয়ে গড়তে পারে বিরাট সাম্রাজ্য। 
কিন্তু গড়তে পারে কি নিজের মনকে আবার?
উত্তর নেই। জানে না ক্ষ্যাপা। বোধহয় কেউই জানে না। সর্বনাশা চৈত্রও জানে না।

ক্ষ্যাপা তাই হেঁটেই চলে। চৈত্র দহনে এক তপ্ত বুক নিয়ে ক্ষ্যাপা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে.......

No comments:

Post a Comment