Sunday, March 25, 2018

কবিতা পাঠের নিভৃত জানালায় কবি স্বপন রায়

ব্লেড রানার
............................................
কথা কত কথা ইথারসমুদ্রে মেশে। তার হিসেব আলাদা।  আধুনিক বা উত্তরাধুনিক ইত্যাদি সময়ের মাপে কথাসমগ্র ধরা দেয়না।লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয়ের মতই এই মাপের কিছু লক্ষণ আছে,  রাম নেই।মানে পরম নেই,  সত্যও নেই। সময় একটা ধারণা মাত্র।তাতে কথা থাকে, কথায় কথায় ভাষা থাকে, ভাষা শব্দের রেফারেবল তাগিদগুলো পরিশীলিত করে। সচলে, অচলে,  ক্রিয়ায়,  মিথষ্ক্রিয়ায় ক’রে যায়। কবি স্বনির্বাচিত প্রকাশের খোঁজে নিজেই নিজের নিয়োগপত্র দেয়।ধরা দেখে,  সরা’ও দেখে। আপ্লুত হয়। হতাশ হয়। কিন্তু লেখে।

‘ব্লেড রানার’ তরুণ কবি শুভ আঢ্য’র কবিতার বই।শুভ’র কবিতাভাষা শারিরীক বিশ্লেষণপ্রসূত নয়,  নিউরোলিঙ্গুইস্টিক। মস্তিষ্কানুসারিই মূলত। প্রথম কবিতাতেই শুভ এমন এক ‘প্যানারোমিক’ আবহে চলে গেছে যেখানে ‘ন্যারেটিভ’ মুখ্য হয়ে উঠতে পারতো।একজন তরুন কবির কাছে যা লোভনীয়ও বটে। বিষেশত অনুষঙ্গ যখন দার্জিলিং!
‘সেই দার্জিলিং থেকে ছোট উচ্চতার শেরপারা
আপনার বৌ,  প্রেমিকা,  বোনের নিতম্ব স্পর্শ ক’রে তাদের
পর্বতাভিযানের স্বাদ দিচ্ছেন যখন দেখা যাচ্ছে,  কলকাতায় গামবুটের বিক্রির হার জানায় বর্ষা অসময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে
লেজ নাড়ছে প্রিয় কুক্কুরির মত,  ঘড়ির দিকে তাকালে জানা যাচ্ছে
সময়ের হিসেবে সেটা বিকেল 4.30 AM..’(সম্ভাবনাময় একটা দিন থেকে ডুবুরি যা দেখে)

কিছু অসম্পর্কিত তথ্য,  কিছু দেখা আর কবির মস্তিষ্কায়ন এই বড় কবিতাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে। শুভ দেখা আর অভিজ্ঞতাকে রহস্যের আবরণ দেয়নি বরং উন্মোচন দিয়েছে। ব্লেড রানার সিরিজের কবিতাংশে পেয়ে যাচ্ছি এই উন্মোচিত মস্তিকাঘাত।
১.‘দৌড়ের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে শরীরকে পিছনে নিয়ে আসা
আর ধনুকের মত বসা, এগুলো ছাড়া কিছুই নেই যে এখন
২.’ আমার ঘরে এখন আলো জ্বলছে, আসছে না ঘুম, আর পুরনো
ভিডিও স্লো মোশানে জাগিয়ে রাখছে আমার পা’
এ এক অনাবিষ্কৃত অনুভুতিমালা! শুভ ব্লেড রানারের যাবতীয় সীমাবদ্ধতাকে তার মেধান্তিক শব্দমালায় ধরতে চেয়েছে।  সেখানে ক্যাটালিস্টের কাজ করেছে আলেকজান্দ্রা(গ্রীক দেবী হেরা)। বীরের রক্ষক যিনি।  এক্ষেত্রে এক ধাবমান লক্ষ্যও বটে।তার সব দৌড়ের শেষে থাকে প্রাণস্বরূপা আলেকজান্দ্রাই, তার অসহায়তার সহায় হয়ে, তার নিরবিচ্ছিন্ন দৌড়ের একমাত্র বিছিন্নতা হয়ে।শুভ লিখেছে, ‘জমি থেকে পা তুলে নিয়েছি যখন, সেই জমিও হারাক/ জমিয়ে হারাক আমায় আলেকজান্দ্রা..’

শুভ’র দেখাগুলো দিব্য নয়, আকস্মিকও নয়।কোথায় যেন জমাট বেঁধে থাকা পাথরের বুকে স্রোতোন্ময় হতে থাকে ওর দেখা।কখনো বিষয়ে, কখনো বিষয়মুখে।স্বপ্ন ও মধ্যবর্তী পর্যায়-এ শুভ লিখছে এরকমই আপাতবিচ্ছিন্ন স্বপ্নবিরোধের বিলীয়মানতাঃ
১. ‘মেয়েটার বুক থেকে আমি উপযুক্ত নোনতা স্বাদের জন্য
অপেক্ষা করি...’
২. ‘মেয়েটা চিনবে নতুন শহরের মানচিত্র/তার প্রথম পাতায় মর্গ,পোস্টমর্টেম আর মোটিভের জাল’
এই কবিতাটিও বড়।ব্যবচ্ছেদি।বিনির্মিত শারিরীকতার এক একটি শলাকাঘাত মূল্যে, বোধে, চেতনায়।

‘চিনা ব্যারাকের দোকান’ সিরিজটিতে শুভ ডাউন টু আর্থ অনেকটাই। তার জটিল বিন্যাস আর সেরিব্রাল কিন্তু প্রচল উচ্চারণ এই সিরিজে কিছুটা আলাদা। পরিপ্রেক্ষিতটাই আলাদা যে। আবার  ‘পাভলভের সুস্থতা ও অসুস্থতাজনিত কথোপকথন’কে কবি শুভ মানসিক রিফ্লেক্সের আধারে গেঁথেছে। গঠনে কথা আর প্রতিসরিত ভাবনার আসা যাওয়া। খুবই চঞ্চল। মন যেমন হয় আরকি!
১. ‘ আর এদিকের দেয়াল সেঁকা রুটির দিকে তাকিয়ে থাকে’
২. ‘একটা নতুন দেয়ালে লিখে রেখেছি / সূর্য আর ভগবানের দিকে আমি তাকাতে পারিনা’
৩. ‘সাহেবের প্রতি ভাল রঙের জামায়/ দিতে লাগলাম লোলুপ দৃষ্টি আমার/ আসলে সেই জামাগুলোতে তার পরস্ত্রী মেমসাহেবের/ চোখ দেখা যাচ্ছিল..

‘অন্ধের কবিতা কিছু’ তে শুভ অনেকটাই অন্তর্মুখী। নিজেকে গোটাচ্ছে। ভাষা মস্তিষ্কপ্রধান।প্রকাশে কিছু জল ও বাতাসের প্রবাহ, কিছুটা অসমান জীবনপিপাসা!  ‘ আমি কিছু কলকল জলতল/ভেঙে ভেঙে যাই আর সামান্য বৃষ্টি হয়ে যায়..’  কবিতার ধর্ম বলে কিছু নেই।জলের যেরকম। তরুন শুভ আঢ্য তার এই প্রথম বইটিতে কবিতাকে নানাভাবে স্পর্শ করেছে। মেধান্বিত করেছে। বইটির পড়ে আমার স্বতই মনে হল এবার ওর পরবর্তী বইয়ের জন্য অপেক্ষা শুরু করাই যায়।
………………….
ব্লেড রানার# শুভ আঢ্য # প্রকাশক-ধানসিঁড়ি # মূল্য-৯০


......................................................................
স্পার্ক অ্যাভিনিউ
..............................................................
‘Brief harp of the larch-trees,
On the spur of moss and sprouting stone
– Facade of the forest on which cloud breaks –
Counterpoint of the void in which I beleive’ (To the brother-tree of numbered Days / Rene Char)

রেনে শার কথিত “কাউন্টারপয়েন্ট অফ ভয়েড” আমি এই পংক্তিগুলোয় প্রতিসরিত হতে দেখলাম! এই দেখায় কোন অতিশয় নেই, অবসৃত লম্বা-নিশ্বাসও নেই, কারণ কবি অনিন্দ্য রায় আমায় ইমপারসোনাল পড়ায় নিয়ে গেছেন, যেখানে আমি বাধ্য বা অবাধ্য পাঠক মাত্র! এবার দেখা যাক “কাউন্টারপয়েন্ট অফ ভয়েড” ঠিক কিভাবে চারিয়ে গেলঃ
১.হেম সেলাই না হলে স্ত্রী হত
২.মুখের বানান তুলতে রুমাল ঠিকমত ভাঁজ হচ্ছে না
৩.কল্পনা থেকে ছুরি বের করে/গেঁথে রেখেছে চপ্পলতায়/হাঁটতে পারছি না
৪.গলুই দেখে মনে মাতৃসদন/অথচ গানের, সূর্যাস্তের, সন্ধির/শস্যদের আলাদা করতে পারিনি

শূন্যের মত ইতিবাচক আর কি আছে? কবি অনিন্দ্য রায় যে পরিসরে নিয়ে যান সেখানে শূন্য শুরু বা শেষে বন্দি নয়,বরং শূন্যতার পরিমার্জনায় অনিন্দ্যর কবিতা হয়ে ওঠে “কাউন্টারপয়েন্ট অফ দ্য ভয়েড” যেখানে ওই ১,২,৩,৪-এর নির্যাস ছড়িয়ে পড়ে, ব্যক্তি নিহিত হয় আশ্রয়হীন আশ্রয়ে, কাউন্টারপয়েন্টে!

অনিন্দ্য বরাবরের উদাসীন কবি! পেশায় ডাক্তার, স্বভাবে নয়, স্বভাব ওই উদাসীনতা! ভাল কবিতা বা খারাপ কবিতা’র যে প্রচলিত নিরিখ রয়েছে সেই নিরিখে আমি ওঁর কোন খারাপ কবিতা কখনো পড়িনি, অথচ কম লেখেন! নিজের লেখালিখি নিয়ে নীরব থাকেন, ২০১০-এ ওঁর একটি অসামান্য পেপারব্যাক বেরিয়েছিল ৩০ ফেব্রুয়ারি...তারপর ২০১৬...এই বই “স্পার্ক অ্যাভিনিউ”! বাংলা কবিতা এখন গান, নাটক, গল্প ইত্যাদি থেকে অনেকটাই নিষ্ক্রান্ত হয়েছে,কবিতা হয়ে চলেছে কবিতাগত ক্রমশই!

আর অনিন্দ্য নিজের কবিতাভাষা নির্মাণ করেছেন আড়ালে থেকে, এটা এখন আর বলার কোন মানেই হয়না যে কবিতা স্থানু নয়,তাই জড়ও নয়! অনুভবের একেকটা ধাক্কায় আজকের কবিরা বিষয়কে প্রয়াত করে দিচ্ছেন বা লীনাভ অংশে রেখে দিচ্ছে্ন বিষয়-বিস্ময়! অনিন্দ্য’র কবিতা শুরু হচ্ছে এইভাবেঃ
১. “মোজা ও তার কিংবদন্তী নিয়ে পাঠক্রম...”
২. “আঁধারক্যান্ডি,ঘুমকে একটু বাড়িয়ে দিচ্ছে,তানপুরাকে জাগাতে
বলে”
৩.”যে হাত হুক সামলাতে পারে না তাকে বাবা বলাচ্ছ?
৪.”দেওয়াল লিখন তখনো তরল,এক ঢোঁকে যতটা
চিরাচরিত কবিতারম্ভের কোন চিহ্ণ নেই এখানে, অনিন্দ্য রিস্ক নিয়েছেন, কারণ তাঁর কোন তাড়া ছিল না, তাঁর দুটো কেন    কোন নৌকোই ছিলনা, ফলত বাংলা কবিতাকে মনের অতিরিক্ত শূন্যে তিনি নিয়ে যেতে পেরেছেন, এটা ভাল লাগা বা মন্দ লাগার বিষয় নয়, কোন দশকসিক্ত ভাবাবেগও নয়, অনিন্দ্য তাঁর কাব্যভাষায় সময়কে বিবশ করেছেন এভাবেঃ “রাশি,ওল্টালেই রক্তের ঝিরঝির,সৌন্দর্যে ছোট একটা ডাক..” আমি পড়তে গিয়ে থেমে গিয়েছিলাম, বিস্ময়ে! এমন নিজস্বঃ আরম্ভ, কতদিন পরে,কারো কবিতায়! এই অংশটি  “গল্প হলেও সত্যি” সিরিজের! কাহিনি ফুরোতে ফুরোতে কি ভাবে কবিতা হয়ে গেল না পড়লে বোঝা যাবেনা!

দেখা যাক এই সিরিজের আরেকটি লেখাঃ
“...দেখি,যার নাম আজ রেখেছি তার বসার ভঙ্গি লোকাল।কোনো বোতামের গান।বই ভেবে বুকের পাটা খুলে ফেলি। অর্ধেক নোনতা আর বাকি উপজাতীয় আচার। ধুনোর মধ্যে চিটে রইলো দড়ি টাঙানোর ডিগ্রি। জ্যান্ত পোষাক,মেলেছ”
এখানে কবি কোন নির্দিষ্ট সীমায় নেই,আবার চমকাদৃত বহুমাত্রার হৈ হৈ তাঁর না-পসন্দ!কবিতা পাওয়ার গভীরে যে অনিয়ন্ত্রিত স্রোত-বিস্রোত থাকে, যে আবহে দেখার যাবতীয় প্রতিসরণের কারুসীমানা তৈরি করে,অনিন্দ্য কবিতা পাচ্ছে সেই গভীর অতলান্ত থেকে! যেখানে অনুভব একমাত্র পরিবাহী আর শব্দ তার অনুষঙ্গ মাত্র!

আমি রেনে শারের একটি লেখা দিয়ে এই আলোচনা শুরু করেছিলাম! শুন্যতার কাউন্টারপয়েন্টগুলোয় কবিতাই তো বিরাজমান, তো যার কাছে শুন্য এক আঙ্কিক প্রারম্ভ মাত্র তার কাছে শুন্য থাকবে ধন্য, অরন্য ,জন্য বা একটু খেলিয়ে পুরনো, দাঁড়ানো ইত্যাদি দিয়ে মেলানোর জন্য! কিন্তু মর্মভেদি কবির কাছে শুন্য হল অতিক্রমের, শুন্য হল সীমার আগল ভাঙা তেপান্তরের মাঠ...আর সেই গানটা হয়তো এখনো সেখানে বয়ে চলেছে...সেই যে “কত কি করার আছে বাকি....”

তো,অনিন্দ্য যখন লেখেনঃ”মুদ্রাটি একই,রকম।অঙ্কের পিঠ থেকে তুলে আনা গোল।তবু বোতাম একবারও রিপিট করেনি।খুলেছে প্রশ্নমালা,সামান্য সরিয়ে রাখা মাথার ঘাম।রুমাল একবার রিপিট করেনি..”
এই যে ক্রমপ্রসারিত গোল বা শূন্য এবং তার বিপুল আয়োজন কবিকে সাদৃশ্যে এনে ফেলছে,ভাবনার সাদৃশ্যে! এন্ড্রিয়ু ফিলিপ স্কটিশ কবি,জন্ম ১৯৭৫-এ!অনিন্দ্য রায় বা এন্ড্রিয়ু ফিলিপ পরস্পরের কবিতা পড়েছেন কিনা জানিনা,তবে না পড়াটাই স্বাভাবিক অথচ দুজনেই শুন্যতার কাউন্টারপয়েন্টে পায়চারি বা কবিতাচারি করছেন!পড়া যাক এন্ড্রিয়ু ফিলিপের একটি কবিতার অংশ। নাম ইনভেনশন অফ জিরো।

'What like was it
this abundant world
where nothing was not—
no neat ring
shackling us to absence,
no way not
to count or be counted—
where everything
filled without this
empty nest of a number
perched in the mind,
everything swerved..'

তবে কবিতার ভৌগলিক পার্থক্য থাকেই,আচার বা অনাচারগত ফারাক থাকবেই,তাতে ভাবনার মেলবন্ধন আটকায় না! কবির কাজ তো থেমে থাকা নয়, পুরনো কবিতার দায় নিয়েই তাকে এগোতে হয়,যেমনটা দেখি অনিন্দ্য’র এই এভিনিউ’তে! স্পার্ক লাগে আমারও!উদ্বেল হয়ে পড়িঃ
“পিঙ্ক,পাপের পয়োধি,শুধু জল দিয়ে বোঝানো যাবেনা

কল্পনা গড়িয়ে এল,অনন্তের মসৃণতায়
ঠেলে দিয়েছে কেউ;আত্মায়,অপব্যবহারে,লোভে
গুলে যেতে দেখি,ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে কামনা

প্রথম কদমটিতে ফুল ফুটে লজ্জা পেয়েছে”

পাঠক, আপনিও পড়ুন!

......................................................................
স্পার্ক অ্যাভিনিউ / অনিন্দ্য রায় / প্রকাশকঃ এখন বাংলা কবিতা’র কাগজ, জলপাইগুড়ি, মুল্য-৫০টাকা।

No comments:

Post a Comment