Sunday, March 25, 2018


আত্মস্বর কিছুতেই চাপা থাকছে না ...
প্রদীপ চক্রবর্তী 

.................................................................
দ্বিতীয় পর্ব
..................
শব্দমালা / দুই
কবিতার বই - সেলসিয়াস
কবি - পার্থসারথি ভৌমিক
প্রকাশক - ঐহিক প্রকাশনী
মূল্য - 80/ - টাকা
প্রথম প্রকাশ - কলকাতা সাহিত্য উৎসব ,ডিসেম্বর 2017
.....................................................................


প্রথমাংশ
................
কেতাবি আলোচনায় একজন কবি ,র মানসিক উপকরণের ভাব সম্পদ সে ভাবে কি ধরা যায় ? ধরা পরে তার চেতন + অধিচেতন +অবচেতন + অচেতন + নিশ্চেতন + চেতন লুপ্ত অবস্থার সুষুপ্তি + বোধ ও বোধি + মনন ও আপেক্ষিক অসংখ্য অনুভব উপসর্গের গূঢ় পর্যবেক্ষণ |একটি কবিতার উপস্থাপনার চেয়েও সেই কবিতার বিমূর্ত সংকেতগুলোর কিছু , কবি ' র নিজস্ব ঐশীকুশল শব্দপ্রয়োগের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে কি কেবল ? সাদা পাতার অবয়বে কবি লিখিত শব্দমালা কি অধিক গূঢ় অর্থকে প্রকাশ ক'রে কবি ,র অলিখিত বা না লিখিত শব্দের খেলার চেয়ে বেশি করে ?
এজরা পাউন্ড , যিনি আপন স্বরসন্ধানে শেক্সপীয়রের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন , চসার , চিনা কবিতা , ত্রুবাদুরদের রচনার দিকে | তিনি সবিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন | সেটি হলো ---- " কবি 'র শব্দ লেখার চেয়ে শব্দ না লেখার দক্ষতা কিংবা সাদা পাতার অবয়বে কবিতার অলিখিত পুননির্মাণ তার মৌলিক সৃজনের একটা বড়দিককে প্রতীয়মান করে তোলে " ....
কখনো কবিতার বৃত্ত থেকে কেন্দ্রে , কখনো কেন্দ্র থেকে বিকেন্দ্রীকরণ বা পুকুরে ছোড়া ঢিলের আঘাতে একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বৃত্ত থেকে অসংখ্য তরঙ্গ বিক্ষেপে ছড়িয়ে পড়ার যে স্পন্দমানতা , বা বিপরীতমুখী বিন্দুগুলোকে সাধিত অধ্যবসায়ে আত্তীকরণ করে তার স্তরভেদের খন্ড অখণ্ড কল্পচিত্রের সমাবেশকে ব্যপক অর্থে সংবেদী রসভোক্তার কাছে উপস্থাপিত করার যে অবিমিশ্র নিজস্বতা তার অনেকটাই দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন শূন্য দশকের কবি , পার্থসারথি ভৌমিক , তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত , '  সেলসিয়াস '  কবিতার বইটির মধ্যে দিয়ে |

দ্বিতীয়াংশ 
...................
বড়ো গোল্ডফ্লেকের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে , হান্ড্রেড পাইপার্সের গ্লাসে সোনালী চুমুক দিয়ে লঘু আলোচনায় মেতে থাকার মতো ' নিছক ' কবি নন পার্থসারথি | তিনি সারা বঙ্গের প্রতিষ্ঠিত কবিতা উৎসবে , ডাক পান না অনেকের মতোই হয়তো এবং আমোদগেঁড়ে আদার ব্যাপারী বা জাহাজিয়া হয়ে , চেয়ারের জল মোছা তল্পি বাহক ও হয়তো নন , কিন্তু তিনি লেখেন কবির জনারণ্যে , নিজের ভাবনাগুলোকে নিরীক্ষা করার জন্য একা এবং একাই | কারণ ,বিজ্ঞাপনের ভাষায় তার কবিতার স্বাদ ভাগ হয় না ,এবং মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যের উপেক্ষিত মহানায়ক চন্দ্র বণিকের মতোই , তার সপ্তডিঙ্গা মধুকর উত্তাল নদী তে ,তার নতুন কিছু করার প্রয়াসের জন্যই ,স্বখাত সলিলে ডুবে মরে ,এবং তার এতে আপত্তিও নেই | কারণ ,তার কবিতার বোধ তাকে ক্রমশ করে নিজের মুদ্রাদোষে একা | মনে হয় ,এই অভিশাপ যা হয়তো কারোর কারোরক্ষেত্রে আশীর্বাদ যেমন তার ক্ষেত্রে |
তার একান্ত প্রস্তুতির সময়সীমা কম বেশি পঁচিশ বছর | অথচ , তার প্রথম কবিতার বই , প্রকাশিত হয় , শূন্য দশকের প্রায় প্রত্যন্তে এসে , যখন তিনি ও এসে দাঁড়িয়েছেন মধ্য চল্লিশের কোঠায় | ' আমিবার ক্ষণপদ '... তার প্রথম কবিতার বই | নিজস্ব পেশার বহুরকম ব্যস্ততার মধ্যেই তার মন মুক্তি খুঁজেছে তার কাল্পনিক বিশ্বের বিচিত্র পথে ও বর্ণিল আন্তর্বিদ্যার সমাদরে | তিনি যতটা না , ' মানবীয় ট্রান্সফর্মার ' , তার চেয়েও বেশি সর্বস্পর্শী বস্তুবিশ্বের অমোঘ অস্তিত্বের প্রসারতায় | আপন স্বরান্বেষণে সদা ব্যস্ত |
তার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তার নতুন বই নিয়ে আড্ডা হচ্ছিলো | সাম্প্রত কবিতা গ্রন্থটি নিয়ে ,তার নিজস্ব জগতের নিগূঢ় ভাবনা ,আমাকে ভাবিত করলো না শুধু ,মনে হলো ,বাংলা কবিতা বস্তুবিশ্ব আর ব্যাপ্ত বিজ্ঞান এর চৌকাঠ ডিঙিয়ে কি ভাবে কবিতার আকাশকে সীমা শেষ হারা করতে পারে ....!
" সেলসিয়াস " খামোকা কেন বাংলা কবিতার বইয়ের নাম হবে ?, জাস্ট ওপর চালাকি , না গিমিক , না লোকদেখানো সস্তা প্রচার ? না কবির সত্যি কারের গভীর কোনো ভাবনা আছে এই বইটির পশ্চাতে ? আড্ডা দিতে দিতে যা কথা উঠে এলো , তা নিম্নরূপ ....
যে ভাবে TEMPERATURE - এর বাংলা " তাপমাত্রা " হয় | সে ভাবে CELSIUS - এর বাংলা " সেলসিয়াস " ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার নেই |
" সেলসিয়াস " বললে দুটো ভাবনা আমাদের মনে আসে - সেলসিয়াস স্কেল এবং ডিগ্রি সেলসিয়াস (°c )এই দুই অর্থে |

ডিগ্রি সেলসিয়াস , সেলসিয়াস স্কেলে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রাকে নির্দেশ করে এবং একইসাথে ডিগ্রি সেলসিয়াসকে দুটি তাপমাত্রার পার্থক্যকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে একক হিসেবে ব্যবহার করা হয় | যে কোনো দুটি তাপমাত্রার পার্থক্যের যে অনিশ্চিয়তা ( uncertainty ) তার নির্দিষ্টকরণের জন্যে ডিগ্রি সেলসিয়াসের ব্যবহার হয়ে থাকে | আমাদের মস্তিস্কে যেহেতু গতিশীল বৈদ্যুতিক আধান ( Electric charge in motion ) মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে , তাপগতিবিদ্যার সূত্র ( Law of Thermodynamics ) অনুযায়ী ,চিন্তন প্রক্রিয়া (Thought process ) চালু থাকাকালীন তাপের উৎপতি ঘটতে বাধ্য | যে কোনো কবি , শিল্পী যখন তার চেতনা ( consciousness ) কে আশ্রয় করে সৃজনে ব্রতী হন তখন উৎপন্ন হওয়া এই তাপ অবশ্যই পরিমাপযোগ্য | চিন্তা ও চেতনা কি ভাবে , কোথায় , কতটা সম্পর্কিত তার বিস্তারিত আলোচনার পরিসর এখানে নেই | তবে সরাসরি সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণে গিয়ে বলা যায় , একই কবি বা শিল্পীর পৃথক পৃথক কবিতার বা শিল্পের সৃষ্টির কালে তার মস্তিষ্কে পরিমাপযোগ্য তাপমাত্রা ভিন্ন হবে এবং যে কোন কবির বা শিল্পীর যে কোনো দুটি কবিতার বা দুটি শিল্পকর্মের জন্মলগ্নে কবির বা শিল্পীর মস্তিষ্কের দুটি পদ্ধতিগত ব্যবস্থা   ( systematic arrangement ) - র তাপমাত্রায় পার্থক্যের সেই অনিশ্চয়তা ( uncertainty ) কে ডিগ্রি সেলসিয়াস দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব | দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম  সেলসিয়াস রাখার ক্ষেত্রে উপরের ভাবনাটি অন্যতম |
সেলসিয়াস (CELSIUS ) শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে আমরা প্রায় উচ্চারণ করে ফেলি ' CELLS SEE US' অর্থাৎ " কোষগুলো আমাদের দেখে "|আমরা কেউই নিজেকে দেখতে পাই না | আমি অন্যকে দেখি | অন্যে আমাকে দেখে | এই ' অন্য ' , আমি মানুষ বা প্রাণী কেবল আর একজন মানুষ বা প্রাণীকে দেখি না | আমি , নিজেকে ছাড়া অন্য মানুষ , অন্য প্রাণী , উদ্ভিদ এমনকি ব্যাকটেরিয়া , ভাইরাসকেও দেখি যখন দেখা শুধুমাত্র ' দেখা ' ( To observe ) অর্থে আবদ্ধ না থেকে ' অনুভব করা ' (To Feel ) অর্থে ব্যাপ্ত হয় | তখন দু ধরণের কোষ ই ( CELL in Plural , CELLS ) ￰প্রোক্যারিওটিক ( Prokaryotic ) ও ইউক্যারিওটিক (Eukaryotic ) ￰বিচার্য হয়ে পড়ে |, তাহলে সেলসিয়াস উচ্চারণ করতে গিয়ে আমরা সৃজনের মৌলিক শর্ত , ' বিশেষ ভাবে দেখা ' আওড়ে ফেলি | এবং শুধু তাই নয় , কোষের দু ধরণের স্বরূপ সামনে আনতে গিয়ে সৃষ্টির আদি ( primitive ) ও অন্ত ( ultimate ) ধ্রুপদী শৈলীতে বেজে ওঠে | কাব্যগ্রন্থটির নামকরণের সময় এই যুক্তিকে আশ্রয় করেও খানিক অগ্রসর হয়েছেন কবি | এ ছাড়া উষ্ণতা সম্বন্ধীয় যা কিছু আমাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত , ' সেলসিয়াস ' সে - সবের  আধার হতে পারে |

পরিশেষ
...............
কোনো কোনো কবির , কয়েকটা মনে রাখার মতো পংক্তি তুলে দিলেই দায় ঝেড়ে ফেলা যায় না | স্মরণাতীত কাল ধরে আবহমান বাংলাভাষার অনেক কবি , বা আলোচক মনে করে এসেছেন , ঈশ্বর বা অজানিত শক্তির সাহায্যে ,কোন ঘোর বা অবগাহিত ভাবের তাড়নায় কবিতার মহা আবির্ভাব হয় ...! যে বিশ্বাস এবং দ্বন্দ্ব সময়ের বাঁকে বাঁকে অনেক সংশয় এবং তুমুল বিতর্ক তৈরী করেছে | একদলকবি ট্রান্স বা ভাবঘোরের কথা বলেন , ছন্দের কথা বলেন , কবিতায় অদৃশ শক্তির ঔদ্ধত্য কে মান্যতা দেন | কেউ কেউ মনে করেন স্পার্ক , কল্পচিত্র , চেতন পথের অতি চলনের ছাপ নিয়েই কবিতার চলাচল | কবিতা প্রস্তুত হয় মাথায় এবং কি ভাবে উৎস কবিতার চল ,কবিতা লিপির মধ্যে দিয়ে ধরা পড়বে ও কবিতা কি ভাবে বিনির্মিত  হবে , কি ভাবে কবিতা তার সমস্ত শক্তি নিয়ে কখনো দৃশ্য ,কখনো শ্রাব্য আবার কখনো দৃশ্য + শ্রাব্য গুনে হয়ে উঠবে নতুনতর ....| কবিতার টোটালিটি কবিতার বস্তু গুণ পাঠকের মধ্যে তৈরী করে ,তৃতীয় একটি কবিতা বা কবিতার ভাষা চল |
পার্থসারথি , এই দ্বিতীয় পথের , নতুনতর চলার ফেরারি নাবিক | একটি পুষ্ট ও পরিবর্ধিত চেতন ও অবচেতন স্পার্ক কিংবা বহুতর অবিষয়ী শব্দক্রীড়া তার অনেক কল্পদৃশ্যের সিনেম্যাটিক কোলাজ চূর্ণকে অবিমিশ্র করে | বিস্তার ঘটায় | আদিকল্প পৃথিবীর প্রাথমিক নৈঃশব্দ থেকে আজগের ভুবন গ্রামের অতি প্রাকৃতিক প্রযুক্তির পড়ন্ত আলোয় | অধরা মুসাফিরের এরোমা কফির ধোঁয়া থেকে অনিকেত ধুলোর ওপর বয়ে যাওয়া অব্যক্ত বস্তু পৃথিবীর আদি কথা ও ভবিষ্য পৃথিবীর অন্ত্যঙ্কে | অবসেশন ও মনের স্তর পেরিয়ে পেরিয়ে কবিতায় পেনিট্রেট করে এক আপন অস্তিত্বের ডিসকোর্স | কারণ এই কবির কন্টেন্ট ও টেকনিক কখনোই পপুলার ভার্স নয় | নতুন টেকনিক্যাল এক্সপ্রেশন আমাদের নিয়ে যায় সমস্ত লিগ্যাসিকে ভেঙে এক নতুন পরিক্রমায় |শূন্যের অসীমতা থেকে শিখর গুলো ডেকে ওঠে , আঁধিয়ারে ভাঙে কতো রঙ ও কুয়াশার ভাষা ...
আসুন পাঠক পার্থসারথি ভৌমিকের , সেলসিয়াস কবিতার বইটি থেকে কয়েকটি কবিতা পড়া যাক , এবার .......








No comments:

Post a Comment