Thursday, March 29, 2018

হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাক্ষণ 

সব্যসাচী ঘোষ


১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ । আনন্দজ্যোতি মজুমদারের দেওয়া তথ্য   অনুযায়ী অমিয়ভূষণ মজুমদারের পেশাগত ডাককর্মী জীবনের সময়কাল । সকালে উঠে লিখতে যাওয়া , বাজার করা শিব পুজো দিয়ে তারপর অফিস । বাড়ি ফিরে বিদেশি সাহিত্য । শৃঙ্খলিত জীবন যেন হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাক্ষণ জমিদারের মেজাজকে কিছুটা বুঝতে সাহায্য করে । সাহিত্য করতেই হবে তাই নাম কে ওয়াস্তে অফিস , অফিসের অন্দরে সাহিত্যিক জ্ঞানে বীরপূজা আদায়ের চেষ্টা। এই সংস্কৃতি সর্বকালে ছিল আছে থাকবেও। কিন্তু অমিয়ভূষণ মজুমদার নিয়ম রক্ষার দফতর করেন নি। শুধু ডাককর্মীর জীবন নয় । অরাজনৈতিক ভাবে গড়ে তোলা ডাক সংগঠনের দক্ষ সংগঠক অমিয়ভূষণ তাঁর সংগঠনের মাস্তুল ধরে তাঁকে কোন প্রকার রাজনীতির ছোঁয়াচ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন । সেই কাজে ঠোক্কর খাচ্ছেন , বেদনা আসছে । সমর্থন , অসমর্থন দুইই রয়েছে । আবার প্রতিদিন সকালে নিবিষ্ট হচ্ছেন সাহিত্যের কাজে । বিকালে জেমস জয়েস , টমাস মান । যেখানে কোনভাবেই এই বিরাট পেশাগত জীবন ও কর্মী সংগঠন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না । সমান্তরাল রেলপথ । অর্থাৎ কোথাও কোন ফাঁক নেই । ফাঁকিবাজি নেই । সবটাই নিখাদ । গঙ্গা থেকে দূরে যেখানে হিমালয়ের সানুতট । সেখানের জীবন যাত্রাতেও আড়াল আবডাল আর খাদ অনেকটাই কম । সেকারণেই কোন ভনিতা ছাড়াই অমিয়ভূষণের গল্পের চরিত্র পুরসভার ময়লা ফেলার মদ্যপ গাড়ির চালক নিজের মেয়েকেই ভোগ করে । মেয়ের গর্ভে বাবার সন্তান গর্ভস্থ হয়। কোন আড়াল ছাড়াই বাবা মেয়ে এই বিষয়ে কথা বলে । মেয়ে সন্তানের জন্ম দিতে চায় । পৃথিবীর বড় অমোঘ প্রিয়তম সন্তানটি আগুনের মত ফুটে উঠবে ওর নাম রাখবে অনল । গল্পের রেশ ধরে আলোচকেরা কোচবিহার থেকে গ্রিক পুরাণ অবধি যোগসূত্র খুঁজে পেতে থাকেন।
             আনন্দজ্যোতি জানালেন বাবা অমিয়ভূষণ ইন্দিরা গান্ধী কে শ্রদ্ধা করতেন । যারা অমিয়ভূষণ চর্চা করেন তাদের কাছে এসব তথ্য হোঁচট খাওয়ায় না, কিন্তু ভাবায় । বাম আন্দোলনের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের যে স্বাভাবিক চলন বরাবর রয়েছে তা তো তখন আরও বেশি মাত্রায় ছিল । বাংলার শিল্পী সাহিত্যিক কবি হয় নিরেপক্ষ হবে , নতুবা বামপন্থী এটাই একপ্রকারের স্বাভাবিকতা । সেখানে জরুরী অবস্থার ইন্দিরাকে সমর্থন , শ্রদ্ধা ! কেন ?  বিরুদ্ধমত তো থাকতেই পারে , ১৮০ ডিগ্রীর ওপারে অবস্থিত অমিয়ভূষণের থেকে আগে এবং পরে ডুয়ার্সের তরাই এর কোল , রাভা , মুন্ডারি , রাজবংশীদের নিয়ে যে সাহিত্য সৃষ্টি যাকে তিনি উপন্যাস বা গল্প লেখা নয় কাজ বলতেন তা তো আর কেউ সেই অর্থে করতে পারলেন না। এই কাজগুলো সাধনের জন্যে তাঁকে কখনই যে বামপন্থার চাদর পরতে হয় নি এবং তাঁর জন্যে বাংলা সাহিত্যই যে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর একটা যুক্তির ব্যাখ্যাও রয়েছে । এই যে উত্তরের লোকজীবন তাদের প্রতি অমিয়ভূষণের নিবিষ্টতা সেখানে জীবনচর্যার সঙ্গে অমিয়ভূষণের  অধিদৈবতের মিশেল একটা অদ্ভুত ইমেজারি নিয়ে আসে । বামপন্থার চেনা ফরম্যাটে থাকলে এই অধিদৈবতকে আমরা এভাবে পেতাম কি ? ২০০০ সালে অমিয়ভূষণকে শিলিগুড়ি জারনালিস্ট ক্লাবের উদ্যোগে কাঞ্চনজঙ্ঘা সম্মান প্রদান করা হয় । রাজ্যের ততকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আসেন সেখানে । মহিষকুড়ার স্রষ্টাকে তাঁর হাত দিয়েই সম্মান প্রদান করা হয় । সম্মান গ্রহণের পর বক্তৃতা করতে গিয়ে অমিয়ভূষণ জানান প্রিয় কবির ভ্রাতুষ্পুত্রের থেকে সম্মান গ্রহণ করে তাঁর ভাল লাগছে। অনুষ্ঠানের পর পরই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এনিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। বামপন্থী সুকান্ত কি সত্যিই অমিয়ভূষণের প্রিয় কবি ? নাকি শুধুই মন্ত্রীকে খুশি করার জন্যে নেহাত কথার কথা বলেছিলেন । অমিয়ভূষণ কিন্তু এমন প্রশ্নের জন্যে তৈরিই ছিলেন তাই সুকান্তের মতাদর্শ নয় তাঁর নির্মাণকে ভাষার সম্পদ বলেই দীর্ঘকাল ধরে মানতেন তিনি । অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বামপন্থা অমিয়ভূষণের কাছে কোনই প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।
সুতরাং এই মানুষটিকে নিয়ে সমস্যা সত্যিই অনেক । ছক নেই তাই ছকে ফেলা যাচ্ছে না  , লেখক কি বলতে চেয়েছেন জাতীয় দিগদর্শন মিলছে না । তাই সমস্যা বিষম , “ কে এই অমিয়ভুষণ পত্র-পত্রিকায় অদীক্ষিত পাঠককুল সঙ্গতভাবেই এই কলমচিকে প্রশ্ন করতে পারেন – কে এই অমিয়ভুষণ  ? তাঁকে খেতে হয় বা মাথায় দিয়ে শুতে হয় ? এই লোকটিকে নিয়ে ঝামেলা বিস্তর । ইনি তারাশংকর – বিভূতিভূষণ – মানিক – সতীনাথের মতো তর্কাতীত স্থায়িত্বের অধিকারী নন । কমলকুমার মজুমদারের মতো লেখকদের লেখক নন । নন সমরেশ বসু – বিমল কর – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মারকাটারি লিখিয়ে। ”  (প্রবন্ধ – অমিয়ভুষণ , অমিতাভ দাশগুপ্ত , বৈতানিক )
তাঁর উপন্যাস বিন্যাস তাই নিজস্ব খেয়ালে চলে , সকলের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে এগিয়ে যায় , , “আমি তাড়িত হ’য়ে লিখি না । আষাঢ় এসে পৌছলে ধূলিকণা থেকে পর্বতচূড়া তৃণদল থেকে মহীরুহে পরিবর্তন এসে এক নতুন পৃথিবী হয়। আবার ফাল্গুন চৈত্রে অনায়াসে যেন অদৃশ্যভাবে বিনাশ্রমে অন্য পৃথিবী । কারো তাগিদ নেই কারো চেষ্টা নেই । ঘটে যাচ্ছে । আমার এক উপন্যাসের পরে অন্য উপন্যাস এমনি ব্যাপার । ” দলবিচ্ছিন্ন কমরুনের সঙ্গে জুটে যাওয়া কিছু বছরের ছোট আসফাকের জঙ্গলে জঙ্গলে ভ্রমণ । শিকার , ডাহুক পুড়িয়ে খাওয়া । কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে ম্যারিনেট করা মাছ । মহিষকুড়ার উপকথার এসব বেঁচে থাকা আমাদের কাছে ডিসকভারি চ্যানেলের বেয়ার গ্রিল থেকে কোন অংশে কম কি ?                        

No comments:

Post a Comment